#পুরুষসিংহ #কুণালশেখর
অপরাহ্ন বেলায় নিজের শাহী খেমে তে বিষণ্ন চিত্তে একাকী বসেছিলেন শাহজাদা সুজা। খানসামারা চেষ্টা করছে তাঁর মন ভালো করবার। শাহী বাওয়র্চি বানিয়ে আনছে দিল খুশ করা লজিজ সব খানা। খুবসুরত বাইজিরা তাদের কলা প্রদর্শনে প্রস্তুত। কিন্তু কিছুই ভালো লাগছেনা তাঁর। বাঙলার সুবাহদার তিনি। অথচ সামান্য একটা বাঙালী রাজাকে কিছুতেই বশে আনতে পারছেন না! কি লজ্জা কি লজ্জা।
চেষ্টার কসুর করেননি শাহসুজা। সৈন্যদের নিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন গড়। কিন্তু কি শয়তানী বুদ্ধি এই বাঙালী জাতটার। দুর্গ ঘিরে গভীর পরিখা কেটে রেখেছে। আর নগরের সাতটা বিশাল বিশাল দীঘিতে বাঁধ দিয়ে এমন কায়দা করে রেখেছে যে বাঁধ খুলে দিলেই প্রবল বেগে জলরাশি এসে ভরিয়ে দেবে পরিখাগুলো। শুকনো পরিখা পার করতে গিয়ে শাহজাদার চোখের সামনে নিমেষের মধ্যে জলে ভেসে গেল অর্ধেক সৈন্য। অগত্যা পিছু ফিরতে বাধ্য হলেন তিনি। সেই দুর্দশার কথা ভেবে মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে শাহসুজার। এরকম চললে দিল্লীতে আব্বা হুজুরকে মুখ দেখাবেন কি করে? সামান্য এক রাজাকে যদি তিনি বাগে আনতে না পারেন তাহলে ভবিষ্যতে শাহেনশাহ-ই-হিন্দ হবার দাবিতে নিজেকে প্রতিপন্ন করবেন কিভাবে?
সময়টা ১৬৪৮ এর আশেপাশে। হিন্দুস্তানে তখন মুঘল হুকুমৎ চলছে। দিল্লীর তখতে বিরাজমান বাদশা শাহজাহান। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহজাদা সুজাকে বাঙলার সুবাহদার হিসেবে মনোনীত করলেন তিনি। আজকের ভাষায় যাকে বলে গভর্নর। আজ হয়তো বাঙলা বলতে অধুনা পশ্চিমবঙ্গকেই বুঝবেন সবাই। কিন্তু তখন বাংলা বলতে বোঝাত আজকের সমগ্র বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্য। নিজ ক্ষমতাবলে একে একে বাংলার সব রাজা, নবাব, জমিদারদের মুঘল সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিবর্তিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন শাহসুজা। জাহাঙ্গীর নগরকে (বর্তমানে ঢাকা) করেছিলেন তাঁর শাসন কার্যের কেন্দ্রস্থল। দিল্লীতে নজরানা পাঠাচ্ছিলেন নিয়মিত। কিন্তু হোঁচট খেলেন এক ছোট্ট রাজ্যে এসে। হ্যাঁ দিল্লীর সাম্রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্য খুবই ছোট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেশ বড়ই ছিল এ রাজ্যের পরিধি। পূর্বে হুগলী থেকে পশ্চিমে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল এবং বীরভূমের কিয়দংশ এবং উত্তরে ঝাড়খন্ড থেকে দক্ষিণে তমলুক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্যের সীমানা।
মল্ল সাম্রাজ্য। ধলভূম, সিংভূম, বীরভূম, মানভূম, বরাভূম, তুঙ্গভূম, সামন্তভূম এবং মল্লভূম এই আটটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল তৎকালীন মল্ল সাম্রাজ্য। ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা আদিমল্ল প্রতিষ্ঠা করেন মল্ল রাজবংশের। কালে কালে যত দিন গিয়েছে মল্ল সাম্রাজ্যের পরিধি এবং শৌর্য ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই মল্ল সাম্রাজ্যের রাজধানী বিষ্ণুপুর আক্রমন করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন শাহসুজা। বিষ্ণুপুর রাজ রঘুনাথ মল্লদেবের চতুর রণকৌশলের সামনে পরাস্ত হতে হয়েছে তাঁকে। খোয়াতে হয়েছে বহু সৈন্য এবং অশ্ব। বিহিত চাই এর। অবিলম্বে বিহিত চাই।
সালাম শাহজাদা। ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ল শাহসুজার। মুখ তুলে তাকাতে রক্ষী জানালো বর্ধমান রাজ এসেছেন। শাহজাদার সাক্ষাৎপ্রার্থী তিনি।
ভেতরে পাঠাও। হুকুম করলেন শাহসুজা। এই বর্ধমানের রাজাটাকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না। ভারী ধূর্ত এবং কুটিল লোকটা। চোখের চাহনিতেই বোঝা যায় মনে মনে সারাক্ষন শয়তানী প্যাঁচ কষছে।
বন্দেগী হুজুর। আভূমি সেলাম করে দাঁড়ালেন বর্ধমান রাজ। যিনি নিজের সমস্ত স্বত্তা বিকিয়ে দিয়েছেন মুঘলদের কাছে। পরাধীনতায় তার আপত্তি নেই। আর যাই হোক বন্দী হয়ে কারাগারে তো নেই তিনি। বিলাস বৈভবে বেশ ভালোই আছেন। সময়মতো দিল্লীর শাহী খাজানা দিয়ে দিচ্ছেন। শাহসুজার নেক নজরে আছেন।
-কি সমাচার বর্ধমান রাজ?
-হুজুর খবর গুরুতর। গোপনে খবর পেয়েছি কাল সন্ধ্যাবেলায় রঘুমল্ল জঙ্গলের পথ দিয়ে যাজি গ্রামে যাবে। এই মওকায় যদি আপনার সেনারা তাকে ঘিরে ফেলে তবে পালাতে পথ পাবেনা রঘুমল্ল।
চোখ জ্বলে উঠল শাহসুজার। এইবার হ্যাঁ এইবার তিনি দেখে নেবেন রঘুমল্লকে। এই সুযোগ। গোপনে কিছুক্ষন শলা পরামর্শ হল দুজনের মধ্যে। তারপর প্রস্থান করলেন বর্ধমান রাজ।
পরদিন সন্ধ্যার কিছুপূর্বে দেখা গেল জঙ্গলের পথ দিয়ে ছোট্ট একটা শোভাযাত্রা চলেছে। অগ্রভাগে রয়েছেন স্বয়ং মহারাজ রঘুনাথ মল্লদেব। তিনি নিরস্ত্র। তাঁর পরিধানে ভক্তের বেশ। সাথে কয়েকজন কীর্তনিয়া। তারা নামগান করছে। আর রয়েছে গুটিকতক সেপাই। মহারাজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তারা।
অন্ধকার নেমে আসছে। আচমকাই আশে পাশের গাছগুলো থেকে ঝুপঝাপ করে কিছু মানুষ লাফিয়ে নামতে লাগল। পোশাক দেখে বোঝা গেল তারা সৈন্য।
থমকে গেল শোভাযাত্রা। মহারাজ গর্জন করে উঠলেন কে তোমরা? কি চাও?
সৈন্যদের আড়াল থেকে কুটিল হাসি নিয়ে বেরিয়ে এলো বর্ধমান রাজ। রঘুমল্লের কাছে এসে বলল তোমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে চাই আমার প্রভুর কাছে।
প্রভু! ক্ষোভে হুঙ্কার দিলেন রঘুমল্ল। লজ্জা করেনা তোমার? এক বিধর্মীর কাছে নিজের মান সম্মান বিকিয়ে বসে আছ?
মল্ল সেনারা তরবারি বার করে রুখে দাঁড়াল। প্রাণ থাকতে তারা বন্দি হতে দেবেনা মহারাজ কে।
কিন্তু বর্ধমান রাজ অতীব কুটিল। তার চোখের ইশারায় মুঘল সেনারা চকিতে কীর্তনিয়াদের গলায় ঠেকালো শানিত তরবারি।
এইবার মহারাজ? তুমি যদি আমাদের সাথে যেতে না চাও তাহলে এদের মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী হবে।
শঙ্কিত হন রঘুমল্ল। মনে মনে রাজ বংশের কুলদেবী মৃন্ময়ীকে ডাকেন- হে মা মৃন্ময়ী এ তুমি কোন ধর্মসঙ্কটে ফেললে মা গো? কিন্তু পরক্ষনেই সিদ্ধান্ত নেন স্বেচ্ছায় বন্দি হবার। নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য কিছুতেই নিরপরাধ কীর্তনিয়াদের মৃত্যমুখে ঠেলে দিতে পারেন না তিনি। নিজের রক্ষীদের নিরস্ত হতে আদেশ দেন।
মুঘল সৈন্যরা শৃঙ্খলাবদ্ধ করল রঘুমল্লর দুই হস্ত। মহা উল্লাসে তাঁকে বন্দী করে নিয়ে চলল বর্ধমান রাজ।
তাঁকে নিয়ে আসা হল মুঘল শিবিরে। নিক্ষেপ করা হলো কারাকক্ষে। বর্ধমান রাজ ছুটলেন শাহসুজাকে খবর দিতে।
খবর পেয়ে প্রকৃতই খুশি হলেন শাহসুজা। এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ভরা চর্মবটিকা ছুঁড়ে দিলেন বর্ধমান রাজের দিকে। খুশিমনে বিদায় নিলো ষড়যন্ত্রী।
রাত্রে আহারের পর শয়ন করেছেন শাহসুজা। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। বারবার খালি একটা কথাই মনে হচ্ছে, এটা কাপুরুষোচিত কাজ হয়েছে। তিনি মুঘল বাঙলার সুবাহদার। হিন্দুস্তানের বাদশা শাহজাহান তাঁর ওয়ালিদ। নিজ বাহুবলে যথেষ্ট বলীয়ান তিনি। সেই তিনি কিনা ছলে বলে বন্দি করলেন এক রাজাকে? তাও আবার নিরস্ত্র অবস্থায়? নাহ কাজটা ঠিক হয়নি। ক্ষনিকের উত্তেজনাবশে বর্ধমানরাজের কথায় সায় দেওয়া উচিৎ হয়নি।
পরদিন প্রত্যুষে সবে ফজরের সালাত আদাহ করে উঠেছেন শাহসুজা এমন সময় রক্ষী এসে জানাল বিষ্ণুপুর রাজ অপমান করেছেন মুঘল সৈন্যদল কে।
- কি বলেছে সে?
- জ্বি প্রতিদিনের মতোই আজও নতুন ঘোড়াটিকে পোষ মানাবার জন্য ময়দানে নিয়ে গিয়েছিলেন সিপাহসালার। কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলেননা দুরন্ত আরবী ঘোড়াটিকে। কারাকক্ষের জানালা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে রঘুমল্ল বিদ্রুপ করেন এই বলে যে তোমাদের শাহজাদার সৈন্যদল সামান্য একটা অশ্বকে পোষ মানাতে পারছে না। আর সেই অপদার্থ সৈন্যদের নিয়ে তিনি কিনা বিষ্ণুপুর অধিকারের স্বপ্ন দেখছেন?
ক্রোধে আরক্ত হয়ে উঠল শাহজাদার মুখ। এতবড় স্পর্ধা লোকটার? মুঘল সেনাদের নিয়ে বিদ্রুপ? আর সিপাহসালার কে বিদ্রুপ করা মানে সেটা প্রকারান্তরে শাহজাদাকেই বিদ্রুপ করা।
রাগে গনগনিয়ে তখনই কারাকক্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন শাহসুজা।
রঘুমল্লর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন-
তুমি জানো ওই অশ্বটি কত দুরন্ত? সবে মাত্র আনা হয়েছে বন্য অশ্বটি কে। এ পর্যন্ত অনেকেই চেষ্টা করেছে ওর পিঠে আহরণ করবার। কিন্তু কেও সক্ষম হয়নি। বরং দুজন প্রাণ হারিয়েছে।
দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলেন রঘুমল্ল - যতই দুরন্ত হোক না কেন আদতে তো সে অশ্বই। মানুষের কাছে তার ক্ষমতা কতটুকু? আপনার সিপাহসালার অশ্ব পোষ মানাতে জানে না শাহজাদা।
-বটে! এত অহংকার তোমার? নিজেকে এত বীর ভাবো তুমি? বেশ তোমাকে আমি সুযোগ দিলাম। যাও ওই অশ্বটির পৃষ্ঠে আহরণ করে দেখাও। দেখি কত তোমার হিম্মৎ।
শিকল খুলে দেওয়া হল রঘুমল্লর। দুরন্ত অশ্বটিকে দুইজন সেপাই ধরে আনল রঘুমল্লের সামনে।
প্রকান্ড অশ্ব। ভয়ানক তার ক্রোধ। তার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষনিকের জন্য বুক কেঁপে গেল রঘুমল্লর। মনকে শক্ত করে ভক্তি ভরে মা মৃন্ময়ীর নাম নিলেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে অশ্বের ঘাড়ে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। যেন জাদুর মত কাজ হল। হাতের স্পর্শে অশ্বটি কিঞ্চিৎ শান্ত হল। নাক দিয়ে আওয়াজ করল মৃদু। ঘাড় নামিয়ে দিল নিচে। মৃণ্ময়ীকে স্মরণ করে এক লাফে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন রঘুমল্ল। তাঁকে নিয়ে দুরন্ত অশ্ব নিমেষে ধুলো উড়িয়ে চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল।
সকাল থেকে হল দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। সকলেই বলাবলি করছে ওই অশ্ব নিশ্চয় পথেই কোথাও রঘুমল্লকে পিঠ থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে। ওর পিঠে বসে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব না। হয়তো বা পতনের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে রঘুমল্লের।
শেষ বিকেলে দেখা গেল একটা ধুলোর ঝড় ছুটে আসছে। মহারাজ রঘুনাথ মল্লদেব ফিরে আসছেন। সকলে সবিস্ময়ে দেখল মহারাজ বিলকুল ঠিক আছেন। তাঁর শরীরে না আছে কোন ক্ষত না আছে অশ্ব থেকে পতনের কোন চিহ্ন। শিবির প্রাঙ্গনে ঢুকে ঘোড়া থেকে নামলেন মহারাজ রঘুমল্ল। এগিয়ে গেলেন বাকরুদ্ধ শাহজাদার কাছে। দৃপ্ত কন্ঠে বললেন নিন শাহজাদা। আপনার অশ্ব এখন সম্পূর্ন তৈরী।
অভিভূত হয়ে গেলেন শাহসুজা। রঘুমল্লকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন সাবাশ মহারাজ। ধন্য আপনি। ধন্য আপনার দুর্জয় সাহস আর পৌরুষ। আপনি চাইলে অনায়াসে ওই অশ্ব নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে আপনি আবার ফিরে এসেছেন আমার কাছে। আপনি যথার্থই পুরুষ সিংহ। তাই আজ থেকে আপনি রঘুনাথ মল্লদেব নন। রঘুনাথ সিংহদেব। আর আপনার মল্লরাজ্য চিরদিন স্বাধীন রাজ্য* হিসেবেই স্বীকৃত থাকবে।
★১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার দেওয়ানী লাভের আগে পর্যন্ত বিষ্ণুপুর একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।
◆ শব্দকোষ-
শাহী=রাজকীয়; খেমে=তাঁবু; খানসামা=ভৃত্য;
বাওয়র্চি=রাঁধুনি; লজিজ=সুস্বাদু;
শাহেনশাহ-ই-হিন্দ=হিন্দুস্তানের বাদশা;
তখত=সিংহাসন; ওয়ালিদ=পিতা;
ফজরের সালাত আদাহ=ভোরের নমাজ পাঠ; সিপাহসালার=সেনাধ্যক্ষ
©