চটিটা পায়ের তুলনায় একটু বড় - তা একাধিকবার লক্ষ্য করলেও খেয়াল থাকেনা । দুটো সিঁড়ি এগিয়ে উঠতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যাথা লাগায় হঠাৎ ভয় হল বছর দশেক আগের পায়ের আঘাতটা নিয়ে । সেই সময়টায় যদিও ভিজে মাটিতে পা পিছলে যাবার সম্ভবনা কম ছিল, কারন আশ্বাস ছিল যে পিছলে গেলেও কোথাও একটা চেনা সুরে কতগুলো লাইন ভেসে উঠত “Pick Yourself up and dust yourself off and back in the saddle” ।
স্কুলে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে চূড়ান্ত তর্কবিতর্ক । “আমি বলছি তো, যে দল প্রথম ম্যাচ হারে সে কোনদিন কাপ পায়নি, এবারেও পাবেনা” - এরম অদ্ভুত যুক্তি খাড়া করে আমি বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলাম যে স্পেন এবারের বিশ্বকাপ কিছুতেই জিততে পারবে না, বরং বিশ্বকাপের সবচেয়ে ধারাবাহিক ভাল টিম জার্মানি এবারে কাপ নেবেই । ঝগড়া চলতে চলতেই ক্লাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ম্যাডাম এসে উপস্থিত হয়ে গেছেন - তা খেয়াল পড়েনি । আধ-ঘুমন্ত চোখ তখনও লাল, দেখি ম্যাডাম হাসছেন । এটাই বোধহয় ফুটবলের আত্মা - কঠিন থেকে কঠিনতর মানুষকেও পালটে দেয় ।
ফ্রিজে সামান্য বরফ ছিল - এর মধ্যে কোনদিন ভাল হুইস্কি পেলে কাজে লাগবে - এই ভেবেই রাখা । গামছায় মুঠো করে হাঁটুতে লাগাতে লাগাতে দুঃখ পেলাম - পায়ের গঠন একই রকম আছে এখনও, শুধু মনের গঠনটা অনেক পালটে গেছে, নয়ত বয়স কিছুই হয়নি, যে প্রৌঢ়সুলভ ভঙ্গিমায় বলতে হবে - “এখন কি আর পায়ের সেই জোর আছে?” এই প্রশ্ন গুলো আসলে স্টেটমেন্ট, প্রশ্ন চিহ্নটা ইনভার্টেড কমার পর দিতে হয়, আর জিজ্ঞেস করতে হয় নিজেকে যে এরম সহজ পলায়নবাদী হওয়া কি স্পোর্টসম্যানশিপ?
প্রশ্নের উত্তর কেউ না দিতে পারায় স্যারের খুব ক্ষেপে যাবার কথা ছিল, কিন্তু তিনিও হঠাৎ সত্যাগ্রহের ইতিহাস ছেড়ে হন্ডুরাস এবং এল সাল্ভাডরের ফুটবল ওয়ার নিয়ে বেশ খোশমেজাজে গল্প ধরলেন - আফটার অল, ওই তিনদিনের যুদ্ধও তো ১৯৪৫ পরবর্তী পৃথিবীর এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়, যদিও দেশ দুটি কোন মহাদেশের তা আমরা বাড়ি এসে অ্যাটলাস খুলে জানতে পেড়েছিলাম । স্যারের বাড়ির ছাদে ঝোলানো ছিল আর্জেন্টিনার বড় পতাকা । একবার বলেছিলেন - “ফুটবল কোনও খেলা নয়, এটা একটা ধর্ম” ।
সাঁতার করে সেদিন পা-টা লক্ষ্য করছিলাম - বেশ ভাল অবস্থায় আছে । আঘাতের সেই ব্যাথা নেই, ত্রাস নেই । কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে মাঠে একটু ফুটবল খেলার কথা ভাবছিলাম। সাইকেল চালিয়ে কয়েক কিলোমিটার আসাযাওয়া করলে যেকোনো দুর্বলতা এমনিই ভাল হয়ে যায়, আর সাথে যদি ফুটবল এসে জুড়ে, তাহলে তো বিবেকানন্দের স্বপ্নে দেখা আদর্শ বাঙালি যুবক । জার্মানি ফ্রান্সকে হারিয়ে দেওয়ায় পরের ম্যাচে কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি - সাদাকালো টিভিতে দেখা ২০০২ চোখের সামনে ভেসে উঠল ।
যে আমি টিভির মুখোমুখি হইনা, সেও লকডাউনে বাবার পাশে বসলাম খবর দেখতে । হাঁটুটা কালচে নীল রঙ ধরেছে । বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথাও খেলা দেখাচ্ছে কিনা । এক মুহূর্তের মধ্যে মনে হয় ভুলে গেছিলাম, হয়ত ইচ্ছা করেই, যে এখন মাঠ গুলোয় মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে না - অন্যান্য প্রাণী তাদের হারানো সাম্রাজ্য পুনর্দখল করছে একে একে । মানুষের সাম্রাজ্য কি তাহলে থমকে গেল? এত হাজার বছরের প্রগতি, ওষুধপত্র সব বৃথা? এল ক্লাসিকো বা কলকাতা ডার্বি কি তাহলে শুধু অনলাইনে স্ট্রিম করা মাল্টিপ্লেয়ারে সীমাবদ্ধ হবে? “এখন কোথায় খেলা হবে?” বাবার কথায় এসব অমূলক অবান্তর চিন্তা মাথা থেকে বের করলাম ।
সকালে চিন্তা করছিলাম, আজ স্যারের মুখটা দেখার মত হবে । স্কুলের গেটে ঢোকা মাত্র ছেলেদের মুখে একটাই আলোচনা - ভাই আর্জেন্টিনা কে তো পরপর চারটে দিয়ে দিল রে! এবারে কাপ জার্মানি ছাড়া আর কারোর চান্স নেই । কিন্তু স্যারকে ক্ষেপানো গেল না - তিনি বিকারহীন মুখ করে বললেন - “জার্মানি আমার দ্বিতীয় ফেভারিট দল, দারুণ খেলেছে”। এভাবে আবেগকে চেপে সত্যিকে স্বীকার করার স্ট্র্যাটেজি আজ অব্দি রপ্ত হল না ।
পরস্পর সাতটা - ডিফেন্স বলে কিচ্ছু ছিলনা ব্রাজিলের দলটায় । বেলো হরিজন্তের কয়েক অযুত মানুষ অবিশ্বাস্য চোখে একটা দলের স্ট্র্যাটেজি দেখে গেল । তখনও আমি হোয়াটসঅ্যাপ শুরু করিনি - ফেসবুকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাত অনেক হয়ে গেল - পরেরদিন সাঁতার কামাই দিলাম । গানের লাইন কানে ভেসে আসল - “When I get older, I will be stronger” - আর চোখে ভেসে বেরাল মিরাস্লভ ক্লোজে আর বাস্তিয়ান শ্বাইনস্তাইগার - এই দুটো চেহারা । খুব ভালভাবেই জানতাম যে এই বিশ্বকাপের পর এরম অন্তত আরও বেশ কিছু নাম এই দাই মানশ্বাফ্ট থেকে অবসর নেবেন । এদের সামনে তখন মাত্র আরেক প্রতিপক্ষ অপেক্ষারত - লিওনেল মেসি এবং আমাদের স্কুলের স্যারের প্রিয় দল ।
ফুটবল ঈশ্বরের আত্মা - এরম একটা কথা শুনেছিলাম - কারণ ফুটবল স্বাধীনতা এনে দেয় - “just like the wavin’ flag”। সেদিন স্কুল কামাই করব করব করেও করা হল না । ঠিক যেরম আট বছর পর একদিন আড্ডায় যাবনা যাবনা করেও গেছিলাম । স্যারের সাথে দেখা হতে বললেন - “আরে সেমিফাইনাল অব্দি যাওয়া টাই কম ব্যাপার নাকি?” আসলে স্যার নিজেও জানতেন না চাঁদে দ্বিতীয় পা কে রেখেছিলেন । সেই বন্ধু এসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলো - “তা ভাই প্রথম ম্যাচে হেরে ফাইনালে যাওয়া গেছে - এরম ইতিহাস তোর বইতে নেই?” । হজম করলাম । আট বছর পর এরম আরও একটা ওষুধ হজম করতে হয়েছে - দক্ষিণ কোরিয়া ২০০২ এর বদলা নিয়ে ফেলল, আর জার্মানি গ্রুপের শেষে থেকে বিশ্বকাপ থেকে বেরিয়ে গেল ।
কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম মদ কিনতে । ফেরার সময় এক পরিত্যক্ত বাগানে দেখলাম ছেলেরা লকডাউন অমান্য করে ফুটবল খেলছে । পায়ে বেশ বেথা ছিল - সামান্য দূরত্ব সাইকেল করে যাওয়া সম্ভব হল না - একজনের বাইকে চেপে যেতে হয়েছিল । ফিরতে ফিরতে বন্ধুটা জিজ্ঞেস করেছিল - “ভাই তুই তো ব্রাহ্মণ, তাও পৈতে রাখিস না, তাই না?” ঘাড় নাড়লাম । সব ধর্মই এখন অসহায় - একমাত্র পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম লকডাউন অমান্য করে মাঠে দৌড়ে বেরাচ্ছে, দাপিয়ে যাচ্ছে - সেই ধর্মের নাম ফুটবল ।