আমাদের দেশে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানী "বেচে খাওয়ার" থুড়ি "সরকার চালানোর" পর্ব চলছে।
আসলে শুধু সরকার চালানো নয়, নানারকম বিশ্বভ্রমণ, কর্পোরেট ছাড়, ব্যাংক তছরূপ করে ভেগে-যাওয়াদের ক্ষতি সামলানো, অস্ত্র কেনার "কমিশন" থুড়ি ভুঁইফোড় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অস্ত্র কিনে গুণাগার দেওয়া, প্রমোটরদের ঘুরপথে অর্থ-সাহায্য.... আরো কত কি!!! এর পাশাপাশি "কালোটাকা" উদ্ধার হবে বলে বাজনা বাজিয়ে, নোট বাতিল করে দেশের মানুষকে চূড়ান্ত কষ্টের মুখে দাঁড় করিয়ে অর্থনীতির গতি কমিয়ে দেওয়ার চাপও সামলাতে হচ্ছে।
গত আর্থিক বছরে এইরকম বেচে-টেচে কামানো গেছিল ৮৭ হাজার কোটি টাকা। এই বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকা। যেসব সংস্থা বেচে দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়েছে, তারমধ্যে "লাভজনক" সংস্থাও আছে বলে সরকার নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে।
কিন্তু এরমধ্যে গত ছয়মাসে বিক্রী-বাট্টা ভালো হয়নি। বেচে কামানো গেছে, মাত্তর আঠারো হাজার কোটি।
[[** এবারের বাজেটের হিসেব অনুযায়ী শেষ অবধি বিক্রি হয়েছে মাত্তর ১৮ হাজার কোটি, গতবারের থেকে অনেকটাই কম। এইবারে লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে হল ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি!!]]
তাই আরো নতুন নতুন সংস্থা, লাভজনক সংস্থাকে বিক্রীর তালিকায় ঢোকাতে হচ্ছে! যেমন ভারত পেট্রোলিয়াম। দিব্যি লাভজনক, প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের সময় থেকে শোনা যাচ্ছিলো বিক্রী হবে হবে... সৌদি-সংস্থা "আরামকো"র সঙ্গে দরদাম নিয়ে কথাবার্তা পাকা করে ফেলেছেন তিনি। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে, আমেরিকায় রাস্তায় নেচে নেচে তেল-কোম্পানী বিক্রী হবে, দাম উঠবে বেশী!! কি হবে শেষপর্যন্ত জানা নেই। প্রসঙ্গত: এই "আরামকো"র কাছেই কিছুদিন আগে রিলায়েন্স-সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দামী সংস্থা "রিলায়েন্স পেট্রোকেমিক্যাল"-এর কুড়ি শতাংশ শেয়ার বেচেছে বড় আম্বানিরা। "মহাজনো গতো সে পন্থা!"
সে যাক, আদার ব্যবসায় থাকলেও একটু জাহাজের খোঁজখবরে যাওয়া যাক।
দুটো তালিকা আছে, একটা ফোর্বসের, "গ্লোবাল ২০০০", আর একটা "ফরচুন ৫০০"! বড় বড় কোম্পানীর ক্রমতালিকা। গত বছর প্রথম লিস্টিতে, প্রথম পাঁচটি কোম্পানীর তিনটিই চীনের, তিনটিই ব্যাংক। প্রথম স্থানে যে ব্যাংকটি সেটি গত সাতবছর ধরে নাকি এক নম্বরে। এগুলো সবই রাষ্ট্রায়ত্ত। আর দ্বিতীয় লিস্টিতে সার্ভিস-সেক্টরকে আলোচনায় আনা হয়না... সেই লিস্টিতেও প্রথম পাঁচের মধ্যে তিনটি চীনের, একটি বিদ্যুৎ-উৎপাদন সংস্থা, আর দুটি তেল ও গ্যাস কোম্পানী। তিনটিই রাষ্ট্রায়ত্ত।
আসলে এইসব কথাবার্তার কোনো অর্থই নেই। আমাদের দেশে এক ধরনের লোক আছে, যাদের সামনে "চীন"-এর নাম উচ্চারণ করলেই বুক 'চিন চিন' করতে থাকে। যারা উচ্চারণ করে, তাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণের মত গুনগুনিয়ে ওঠে "দালাল" ইত্যাদি শব্দের রাশি। তা হোক। অসুবিধে নেই। বামপন্থী না সমাজবাদী না বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী না একদম "দো-আঁশলা পুঁজিবাদের" ঢং-এ চীন এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছেছে তাই নিয়ে কোনো বিতর্ক করবার ইচ্ছা নেই! কিন্তু পৌঁছেছে একটা উচ্চতায়, তাই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
একটা হিসেব দিই। "ফোর্বস" পত্রিকা ২০০৩ সাল থেকে এই "গ্লোবাল ২০০০"-এর তালিকা প্রকাশ করছে। প্রথম বছরে এতে আমেরিকান সংস্থার সংখ্যা ছিল ৭৭৬, আর এই বছরে ৫৭৫। অন্যদিকে প্রথম বছরে চীনা (হংকং সহ) সংস্থার সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৩, আর এই বছরে ৩০৯। এর একটি বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত। প্রসঙ্গত: এই বছরে ভারতীয় সংস্থার সংখ্যা ৫৭, তারমধ্যে ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত। হয়তো কিছুই বোঝা গেল না, তবু কিছু কি বোঝা গেল??!!
বিলগ্নিকরণ বা বেসরকারিকরণের নতুন নতুন ধারা আমদানি করা হচ্ছে এদেশে। যেমন ধরুন, বিমানবন্দর। একটা একটা করে তুলে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারী হাতে (নিন্দুকেরা বলছে বেশী বরাত পাচ্ছে "আদানি"রাই)! ইদানিং "ট্রেন" বেসরকারিকরণের ধারাও শুরু হয়েছে।
[[**এই বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১০০টি বিমানবন্দর, ১৫০টি বেসরকারী ট্রেন।]]
আবার কিছু লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানীর ক্ষেত্রে ঠিক হয়েছে, তাদের ৫০ শতাংশের বেশী শেয়ার সরকার নিজের হাতে রেখে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বে থাকবে না। ২০ থেকে ৩৫ বা ৪০ শতাংশের মত শেয়ার হাতে রেখে বাকীটা বিক্রি করে দেওয়া হবে, তাতে যতটা কর্তৃত্ব থাকবে, তাতেই সরকার সন্তুষ্ট।
এইভাবে অতি সম্প্রতি যে পাঁচটি সংস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তারমধ্যে দুটি বিদ্যুৎ প্রকল্প। এদের সব শেয়ারই আবার অন্য দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থা কিনে নেবে। কিন্তু অন্য তিনটির নির্দিষ্ট পরিমান শেয়ার বিক্রী করা হবে। সবগুলি লাভজনক।
আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাজের সংকোচন করা হচ্ছে। যেমন জাতীয় সড়ক কর্পোরেশন। অর্থবরাদ্দ কমানো হয়েছে।
************************************************************************************************************************
সেসব কথা যাক। আমি এখানে আলোচনা করতে চাইছি একটি নির্দিষ্ট ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিয়ে, যার সাথে আমার নিজেরও একটি আবেগের যোগ আছে।
১৯৫৬ সালে তৈরী হওয়া এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির মোট সম্পদের পরিমাণ ৩১ লক্ষ কোটি টাকার বেশী (আমেরিকান ডলারে ৪৫০ বিলিয়ন প্রায়)। সংস্থার সরাসরি কর্মচারীর সংখ্যা এক লাখ বারো হাজারের মত, আর এর সাথে যুক্ত কমিশন এজেন্টের সংখ্যা প্রায় পনেরো লক্ষের কাছাকাছি।
নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন সংস্থাটির নাম। হ্যাঁ, অবশ্যই ভারতীয় জীবন বীমা নিগম, "এলআইসি" নামে এক কথায় সবাই চেনে।
আচ্ছা, এত সব কথার পরে "এলআইসি"কে নিয়ে পরলাম কেনো?? এর কারণ, এই সংস্থার ইতিহাস, জাতীয় উন্নয়ণে অবদান ইত্যাদির পাশাপাশি কিভাবে সরকারী নীতি বা নীতিহীনতার চাপের মধ্যে দিয়ে একে এগোতে হয়, বা হচ্ছে, তার আকর্ষণীয় বিবরণী আছে যা অনেকেরই অজানা।
১৯৫৬ সালে ২৩৫টি বেসরকারি বীমা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডকে একজোট করে তৈরী হয়েছিল এই সংস্থা। আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে, সারাদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। একটা সময়ের পর থেকে জাতীয় পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদি দেশের নানা বিষয়ে অর্থসাহায্য এসেছে এই সংস্থার কাছ থেকে। প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে নির্দিষ্ট অর্থ সাহায্য করেছে "এলআইসি", শেষ তিনটিতে এক লক্ষ কোটি বা তার বেশী।
**************************************************************************************************************************
এই অবধি লিখেছিলাম মাস দেড় দুই আগে। আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করা হয়নি।
এরই মধ্যে এসে গেলো এই বছরের বাজেট, "বাজেট ২০২০"। প্রথম দিকে খুব একটা কৌতূহল দেখাইনি। পরে হঠাৎ করে খেয়াল করে দেখি, বলা হয়েছে "এলআইসি"র ক্ষেত্রে সরকার নিজের অংশের কিছুটা IPO-এর মাধ্যমে বেচে দেবে।
এমন আশঙ্কা যে ছিলনা তা নয়, বস্তুত: সেরকম আশঙ্কা থেকেই এই লেখাটি শুরু করেছিলাম।
কিন্তু সংশয় জাগলো অন্যখানে। সেটা হচ্ছে, "এলআইসি"তে সরকারের অংশীদারিত্ব ঠিক কতটা??
আসলে "এলআইসি" ছিল বা বলা ভালো এখনো হচ্ছে, সরকারের "সোনার ডিম দেওয়া হাঁস"। যত্রতত্র, যেকোনো অর্থনৈতিক অসহায় অবস্থা কাটাতে বা দায়বদ্ধতা পূরণে এদের কাছ থেকে সরকার নানা সময়ে হাজার, লক্ষ কোটি টাকা নিয়েছে, বারেবারে। এমন একটি হাঁসকে কেটে খেয়ে ফেললে তার ডিম দেওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়া হয়, এই যুক্তিতে "এলআইসি" বেঁচে গেলেও যেতে পারে, এমনটা মনে হয়েছিল। কিন্তু, এখন দেখছি সরকারের "মতিভ্রম" ষোল আনাই হয়েছে! কিংবা হয়তো দেউলিয়াপনার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আর ফেরার পথ নেই!!
কিন্তু, কতটা বেচে দেবে?? "অংশ"ই বা কতটা?? এইসব নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করা হয় নি। শোনা যাচ্ছে, ১৯৫৬ সালের "এলআইসি অ্যাক্ট" না পাল্টালে নাকি বিক্রী-বাট্টা শুরু হওয়া অত সহজ নয়।
কিন্তু, মুস্কিল অন্য জায়গায়। এই দেশে বীমা প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তার অন্যতম কারণ হল, আয়কর ছাড়ের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা। এইবারে নতুন ধরনের (এখনো ঐচ্ছিক) "করব্যবস্থা"র প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে এইধরনের ছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু করা হচ্ছে।
এটা আগামীদিনে "আবশ্যিক" হবে বলেই মনে হয়। সেইদিক দিয়ে জীবনবিমার চাহিদা, কর-ছাড়সহ "সঞ্চয়ের" একটি পদ্ধতি হিসেবে হ্রাস পাবে, পাবেই পাবে। অর্থাৎ "আয়" ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং , হাঁসটিকে শুধু মারা নয়, মারার আগে "জখম" করার প্রচেষ্টাও জারি আছে।
এককথায় বলা যায়, সবসময়েই দেশের উন্নতির সাথী, একটি অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান "এলআইসি"কে আজ অনিশ্চিত অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কোটি কোটি গ্রাহক, কয়েক লক্ষ এজেন্ট ও তাদের পরিবার, লাখের বেশী কর্মচারী ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যতের কথা আদৌ মাথায় না রেখে।
****************************************************************************************************************************
আমার বাবা এক বছর হল মারা গিয়েছেন।
১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের পাবনা থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে জলপাইগুড়ি শহরে এসে উনি জীবিকার জন্য একটি বেসরকারী বীমা কোম্পানিতে চাকরী নেন। নাম "হিন্দুস্থান ইন্সুরেন্স", ১৯৫৬ সালে সেই সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত "এলআইসি"র সাথে মিশে যায়।
তারপর থেকে ১৯৮৯ সাল অবধি চাকরী করার পরে অবসর নেন। তবু ৯০ বছর বয়সে মারা যাবার আগে অবধি তার জীবন ছিল "এলআইসি"ময়। প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত খবর রাখতেন। চাকরী জীবনে এবং পরেও বীমা কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
আজ উনি নেই, থাকলে খুবই মর্মাহত হতেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনের কথা বলতেন যাতে এই "অবিমৃষ্যকরিতা" বন্ধ করা যায় কোনোভাবে।
শুনছি, বীমা কর্মচারী সমিতি আন্দোলনে নামবে দেশ জুড়ে এজেন্টদের নিয়ে, সম্ভব হলে গ্রাহকদেরও সঙ্গে নিয়ে। এই আন্দোলনের সাফল্য কামনা করি।