এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • গল্প নয়

    Lattu Da লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ২৪৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Lattu Da | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১২:৪৭728016
  • "স্কুল পালানো ছেলে"
    ঊনিশশো চুয়ান্ন সাল। উন্নয়ন পরিষদ প্রাইমারি স্কুলে মেজদি নিয়ে গিয়ে ইনফ্যান্ট এ ভর্তি করেছিলো। সাড়ে পাচ
    বছর বয়স। দেখতে দেখতে বছরের শেষে ক্লাস ওয়ান এ উঠলাম। তখন বন্ধুবান্ধব বেড়েছে। প্রথম বছরের মতো স্কলে যাবার অনীহা কেটে গেছে। এখন খেয়েদেয়ে বইপত্তর নিয়ে আগেভাগেই স্কুলে যাই। সাড়ে দশটা থেকে স্কুল। দশটা নাগাদ স্কুলে পৌঁছে গেছি। নানা রকম খেলাধুলো চলছে। মার্বেল খেলা,লাট্টু খেলা, মেয়েদের এক্কাদোক্কা। নিখিল স্কুল লাগোয়া একটা খেজুর গাছে উঠছে। এমন সময় আমার ক্লাসেরই রাখালের সংগে শুরু হলো তুমুল লড়াই। তখন ঘুষো ঘুষি কম হতো। কুস্তা কুস্তি বেশী। রাখাল বয়সে উচ্চতায় শক্তিতেও আমার চাইতে দর। আমি রোগাপটকা ছোট্টখাট্টো। রাখাল আমার বুকের উপর চেপে বসে হাত দুটো চেপে ধরে আছে। দর্শকরা মজা দেখছে। রাখালের বন্ধুরা রাখালের পক্ষে আমার বন্ধুরা আমার পক্ষে চিৎকার করছে। লড়াই মঞ্চঃস্কুলের পাশের ব্রিটিশ আমলের এবড়ো খেবড়ো পিচের রাস্তা। রাখাল বুকের উপর চেপে বসা-হঠাৎ মাথায় এলো বাঁচার উপায় মরিয়া বুদ্ধি। বিদ্যুৎ গতিতে আমার পা দুটো রাখালের গলার কাছে এনে সজোরে জোড়া পায়ে লাথি চালালাম। রাখাল চিত হয়ে পিচ রাস্তায় ছিটকে পড়লো। রাস্তার পাথরে লেগে ওর মাথা ফেটে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। রক্ত দেখেই ভয়ে আমি ফাসির আসামি হয়ে গেলাম। পাশে রাখা বই খাতার ব্যাগ নিয়ে ভোঁ দৌড়। মানিক মাস্টার মশাই এর লিক লিকে বেত! মাথায় উঠলো স্কুল করা। আমি আদাড়েবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।সেকালে স্কুল ইউনিফর্ম ছিলোনা। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে মেয়েরা যেমন সাধ্য পোষাকেই স্কুলে যেতো। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। পেটে চুই চুই ক্ষিধে নিয়ে মুখ চুন করে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়িতে শুধু মা আর ছোট্ট লাল্টু ঘুমোচ্ছে। মা আমাকে দেখেই বলে উঠলো, "কিরে স্কুলে যাস নাই? তাইলে কই গেছিলি? সারাদিন টই টই কইরা ঘুইরা আইলি?" আমি রাখালের সংগে লড়াই -রাখালের আমার বুকে চেপে বসা-দুপায়ে ওর গলায় লাথি ছিটকে ফেলা-রাখালের মাথা ফাটা-থেকে স্কুল পালানো সব খুলে বলার পর বললাম, "মা কাল থেইকা আমি আর ওই স্কুলে যামুনা। তাইলে মাণিক
    মাস্টার মশাই আমারে ব্যাত দিয়া পিটাইতে পিটাইতে মাইরা
    ফালাইবো!" মানিক মাস্টার মশাইর পিটানোর সুখ্যাতি মায়ের অজ্ঞাত ছিলোনা। মা তারপর খেতে দিলেন।
    আমার শুরু হলো স্কুলছুট স্বাধীন জীবন। একদম তাইরে নাইরে না। সারাদিন টইটই করে ঘোরা। সকাল সন্ধায় যখন
    মেজদি বাড়িতে ওয়ানের 'সহজ পাঠ' নিয়ে পড়াশুনো করতাম
    সাথে লেখালেখি ও। মেজদি মাকে বলতো, "মা লাট্টু কে স্কুলে পাঠাইবানা?" মা বিষণ্ণ সুরে বলতো, "দ্যাখ বিমল, রোগা পাৎলা পোলাটা স্কুলে গ্যালে রাখাইলাও মারবো,আবার মানিক মাস্টারের ব্যাত কি কইরা পাঠাই স্কুলে ক' দেখি?"
    দিন দশেক বাদে। সেটা রবিবার। হঠাৎ মাণিক মাস্টার
    মশাই আমাদের বাড়িতে হাজির। মেজদি মেজদা কে পাঠিয়ে
    আমাকে ডেকে আনালো। আমি ঢুকতেই মেজদি ইশারায় প্রণাম করতে বললো। আমি ঢিপ করে প্রণাম করতেই মাস্টার
    হেসে মাথায় হাত রেখে বললেন,"আলেকজান্ডার আর পুরুর যুদ্ধে পুরু হারেনি-রাখালই তোমার বুকে চেপে বসেছিলো-তুমি
    বাঁচতে গিয়ে ওর গলায় লাথি মেরেছো-ওর মাথা ফেটেছে -তাই বলে ভয়ে তুমি স্কুল যাওয়া ছেড়ে দেবে? পালিয়ে বেড়াবে?
    মনে থাকে যেন কাল থেকে তুমি স্কুলে যাবে!" মাস্টার মশাই মেজদিকেও বলে দিলেন, "বিমল, কাল থেকে ভাইকে স্কুলে পাঠাবে। ও কিন্তু পড়াশুনোয় খুব ভালো!" পরদিন থেকে ফের স্কুল শুরু। রাখাল কুদে এলেও কেউ ওকে বলেছিলো,"রাখাল ওকে কিছু বলতে যাসনা, মাণিক মাস্টার মশাই কিন্তু ওকে বাড়ি গিয়ে ডেকে স্কুলে এনেছে, মনে রাখিস!" শুনেই রাখালের বুঝি মনে পড়ে যায় লিক লিকে বেতের কথা। রাখাল চুপ। মাণিক মাস্টার মশাইর কথা আজও আমি শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করি। আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে। ছোট্ট একটা স্কুলছুট
    ছাত্রের প্রতি তার আন্তরিকতা ছিলো সাগরের মতো সুগভীর আর আকাশের সীমাহীন!!!
  • Lattu Da | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৩:৪১728017
  • "ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে"

    বছর কয়েক আগের কথা। টিক সন্ধ্যা ছ'টা বাজে বাজে। ফ্ল্যাটের ডোর বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলেই দেখি বীণা।
    -এতো আগে, আজ কি ব্যাপার?
    -না না দাদা আজ রান্না করতে আসবো না বউদিকে বলে দেবেন!
    -কারণ?
    -বীণা যা বললো,"আমার এক বান্ধবীর আজ রাত্রেই হঠাৎ বিয়ের ঠিক হলো। রাত দশটায় লগ্ন। আমাকে ভালো শাড়ী-ব্লাউজ-সায়া নিয়ে যেতে হবে।

    ওই মেয়ের আগে বিয়ে হয়ে ছিলো। বছর না ঘুরতে স্বামীর দুর্ঘটনায় মৃত্যু। স্বামীখাকি মেয়ের ঠাই হলোনা শ্বশুর বাড়িতে। অধিকার অর্জনের মামলা মোকদ্দমা করার মুরোদ ছিলনা মেয়ের। ফিরে এলো দাদার বাড়িতে। বাপ-মা মরা মেয়ের দাদা-বউদির বাড়িতেও ঠাই হলোনা। শেষে ঠাই হলো মামার বাড়িতে। শত হলেও আপন দিদির অসহায় কন্যাকে মামা ফেলতে পারলেন না। মামী প্রথমে গাঁইগুই করলেও চতুরা মহিলা বুঝলেন-বিনে মাইনের পেটে ভাতে ঝি হয়ে থাকলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। মামা কিন্তু কাজের মেয়েও রেখেছেন। কিন্তু মামী, মামার অসাক্ষাতে মানসিক অত্যাচারের রোলার চালাতো। মামার নজরেও পড়তো মাঝে মাঝে। মামা অনেক ঘটক দেখলেন। ফোন নম্বর দিলেন। কিন্তু কোন ঘটকই বিধবা পাত্রীর ব্যাপারে ততো উৎসাহী নয়। বিদ্যাসাগর যতোই বিধবাবিবাহ প্রচলন করে থাকুন - সে প্রথা এখনো এদেশে জনপ্রিয়তা পায়নি। আজও সবাই অনূঢ়া কন্যাই খোঁজে, বিধবা নৈব নৈব চ:।
    আজ রাত্রেই আমার বান্ধবীর মামাকে ঘটকের জরুরী ফোন "মেয়ে বিয়ে দিতে চাইলে এক্ষুনি মেয়ে পাঠাও!" আসলে সেই ঘটকের পছন্দ পাত্র। বর যাত্রী সহ বিয়ে করতে এসে শোনে, বিউটি পার্লার এ যাবার নাম করে পাত্রী প্রেমিকের পক্ষীরাজ বাইকে চেপে উধাও। কোন কালী মন্দিরে গিয়ে বিয়ে সেরেছে। পাত্রপক্ষ এবার ঘটকের গলা টিপে ধরেছে, কেমন মেয়ে দেখালে? মেয়ে চাই যেনতেনপ্রকারে। বিয়ে করতে এসে বউ ছাড়া ফিরে গেলে পাড়ায় মুখ দেখাবে কিকরে?! তাই এতো জরুরী ফোন ঘটকের। ওদের মেয়ে চাই-রূপটুপ বিধবা কুমারী কিছুই বিচার্য নয়।

    বীণা ফিরে গেলো। আমি রান্নার তোর জোড় শুরু করলাম। রান্না প্রায় শেষ।এবার গিন্নি ফিরে এলো স্কুল থেকে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো
    - এ কী তুমি রাঁধছ?
    - বীণা গেছে "ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে"এর কনে নিয়ে বিয়ে বাড়ি। রাতে রাঁধতে আসবেনা।

    গিন্নি তখন বাকি রান্নার ভার নিজের হাতে তুলে নিলো। পরদিন রাতে। বীণা রান্না করতে এলে ওর কাছে ঘটনার উপসংহার শুনলাম। বিয়ে হলো। পাড়াপড়শির চাপে -পার্লার পালানো কন্যার পিতা ওখানেই, ওই বাসরেই বরকনের বিয়ে দিলেন। বরযাত্রীরা সব খেলো। রান্নাবান্না তো ছিলোই। পুরুত নাপিত মজুত ছিলেন।কন্যা সম্প্রদান করলেন কনের মামা। যতো এয়োতি কাজ, মালা বদল, শুভদৃষ্টি, বাসর জাগা কিছুই বাদ গেলো না। পাড়াপড়শি রাও পাতপেড়ে খেলো। একেই তো বলে,"ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে", কার যে কার সংগে কোথায় আর কবে কখন বিয়ে হবে - সেটা বোধহয় প্রজাপতি ব্রহ্মাই জানেন।

    বছর দু'ই বাদে একদিন বীণাকে জিজ্ঞেস করলাম,"হ্যা বীণা তোমার সেই বান্ধবী কেমন আছে?"
    - বীণা বললো তোফা আছে স্বামী এক ছেলে নিয়ে সুখে ঘর সংসার করছে!" মনে হলো,"মধুরেণসমাপয়েৎ!"।
  • Lattu Da | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৩:৪৪728018
  • "জীবনের কত পাতা ছিঁড়ে গেলে পাগল হওয়া যায়।"

    আজও ভুলিনি ওকে। খুব মনে পড়ে। আমি তখন কলকাতায় কর্মরত। রোজ অফিস যাবার সময় দেখতাম-লোকটা পথের
    ধারে বসে আছে। মাথায় উসকোখুসকো চুল। যে চুল গুলো এ জীবনে তেল-সাবান বা চিরুনির ছোঁয়া পায় নি। শরীরে শতচ্ছিন্ন ন্যাতা জড়ানো। কিন্তু চোখ দু'টো ভারী উজ্জ্বল! লোকটা একটা খবরেরকাগজ কুচি কুচি করে ছিঁড়তো। পরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খবর পড়তো। পড়া হলে সেই চ্ছিন্ন কাগজ গুলো জুড়বার চেষ্টা করতো -আর কিছুতেই যেন মেলাতে পারতোনা।

    আমার মনে হতো, বেচারার পুরো জীবনটাই যেন ছেঁড়া কাগজের মতো চ্ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। তাই ছেঁড়া কাগজ জুড়ে
    জুড়ে জীবনকে জীবনকে জুড়বার ব্যর্থ প্রয়াস। যেন ওর "জীবনের গল্পের" খেই খুঁজে বেড়াচ্ছে-কিন্তু খেই খুঁজে পাচ্ছেনা। পথের গাড়ি ঘোড়া লোকজন যাবতীয় সব কিছুর প্রতি চরম ঔদাসীন্য! নিবিষ্ট মনে ছেঁড়া কাগজের মধ্যেই জীবনকে জোড়ার চেষ্টা? নাকি জীবনের মানে খুঁজে বেড়ান জানিনা । ওঁকে দেখে মনে পড়ে যেত বব ডিলানের গান " কত খানি পথ চললে পরে মানুষ হওয়া যায় "। আর ভাবতাম জীবনের কত গুলো পাতা ছিঁড়ে গেলে পাগল হওয়া যায়। প্রতিনিয়তই তো আমাদের জীবন থেকে কত পাতা খসে যায়।
  • Lattu Da | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৪:০৯728019
  • "চোখের তারায় ব্যথার ছবি "

    ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর। দু'হাজার পনেরো। আমাদের বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষ। আমার জন্মভিটে দেখলাম। পঞ্চান্ন প্যারী দাস রোড বাংলা বাজারে।বাড়িটা আজো অক্ষত। গিন্নির জন্মভিটে দৌলত পুর। জন্ম ভিটে আর নেই। আছে অনেক অনেক পরিচিত লোকজন! তাদের কী সীমাহীন আন্তরিকতা! মুগ্ধ হয়ে গেলাম! সব দেখা শেষ।এবার ফেরার পালা। ভাইপো যাদব, স্বপ্না,পূজাকে ডেকে বলে-তিনজনে ওদের ফ্ল্যাট থেকে নাবলাম। গেটে এসে মাণিক কে ডাকলাম। মানিক গেট খুলে দিলো। ছেলে মানিক কে একশো টাকা দিলো। মানিক খুব খুশি! তিন জনে হাটতে হাটতে তাতীবাজার তেঁ মাথায় এলাম।ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। রিকশা নেই। এক সি.এন.জি. ড্রাইভার মতিঝিল যেতে দু'শো টাকা হাকলো। এক ভদ্রলোক বললেন,"দাদা,বাসে উঠে মতিঝিলের কাছাকাছি নাবুন, ওখান থেকে রিকশা বা সি.এন.জি. সুবিধা হবে!" সংগে সংগে একটা ফাকা বাসে তিনজনে চাপলাম। ভাড়া দশটাকা।ফাকা রাস্তা কালকের মতো যানজট নেই।

    খানিক বাদেই মতিঝিলের কাছাকাছি এসে নাবলাম। এক সি.এন.জি. হাকলো দেরশো টাকা। একশো টাকায় অন্য সি.এন.জি.ধরে মতিঝিল স্ট্যান্ডে এলাম। ঈগল বাসে চাপলাম।আমাদের সিট পেছনের দিকে।'আই'-'থ্রি' আর 'জে'-'থ্রি'-'ফোর'। তিনজনে সিটে বসলাম। বাস ছাড়লো। কিন্তু ভীষণ গয়ংগচ্ছ চাল!একজন যাত্রী যেই হম্বিতম্বি শুরু করলো,"গোরুর গাড়ি না লোকাল বাস?" অমনি সমস্ত যাত্রী যারা বেনাপোল যাবে এক সংগে ফুঁসে উঠলো,"বাস ঠিক ঠাক চালাবে না অন্য কিছু করবো?" যাত্রী বিক্ষোভ ম্যাজিকের মতো কাজ করলো! সত্যি বাস দ্রুত বেগে ছুটে চললো। কোন স্টপেজ এ বাস থামলেই কতোনা হকার নানান পসরা জানালা দিয়ে বিক্রি করছে। গিন্নি বিশ টাকা দিয়ে কদবেল কিন্তু কাচা ফেলে দিতে হলো।ছেলে জানালা থেকে তিনটা কাঠি গোজা ফোটা ফুলের মতো করে কাটা ঝাল নুন মাখানো বিলিতি আমড়া কিনলো।কাঁচামিঠা বিলিতি আমড়া খুব স্বাদে খেলাম! বাস সাভার আসতেই পুরো বাস ভরে গেলো। এবার কিন্তু বাস দুরন্ত গতিতে ছুটে চললো। পাটরিয়া ঘাটে এসে আমরা বাস সমেত স্টিমারে উঠলাম।ওপাড়ে গোয়ালন্দ ঘাট। ছেলে আমাদের দ'জনকে বাস থেকে নাবিয়ে নিতে নিতে বললো,"চলো মা বাসে বসে থেকে কি হবে?স্টিমারটা ঘুরে ঘুরে দেখি! "আমরা দু'জনে ছেলের পিছু পিছু বাস থেকে নাবলাম। ছেলে অনেক ছবি তুললো। আমিও আমার ট্যাব এ অনেক ছবি তুললাম। স্টিমারের দোতালার ক্যান্টিন এও গেলাম। ওখানেও অনেক ছবি তুললাম।

    এবার স্টিমারে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে চাপলাম। এবার স্টিমার ছাড়লো। সামনে অকূলদরিয়ার পদ্মা। স্টিমার অনেকক্ষণ বাদে পদ্মা পাড় করে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে ভিড়লো। বাস এবার স্টিমারের কোল ছেড়ে রাজ পথে উঠলো। নদীর ধারে যতো ঘর বাড়ি সব টিনের- চালায় টিন দেয়ালেও টিন। কোথাও ইটে গাথা দালানবাড়ি নেই। বোধ হয় নদীর ভাঙনে -টিন বাচানো যাবে পাকা বাড়ি তো পুরোই নদীগর্ভএ তলিয়ে যাবে। বাস দ্রুত ছুটছে। বরংগিল পার হয়ে গেলো। বাস ঢুকছে ফরিদপুর -দেখতে দেখতেই পাড় হয়ে গেলো মাগুরা। আমাদের বাঁ দিকের সিট 'আই' 'ওয়ান'-'টু' তে প্রৌর দম্পতি বসে আছেন। ভদ্রমহিলা গিন্নিকে বললেন,"আপনাদের ছেলে? আপনারা ভাগ্যবান! কী ভাবে মা-বাবার দেখভাল করছে! আমাদের সে ভাগ্য নেই!" গিন্নি বললো, "ছেলেই আমাদের জন্মভিটে দেখাতে বাংলা দেশে এনেছিলো এখন ফিরছি। অনেকে বলে বিয়ের পরেও এই মনটা থাকলেই ভাগ্যবান!" ভদ্রমহিলা এবার দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠেন,"খনার বচন জানেন? উঠন্তি মূলা পত্তনি তে চেনা যায় -আমাদের দুই ছেলে চাকরি পর ও কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি -এমনকি কাছের থেকে কাছে দক্ষিণেশ্বর এও না এখন বিয়ের পর একজন আমেরিকায় একজন মুম্বাই ঘোরানো দুরের কথা দেখাও করেনা।আর দিদি মনে রাখবেন যারা বদলাবার নয়- তারা বিয়ের পরে কেন, সারা জীবনেও বদলায় না!" আমি ভদ্রমহিলার ম্লান দু'টো চোখের তারায় একরাশ ব্যথার ছবি ফুটে উঠতে দেখলাম!
  • Lattu Da | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৪:১৯728020
  • "একেই তো বলে মানবিকতা"

    ঈগল বাস। বাংলা দেশের ঢাকার মতিঝিলে বাসে উঠলাম। সেবাস ঈগলের মতো উড়তে উড়তে নয়-অনেক ধুকতে ধুকতে - অনেক উজান উজিয়ে বেনা পোল বর্ডার থেকে অনেকটা দূরে এসে থামলো। তখন ভর দুপুর। মাথার উপর সুর্যের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর! কন্ডাকটর বললো,"বাস আর যাবেনা, পুলিশ ঢুকতে দেয়না"। যাবার সময় কিন্তু বেনাপোল বর্ডার থেকেই বাসে উঠেছিলাম। সি.এন.জি.চাপতে হয়নি।এখন সি.এন.জি.চাপতে হবে। এটা বাস আর সি.এন.জি. র আতাত নয়তো? আমরা তিন জন বাস থেকে মালপত্তর নিয়ে নাবলাম। মালপত্তর বলতে তিনটে ট্রলি ব্যাগ আর আমার সাইডব্যাগ। তাতে বাংলাদেশের কোন মালই ছিলোনা। এখন ভারত থেকেই বাংলা দেশে মাল যায়।বাংলাদেশ থেকে ভারতে কিছুই আসেনা। সি.এন.জি.চালকরা বাসের চার দিক ঘিরে আছে। হাকছে বর্ডার বর্ডার! বাসের যাত্রীরা সব সেদিকেই ছুটছে।
    এমন সময় এক বৃদ্ধ মুসলিম ভ্যান চালক-কাতর কন্ঠে অনুনয়ের সুরে বলতে লাগলো,"আপনারা সবাই সি.এন.জি.তে গেলে আমরা খাবো কি? আমাদের ক্ষিধে নেই? আমাদের পেট নেই? যা খুশি ভাড়া দিন তবু ভ্যানে চাপুন!" সবার তাড়া কেউ ভ্যানে চাপছেনা। সবাই ছুটছে সি.এন.জি. ধরতে। ভ্যান চালকের বিলাপ শুধুই অরন্যে রোদন ভ্যানে একজন ও বসলো না। ছেলের কি মনে হলো বললো,"বাবা, চলো ভ্যানে যাই। ছেলে সব গুলো ব্যাগ ভ্যানে রাখলো। গিন্নি বললো,"এই ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ভ্যানে?আর সময় তাওতো বেশী লাগবে!" ছেলে বললো,"কি হবে ভ্যান চললে আর রোদ লাগবেনা - তুমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বোসো!"ছেলের কথা মা কি ফেলতে পারে? অগত্যা ভ্যান এই সবাই চাপলাম।
    আমিতো ছেলের মনটা পড়ে ফেললাম। ভ্যানে একজনও লোক বসেনি -তাই ভ্যান চালকের প্রতি ছেলের মন সহানুভূতিতে আদ্র। প্রচন্ড রোদের মধ্যেও কোত্থেকে একরাশ মেঘ এসে সুর্যকে ঢেকে দিলো। সেটা কি বিধাতার ভ্যান চালকের প্রতি করুণায় না আমাদের প্রতি করুণায় বুঝতে পারলামনা।হয়তো উভয় এর প্রততি করুণায়। ভ্যান চলছে। পাশ দিয়ে সি.এন.জি. গুলো দ্রুত বেগে বেড়িয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে পাঁচিলএ বিগত নির্বাচন এর পোস্টার। ভ্যান চলছে বাংলা দেশের যশোর রোড ধরে। পিচ ঢালা মসৃণ পথ। ভ্যানচালক যথা সম্ভব জোড়ে চালাবার চেষ্টা করছে আর গল গল করে ঘামছে। ছেলে বলে উঠলো, " দাদা অতো চালাবার কোন দরকার নেই। আমাদের তেমন তাড়া নেই।আস্তে চালান!"
    বাংলা দেশের কাস্টমস অফিসের কাছে ভ্যান থেকে নাবলাম।ছেলে বললো,"কতো টাকা দেবো?" ভ্যান চালক বললো,"তিন জন পনেরো টাকাই দিন। আপনাদের থেকে বেশী নেবো না। কেউ তো আমার ভ্যানে চাপলো না শুধু আপনারাই চাপলেন!" ছেলে ভ্যান চালকের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিলো। ভ্যানচালক বললো,"দাদা খুচরো দিন সকাল থেকে এক টাকাও ভাড়া খাটিনি সবই তো সি.এন.জি. শালারা নিয়ে যায় আমাদের কপালে জোটে ছিটেফোঁটা! " ছেলে বলে উঠলো, "কিছুই ফেরাতে হবেনা" গরিব ভ্যান চালক আনন্দে আপ্লুত! টাকাটা কপালে ঠেকিয়ে বার বার বলতে লাগলো," আল্লা তালা আপনাদের মঙ্গল করুণ! "

    আমি অবাক হলাম! আনন্দ ও পেলাম! ছেলের মানবিকতা দেখে! এই ছেলে দমদম এয়ার পোর্টে রিকশা ভাগিয়ে দিয়েছিলো পঞ্চাশ মিটার যেতে পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিলো বলে। ভারী ব্যাগ কাঁধে তুলে হেটেই এয়ার পোর্টে চলে গিয়েছিলো। আর আজ হেলায় পনেরো টাকার বদলে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলো! একেই তো বলে মানবিকতা!
  • Du | 182.58.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ২১:৪০728021
  • ভালো লাগছে আপনার অভিজ্ঞতার কথা পড়তে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন