এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আমার ভাইফোঁটা

    tania
    অন্যান্য | ১৩ নভেম্বর ২০১৫ | ১৫৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • tania | 165.57.***.*** | ১৩ নভেম্বর ২০১৫ ২৩:৫১688048
  • ভাইফোঁটা এমন একটা পার্বন যেটা আমি চিরকাল সাইডলাইন থেকেই দেখে গেলাম। অথচ ভাইফোঁটা নিয়ে যতটা হইচই হওয়া উচিত, আমাদের বাড়িতে ততটাই হত। শুধু আমাকে বাদ দিয়ে।

    আমাদের ভাইফোঁটা হত দুদিন ধরে। প্রতিপদে বাবার বাড়ির দিকের ফোঁটা আর দ্বিতীয়ায় মা'র বাড়ির দিকের। প্রতিপদের দিন সক্কাক সক্কাল গুডুয়া (মানে আমার ঠাকুমার ভাই) এক বড়সড় ভাঁড় রসগোল্লা নিয়ে ধবধবে ধুতি পান্জাবী পরে আমাদের বাড়ি এসে যেত। তারো আগে বাপি নানা রকম মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আমি হয়ত তখনও মশাড়ির ভেতর গড়াচ্ছি। গুডুয়া এসে গেলেই আমার সেই মৌতাতের ফর্দাফাঁই। তখনও বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছে করত না। তাই চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে শুয়ে দেখতাম ঠাকুমা মেঝেতে আসন (নিজের বানানো) পেতে থালা সাজিয়ে গুডুয়াকে বসাচ্ছে। তারপর মন্ত্র পড়ে ফোঁটা।

    ঢাক বাজে ঢোল বাজে স্বর্গে বাজে কাড়া
    আজ হইতে ভাই তুমি না যাইয়ো যমপাড়া
    যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
    আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা
    যমুনার ফোঁটা পাইয়া যম অমর
    আমার ফোঁটা পাইয়া আমার ভাই অমর
    যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
    আইজ হইতে ভাই তুমি নিম তিতা নিম তিতা নিম তিতা!

    প্রথমে ঘি, তারপর চন্দন তারওপরে কাজলের। তারপর চামচে করে দই খাওয়ানো। মা পাশে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাত। সেসব হয়ে গেলে থালা ভর্তি মিষ্টি গুডুয়ার হাতে তুলে দিত। গুডুয়া বলত, রাখ, আগে তোরে নমস্কার করি। ঠাকুমা মাথায় হাত রেখে বলত, আশির্বাদ করি সামনের বছর য্যান তোরে আর ফোঁটা নিতে আইতে না হয় (মানে নিজের মৃত্যু কামনা)। এটা ওদের দুজনের একটা স্ট্যানডার্ড জোক ছিল। তারপর মিষ্টি খেতে খেতে আড্ডা। ওদিকে জলখাবার রেডি, লুচি, তরকারি আর ভাজা মিষ্টি। ব্যস, প্রথম পর্ব সমাপ্ত।

    তারপর স্নান টান সেরে নতুন জামা পরে আমরা তিনজনে বেরোতাম। বেরোনোর আগে বাপি চোদ্দবার শাড়ির প্যাকেটটা নেবার কথা মনে করিয়ে দিত। গন্তব্য গুডুয়ার বাড়ি। ওখানে দুপুরে নেমন্তন্ন। বাপি আর কাকামনিকে ফোঁটা দিত মুন্নিপিসি। সেদিন আরও অনেক পাড়াতুতো ভাইরা ফোঁটা নিত মুন্নিপিসির কাছে। কিন্তু বাপি যেহেতু বড়দা, তাই বাপি সবার আগে। এখানেও আমার জায়্গা সেই খাটের ওপর। বসে বসে দেখতাম আর মনে মনে মনখারাপ করতাম। অবশ্য গুডুয়া আমাকে বলত তুই আমারে ফোঁটা দে। কিন্তু আমার বয়ে গেছে। একে তো দাদা আর দাদু এক নয়। তার ওপর গুডুয়ার ফোঁটা তো অলরেডি হয়ে গেছে সকালে। সেকেন্ড হবার কোনো মানেই হয়না। তাই আমার ঐ খাটে বসে বসেই দেখা। তারপর জম্পেশ খাওয়া দাওয়া।মাংস, চাটনি আর পায়েস থাকবেই থাকবে। শেষে পান। দুপুরে প্রচুর আড্ডা মেরে, বিকেলে চা আর নিমকি খেয়ে বাড়ি। অথঃ দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত।

    পরের দিন ঠাকুমা উপোস করে সকালে আখ, দুধ আরও কি কি দিয়ে চরু রান্না করত। গুডুয়া উপোস করে এসে সেই চরু খেত। ঠাকুমাও তার পর খেত। প্রতিপদের ফোঁটা খেয়েই হত। এদিন আমিষ হেঁসেলে খুব ব্যস্ততা। মাছ, মাংস, মুগের ডাল, ফুল কপির তরকারি এইসব রান্না হত। মা'র সেদিন সকাল থেকে উপোস। এগারোটার মধ্যে বড়মামা এসে যেত ফ্যামিলি শুদ্ধু। তারপর মা বড়মামাকে ফোঁটা দিত। এটা অন্য মন্ত্র। ঠাকুমারটা নয়। ব্যানার্জি বাড়ির।

    ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
    যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
    যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
    আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা
    আজ হইতে ভাই তুমি নিম তিতা!

    তারপর আগের দিনের সিন রিপীট। মিষ্টির থালা, শাড়ি ইত্যাদি। আমি আর আমার মামাতো বোন সেই খাটের ওপর অকাজের ধাড়ি হয়ে বিরাজ করছি। তারপর খাওয়া দাওয়া। আড্ডা। ওরা বিকেলের জল খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়ত। ফিরতে হবে সেই খড়দা। বড়মামার শ্বশুর বাড়ি। সেখানে আবার বড়মানি আশিষমামাকে ফোঁটা দেবে রাতে।

    তো এইভাবে সাইডলাইনে থাকতে থাকতে আমারও খুব শখ হত একদিনের জন্য একটা ভাই পাবার। পাড়ার ছেলেরা যাদের আমি কাকু ডাকতাম, তারা পাড়ার পিসিদের কালিপুজো নাগাদ আওয়াজ দিত, এই ভাই ভাড়া লাগলে খবর দিস। আমার মনে হত, ইস, আমার বয়সীগুলো যদি একবার বলত! তারপর গেলাম কলেজে। কোটি কোটি ছেলে। ক্লাসের ছেলেগুলোকে বললাম, এই তোরা ফোঁটা নিবি? এমন হতচ্ছাড়া, যে বলে, তোর থেকে তো কিছুতেই নেবনা!

    তো এভাবেই কেটে গেছে এত বছর। আমারও আর সেইভাবে ভাইফোঁটা দেওয়া হয়নি। প্রতিবার এই একটা পার্বনে মনের মধ্যে কোথায় একটা চিনচিনে কষ্ট হয়। কাল বাড়ি ফিরে ছেলেকে বললাম যে জানিস, আজ কলকাতায় একটা ফেস্টিভাল হচ্ছে। ভাইফোঁটা। ও পুরো ব্যাপারটা ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল আমি কাকে ফোঁটা দিই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, কাউকে না। তখন ব্যাটা বলে কি, আমাকে দাও। আমি বললাম ধুর বোকা! ছেলেকে কেউ ফোঁটা দেয়? বলে, প্রবলেমটা কি? তুমি তো বললে বোনেরা ফোঁটা দেয় to wish long life of their brother আর ভাইরা বোনেদের প্রোটেক্ট করবে প্রমিস করে। তুমি আমার long life চাও, আর আমিও তোমায় প্রটেক্ট করব এটা তো obvious। তাহলে আমাকে ফোঁটা দিতে আপর্ত্তিটা (ঠিক এই উচ্চারণে) কিসের?
  • mumu | 216.2.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩৯688049
  • তাই আমি ভাবি যে আমার বর খালি অন্য ছড়া বলে ক্যানে, বাঙ্গাল দের আলাদা ছড়া আজ জানলুম

    লেখটাও হয়েচে সরেস, এক্কেরে ভাজা মিস্টির মত
  • kiki | 55.124.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ১৩:১৮688050
  • ঃ)

    আর আমায় কি অত্যাচার ই না সহ্য করতে হত। আগে থেকে কি দেব জানাতে হত, এমনকি জানালেও ফোঁটা না নেবার বায়নাক্কা চলতেই থাকত, মারপিটে যেটা সমাপ্ত হত। তারপর কুড়ি বছর ভাই এদিন থাকতোই না প্রায়। এবার আবার রয়েছে। কিন্তু এবার নাকি আমায় ফোঁটা দিতে নেই। মা স্মরন করিয়ে দিলো। এই তো ব্যাপার।

    লেখাটা বেশ হয়েছে।
  • cm | 127.247.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ১৩:৪৪688051
  • এ প্রথা কি সমগ্র উত্তরভারত জুড়েই আছে? নইলে বাঙালিরা সংষ্কৃতয় ছড়া লিখবে বলে মনে হয়না।
  • Bratin | 11.39.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ১৩:৫৭688052
  • রাখীর মতো ই সম্ভাব্য প্রেমিক রা সন্ত্রস্ত থাকতো যদি জোর করে তাদের ভাই করে দেওয়া হয় ঃ)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন