এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  গান

  • কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়

    Somen Dey লেখকের গ্রাহক হোন
    গান | ০৭ আগস্ট ২০১৪ | ৩২৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Somen Dey | ০৭ আগস্ট ২০১৪ ১১:৩৬644565
  • কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায়
    ***********************

    রবীন্দ্রনাথ খুব নিশ্চিত ভাবে জানতেন বাঙ্গালি যতই বিস্মৃতিপ্রবন জাতি হোক , তারা ভুলতে পারবে না তাঁর রচিত গান গুলি । কারন বাঙ্গালির মানসলোককে তিনি বিলক্ষণ চিনতেন । চিনতেন এই মানসলোকের সমস্ত আলো-আঁধারির মূর্ছনা , বেদনার কোমল-গান্ধার , মন-কেমনের মীড় , সুখানুভুতির কড়ি ও কোমল । তাই তিনি এই মানসলোকের পরতে পরতে তিনি সুকৌশলে জড়িয়ে দিয়েছেন এমন সব গান যা বাঙ্গালির জীবনে অবধারিত হয়ে , অবশ্যম্ভাবী হয়ে , অমোঘ হয়ে থাকতেই হবে যতদিন বাঙ্গালির কণামাত্র বাঙ্গালিত্ব অবশিষ্ট থাকবে।

    কিন্তু এ সব গানের পিছনে কি শুধুই কথার অনবদ্যতা , নাকি সুরের সম্মোহন ।কে কার হাত ধরে থাকে , কে কার অলঙ্কার হয়ে আমাদের আমাদের জীবনভর সকাল-সাঁঝে প্রতীয়মান হয় তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে । আজ এখানে না হয় আমরা একটু আলাদা করে শুধু সুরকার রবীন্দ্রনাথ কে বুঝবার চেষ্টা করি ।

    যদি এখনকার ঠিকানার ওই ৬/৪ দ্বারকা নাথ ঠাকুর লেনের বাড়িটিতে আমাদের রবি ঠাকুর না জন্মাতেন , মানে তিনি যদি এই বাংলা দেশেরই অন্য কোনো বাড়িতে , অন্য কোনো পরিবারে , অন্য কোনো সময়ে জন্মাতেন তা হলে কি তাঁর সহস্রমুখী প্রতিভা এমন করে বিকশিত হত ? তাঁর সঙ্গীতবোধ এ্মন বিস্ময়কর ভাবে পরিপক্ক হত ? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে অযথা সময় নষ্ট না করে বরং এই টে মেনে নেওয়া যাক , তিনি ঠিক সময়ে ঠিক বাড়িতেই জন্মেছিলেন । সেটাই বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য ।
    দেবেন্দ্রনাথের অষ্টম পুত্রটি যখন ভূমিষ্ঠ হচ্ছেন তখনই এই বঙ্গ দেশের সমাজ অনেক দিনের একটা গুমোট আবহাওয়া কাটিয়ে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ঢেউ উঠতে আরম্ভ করেছে । ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ’ বইটিতে শিবনাথ শাশ্ত্রী ১৮৫৬ থে ১৮৬১ এই সময় টাকে বঙ্গ সমাজের একটা মাহেন্দ্রক্ষণ বলেছেন । একদিকে মাইকেল মধুসুদন দত্ত , দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব , অন্যদিকে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের আন্দোলন আবার একই সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে বাংলার এলিট সমাজের উদ্বেল হওয়া , একটা মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া , এই সবের প্রভাবে বঙ্গ সমাজে এবং বাঙ্গালির মননে একটু করে যেন আধুনিকতার স্পর্শ লাগাছে । আর এর কিছুদিনের মধ্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী ও বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাব্য ও উপন্যাসের জগতে আনছেন নুতন ভাবনা ,নুতন ভাষা ।
    বাংলার রেনেসাঁসের পালে হাওয়া লাগতে আরম্ভ হয়েছে । আর এই রকম একটা সময়েই জোড়াসাঁকোর সেই বাড়ীটিতে শিশু থেকে বালক হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ । খুলে যাচ্ছে মনের দরজা জানালা , নুতন আলোয় আলোকিত হচ্ছেন বালক রবি ।

    প্রথম অধ্যায়
    *******
    শুরু করি তাঁর শৈশবকালের সাংগীতিক পরিবেশের কথা বলে ।
    উনবিংশ শতাব্দীর অভিজাত ধনী সমাজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা করার একটা চল ছিল । এটা হয়ত তখনকার ধনীরা অনেকটা করতেন তাদের আভিজাত্যের আড়ম্বর দেখানোর তাগিদে। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথে সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিল অন্তর থেকে । তাই এ দেশের শ্রেষ্ঠ গায়কদের তিনি ব্রাহ্ম সমাজে গান গাইতে আমন্ত্রন জানাতেন । এঁদের মধ্যে অনেক কে নিজের বাড়িতে এনে রাখতেন । বিষ্ণু চক্রবর্তী , শ্রীকন্ঠ সিংহ , যদু ভট্ট এঁরা কখনো শিক্ষক হিসেবে কখনো গায়ক হিসেবে ঠাকুর বাড়িতে অহরহ যাতায়াত করতেন ।
    রবীন্দ্রনাথের প্রায় অক্ষর জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুর জ্ঞান তাল জ্ঞান হয়ে গেছল খুব স্বাভাবিক ভাবে । বালক রবি শিক্ষক হিসাবে পাচ্ছেন সে কালের তিন মহারথী কে – বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকন্ঠ সিংহ এবং যদু ভট্ট কে । এঁরা শুধু যে উচ্চ মানের গায়ক ছিলেন শুধু তাই নয় এঁরা খুব আধুনিক মনস্ক মানুষ ছিলেন ।
    রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকেই আমরা জানতে পারি - বিষ্ণু চক্রবর্তী সে সময় গ্রাম্য ছড়ায় সুর বসিয়ে বালক রবি কে রাগ রাগিনীর সঙ্গে খুব সহজে পরিচয় করিয়ে দিতেন । সে সময়ে সেটা খুবই অভাবনীয় ।
    শ্রীকন্ঠ সিংহ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘তিনি তো গান শেখাতেন না , গান দিতেন , কখন তুলে নিতুম বুঝতেই পারতুম না ।‘
    আর যদু ভট্ট সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারনা – ‘যদু ভট্টের মত সঙ্গীত ভাবুক আধুনিক ভারতে কেও ছিলেন কিনা সন্দেহ ।’
    শুধু অসাধারন সব গানের মাস্টারমশাইদের পেয়ে তাঁর সাংগীতিক জ্ঞানের ভিত শক্ত হয়েছিল তাই নয় , সে সময় জোড়াসাঁকোর বাড়িটাতেও যেন চারিদিকে সুর খেলে বেড়াতো সকাল সন্ধায় তাঁর কানে ভেসে আসত নানা ধরনের গান। বালক রবি তার বেশির ভাগ অগ্রজদের দেখছেন চুটিয়ে গান বাজনা করতে ।
    বড়দাদা দ্বিজেন্দ্র নাথের গান বাজনায় প্রবল আগ্রহ ছিল । তাঁকে বাংলা স্বরলিপি সৃষ্টির আদি পুরুষ বলা যেতে পারে । মেজদা সত্যেন্দ্র নাথ শুধু এ দেশের প্রথম আই সি এস ই হন নি , তিনি বেশ কিছু ব্রহ্ম সঙ্গীত ও রচনা করেছিলেন । অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনিও যথেষ্ট গান বাজনার সমঝদার ছিলেন ।
    নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্র নাথ পিয়ানো , বেহালা , সেতার সব কিছুই বাজাতে পারতেন । ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য দুই সঙ্গীতেই তাঁর অসাধারন দখল ছিল ।
    রবীন্দ্রনাথের ঠিক উপরের দাদা সোমেন্দ্র নাথ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন । তিনি নিধুবাবুর গান ও খুব চমৎকার গাইতে পারতেন । রবীন্দ্রনাথের এক কাকার উদ্যোগে অই বাড়িতে যাত্রা পালা , দাশরথীর পাঁচালি ,হরু ঠাকুরের গান, গগন হরকরার গান , কবিগান , পালা কীর্তন এ সব লেগেই থাকত ।
    এ ছাড়া দেবেন্দ্রনাথের কন্যারা , দৌহিত্রী রা , অনেকেই গান বাজনা করতেন ।
    এই সব নানা ধরনের গান শুনতে শুনতে বালক রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠছেন আর তাঁর মধ্যে জন্ম নিচ্ছে একজন কম্পোজার, ,এক জন বিশ্বমানের সঙ্গীত স্রষ্টা , এবং একজন সঙ্গীত ভাবুক, যিনি কিছুদিনের মধ্যেই ভারতীয় সঙ্গীতের প্রচলিত ছক গুলো কে ভেঙ্গে চুরে একটা নুতন ধরনের সঙ্গীতের ধারা কে রুপ দেবেন ।
    ঠিক এই সময় রবীন্দ্রনাথ সাহচর্য পাচ্ছেন এমন দুটি মানুষের , রবি থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার পিছনে যাদের অবদান সব চেয়ে বেশি । এঁদের সংস্পর্শে এসেই লাজুক রবির সঙ্কোচ কেটে যায় । রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায় – ‘তাঁর সংশ্রবে আমার ভিতরকার সংকোচ ঘুচিয়া গিয়াছিল । সে সময় বন্ধন মুক্তি না ঘটিলে চিরজীবন একটা পঙ্গুতা থাকিয়া যাইত ’

    এঁদের তিনজনে জোড়াসাঁকো বাড়ির ছাতে বসে বিকেল বেলা গুলোতে মধুর আড্ডার যে সময় টুকু কাটিয়ে ছিলেন সে সময় টুকুর প্রতিধ্বনি বার বার ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের গানে কবিতায় । বলা বাহুল্য , এরাঁ হলেন জ্যোতি দাদা ও নতুন বৌঠান ।
    কখনো জ্যোতি দাদা একটা সুর পিয়ানো তে বাজাচ্ছেন আর রবি তাতে কথা বসাচ্ছেন , আর কখনো রবি একটা গান লিখে ফেলছেন আর জ্যোতিদাদা তাতে সুর বসিয়ে দিচ্ছেন ।
    এ রকম একটা সময়েই কোনো এক অলস দুপুরে , যখন কোলকাতার আকাশে খুব ঘন মেঘ করেছে , ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহলের কোনো এক আবছায়া কোনে একটা স্লেট হাতে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রবি লিখে ফেললেন – গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে । লিখে নিজেই একটু চমকে গেলেন ।
    তার কিছুদিন পরেই গোটা গানটি লিখে ফেললেন এবং সেই সঙ্গে বিদ্যাপতি চণ্ডিদাস পড়ে যে মুগ্ধতা তাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল সেই সময় হয়তো তারই ফল স্বরূপ কিশোর রবি একটা নতুন ভাষাই সৃষ্টি করে ফেললেন এবং সে ভাষা তেই দশটি গান রচনা করলেন । এর পিছনে নতুন বৌঠানের প্রচুর উৎসাহ ছিলো ।
    এই দশটি গানের সুর কতটা রবির নিজের আর কতটা তার জ্যোতিদাদার সেটা আমরা খুব সঠিক ভাবে জানতে পারবো না কোনো দিন ।এই সব গানের সুরে কীর্তনের প্রচুর প্রভাব আছে , যেটা রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কালের অনেক গানেই আমরা পেয়েছি ।
    তবে অন্তত দুটি গান –গোবিন্দদাসের লেখা ‘ সুন্দরী রাধে আওরে বানু ’ গানটি এবং বিদ্যাপতির লেখা ‘এ ভরা বাদর , এ মাহ ভাদর ’ এ দুটি গানে যে রবীন্দ্রনাথ নিজে সুর করেছিলেন তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন । এ কাজটা করেছেন চোদ্দ পনেরো বছর বয়সে । এর আগেই তিনি জ্যোতিদাদার রচিত নাটক সরোজিনী নাটকের জন্য একটি গান রচনা করেছেন -জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ । নাটকের একটি আবেগময় মুহূর্তে কিছু নাটকীয় বক্তিতা ছিল । সেটির বদলে কিশোর রবির উপর ভার পড়ে একটি গান লিখে দেওয়ার ।সেই উদ্দেশেই এই গান ।
    এর বছর দু এক পরে তিনি প্রথম যে মৌলিক গান টি লেখেন সেটি – সেটি তোমারি তরে মা , সঁপিনু এ দেহ , তোমারী তরে মা সঁপিনু প্রাণ । অর্থাৎ ওই কিশোর বয়সেই কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের যাত্রা শুরু ।

    দেবেন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকে ছোট্টো রবির গলায় গান শুনতে ভালবাসতেন । হয়তো তাঁরই নির্দেশে এ সময় কিছু ব্রহ্ম সঙ্গীত ও রচনা করেন । এই সব গান গূলি সুর করতে গিয়ে তিনি কিছু প্রচলিত হিন্দি ধ্রুপদ গানের সুর থেকে সাহায্য নেন । তবে সেই কিশোর বয়সেই কোনো গানের সুর হুবহু নকল করেন নি ।সে সব গানের অংশ বিশেষ নিয়ে বাকি টা নিজেই মানান সই সুর বসিয়েছেন । এই ভাবেই রবীন্দ্রনাথের ভাঙ্গা গান রচনার সূচনা হয়।
    সতেরো আঠারো বছর বয়সে রচিত অনেক গানের স্বরলিপি পাওয়া যায়নি । সেগুলি হারিয়েই গেছে । তবে এই সময়ে রচিত – বলি ও আমার গোলাপ বালা , শুনো নলিনী গো আঁখি আজও জনপ্রিয় । তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা – গানটির প্রাথমিক রুপ টিও এই সময় রচিত হয় । এই গানটি সেই সময়ের সম্পূর্ণ অন্য মেরুর এক দ্রস্টা আর এক উজ্বল বঙ্গ সন্তান নরেন দত্ত মহাশয়েরও অতি প্রিয় গান ছিল । এই বয়সে তিনি আরো একটি গান রচনা করেছিলেন যেটি আজকের দিনেও জনপ্রিয়তম রবীন্দ্রসঙ্গীত গুলির মধ্যে অন্যতম । যারা সচরাচর রবীন্দ্রনাথের গান করেন না তারাও এ গান টি মনে মনে কখনো সখনো গুন গুন করে ওঠেন ।
    গানটি - সখি ভাবনা কাহারে বলে সখি যাতনা কাহারে বলে ...। বেহাগ খাম্বাজ দুই রাগের আভাস মিশিয়ে সুর করা গানটি আজও একেবারে আধুনিক লাগে ।

    রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে কুড়ি । ইতি মধ্যে তিনি বছর দুই কাটিয়ে এসেছেন বিলেতে । ব্রাইটন স্কুলে এবং লন্ডন ইউনিভারসিটি তে ইংরাজি সাহিত্য পড়ে এসেছেন । পিতার ইচ্ছে ছিল আবার তিনি বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে । কিন্তু তিনি মাদ্রাজ থেকি ফিরে এসেছেন । ব্যারিস্টারি পড়া হয় নি । তিনি একজন সফল ব্যারিস্টার হলে বাংলা সাহিত্যের যে কি দশা হত তা কল্পনা করতে ভয় লাগে । এমনি এক সময়ে ঠাকুর বাড়িতে একটি বিদ্দজন সভা হবে ।তরুন রবির উপর ভার পড়লো অভ্যাগতদের মনোরঞ্জনের জন্যে কিছু একটা করার । রবি প্রবল উৎসাহে লেগে পড়লেন । রচনা করে ফেললেন – বাল্মিকী প্রতিভা । তাঁর জ্যোতি দাদা এই সময় পিয়ানো তে রাগ রাগিনী যেমন বাজাতেন , তেমনি বাজাতেন কিছু বিলিতি গৎ । এই সব সুর গুলো মিলে মিশে একটা অদ্ভুত অভিঘাত সৃষ্টি করতো রবীন্দ্রনাথের মনে । এই অভিঘাতেরই ফসল বাল্মিকী প্রতিভার গান । রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই পর্বটিকে গীতিবিপ্লব বলেছেন । আমরা এই সময়ে দাঁড়িয়েও বাল্মিকি প্রতিভার গান গুলি শুনলে বুঝতে পারি যথার্থই এটি একটি বিপ্লব ছিল ।
    এই প্রথম তিনি ভারতীয় সঙ্গীতে এক ধরনের বিশ্ববোধের আমদানী করলেন । একদিকে কিছু পাশ্চাত্য গানের সুর ভেঙ্গে বাংলা গান রচনা করলেন অন্য দিকে ভারতীয় রাগ রাগিনীর নির্দিষ্ট চলন থেকে বেরিয়ে এসে নাটকের প্রয়োজনে তাদের অন্যরকম ভাবে ব্যাবহার করলেন ।ব্যান্ড সঙ্গীতের সুরে – এনেছি মোরা এনেছি মোরা , ফারসী গানের সুরে হা কি দশা হল আমার , নিধু বাবুর একটি গানের সুর থেকে নিয়ে –থাম থাম কি করিবি বধি পাখিটির প্রাণ , আইরিশ গান Nancy lee থেকে কালি কালি বল রে আজ , go where the waits thee থেকে মরি ও কাহার বাছা এই সব যেমন ছিল তেমনি খাম্বাজ রাগে – এক ডোরে বাঁধা আছি , হাম্বির রাগে – জীবনে কিছুই হল না হায়া , গৌড় মপ্ললার রাগে - হৃদয়ে রাখ গো চরনে তোমার এই সব ও ছিল ।
    আর একটা অভিনব ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন , যা সম্ববত এ দেশে প্রথম । সেটা সংলাপ গুলি তে মুড অনুযায়ী রাগের ব্যাবহার ।
    বাল্মীকি প্রতিভা লেখার পরে পরেই আর একটি গীত নাট্য লিখে ফেললেন –কালমৃগয়া । এ
    বাল্মীকি প্রতিভা তে যে ছন্দের একটু আধটু ঘাটতি ছিল কালমৃগয়া তে সেটা আর থাকলো না । এখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত তিনটি নতুন দিকের সূচনা হল । এক, কয়েকটি বৈদিক স্তোত্রতে সুর বসালেন , দুই, যে ঋতুর গানে তিনি পরবর্তী কালে তাঁর অনন্যতার ছাপ রাখবেন , তাঁর সেই ঋতু পর্যায়ের গানের এখানেই সুত্রপাত হল ( গহন ঘন ছাইলো , রিমঝিম ঘন ঘনরে ) আর তিন, বিলিতি গানের সুরের সঙ্গে দেশি রাগের ফিউসন সেও এই দেশে তিনিই প্রথম করছেন তার সুচনাও এখানেই হল । যেমন –মানা না মানিলি – go where glory awaits thee এবং গানের সুরের সঙ্গে মেলালেন মিশ্র বিলাওল , তেমনি – Robin a dair থেকে নিয়ে - সকলি ফুরালো হায় - গানে মেশালেন ঝিঝিঁট খাম্বাজের ছায়া ।
    রবীন্দ্রনাথ এই বাল্মীকি প্রতিভা আর কালমৃগয়ার পর্যায় টিকে ‘সঙ্গীতের উত্তেজনা ’ বলেছেন । এই উত্তেজনা টির বোধহয় খুব প্রয়োজন ছিল । জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাব হয়তো অনেকটাই ছিল , কিন্তু তাও সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নামক একজন শক্তিশালী বিদ্রোহী কম্পোজার কেও এখানে চেনা যায় ।
    আসলে সৃষ্টি করতে গেলে যে ভাঙ্গাটাও প্রয়োজন সেটা কুড়ি বছরের কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছলো । ভাঙ্গনের জয়গান গাওয়ার সেই শুরু ।

    দ্বিতীয় অধ্যায়
    *********

    এর পরে যেমন কাব্য জগতে মানসী ও কড়ি ও কোমলের মধ্যে এক প্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছে , কম্পোজার রবীন্দ্রনাথ ও ক্রমশ আরো পরিণত হয়ে উঠছেন । তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনে ঘটে গেছে দু টি বড় ঘটনা । বাইশ বছর বয়সে মৃনালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ আর তেইশ বছর বয়সে তাঁর অতি প্রিয় নতুন বৌঠানের জীবনাবসান । আমরা জানি এই মৃত্যুটির অভিঘাত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে যেমন পড়েছে তেমনি প্রবল ভাবে পড়েছে গানেও ।
    কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কিছুদিন আগে ঠাকুর বাড়িতে নলিনী নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করা হয় , যাতে অভিনয় করবেন ঠাকুর বাড়ির সব বিখ্যাত ব্যাক্তিত্যরা। পরিকল্পনাটি একটু অদ্ভুত ছিল । ঠিক হয়েছিল যারা এই নাটকে অভিনয় করবে তারা নিজেরাই নিজেদের সংলাপ লিখবে । পরে সেটি রবীন্দ্রনাথ ঘসে মেজে অভিনয় যোগ্য করে তুলবেন ।কাদম্বরী দেবী এই নাটকে নীরজা নামের একটি ছোটো রোলে অভিনয় করবেন এমনই ঠিক ছিল । কিন্তু এই নাটকের মহড়া শুরু হতেই সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে গেলো । কাদম্বরী দেবীর আত্নহত্যা ।এই ঘটনার পর স্বাভাবিক ভাবেই নাটকের অভিনয় বন্ধ হয়ে গেল । কিন্তু এই ঘটনার উল্লেখ এখানে করা হল এই জন্যে যে কিছুদিন পরে যখন এই নাটকটি অভিনয়ের উদ্যগ নেওয়া হয় , তখন রবীন্দ্রনাথ নাটকের নীরজা চরিত্রে এমন একটি গান জুড়ে দেন যেটি শুনলে আজও আমরা বিষাদ্গ্রস্ত হয়ে যাই । ‘কিছুই তো হল না , সেই সব সেই সব হাহাকার রব ’ । মিশ্র ঝিঝিঁট রাগে একটি অনবদ্য ব্যাবহার ।

    অথচ এই গানটি রচনার কিছু আগেই তিনি আরেকটি গান রচনা করেছেন ঝিঝিঁট রাগেই ।সেটির মেজাজ একেবারেই ভিন্ন । একটি চমৎকার দেশাত্নবোধক গান – এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন ।

    এই সময়ে কিছু ব্রহ্ম সঙ্গীত রচনা করতে হয়েছে । ব্রহ্মসঙ্গীতের সুর প্রধানত ধ্রুপদ ধামার খেয়াল টপ্পা ও ঠুংরি প্রধানত এই চার ধরনের হিন্দুস্থানি গান থেকে নেওয়া । কখনো খুব সরাসরি কোনো গানের সুর নিয়েছেন কখনো একটি বিশেষ অংশ মাত্র নিয়েছেন । তবে কোনো হিন্দি গান বা কোনো প্রাদেশিক গানের সুর ভালো লাগলেই সেট থেকে একটা বাংলা গান দাঁড় করিয়ে দিতেন । অনেক সময়েই মুল গান থেকে এই সব ভাঙ্গা গান গুলি অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে । সে কথায় পরে আসা যাবে ।

    সাতাশ বছর বয়সে কবি আরো অনেক বেশি মৌলিক সুরকার হয়ে উঠলেন । মায়ার খেলা গীতি নাট্যের গান গুলি সুর দেবার সময়ে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রভাব মুক্ত হয়ে উঠলেন । বাল্মীকি প্রতিভা ও কালমৃগয়া মুলত নাটকের সংলাপে সুর বসানোর চেষ্টা ছিল । তাই সে গান গুলি স্বাধীন নয় । কিন্তু মায়ার খেলার গানগুলি বেশিরভাগ স্বাধীন ও সম্পূর্ণ গান । যে ধরনের গানে আমরা আগে নাশুনে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের গান বলে চিনে নিতে পারি সেই ধরনের রবি ঠাকুরের সিগনেচার করা গান গুলি আমরা পেলাম মায়ার খেলাতে । ভারতীয় রাগ কে সুনিপুন ভাবে ব্যাবহার করেও অনবদ্য সব শটসৃষ্টি করলেন । ইমনকল্যানে পথহারা তুমি পথিক যেন গো , পিলু রাগে আমার পরান যাহা চায় , মিশ্র ভুপালীতে সখী বহে গেল বেলা , দেশ রাগে দে লো সখী দে , দরবারী কানাড়াতে বিদায় করেছ যারে নয়ন জলে – এ সব গানের জনপ্রিয়তা তো আজও একটুও কমে যায় যায় নি।
    সাতাশ বছর অবধি তিনি লিখে ফেলেছেন এবং সুর দিয়েছেন প্রায় চারশো টি গান । মোটামুটি গড়পড়তা বছরে ৫০ টি গান করে গান সৃষ্টি করেছেন । সে সময় না ছিল না ছিল রেডিও তে সম্প্রসারণের ব্যাবস্থা না ছিল রেকরড করার ব্যাবস্থা । কোনো মৌলিক সুর দেওয়া বা অন্য কোনো গানের থেকে প্রভাবিত হয়ে কোনো ভাঙ্গা রচনা করা এ সমস্ত ব্যাপারটাই শ্রুতি এবং স্মৃতি নির্ভর ছিল । তাই কোনো গান মাথায় এলেই সেটাকে সঙ্গে সঙ্গে স্বরলিপিবদ্ধ করে নিতে হত । এ সব মাথায় রাখলে বোঝা যায় সুরকার হিসেবে তিনি প্রতিভাশালী তো ছিলেনই সেই সঙ্গে কতটা দক্ষ কম্পোজার ছিলেন ।
    এই সাতাশ বছর বয়স অবধি রবীন্দ্রনাথ যে গান গুলি রচনা করেছেন তাতে খুব বেশি দেশজ গানে প্রভাব পড়েনি । এই সময় কিছু বিদেশি সুর, কিছু ধ্রুপদ , খেয়াল , ঠুংরী টপ্পা এই সবের প্রভাব তাঁর গানে বেশি ছিল । মাত্র কয়েকটি কীর্তনের প্রভাব পাওয়া যায় ষোল বছর বয়সের রচনা – গহন কুসু্ম কুঞ্জ মাঝে ।তেইশ বছর বয়সের রচনা – আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি , , ছাব্বিস বছর বয়সে –সুখে আছি , সুখে আছি । এ ছাড়া দু একটি গানে রামপ্রসাদী সুরও লাগিয়েছিলেন ।

    তৃতীয় অধ্যায়
    ********
    এর পরবর্তী সময়ে প্রধানত জমিদারী দেখাশোনার প্রয়োজনেই রবীন্দ্রনাথ কে কিছু গ্রামে ভ্রমন করতে হয় । এই সময় তিনি বাউল , ভাটিয়ালী , সারি , ঝুমুর এবং বিভিন্ন ধরনের কীর্তন গান শোনবার সুযোগ হয় । তিনি এই সব গানের সহজিয়া সুরে এবং কথার দর্শনে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হন । বিশেষ করে বাউল গানের কথা এবং সুর দুইএতেই একসময় তিনি মজে গেছলেন বলা যায়।
    কিছু গানে তো মুল সুর অপরিবর্তিত রেখে নিজের কথা বসিয়েছিলেন ।
    যেমন – আমার সোনার বাংলা ( আমি কোথায় পাব তারে ) , যদি তোর ডাক শুনে কেও ( হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে ) , ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি , মাঝি তুই পরের দ্বারে , ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি ( দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ ) ।
    আর বাউল সুরের প্রভাবিত গান তো প্রচুর ।
    বিশেষ করে অনেক স্বদেশী গানে বাউল গানের সুর লাগিয়েছেন , কারন এই সুরে পেয়েছিলেন একটা দেশজ স্টাইলে উদ্দীপনের প্রকাশ ।

    খেয়া থেকে বলাকা কাব্য গ্রন্থ রচনায় মধ্যে প্রায় আট বছর সময় কাল রবীন্দ্রনাথ প্রায় কবিতা থেকে ছুটি নিয়ে ছিলেন । সম্পূর্ণ ভাবে মজে ছিলেন গানে । গানের সুরে এবং ভাষায় দু জায়গাতেই এক নুতন রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেলাম । উত্তর-পঞ্চাশের রবীন্দ্রনাথের গানে সুর ও কথার অর্ধ নারীশ্বর রুপ্ টি আর স্পষ্ট হয়ে উঠলো । সুর কি ভাবে কথার রুপকল্প কে এঁকে ফেলছে তার উদাহরন তো অজস্র । তবু যদি কয়েকটি বেছে নিতে হয় তাহলে তাঁর প্রিয় সময় প্রভাত ও সন্ধ্যা আর প্রিয় ঋতু বর্ষা ও বসন্তএর অনুসঙ্গের চারটি গান বেছে নেওয়া যেতে পারে নেহাতই উদাহরন হিসেবে ।
    আমাদের অতি পরিচিত গান – ‘আলোকের এই ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দাও ’ । এ গান টি তিনি ৫৪ বছর বয়সে রচনা করেছেন কাশ্মীরে বসে । সকাল বেলার একটি জাগরণী গান , অতএব খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভৈরবী রাগ । শুরু হচ্ছে কোমল গান্ধার ছুঁয়ে একটি নম্র আকুতি নিয়ে , প্রথম লাইনের ‘ধুইয়ে দাও’ যেন একটি আবেদন আর দ্বিতীয় লাইনের ‘ ধুইয়ে দাও’র অন্য সুর বুঝিয়ে দিচ্ছে এখানে ধুলার ঢাকা আপনাকে জলের ধারা ধুইয়ে দেওয়া যেন ধাপে ধাপে শুরু হচ্ছে । অন্তরার প্রথম অংশে পরান বীণায় অমৃত গান ঘুমিয়ে থাকার কথা বলছেন তাই এখানে সুর তার সপ্তকের কোমল রেখাব ছুঁয়ে নেমে এসেছে । পরের অংশে সুপ্তি কেটে গিয়ে প্রান যেন বন্ধন ছিন্ন করে ছুটছে - বিশ্ব হৃদয় হতে ধাওয়া আলোর পাগল প্রভাত-হাওয়া – এখানে আর সুপ্তি নেই , প্রান নিখিলের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে , তাই সুর একটু বেশি উচ্চকিত হয়ে তার সপ্তকের কোমল গান্ধার ও মধ্যম অবধি পৌঁছে যাচ্ছে । আবার পরের লাইনে বিশ্ব হৃদয়ের স্পর্শে ব্যাক্তি হৃদয় যেন প্রণত হতে চাইছে তাই – সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও – এই লাইনের ‘নুইয়ে দাও’ অংশ টুকুতে সুর মধ্য সপ্তকের কোমল নিখাদ থেকে চকিতে মধ্য সপ্তকে ষড়জে নেমে আসছে ।

    তেমনি একটি সন্ধ্যা কালের গান – ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’ । পঁয়ষট্টি বছর বয়সে জার্মানির স্টুটগারডে বসে রচনা করেছেন এই গান । স্থায়ীর প্রথম লাইনে প্রথমে মুগ্ধতা আর এই লাইনের পরের অংশে প্রহর শেষ হওয়ার প্রচ্ছন্ন বিষাদ ।
    স্থায়ীর দ্বিতীয় লাইনে ‘আনন্দ আবেশ’ দু বার উচ্চারিত হওয়ার মধ্যে গানের মর্মবাণী টি যেন ধরিয়ে দেওয়া – এ গানের উদ্দেশ্য রুপ মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দেওয়া ।
    অন্তরাতে দিন শেষের মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের সোনালী আভা দেখার মাধুর্য বেহাগের চলন দিয়ে বোঝানো , আবার দ্বিতীয় লাইনে ‘ গুঞ্জরিছে ’ শব্দ টি প্রথমে একবার তার সপ্তকে সহ্জ ভাবে আবার পরে মধ্য সপ্তকে দোলায়িত ভাবে উচ্চারনে বুঝিয়ে দেওয়া হল আনন্দের গুঞ্জরন । এর পরেই ‘কোথায়’ শব্দ টির সুরারোপে মধ্য সপ্তকের পঞ্চম থেকে তার সপ্তকের ষড়জে নিয়ে এসে যেন একটা নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার দ্যোতনা সৃষ্টি হয়ে গেল ।
    সঞ্চারিতে ‘সায়ন্তন’ শব্দটির প্রয়োগেই যেন একটা ধ্বনি সুষমা আপনা আপনি তৈরি হয়ে যায় । সুরও সেই স্নিগ্ধতা কে প্রকাশ করে ।
    এর পর আসি একটি বর্ষা ঋতুর গানে । কিছুটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অসাধারন গায়কীর দৌলতে এটি একটি অতি জনপ্রিয় গান – ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ । কবির জীবনের উপান্তে , আটাত্তর বছর বয়সের রচনা । এ গানে শব্দ চয়নেই বোঝা যাচ্ছে বরষার রুপ বর্ণনায় কালিদাসের কালের ব্যাঞ্জনা নিয়ে আনতে চাইছেন । ‘ঝঞ্জন মঞ্জীর’ , ‘তাল- তমাল-অরন্য’ , ‘হংস বলাকা’ শব্দ গুলি তে যেন একটু ক্ল্যাসিসিস্ট আবহ আনার চেষ্টা । গান শুরু হল শান্ত ভাবে মধ্য সপ্তকের ষড়জ থেকে । কিন্তু ‘নিঃসীম শুন্যে’ তে উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে টি বোঝাতে সুর চলে যাচ্ছে চড়াতে উঠে তার সপ্তকের ষড়জে গিয়ে , আবার চকিতে সেখান থেকে ‘শ্রাবনবরষন সঙ্গীতে’ তে নেমে আসছে মধ্য সপ্তকের ষড়জে – বর্ষার গাম্ভীর্য বোঝাতে ।
    তিনবার ‘রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম’ উচ্চারনে দুলে দুলে ধারা পতনের শব্দ ।
    সঞ্চারীতে ‘বায়ু বহে’ তে আবার শান্ত সুর পুব হাওয়ার মৃদুমন্দ রুপ্ টি ফোটায় । আভোগীর শেষ চরনে ‘ খুব্ধ শাখার আন্দোলনে’ এই জায়গায় সুরে খুব্ধ শাখার সুরে আন্দোলিত ভাবটি সৃষ্টি করে গাছের ডালের দুলে ওঠার চিত্রকল্প টি ।

    বসন্তের একটি গান যা ততটা প্রচলিত নয় কিন্তু উল্লেখ করছি এটির সুরের অভীনবত্বের জন্যে । কবির ষাট বছর বয়সের রচিত গান – ‘ও মঞ্জরী ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’
    আমের মঞ্জরীর ঝরে পড়ার মধ্যে যে একটা বেদনা বিধুর ঔদাস্য আছে সেটা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কার চোখেই বা পড়বে । খাম্বাজ রাগের আভাস থাকলেও গানটির আরম্ভের ‘ও’ টি শুরু হচ্ছে তার সপ্তকের রেখাব থেকে এবং প্রলম্বিত হচ্ছে তিন মাত্রা অবধি । যেন অনেক দূর থেকে একটা ডাক আসছে , সে ডাকে খানিকটা যেন কোকিলের ডাকের ভঙ্গী ।
    স্থায়ী তে – ‘হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি’ এই অংশের ‘উদাস’ শব্দ টি নয় মাত্রায় প্রসারিত করে এক অপূর্ব ঔদাসিন্যের ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছে । এর পরেই ‘ঝরি’ শব্দটি পর পর তিনবার তিন রকম ব্যাবহার করে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়া মুকুলের চিত্রকল্প তৈরি করে দেয় ।
    এমন উদাহরন আর বেশি দিয়ে এই নিবন্ধ টি ভারাক্রান্ত করতে চাইছি না ।

    প্রথাগত ভাবে রাগসঙ্গীতের তালিম নেন নি । হয়ত আমাদের মত সাধারন শ্রোতাদের জন্যে সেটা ভালোই হয়েছে । কারন তিনি কোনো ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধলে রাগ সঙ্গীতের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার ব্যাপারে হয়তো শুচীবায়ুগ্রস্ত হয়ে উঠতেন । তিনি যেভাবে রাগসঙ্গীতের ধ্যান ধারনা ভেঙ্গেছেন , রাগসঙ্গীতের অনুগত ছাত্র হলে সেটা হয়ত ততটা সহজ হত না । কালোয়াতি গানের নির্দিষ্ট নিয়মানুবর্তিতা থেকে বেরিয়ে আসাটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এই জন্যে যে তিনি রাগ রাগিনীর এবং বিশ্বসঙ্গীতের মুল জায়গাটাকে বুঝে ফেলেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে অনেক গানেই অবশ্য রাগ সঙ্গীতের সুরের কাঠামো কে অবিকৃত রেখেছেন । কিন্তু একটু বেশি বয়সে এই কাঠামো ভেঙ্গে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন । অনেক সময়েই তিনি ব্যাকরন মানেন নি । সম প্রকৃতির রাগের মিশ্রনের সঙ্গে একেবারে ভীন্ন প্রকৃতির রাগের ও মিশ্রন ঘটিয়েছেন , সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করি ।
    ‘অশ্রুভরা বেদনা’ গানটিতে খাম্বাজ ও টোড়ি আছে কিন্তু কোনোটাই স্পষ্ট নয় । ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’ গানটিতে সারং এর সঙ্গে মল্লার ও কানাড়া রাগ মিশিয়েছেন । সারং দুপুরের, মল্লার বর্ষা ঋতুর আর কানাড়া রাত্রির রাগ । ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গানে ভৈঁরো ও বিভাস কে অনায়াসে মিশিয়েছেন । ‘প্রখর তপন তাপে’ গানটিতে ভীমপলশ্রী ,মুলতানী দুটি অপরাহ্নের রাগের সঙ্গে সকালের রাগ ভৈরবীকে মিলিয়েছেন ।
    অনেক সময়ে বিশেষ কোনো রাগে প্রথাগতভাবে কোনো বর্জিত স্বর থাকা সত্বেও নিষেধ না তিনি সেই বর্জিত স্বর প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেন নি । ইমন রাগে আধারিত ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার’ , ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’ , ‘সকলি ফুরালো হায়’ গান গুলিতে পাশাপাশি শুদ্ধ রে ও কোমল রে প্রয়োগ করেছেন অবলীলাক্রমে ।
    আমাদের বাংলার দেশজ কীর্তনের সুরের ঢং এর সঙ্গে খেয়ালের স্বাধীন সুরবিস্তার কে মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি – ‘মরি লো মরি , আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে ’ গানটিতে ।
    আর একটি গানে – ‘ও চাঁদ , চোখের জলে লাগলো জোয়ার ’ আরো এক ধাপ এগিয়ে কীর্তন খেয়ালের ঢং এর সঙ্গে টপ্পার দানাও মিলিয়ে দিয়েছেন ।
    এই ব্যাকরন না মানা মিশ্রন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি বৈপ্লবিক মন্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক – ‘ যদি মধ্যমের স্থানে পঞ্চম দিলে ভালো শোনায় আর তাহাতে বর্ণনীয় ভাবের সহয়তা করে , তবে জয়জয়ন্তী বাঁচুন কিম্বা মরুন, আমি পঞ্চম কেই বহাল রাখিবি না কেন ? ’

    বঙ্গ জীবনে প্রেম কে মহাসমারোহে গানে গানে আহ্বান করতে রবীন্দ্রনাথই শিখিয়েছেন । উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অবধি বাঙ্গালির কাছে ভদ্রসমাজে গাইবার মত গান বলতে ছিল ভক্তিগীতি । রামনিধী গুপ্ত কিছু টপ্পা গানে প্রেমের কথা বলতে গিয়ে তৎকালীন সমাজে বেশ বাধা পেয়েছিলন । তবু তিনি বাংলা প্রেমের গান কে অনেকটা আধুনিক করে তুলেছিলেন । কিন্তু তার পর আর কিছু এগোয় নি ।আর যা কিছু প্রেমের গান আমাদের কীর্তন বা লোক গানের ফরম্যাটে রচিত হয়েছে তা সবই রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উপকথা অবলম্বন করে । আমাদের জীবনের প্রেম কে গান দিয়ে সগর্বে উৎযাপন করতে করতে শেখালেন রবি ঠাকুর । যেহেতু আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর নিয়ে কথা বলছি আমরা প্রেমের গানেও সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবো । আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্রনাথ তরুন বয়সের গান গুলিতে দ্রুত ছন্দের গান খুব কম । তেইশ বছর অবধি যে একশোটির মতন গান রচনা করেছেন তার মধ্যে বাল্মিকী প্রতিভা ছাড়া অন্য গানগুলিতে দ্রুত লয় ব্যাবহার করেন নি । বেশির ভাগ গানেই খেমটা তালের । বেশির ভাগ গানে প্রেমের বিরহ , করুনা , শুন্যতা , হতাশা প্রকাশ পেয়েছে ।
    ‘বলি গো সজনী , যেও না যেও না’ (কালাংড়া ) , ‘কেহ কারো মন বোঝেনা ,কাছে এসে সরে যায়’ ( কাফি সিন্ধু ) , দুজনে দেখা হল ( বেহাগ-খাম্বাজ ) , ও গান আর গাস্ নে, গাস্ নে, গাস্ নে (খাম্বাজ ) এগুলি এই বয়সে রচিত কয়েকটি বিষাদ -স্নিগ্ধ কিছু গান ।
    যত বয়স বেড়ছে প্রেমের গানে তিনি কথার সঙ্গে সঙ্গে সুরেও অনেক বেশি পরিনত হয়েছেন ।প্রথম দিকের কিছু গান ছাড়া প্রেমের গানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাব কম । বরং তিনি এনেছেন কীর্তন ও লৌকিক গানের সুর , টপ্পার সুর , পাশ্চাত্য সুর এবং সেই সঙ্গে রাগ্রাগিনীর ছকভাঙ্গা মিশ্রন ।
    তেত্রিশ থেকে ছত্রিশ বছর বয়সে রচিত কয়েকটি গানে একটি প্যাটার্ন ধরা পড়ে ।যেমন সাহানা রাগে রচিত ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’ , ইমন কল্যান রাগে রচিত ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার নিভৃত সাধনা ’ মিশ্র ঝিঁঝিটে রচিত ‘বঁধু, মিছে রাগ কোরো না, কোরো না’ , ভৈরবী তে ‘বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল’ , ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে (কীর্তন) , ওগো কাঙ্গাল আমায় কাঙ্গাল করেছ (ভৈরবী ), তুমি রবে নীরবে (বেহাগ) । এখান অবধি তিনি রাগ রাগিনীর ছক গুলি অনেকটাই মেনে চলছেন ।

    চতুর্থ এবং শেষ অধ্যায়
    *****************
    কিন্তু বয়স পঞ্চাশ পেরোনোর পরে তিনি কম্পোজার হিসেবে আরো বেশি পরিনত হয়ে উঠলেন । রাগ গুলিকে এমনভাবে ব্যাবহার করেছেন যেখানে এক অনন্য সুরকার রবীন্দ্রনাথের সিগ্নেচার এবং স্টাইল খুব স্পষ্ট ।
    ভৈরবীর অনবদ্য প্রয়োগ দেখি – ‘কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে’ , ’ গানে । তেমনি পূরবী তে ‘তুমি তো সেই যাবেই চলে’ , ‘কী ধ্বনি বাজে’ গানে । খাম্বাজে ‘মনে রবে কিনা রবে আমারে’ , ‘বিরল দিন বিরস কাজ’ , পিলুতে ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলাম ’ ‘তোমায় গান শোনাবো’ এ সব গানের সুরে এমন কিছু পাই যা গানের কথাকে হাত ধরে নিয়ে যায় এক অসাধারন অভিব্যাপ্তির আলোকে ।

    বয়স তাকে বৃদ্ধ করেনি কোনো দিন । তা নইলে কি আর উনআশি বছর বয়সে ভৈরবী রাগে গান বেঁধে বলেন – ‘প্রেম এসেছিল , নিঃশব্দ চরনে’ ,কিম্বা বাহাত্তরে পৌঁছে খাম্বাজের ছোঁয়া দিয়ে একটি যৌবন-মত্ততার গান বাঁধেন – ‘আমরা নুতন যৌবনের দুত’ ।

    সত্তর পেরিয়েও তিনি সুর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়েন নি । বরং আরো বেশি করে করেছেন ।
    ‘মধু গন্ধে ভরা’ গানে তাল ফেরতা এনে দাদরা ও কাহারবা দুই তালের প্রয়োগ করলেন ।অবশ্য এই তাল ফেরতার পরীক্ষা তিনি আগেও করেছেন । নৃত্যের তালে তালে , হে নিরুপমা , আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি এই সব গানে ।
    কীর্তনের সুরের একটি অনবদ্য প্রয়োগ করে রচনা করলেন –‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ ।
    বর্ষা কে আবাহনের গানে প্রথাগত মল্লার না বসিয়ে বসালেন দেশ রাগ – এসো শ্যামল সুন্দর , কিম্বা আরেকটি বর্ষার গানে – রিমিকি ঝিমিকি ঝরে বাদলের ধারা , বাঁধলেন ইমন-কল্যানে ।
    এ সব কাজই করছেন সত্তর পেরিয়ে , এই বঙ্গ দেশে যে সময় তখনকার সত্তর বছর বয়েসটাকে বারানসীর কর্মহীন নির্বাসনে পাঠানো টাই রেওয়াজ ছিল ।
    কিন্তু মন যতই সতেজ থাক শরীরের তো একটা ধর্ম আছে । সেতো ক্লান্ত হবেই জাগতীয় নিয়মে ।

    ১৯৪১ সালে আশি বছর বয়সে কালিম্পং থেকে রবীন্দ্রনাথ বেশ অসুস্থ হয়ে ফিরলেন শান্তিনিকেতনে। এর আগে চিকিৎসার জন্যে কোলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কদিন ছিলেন , কিন্তু তাঁর মন পড়ে আছে তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনে । চলে এলেন সেখানে । কানে শুনতে পাচ্ছেন না , চোখেও কম দেখছেন ।তিনি বুঝতে পারছেন আর অত চুপি চুপি নয় এবার মরণ একটু জোরে জোরেই কথা বলছে তাঁর সঙ্গে । প্রতি বছর ১লা বৈশাখে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে । প্রতিবছরই কোনো না কোনো নুতন গান রচনা করে দেন । সবার মনে সংশয় এ বছর কি পারবেন তিনি ? হাল ছাড়েন নি শান্তিদেব । রোজই এসে বসে থাকছেন কবির কাছে , যদি কোনো গান মনে আসে । কবি বললেন - সুর যেন আর টের পাইনে আমি , এ বার না হয় পুরনো গান দিয়ে অনুষ্ঠান হোক । শান্তিদেব তবু ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন । কবি একটু ভেবে বললেন – ‘ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখা যাক । সৌম্য আমাকে বলেছে আমি নাকি যন্ত্রের জয়গান করেছি , কিন্তু মানবের জয়গান করিনি, এ বার তাই একটা কবিতায় মানবের জয়গান গাইলুম , ওটিই এ বারের নববর্ষের গান ‘
    উজ্বল হয়ে উঠলো শান্তিদেবের মুখ , কিন্তু একটু সংশয় রইল এত বড় কবিতা কে কি সুরারোপ করতে পারবেন কবি !
    পরের দিন কবিতাটিকে একটু ছোট করে দিয়ে সুর করতে বসলেন শান্তিদেব কে নিয়ে । ভৈরব রাগে বেঁধে ফেললেন কথাগুলো কে –
    ‘ঐ মহামানব আসে
    দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
    মর্ত ধুলির ঘাসে ঘাসে ’
    কানে খুব কম শুনছেন , তবু গায়ক দলকে ডেকে সামনে বসিয়ে তুলে দিলেন গানটি । সারা শরীরে অনেক যন্ত্রণা , তাঁর সেই বিখ্যাত প্রখর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সেই অতিমানবিক স্মরনশক্তি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসছে । তবু তিনি শুনবার চেষ্টা করছেন কি রকম দাঁড়াল তার দেওয়া সুরটি । কোথাও কি তিনি বুঝতে পারছিলেন সুরের সুরধুনীর প্রবাহ নিঃশেষ হয়ে আসছে ? হয়ত এই তাঁর শেষ গান , শেষ সুর ?
    বাল্মীকি প্রতিভা তে দেবী সরস্বতী বাল্মীকি কে বর দিয়েছিলেন –

    ‘যত দিন আছে শশী, যত দিন আছে রবি,
    তুই বাজাইবি বীণা তুই আদি মহাকবি!
    মোর পদ্মাসনতলে রহিবে আসন তোর,
    নিত্য নব নব গীতে সতত রহিবি ভোর।
    বসি তোর পদতলে কবিবালকেরা যত
    শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত!
    এই নে আমার বীণা দিনু তোরে উপহার
    যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার!

    আসলে বাল্মিকী নয় , কুড়ি বছরের রবীন্দ্রনাথের জন্যেই দেবী সরস্বতী এই বর দিয়েছিলেন ।
    কবি বুঝতে পারছেন সেই দেবী সরস্বতীর অভয় মুদ্রা ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে ,পদ্মাসনতলের আসনটি যেন টলে যাচ্ছে ।

    কদিন পরে পঁচিশে বৈশাখে আরো একবার অনুরোধ এল একটি নুতন গান রচনা করার জন্যে । কিন্ত একেবারে নুতন করে গান লিখতে আর ইচ্ছে করছে না । আগে লেখা পূরবী কাব্য গ্রন্থের একটি কবিতা কে বেছে নিয়ে তাকে একটা সংক্ষিপ্ত রুপ দিয়ে একটি গান বেঁধে দিলেন – ১৯৪১ সালের ৬ই মে শেষ বার সুর দিলেন তাঁর নিজের গানে - ‘ হে নূতন , দেখা দিক আরবার , জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ । ভৈরবীর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব তো ছিলই । তাই জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে বেছে নিলেন প্রত্যূষের রাগ ভৈরবীকেই , কারন সৃষ্টির তৃষ্ণা তখনো ফুরায় নি , তখনো তাঁর অন্তরাত্না চাইছে আর এক নুতন চেতনার জগতে –
    - ‘ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
    ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ’ ।

    ********
    ১৯৪১ সালের ৬ই মে থেকে ৭ই আগস্ট , এই তিন মাসের মধ্যে আর কোনো সুর ধরা দেয় নি তাঁর কাছে , অথবা ধরা দিয়েছিল কিন্তু সে সুরে বসাবার মত কথারা ধরা দেয় নি , নাকি দুইই ধরা দিয়েছিল কিন্তু অশক্ত শরীর তাকে লিপিবদ্ধ বা স্বরবদ্ধ করতে দেয়নি , তা আমরা জানতে পারবো না কোনো দিন ।

    তাঁর দেওয়া সুর গুলি যাতে অনাগত কালের আধুনিকতার উৎপাত সহ্য করে অবিকৃত থাকে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন তিনি ।
    দিলীপ কুমার রায় কে বেশ রেগেই লিখেছিলেন – ‘আমার গানে ত আমি সে ফাঁক রাখিনি যে ,সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠবো’
    অর্থাৎ একটা আশঙ্কা তাঁর ছিল যেখানে ‘ দ্বারী নেই শুধু দোহাই আছে , এমন অবস্থায় দস্যু কে ঠেকাতে পারে কে ’ । জানিনা তাঁর কল্পনার সেই দস্যুদের আর কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে ।

    তিনি তাঁর সমস্ত জীবন সুরের তপস্যা করে বাঙ্গালির হৃদয়ের অন্তপুরে একটু অনাড়ম্বর জায়গা চেয়ে ছিলেন । খুব সামান্য ছিল তাঁর চাওয়া –
    ‘ আমার গান যদি শিখতে চাও নিরালায় স্বগত নাওয়ার ঘরে কিম্বা এমনি সব জায়গায় গলা ছেড়ে গাবে । আমার আকাঙ্খার দৌড় এই পর্যন্ত , এর বেশি ambition নাই বা রাখলে’

    কিন্তু এই দিশেহারা বাঙ্গালি জাতির তাঁকে নিয়ে ambition যে আকাশছোঁয়া । কে তাদের বোঝাবে যে তিনি যদি স্বর্গ নামক এক কল্পলোক থেকে আজকের বাঙ্গালির হালচাল নজরে রাখতেন , তাহলে ট্রাফিক সিগন্যালে গান বাজানো দেখে যতটা খুশি হতেন বা তাঁর গানে ইউ টিউবে অজস্র ‘লাইক’ এর সংখ্যা দেখে যতটা খুশি হতেন তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হতেন যদি আজকের বাঙালি সত্যি সত্যি নিরালায় স্বগত নাওয়ার ঘরে তাঁর গান হৃদয় দিয়ে গলা খুলে গাইছে এমন দৃশ্য টি দেখতে পেতেন ।
  • dd | 132.183.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৪ ১২:০৯644567
  • বাঃ। মুগ্ধ হলাম
  • b | 135.2.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৪ ১২:৩৪644568
  • সৌমেনবাবু, দারুণ হয়েছে। তবে একবারে এতো বড়ো না লিখে ভেঙে ভেঙে পোস্ট করলে ভালো লাগতো।
  • Ranjan Roy | ০৭ আগস্ট ২০১৪ ১৩:০২644569
  • সৌমেন,
    যথারীতি এক স্নিগ্ধ এবং মননশীল অনুভব।
    ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে আছি।
  • সৌগত ধর চৌধুরী | ***:*** | ২৬ আগস্ট ২০১৯ ১৬:০২644570
  • খুব সুন্দর, বিশ্লেষণাত্মক লেখা। অনেক ধন্যবাদ।
  • dhonyo | ***:*** | ২৬ আগস্ট ২০১৯ ২১:৩২644571
  • ওফ্ফ্ফ! কি লেখা!
  • ন্যাড়া | ***:*** | ২৭ আগস্ট ২০১৯ ১০:২৪644572
  • "রবীন্দ্রসংগীতের যা শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের রচনা তাঁর সেরা ছবির মতোই সতেজ, সাবলীল ও অননুকরণীয়। এখানে রাগরাগিণীর প্রশ্ন আসে না, বাউল-কীর্তনের প্রশ্ন আসে না, বাদী-সম্বাদীর প্রশ্ন আসে না। এখানে সবই আছে, আবার সবই যেন নতুন। এমন কি এখানে কথা ও সুরের সামঞ্জস্যের বিচারটাও অবান্তর বলে মনে হয়, কারণ সব শ্রেষ্ঠ শিল্পরচনার মতোই এ গানও বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে।"

    (এটা সত্যজিতের লেখা থেকে তুলে দিলাম। "রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভাববার কথা" নামের প্রবন্ধে সত্যজিৎ যা লিখেছেন তার সঙ্গে আমার মত এতটাই মিলে যায় যে, ওখানে থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমার মত বোঝান সবচেয়ে সোজা।)

    অনেকেই কম্পোজার রবীন্দ্রনাথের জীবনকে তিন অধ্যায়ে ভাগ করেন। প্রথম অধ্যায় ধ্রুপদ-ভাঙা, হিন্দি ভজন ভাঙা আর পিয়ানোর সুরে কথা বসানো, বিলিতি সুরে কথা বসান। অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ির প্রভাব পুরোমাত্রায় বর্তমান এবং খুব মৌলিকও নন, বিদ্রোহী তো ননই। দ্বিতীয় অধ্যায় হল যখন উনি ঠাকুরবাড়ির প্রভাবে থেকে বেরিয়ে আসছেন। জমিদারী দেখছেন। লোকায়ত গানের সংস্পর্শে আসছেন। রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। এখানেও মৌলিকতা খুব না থাকলেও, স্বকীয়তা আসছে কম্পজিশনে। আর তৃতীয় পর্যায় যখন সব মিলেমিশে আপাদমস্তক নতুন সৃষ্টি হয়ে উঠছে, সত্যজিৎ যেটাকে বলছেন, "রাগরাগিণীর প্রশ্ন আসে না, বাউল-কীর্তনের প্রশ্ন আসে না, বাদী-সম্বাদীর প্রশ্ন আসে না"।

    লেখাটা ভাবনার খোরাক জোগাল।
  • অর্জুন | ***:*** | ২৭ আগস্ট ২০১৯ ২০:৩১644573
  • একদম মন ভাল করে দেওয়া লেখা। লেখককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ।
  • রঞ্জন | ***:*** | ২৭ আগস্ট ২০১৯ ২০:৫৪644574
  • জ্জিও ন্যাড়াবাবু!
    ভাল লাগল এবং ঋদ্ধ হলাম।
  • avi | ***:*** | ২৭ আগস্ট ২০১৯ ২২:৪৪644566
  • সেদিন স্বরবিতান খুলে আনন্দধারা বহিছে ভুবনে গাইতে গিয়ে কী চাপ খেলাম। রবীন্দ্রনাথ সুর দিয়েছেন মিশ্র মালকোষ ধরে, সেইমতোই স্বরলিপি। এদিকে মাথার মধ্যে মোহরদেবীর গাওয়া শুদ্ধ মালকোষ গেঁথে গেছে। কী গেরো! শেষমেশ ছেড়েই দিলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন