এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • দুর্গাপুজোর নস্টালজিয়া

    tania
    অন্যান্য | ১৫ আগস্ট ২০০৬ | ৪৭৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • shrabani | 124.3.***.*** | ২০ অক্টোবর ২০০৮ ১৭:২৮631306
  • ফুলদিটার তো দারুন ভুতের ভয় বিশেষ করে দেশে এলে, চারদিকে তো আলোটালো নেই কলকাতার মত, তাই ও আমার আর মায়ের মাঝখানে শোয়। আমার ভয়টয় করেনা, বাবা বলেছে ভুত বলে কিছু নেই, ভয় আমাদের মনে। কিন্তু মায়ের ভয় আছে আমায় ধারে শোয়ালে আমি নির্ঘাত খাট থেকে পড়ে যাব। আমি শুই দেয়ালের দিকে, একটা বড় জানালার ধারে। ঘাটের দিকের বড় কাঁঠালগাছটার পাতারা সেই জানালার বাইরে থেকে রোজ সকালে দুলে দুলে আমায় গুড মর্নিং বলে। সপ্তমীর দিন থেকে দশমী অবধি রোজই আমাদের দুজনেরই ঘুম ভাঙে সানাইয়ের সুরে। আমাদের বাড়ী অবধি সানাইয়ের শব্দ আসছে মানে নহবত বাজছে। নাহলে আটচালায় বসে বাজালে এখান অব্দি আওয়াজ পৌঁছয়না। আর ঘুম ভেঙে কখনই আমরা মাকে দেখতে পাইনা, মা সবথেকে আগে উঠে পড়ে, আর মায়ের থেকেও আগে জেঠাই আর মনিকাকা চলে আসে চানটান সেরে।

    এইদিন চা টা হবার সাথে সাথেই জেঠাই দুয়ারে এক পাশে তোলা উনুনে ভাতে ভাত চাপিয়ে দেয়। মা চান করে আসে তাড়াহুড়ো করে, আসলে আজ বলিদানের হাড়িকাঠ পোঁতা থেকে দশমীর সকালে হাড়িকাঠ তোলা অবধি মা আর ভাত খাবেনা। শুধু মা নয় সব বাড়িরই গিন্নীরা তাই, জেঠীমা কাকিমা সব্বাই। বামুন কাকা আগের দিনই সবাইকে বলে দেয় হাড়িকাঠ পোঁতার সময়, সেইমত সবাই ভাতটাত খেয়ে রেডি হয়ে নেয়। জেঠাই মাসী দিদি সবাই গজগজ করতে থাকে, এ কি নিয়ম বাবা তোমাদের, পুজোর কদিন বাড়িময় ভালমন্দ রান্না আর গিন্নীদের না খাইয়ে রাখা! কিন্তু আমার তো ভালই মনে হয়, কি আর এমন ভালমন্দ রান্না, শুধু গুচ্ছের মাছ আর হাবজিজাবজি, চচ্চড়ি পুঁইশাক। তারচেয়ে মায়ের খাওয়াটা অনেক ভাল লুচি পরোটা আলুভাজা বেগুনভাজা ইচ্ছেমত। মা যে কেন খেতে চায়না, আমি হলে তো আরাম করে অনেক খেতাম!

    সময় জানা থাকলেও হাড়িকাঠ পোঁতার আগে একবার ঢাক বাজানো হয়, সেটা ওয়ার্নিং। সবাই পড়িমড়ি করে খাওয়া সারে, পোঁতা হয়ে গেলে আরেকবার। পুজোর সময় এটা বেশ মজা লাগে আমার, ঢাক টা ঘড়ি হয়ে যায়। পুজোয় বসবে, একবার ঢাক বাজিয়ে জানিয়ে দাও, আরতি হবে ঢাক বাজাও সবাই আসবে, বলি হবে তাও। অনেক সময় খেয়াল না করলে মায়েরা আমাদের ছোটোদের মন্দিরে পাঠিয়ে দেয়, যা তো ঢাক কেন বাজল দেখে আয়!
    ষষ্ঠীর দিনে অত লোকের খাওয়াদাওয়ার পরে যা ভাত বেঁচে যায়, জল দিয়ে রাখা হয়। সপ্তমীর সকালে জেঠাই, ময়নারা, পঞ্চা, আরো কাজের লোকেরা সেই পান্তা ভাতে ব্রেকফাস্ট করে। মনিকাকা আগের দিনের মাছভাজা গরম করে পেঁয়াজ লঙ্কা তেলে চটকে দেয় আর ওরা সবাই খিড়কী দুয়ারে বসে ল্‌ঙ্কায় লাল করে হাপুস হুপুস শব্দে সেই ভাত খায় মাছ চটকানো দিয়ে। আমি ফুলদি প্রতিবারেই বায়না করি মায়ের কাছে ঐ রকম খাওয়ার জন্য কিন্তু মা দেয় না, ঐ ভাত নাকি খুব ঠান্ডা আমাদের অব্যেস নেই সহ্য হবেনা। আমরা প্রতিজ্ঞা করি বড় হয়ে নির্ঘাত খাব সপ্তমীর দিনে পান্তা ভাত। ঐ উপাদেয় খাবার দেখার পর আমাদের গলা দিয়ে শুকনো পরোটা আলুর তরকারী আর নামেই না।

    সপ্তমীর দিন শুধুই পুজো হয় সেই সকাল থেকে, ঘট ডোবানোর পর থেকেই। মন্দিরের মধ্যে পুজোর যোগাড়ে ব্রাহ্মনেরা আর দু একজন বাড়ির ছেলে, বুবুদা হারিকাকা এরা। বাইরে জেঠীমা বসে বসে বেলপাতা ছাড়ায় খালি। আমাদের নিত্যিপুজোর বামুনকাকা কাজ কিছুই করেনা শুধু হাঁকডাক করে। পুজো করতে আসে পঞ্চুদাদামশাই। দাদামশাই অনেক বুড়ো আর এই লম্বা। পঞ্চপ্রদীপটা তুলে যখন আরতি করে তখন প্রায় দুর্গার মুকুটে পৌঁছে যায় হাত। দাদামশাইয়ের ভাইপো ভুতুকাকা আসে দাদামশাইকে সাহায্য করতে আর চন্ডীপাঠ করতে। বাবা বলে দাদামশাই খুব বিদ্বান, দুর্গাপুজো করা যে সে পুরুতের কাজ নয়!

    পুজো যখন হয় আমার কিছু করার নেই,ভালো লাগেনা। সবাই শুধু চুপ করতে বলে। পুজো শেষ হলে বলি হয় তারপরে আরতি। বলির ঢাক বাজলেই মা কাকীমারা নতুন শাড়ী পরতে শুরু করে আরতি শুরু হবে বলে। বলি হবার সময় চারিদিক একদম নিস্তব্ধ, ছোটো বাচ্চাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাছে কেঁদে ফেলে। শুধু ছাগলটা ব্যা ব্যা করতে থাকে। বলির ছাগলদের নিয়ে এসে ডাক্তার জেঠুর সদরে বেঁধে রাখা হয়। আমরা কখোনো কখোনো গিয়ে পাতা খাওয়াই। শীতল কামার যখন কাতানটা নিয়ে হাড়িকাঠের দিকে এগোয় আমি তখনই বাবার কোলে মুখ গুঁজে দিই। জেঠু দাদু সব "মা মা মাগো" করতে থাকে আর ছাগলটা "ম্যা ম্যা"। শীতলের পা টা একটু একটু টলে। রিন্টু আমাকে বলেছে শীতল মদ খেয়ে আসে তাই ওর পা টলে, মদ না খেলে ও নাকি বলি দিতেই পারবেনা। আমি ঠিক বুঝিনা মদ তো খারাপ জিনিস, খারাপ লোকেরা খায়, তাহলে শীতল কামারের মত খারাপ লোককে আমাদের পুজোতে বলি দিতে দেয় কেন?
    আমি চোখ বুজে থাকি ততক্ষণ যতক্ষণ না উদ্দাম ঢাক বেজে ওঠে, ঢাকীরা পাগলের মত বাজায়। হারিকাকা একটা সরায় ছাগলের মুন্ডু টা নিয়ে দৌড়ে মন্দিরের দুয়ারে যায় আর বামুন কাকার উড়নিটা নিয়ে দুজন লোক দুদিকে ধরে জায়গাটা আড়াল করে দেয়, চক্ষুদান হবে। আমরা এদিকে বসে থাকি এতগুলো লোক রুদ্ধশ্বাসে, ঢাকের আওয়াজ বন্ধ!
    উড়নিটা সরানো আর বামুনকাকার " ঢাক বাজাও" বলে হুঙ্কার প্রায় একসঙ্গে শোনা আর দেখা যায়, আমাদের সামনে দেখি দাদামশাই য়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে, আরতি শুরু হয়ে গেছে। আরতির সিকোয়েন্স আমাদের মুখস্ত তবু খেলার মত বলে যাই, এবার শাঁখ, এবার ফুল, এবার জল, এবার চামর ইত্যাদি। চামরের পরেই শাঁখ বাজিয়ে আরতি শেষ। আরতির পরে অঞ্জলি, মা অঞ্জলি দেয় কিন্তু আমাদের দিতে দেয় না। আমরা একদিন অঞ্জলি দিই যেদিন পুজো তাড়াতাড়ি হয় সেদিন। মা বলে বাচ্চাদের রোজ রোজ অঞ্জলি দিতে নেই। কুমকুমরা কিন্তু রোজ দেয়, আমারও ইচ্ছে করে কিন্তু হয়না। সবাই অঞ্জলি দেয়, আমি আটচালায় বসে থাকি বাবার কোলে, চোখ চলে যায় মন্দিরের দুয়ারে ঐ ছাগলের মাথার দিকে, চোখদুটো খোলা, মাথার ওপরে একটা প্রদীপের সলতে জ্বালানো।
    আর চাইতে পারিনা, চোখ বন্ধ করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠি!
  • shrabani | 124.3.***.*** | ২১ অক্টোবর ২০০৮ ১৫:৫৬631307
  • অষ্টমীর দিন আমরা যাই অন্যান্য জায়গার ঠাকুর দেখতে, সবচেয়ে ভাল জামাটা পরা হয় ঐ দিনে। কেননা অন্য পাড়া থেকেও সবাই আসে আমাদের ঠাকুর দেখতে। ঠাকুর দেখে যারা যাদের বেশী চেনা তাদের বাড়ীতে যায়। আমাদের বাড়ীতেও আসে অনেকে সন্ধ্যেবেলায়, সেইজন্যে মা বেরোতে পারেনা বিকেলে আমাদের সাথে। মা সকালে যায় ভটচায বাড়ীতে, অন্য রায়েদের বাড়ী,গেঁড়িবুড়িতলায় পুজো দিতে। মায়ের সঙ্গে দিদিও যায় রিক্সায় করে। ওরা অনেক চেষ্টা করে আমাকে লুকিয়ে যেতে কিন্তু আমিও সকাল থেকেই মাকে চোখে চোখে রাখি, মা খেলতে যেতে বললেও দুরে যাইনা, কাছেই থাকি। তারপরে যেই দেখি মা আর দিদি পুজোর থালা কুরুশের ঢাকনায় ঢেকে বেরোচ্ছে, আমিও যাব বলে কান্না জুড়ে দিই, তখনই বাবা বলে যা ওকেও নিয়ে যা। ব্যস, দিদি গজগজ করতে করতে দু চারটে গাঁট্টা সহযোগে আমায় জামাকাপড় পরায়, মন্দিরে তো শুদ্ধু কাপড়ে যেতে হয় তাই! আমার তো ওরকমই, কেউ কোথাও যাচ্ছে দেখলেই যেতে ইচ্ছে করে!

    অবশ্য পুজো দিতে যাওয়ার চেয়ে বেশী মজা অষ্টমীর বিকেলে বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ায়। সঙ্গে আরো অনেকে যায়, জেঠুরা, অন্যান্য অনেকে, কুমকুমও থাকে, ওতো আসলে আমার ভাইঝি হয় মা বলেছে, কিন্তু আমার থেকে বড়। সারি সারি রিক্সা এসে দাঁড়ায় রাসমন্দিরের কাছে, আমরা দেখে শুনে আগে আগে গিয়ে বসে পড়ি ঝালর লাগানো ভাল রিক্সাটায়, আমি ফুলদি আর বাবা একটায়। বেশীরভাগই বাড়ীর পুজো, আমাদের মতই দালান মন্দির, ঠাকুর ও একই ধরণের, শুধু সার্বজনীনতলা ছাড়া। সার্বজনীন তলার পুজোকে বলে বারোয়ারী পুজো। মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল খাটিয়ে পুজো। ঠাকুর ও অন্যরকম, কাপড় দিয়ে পাহাড় বানানো, সরস্বতী লক্ষ্মী কার্তিক গণেশ দুর্গার সঙ্গে নেই দুরে দুরে দাঁড়িয়ে, মাদুর্গার মুখটাও কেমন বৌদি দিদিদের মতন, মা মা নয়। বাবা জেঠু প্রণামী চাঁদা দেয়। ফুলদি আমার থেকে অনেক বেশী জানে। ও বলে, আসলে আমাদের বাড়ির পুজোগুলোতে তো বাইরের লোকের নামে পুজো হয়না, তাই যাদের বাড়িতে পুজো হয়না তারা মিলে এই বারোয়ারী পুজো শুরু করেছে। বেশ করেছে, এটাই তো ভাল, এখানে পুজোতে কোনো নিয়ম বাধা নেই, আমাদের মন্দিরে তো শুধু বামুনকাকার পাহারা, এই করবিনা, এ উঠবিনা, এটা ছুঁবিনা!

    সার্বজনীন তলায় আরো ভাল লাগে কারন মেলা বসে, অনেক ছোটো কলকাতার রথের মেলা নয়, তবু মেলা তো। একটা লোক ম্যাজিক দেখায়, বাবা সেটা আমাদের সব বাচ্চাদের দেখতে দেয় কিন্তু খেতে কিচ্ছু দেয়না। ঐ লাল সবুজ কমলা আইসক্রীমের কাঠি, আর বুড়ির চুল দুর থেকেই দেখে মন ভরাতে হয়। ফুলদির আবার ইচ্ছে করে ঐ হাঁড়ির ঘুগনি ওপরে ডিম সেদ্ধ দেওয়া খেতে। কিন্তু বাবা বাইরের জিনিস খেতেই দেবেনা, শুধু বলবে কলকাতায় গিয়ে ভাল আইসক্রীম খাওয়াব, বিজয়ার দিন মাকে বলব ঘুগনি বানাতে। কি করে বোঝাই আমরা যে এই র ঙ বের ঙের আইসক্রীমের কাছে সেই সাদা কাপের আইসক্রীম, মায়ের ঘুগনির কাছে এই হাঁড়ির লালচে ঘুগনি ওপরে সাদা ধবধবে ডিমসেদ্ধর বাহার সমেত!
    শেষমেষ বেলুন আর পাখা কিনে বাড়ি ফিরি, ফুলদি কেনে কাঁচের চুড়ি, আমার হাতের মাপে চুড়ি পাওয়া যায়না তাই মনটা খারাপ হয়ে যায়! বাবা সান্ত্বনা দেয় সামনের বছর বড় হয়ে গেলে চুড়ি কিনবে।

    বাড়ি ফিরতে হয় আমাদের সন্ধ্যা আরতির আগে, এটাই আমাদের বাড়ীর নিয়ম, যে যেখানেই যাক, পুজোর দিনে সন্ধ্যা আরতির সময় মন্দিরে থাকতেই হবে, মায়েদেরও, যত কাজই থাক বাড়িতে। তাই সন্ধ্যের সময় মন্দিরে ভীড় হয় সবথেকে বেশী, বিশেষ করে আজকের দিনে তো তিল ধারনের জায়গা থাকেনা, আগে থেকে দালানে উঠে না দাঁড়ালে পরে আমরা জায়গাই পাবনা। এইদিন আমরা তাই ব্রজরাজের আরতিও দেখতে যাইনা, জায়গা চলে যাবার আগে, নাহলে এইসময় ব্রজরাজের মন্দিরও যা সুন্দর করে আলো দিয়ে, ফুল দিয়ে সাজায়! ঠাকুর কে সব তোলা গয়না পরানো হয়, সোনার হার, মুকুট, শিখিপাখা। চামরটাও রোজগারের চামরের থেকে আলাদা, রুপোর বাঁটের।

    আমরা দুগ্গাদালানে স্টাইল মেরে দাঁড়িয়ে থাকি, বাইরের লোকেরা আসে নীচে থেকে ঠাকুর দেখে, তার সঙ্গে আমাদেরও দেখে। আজকে মা দিদি কাকীমা জেঠীমারা সবাই সুন্দর সাজে, ভাল শাড়ী গয়নায়। আরতিও আজ বেশীক্ষণ ধরে হয়, আরতি শেষে বামুনকাকা প্রসাদ দেয় ফলমুল সন্দেশ বাতাসা। অন্যদিন পূজোর প্রসাদ সবার ঘরে ঘরে দিয়ে আসা হয়, লুচি ভোগও, আজ বাইরের লোকেদের জন্য মন্দিরে প্রসাদ বিলি করার রীতি।
    অষ্টমী আমার আর এক কারণে ভাল লাগে, ভাত মাছ খেতে হয়না, সকাল রাত সবসময় লুচি আর নিরামিষ। পুজোর মধ্যে আজকের খাবারটাই আমার বেস্ট লাগে। আমি ভাত ভালবাসিনা মা তাই বলে আমাকে খোট্টাদের মেয়ে বলে। আজকের রান্না মনিকাকার রান্নাঘরে হয়না, আলাদা তোলা নিরামিষ উনুনে হয়, ছোলার ডাল কিশমিশ দিয়ে, ফুলকপির তরকারী, বেগুন ভাজা, প্লাস্টিক চাটনি স অব মা নিজে বানায়। আজ বড়জেঠু আর জেঠিমা আমাদের বাড়িতে খায়, জেঠু মায়ের হাতে এইসব খেতে ভালবাসে কিনা তাই। বেগুন ফুলকপি সব বাবা লোক দিয়ে শহর থেকে আনায়, তাই হয় নাহলে এখানে এসব তেমন পাওয়া যায়না। বেশীরভাগ বাড়ীতে তাই কুমড়োর ছক্কা হয় ছোলার ডালের সাথে, আমার তো ছোলা দিয়ে কুমড়োর ছক্কাও দিব্যি লাগে। কাকীমা আমাকে দিয়ে যায়।

    আরতির শেষে অনেকে আমাদের বাড়ীতে আসে, চাটুজ্যে বাড়ীর মেয়েরা, দত্তদের বাড়ীর সবাই, বাবা মায়ের বন্ধু রা। মেয়েদের মা বসায় নীচের ঘরে, সবার জন্য মা ছাঁচ সন্দেশ বার করে, কুচো নিমকি মায়ের হাতের। সবাই আমাদের দেখতে চায়, খালি এক কথা ইস, কত বড় হয়ে গেছে। রাগ হয়, আমি বলে আরো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে দিদির মত হয়ে যেতে চাই চটপট, আর এরা দ্যাখো আমার বড় হওয়ায় দু:খ করছে!
    আজকে আমাকে গানের আসরে যেতে দেওয়া হয় না, মনিকাকা লুচি ভাজে সবাই চলে যাওয়ার পর, আমরা সকলে আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব, রাতে সন্ধিপুজো আছে। আমি একটু দেরীতে আসরে পৌঁছলেও খাওয়ার ঝ্‌ঞ্ঝাট মিটে যেতে খুশীই হই। সন্ধি পুজোর সময় গান বন্ধ করে দেওয়া হয়, বলি আর একশ আট প্রদীপ ধরানো আছে। সন্ধির সবই তড়িঘড়িতে হয়। তাই হইহই হট্টগোল ও বেশী হয়, বড়রা সবাই মুখটাকে খুব সিরিয়াস করে থাকে যতক্ষণ না পুজো শেষ হচ্ছে। আমার প্রদীপ ধরানোটায় সবচেয়ে মজা লাগে আর তাই জেগে থাকি, ঘুম এলে বুড়িদের বাড়ি মন্দিরের কাছে, ওখানে গিয়ে চোখে জল দিয়ে আসি।

    আমাদের বাড়ির দু তরফ আছে, পুরোনো তরফ আর নতুন তরফ, কেন মাদুগ্গাই জানেন। অন্য সময় সব এক শুধু এই সন্ধির প্রদীপ জ্বালানোতে রেষারেষিটা মালুম হয়। ওদিকের একটা প্রদীপের কুলো আসে, এদিকের আর একটা। সলতে ঘি সব দিয়ে বাড়ির মেয়েরা রেডি করে রাখে, আমাদের তরফে আমার দিদি আর বাণীদি দীপাপিসী এরা করে। কিন্তু আমাদের নিয়ম হল প্রদীপ মেয়েরা জ্বালাতে পারবেনা, ছেলেদের জ্বালাতে হবে। সন্ধির আরতির পরে ঠাকুরমশাই দুই কুলো পুজো করে কিসব মন্ত্র টন্ত্র বলে আর প্রদীপ ধরানো শুরু হয়, ছেলেরা ভাল পারেনা মেয়েরা নির্দেশ দিতে থাকে, ওদিকে বামুনকাকা ঘড়ি ধরে "তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি" করতে থাকে। দু তরফের কম্পিটিশন চলে, প্রথমে দু জন শুরু করে তারপর পারফরমেন্স দেখে দু পক্ষের আরো দু চারজন যারা ধুতি (প্যান্ট পরে বা পাজামা পরে ঠাকুরের প্রদীপে হাত দেওয়া যায় না) পরে রেডি থাকে, দরকার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে!
    আমার দাদা সারা পুজোতে মন্দিরের দিকে পা বাড়ায়না কিন্তু সন্ধির পুস্পাঞ্জলি দেয়। সন্ধির অঞ্জলি দু তিনজন বাঁধা লোকে দেয়, সোম কাকীমা, দীপাপিসীর মা, হারিকাকা আর দাদা। মা বলে সন্ধিপুজো সাধারনত রাত্রে হয় তো আর নির্জলা উপোস করতে হয়, খুব শক্ত, সবাই পারেনা। আগে নাকি বাবা দিত, এখন দাদা দেয়। বাবার গরদের ধুতি পরে শাল গায়ে দিয়ে দাদা অঞ্জলি দিতে আসে যখন সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আমার বড় হয়ে এটাও করার ইচ্ছে, সন্ধির অঞ্জলি দেবার, তাও রাত্রিবেলায় যখন কেউ দিতে পারবেনা তখন!
  • shrabani | 124.3.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০০৮ ১২:৩২631308
  • নবমীর সকালে উঠতে দেরীই হয় আমার, আগেরদিন সন্ধিপুজো শেষে শুতে অনেক রাত হওয়ার জন্যে। উঠে মুখ টুখ ধুয়ে যখন নীচের দালানে গেছি দৈনন্দিন ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে, চায়ের পাট মিটে গেছে। মন্দিরের যোগাড়ে ছেলেটি ডালা নিয়ে বসে আছে, মা ভাঁড়ারে নবমীর পুজো বার করছে। জেঠাই আমার হাতে রোজকার মত হর্লিক্স আর বিস্কিট ধরিয়ে দেয়। সবে বিস্কিটে দু তিন কামড় দিয়েছি, ফুলদি কোথা থেকে লাফাতে লাফাতে এল, আমার দিকে দেখেই, এমা তুই বিস্কিট খেয়ে ফেললি, আর অঞ্জলি দিতে পারবিনা, ওমা বোন খেয়ে ফেলেছে। ব্যস, আমি সেই বিস্কিট মুখেই ভ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ, সবাই কাজ ফেলে দৌড়ে দুয়ারে।
    জেঠাই আর মা চোখাচোখি করে, দিদি শুধু ওপর থেকে বলে ওঠে, শুরু হয়ে গেল সানাইবাদন। নহবত আজ দেখছি আমাদের বাড়ীতেই। আমাকে আর কেউ চুপ করাতে পারেনা, জেঠাই আর মা যে ষড়যন্ত্র করে আমাকে খাইয়ে দিল অঞ্জলির আগে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বাবা এসে সামাল দিতে চেষ্টা করে, অঞ্জলি পরের বছর দেবে বলে। আমি বলে সারা পুজো বসে আছি অঞ্জলি কবে দেব, আর এরা এমনি করে বলছে!
    ছোটখাট ধবধবে ফরসা, দুধসাদা গরদের থানে আর কালো চশমায় আমার মেজ জেঠাইমা ঢোকে, আমাদের উঠোন থেকে গন্ধরাজ ফুল তুলতে তার নিজের বাড়ির শিবপুজোর জন্যে। জেঠাইমা আমাদের সবার ফেভারিট, এত শান্ত আর মিষ্টি, একটুও ধমকে কথা বলতে পারেনা। ব্যাপার দেখে পুজোর কাপড়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে তারপরে মাকে ইশারা করে বলে, "না জেনে দু কামড় বিস্কিটে কিচ্ছু দোষ হয়না, দুগ্গা ওকে চান করিয়ে দে তারপরে মাথায় একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দে, তাহলেই শুদ্ধ হয়ে যাবে। কাঁদেনা সোনা, মা দুগ্গা ছোটোরা খেয়ে অঞ্জলি দিলেও দোষ নেয় না।"
    জেঠাইমার কথায় শান্ত হই তবে সারাদিন আর মা জেঠাইয়ের দিকে তাকাইনা। তবু অঞ্জলির পরে শয়তান ফুলদিটা বলে আমার কথা নাকি মা দুগ্গা শোনেইনি যেহেতু আমি খেয়ে অঞ্জলি দিয়েছি। ও বেশী জানে না মেজজেঠাইমা?

    নবমীতে দুটো পাঁঠাবলি হয় আর সন্ধির বলির পাঁঠা সব মিলিয়ে আজ রাত্রে ফিস্ট হয় মাংসের ঝোল আর ভাতের, যা মজা হয়না, বাড়ীর সবার একসাথে খাওয়া। দুপুর থেকে সদরঘাটের কাছে তিরপল টাঙিয়ে রান্না হয়, এই বড় হাঁড়িতে ভাত, ডেকচিতে মাংস। আমরা বিকেল থেকেই মন্দিরে, বাড়ীতে রান্নার ঝামেলা থাকেনা বলে মা রাও আজ মন্দিরে বেশীক্ষণ থাকে, আরতির পরেও গল্প করে অনেকক্ষন। রিন্টুরা তো মাংস কাটাও দেখতে যায়, বিমলদারা কাটে।
    দিদি খুব গজগজ করে, কি জলের মত পেঁয়াজছাড়া মাংস, একটুও ভাল লাগেনা খেতে। মা অবশ্য শুনতে পেলে ধমক দেয়, প্রসাদ নিয়ে এসব বলতে নেই! এবারে শুনলাম দাদারা সব গাছের পেঁপে পেড়েছে, মাংস ভাতের সঙ্গে চাটনিও হবে। আমার তো ঐ জলের মত মাংসের ঝোল খেতেই খুব ভাল লাগে, কি সুন্দর হুস করে পেটের মধ্যে চলে যায়, তাড়াতাড়ি খাওয়া হয়ে যায়। বৈঠকখানার মেঝেতে সবাই সার দিয়ে বসা হয়, মেঝেটা আবার এবড়োখেবড়ো, পাতা গুলো ঠিকমত সোজা থাকেনা। গরম ভাতের ওপর যখন পুকুরের জলের মত ঝোল দেয় ফটাফট, তাড়াতাড়ি পাতাটা গুটিয়ে না নিলেই ঝোল গড়িয়ে মেঝেতে। আমি আবার একটু ভেবলি আছি পাতা সময়মত গোটাতে পারিনা, তাই ফুলদি আমার পাশে বসে। ফুলদি খুব চটপটে, একহাতে আমার আর একহাতে নিজের পাতা ধরে নিয়ে চটপট ভাত আর ঝোল মাখিয়ে ফেলে। এত গরম যে আমি তো ফুঁ দিতে দিতে খেতে থাকি, তাও বাড়ির থেকে তাড়াতাড়ি খাই। এত ঝোল তাও শেষে মায়েরা খেতে বসলে ঝোল শেষ হয়ে যায়, হারিকাকা তখন একটা কেটলিতে নুন জল ফুটিয়ে মাংসের ডেকচিতে ঢেলে দেয়, আমরা নিজের চক্ষে দেখেছি!
  • shrabani | 124.3.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০০৮ ১২:৪৭631309
  • দশমীর দিন সকাল থেকেই মনটা খারাপ হয়ে যায়, আমাদের বাড়ীতে মা আর জেঠাই গোছগাছ শুরু করে দেয়, পরের দিন একাদশীতে আমাদের ফেরা। বাবাকে কত বলি, পুরো ছুটিটাই দেশে থাকতে কিন্তু শোনেনা। আমরা তো অনেক আগে আসি তাই বাবার অনেক কাজ বাকী পড়ে যায়। বাড়িতে এইসব বাঁধাছাঁদার মাঝে আমার থাকতেই ইচ্ছে করেনা। মন্দিরে চলে যাই, ওখানে কুমকুম রিন্টু কালুরাও আসে। ওদেরও আমাদের জন্য মন কেমন করে।এইদিন মন্দিরও ফাঁকা থাকে, ঢাকটাও কেমন আস্তে আস্তে বাজে, সানাইয়ে করুণ সুর। আরতির পরেই সবার ডাক পড়ে শান্তিজল আর হোমের ফোঁটা নিতে। ফোঁটা শুধু বাড়ির ছেলেদের দেওয়া হয় তবে বামুনকাকা বাচ্চাদের সবার কপালে দিয়ে দেয়। শান্তিজলের সময় মা আমাকে পাশে নিয়ে বসে, মায়ের আঁচলে আমার পা ঢেকে, পায়ে জল পড়লে পাপ হয় না!

    তারপরেই সব শেষ, বিজয়া হয়ে বাড়ি বাড়ি চিড়েভোগ গেলেই বুকটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। বাড়িতে আজ মনিকাকা এবেলার রান্না তাড়াতাড়ি করে ফেলে। সব গুছিয়ে চান করে আবার ওবেলার রান্না বসায়। আসলে আজ বিকেলে মনিকাকা বাড়ী চলে যায়। আর একটা দিন তো, জেঠাই ই রান্না সামলে নেয়। আমার খুব খারাপ লাগে মনিকাকা যখন যায়, কিন্তু মা যখন বলে মনিকাকা সারা পুজো তো আমাদের এখানেই থাকে, ওর ছেলেমেয়ে আছে, তাদের কাছেও তো যাওয়া দরকার পুজোর দিনে। আজ মনিকাকা বাড়ী গিয়ে ওদের নিয়ে ভাসান দেখতে বেরোয়। এটা শুনলে আমার আর খারাপ লাগেনা বরং মনিকাকার ছেলেমেয়ের জন্য দু:খ হয়, সারাপুজো ওদের বাবা কাজ করে, ওদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে যায়না।

    এইসব দু:খে কষ্টে (মা বলে কদিনের হুড়দুমে ক্লান্ত হয়ে) আমি দুপুরে বাবার পাশে ঘুমিয়ে পড়ি। উঠি যখন বেলা হয়ে আসে। জুতো জামা পরতে পরতেই ঢাক বাজনা বেজে ওঠে, ভাসান শুরু হবে। দুধ শেষ না করেই দৌড়ই মন্দিরের দিকে। তখন সেখানে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার! বাড়ির ছেলেরা মাদুগ্গার গয়না মুকুট সাজপোষাক খুলতে শুরু করেছে। কাত্তিক সরস্বতী লক্ষ্মী গণেশ কে আলাদা নামানো হয়েছে, নীচে থেকে দাদু জেঠুরা চেঁচাচ্ছে, "ওরে শোলার সব খুলিসনা, ঘাটে গিয়ে খুলবি এখনও মেয়েদের বরণ বাকী"। আমি জানি একসাথে সব ঠাকুরদের বার করা যায়না, মন্দিরের দরজায় লেগে যায় তাই সব আলাদা আলাদা রাখা হয়। আটচালার বাইরে এক এক করে এনে রাখা হয়, বাগদীপাড়ার ষন্ডা ষন্ডা লোকেরা বাঁশ দড়ি নিয়ে ঠাকুর নিয়ে যাবার মাচা বাঁধছে।
    মা দুগ্গাকে বাইরে আনতেই সবচেয়ে কষ্ট, অত বড় বড় লোকগুলোর ঘাম বেরিয়ে যায় এই ঠান্ডাতেও আর সবাই হাঁফাতে থাকে। বাইরে নিয়ে এসে ঠিক ঠাকুরপুকুরের ঘাটে যাবার মুখটাতে অনেকটা লম্বা মত খোলা জমি আছে সেখানে সবাইকে রাখা হয়। ওখানেই একপাশে দাদারে বোমার গাছ রাখে, ঠিক ভাসানের সময় গাছে আগুন দেয় আর ফট ফট করে কী ভীষণ শব্দে, বোমা ফাটতে থাকে। তার সঙ্গে উত্তাল ঢাকের আওয়াজ, আমি তো কান চেপে দুরে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।

    অন্ধকার হয়ে যায় সব ঠাকুর এনে রাখতে রাখতে। একজন দুজন করে মা কাকী জেঠী বৌদিরা আসতে শুরু করে, হাতে সিঁদুরের কৌটো থালায় নাড়ু। সব ঠাকুর এসে গেলে আবার মা দুগ্গাদের সবাইকে একসাথে করা হয় যেমন মন্দিরের মধ্যে ছিল, অবশ্য গয়না, হাতের অস্ত্র এইসব খুলে নেওয়া হয় আগেই। বামুন দাদামশাই এসে বরণ করে, ঘাটের ওখানটায় লাইন টেনে একটা মাত্র বাল্ব জ্বালানো, সেই আলোয় হয়না বলে অনেক হ্যাজাক জ্বালা হয়, এছাড়া পুকুরের পাড়ে তো আলো নেই। জেঠু বরণ করার পরেই মায়েরা সিঁদুর পরাতে আর নাড়ু খাওয়াতে শুরু করে ঠাকুরদের, আর ছোটোরা সবাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। আমিও ফুলদির হাত ধরে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে সব ঠাকুরদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। মজা লাগে এতদিন যে মন্দিরের ঠাকুরের ধারে কাছে যেতে দিতনা, এখন তাদেরই ছুঁতে পারছি অনায়াসে। একটু দুরে বাবা দাদারা দাঁড়িয়ে থাকে, আমিও ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, মায়েদের সিঁদুর খেলা দেখি। আবীরখেলার মত সবাই এ ওকে সিঁদুরে ভুত করে দেয়। আমি আবীরখেলার মতই সিঁদুরখেলাকেও ভয় করি, বাবার আড়ালে লুকিয়ে থাকি। ভাগ্যিস, দিদি ফুলদিকে ও দেখি কারা কপালে ধেবড়া টিপ পরিয়ে দিয়েছে!

    এরপরে বামুন দাদামশাই একটা থালায় চাল আর মোহর রেখে জেঠুর ধুতির কোঁচড়ে ঢেলে দেয়, একে বলে কনকাঞ্জলি। জেঠু সেটা নিয়েই মুখ ঢেকে বাড়ির দিকে চলে যায়, আর ঠাকুরের মুখ দেখবেনা। আর এরপরেই সবাই এসে "দুগ্গা মাঈ কী জয়" বলে চিৎকার করতে করতে ঠাকুরদের তুলে তুলে ঘাটের দিকে নিয়ে যায়, আমাকে বাবা যেতে দেয়না, জলের ধারে।
    ছোড়দা দাদারা রিন্টু কালু বিজু সবাই "দুগ্গা মাঈ কী জয়, আবার হবে আসছে বছর" বলতে বলতে ঠাকুরের সঙ্গে যায়। বাগদীদের একটা লোক ঠাকুরের শোলার মুকুটগুলো খুলে নেয়, এগুলো নাকি ওরা নিয়ে যায় ওদের শেতলা পুজোর জন্যে।
    আমি বাবা জেঠুদের সাথে এসে মন্দিরে বসি, মায়েরা বাড়ীর দিকে যায়, সব বিজয়া করতে আসার পালা শুরু হবে, নাড়ু মিষ্টি সব গুছিয়ে রাখতে হবে। মন্দিরের দালানে একটা কম্বল পেতে বামুন কাকা আর পঞ্চুদাদামশাই বসে। ওদের পাশে ডাঁই করে রাখা সবুজ লতা, অপরাজিতা। ঢাকীরা প্রথম উঠে আসে ঘাটের দিক থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে তার পেছন পেছন সবাই জল নিয়ে, সবার মাথায় বিসর্জনের জলের ছিটে দেয়। বাড়ির সব বড়রা মাথায় জল নিয়ে এক এক করে দাদামশাইয়ের কাছে যায়, দাদামশাই অপরাজিতা বাঁধেন হাতে। ছোট ছেলেদের হাতে বামুন কাকা বাঁধে। অপরাজিতা বেঁধেই সবাই খালি মন্দিরে বসে দুগ্গার পাটার ওপর কাগজ রেখে লাল কলম দিয়ে আয়ব্যয় লেখে। আয়ব্যয় মানে আমি আগে ভাবতাম মা যেমন খাতায় সংসারের হিসেব লেখে, জমা খরচ তাই বোধহয়। কিন্তু আসলে ওরা সব একশ আটবার গণেশায় নম লেখে। রিন্টু কালুরা তো আবার ফাঁকিবাজী করে কুড়িবার লিখেই ছেড়ে দেয়। আমার খুব রাগ হয় মেয়েরা এসব করেনা তাই, আমায় লিখতে দিলে আমি ঠিক একশ আটবারই লিখতাম!

    এরপরে ব্রজরাজের মন্দিরের ভেতরে সব ছেলেরা গোটা সুপুরি হাতে করে অষ্টোত্তর শতনাম শোনে। আমরা মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি নাম শোনা শেষ হল কিনা, নাহলে বিজয়ার প্রণাম শুরু হবেনা। শেষ হলেই বাবারা বাইরে এসে মন্দিরের সামনেই কোলাকুলি করে আর আমি এক ছুট্টে বাড়ী গিয়ে মা কে জেঠাইকে প্রণাম করি, দিদিও ফুলদিও। তারপরে বাড়ীতেই বসে থাকি বাবার আসার অপেক্ষায়। বাবা মাকে প্রণাম করে তবেই আমরা বেরই অন্যদের প্রণাম করতে। সব দলে দলে যায়, মাঝে মাঝে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের দেখা হয়ে যায়, কোন বাড়ীতে কি দিচ্ছে জানা হয়।

    অনেক রাত অবধি প্রণামের পালা চলে। এইসবের মাঝেই পুজোর শেষ দিনটাও শেষ হয়ে যায়। পরের দিন সকাল থেকেই যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সকাল থেকে নানা লোকের যাতায়াত, লক্ষ্মীকাকা ভোরবেলাতেই চলে আসে। গোছগাছের মাঝে জেঠাইমা কাকীমারা এলেই মাকে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দেয়। বাবা দেখতে পেলেই বলে "আরে আবার তো আসা হবে, কোন আর দুরে যাচ্ছি"। আমি জানি আর এখন আসা হবে না, সেই কত দিন পরে আবার একটা পুজো এলে তবেই আসব আমরা!
    বেলার দিকে ড্রাইভার কাকা এসে যায় গাড়ী নিয়ে।
    ফুলদি আমার হাত ধরে বাইরের দিকে নিয়ে যায়, আমরা ভাল করে পুকুর বাগান গাছগুলোকে দেখে নি এবছরের মত শেষ বার। দু চারটে পাতাও তুলে নিই আমার প্রিয় কাঁঠাল গাছটার। খাওয়া দাওয়া শেষে জেঠাই আমাদের তৈরী করে, চোখে জল, শুধু শুধু থুতনি ধরে ধরে চুমু খায়।
    গাড়ীতে ওঠবার সময় সারা পাড়া এসে জড়ো হয়। সব মন্দিরে গিয়ে গিয়ে প্রণাম করি, বড়দেরও। মা বড়জেঠুকে প্রণাম করতেই জেঠু মায়ের মাথায় হাত রেখে বলে, "আজ সত্যিই আমার দুগ্গামা চলে যাচ্ছে লক্ষ্মী সরস্বতী কাত্তিক গণেশদের নিয়ে, আমার বাড়ী ফাঁকা করে। এবার একটু তাড়াতাড়ি এস মা, কবে চলে যাব তার আগে মাকে যেন দেখি"। মা এতক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ে জেঠাইমা ধরে ধরে গাড়ীতে তোলে। আমি এবার মায়ের কোলে, দিদি দাদাও যাচ্ছে তাই সীটে বসতে পাইনা।
    সবাই ফিরে ফিরে হাত নাড়াতে নাড়াতে গাড়ী কখন পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যায়, আমি তখনও হিসেব মেলাতে ব্যস্ত, ফুলদি দিদি লক্ষ্মী সরস্বতী না আমি ফুলদি?
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন