এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • মরাচৌ সাক্ষাৎকারসমগ্র

    বাঘু
    অন্যান্য | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ৪১৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • * | 208.5.***.*** | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২১:১৭628081
  • (মলয় রায়চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ‘স্বপ্ন’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক কুমারবিষ্ণু দে । সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল মলয় রায়চৌধুরীর তৎকালীন বাসা কলকাতার নাকতলার ফ্ল্যাটে ১৮ জুন ২০০৭ এবং ‘স্বপ্ন’ পত্রিকার শারদ ১৪১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল । এটি ছিল পত্রিকাটির বিশেষ মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যা ।

    ঋণস্বীকার: সম্পাদক, স্বপ্ন পত্রিকা,নবীনচন্দ্র কলেজ, ডাক: বদরপুর, অসম ৭৮৮৮০৬ । মোবাইল নং ০৯৮৬৪৯০৮৭৯৯)

    সাক্ষাৎকার: মলয় রায়চৌধুরী
    ডিসেম্বর 2, 2012শিকড়সাহিত্যের খবরমন্তব্য দিন

    ডক্টর দে: একজন লোক কেন লেখে ? কেন ?
    malay_roy_choudhury[1]
    মলয়: সবাই একই কারণে লেখেন না । প্রতিটি লেখা একই কারণে রচিত নয় । একই লোক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়েসে একই কারণে লেখেন না । আমার মনে হয়, আমি লেখালিখি শুরু করেছিলুম প্রাকযৌবনের উচ্ছৃঙ্খল সাহিত্যপাঠ, বঙ্গসংস্কৃতিতে আউটসাইডার-বোধ, পারিবারিক গোঁড়ামি, সাবর্ণ চৌধুরী ক্ল্যানের সীমালঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে ।
    আমি যে কেন লিখি, এই অমূলক প্রশ্নটা আমার কোনো ভারবাহী জিঞ্জাসাবোধের অন্তর্গত ছিল না যদিও, একটি দার্শনিক সমস্যা হিসাবে প্রতিনিয়ত আমাকে এমনভাবে চিন্তিত রেখেছে যে, প্রশ্নহীনতা, চিন্তাহীনতা, এমনকি চেতনাবোধ গুলিয়ে ফেলেও, আমার লেখার সম্ভাবনা থেকে, লিখিত পাঠবস্তু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার, কোনো সদুত্তর পাই না । আমার মধ্যে আমার লেখার প্রক্রিয়াটি নিজে, ওই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর । আমি কেন লিখি, এই সমস্যাটি, সারাজীবন একই দার্শনিকতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না , কেন না, একজন মানুষের মানসিক অবস্হানগুলোর সুস্পষ্ট জলবিভাজন থাকে না ।
    যাঁরা মার্কসবাদী, গান্ধিবাদী, রামকৃষ্ণ অথবা শ্রীঅরবিন্দে বিশ্বাসী, কিংবা রাজ্য সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন, তাঁদের, মনে হয়, এই সমস্যাটির হাঙরের হাঁ-মুখে পড়তে হয় না । লেখালিখিটা যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা তো জানেজই কেন লিখছেন; তাই বলে আমি মনে করি না যে তাঁদের নিজস্ব অবস্হানের জন্যে তাঁদের অশপদ্ধা করতে হবে ।

    ডক্টর দে: আপনি কি হিন্দু ?

    মলয়: হ্যাঁ, আমি হিন্দু । কিন্তু একেশ্বরবাদ ও অরগ্যানাইজড রিলিজিয়নে বিশ্বাসী নই । আমি প্রকৃতিকে ডিভাইন বলে মনে করি । প্যাগান হিন্দুর মতো জল, আলো, বাতাসকে ডিভাইন মনে করি । তাদের নিয়ে কবিতা লিখি না ।

    ডক্টর দে: আপনি হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারে বলেছেন ‘ঈশ্বরের মৃত্যুসংবাদ অনেক-কাল আগেই পেয়ে গেছি, এখন আমিই আমার নিয়ন্ত্রক ও কর্ণধার । এখানেই কবিতার শুরু ।’ বিষয়বক্তব্যকে একটু সহজ করে বলুন ।

    মলয়: ব্যাপারটা বুঝতে হবে দেশভাগোত্তর বাঙালির উত্তর-ঔপনিবেশিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে, যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হল । ইউরোপে রেনেসাঁসের হর্ষোল্লাসে ঈশ্বর প্রণীত নিয়ম-শৃঙ্খলার ভাঙনকে মুক্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, এবং ঈশ্বরের সিংহাসনে বসানো হয়েছিল ব্যক্তি-মানুষকে । পরিবর্তনটি ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছিল মানব-সমাজে; প্রথমে ইউরোপে, এরপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ যে ভূখণ্ডে গেছে, সেখানে । প্রতিটি ঊপনিবেশে সেখানকার দেবী-দেবতা ও আরাধ্য ইষ্টকে মেরে ফেলতে ইউরোপ যে সফল হয়েছিল শুধু তাই নয়, সেসমস্ত দেশের ইউরোপীয় মূল্যবোধ প্রভাবিত ভূমিপুত্রদের মধ্যে এই চিন্তাচেতনাকে ইতিবাচক গরিমা দিতে পেরেছিল । তার আগে প্রতিষ্ঠা দেবার জণে ব্যক্তি-মানুষকে বলা হত দেবতুল্য, সাক্ষাৎ ভগবতী ।
    ওই নবজাগৃতির ভাবকল্পটি ঈতিহ্যগত প্রভূত্ববাদের জায়গায় ‘জোর যার সত্য তার’ এই আধিপত্যবাদকে যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা, ব্যক্তি-এককের ক্ষমতা প্রয়োগের আহ্লাদ ইত্যাদি তর্ক দ্বারা ন্যাজ্যতা দেবার প্রতিপাদ্য গড়ে তুলেছিল, যা শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে আধুনিকতাবাদকে চাপিয়ে প্রকৃতির সৃষ্টিগত জটিলতা ও সমগ্রতা থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল ।
    প্রাক-ঔপনিবেশিক বঙ্গসমাজে তাই প্রকৃতি-সংস্কৃতি বাইনারি অপোজিশান ছিল না । বাংলায় প্রকাশিত প্রথম হাংরি ম্যানিফেস্টো দ্যাখো । এই আরণ্যকতার উল্লেখ আছে । ওই বাইনারি অপোজিশান বা বলা যায় সব রকমের বাইনারি অপোজিশান বর্জন করেই কবিতা লেখার কথা বলেছিলুম ।

    ডক্টর দে: আপনি বলেছিলেন আত্মার ইরিটেশা থেকে হাংরি কবিতার জন্ম । ‘আত্মার ইরিটেশান’ ভাবকল্পটা একটু সহজ করে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে কঠিনতা দূর হয় ।

    মলয় : ঝিনুকের মধয়ে বালুকণা ঢুকলে যে ইরিটেশান হয়, তার দরুন মুক্ত তৈরি হয় । কবি যেহেতু সর্বব্যাপী এবং নিজেকে নিজে জানেন, তাই আত্মা শব্দটা প্রয়োগ করেছিলুম । আরো জানার প্রক্রিয়া থেকে ইরিটেশান হয়, যার দরুন বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানে প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটান । হাংরি আন্দোলনকারীরা প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটাবার চেষ্টা করলেন সাহিত্যে ।

    ডক্টর দে: আপনার কবিতাকে কেন হাংরি বলা হবে ?

    মলয়: কেননা আমি কবিতা থেকে কিচ্ছু বাদ দিইনি । কবিতা হাঁ-মুখে ছিল সবই গ্রাহ্য । অমুক হলে কবিতা হবে না, তমুক হলে কবিতা অসফল, এই ধরনের তর্ক সদ্য উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলায় মনে হত বুদ্ধিহীন ।

    ডক্টর দে: ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতায় কিসের ক্ষুধার কথা বলা হয়েছে ?

    মলয়: কবিতাটা নিজেই তার হাঁ-মুখে জীবন, যৌবন, মৃত্যু, যৌনতা, প্রেম, বাবা-মা, সমাজ, সময়, ইতিহাস সবাইকে পুরে নিতে চাইছে । এবং তা দ্রুতি- আক্রান্ত ।

    ডক্টর দে: আন্দোলনের জন্য ইংরেজি ‘হাংরি’ শব্দটা ব্যবহার না করে ‘ক্ষুধার্ত‘ শব্দটা ব্যবহার করলে কি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সঠিক শক্তি পাওয়া যেত না ?

    মলয়: না । ক্ষুধার্ত শব্দটায় ব্যক্তির আর্তির লেজুড় রয়েছে । ব্লান্ডার হয়ে যেত । শক্তি চট্টোপাধ্যায় করেছিলেন ‘ক্ষুৎকাতর’; তাও গ্রাহ্য হয়নি । হাওয়া খাওয়া, পালটি খাওয়া, লাথি খাওয়া, গোঁত্তা খাওয়া, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদির মজা ওই আর্তি বা কাতরতায় নষ্ট হয়ে যায় । খাওয়া তো সর্বগ্রাসী ।
    এতদিনে হাংরি শব্দের উৎস-সূত্র আর দার্শনিক প্রেক্ষাপট জেনে গেছ নিশ্চই । না খেতে পেয়ে মরা বা যৌন ক্ষুধার সঙ্গে হাংরিকে সম্পর্কিত করেছিলেন প্রধানত সাংবাদিকরা ।
    হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে । উনি কালখণ্ডকে হাংরি রুপে চিহ্ণিত করেছিলেন ।
    ওই সময়ে আমি হাতে পাই অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট । স্পেংলার বলেছিলেন যে সমাজ-সংস্কৃতি হল জৈব প্রক্রিয়া । তা যখন কেবল নিজের সৃজন-ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করে, তার নিত্য-নতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু তার অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় জখন তার নিজের স্ফূরণ-ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে; তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । অথাৎ তখন সমাজ-সংস্কৃতিটি হাংরি । আমার মনে হয়েছিল, দেশ-ভাগোত্তর বঙ্গসমাজ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় ।
    হাংরি আন্দোলন ছিল এই চিন্তাভাবনার ফসল । ‘সম্প্রতি’ পত্রিকায় ১৯৬২ সালে এই কথাগুলোই নিজের মতন করে শক্তিদা বলেছিলেন । প্রশ্ন হল যে পরে কোনো-কোনো আন্দোলনকারী হাংরি শব্দের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তা খুবই স্বাভাবিক । বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঁকবদলকারী আন্দোলন, যার খবর পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সব আলো আমার ওপর এসে পড়ছিল । তাই আন্দোলনের মধ্যেই প্রত্যেকে নিজস্ব পরিসর গড়তে চেয়েছেন । প্রচার চেয়েছেন ।

    ডক্টর দে: হাংরি আন্দোলনের কবিরা যে ক্ষুধার কথা বলতে চেয়েছেন সেটা অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না । এতে আপনার অভিমত কি?

    মলয়: একটু-আধটু পড়াশোনা না করলে বোধগম্য না হতেই পারে । অনেক পাঠকই লেখকের ক্ষুধা খুঁজে মরেন, যখন কি না ক্ষুধাটা ডিসকোর্সের ।

    ডক্টর দে: হাংরিয়ালিজমের সঙ্গে ডাডাইজম এবং সুররিয়ালিজমের পার্থক্য কী ?

    মলয়: ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম হল সময়-তাড়িত চিন্তাতন্ত্রের ফসল, জুডিও-ক্রিশ্চিয়ানিটির ফসল । হাংরিয়ালিজম হল পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রের ফসল, বহুত্ববাদী ভাবনার ফসল । ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম লেখককে তার মস্তিষ্ক থেকে আলাদা করে ভেবেছে । হাংরিয়ালিজম লেখককে একলেকটিক বলে মেনে নিয়েছে । ডাডাবাদী-পরাবাস্তববাদীরা জন্মেছেন আর্ট ফর আর্ট সেক-এর পৃষ্ঠপটে, তাই ভাঙচুর করছেন । হাংরিয়ালিস্টরা ‘আর্ট’ কনসেপ্টটাকেই আক্রমণ করেছেন ।

    ডক্টর দে: কোনো একটি কবিতা যে হাংরি সেটা বোঝার জন্য কোন বৈশিষ্ট্যগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ? সাধারণ পাঠক কী করে বুঝবেন যে কবিতা-বিশেষটি হাংরি ?

    মলয়: সাধারণ পাঠক কি আর কবিতা পড়েন ? মনে হয় না । পাঢবস্তুটি যদি সাহিত্যের তদানীন্তন উর্ধ ও নিম্ন সীমাগুলো লঙ্ঘন করে, তাহলে টের পাওয়া যেতে পারে । শৈলেশ্বর, প্রদীপ, ত্রিদিব, সুবিমল, দেবী, সুবো, ফালগুনী, উৎপল, সমীর, আমার ওই সময়ের কবিতা পড়ো । মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির কবিতা, বিষয়কেনদ্রহীন, শিরোনাম দিয়ে বিষয় চিহ্ণিত হয় না, শব্দের ও ছন্দের যথেচ্ছাচার, লজিকাল সিকোয়েন্স বর্জিত, গুরুচণ্ডালি ভাষা, ইন্দ্রিয় পালটা-পালটি, প্রতীক বর্জিত, ছেঁড়া চিত্রকল্প ইত্যাদি । অথাৎ পাঠবস্তুটি বিবেচ্য, লেখক নন ।

    ডক্টর দে: এমন অনেক কবিতা হাংরি-পরবর্তী কালে রচিত হয়েছে যেগুলোর মধ্যে যৌন শব্দ, অশ্লীল শব্দ, নতুন শব্দ, নিম্নশ্রেণির শব্দ, অশ্লীল উপাদান, ঘৃণ্য জীবনবোধ ইত্যাদি পাওয়া যায় । সে-ধরণের কবিতাকে কী হাংরি প্রভাবিত কবিতার পর্যায়ে ফেলা যায় ? অথবা অনেকেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, হাংরি আন্দোলন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, কিন্তু দেখা যায় হাংরি কবিতার বৈশিষ্ট্য তাঁদের লেখায় রয়েছে । সেগুলোকে কি হাংরি কবিতা বলব না ?

    মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময় কাল ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ । ফলে স্বাভাবিক যে তার পরের অনেক কবি প্রভাবিত হবেন । আগের প্রশ্নের উত্তরে যে বৈশিঢ়্ট্যের কথা বললুম সেগুলো যদি থাকে তো অস্বিকার করার কারণ দেখি না । উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরার আনেকে নকশাল আন্দোলনের পর নিজেদের হাংরি ঘোষণা করেছেন । আমি তাঁদের চিনি না, দেখিনি । এটাই তো হাংরির সাফল্য ।

    ডক্টর দে: আপনি ১৯৬৫ সালে পালামৌতে সম্বর্ধনায় লেখা ইংরেজি বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমি কবিতাকে জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাই” । পেরেছেন কি ?

    মলয়: না, পারিনি মনে হয় । বঙ্গসমাজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে, কবিতাহীন হয়ে গেছে । বাজার হয়ে উঠেছে প্রধান ডিসকোর্স । ফলে কবিতা প্রক্রিয়াটাই আজ কাউন্টার-ডিসকোর্সের চেহারা নিতে বাধ্য হয়েছে । কবিরা যেন গোপন সমিতির সদস্য । তার বাইরে বেরোলেই ঢুকতে হবে বাজারা । এখন কবিরাই শুধু কবিতা পড়ে । সে-সময়ে রাজনীতিকরাও কবিতা পড়তেন ।

    ডক্টর দে: সমস্ত লেখকই লেখার শুরুতে প্রতিষ্ঠান আঁকড়ে ধরতে চান । তার কারণ প্রচারমুখিতা ।ঔ যে যত প্রচারিত সে তত সার্থক বলে মনে করা হয় । তাহ।এ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব না-পাওয়াই বোঝায় । আপনি কি বলেন ?

    মলয়: এসটাবলিশমেন্ট ও অ্যান্টিএসটাবলিশমেন্ট শব্দদুটো বঙ্গসমাজে আমিই প্রথম এনেছিলুম । দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতালোভী বামপন্হীরা শব্দ দুটোর সঙ্গে আনন্দবাজারকে গুলিয়ে দিয়েছিল । মনে রাখতে হবে যে আমরা নাড়া দিতে চেয়েছিলুম প্রশাসনকে, যে অক্টোপাসের একটা আঁকশি ছিল আনন্দবাজার । এখন অন্য আঁকশিগুলোকে গণশক্তি, বাংলা আকাদেমি, তথ্যসংস্কৃতি বিভাগ, নন্দন, আলিমুদ্দিন, মহল্লা কমিটি, পঞ্চায়েত ইত্যাদি দিয়ে সহজে চিহ্ণিত করা যায় । এখন এসটাবলিশমেন্ট আরও ভয়ংকর । তার চাই লাশের পর লাশ ।
    রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠান শব্দটার বদলে অচলায়তনের কথা বলেছিলেন । আমাকে নিয়ে মুর্শিদ এ. এম. যে-বইটা প্রকাশ করেছেন, তাতে কলিম খান তাঁর রচনায় গৌতম বুদ্জধ, শংকরাচার্য, রবীন্দ্রনাধ প্রমুখকে বলেছেল প্রতিষ্ঠানবিরোধী ।
    যাঁরা লেখালিখির ব্যবসায় ঢুকতে চান তাঁদের জন্যে আনন্দবাজার জরুরি । যাঁরা সরকারি পুরস্কারের জন্যে লালায়িত তাঁরা গণশক্তি পত্রিকায় ঢুকতে চান । প্রচারিত হন তাঁরা । কিন্তু বেশিরভাগই হারিয়ে যান । সকলে ওসব জায়গায় ঢুকতে চায় না, কেউ-কেউ চায় । প্রধানত অন্য ভালো চাকরি জোটা না বলে । তাছাড়া প্রচারের আলোয় থাকার জন্যে অবিরাম লেখা-ব্যাপারটার ঘানি ঘোরাতে হয় । প্রতিষ্ঠান য়ভক্তি-এককের মূল্যবোধ নষ্জট করে । অক্টোপাস তাকে যে আঁকশি দিয়েই আঁকড়ে ধরুক না কেন ।

    ডক্টর দে: আমরা জানি হাংরি আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী । এমন কি, প্রতিষ্ঠানের পত্রিকাব যাঁরা লিখতেন তাঁদেরও কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে বুলেটিনগুলোয় লিখতেন । তাহলে স্বীকার করতে হয় এই আন্দোলোনটাই একটা প্রতিষ্ঠান । আপনি স্বীকার করেন কী ?

    মলয়: অক্টোপাসের কোনো আঁকশির ক্ষমতাই হাংরি আন্দোলনের ছিল না । শক্তিকে আনন্দবাজারের আঁকশি ধরেছিল,উৎপলকুমার বসুকে এখন ধরেছে । সুভাষ আর বাসুদেবকে ধরেছিল সিপিএমের আঁকশি । সুবিমল সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিয়েছে । তাতে হাংরি আন্দোলনের স্ট্রাকচার এবং কাউন্টারডিসকোর্সে রদবদল হয় না । সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেকেও অনেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন । আর কীর্তি হিসেবে উৎপলের ‘পুরী সিরিজ’ ও শক্তিদার ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ’ এবং বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ তাতে ক্ষুন্ন বা বাতিল হয় না । সাহিত্যিক কাজ য়্যাপারটা প্রতিষ্ঠানের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এখন প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসায়ী বটে — আনন্দবাজার ও সিপিএম দুটিতেই— এবং আমি তাঁর সমালোচনা করি । কিন্তু কৈশোরকালীন সম্পর্কের দরুন তাঙকে শ্রদ্ধা করি । ওই সম্পর্কের কারণে উনি আমার পক্ষের সাক্ষী ছিলেন; যখন কি না শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ দিয়েছিলেন ।

    ডক্টর দে: আধুনিকতা ব্যাপারটা আপনার মতে “একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর” । কী ভাবে ?

    মলয় : ‘মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর ‘গ্রন্হে ‘ধ্রুপদী জোচ্চোর’ শিরোনামে আমার কবিতাটা পড়েছ কি ? ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে ‘আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা’ নামে আমার একটা বই বেরিয়েছিল । ওদের ওয়েবসাইটে দেখলুম এখনও পাওয়া যায় । মডার্ন, মডার্নিটি, মডার্নিজম কিন্তু একই ব্যাপার নয় ।
    বঙ্গীয় আধুনিকতা প্রসারিত হয়েছিল ঔপনিবেশিকতার স্ফূরণরূপে । স্বাভাবিক যে উত্তর-ঔপনিবেশিকতায় তার আদল-আদরা পালটাবে । ইউরোপে ঠিক যে-ভাবে ও যে-কারনে আধুনিকতার উদ্ধব ও প্রসার ঘটেছিল, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সে-ভাবে ও সে-কারণে তা ঘটেনি । আমাদের অভিধানে তাই আধুনিকতার অর্থ বর্তমানকালীন, সাম্প্রতিক, হালের, অধুনাতন, নব্য । আসলে, আধুনিকতা হল জীবনের একটি ফর্ম, পরিবর্তিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, সামাজিক বিন্যাসের কাঠামো । অন্যরকম আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ, আদান-প্রদানের জীবন উদ্ভূত হয়েছিল, এবং হোতারা তাকে ইতিবাচকতা দিয়েছিলেন ।
    জ্ঞান ব্যাপারটা অটীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ওই জীবনবোধে, যা থেকে বিশেষজ্ঞদের আবি্র্ভাব । বিজ্ঞানের এক বিশেষ দৃষ্টি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল জ্ঞান সম্পর্কে অমন ধারণা । এখন তাকে বলা হচ্ছে রিডাকশানিজম বা খণ্ডবাদ । অমন জ্ঞান না থাকাকে আধুনিকতা মনে করেছে মূর্খতা, অর্থাৎ তা খারাপ, অনৈতিক, অজ্ঞতা, আনকালচার্ড । আধুনিক বিজ্ঞানকে তুলে ধরা হয়েছিল একটি সর্বজনীন, মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ জ্ঞান-কাঠামো হিসেবে, এবং মেনে নেয়া হয়েছিলযে ব্রহ্মাণ্ড, জীবন ও সমস্ত কিছু সম্পর্কে তা শেঢ় কথা বলে দিতে পারে । এই যান্ত্রিক প্যারাডাইম বা খণ্ডবাদকে ইউরোপ প্রয়োগ করেছিল সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে; নিজেদের আধিপত্যকে বৈধতা দেবার স্বার্থে । সাম্রাজ্যবাদ, খণ্ডবাদ, আধুনিকতাবাদ, বিজ্ঞানবাদ সবই চলেছে হাতে হাত মিলিয়ে ।
    ওই ইউরোপীয় প্যারাডাইমটার জ্ঞানতাত্বিক, এমনকি তত্ববাদী অনুমানগুলো, সমরূপতা বা একরূপতার ধারণার ওপর নি্র্যরশীল, যা মনে করে যে, তাবৎ নিয়ম, ব্যবস্হা, প্রণালী, কাঠামো ইত্যাদির বুনিয়াদি উপকরণগুলোর মধ্যে পার্থক্য নেই । আধুনিক কবিতার প্রতিপাদকরা এই খণ্ডবাদী দর্শনের পথটিকে সমস্ত কবিদের ক্ষেত্রে অবশ্যমান্য করতে চেয়েছে, বেঁধে দিতে চেয়েছে সমরূপতার অনুশাসন, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী শর্ত অনুযায়ী । জোচ্চুরি ছাড়া আধিপত্য হয় না । তুমি ভেবে দেখো, কেন বহুকাল পর্যন্ত নজরুল আর জসীমুদ্দিনকে একঘরে করে রেখেছিলেন ওই হোতারা । ভাগ্যিস নজরুল মারা গেলেন বাংলাদেশে ।
    খণ্ডবাদের অধিযান্ত্রিক উপমাগুলো প্রকৃতি ও সমাজকে, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক স্তরে পুনর্গঠন করেছে নিজেদের স্বার্থে । প্রকৃতির ওপর আরোপ করা হয়েছে যান্ত্রিকতার মেটাফর, যেহেতু তা বিভাজন-সহায়ক এবং স্বকার্যে প্রয়োগযোগ্যতার অনুমানে ভর করে দাঁড়ায় । পক্ষান্তরে, জৈব মেটাফরগুলো মনে করেছে যে পরস্পর-নির্ভরশীলতা এবং আদান-প্রদানের দ্বারা ক্ষমতার বিন্যাস হোয়া দরকার । বাস্তবজগত একটি জীবন্ত ব্যাপার । এই জীবন্ত ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে খণ্ডবাদ থেকে চাগিয়েছে আর প্রশ্রয় পেয়েছে সন্ত্রাস । বহু আদর্শকে আধুনিকতা মানবসমাজে এনেছিল, এবং সেগুলোকে প্রতিষ্ঠা দেবার প্রধান উপায় করা হয়েছে সন্ত্রাসকে ।

    ডক্টর দে: দীর্ঘদিন লেখা থেকে বিরতি ঘটিয়ে যখন দ্বিতীয়বার লেখারজগতে ফিরে এলেন, তখন আপনি বলেছিলেন, নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে করি না । কেন? ক্ষুধার্ত প্রজন্মের স্রষ্টা আপনি । তার মানে ক্ষুধা শেষ ? যখন আন্দোলন করেছিলেন, তখনও কি ক্ষুধা ছিল না? কিন্তু অনেকেরি যে ক্ষুধা ছিল এবং রয়েছে ?

    মলয়: তুমি আবার পেটের খিদের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে গুলিয়ে ফেলছ । আমলাশোল আর ডুয়ার্সে চাষি আর মজুররা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে বলে সরকারের তুলোধুনা করব । নিজেকে ক্ষুধার্ত বলতে যাব কেন? হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যারা সিপিএমের ছত্রছায়ায় ঢুকেছিল—যেমন সুভাষ, বাসুদেব, শৈলেশ্বর— তারাই এই গোলমালটা বাধিয়েছে । দিব্বি চাকরি-বাকরি করে আরামে থেকেছে আর নিজেদের বলেছে সর্বহারা ।
    নিজেকে সেই সময়ে হাংরি আন্দোলনকারী বলতুম, ক্ষুধার্ত বলতুম না । তাছাড়া, নিজেকে ক্ষুধার্ত মনে না করার বহুবিধ কারণ আছে । যেমন, যাঁরা মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হলেন (সুভাষ ও শৈলেশ্বর), তারাই ‘ক্ষুধার্ত’ নামে পত্রিকা বের করতেন । তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা, মূল্যবোধের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই । অনুপম মুখোপাধ্যায়ের রিভিউ পড়ে জানতে পারলুম, আমার নামে তাতে জাল প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে ।
    যাঁরা নিজেদের ক্ষুধার্ত বললেন তাঁরা শাসকদল ও তার শিক্ষক সংগঠনে ঢুকলেন । হাংরি আন্দোলনকারীর তো অচলায়তন ভাঙার কথা । তারা তাতে ঢুকে আশ্রয় নেবে কেন? এটা তো জোচ্চুরি । আত্মসন্মানবোধহীনতা ।
    উত্তরবঙ্গ আর ত্রিপুরায় অনেকে ক্ষুধার্ত ঘোষণা করেছিলেন নিজেদের । দেখলুম তাঁদের চেয়ে আমি সব ব্যাপারেই আলাদা । অভিজ্মতা ও ভাবনাচিন্তায় তো বটেই । আবার যখন লিখতে আরম্ভ করলুম তখন চাকুরিসূত্রে সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়াচ্ছি, বিশেষ করে গ্রামে-গ্রামে ।

    ডক্টর দে: শিল্পকৃতির জন্যে আন্দোলন জরুরি নয়; শিল্পী ও ভাবুকদের মধ্যে অনেকেই নির্জনে সাধনা করার পক্ষপাতি ল কথাটা আপনি কতটুকু সমর্থন করেন ?

    মলয়: মন্দিরের আরাধ্যরা শিল্পকৃতি নন । তাঁদের উপড়ে চুরি করে ইউরোপ-আমেরিকায় কোটি-কোটি ডলারে বিক্রির পর তাঁরা হয়ে যান শিল্পবস্তু । অর্থাৎ তা থেকে ডিভিনিটি নিষ্কাশিত । শিল্প শব্দটা হল আর্ট শব্দের বাংলা, যে কনসেপ্ট এসেছে সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে চেপে ।
    কবিতা, উপন্যাস লেখার জন্যে আন্দোলন জরুরি নয়, এটা ঠিক । সে-সময়ে কাউন্টার কালচারাল মুক্তধারা বইয়ে দেবার জন্যে প্যারাডাইম শিফ্ট দরকার ছিল ।
    আর নির্জনে একা বা অনেকের মাঝে বসে যারা কখনও সাধনা ব্যাপারটা কী, তা জানার চেষ্টা করেননি, তাঁরা অমন মধ্যযুগীয় অভিব্যক্তি প্রয়োগ করতেন । আমি আচার্য রজনীস (তখন তিনি চন্দ্রমোহন জৈন ছিলেন), রামকৃষ্ণ আশ্রম, বালটিবাবা, মোহন্ত গোরখনাথ, গাঁজাপায়ী নিরক্ষর সন্ন্যাসী, সব সঙ্গ করে দেখে নিয়েছি । লেখা।লিখির জন্যে দরকার বিপুল অভিজ্ঞতা । জীবনানন্দ রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরতেন । রবীন্দ্রনাথ হিল্লি-দিলই করতেন । নানা এলাকার নানা রকম মানুষের সঠ্গে যত বেশি মেশা যায়, একজন লেখক ও ভাবুক তত বেশি সমৃদ্ধ হন । নির্জনে নয় ।

    ডক্টর দে: হাংরি আন্দোলন শুরু করার আগে বাংলা-সাহিত্যের কোন কবি-লেখকদের রচনা পড়েছিলেন ? মন্বন্তর,দেশভাগ, উদ্বাস্তু, দাঙ্গা, এগুলো হাংরি আনদোলনের ক্ষেত্রে আপনার চিন্তায় কতটুকু প্রভাব ফেলেছিল ?

    মলয়: আমি ভালো পড়ুয়া ছাত্র ছিলুম । বাবাকে আর দাদা সমীরকে বললেই বই কেনা যেত । চাকরি করতে ঢুকে বাড়ির জন্যে খরচ করতে হত না । বই কিনতুম আর অভিজ্ঞতা সংগ্রহে খরচ করতুম । তাই রবীন্দ্রনাথ আর শশধর দত্ত আকযোগে পড়েছি । গোগ্রাস পাঠক ছিলুম । বন্ধু-বান্ধব, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, দাদা ও দাদার কবি-বন্ধুদের মুখে নাম শুনলেই বই যোগাড় করতুম ।
    বই পড়ে বা লোকমুখে শুনে যে চিন্তা-প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে তার তুলনায় আভিজ্ঞতা-সঞ্জাত চিন্তা-প্রক্রিয়াকে আমি গুরুত্ব দিই । অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লিখলে তার লিটেরারি প্রেমাইস থাকে না । ছোটোলোকের ছোটবেলা, এই অধম ওই অধম, অভিমুখের উপজীব্য, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, নখদন্ত বইগুলো পড়লে তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে ।

    ডক্টর দে: একজন লেখক, কবি বা চিত্রকর যে হাংরি আন্দোলনের সহযোদ্ধা তা কী করে বোঝা যাবে ?

    মলয়: সহযোদ্ধা কথাটায় আমার আপত্তি আছে । ওটা যুদ্ধ ছিল না । বলতে হবে অংশগ্রহণকারী ।
    ম্যানিফেস্টোগুলোয় যাঁদের নাম আছে, কোনো না কোনো সময়ে, তাঁরা অঙশগ্রহণকারী ।
    হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, পলিটব্যুরো বা হাইকমাণ্ড ছিল না । তাই যিনি চেয়েছেন তিনিই নিজেকে অঙশগ্রহণকারী ঘোষণা করেছেন । যেমনঅরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, সেলিম মুস্তফা, রসরাজ নাথ, বিকাশ সরকার, অরুণ বণিক, জীবতোষ দাস, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নিজেদের হাংরি ঘোষণা করেছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার দেড়-দুই দশক পর । ফলে ইমপ্যাক্ট প্রমাণিত ।

    ডক্টর দে: শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই আন্দোলনকে বলেছিলেন সর্বগ্রাসী ? কেমন করে ?
    মলয়: একটু আগেই তো স্পেংলার ব্যাখ্যা করার সময়ে সে-কথা বললুম ।

    ডক্টর দে: দেবেশ রায় বলেছিলেন, “তত্ববিশ্বের ক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন ছিল নকশাল আন্দোলনের প্রথম ধাপ”। আপনার মন্তব্য কী?

    মলয়: উনি সরকারি মার্কসবাদী বলেই হয়ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে কথাটা বলে থাকবেন । কিউবায় কারোর ফুসকুড়ি হলে ওনারা মিছিল-মিটিং করতেন । আমার পুলিশি হেনস্হার সময়ে এগি্যে আসেননি । মার্কসবাদীদের মধ্যে একমাত্র তরুণ সান্যাল এসেছিলেন, পার্টির দাদাদের নিষেধ সত্বেও । আর যুগান্তর সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন কৃষ্ণ ধর ।

    ডক্টর দে: “বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার জটিলতা ও আস্পষ্টতার বিরুদ্ধে হাংরি আন্দোলনই ছিল প্রথম পরিকল্পিত বিদ্রোহ” । আধুনিকতার জটিলতা ও অস্পষ্টতা প্রাঞ্জল করে দিলে পাঠকের সামনে ধোঁয়াটে ভাব কেটে যাবে ।

    মলয়: আধুনিকতা সম্পর্কে ব্যাপারটাতো একটু আগেই ব্যাখ্যা করেছি । আর হাংরি আন্দোলন যে পরিকল্পনা করেই আমি দাদা, শক্তিদা করেছিলুম তা আজ সবাই জানেন ।

    ডক্টর দে: ব্যক্তিগতভাবে হাংরি আন্দোলন নিয়ে সে-সময়ে বিদেশি কাদের সঙ্গে আলোচনা হত ? আজকের দিনে হাংরি আন্দোলন বিষয়ে বিদেশিরা এখনও আলোচনা করেন কি।

    মলয়:আলোচনা ধরণের তেমন কিছু হত না । তবে, আন্দোলন আরম্ভ হবার পর দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড,অ্যালেন গিন্সবার্গ, জর্জ ডাউডেন, ওকতাভিও পাজ, ডেইজি অ্যালডান, আরনেস্তো কার্দেনাল প্রমুখের সঙ্গে । বহু লেখক-কবি-সম্পাদকের সঙ্গে যোপগাযোগ ছিল, যাঁরা ম্যানিফেস্টো, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন, যেমন লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, ডিক বাকেন, মার্গারেট র‌্যানডাল, এরিক মটর‌্যাম, জেরোম রোদেনবার্গ, বার্নে রসেট, ক্যারল বার্জ, কার্ল ওয়েসনার, রবার্ট কেলি, গর্ডন ল্যাসলেট, ড্যান জর্জাকাস, আইডা স্পলডিং, লেরয় জোন্স (হামিরি বারাকা), অ্যালান ডি লোচ, অ্যালেন ভ্যান নিউকার্ক, জেমস লাফলিন, ডায়না ডি প্রিমা, জর্জ বাওয়ারিং, পল ব্ল্যাকবার্ন, অ্যালেন হফম্যান, ক্লেটন অ্যাশলেম্যান, ক্যারল রুবেনস্টিন, অ্যার্মন্ড শোয়েনার, টেড বেরিগ্যান, রবের্তো হুয়ারোজ, লিটা হরনিক প্রমুখ । বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওনাদের আরকাইভে আমার চিঠি-কবিতা-ম্যানিফেস্টো যে সংরক্ষিত তা ‘গুগল’ সার্চ করলে পাওয়া যায় ।
    হাইকোর্টে মকদ্দমার অকল্পনীয় খরচ মেটাতে অনেকে লেখা ছাপিয়ে সাহায্য করতেন । এখানে কমলকুমার মজুমদার এবং অশোক মিত্র আই এ এস ছাড়া কেউ সাহায্য করেননি । কলকাতায় থাকার জায়গাও ছিল না ।
    হাংরিয়ালিজম বা আন্দোলনকারীর নামে নেট সার্চ করলে বোঝা যায় যে অবিরাম আলোচনা-মন্তব্য চলছে । বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় ।
    ওই সময়ে বেনারস-পাটনা-নেপালে বহু হিপি-হিপিনীদের সঙ্গেও সময় কাটিয়েছি, যাঁরা নেশা-যৌনতার যথেচ্ছচারী জীবন কাটাতে ইউরোপ,আমেরিকা, জাপান থেকে আসতেন । ওই সময়ের এক ঝলক আমি ব্যবহার করছি “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ।

    ডক্টর দে: কোন ধরণের কবিতা অমরত্ব পায় ? অর্থাৎ মৃত্যুর পর শত বছর পরও কোনো-কোনো কবিতা আমরা আবার পড়ি । কেন?

    মলয়: অমরত্ব ব্যাপারটা বলতে পারব না । বহু কবিতা অ্যাকাডেমিক চত্বরে পঠিত হব, অথচ জনমানস থেকে লোপাট হয়ে যায় । যেমন চর্যাপদ, শূন্যপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদাবলী সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, দৌলত কাজী-সৈয়দ আলাওল, মৈমনসিংহগীতিকা, ভারতচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, সবাই অমর । কিন্তু কলেজের বাইরে কেউ পড়ে না।

    ডক্টর দে: আমরা কবিতায় ‘আধুনিক’ শব্দটা প্রয়োগ করি । আসলে ‘আধুনিক’ শব্দটা কবিতার বেলায় কতটুকু প্রযোজ্য ? কবিতার আধুনিকতা প্রকৃতপক্ষে কী?

    মলয়: একট আগেই এ-বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলুম । বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ হলেন সাহিত্যের জলবিভাজক । তাঁর পূর্বের কবিদের পড়লে আমরা বুঝতে পারি লেখাগুলো প্রাগাধুনিক । তাঁর পরের কবিদের লেখা পড়ে বুঝি যে তা আধুনিক । অতএব শব্দটা যে প্রযোজ্য সে-ব্যাপারে সংশয় থাকা নিরর্থক ।
    “বদ্ধসূচনা ও বদ্ধসমাপ্তির মাঝে একটি স্বয়ংসম্পূর্ন ভাষা পরিসর যা একরৈখিক অন্তর্বয়নের মাধ্যমে যুক্তিক্রম মেনে নির্মিত, এবং যার বিষয় কেন্দ্রের মালিকানা কবির নিজস্ব, এবং শিরোনামের দ্বারা তিনি তা ঘোষণা করেন, অবশ্যই গৃহপালিত বাকমণ্ডল ব্যবহার করে”। আধুনিক কবিতার এরকম একটা সংজ্ঞা হতে পারে । আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ আধুনিক কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, “ইট শুড নট মিন, বাট বি” । দীপ্তি ত্রিপাঠী আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য বলার সময়ে যে পয়েন্টগুলো দিয়েছিলেন সেগুলো উত্তরআধুনিক কবিতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । ওনার সময়ে উত্তরআধুনিক বা পোস্টমডার্ন ব্যাপারটা আসেনি বলে ওনার বক্তব্য থেকে আমরা বঞ্চিত ।

    ডক্টর দে: কোন-কোন উপাদানের সাহায্যে বোঝা যাবে যে একটি কবিতা উত্তরআধুনিক?

    মলয়: দাদা সমীর রায়চৌধুরী উত্তরঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আধুনিক এবং উত্তরআধুনিক কবিতার তুলনামূলক তালিকা তৈরি করেছিলেন। সেটা দেখেও, তাহলে দুটোই স্পষ্ট হবে । সমীর চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক, যিনি “আংরি জেনারেশান রচনা সংকলন” বের করেছেন, তাঁর সঢ্গে আমার দাদাকে গুলিয়ে ফেলো না যেন।

    ডক্টর দে: অভিযোগমত হাংরি কবিতা যদি অশ্লীল হয়, তাহলে রামায়ণ, মহাভারত, গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মনসামঙ্গল অশ্লীল । কোনারক, খাজুরাহো, পুরীর মন্দির অশ্লীল । সাহিত্য-শিল্পে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ নিয়ে আপনার বক্তব্য চাইব । অশ্লীলতা বিষয়ক হাংরি বুলেটিনে যা বলা হবেছিল, তাছাড়া আর কোনো বক্তব্য আছে কি?

    মলয়: সনাতন ভারতবর্ষে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ যে ছিল না, তা তোমার উল্লেখ করা কাজগুলো থেকেই স্পষ্ট । সনাতন ভারতবর্ষে দেখা হত কাজটা রসশাস্ত্র-অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী হয়েছে কিনা । শৃঙ্গার-রস ব্যাপারটাই তো আদি রস ।
    দুর্ভাগ্যবশত আরবি-তুর্কি-আফগানি বিটকেল মূল্যবোধের প্রথম ঝাপটায় সনাতন ভারত ব্যাপারটা লোপাট হয়ে গেল । প্রচুর ভাঙচুর হল । তারপর এল ভিকটোরীয় খ্রিষ্টধর্মীর দল । যেটুকু বেঁচেছিল তা-ও গেল । ওরা অবসিনিটির আইন র্বিটেন থেকে আমদানি করে কী শ্লীল আর কী অশ্লীল তার র্খিষ্টিয় ফতোয়া দিতে লাগল । ওদের আনা মানদণ্ডের চাকর হয়ে গেল ভারতীয়রা । এত পুরু ঔপনিবেশিকতার চাদর জমে গেছে এদেশের চিন্তা-চেতনায় যে তা সহজে যাবার নয় । তার ওপর, সমাজে যারা ছড়ি ঘোরায়, তারা ইংরেজদের আদল-আদরায় নিজেদের সংস্কৃতিমান মনে করে । এঁরাই হাংরি আন্দোলনে অশ্লীলতা খুঁজে বের করেছিলেন ।

    ডক্টর দে: যৌনতা ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । মানুষের যৌনক্ষুধা বিলুপ্ত হয়ে গেলে অনেকটা জড়পদার্থে পরিণত হয়ে যায় । যৌনতা মস্তিষ্কগত, যে-কারনে পশুদের মত মানুষের যৌনতার ঋতু হয় না । বিজ্ঞানমতে যার যৌনশক্তি যত প্রখর, তার তত মেধার জোর, এবং সৃষ্টিশক্তি । তাহলে কাব্য-সাহিত্যে এর প্রকাশকে যাঁরা অপরাধ বলেন, তাঁরা কি ঠিক করেন?

    মলয়: তারা সব বাঁজা বা হিজড়ে ।

    ডক্টর দে: যারা রাজনৈতিক উগ্রপন্হী, তারা বিভিন্নভাবে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে । আমরা শুনেছি, হাংরি আন্দোলনকারীরা ইশতাহার বুলেটিন পোস্টার হ্যান্ডবিল পত্রপত্রিকা বই ইত্যাদি প্রকাশের বাইরে কিছু আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ করেছিলেন । যেমন, সম্পাদককে জুতোর বাক্স দিয়ে বলা হয়েছিল রিভিউ করতে; টপলেস যুবতীর প্রদর্শনী, সাদা কাগজ গল্প-সম্পাদককে দিয়ে বলা হয়েছিল ছাপাতে । বিয়ের কার্ডে কবিতা পাঠের নিমন্ত্রণপত্র তৈরি করা হয়েছিল । “মুখোশ খুলে ফেলুন” লেখা রাক্ষস, ও পশুর মুখোশ মন্ত্রীদের পাঠানো, মাইকেলের সমাধিতে-খালাসিটোলা-কেওড়াতলা শ্ঞশানে কবিতা পাঠের আয়োজন, বাঁকুড়ায় উলঙ্গ অবস্হায় নদী পারাপার, দুমকায় হাড়িয়ার হাঁড়ি বাজিয়ে দোলের সময় উদ্দাম নৃত্য, হিপিনীদের সঙ্গে নেশা ও যৌনতার বেনারসী-নেপালি অনাচার, গ্রন্হের দাম ১৪৪৩৫০০ টাকা রাখা বা ৫০টি টিয়ি সিল রাখা ইত্যাদি । এখন কথা হচ্ছে, হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যশিল্পে স্হিতাবস্হা ভাঙা । তা করতে গিয়ে এই সমস্ত কার্যকলাপ কেন? হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কার্যকলাপের সঙ্গে ডাডা আন্দোলনকারী এবং বিট জেনারেশানের কার্যকলাপের মিল খুঁজে পান আলোচকরা । তা কতটা সত্য? আমার মনে হয়, কেবল সাহিত্যশিল্প চর্চায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলে, হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা-মকদ্দমা-হেনস্হা হত না । অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহের অভিযোগে গ্রেপতার হতেন না । তখনকার সাহিত্যিক, রাজনেতা, প্রশাসক, সাংবাদিক, বণিকরা এবং সমাজের গণ্যমান্যরা বাধ্য হয়ে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা হয়, এবং কোর্টে ডাকাত ও খুনিদের পাশাপাশি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপমান ও কারারুদ্ধ করা হয় । অনেক ক্ষেত্রে আপনাদের এই কার্যকলাপকে বয়স্ক শরিকরা, যাঁরা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ছেড়ে হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, অন্তর দিয়ে সমর্থন করেননি, যতটা করেছিলেন সাহিত্যে সহিতাবস্হা ভাঙার আন্দোলনকে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ওগুলো সস্তায় নাম কেনার চেষ্টা । এই সমস্ত অভিযোগ সম্বন্ধে কী বলবেন ?

    মলয়: ডাডা আন্দোলনের ত্রস্তান জারা, মিশেল দুশঁ প্রমুখের প্রয়াস ছিল যুদ্ধোত্তর ইউরোপে শিল্পকৃতিকে রিডিফাইন করার প্রয়াস । অ্যালেন গিন্সবার্গ, উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ বিট আন্দোলনকারীরা ম্যাককার্থি-পরবর্তী রক্ষণশীল আমেরিকার দমবন্ধকরা আবহাওয়া কাটিয়ে খোলা হাওয়া আনতে চাইছিলেন । আমাদের কার্যকলাপ ছিল দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ে আক্রান্ত উত্তরঔপনিবেশিক বঙ্গসমাজের স্হিতাবস্হায় আঘাত দেয়া । অচলায়তনে ফাটল ধরিয়ে মুক্তধারাকে বের করা । কাগজ কলম নিয়ে ঘরে বসে তিনে কত্তে তিন হাতে রইল পেনসিল নয় ।
    হামাকে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে ডাকাতদের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটানো হল ।প্রদীপ চৌধুরী শান্তিনিকেতন থেকে রাস্টিকেট হল । উৎপলকুমার বসু যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হলেন । আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী চাকরি থেকে সাসপেন্ড হলেন । সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হল । কফিহাউসের সামনে লোহার রড, চেন, হকিস্টিক নিয়ে সুবিমলকে ঘিরে ফেলা হল । এগুলো থেকেই তো প্রমাণ হয় যে স্হিতাবস্হায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল ।
    ওসব কার্যকলাপে কেউ আতঙ্কিত হয়েছিল বলে তো শুনিনি । ভিরমি খেয়েছিল বা ঘাবড়ে গিয়েছিল বলা যায় । তখন পর্যন্ত বঙ্গীয় সাহিত্যিকরা ছিল “আর্ট ফর আর্ট সেক”-এর নৌকোয়, যা হাংরি আন্দোলনের ধাক্কায় ডুবে যায় । বঙ্গসমাজের পচনকে যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই শনাক্ত করেছিল, বামপন্হীরা নয়, তা এখনকার পশ্চিম বাংলার দিকে তাকালেই টের পাবে ।
    আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু ধান্দবাজি করে নাম কিনেছেন, এ-ব্যাপারে কিছু বললে বড় মুখে ছোট কথা হয়ে যাবে । ওনার গুণগ্রাহী বিশ্বব্যাপী । শক্তি চট্টোপাধ্যাব আনন্দবাজার চাকরি পাবেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেন । শৈলেশ্বর আর সুভাষ যে মুচলেকা দিয়েছিল তা বহু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে ।

    ডক্টর দে: আজকের এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি হাংরি আন্দোলন শুরুর কথা ভাবা হয়, তাহলে কীভাবে ভাববেন ? দর্শন ধার করার জন্য স্পেঢলারের ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ বইটির প্রয়োজন হবে কি ? নতুন দর্শন যুক্ত করার প্রয়োজন থাকলে কার দর্শন গ্রহনযোগ্য মনে করেন? প্রথম ইশতাহার শুরু করলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী হবে ? ধরা যাক, প্রথম হাংরি ইশতাহার প্রকাশ পাবে তাতে কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, দশফন, সাহিত্য, স্বাধীনতা, মানুষ, বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস, অর্থনীতি, ক্ষুধা, সংস্কৃতি, ছবি-আঁকা বিষয়ে আপনার অভিমত কি ১৯৬১-৬৫ সময়ের থেকে ভিন্ন হবে ?

    মলয়: আমার ‘পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন’ বইটার আর ‘প্রমা’ পত্রিকাব প্রকাশিত ‘উত্তরদার্শনিকতা’ নামের দীর্ঘ প্রবন্ধের জেরক্স তো তুমি নিয়েছ ? গভীরভাবে পড়লেই টের পাবে যে হাংরি বা ওই ধরনের আর কোনো কাউন্টার-কালচারাল আন্দোলন সম্ভব নয় । বিশ্ব এখন দ্রুতি-আক্রান্ত, প্রযুক্তি তাবৎ অনুমানকে ছাপিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ছে প্রতিটি সমাজের ম্যাক্রো ও মাইক্রো স্তর । যাবতীয় অ্যিধার ভাবসীমা হয়ৈ গেছে পরিধিহীন ।

    ডক্টর দে: আন্দোলনের শুরুতে সম্পাদনার দায়িত্ব, প্রচার ও প্রসারের জন্য হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়কে আবিষ্কার করেছিলেন । আজকের দিনে আন্দোলন শুরু করতে গেলে এই কাজের জন্য কাকে খুঁজে আনবেন? নেতৃত্বের জন্যই বা কোন অগ্রজকে চিহ্ণিত করবেন?

    মলয়: আর কোনো অমন আন্দোলন যে সম্ভব নয় তা তো একটু আগেই বলেছি । সাব-অলটার্ন কবি-লেখকরা আজ নিজের জোরে সাহিত্য-পরিসর গড়ে নিয়েছেন । তারাই বরং সংখ্যায় বেশি । তাঁরা এনেছেন নিজস্ব শব্দভাঁড়ার, অভিয়ভক্তি, ডিকশন, ভাষাবিন্যাস । এই মুহূর্তে কবিতায় অনিকেত পাত্র আর ফিকশানে অনিল ঘড়াইয়ের নাম মনে পড়ছে ।
    হাংরি আন্দোলনে আগে পর্যন্ত তুমি ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ ইত্যাদি পত্রিকা দ্যাখো । নিম্নবর্গের একজন কবির কবিতাও পাবে না, কেননা, ওই শ্রেণির ভাষাকাঠামো অভিজাত সম্পাদকের স্বকৃতি পেত না । ইউরোপ তখন ওনাদের মাথায় চেপে বসেছিল । হারাধন ধাড়া বললে ওঁর অবশ্য খারাপ লাগে, কেন জানি না । তাই পালটে করেছেন দেবী রায় । হয়ত ঠিকই করেছেন ।

    ডক্টর দে: ‘হাংরি’ এই যে অভিধা, তা একটি কবিতা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলে পাঠকদের সুবিধা হয় ।

    মলয়: তুমি ‘জখম’ কবিতাটাই নাও না । ওই কালখণ্ডের পুরো বঙ্গসমাজকে নিজের হাঁ-মুখে ঢুকিয়ে নিয়েছে পাঠবস্তুটা । তারপর পংক্তির পর পংক্ত উগরে দিয়েছে পাঠকের সামনে । ওই পাঠবস্তুটি তার সর্বগ্রাসী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তখনকার তাবৎ সাহিত্যিক অনুশাসনকে অস্বীকার করে কবিতা হয়ে উঠতে চেয়েছে । পাঠবস্তুটি তার হাঁ-মুখে পোরার জন্যে কোনো বাদবিচার করছে না । পাঠবস্তুটা সে-কারণে বিষয়বস্তুহীন, শিরোনাম দিয়ে বিষয় চিহ্ণিত হচ্ছে না । তার কোনো ব্রেকফাস্ট টাইম, লাঞ্চ টাইম, ককটেল টাইম, ডিনার টাইম, পর্ব নেই । পাঠবস্তুর শুরু ও শেষ দু-ই মুক্ত । তা সর্বগ্রাসের আগে গণ্ডুষ ও শেষে আচমন করছে না । বানানের, শব্দের ও ছন্দের যথেচ্ছাচারে লিপ্ত, দু-হাতে খাবার মতন । সর্বোপরি, ওটি ‘সাওয়ার হাংরি টাইমের ‘ কবিতা । প্রতীক বর্জিত, ছেঁড়াখোঁড়া চেবানো চিত্রকল্প, কোনটা আগে আর কোনটা পরে গ্রাস করার বালাই নেই বলে পাঠবস্তুর পংক্তিরা অনুক্রমহীন ।গোগ্রাস খাবার মতন যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায় । বাইনারি অপোজিশান বা যুগ্মবৈপরীত্যের মূলকাঠামোকে চুরমার করা হয়েছে, যার দরুন হরেকরকম ‘আমি’ ছড়িয়ে আছে পাঠবস্তু জুড়ে, অর্থাৎ পাঠবস্তুর হাঁ-মুখও অতগুলো । ‘জখম’-এর আগে দীর্ঘ কবিতা হত নদী-প্রবাহের মতো । ‘জখম’, পক্ষান্তরে, তৃণভূমির মতন । টৃণের মতন পংক্তিগুলো পরস্পরের সঙ্গে একযোগে যুক্ত ও বিযুক্ত । তৃণভূমির মতই এর ব্যাপ্তি বিশাল, এবং যতবার পড়বে তার বৃদ্ধি ঘটবে । লক্ষ্য করো, পাঠবস্তুটির হাঁ-মুখে ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, সমায়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছু নির্বিচারে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । ফিকশানে তুমি বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘রন্ধনশালা’ পড়ো ।

    ডক্টর দে: আজকের দিনের কবিতায় হাংরি আন্দোলনের সাহিত্যকৃতি প্রভাব ফেলতে পেরেছে কি ? অথাৎ আজ বহু প্রকার কবিতা লেখা হচ্ছে । সবারই নিজস্ব বোধভূবন রয়েছে । এই ভুবনে হাংরি কবিতার সাহিত্য-দর্শন বা ক্যানন প্রতিফলিত হয় কি ?

    মলয়: কেবল কবিতা কেন, সাহিত্যের সব এলাকায় প্রবেশ করেছে হাংরিয়ালিস্ট ক্যানন, এমন কি পত্রিকার নামকরণেও । ১৯৬১-৬৫-র আগের ও পরের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে দ্যাখো, তাহলেই চোখে পড়বে । শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিন পরিসরে তা সীমিত নয়; বাণিজ্যিক লেখকরাও হাংরি আন্দোলন থেকে প্রচুর মাল-মশলা খড়কুটো নিয়েছেন । এই তো কয়েকদিন আগে নারায়ণ ঘোষের চিঠি পেলুম, যাতে উনি বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছেন । তুমি তো পি এইচ ডি করছ, তুমি আরো ভালো বলতে পারবে। এই কিছুক্ষণ আগেই একটা প্রশ্নে তুমি নিজেই বলছিলে যে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এমন অনেকের কবিতায় হাংরি বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । তবে?

    ডক্টর দে: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০০০ সালের শেষে বিশ্ব কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছে, মডার্ন অ্যাণ্ড পোস্টমডার্ন পোয়েট্রি অব দি মিলেনিয়াম শিরোনামে । তাতে বাংলা সাহিত্য থেকে কেবল আপনার কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার অনুবাদ Stark Electric Jesus, তা কি এই জন্য যে আপনার সঙ্গে প্রধান-প্রধান বিট কবিদের যোগাযোগ ছিল ? ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায় ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি সে সময়ে কী ভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল ? বাঙালি সাহিত্য আলোচকরা তো সে-সময়ে কবিতাটিকে প্রাপ্য সন্মান দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন ।

    মলয়: কেবল বিটরা নন, অন্যান্য গোষ্ঠির কবিদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হয়ে উঠেছিল কবিতাটা, কেননা তাঁদের সাহিত্যের প্রেক্ষিতেও একেবারে নতুন ছিল প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার । আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যেমন হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, ডেভিড অ্যানটিন, রবার্ট ক্রিলি, জোয়েল ওপেনহাইমার প্রমুখের যোগাযোগ ছিল, যাঁরা ছাত্রদের ওয়র্কশপে কবিতাটা বিশ্লেষণ করেছেন ।
    ড্যান ব্রাউনের ‘দা ভিঞ্চি কোড’ প্রকাশিত হবার পর Stark Electric Jesus একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে । সেটা তুমি গুগল সার্চ করলে নেটে দেখতে পাবে । খ্রিষ্টধর্মীদের মাঝে কবিতাটা অন্য ব্যাখ্যা পাচ্ছে । যিশুকে তাঁরা এখন ‘স্টার্ক’ এবং ‘ইলেকট্রিক’ রূপে দেখছেন, এবং তা সেই সময়ে, যখন তিনি ক্রস নিয়ে প্যাশানে আক্রন্ত । একটি ব্যাখ্যায় কবির প্রেমিকা শুভাকে তুলনা করা হয়েছে মেরি ম্যাগডালেনের সঙ্গে ।
    ‘কৌরব’ পত্রিকার সম্পাদক আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, যিনি আমেরিকায় থাকেন, লিখে জানিয়েছেন যে বহু ইংরেজি-ভাষী কবির কাছে তিনি এই কবিতাটার কথা শুনেছেন । আমার মনে হয় কবিতাটা নানা ভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য বলেই হাজার বছর পূর্তি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । তাছাড়া, কনটেমপোরারি অথর্স অটোবায়োগ্রাফি সিরিজ-এ প্রকাশিত আমার আত্মজীবনী স্নাতক ক্লাসে ‘অটো-এসে’ নামের সেশানে অনেক সময়ে পড়ানো হয় ।

    ডক্টর দে: ‘জখম’ কবিতা যখন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন অনেকে বলেছিলেন রচনাটি গিন্সবার্গের ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ এর অনুকরণে লেখা । তারপর আপনি, বিকাশ সরকার, আশেক তুহিন, শুভঙ্কর দাশ বই দুটি অনুবাদ করার পর যখন তাঁদের ভুল ভাঙল, তাঁরা বললেন, ‘জখম’ কবিতা ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘লিভস অব গ্রাস দ্বারা প্রভাবিত । ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৯৯) কেদার ভাদুড়ির সাক্ষাৎকার নেবার সময় আপনি বলেছিলেন যে ‘জখম’ কবিতার টোনাল স্ট্রাকচার গঠনের সময় মাথায় ছিল ফেনটন জনসনের ‘টায়ার্ড’, রিচাডফ রাইটের ‘বিটুইন দি ওয়ার্লড অ্যাণ্ড মি’ এবং ক্রস্টোফার স্মার্টের ‘জুবিলেট অ্যাগনো’ কবিতাগুলো । আপনাদের সময়ে কবিতার যে সংজ্ঞা ছিল তার সঙ্গে ‘জখম’ কিন্তু খাপ খায় না । আপনি কি বলবেন?

    মলয়: ‘লিভস অব গ্রাস’, ‘টায়ার্ড’ ‘বিটুইন দি ওয়ার্লড অ্যাণ্ড মি’ আর ‘জুলিয়েট অ্যাগনো’-র গতিময়তা ‘জখম’ থেকে বর্জিত । দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের কাউবয়রা গিটার বাজিয়ে ‘লিভস অব গ্রাস’ গায় । ‘জখম’ তো বাংলা ব্যাণ্ডো গাইতে পারবে না, এমনই আপাত-অনুক্রমহীন ও নিঃছন্দ এর গঠন । বাংলা বাক্য, শ্বাসে ধরে রাখার সঙ্গে ইংরেজি বাক্য ধরে রাখার সময়-পার্থক্য আছে । তবে এটা ঠিক যে, কবিতার সংজ্ঞার আমি তোয়াক্কা করিনি ‘জখম’ লেখার সময় । যা ইচ্ছে, যেমন ভাবে ইচ্ছে, লিখে গেছি । কে কী বলবেন, এসব ভেবে হাংরি আন্দোলনের সময়ও লিখিনি, এখনও লিখি না । কবিতাটা নিজেই কবিতাকে সংজ্ঞাহীন করে দিয়েছে, এরকমও ভাবতে পারো ।

    ডক্টর দে: তাহলে কি ধীমান চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, কমল চক্রবর্তী, রঞ্জন মৈত্র, প্রণব পাল, অলোক বিশ্বাস, আর্যনীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখের ভাষা বদলের কবিতা, অতিচেতনার কবিতা, ভাষা ভাবনার কবিতা ইত্যাদি আপনাদের খুলে দেয়া সিংহদ্বার দ্বারা উপকৃত?

    মলয়; দেশ-কাল-পাত্রের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে লেখালিখি । আমি বাণিজ্যিক বা সরকার-পোষ্য লেখালিখির কথা বলছি না । যাঁরা নিজস্ব ঢঙে লেখালিখি করতে চান, কারোর পরোয়া করেন না, তাঁদের জন্যে একটা খোলা হাওয়ার চত্বর গড়ে দিয়েছে হাংরি, শ্রুতি আর নিমসাহিত্য আন্দোলন । তুমি যাঁদের নাম বললে, তাঁরা আউটস্ট্যান্ডিং কাক করছেন । ওনাদের কবিতা পড়ে মনে হয়, পরের প্রজন্মের জন্যে আর কিছু বাকি রইল না ।

    ডক্টর দে: হাংরি, অনেকে বলেন, বাংলা সাহিত্যের জলবিভাজক ঘটনা । কিন্তু হলদিয়ায় প্রতিবছর যে বিশ্ব কবিতা উৎসব হয়, তাতে আপনাকে এবং প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র, সুবিমল বসাক প্রমুখকে কখনও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি । কেন?

    মলয়: আমরা কারোর প্রতি অনুগত নই বলে । আমাদের কখনও যেতে বলা হয়নি । অথচ কেউ প্রশ্ন তুললে কর্তাব্যক্তিরা বলেন যে, তাঁরা নাকি প্রতিবছর আমন্ত্রণ জানান । ওটা নন্দীগ্রাম-খ্যাত রাজনীতিকলক্ষ্মণ শেঠ মশায়ের মহোৎসব ল বহু কবির জামাকাপড়ে সেসব রক্ত আর অশ্রুজল লেগে আছে ।

    ডক্টর দে: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ‘-ও একটি সময়-চিহ্ণকারী ঘটনা । হাংরি আন্দোলনের সময়ে–১৯৬৩ সালে– কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল । কৃত্তিবাসের ওয়েবসাইটে আপনার এবং এই কাব্যগ্রন্হের কোনো উল্লেখ নেই । আপনার দাদাসমীর রায়চৌধুরীর ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি‘ পখাশিত হয়েছিল কৃত্তিবাস থেকে । তাঁরও উল্লেখ নেই । পঞ্চাশবর্ষপূর্তি সংখ্যা থেকেও আপনারা দুজন বর্জিত । একে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

    মলয়: এটা হাংরি আন্দোলের সাফল্যের স্বীকৃতি । নয়তো দাদাকে তো বাদ দেবার কারণ ছিল না । দাদা তো কৃত্তিবাসেরফণীশ্বরনাথ রেণু সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন । পত্রিকার জন্যে দীপক মজুমদারের সঠ্গে দৌড়ঝাঁপ করতেন । চাইবাসা, দুমকা, ধানবাদ, ডালটনগঞ্জ, লাহেরিয়া সরাই, ভাগলপুর, মুজফফরপুর ইত্যাদি যেখানে-যেখানে দাদার পোস্টিং হয়েছে, শক্তি-সুনীল-সন্দীপন প্রমুখ সেখানে দল বেঁধে গিয়ে দিনের পর দিন থেকেছেন । এসটাবলিশমেন্টের হাজার চেষ্টা সত্বেও হাংরি আন্দোলন যদি ছেয়ে ফেলতে থাকে তো তার দায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ।
    এসটাবলিশমেন্ট চিরকালই ইতিহাসকে বিকৃত করতে চায় ।শক্তি চট্টোপাধ্যাব দাদার কুঁড়ে ঘরে বছর দু-তিন ছিলেন । উনি দাদার এক শ্যালিকার প্রেমে পড়েছিলেন । সম্প্রতি মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায় আর সমীর সেনগুপ্ত চাইবাসা গিয়ে শক্তি সম্পর্কে শুটিং করে এসেছেন । আমাদের সম্পর্কে ভীতি কেন এবং কোন স্তরে কাজ করছে ভেবে দ্যাখো ।

    ডক্টর দে: সাহিত্যে প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করলে চিরকালই পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করার কথা অনুমান করা হয় । অনেকে মনে করেন যে হাংরি আন্দোলন, যা ষাট দশকের আন্দোলন, তা ্রভাবিত করেছে পঞ্চাসের দশকের বেশ কয়েকজন কবিকে । আপনিও কি তাই মনে করেন?

    মলয়: হ্যাঁ । ১৯৬১ সালের আগে লেখা ওনাদের কবিতা পড়ে দ্যাখো আর পরের কবিতা পড়ে দ্যাখো । পুরোপুরি বদলে গেছে । কবিতায় গুরুচণ্ডালী নিয়ে এলুম আমরা, ছন্দপতন নিয়ে এলুম আমরা, অথচ দাবি করছেন ওনারা । কলকাতা-পাটনা=বেনারস-কাঠমাণ্ডু ইত্যাদি শহরে রাত্রীকালীন হ্যাপেনিং শুরু করলুম আমরা, অথচ সেসব ঘটনা ওনারা নিজেদের লেখালিখিতে ঢুকিয়ে নিলেন । তোমার তো বয়স কম; পরে বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখো, বিশ্লেষণ কোরো ।হাংরি আন্দোলন গিন্সবার্গকেও প্রভাবিত করেছিল, সে থত্য তুমি নেট সার্ফ করলেই পাবে ।

    ডক্টর দে: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি প্রমুখের কবিতায় প্রেমাস্পদকে গবেষকরা চিহ্ণিত করে ফেলেছেন । আমরা জেনেছি তাঁরা সব বাস্তব । কবিরা তাঁদের পাননি । আপনার কবিতায় নারীরা কি বাস্তব? না কি কাল্পনিক?

    মলয়: বাস্তব । তবে, আমার প্রেমের কবিতা সেই অর্থে প্রেমের কবিতা নয়, যে অর্থে ওই তিন কবির । আমি ্রেমের মধ্যে থাকাকালীন নিজের মনঃস্হিতিতে নেশাগ্রস্ত থেকেছি । সে-কারণে একজন নারী তিন-চার বছরেই আকর্ষণ হারিয়েছেন । বা বলা যায়, প্রেমের মনঃস্হিতি ক্রমশ উবে গেছে । এটা কলেজে ঢোকার পর থেকে ঘটতে থেকেছে । অনেকে একে অনৈতিক বলবেন, স্বার্থপরতা বলবেন । ‘মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর‘ পর্যন্ত আমি আবিরাম প্রেমের মনঃস্হিতিতে থাকতে চেয়েছি । উপন্যাসগুলোয় বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে এই মনঃস্হিতিকে ধরবার চেষ্টা করেছি । ‘মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর’ -এর নারী আমার চায়ে কুড়ি বছরের ছোট ছিলেন । প্রায়ই আত্মহত্যার হুমকি দিতেন । শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেন, অথচ তখন তাঁর বিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেছে ।

    ডক্টর দে: আপনি কখনও আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন?

    মলয়; হ্যাঁ । ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল আশানুরুপ না হওয়ায় । পটাশিয়াম ফেরিসায়েনাইড খেয়ে, যে কেমিকাল তখনকার দিনে বাবার ফোটোগ্রাফি ব্যবসায় প্রয়োজন হত । পিসেমশায় ধরে ফেলেছিলেন । ওরই বড়ছেলে সেন্টুদা, মানে অজয় হালদার, যাঁর কথা তুমি একবার জানতে চেয়েছিলে । শক্তিদাকে উনিই মদ খেয়ে বেহেড হবার পথে নিয়ে যান । ওই বেহেড হবার কারণেই মারা যান শক্তিদা । আমাকে পিসেমশায় আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করে মারা যান । ‘অপ্রকাশিত ছোটগল্প’ বইতে ‘তিনকড়ি হালদার’ নামে গদ্যটা ওনাকে কিয়ে লেখা ।

    ডক্টর দে: আপনার প্রবন্ধগুলো নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের কথা ভেবে দেখেছেন?

    মলয়: কেউ বের করতে চাইলে বেরোবে । আমার তো কোনো রচনার কপিরাইট নেই। কিছু প্রবন্ধ ফাইলবন্দি হয়ে আছে কবিতীর্থ প্রকাশনীর উৎপল ভট্টাচার্যের কাছে আর কিছু প্রবন্ধ আরেকটা ফাইলে আবিষ্কার প্রকাশনীর মুর্শিদ এ এম-এর কাছে, যিনি প্রচুর পরিশ্রম ও বহু টাকা খরচ করে আমার কবিতাসমগ্র ১৯৬১-২০০৪ বের করেছেন ।

    নাসের হোসেন নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অক্টোবর 7, 2013by কিছু লেখাপত্র

    নাসের : হাংরি আন্দোলনের শুরু ১৯৬১ । প্রথম ইশতাহার আপনি প্রকাশ করেন । চারজনে শুরু করেছিলেন ; তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ( হারাধন ধাড়া ), শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর আপনি নিজে । কিন্তু সমীরদার অনেক লেখাতে পড়েছি, হাংরি বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক আগে থেকেই আপনি ও সমীরদা এ-ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেছিলেন । সমীরদা চাইছিলেন উপযুক্ত সময়ে আলোচনাটা শুরু করতে । ঠিক কোন সাল থেকে এ-ব্যাপারে আপনার ও সমীরদার কথাবার্তা শুরু হয়েছিল ? আপনি তখন কলেজে অর্থনীতির ছাত্র । আপনার স্পেশাল পেপার ছিল ইনডিয়ান ইকোনমিক্স । এটা কি ১৯৫৯ সাল ? সমীরদা ও আপনার মধ্যে এই সময়ই প্রথম হাংরি সম্পর্কিত আলোনা শুরু হয়েছিল ? সেই সময়ে সাহিত্য পরিস্হিতি ও রাজনৈতিক পরিবেশ ঠিক কীরকম ছিল ? একটু বিস্তৃত করে যদি বলেন, ভালো হয় ।

    মলয় : হ্যাঁ, সান্মানিক স্নাতকে আমি মার্কসবাদে আগ্রহী হই । দাদা মার্কসবাদে আগ্রহী হয়েছিলেন পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থাকার সময়ে, আমার ছোটোমামার প্রভাবে । তবে আমরা দুজনেই বইপড়ুয়া মার্কসবাদী ছিলুম । ওই দেশগুলোয় যা ঘটছিল তাতে আমাদের অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ; আর তিরিশ বছরে পশ্চিমবাংলায় যা ঘটালেন মার্কসবাদীরা, আমাদের ভাবনাকে বলা চলে প্রফেটিক ।

    সময়টা ১৯৫৭-৫৮ হবে । না, স্নাতকোত্তরে আমার স্পেশাল পেপার ছিল MONEY, জানি না এই শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ আছে কিনা । ইনডিয়ান ইকোনমিক্সও একটা পেপার ছিল যাতে আমি সবচেয়ে বেশী মার্কস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড করেছিলুম ।

    দাদার চাকুরিস্হল ধানবাদে দাদার কবি-বন্ধু দীপক মজুমদারের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তিনি আমাকে ‘ইতিহাসের দর্শন’ পড়তে বলেছিলেন । আমি বিষয়টা নিয়ে একটা গদ্য তৈরি করেছিলুম যেটা দাদা ওনার বন্ধু বিমানবিহারী মজুমদারের ছেলেকে সম্পাদনা করতে দিয়েছিলেন । পরে এই লেখাটা ”বিংশ শতাব্দী” পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল ।

    নানা বিষয় নিয়ে দাদার সঙ্গে আলোচনা চলত । ক্রমশ আমরা বাঙালির সংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনা করতে থাকি আর সেখান থেকে সাহিত্য আলোচনায় । বস্তুত হাংরি আন্দোলনের তাত্বিক আইডিয়াটা ওই ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কিত অসওয়াল্ড স্পেংলারের বই ‘দি ডিক্লাইন অফ দি ওয়েস্ট’ থেকে পেয়েছিলুম । দার্শনিক বনেদ আর হাংরি শব্দটা সম্পর্কে আমরা দুজনে একমত হবার পর ১৯৬১ সালে দেবী রায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাটনা এলে আন্দোলন শুরু করার পরিকল্পনা ফাইনালাইজ হয় । শক্তিদার পড়াশুনা বিশেষ চিল না বলে আমাদের একটা প্রাথমিক দোনামনা ছিল, কিন্তু আমাদের মধ্যে তিনিই অধিকতর পরিচিত ছিলেন ।

    সে-সময়ের সাহিত্যিক পরিবেশকে বলা যায় অনেকটা ক্লোজড ডোর ধরনের মানদণ্ড বা ক্যানন নির্দেশিত । লক্ষ করলে দেখবে হাংরি আন্দোলনেই প্রথম কবিতার ডিসকোর্সের গুরুত্বের কথা বলা হল, যে কারণে তার পর থেকে প্রতিটি দশক নিজের ডিসকোর্স উপস্হাপন করে চলেছে , যাতে তাদের ভাঙনরেখাকে স্পষ্ট করে তোলা যায় । রবীন্দ্রনাথের পর যে আধুনিকতাবাদীরা আমাদের সামনে উদয় হলেন, তাঁরা, কী বলব, উন্নাসিক শব্দটা ব্যবহার যুৎসই হবে । সম্ভবত ইংরেজি শিক্ষার গোমর । রবীন্দ্রনাথকে যেকোনো কবি অ্যাপ্রোচ করতে পারতেন, তিনি খোলাখুলি মতামত দিতেন । কিন্তু তাঁর পরে যাঁরা এলেন, তাঁরা ব্লকেড খাড়া করার সাহিতভিক উন্নাসিকতা নিয়ে এলেন, যেন ওনারাই নান্দনিক সংস্কৃতির মালিক । এই জিনিস চালু করে গিয়েছিল ইংরেজরা, যে-কারণে আমাদের দেশের প্রান্তিক সমাজের সাহিত্য একেবারে মুছে গেছে, এমনকি সেসব বইপত্র-পুঁথি-পাঁচালি আর পাওয়া যায় না ।

    রাজনৈতিক পরিবেশকে বলা যায় ভয়াবহ । দাঙ্গা আর দেশভাগের পর উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবাংলার যে উনিশ শতকি রেনেসঁসি বনেদ ছিল তা ধ্বংস হয়ে গিয়েচিল ; উদ্বাস্তুরা চাইছিলেন রিরুটিং যা করতে গিয়ে তাঁদের প্রাক-দেশভাগ মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবার প্রয়াস করতে হচ্ছিল । এই সময় একদল সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছিল যাঁরা স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়’ বা এই স্বাধীনতা মিথ্যা, আর ট্রামে-বাসে বোমা মারামারি পোড়ানো ইত্যাদি কাজে মন দিয়েছিলেন । মজার ব্যাপার হল, এঁরাই পরে মসনদ দখল করে দিব্বি আয়েস করেছেন । সেই যে সর্বব্যাপী অধঃপতন শুরু হল তা নিয়ে এলো সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য । এই বাঁকবদলের কধাই বলেছিলেন স্পেংলার । ফলে হাংরি আন্দোলন ছিল অবশ্যম্ভাবী । আমরা না করলে, অন্যেরা, যারা ওই জৈবিক মোচড়টা টের পেয়েছিল তারা নিশ্চয় করত । কেউ না কেউ করতই । সময়-পরিসরের খেলাটা কেমন দ্যাখো । ওই সময়েই বিধান রায় মারা গিয়ে মসনদে বসলেন প্রফুল্লচন্দ্র সেন । আর বামপন্হীরা আন্দামানকে একটা বাংলাদেশ হয়ে উঠতে দিল না ।

    নাসের : হাংরি আন্দোলন মামলায় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন দেবী রায় । তাঁর নাম দেখেই কি আপনারা হারাধন ধাড়ার নাম রেখেছিলেন দেবী রায় ? দেবীদার সঙ্গে ঠিক কী ভাবে সন্মিলনটা গড়ে উঠেছিল ? আমরা আপনাদের সখ্যের ব্যাপারটা এবং হাংরি সম্পর্কিত কর্মোন্মাদনার জায়গাটা জানতে চাইছি । যতটা স্মৃতির ভেতরে যাওয়া যায় যাবেন ।

    মলয়: না হে । আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর মকদ্দমাটা দায়ের হয়েছিল ১৯৬৪ সালে । পুলিশের দপ্তরে কে কী তা নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ ছিল না । আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে দেবী রায় সম্ভবত প্রথম নিম্নবর্গের কবি এবং স্বাভাবিক কারণেই তার পদবি যে অন্তরায় হবে তা তুমি কবিতা, ধ্রুপদী, একক, উত্তরসূরী, কৃত্তিবাস, শতভিষা পত্রিকাগুলোর পাতা ওল্টালেই টের পাবে । ওই পত্রিকাগুলোর সম্পাদক কাদের লেখা বাদ দিতেন তা নিয়ে একটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা অত্যন্ত জরুরি । তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে সাহিত্যিক ক্যাননগুলো সামাজিক-রাজনীতির ক্ষেত্রে কী ভাবে প্রয়োগ হতো । দেবী রায় এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তন করেছিলেন । তবে, আমাদের বিরুদ্ধে মকদ্দমা দায়ের হবার সময়ে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার দেবী রায়কে কলকাতার তৎকালীন কর্তারা বুঝিয়েছিলেন যে কবি দেবী রায়ের নামটা তাঁর নকল । ডিসি ডিডির সৌভাগ্য যে হাংরি আন্দোলনের জন্য তাঁর নামটা ভবিষ্যতে সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখ করা হবে, নয়তো তিনি নকশাল দমনকারী ক্যালিগুলা হয়েই থেকে যেতেন ।

    একটা কথা তুমি বলো আমায় । বিনয় মজুমদারকে অকাদেমি পুরস্কার দিতে এত দেরি হল কেন ? ওনার আগে যাদের দেয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগ লেখক-কবিদের তো আমরা ইতিমধ্যে ভুলেগেছি । তাও হেলা-ফেলা করে দেয়া হল, কেন ? তিনি কি সামাজিক-রাজনীতির শিকার হলেন, নাকি পুরস্কারদাতা কবিদের ভয় ছিল যে বিনয় ওনাদের অতিক্রম করে ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করেছেন ? পাঁচ লাখি আনন্দ পুরস্কারও বিনয়ের প্রাপ্য ছিল না কী ? উনি ডিজার্ভ করতেন, আর ওনার প্রয়োজনও ছিল । ওনার সম্পর্কে কারা লেখালিখি শুরু করলেন, কারা ফিল্মের স্মৃতিতে তুলে রাখলেন ওনাকে ? যাকগে, কী আর হবে এসব আলোচনায় !

    দেবী রায়কে আমি খুঁজে পাই একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকের দপতরে । আমার শৈশব কেটেছে ছোটোলোকদের পাযা ইমলিতলায়, আর দেবীর বাড়ি গিয়ে দেখলুম হাওড়ার ইমলিতলা । ধাড়া পদবিও আমাকে প্রভাবিত করেছিল, কেননা আমি জানতুম যে এই ধরনের প্রান্তিক লেখক লর্ড ম্যাকলের দয়ায় বাংলা সাহিত্যে তখনও পর্যন্ত ডিবার্ড । শক্তিদাও ওই সময়ে একটা বস্তিতে থাকতেন । সুবিমল বসাক যোগ না দেয়া পর্যন্ত কলকাতায় প্রধান কাজটা দেবীই করত । প্রথম ইংরেজি বুলেটিনগুলো আমি ইংরেজিতে ছাপিয়ে দেবীকে পাঠাতুম আর দেবী সেগুলো বিলি করে ঝড় তুলত । সুবিমল যোগ দেবার পর একটা সুবিধে হল যে ও সেই সময়ে ইনকাম ট্যাক্স দপতরে ছিল আর বিশেষ কাজকর্ম ছিল না । আর সে-সময়ে স্টেনসিল করার সুবিধা ছিল । সুবিমল স্টেনসিলে ড্রইং এঁকে রেগুলার বুলেতিন বের করত, তাতে নম্বর-টম্বর দেয়া ধাকত না । এই স্টেনসিলে আঁকা ড্রইং সে-সময়ের প্রেক্ষিতে আক্রমণাত্মক ছিল । তিনটে ড্রইং আমার মনে আছে । একটায় একজনের দেহ জুড়ে কাঁঠালগাছে কাঁঠালের মতন স্তন ঝোলানো, ইন্দ্রকে যেমন অভিশাপ দেয়া হয়েছিল তার সারা গায়ে যোনি গজাবে, পরে ইন্দ্র সেটা মুকুব করিয়ে যোনির বদলে চোখ করিয়ে নেন । আরেকটা ছিল আপাতদৃষ্টিতে ফুলদানি যা আদপে একজোড়া নারী-পুরুষের সঙ্গম । একটা ছিল নারী-পুরুষের পায়ের পাতা যা দেখে টের পাওবা যায় তারা কোন কাজে লিপ্ত । ওই ম্যাকলেপুত্রদের আবহে এই ধরনের বুলেটিন কেমন উথালপাথাল ঘটিয়ে থাকবে তা এখন বোঝা মুশকিল ।

    কোনো-কোনো আলোচক দেখি নিজেরাই হাংরি বুলেটিনের নম্বর দিয়ে নিচ্ছেন, অমুকটা অত নম্বর, তমুকটা তত নম্বর উত্যাদি । কত বুলেটিন যে বিনা নম্বরে বা উল্টো-পাল্টা নম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল তার হিসেব আমরা নিজেরাই রাখিনি । আসলে হাংরি ব্যাপারটাকে বুঝে উঠতে পারেননি তাঁরা ।

    তারপর ‘দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন’ বাক্যটা কাগজের মুখোশে ছাপিয়ে বিলি, জন্তু দেব দেবী রাক্ষস ইত্যাদি । দেবীর অবদান ছাড়া এটা ঘটানো যেত না । কলকাতাকে তোলপাড় করে দিয়েচিল, তার কারণ সবাই তো মুখোশ পরে বসেছিল ; এখনও আছে অবশ্য, আরও ভয়ংকর দানবীয় মুখোশ । ইউ টিউবে দেখলুম , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ শরিফকে বলছেন যে হাংরিরা সবাইকে বলত মুখোশ পরে নাও । আরে ! আমরা বলেছিলুম , মুখোশ খুলে ফেলুন । পরে নিন বলিনি । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে উনি এত বেশি প্যারানয়েড ছিলেন যে আসল ব্যাপারটাকেও গোলমাল করে ফেলতেন ।

    সন্দীপনদা একটা অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন দেবী রায়কে, যার টেক্সটের ভেতরে আরও অনেককে লেখা চিঠি ছিল ; এটা ওনার একটা গদ্য যা উনি হাংরি বুলেটিন বা পত্রিকায় ছাপাবার জন্য দিয়েছিলেন । দেবী রায়ের বাড়ি সাইকেল চালিয়ে ভোরবেলা দিয়ে এসেছিলেন । চিঠিটা উনি অন্যান্যদেরও পাঠিয়েছিলেন, প্রত্যেকের নাম বিভিন্ন রঙিন পেনসিল দিয়ে আনডারলাইন করা, যার যেমন চরিত্র তাকে তেমন রঙ দিয়েছিলেন । সুনীলদা চিঠিটা পেয়ে চটে গিয়েছিলেন, ওনার হাংরি প্যারানয়ার দরুণ । সন্দীঈপনদাকে আমেরিকা থেকে লেখা ওনার চিঠিতে উষ্মার তাপ টের পাবে । চিঠিটা দেবী রায়কে সম্বোধন করে লেখা । কিন্তু সুনীলদা সন্দীপনকে উত্তর দেবার সময়ে উল্লেখ করেছেন হারাধন ধাড়ার নাম । স্পষ্ট যে ব্রা্হ্মণ সম্পাদকের অবচেতনে কাজ করেছে এই বোধ যে নিম্নবর্গের লোকেরা সাহিত্যের আসরে কাজ করার যোগ্য নন ।

    আমার মকদ্দমার সময়ে গিন্সবার্গ আমার সমর্থনে অনেককে চিঠি দিচ্ছিলেন বলে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অনেকে গিন্সবার্গকে আমার বিরুদ্ধে নানা কথা লিখছিলেন— এসব আমি জানতে পারলুম গিন্সবার্গ অছি পরিষদের কর্তা বিল মর্গানের কাছ থেকে, যিনি নাকতলায় আমার বাসায় এসেছেন আর গিন্সবার্গের লেখা চিঠির সংকলন প্রকাশ করেছেন ।

    আমরা কয়েকজন একত্রিত হতুম কোথাও ; সাধারণত কলকাতার বাইরে যেতেই ভালবাসত সবাই । তাই বলে কোনো সভাঘর ধরণের ব্যাপার ছিল না । অর্থাৎ সবাই মিলে কোথাও একত্রিত হইনি কখনও । একটা ব্যাপার পেছন ফিরে ভাবলে মজার মনে হয় । নিজের লেখাটা কিন্তু সকলেই লুকিয়ে লিখত আর ছাপাবার আগে এনে হাজির করত । সুভাষ ওর ”আমার চাবি” বইয়ের গদ্যগুলো ওর রুমমেট শৈলেশ্বরের সামনে বসেও লিখত না । লিখত গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে একটা বারে বসে, সম্ভবত অ্যাম্বার নাম ছিল বারটার । আমি সেখানে পৌঁছে দেখতুম যে ওর লেখা কমপ্লিট । তারপর মদ খাওয়াবার খরচ আমাকে বইতে হতো ।

    নব্বুই দশকে যখন কলকাতায় এলুম তখন দেখি যে সুভাষ কমবয়সী চ্যাংড়াদের নিয়ে দল গড়ে ফেলেছে । তারা ওর সমালোচনা করার বদলে তোল্লাই দিয়ে ওর গদ্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে । এক চ্যাংড়া আমায় একদিন বলল, ”না হয় ধরেই নিলাম যে হাংরি মামলা হয়েছিল, কিন্তু তা কেবল আপনার বিরুদ্ধে হয়েছিল তার তো প্রমাণ নেই।” বুঝলুম যে সুভাষ একখানা গল্প বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে আমার অবর্তমানে । স্কাউন্ড্রেল চ্যালাটা এটাও জানত না যে কারা-কারা রাজসাক্ষী হয়েছিল, পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল । তখন আমি ‘হাংরি কিম্বদন্তি’ বইটা বের করলুম যাতে আসল ব্যাপারটা পাঠকরা জানতে পারেন ।

    অবনী ধরের গল্প বলি তোমায় । স্কুলের গণ্ডী পেরোয়নি বলে আমাদের সঙ্গে সেরকমভাবে মিশতে পারত না । বাবা আরেক বোষ্টমিকে নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন । অবনী স্কুলের গণ্ডি পেরোবার আগেই চলে গেল জাহাজে খালাসির কাজ করতে । মা একলা হয়ে গিয়েছিলেন বলে ফিরে এসে হেন কাজ নেই যা করেনি ; কয়লা বেচা থেকে ঠেলাগাড়ি চালানো । কলকাতায় বস্তিতে থাকত । তারপর অশোকনগরে উদ্বাস্তুদের বরাদ্দ বাসা পেল । বিয়ে করল । সংসার চলত মূলত স্ত্রীর মামুলি চাকরির মাইনেতে । ছেলে আর মেয়ে হল । তাদের স্কুল-কলেজে পড়িয়ে বিয়ে দিল । ছেলে আলাদা হয়ে গেল । অবনী আর ওর স্ত্রী ফের ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান । ওর গদ্যগুলো পড়ে না থাকলে পড়ে দেখো, একেবারে অন্য ফ্লেভারের লেখা । নেশা করত না । আমি কলকাতায় এসে শর্মী পাণ্ডেকে বলে ওর সবকটা গদ্য দিয়ে একটা বই প্রকাশ করিয়েছি , কেননা ওর লেখাপত্র হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল । হাংরি আন্দোলনকারী ছিল অথচ কেউ ওকে গুরুত্ব দিল না, বিশেষ করে ওর কাছের হাংরিরা ।

    নাসের : এ-বছরে ‘হাওয়া ৪৯’ ( জুলাই ২০১৩ ) পত্রিকায় অদ্রীশ বিশ্বাসের একটা চিঠি বেরিয়েছে, যা পড়ে বোঝা যায় যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকা থাকাকালীন হাংরির সামগ্রী ও ক্রিয়াকলাপ উনি পছন্দ করছেন না । যদিও বন্ধুসুলভ একটা নমনীয়তাও ছিল এ-ব্যাপারে । সেই মর্মে অদ্রীশের ওই চিঠি । এ-ব্যাপারটা যদি একটু খুলে বলেন ।

    মলয়: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন আমেরিকায় তখন হাংরি আন্দোলন তুঙ্গে ; নানা পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, এমনকি আমেরিকা-ইউরোপেও । তিনি বেশ কয়েক জায়গায় লিখেছিলেন যে তাঁকে বাদ দেবার জন্য ও তাঁর ও কৃত্তিবাস-এর বিরোধীতা করার জন্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে । এত জ্ঞানী-গুণি হয়ে কী করে অমন আবেগে বয়ে গেলেন বিশ্লেষণ করা কঠিন । ওই চিঠির সঙ্গে অদ্রীশ দাদাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা চিঠির কপি, যা সুনীল লিখেছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে, তা পাঠিয়েছিলেন । অদ্রীশ ওই চিঠিটায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে । সুনীলদা আমাকেই আক্রমণ করে গেছেন সুযোগ পেলেই , হাংরি আন্দোলনের কারণে । পরে যারা হাংরি আন্দোলন রিভাইভ করার চেষ্টা করল, তাদের আক্রমণ করলেন না । তার মানে ওনার মনে হয়ে থাকবে যে যারা রিভাইভ করতে চাইল তারা আগের আগ্নেয়গিরি নয় ; তা নিছক পাহাড়টিলা ।

    চিঠিতে সুনীল সন্দীপনকে বলছেন হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করতে । তিনি সন্দীপনের কাছে জবাবদিহি চেয়েছেন যে কেন সন্দীপন মলয়কে পছন্দ করছেন, যখন কিনা মলয়ের মধ্যে সত্যিকার কোনো লেখকের ব্যাপার নেই । চিঠিটার অনেকটা জুড়ে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, কী বলব, বিষোদগার ! কৃত্তিবাস থেকে যাঁরা হাংরি আন্দোনে এসেছিলেন তাঁদের আমেরিকা থেকে চিঠি লিখে-লিখে বলছিলেন বেরিয়ে যেতে । তারপর তাঁরা বেরিয়ে গিয়ে যখন কোর্টে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হলেন, তখন সুনীল তুরুপের তাসটি ফেললেন আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে, আর সাহিত্যের ইতিহাসে চিরকালের জন্য বিশ্বাসঘাতক হিসাবে বদনাম করে দিলেন সন্দীপন, শক্তি, উৎপলকে ।

    তিনি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে কফিহাউসে গেলে সন্দীপন-শক্তি তাঁকে চেপে ধরেন । ফলে কয়েক দিন পর তিনি দাদাকে চিঠি লিখে জানান যে কোর্টে তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন । দেশ পত্রিকায় যেমন বাজে বইকেও ভালো বলেন, তেমনই কোর্টে কবিতাটির গুণগান করেছেন, আসলে আমার কবিতাটা পড়ে তাঁর গা রি-রি করে উঠেছিল, এবং মলয় একেবারে কবিতা লিখতে জানে না, ইত্যাদি ।

    সুনীল একদিকে আমার কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ প্রকাশ করছেন, আবার একই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধতাও করে গেলেন । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমি তাঁর বাড়ি গিয়েছিলুম । তখনই টের পাই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম নেতা হিসাবে দেখানো হয়েছে বলে তাঁর ক্রোধটা আমার ওপর পড়েছে । সুনীলদা আমার কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে পৃথিবীর কোন সাহিত্য আন্দোলন নেতার নাম ঘোষণা করে আরম্ভ হয়েছে তুমি আমাকে দেখাও । বলেছিলেন, নিজে আরম্ভ করেছ তো নেতা হিসাবে নিজের নাম দিলে না কেন ।

    তিনি সেদিন বহু কথা বলেছিলেন যা আমি ‘রাহুকেতু’ নামে একটা উপন্যাসে লেখা আরম্ভ করেছি, ছোটোভাই রাহুল আর বড়ভাই অনিকেতদের ওই সময়টা নিয়ে লিখছি, কেননা অনেক ব্যাপার স্মৃতিকথায় লিখলে নোংরা হয়ে যেতে পারে । আমাকে তিনি প্রচুর চিঠি লিখতেন, হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার আগে । শক্তিদা, সন্দীপনদা, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখতেন । সুনীলদার মনে হয়ে থাকবে যে কেন আমি তাঁকে না জানিয়ে আন্দোলন আরম্ভ করে দিলুম, যখন কিনা সাহিত্যের আসরে তিনিই আমাকে নিয়ে এসেছেন । দাদাকে কিন্তু তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার অনুরোধ জানিয়ে কোনো চিঠি লেখেননি । সেসব চিঠিপত্র আর তাঁর ফরাসি প্রেমিকার ফোটো লালবাজার পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করার সময়ে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গিয়েছিল । তবু, মনে হয়, দাদার সম্পর্কেও তাঁর ক্ষোভ ছিল, হাংরি আন্দোলন আর তারপর অধুনান্তিক বাঁকবদল ঘটাবার জন্য । দাদাকে কত চিঠি লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই, দাদার প্রতিটি কর্মস্হলে গেছেন, একা বা বন্ধুদের নিয়ে বা স্ত্রীকে নিয়ে ছেলেকে নিয়ে, কিন্তু সংকলন বের করার সময়ে দাদাকে ভুলে যেতেন ; স্মৃতিকথা ‘অর্ধেক জীবন’ বইতে দাদার আর চাইবাসার তেমন উল্লেখই নেই, অথচ বেশ কয়েকটা উপন্যাস তো চাইবাসার ঘটনাবলী নিয়ে ।

    শক্তিদা দাদার শালি শীলার প্রেমে পড়েছিলেন আর প্রায় দুবছর ছিলেন দাদার নিমডির চালায় । শক্তিদাকে নিয়ে সমীর সেনগুপ্ত একটা ফিল্ম করার জন্য চাইবাসা গেলেন আর উল্টোপাল্টা পাড়ায় ফিল্ম তুলে নিয়ে এলেন ; দাদার সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন মনে করলেন না । আজব দেশের গজব গল্প !

    হ্যাঁ, সুনীলদা আমাকে স্নেহ করতেন । আমার পক্ষে সেকারণেই তাঁকে অশ্রদ্ধা করা অসম্ভব । শক্তিদা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনিও দাদার কাছে আমার খোঁজ করতেন । একবার তো কয়েকটা লিটল ম্যাগাজিনে আমার মৃত্যু সংবাদ পড়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন । তাঁকে শ্রদ্ধা করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে । তাঁকে আমরা নেতৃত্বের আসনে বসালুম, আর তিনি হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেছেন তা একটি সংবাদপত্র মালিককে জানাবার জন্য হাংরি আন্দোলনকারীদের মারধরের চেষ্টা করলেন একদিন কফিহাউসের সামনে । কাদের তিনি সঙ্গে এনেছিলেন জানো ? নাম শুনলে অবাক হবে । তাঁরাই বা কেন যে রাজি হয়েছিলেন জানি না ; তাঁদের তো কারো কাছে কিছু প্রমাণ করার ছিল না । তবে শক্তিদার বেশ কিছু কবিতা আমাকে টানে, যদিও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে শক্তির কবিতা সত্যেন দত্তের সরলীকরণ ।

    পরে সুনীলদা কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা দেবার জন্য একবার এক তরুণের হাতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তার নাম সম্ভবত রূপক চক্রবর্তী । আর আরেকবার চিঠি পাঠিয়েছিলেন ডাকে । আমার মনে হয় সুনীলদা চিঠিগুলো কাকে লেখা হচ্ছে তা না দেখেই সই করে দিতেন । তরুণ কবিরা নিজেরাই কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমার কবিতা ছাপাবার জন্য অমন চিঠি তৈরি করে থাকবেন । নয়তো সুনীলদা ইচ্ছে করলেই আমাকে ফোন করতে পারতেন ।

    আসলে আমেরিকায় বসে এখানকার খবরাখবর পেয়ে তাঁর মনে হচ্ছিল যে কলকাতায় সাহিত্যজগতে উথালপাথাল হচ্ছে আর উনি তাতে অংশ নিতে পারছেন না । তাই অমন নিসপিসে চিঠিচাপাটি লিখছিলেন । হাংরি আন্দোলনের পরেই কিন্তু ওনার কবিতার ধারা পুরোপুরি পালটে যায় ; উনি তো সেই পঞ্চাশের শুরু থেকেই কবিতা লিখছিলেন । তখনকার কবিতার পাশে ওনার ষাটের কবিতাগুলো পড়ে দেখলে টের পাবে ।

    নাসের : ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫, এই পর্যন্ত আপনি বলেন হাংরি আন্দোলনের মূল কার্যকর সময় । কিন্তু আমরা দেখেছি তার পরেও তো অনেকে বিভিন্ন সময়ে হাংরি আন্দোলনের অঙ্গীভূত করেছেন নিজেদের । যেমন অরুণেশ ঘোষ তো প্রায় ১৯৬৮-৬৯ সালে নিজেকে হাংরি ঘোষণা করেছেন । শৈলেশ্বর ঘোষ, অরুণ বণিক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তো বেরিয়ে গিয়েছিলেন । একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, হাংরি দর্শনের দ্বারা একবার যারা সংক্রামিত হয়েছেন সেটা তাঁদের সারা জীবনই বহন করতে হয়েছে । তাঁদের লেখার মধ্যে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া গেছে । এ নিয়ে আপনার কাছে কিছু শুনতে চাইছি । পারলে একটু বেশি করেই বলুন , যাতে অনেক কথাই বেরিয়ে আসতে পারে যা আমাদের সেভাবে কিংবা একেবারেই জানা ছিল না ।

    মলয় : আমি বলেছিলুম যে ১৯৬৫ সালে আন্দোলোন ফুরিয়ে যায় । ১৯৬৫ সালে সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে এজাহার দিয়েছিল যে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না, তারা এই আন্দোলনে বিশ্বাসী নয় ; এই আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করছে আর ভবিষ্যতে এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না । ওই দিনই জানা যায় যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী ্তে রাজি হয়েছেন । আমার কেস আরম্ভ হলে দেবী, সুবিমল, ত্রিদিব-আলো, ফালগুনী ছাড়া সবাই কলকাতা থেকে কেটে পড়েছিল ।

    এই ধরনের হীন কাজের পর কেউ যদি গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আবার নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে তো তুমি তাদের কী বলবে ? পত্রিকা বের করলেই কি আন্দোলন হল ? আন্দোলনের কর্মকাণ্ড কই ? এটা ঠিক যে ১৯৬৯ সালে সুভাষ, শৈলেশ্বর, বাসুদেব মিলে ‘ক্ষুধার্ত’ নামে একটা পত্রিকা বের করে, কিন্তু তখনও নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করতে পারছিল না তারা, রাজসাক্ষী হয়ে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য চারিদিকে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল বলে । সাহস থাকলে আর সৎ হলে তো আবার হাংরি বুলেটিন বের করলেই পারত । তবে, হাংরি আন্দোলন তো আর কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি নয়, তাই যার ইচ্ছে নিজেকে হারি থেকে নাকচ করে আবার জন্ম নিতে পারে । বিট্রে করেছিল বলে ঘোষভাইদের মধ্যে নিজেদের হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা জাহির করার আদেখলাপনা চাগিয়ে উঠেছিল । শুনেছি সেসব কথা পাবলিককে জানাতে যতটা পারে ইতিহাসকে বিকৃত করে গেছে । ইত্তম দাশ ষাটের আন্দোলনগুলো নিয়ে একটা তথ্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন বলে ঘোষভাইরা উত্তম সম্পর্কেও অপমানজনক কথা বলত ।

    শঙ্খ ঘোষও তাঁর ‘শব্দ ও সত্য’ বইতে ওই নামের প্রবন্ধে ইতিহাসকে ঝাপসা করেছেন । বইখানার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘ঘোলাটে শব্দ ও ঝাপসা সত্য’ । পড়েছ কি বইটা ? ১৯৭১ সালে লেখা বইতে উনি জানতেনই না যে তার আগে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী হাংরি মামলায় আমার কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল !

    ক্ষুধার্ত শব্দটা হাংরির প্রতিশব্দ হতে পারে না । আর্ত আবার কেন ? খিদেকে হীন মনে করার তো কারণ নেই । তুমি তো ছোটোবেলা থেকে বলছ, মা খিদে পেয়েছে । তাছাড়া পেটের খিদে বলে তো শেষ করা হচ্ছে না । খিদে পাওয়াটা তো আনন্দের । নিজেদের ভিকিরি লেবেল মারার আন্দোলন তো ছিল না হাংরি । কত রকমের যে খাবার হয় তা একবার কয়েকটা দেশ ঘুরলেই টের পাবে ; কত রকমের খিদে হয় তা জানতে পারবে । কেবল পেটের খিদে নয়, নানা ধরনের খিদে আর তা মেটাবার এলাহি কাণ্ড ।

    অরুণেশ ঘোষ নিজেকে হাংরি ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালে, ১৯৬৮-৬৯ সালে নয় । তাঁর সঙ্গে আমার কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, তুমি শুনে অবাক হবে, তিনি কেন জানি না আমাকে এড়িয়ে যেতেন । অরুণ বণিক হাংরি থেকে বেরিয়ে যাননি, তিনি খুন হয়ে গিয়েছিলেন, সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে । আর যারা ক্ষুধার্ত লেখালিখি করছিল তাদের মধ্যে সুভাষ কুণ্ডু, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন চক্রবর্তী, রবিউল, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর মুখোপাধ্যায়, জামালউদ্দীন, দীপকজ্যোতি বড়ুয়া, রবীন্দ্র মল্লিক, নিত্য মালাকার, সেলিম মুস্তফা প্রমুখকে আমি চিনি না । চিনি কেবল বিকাশ সরকার, সমীরণ ঘোষ, অলোক গোস্বামীকে । সন্দীপন যদিও সাক্ষ্যে আর এজাহারে বলেছিলেন উনি হাংরি আন্দোনে ছিলেন না, কিন্তু ১৯৭৫ সালে পেংগুইন বুকস যখন ”নিউ রাইটিং ইন ইনডিয়া” প্রকাশ করল, তাতে তিনি আত্মপরিচয় দেবার সময়ে লিখলেন যে He was also responsible for starting the Hungryalist movement in Bengali, along with Shakti Chattopadhyay the poet and Utpal Basu, a writer now living in London. সে-সময়ে সন্দীপনদা বোধহয় উৎপলকুমার বসুকে কবি বলে মনে করতেন না । বা ওই আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে একখানা চাল দিয়েছিলেন উৎপলকুমার বসুকে হেনস্হা করার জন্য । কিংবা হয়ত সত্যিই শক্তির গীতিময়তা ওনাকে আপ্লুত করত — কবিতায় উনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ করতেন না ।

    সবাই হাংরি স্পিরিট ক্যারি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না । সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত সিপিএম দলে যোগ দিয়ে কার্ড হোল্ডার হবার পর ওরা ফিজল আউট করে গিয়েছিল ; ওদের পরের লেখাগুলো পড়লেই টের পাবে । সিপিএম তো ছিল খুংখার প্রতিষ্ঠান ; হাংরি হয়ে কোন তর্কে যোগ দিল তাতে ? কোনো প্রশ্ন তুলল না অবিচার-অত্যাচার সম্পর্কে, যা গ্রামে-গঞ্জে ঘটছিল সে-সময়ে ? শৈলেশ্বরও ছিল সিপিএম-এর ইসকুল মাস্টার সংগঠনে, অথচ নতুন সরকার মসনদে বসতেই ভিড়ল সেকানে । তিরিশ বছর ধরে যে নারকীয় অবস্হা কায়েম ছিল, বিশেষ করে আশির দশকের ”বামপন্হী ফ্যাসিবাদ”, সে-ব্যাপারে ছিল স্পিকটি-নট । তুলনামূলকভাবে অরুণেশ ছিলেন সৎ । বামপন্হীদের সম্পর্কে সহানুভূতি থাকলেও তাদের ছেড়ে কথা বলেননি । সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কারনেজের পর একটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেছিলেন ক্ষোভ ক্রোধ দুঃখ যাতনাবোধ মেলে ধরে । আমি অবশ্য বর্তমান মসনদের হয়ে কথা বলছি না ।

    পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সুনীলদা-শক্তিদা-সন্দীপনদা সবাই ছিলেন কংগ্রেসি । বামপন্হীরা মসনদে বসতেই তাঁরা রাতারাতি হয়ে গেলেন দরবারি । সন্দীপনদা তো লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্যাঙাত হয়ে পেছন-পেছন ঘরছেন দেখেছি । অলোক গোস্বামী, নিত্য মালাকার, সুভাষ কুণ্ডু, রবিউল এনারা হাংরিতে যোগ দেবার আগে যেমন লিখতেন, পরেও তাই । বিকাশ সরকার নিজের আলাদা কবিতা-শরীর গড়ে ফেলেছেন ”যুগশঙ্খ” পত্রিকায় যোগ দেবার পর ।

    কিছুকাল আগে একটা ফিল্ম এসেছিল, ”বাইশে শ্রাবণ” নামে । তাতে গৌতম ঘোষ একজন হাংরি কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন । হাংরি ব্যাপারটাকে একটা গাঁজার মোড়কে উপস্হিত করেছিল ফিল্মটা । আমরা কেউ লেখা চাপাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতুম না । আমাদের উত্তরপাড়ার খণ্ডহর অমন ঘিঞ্জি ছিল না । সে-সময়ে বইমেলা নামের মেলা বসত না । বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক অংশে আগুন ধরানো হয়েছে দেখালেও না হয় সহ্য করা যেতে পারত । অনেকে, বাংলাদেশি পাঠকরাও, বলেছিল, আপনি প্রতিবাদ করছেন না কেন । আমি ওই একই উত্তর দিতুম । হাংরি আন্দোলন তো আমার প্রায়ভেট প্রপার্টি নয় । ফিল্মটা যখন রিলিজ হয়েছিল তখন রাজসাক্ষীদের উল্লেখ ছিল । যারা শুরু করেছিল তাতে শৈলেশ্বর ঘোষের নাম ছিল না । শৈলেশ্বর পঞ্চাশ দশকের এক কবিকে ধরে পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিল যাতে রাজসাক্ষীরূপে ওকে উল্লেখ না করা হয় । দেবী রায়ের কোনো উল্লেখ না করা সত্ত্বেও ও গিয়ে ধরাধরি করেনি । হাংরি মকদ্দমায় দেবী কিন্তু কোনো এজাহারও দেয়নি ঘোষভাইদের মতন ।

    সুনীলদা মারা যেতে হাংরি আন্দোলন নিয়ে কমরেড বিমান বসু যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা শুনেছিলে বা পড়েছিলে ? তা আমি কেনই বা তার প্রতিবাদ করব ? ওটা ওনার ইনটারপ্রিটেশন । ছাত্র-ছাত্রীরা এম ফিল করছে হাংরি আন্দোলন নিয়ে, এমনকি হিন্দিতেও তার প্রভাব নিয়ে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে । কোথায় কে কী লিখছেন তা তো আমি জানি না । জেনেই বা কী করব ! যার যা ইচ্ছে লিখুন । শতকে-শতকে লিখতে থাকুন ।

    নাসের : ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশিত হওয়ামাত্র দর্পন, জলসা, জনতা ইত্যাদি হালকামেধা পত্রিকাসহ অমৃত, দৈনিক বসুমতী, দৈনিক যুগান্তরের মতন বহুগ্রাহ্য পত্রিকার পাশাপাশি ভাষা-সাহিত্যের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক হাংরি, অ্যাংরি, বিট, তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে এমনভাবে উল্লেখ করতেন, যেন এই তিনটি হচ্ছে একই প্রকার অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন । এই ঘটনাটি বা বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে জানতে চাইছি আমরা ।

    মলয় : হ্যাঁ । জনতা, দর্পণ ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ-ওসকানো খবর ছাপা হতো, কার্টুন বেরোত । ওদের দপতরে গিয়ে একটু জ্ঞান পরিবেশন করার পর ওরা অমন সংবাদ ছাপানো বন্ধ করে । একটা জিনিস জেনে গিয়েচিলুম যে বেশির ভাগ সাংবাদিক আর সম্পাদকের তেমন পড়াশুনা নেই, আর তাদের কুপোকাৎ করা সহজ । যুগান্তর সংবাদপত্রে কিন্তু কৃষ্ণ ধর দুটো প্রধান সম্পাদকীয় লিখেছিলেন আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে । দর্পণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ ; তা দর্পণ-এ লেখা হল হাংরি আন্দোলন বিদেশি প্রভাবিত । ওনার বরানগরের ফ্ল্যাটে উনি ডেকেছিলেন রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাওয়াবার জন্য । আমি তৈরি হয়েই গিয়েছিলুম ভারতে আলুর আগমনের ইতিহাস নিয়ে ; তখন উনি মুচকি হাসি দিয়ে বুঝতে পারেন যে ওনাকে কোন দিকে তেনে নিয়ে যাচ্ছি । বহু আলোচক অমন আলুর দম খেয়েছেন আঙুল চুষে-চুষে আর আমাদের বলেছেন আমরা বিদেশিদের দ্বারা প্রভাবিত ।

    অনেক কাগজে লেখা হচ্ছিল আমরা নাকি আত্মপ্রচার ক্ষ্যাপা । অথচ যারা তা বলছিল, পরে জানতে পারলুম যে তারা যে যার পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটো ইত্যাদি সংরক্ষণ করার ব্যবস্হা করে চলেচে । ফোটোও তোলাচ্ছে পোজ মেরে । বিমল কর সারা বাড়ি নিজের ফোটো দিয়ে সাজিয়েভ রেখেছিলেন, এমনকি ওপরতলায় যাবার সিঁড়িতেও ।

    আরে ! তুমি সে-সব কেন করছ ভায়া ? মরার পর যাতে তোমার প্রচারটা তোমার হয়ে অন্যেরা করে দ্যায় ! ভাঁওতাবাজির চূড়ান্ত । ঘাড় নামিয়ে সম্বর্ধনা কেন নিচ্ছ ? যাতে তোমার প্রচার ছড়ায় । আমরা নিউজমেকার হতে চাইনি । আমরা চেয়েছিলুম সমাজে আঘাত দিতে । আমি আমার পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্রের সেফ ডিপজিট ভল্ট খুলে রেখে যাচ্ছি না ; এমনকি আমি আমার নিজের লেখা বইপত্রও আলমারিতে সাজিয়ে রাখি না । রাখিই না । তবে মকদ্দমার সময়ে উকিলদের সাহায্যের জন্য যাবতীয় কাটিংসের একটা ফাইল তৈরি করেছিলুম সেটা সুবিমলের কাছ থেকে সুভাষ ঘোষ হাতিয়ে নিয়ে আর ফেরত দ্যায়নি ।

    এটা সত্যিই ইডিয়টিক যে চোখ বুজে অনেকে লিখে দিচ্ছিল যে হাংরি, বিট আর অ্যাংরিদের আন্দোলন একই ব্যাপার । কোনো রচনা কৌম-নিরপেক্ষ হতে পারে না । বাঙালি একটা বিশেষ কৌম, সেটাকে অস্বীকার করাটা বাঙালিকে অপমান করা । দেখবে যে বিদেশে গিয়েও বাঙালি তার বাঙালিত্ব থেকে বেরোতে পারেনি , চেষ্টা করেও ; যখন কিনা সেই দেশে ভূমিষ্ঠ তাদের সন্তানসন্ততি মুক্ত হয়ে গেছে বাঙালিত্ব থেকে আর তা তাদের বাবা-মাকে সারা জীবন কুরে ভখেতে থাকে ।

    সমস্যা ছিল ওই সাংবাদিক-আলোচকদের শিক্ষা-প্রণালীতে । তাঁদের চিন্তাধারার প্রধান অন্তরায় ছিল সীমিত বিষয়ের বিশেষজ্ঞতা, মানে, কেবল বাংলা ভাষা-সাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন । তাঁরা মাল্টিডিসিপ্লিনারি দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করতে পারতেন না ; ফলে ব্যক্তি-একক ও তার সমষ্টিকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণ তো আর কেবল সাহিত্য দিয়ে হয় না । তাঁরা ছিলেন খণ্ডবাদী, যা আধুনিকতাবাদের চারিয়ে-দেয়া বিষের অন্যতম ।

    নাসের : হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউনসিল, পলিটব্যুরো বা সম্পাদকের দপতর ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না; যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পাদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকা দপতরটি নতুন বাড়িতে উঠে যেত । হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারনাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায়, যে-কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী ও সাহিত্যিকরা ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া, মারাঠি ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল । এই ব্যাপারটি একটু বড়ো পরিসরে বলুন ।

    মলয়: হ্যাঁ। আমাদের কোনো কেন্দ্র ছিল না । কেন্দ্র মানেই তো ক্ষমতাপ্রতাপ জাহির করার ঘাঁটি । যে পত্রিকাগুলোর নাম করলে সেগুলোর সম্পাদকের হাতে একটা করে লক্ষ্মণের লেজার বিম রেখা টানার বৈজ্ঞানিক ছড়ি থাকত ; তার বাইরে কারা আর ভেতরে কারা সেটা সম্পাদক মশায় নিজের সুপার আই কিউ দিয়ে মাপতেন । সে-সব পটপিকার সম্পাদকেরা নিজেদের গড়া ক্যানন অনুযায়ী সাহিত্যকে চালিত করে গেছেন । তাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে একরৈখিক মনে করে একটি লাইন বরাবর হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন । আমরা বললুম কলমের স্বাধীনতার কথা, যার যেমন ইচ্ছে লেখার কথা । ষাটের পর দভাখো । যে যেমন ইচ্ছে লিখছেন । কেউ আর পরোয়া করে না কে কী বলল, না বলল । আর এখন তো ইনটারনেট হয়ে কবি-লেখকরা অজস্র পাঠক-পাঠিকা পাচ্ছেন । ছড়িদারদের এলাকা সীমিত কেবল কমার্শিয়াল গ্লসির বাজারে ।

    হাংরি বুলেটিন প্রথম কয়েকটা আমি লিখেছিলুম দেবীর হাওড়ার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যাতে আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারেন । কেননা দাদা চাইবাসায়, আমি পাটনায় আর শক্তিদার কোনো পাকা ঠাঁই ছিল না । অনেকে যোগ দেবার পর যেমন ইচ্ছে বুলেটিন বের করার স্বাধীনতা ছিল । যেহেতু ফালি কাগজে বের করা হতো, তাই পকেটের রেস্ততে চাপ পড়ত না । অবশ্য খরচটা আমি বা দাদা করতুম । চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হবার ফলে মকদ্দমার সময়ে হাংরি বুলেটিনের খরচ যোগানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল আমার পক্ষে । আর বাদবাকি সবাই তো কেটে পড়ল আমাকে চার্জশিট দেবার পর ।

    ইংরেজিতে কবেকটা বুলেতিন বের করার ফলে ভারতের অন্য ভাষাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়ে গিয়েছিল । সে-সব ভাষার সাহিত্যিকরা পত্রপত্রিকায় লিখছিলেন আমাদের নিয়ে । ইংরেজিতে বেরভ করার কারণে কলকাতার সাহিত্যকর্তারা অনেকে গোঁসাঘরে হাত-পা ছুঁড়তেন । কিন্তু মামলা আরম্ভ হবার পরই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে কত জরুরি ছিল ওই কয়েকটা ইংরেজি বুলেটিন ।

    নেপালের অ্যাকাডেমি কর্তা আমাদের ডেকে নিবে গিয়েছিলেন । আমি, দাদা, কাঞ্চন, করুণা, সুবিমল, অনিল আমরা সবাই কয়েকমাস ছিলুম ঠমেল নামে একটা পাড়ায় । খড়ের বিছানা । যত ইচ্ছে চরস ফোঁকো, নেপালি দিশি মদ খাও, মোষের কাঁচা মাংস খাও, হিপিনিদের সঙ্গে প্রেম করো, আর কবিতা পাঠ করো, নিজের ভাষায়, কেউ তা হিন্দিতে অনুবাদ করে দিত, আর তারপর সেটা নেপালিতে অনুবাদ করে শোনাত কোনো তরুণ নেপালি কবি । দাদা নেপালি ভাষায় একটা আংরি সংকলন বের করেছিল ।

    কাঠমাণ্ডুতে যে বাড়িটায় আমরা থাকতুম তা বিরাট একখানা চালাঘরের কলোনি, মাঝখানে প্রায় একশো বর্গ মিটার উঠোন, আর তার চারিধারে তিন তলা চালাঘরে ভাড়াটে , হিপি-হিপিনিই বেশি । কাঠের পাকানো সিঁড়ি, রাত হলেই অন্ধকার, নেশার ধোঁয়ায় ধোঁয়া । উঠতে গিয়ে প্রায়ই ভুলে অন্যের ঘরে বা কোনো মদের ঠেকে ঢুকে পড়তুম ।

    করুণা একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তার লিভটুগেদার পার্টনার হয়ে গেল কাঠমাণ্ডু গিয়ে । কী করে ও এসব পারত ভাবলে অবাক হতে হয় । দোহারা যুবতীটি একটা আর্ট গ্যালারির মালিক ছিল । করুণার আর অনিলের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল । করুণার যে পেইনটিংগুলো বিক্রি হয়নি সেগুলোকে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিতে বললেন ওর কৃষ্ণাঙ্গী সঙ্গিনী । করুণা, যাকে বলে অম্লানবদনে ,হাসতে-হাসতে আগুন ধরিয়ে দিল । অনিল বলেছিল, প্রতিরাতে শোবার খেসারত দিচ্ছে । আগুন ঘিরে হিপি-হিপিনির সে কি নাচ, হ্যাশিশ টেনে ।

    নাসের : আমরা জেনেছি যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন, সে-সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরির নেতৃত্ব দেবেন পরিকল্পনা হয়েছিল । শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায় প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্হের বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘শয়তানের মুখ’ এবং সমীর রায়চৌধুরীর ‘জানোয়ার’ । পরে সুনীলদা তাঁর বইটির নাম পালটে রেখেছিলেন ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ । এই ঘটনাটি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যতটা সম্ভব জানান ।

    মলয় : না । কার কাছে শুনেছ জানি না । শক্তিদা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েচিলেন ১৯৬৫ সালে যখন সুনীলদা হাংরির ওপর পুরোপুরি খাপ্পা । পেলে আমায় চিবিয়ে খেয়ে ফ্যালেন । ওনার রাগ এই জন্যই ছিল যে তাঁকে না জানিয়ে আমি হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করে দিয়েছিলুম । সুনীলদা আমার বইটা প্রকাশ করার কথা যখন ভাবছেন তখনও তিনি হাংরির ঝড়ের তেজ টের পাননি । এদেশে-বিদেশে নানা ভাষায় হাংরি নিয়ে লেখা আরম্ভ হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । আমেরিকা থেকে আমাকে আর সন্দীপনদাকে লেখা ওনার ১৯৬৪ সালের চিঠি দুটো পড়লেই তা স্পষ্ট হবে ।

    সুনীলদাকে জানানোর কথা আমি শক্তিদাকে বলেছিলুম । উনি বলেছিলেন যে, জানালেই হবেখন, তাড়াহুড়োর কী আছে ; আগে আওয়াজটা উঠুক । সন্দীপনদা বলেছিলেন, তুমি কি ফুটবল টিম গঠন করছ যে ক্যাপ্টেন দরকার ! সুনীলদা বোধহয় ওনাদের কোনঠাসা করে দিয়েছিলেন, আর কলকাতার সাংস্কৃতিক-রাজনীতির খুনোখুনির সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলুম না । একটা চিঠিতে সন্দীপনদা আমাকে লিখেছিলেন যে কৃত্তিবাস ওনার ধোপা-নাপিত বন্ধ করে দিয়েছে । সন্দীপনদা এত বেশি কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন যে বাধ্য হয়ে ‘আজকাল’ পত্রিকার ঘাঁটিতে নাম লেখান । যে গদ্য উনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তারপর আর পুরস্কারের জন্য সুনীলদার কাছে গিয়ে হাত কচলাবার প্রয়োজন ছিল না । আনন্দবাজারে ঢুকে সুনীলদা পুরোপুরি পালটে গিয়েছিলেন । আমেরিকায় গিয়ে উনি বাজারের ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলেন । শন্দীপনদাকে লেখা চিঠিতে সাত কোটি ক্রেতার কথা লিখেছিলেন; তারপর তো সে বাজার বাইশ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেল । তাদের জন্য এক ধরনের ঝরঝরে গদ্য বানিয়ে ফেললেন, যা তরতর করে পড়া যায়, আর তা লেখাও যায় হু-হু করে ।

    অসট্রেলিয়ার একটা ওয়েবসাইট ওনাকে বলেছিল ‘ক্যামেলিয়ন’, আর যে মহিলা তা লিখেছিলেন, তিনি সাতটি পরিবারের একটির সদস্য যারা সুনীলদাকে অসট্রেলিয়া যাবার-থাকার খরচ দিয়েছিল ।

    তোমার মনে নেই হয়তো, তুমি তখন সাহিত্যে আসোনি, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে ( পঞ্চদশ সংকলন ) সুনীলদা কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ”অকাদেমি পুরস্কার । যারা পুরস্কার দেয় আর যারা পুরস্কার পায় তাদের হাস্যকর ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করার লোক নাই । পুরস্কার পায় কারা ? যারা তথাকথিত জীবনে নিরুদ্বেগ — যাদের অর্থসম্পদ এবং প্রতিভা যথাক্রমে প্রচুর আছে এবং সামান্যতম নেই এবং যাদের হাত সব সময়েই অপরের পদধুলি নিয়ে-নিয়ে নোংরা হয়ে থাকে । কোনোম শিল্পীই পুরস্কার প্রত্যাশী নয় । পুরস্কার একমাত্র নেওয়া সম্ভব ঈশ্বর অথবা শয়তানের হাত থেকে — ভোটে জেতা মানুষের কাছে কোন শিল্পী পুরস্কার নেবে ?”

    সুনীলদার মৃত্যুর পর বেশিরভাগ ওয়েবসাইটে লেখা হল যে উনি হাংরি আন্দোলনকারী ছিলেন । কেন ? কে বা কারা তাঁর জীবদ্দশায় প্রচার করে গেছে যে তিনি হাংরি আন্দোলনে ছিলেন ? উনি তো সারা পৃথিবী ঘুরেছেন । আমার একটা সন্দেহ আছে, তা আর তোমায় বলছি না । উপন্যাসের জন্যে কিছু নিজের স্টকে রাখি ।

    নাসের : প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হাংরি কবি-লেককদের যে-কাজকে অনেকে বলেছিলেন লজ্জাকর, যৌনতার বাড়াবাড়ি, মানসিক নোংরামি, সামাজিক বিদ্রোহ বা রাজনৈতিক প্রতিরোধ, পরবর্তীকালে অনুরূপ পাঠবস্তুতে ছেয়ে গেছে বাংলা সাহিত্য, এমনকি কমার্শিয়াল সাহিত্য । কিন্তু একটি বিশেষ আন্দোলনকে সেই আন্দোলনের সময়কার প্রেক্ষাপটে যাচাই করতে হবে । ছয়ের দশকে জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া সমাজবর্গটির মূল্যবোধের দখলে ছিল বঙ্গসংস্কৃতি । স্বাভাবিক কারণেই হাংরি সাহিত্যের থিম, আঙ্গিক, কাঠামো, বিষয় ও ইথসকে অনেকের মনে হয়েছিল কুৎসিত, বেসুরো, দুর্বোধ্য, নোংরা, লজ্জাকর, অনৈতিক আর সমাজবিরোধী । হাংরির সাহিত্যপ্রয়াস তার আবির্ভাবের কিছু বছর পর থেকেই দেখা গেছে ধীরে-ধীরে গৃহীত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের সমগ্র কর্মকাণ্ডের মধ্যে । এই ব্যাপারটার আপনি কী ব্যাখ্যা দেবেন ? বিভিন্ন উদাহরণ ও ঘটনা চিহ্ণিত করে যদি কিছু বলেন, আমরা উপকৃত হব । হাংরি স্পিরিট পুরোটাই কি সঞ্চারিত হয়েছে ?

    মলয়: আমার মনে হয় এই ব্যাপারটা পৃথিবীর সব কয়টা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঘটেছে । ডাডা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কতরকমের কথা বলা হয়েছিল । এখন তো বিজ্ঞাপনের জগতও ডাডাদের নকল করে বাজার মাৎ করার খেলা খেলছে । আন্দোলন সব সময়েই নিজের সময় আর চিন্তাপরিসর থেকে অনেক এগিয়ে থাকে । বিজ্ঞাপনগুলো দেখলেই টের পাবে লজ্জা ব্যাপারটা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত , যৌনতা নিয়ে পাঠকরা আর চিন্তিত নন । বাংলা ফিল্মের নায়িকাদের দ্যাখো, বেশিরভাগই তো হাফল্যাংটো, এবং তা আর যৌন আবেগ উদ্রেক করে না । দর্শকরা সিটি মারে নায়কের বাহাদুরি দেখে, ফাটাকেষ্টর কেরামতি দেখে ; হাফল্যাংটো নায়িকাদের দেখে নয় । তবে এটাকে হাংরি স্পিরিট বলা ভুল হবে । এটা মূলত মার্কেট ম্যানিপুলেশানের প্রক্রিয়া । আমি বরং ঋতুপর্ণ ঘোষের কাজে হাংরি স্পিরিট ছিল বলব ।

    নাসের : ‘পিজিন’ এই ইংরেজি শব্দটির অর্থ আঠারো-উনিশ শতকে বোঝাত ইংরেজি ও চৈনিক মিশ্রিত অশুদ্ধ ভাষা; বিশ শতকে তা হয় ইউরোপীয় ও উপনিবেশের ভাষার সংকরায়ণ, যে গদ্যবিন্যাসে দক্ষতা অর্জনের জন্য সালমান রুশডি, অরুন্ধতী রায়, বেন ওকরি, আমা আটা আইডু, এলেচি আমাদি, জামাইকা কিনকেইড, নিল বিসুনদাথ প্রমুখ উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখকগণ আজ জগদ্বিখ্যাত । প্রসঙ্গত, পিজিন ইংলিশ শব্দবন্ধটি স্যার ফ্রানসিস বেকন ১৬০৫ সালে লেখা তাঁর ‘দি অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং’ বইতে সর্বপ্রধম প্রয়োগ করেন । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর চেতনায় যে দ্বিধাটি এখানে প্রকট তা হল গুরু ও চণ্ডালের অথবা শিষ্ট ও অশিষ্ট ভাষার মিশ্রণ সংক্রান্ত, যে দ্বিধা হাংরি আন্দোলনকারীদের আরম্ভসূত্রেই ছিল না । অর্থাৎ ব্যাকরণের দেয়ালও ভাঙা হয়েছিল আন্দোলনে । এই পিজিন সাহিত্য এবং হাংরি আন্দোলনের রচনা নিয়ে বেশ কিছু কথা আপনার কাছে শুনতে চাইছি ।

    মলয় : হাংরি বুলেটিন কয়েকটা ইংরেজিতে বের করা হয়েছিল, আর তার দরুণ ভারতের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল । পরে ইউরোপ-আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনে সেগুলো ছাপা হয় । ওই ইংরেজি বুলেটিনের কারণেই হাংরি আন্দোলনের কথা চাউর হতে পারল, তা অনেকেরই পছন্দ হয়নি সে-সময়ে । তাই কী আর করা । তাঁরা আক্রমণ করে বসলেন ওই বুলেটিনগুলোর ইংরেজিকে । ইতিমধ্যে যে প্রাক্তন উপনিবেশের লেখকরা যে যার দেশের গুরুচণ্ডালী ইংরেজিতে লেখালিখি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন পৃথিবীজুড়ে, সে-খবর কলকাতায় বোধহয় তখনও পৌঁছোয়নি । ওই যে, একটু আগে বললুম না, যে, তখনকার পত্রিকাগুলো নিম্নর্বের ডিসকোর্সকে গ্রহণ করতে পারছিল না । ব্রাহ্মণ সম্পাদকরা পিছড়াবর্গের লেখা অনুমোদন করার জন্য নিজেদের উন্মুক্ত করতে পারেননি । কত ধরনের পদবি আছে বঙ্গসমাজে, অথচ তাদের কেন দেখা মেলেনি সে-সময়কার পত্রিকাগুলোয় ?

    সুবিমল বসাকের গল্প-উপন্যাসগুলো পড়লে আমি কী বলতে চাইছি স্পষ্ট হবে । এই যে বাদবাংলা বা বহির্বঙ্গ নামের পরিসরটা আজ দেখতে পাও, তা ওই ডিসকোর্সের কারণে । সুবিমল ওর টেক্সটে বাঙালদের ভাষা, বহির্বঙ্গের বাঙালির বাংলা, কলকাতার হিন্দিভাষীদের কথায় বাংলার অনুপ্রবেশ নিয়ে অনেক কাজ করেছে । তাছাড়া ও যে কবিতাগুলো লিখেছে তাতেও এনেছে গুরুবিরোধী চণ্ডালের বাকজগত । বহু পাঠক জানেন না যে ওর কবিতার বইও আছে কয়েকটা ।

    নাসের : আপনি লিখেছেন, ”হাংরি আন্দোলন মামলায় প্রায় তিন বছর চাকরি থেকে সাসপেণ্ডেড ছিলুম বলে বেশ ফ্রি ছিলুম । বন্ধুরা বললেই বেরিয়ে পড়া যেত । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, দেবী রায়, কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, রাজকমল চৌধুরী, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, কারোর না কারোর সঙ্গে বা কয়েকজনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তুম হাংরি মজাদারির লোভে, দাদার কর্মস্হল কিংবা দিঘা, বহরমপুর, খাগড়া, মেখলিগঞ্জ, গোসাবা, দিল্লি, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর, কানপুর, বেনারস, কাঠমাণ্ডু । স্রেফ একটা গামছা নিয়ে । ফালগুনী যেতে চাইত পাটনার কাছাকাছি খগোল, মনের, আরা, কোইলওয়র, হাজিপুর এইসব জায়গায়, খেত-টাটকা পাতা ফোঁকার উদ্দেশ্যে, পোস্ত-খোসার শরবত খাবার বা ভাঙের পকৌড়ি খাবার জন্যে, যাতে ইমোশানাল হাই পাওয়া যায়।” ফালগুনী রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও তাঁর লেখাপত্র সম্পর্কে শুনতে চাই আপনার কাছে । বহরমপুরে ও কাঠমাণ্ডুতে কী ভাবে কাটিয়েছিলেন সেই গল্পগুলো একটু বলুন ।

    মলয় : অনেক জায়গায় গেছি সে-সময়ে । একবার সুবো আচার্যের বাড়ি বিষ্ণুপুরে গিয়েছিলুম । গাঁজা ফোঁকা হল । সুবো বলল, চলো এখান থেকে কিছুদূরে একটা নদী আছে । নদীর নাম মনে নেই । ত্রিদিব বলল, চলো পার হওয়া যাক। সুবিমলও ছিল । আমরা চারজনে জামাপ্যান্ট খুলে বাণ্ডিল বানিয়ে মাথায় তুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হেঁটে পার হলুম নদী । কোথাও কেউ নেই । সবুজ চরাচর । তারপর গাছতলায় বসে আবার ফোঁকা হল । প্রেমে পড়ার গল্প হল । নতুন কী লেখালিখি করা যায় তার আলোচনা হল ।

    খাগড়ার কাছে কোনো গ্রামে সুবিমলের মাসি বা মাইমা থাকতেন । রাতে আমাদের শুতে দিয়েছিলেন মশারি টাঙিয়ে মেঝেয় । ভোরের দিকে দেখি, মশারির চালে একটা সাপ । ফণা তুলে । বিছানায় মাথার কাছে পাকানো হাংরি বুলেটিন ছিল, কেননা তখন কলকাতার প্রেসগুলোতে গিয়ে-গিয়ে অগ্রজরা বা প্রতিষ্ঠানের এজেন্টরা প্রেস মালিকদের ভয় পাইয়ে এমন অবস্হা তৈরি করেছিল যে আমরা বহরমপুরে সিগনাস প্রিন্টিং কোঅপারেটিভে বই-পত্রিকা ছাপাতুম; ওনারাই রিপন স্ট্রিটে একজনের হাতে পাঠিয়ে দিতেন । বুলেটিনের ছড়ি দিয়ে সাপটাকে মশারির চাল থেকে বাইরে ফেলে দিলুম ।

    তুমি তো বহরমপুরেই থাকো, সিগনাস এখনও আছে নিশ্চয়ই, কেননা একবার অফিসের কাজে গেলে ওনারা আমায় ডেকে দেখিয়েছিলেন কোন ট্রেডল মেশিনে হাংরি-বই-বুলেটিন ছাপানো হতো । আমাদের চেঁচামেচি শুনে সুবিমলের মাসিমা সাপটাকে দেখতেভ পেলেন একটা গর্তে ঢুকতে । তারপর যা করলেন তা অবাক-করা কাণ্ড । সাপটাযেখানে ঢুকেছিল সেখান থেকে চিনির একটা রেখা টেনে নিয়ে গেলেন কাঠপিঁপড়ের ঝাঁকের কাছে বেশ দূরে । দুপুরে খাবার সময়ে ডেকে দেখালেন পিঁপড়েগুলো সাপটার কী অবস্হা করেছে ।

    রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে গিয়েছিলুম ওর গ্রাম মাহিষিতে । সেখানে ছিন্নমস্তার মন্দিরে মোষ বলি হতো আর আসপাশের গ্রাম থেকে লোকে আসত কাটা মাংসের প্রসাদ নিতে । তারপর গায়ে মোষের রক্ত মেখে সোমরস মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ । সারাদিনে বহু মোষ বলি হতো । লোকে বলত প্রতিমার মাথার ওপর ফুল রাখলে সে-ফুল যদি না পড়ে যায় তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হবে । রাজকমল যতবার ফুল রেখেছিল ফুল পড়ে গিয়েছিল । ও সে-সময়ে প্রেম করছিল ওর দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মীয়ার সঙ্গে । এক বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল ওর । যখন মারা গেল রাজকমল তখন ওর প্রথম বউই অন্ত্যেষ্টির ব্যবস্হা করেছিল । রাজকমলও ফালগুনীর মতন অত্যধিক নেশার কারণে আত্মধ্বংসের দিকে চলে গিয়েছিল । হিন্দি কবিতার জগতে যেমন রাজকমল তেমনই কিংবদন্তি বাংলায় ফালগুনী রায় ।

    কাঠমাণ্ডুতে পারিজাত নামে এক মহিলা কবি আমাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়ি, পাহাড়ি পথে যেতে হয়েছিল । শিলিগুড়ি শহরে ওনার মূর্তি আছে । বসেছিলেন মৎস্যকুমারীর মতন পা এলিয়ে, পায়ের ওপর শাল চাপা । প্রচুর নেপালি দিশি মদ খাওয়ালেন, পেতলের বাটি করে । কবিতা পাঠ হল । আমি বলে ফেললুম যে আপনাকে এই মৎস্যকুমারীর ঢঙে বসে থাকতে দেখে প্রণয় নিবেদন করার ইচ্ছে হচ্ছে । উনি বললেন, করুন, একটু দাঁড়ান, পায়ের ওপর থেকে শালটা সরিয়ে আমার লেজের আঁশ দেখাই । শাল সরালেন । আমরা স্তম্ভিত । ওনার পায়ে ছোটোবেলা থেকে পোলিও ছিল বলে তার গ্রোথ হয়নি । পরে উনি অনেকবার কলকাতায় সুবিমলের বাসায় আতিথ্য নিয়েছেন । হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে ওনারা নেপালে আরম্ভ করেছিলেন ‘রালফা আন্দোলন’ ।

    অনিল, করুণা, কাঞ্চন থাকত বেনারসে । করুণা বলল, চলে এসো, অঢেল হিপিনি আর হ্যাশিশ আর পাকিস্তানি গর্দা নামের গাঁজা ফুলের গুঁড়ো । তুমি আমার উপন্যাস ”অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” পড়ে, কিছুটা আইডিয়া হবে । তখন তো পৃথিবী অন্যরকম ছিল । হিপিরা অ্যামস্টারডম থেকে রওনা দিয়ে টার্কি ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তানের হিপি ট্রেইল দিয়ে পৌঁছত বেনারসে, আর সঙ্গে আনত সেসব দেশের মাদক । আমি একদিন যাবতীয় মিশ্রণ খেয়ে ডিগবাজি খেয়েছিলুম ফুটপাতে । করুণা ফালুদা খাইয়ে জ্ঞান ফেরাতে দেখি কাঞ্চনের বাড়িতে গ্যারাজের ওপরের ঘরে শুয়ে আছি ।

    তখনকার ছোটোনাগপুর অঞ্চলে নানা জেলায় দাদার পোস্টিং হতো আর আমরা হিপিদল এলে তাদের নিয়ে যেতুম ডালটনগঞ্জ দুমকা চাইবাসা হাজারিবাগ ইত্যাদি জায়গায় । সেসময়ে যেমন কে সি দাশের গরম রসগোল্লা খাওয়াতুম ইপিদের, তেমনই দাদা ওদের খাওয়াত গরম মহুয়ার মদ, রিয়্যালি, গরম টাটকা তৈরি মদ । দুমকাতে বোধহয়, দোল খেলা হয়েছিল মদ খেয়ে । তারপর ডালটনগঞ্জে হরিণের মাংস আর গরম-গরম মহুয়ার মদ, চা খাবার মতন করে । বেশিরভাগ হিপির কাছে ব্যাপারগুলো অ্যাডভেঞ্চার ঠেকত ।

    নাসের : আপনার দুটি পদ্যনাটিকা হচ্ছে ”ভালোবাসার উৎসব” ও ”যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” । ”ভালোবাসার উৎসব”-এ সাতজন যুবতীকে দেখতে পেয়েছি, তাঁরা হলেন, কুলসুম বানু, নন্দিতা সিনহা, ভূবনমোহিনী রাণা, চিত্রাঙ্গদা বসু, ক্যারল নোভাক, অবন্তিকা রায়, সীমন্তিনী সেনগুপ্ত । এছাড়া আন্যান্য চরিত্রও রয়েছে । আমরা এই সাত যুবতী সম্পর্কে জানতে আগ্রহী । অসুবিধা না থাকলে ওঁদের সম্পর্কে একটু বলুন । ”যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” কাব্যনাটকে দেবযানী, যিনি ১৮ শতকের যুবতী, তিনি বলছেন, ”নারী হয়ে নারী থাকা সবচে কঠিন”। এই বক্তব্যটিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ? একটু বিস্তারিত বলুন ।

    মলয়: এছাড়া আরও দুটো কাব্যনাটক লিখেছি, ”ভরসন্ধ্যা” আর ”সুর্পনখা-বাল্মিকী সংবাদ”, সেগুলোকেও হাইপাররিয়াল বলা যায় । দ্বিতীয়টায় সুর্পনখা বাল্মিকীকে অনুরোধ করছে যে তাকে রামায়ণ থেকে মহাভারতে যেতে দেয়া হোক । রামায়ণের কবি পাখিরা প্রেম করতে পারল না বলে সেই আঘাতে কবি হয়ে উঠলেন, কিন্তু তাঁর রামায়ণে কাউকে প্রেম করতে দিলেন না, সুর্পনখাকে তো নয়ই ; উর্মিলাকে চোদ্দ বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন যাতে না সে অন্য কারোর প্রেমে পড়ে । সীতার চারিধারে লক্ষ্মণের লেজার-বিম লাইন টানলেন, ইত্যাদি, যখন কিনা মহাভারতে কবি নিজেই শুরু করেছেন প্রেমকর্ম দিয়ে, সকলেই বারবার প্রেম করার সুযোগ পেয়েচে ।

    তুমি যাদের কথা জানতে চাইছ, সেই যুবতীরা কারা তা তো কাব্যনাট্যে স্পষ্ট করে দিয়েছি, সংলাপের মাধ্যমে । তুমি কি জানতে চাইছ, এনারা আমার জীবন থেকে নেয়া কিনা । উত্তর দেয়া কঠিন । প্রথম জনের কথা বলি যাঁর নাম কুলসুম বানু, ইমলিতলার শিয়া পরিবারের মেয়ে । এই পরিবারটি ওয়াজেদ আলি শাহ-এর পতনের পর লখনউ থেকে পালিয়ে এসেছিল । অত্যন্ত গরিব হয়ে গিয়েছিল ওরা । বিড়ি তৈরি করে, হাঁস-মুরগির ডিম বেচে চলত ওদের সংসার । শায়রি করতে ভালোবাসতেন ; আমার যৌনতার উন্মেষ ঘটান । ওনাকে নিয়ে লেখা আমার কবিতা আছে কয়েকটা । আমি কুলসুম আপা বলে ডাকতুম । শেষজন শ্রীমন্তিনী, ইনি আমার কবিতার প্রেমিকা, আমার কবিতাকে প্রিডেটর পুরুষ বলে মনে করেন, বলেন যে আমার কবিতা ওনার দেহেও কাজ করে, ওনাকে জাপটে পিষে ফেলতে চায় । কী বলব ? আমার পাঠিকার সংখ্যা পাঠকের চেয়ে বেশি, কিন্তু কেউই এভাবে আমাকে অতিক্রম করে আমার কবিতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা কখনও বলেননি । ওয়ানডারফুল পাঠক-প্রেমিকা ।

    ভূবনমোহিনী ছিলেন আমার সহপাঠিনী ; চুমু খাবার সময়ে কোনো তরুণীর মুখ থেকে যে মদের গন্ধ বেরোতে পারে তা ভূবনের ঠোঁটে ঠোঁট রাখার আগে আমার কল্পনায় ছিল না । যদিও ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় শৈশব কেটেছে, সেদিন বুঝতে পেরেছিলুম যে অবচেতনে মধ্যবিত্তের পোকা থেকে গেছে । উনি ছিলেন নেপালের রাণা পরিবারের মেয়ে আর ওনাদের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো রুপোর ভাঁড়ে জঁর নামের নেপালি মদ খাইয়ে, বলেছিলেন উনি । প্রতিপত্তিশালী সামন্ত পরিবারের মেয়ে । ফণীশ্বরনাথ রেণু, হিন্দি সাহিত্যিক, যিনি রাণাদের বিরুদ্ধে নেপালে সশস্ত্র লড়াইতে অংশ নিয়েছিলেন, ওনাকে ঘটনাটা বলতে, উনি বলেছিলেন যে মেয়েটির পরিবার জানতে পারলে তোমায় জ্যান্ত পুঁতে দেবে ।

    অন্যান্যদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না, কেননা তাঁদের সন্তানসন্ততিরা পছন্দ করবেন না ।

    ক্যারল নোভাকের ভেতরে রয়েছেন কয়েকজন হিপিনি, যাদের তুমি পাবে আমার কবিতায় আর ”অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ।

    দেবযানী ১৮ শতকে যা ছিলেন এই শতকে তাঁর জৈবিক অবস্হানের বিশেষ হেরফের হয়নি । ফলে আস্তিত্বিক নারীত্ব থেকে গেছে যেখানে ছিল সেখানেই । বাঙালি নারীকে ”নারী” সংজ্ঞার ভেতরে আবদ্ধ করে রেখে দেয়া হয়েছে । ওই সংজ্ঞাকে রিডিফাইন করা কয়েক শতকেও সম্ভব হয়নি । পোশাক ইত্যাদি কেবল পালটেছে । সংজ্ঞার চারিধারে যে লেজার-বিমের সীমা তা ভাঙেনি । পুরুষের ক্ষেত্রে তা অবিরাম রিডিফাইন হয়ে চলেছে । নারীকে লড়তে হচ্ছে নিজেরই স্হিতির সীমার সঙ্গে । এই সীমা জেনডার ডাইরেকটেড হলেও ভ্যাজাইনা-সেন্ট্রিক নয় ।

    নাসের : আমেরিকার ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির ইরাজি বিভাগের গবেষক মারিনা রেজা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি রচনা করেছেন ভারতে এসে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে । গবেষণাপত্রটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষ্যটি আমি বাংলায় আনুবাদ করেছি, যা ‘হাওয়া ৪৯’ জুলাই ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এটা এক আশ্চর্য গবেষণাপত্র— নানান দিক থেকে আলো ফেলে পুরো ব্যাপারটাকে দেখাতে চেয়েছেন তিনি । তাঁর রচনাটি ইনটারনেট থেকে গৃহীত হয়েছিল । এই রচনায় পাটনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া গঙ্গা নদী এবং তারই অনুষঙ্গে জলপ্রবাহের প্রবহমানতা কী ভাবে আপনাকে সময়-অভিযানে নিয়ে গেছে, সে-কথা, ও সেই অনুভব প্রসঙ্গে বলুন আমাদের । আসলে আমরা আপনার জীবনের সেই সময়টাকে ধরতে চাইছি ।

    মলয়: মারিনা রেজা এখন মারিনা ডি হেলার হয়েছেন । মারিনার গবেষণা প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি । হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করার জন্যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বলেছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে । সেই অধ্যাপিকা মারিনাকে লেখেন যে কলকাতায় এসে তিনি যেন এ-ব্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । মারিনা ইনটারনেট ঘেঁটে আমাদের নাম খুঁজে পান আর ইউ টিউব মারফত আমাকে ইমেল করেন, আর তাঁকে বিপথগামী করে দেবার ঘটনাটা জানান । ব্যাপারখানা বোঝো । পঞ্চাশ বছর পরও একই কার্যকলাপ ঘটে চলেছে । ডেবোরা বেকারকে তো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি ; ফলে তিনি ”দি ব্লু হ্যান্ড” বইতে গল্প বানিয়েছেন । তবে ডেবোরা বেকারের বইম পড়লে টের পাওয়া যায় যে এশিয়া সোসাইটির বনি ক্রাউন চেয়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের নেতাকে অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে স্কলারশিপটা দেয়া হোক । শক্তিদা মাতলামির জন্য এমন ছবি গড়ে তুলেছিলেন যে তাঁর হাত থেকে স্কলারশিপটা ফসকে যায় ।

    ( সাক্ষাৎকারের উত্তরগুলি কয়েকদিনে কলকাতায় গ্রথিত ; ৭ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট ২০১৩ , বাগুইআটি, কলকাতায় । প্রকাশিত হয়েছে ”চন্দ্রগ্রহণ” পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ সংখ্যায় । )
    নাসের হোসেন

    নাসের হোসেন
    Posted in কৃত্তিবাস পত্রিকা, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা, বিশ্বাসঘাতকতা, শিল্পীর কন্ঠরোধ, হাংরি আন্দোলন| Tagged লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য আন্দোলন, হাংরি আন্দোলন, হাওয়া৪৯ পত্রিকা, Betrayal| মন্তব্য দিন
    দেবরাজ চক্রবর্তী নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on ফেব্রুয়ারি 6, 2013by কিছু লেখাপত্র

    দেবরাজ: মলয়দা, আপনার লেখার জন্য রাষ্ট্র যখন আপনাকে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন আপনার কী মনে হয়েছিল ?

    মলয় : অবাক লেগেছিল । কেননা বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য তার আগে তো রাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপ কখনও নেয়নি বলে জানতুম । তাছাড়া আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে ; কলকাতার তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ ছিল যে আমাকে যেন ওভাবেই হিউমিলিয়েট করা হয় ।

    দেবরাজ: যে সময়ে রাষ্ট্র আপনার কন্ঠরোধ করেছিল, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন ।

    মলয় : সে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে তোমাদের পত্রিকায় স্হান সংকুলান হবে না । অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু হল যে সাহিত্যিক লড়াইটা একাই লড়া যায় আর লড়তে হয় ।

    দেবরাজ : আপনার লেখায় বাংলা সাহিত্য এক নতুন ধরনের ভাষা পেল । আপনি কেন এই ভাষাকেই বেছে নিলেন?

    মলয় : আমি তো ফিকশান লেখায়, কবিতায় আর প্রবন্ধে ভিন্নভিন্ন ভাষা-কাঠামো ব্যবহার করি । হ্যাঁ, আমি শব্দ আর বাক্যের ব্যাংক তৈরি করেছিলুম আর তা থেকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতুম । সমার্থশব্দকোষও ব্যবহার করেছি বিকল্প শব্দের খোঁজে । ফিকশানের ক্ষেত্রে ‘নখদন্ত’ লেখায় খাপছাড়াভাব আনার প্রয়াস করেছিলুম । কবিতায়, ২০০৫ সাল পর্যন্ত কমপ্লেক্স কাঠামোর পর এখন অবন্তিকাকে নিয়ে যেগুলো লিখছি, সেগুলো থেকে কমপ্লেক্সিটি বাদ দেবার চেষ্টা করেছি । এক্সটেমপোর লেখা লিখে দেখতে চেয়েছি । এক্সটেমপোর গদ্য লিখছি জুবিন ঘোষদের ক্ষেপচুরিয়ান ই-জাইনে । আসলে আরথ্রাইটিসের কারণে কলম ধরতে পারি না বলে কমপিউটারে লিখি ; ফলে, এক্সটেমপোর লেখার তাগিদ গড়ে উঠেছে । ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক ( অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস ) নামের লেখাটাও লিখেছি একই প্রক্রিয়ায় ।

    দেবরাজ : আপনি কি সচেতনভাবেই এই ভাষাশৈলীকে বেছে নিলেন ?

    মলয় : সব লেখার ভাষাবিন্যাস সচেতনভাবেই তো করেছি ।

    দেবরাজ : রাষ্ট্র আপনাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল কেন ? অশালীন ভাষা ব্যবহারের করার জন্য ? না রাজনৈতিক সচেতনতার জন্য ? আপনার কী মনে হয় ?

    মলয় : সে সময়ে যারা পশ্চিমবঙ্গের এসট্যাবলিশমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করত তারা, যে কারণেই হোক, ভয় পেয়ে গিয়েছিল । এসট্যাবলিশমেন্ট বলতে আমি সংবাদপত্রগোষ্ঠীর কথা বলছি না । আমি বলছি ক্ষমতাধিকারীদের কথা । বলছি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মসনদে আসীন লোকেদের কথা । ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের সর্বভারতীয় কর্তা এ. বি. শাহকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার তেমনটাই জানিয়েছিলেন ।

    দেবরাজ : রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী মনোভাবের জন্যই কি আপনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ?

    মলয় : যে কোনো পুরস্কারই পুরস্কারদাতার মূল্যবোধটি প্রাপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, ওই পুরস্কারটির মাধ্যমে । বাংলা অ্যাকাডেমির দিকে তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে ; আগের লট চলে গিয়ে নতুন লট এসেছে ; তাদের পুরস্কার-প্রাপকদের তালিকা একেবারে আলাদা । আমি কোনো পুরস্কার নিই না । লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও নয় । আমার নাকতলার বাড়িতে অনুষ্ঠান করে পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন এক সম্পাদক ; তিনি বোঝার চেষ্টাই করেননি আমার অবস্হান । আমি কোনো সম্বর্ধনাও নিই না । এই সব ব্যাপারগুলো আমাকে প্রচণ্ড ডিসটার্ব করে ।

    দেবরাজ : সেই সময়ে, আপনার কাছের মানুষ ও সমকালীন লেখকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

    মলয় : কাছের মানুষ বলতে যদি আত্মীয়দের কথা বলছ, তাঁরা ডেট পড়লে ব্যাংকশাল কোর্টে আমাকে সমর্থন জানিয়ে যেতেন । হাংরি আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুবিমল বসাক নিয়মিত আর দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র-আলো মিত্র মাঝে-মধ্যে কোর্টে আসতেন । কিন্তু সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে পুলিশের সাক্ষী হয়েছিলেন ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য । দীপক মজুমদার একটা চিঠি তৈরি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে লেখা, আমাকে গ্রেপ্তার আর আমার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করে । সেই চিঠিতে আনন্দ বাগচী ছাড়া আর কোনো সাহিত্যিক সই করতে রাজি হননি ; অনেকে দীপককে ভর্ৎসনা করেছিলেন ।

    দেবরাজ : হাংরি আন্দোলনের প্রথম দিকে যাঁরা ছিলেন,তাঁদের মধ্যে কয়েকজন পরে এই আন্দোলন থেকে সরে যান । এর কী কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন ?

    মলয়: যাঁরা মুচলেকা দিয়েছিলেন, তাঁরা ভয় পেয়েগিয়েছিলেন । শৈলেশ্বর ঘোষ তো কাঁদছিলেন লালবাজারে যখন জেরা করা হচ্ছিল । বোধহয় চাকরি খোয়াবার ভয় ছিল । কৃত্তিবাস গোষ্ঠী থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা ছেড়ে চলে যান প্রধানত আয়ওয়া থেকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠির আঘাতে-আঘাতে । প্রতিদানে পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হবার পর ওনাদের গ্রন্হ প্রকাশ, পুরস্কার ইত্যাদির ব্যবস্হা করেছিলেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকেও বলেছিলেন, “তোর ওই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছাড় ; আমার কাছে আয়, আমি প্রকাশকদের বলে তোর বইগুলো বের করে দেবো আর পুরস্কারও পাইয়ে দেবো ; দেখতেই পাচ্ছিস কারা-কারা পুরস্কার পাচ্ছে ।

    দেবরাজ : তৎকালীন কোনো সংবাদপত্র কি আপনাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল ? তৎকালীন লিটল ম্যাগাজিনগুলির এই আন্দোলনের প্রতি কী ভূমিকা ছিল ?

    মলয়: না, কোনো সংবাদপত্রমালিক সমর্থন করেননি বলেই জানি । তবে সে সময়ে ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রে দুটি সম্পাদকীয় আমাদের সমর্থনে লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর । আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান সংবাদপত্রে কয়েকবার টিটকিরি মেরে কার্টুন বেরিয়েছিল আমার আর দেবী রায়ের । দর্পণ, জনতা ইত্যাদি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে আমাদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখা হতো বা কার্টুন বেরোতো । আমি গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে দেখা করার পর দর্পণ-এ তা বন্ধ হয় । হাংরি আন্দোলনের কারণেই লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটে ; তার আগে হাতে-গোণা গুটিকয় লিটল ম্যাগাজিন ছিল যাদের এলিটিস্ট বলাই ভালো । তার সম্পাদকরা আমার সঙ্গে কথা বলার আগে আমাকে পেডেস্ট্রিয়ান ভাবতেন ।

    দেবরাজ : মলয়দা, এবার একটু অন্য প্রশ্ন করি । এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের পরিস্হিতি ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনার কী মত ?

    মলয় : যাঁরা পটবয়লার সাইত্য করেন, তাঁরাই চতুদীক ছেয়ে ফেলেছেন । লিটল ম্যাগাজিন স্তরে অনেক কাজ হচ্ছে । আমাদের অ্যাকাডেমিয়া ওই পটবয়লার জগতের বাইরে বেরোতে চান না । বিদেশি সাহিত্যিকদের নিয়ে আমাদের অ্যাকাডেমিয়া যতটা আগ্রহী, ততটা তাঁরা লিটল ম্যাগাজিনের নন-কনফরমিস্ট বাংলা লেখালিখির সঙ্গে নন । তবে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা যাঁরা অ্যাকাডেমিক জগতে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলা ক্রিয়েটিভ লেখালিখির দিকে নজর দেবেন বলে মনে হয় । এটা যে হবে তা এই জন্য বলছি যে তা না হলে আমার সম্পর্কে একজন তরুণ লেকচারার পিএচ ডি করবেন কেন ? আমাকে বেশ কয়েকজন লেকচারার বলেছেন যে তাঁরা বাংলা অ্যাকাডেমিয়ায় পরিবর্তন ঘটাবেন ।

    দেবরাজ : বর্তমান বাংলা সাহিত্যের জগৎ কি ক্রমশ রাজনীতি-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে ?

    মলয় : সমগ্র সাহিত্য জগৎ নয়, তবে সাহিত্যিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়ে গেছেন দলাদলিতে । দলাদলি না করলে স্বীকৃতি মেলা, বই প্রকাশ, বিক্রি, পুরস্কারপ্রাপ্তি ইত্যাদি আজ অসম্ভব । বঙ্গসমাজ সহজে এই ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না । বহু লেখকই মনের কথা আর লিখতে চান না ।

    দেবরাজ : আপনার অনেক লেখা আমরা ই-ম্যাগাজিন বা ইন্টারনেটে দেখতে পাই । লেখার জন্য এই মাধ্যমটিকে আপনার কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় ? এর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে ?

    মলয় : ইনটারনেটের মাধ্যমে আমি সারা পৃথিবীর পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমার লেখা পৌঁছে দিতে পারছি । তার আগে আমার এত পাঠক-পাঠিকা ছিল না । উন্নত দেশগুলোয় ইনটারনেট বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । কিন্ডল-এ অনেকে বই আপলোড করে যখন ইচ্ছা পড়তে পারছেন পাঠক । ওপার বাংলায় ইনটারনেটে বাংলা ভাষায় যা ঘটছে তা থেকে অনুমান করা যায় যে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গেও এর গুরুত্ব বাড়বে ।

    দেবরাজ : এই সময়ের কার-কার লেখা আপনার ভালো লাগে ?

    মলয়: একটা লেখায় কী কাজ করা হয়েছে, সেটাই দেখার । জেমস জয়েস ও মার্সেল প্রুস্তের লেখা অনেকেরই ভালো লাগবে না । কিন্তু তাঁদের কারণেই তাঁদের মাতৃভাষা আজ এত উন্নত ।

    ( ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে নেয়া সাক্ষাৎকার । দেবরাজ চক্রবর্তী, সম্পাদক ‘পারেজিয়া’, গড়িয়া, কলকাতা ৭০০ ০৮৪ )
    দেবরাজ চক্রবর্তী

    দেবরাজ চক্রবর্তী
    Posted in কৃত্তিবাস পত্রিকা, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা, লিটল ম্যাগাজিন, হাংরি আন্দোলন| Tagged প্যারেজিয়া, লিটল ম্যাগাজিন, হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায় নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অগাষ্ট 24, 2012by কিছু লেখাপত্র

    মলয় রায়চৌধুরী

    সুদক্ষিণা: মলয়দা, একটা কথা আমায় বোঝান । পোস্টমডার্ন সাহিত্যভাবনা নিয়ে এত পরস্পরবিরোধী প্রতিপাদ্য সোনা যাচ্ছে কেন ? অমিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন, ওনারা উত্তরআধুনিক কবিতার একটা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন , তাতে আশির দশকের বহু কবিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।কবিতাগুলোকে আমার অন্যধরণের মনে হয়নি। অমন কবিতা পঞ্চাশের, ষাটের, সত্তরের কবিরা তার পূর্বেও লিখছিলেন। সমালোচিত হবার পর ওনারা উত্তরআধুনিক চেতনার ভূমিকা শিরোনামে একটি গ্রন্হ লেখেন । বক্তব্য ছিল যে কবিতার অবয়ব ভিন্ন না হলেও, চেতনাটি ভিন্ন। কিন্তু ফরাসি পোস্টমডার্ন ভাবুক জাক লাকাঁ, মিশেল ফুকো প্রমুখ তো বলেছেন যে আজকের মানুষের সমন্বিত চেতনা হয় না। অপরপক্ষে সমীর রায়চৌধুরী, ধীমান চক্রবর্তী, রুদ্র কিংশুক, প্রভাত চৌধুরীর মতে, পোস্টমডার্ন সাহিত্যভাবনার জন্ম তিরিশের দশকের উত্তরঔপনিবেশিক নিকারাগুয়ায়। নিতাই জানার পোস্টমডার্ন ও উত্তরআধুনিক বাংলা কবিতা পরিচয়, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোস্টমডার্ন ভাবনা ও অন্যান্য, সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর উত্তরআধুনিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, বীরেন্দ্র চক্রবর্তীর বাংলা কবিতার প্রাকৃতায়ন ইত্যাদি বইগুলো পড়ে আরও কনফিউজড হয়ে গেছি। আপনাকে তো পোস্টমডার্ন সাহিত্যভাবনার অথরিটি মনে করা হয় । আপনি বিষয়টা বুঝতে প্লিজ সাহায্য করুন।

    মলয়: তুমি তো দেখছি কেদার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে আমি যে টেকনিক অ্যাডপ্ট করেছিলুম, সেটাই ফলো করছ। প্রশ্নের মধ্যেই একটা উত্তর লুকিয়ে রাখছ যাতে তার বিকল্প উত্তর দিতে পারি। হ্যাঁ, অনেকেই মনে করেন যে আসল সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন অঞ্জন সেন, অমিতাভ গুপ্তরা । নিতাই জানা, বীরেন্দ্র চক্রবর্তী তাকে আরও জটিল করে তুলেছেন। অঞ্জন সেন একটা তালিকা তৈরি করে দেখিয়েছিলেন যে পঞ্চাশ আর ষাটের কবিরা ইউরোপের নকল করে অবক্ষয়ী কবিতা লিখেছেন, যখন কিনা ওনারা সুস্হ চেতনার প্রাগৈতিহাসিক কবিতা লিখছেন। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের অবক্ষয়ের কারণ হল দেশভাগের পর, উদ্বাস্তুদের আন্দামানে যেতে না দিয়ে জোর করে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন দেবার গোঁ। অঞ্জন সেন, উদয়নারায়ণ সিংহ, অমিতাভ গুপ্ত যখন উত্তরআধুনিক কবিতার আওয়াজ তুলেছিলেন তখন পোস্টমডার্ন ভাবনাটা তাঁদের কাছে স্পষ্ট ছিল না । তার ওপর ওনারা প্রগতিতত্ত্বের রৈখিক ডায়ালেকটিকে বিশ্বাসী, যা পোস্টমডার্ন ভাবনায় গ্রাহ্য নয়। এখন দুটোকে মেলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন । পার্থপ্রতিম, সুদেষ্ণা ওনাদের বইতে মার্কসবাদের সঙ্গে পোস্টমডার্ন ভাবনার সংঘাতকে বড়ো করে দেখেছেন। ওগুলোও একপেশে।ঔ ভারতবর্ষে এখন বহু মার্কসবাদী দল আছে । তাদের মধ্যে খুনোখুনি হয় । এই বহুত্বই পোস্টমডার্ন । বহুত্ব ও বৈভিন্ন্য অস্বীকার করে পোস্টমডার্ন ভাবনা হয় না। বহুত্ব ও বৈভিন্ন্য হল ভৌগলিক, প্রকৃতিপ্রদত্ত । মানবসমাজে তা থাকবেই । সেকারণেই বাংলাদেশীরা বাঙালি হয়েও আমাদের থেকে আলাদা।

    সুদক্ষিণা: ওনারা, অঞ্জন সেন ওনারা, ফেদেরিকো দ্য ওনিসের কথা বলেননি তো কখনও। যদি ইউরোকেন্দ্রিকতার বিরোধিতা করার ছিল, তাহলে তো ওনিস প্রসঙ্গ তোলা উচিত ছিল। সমীর রায়চৌধুরী এবং প্রভাত চৌধুরী, যাঁরা পঞ্চাশের ষাটের কবি, ওনারা দেখেছি ওনিস থেকে বক্তব্যের সূত্রপাত করেছেন । আপনিও খোলাবারান্দা সম্পাদক দূর্বাদল দত্তকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তাতে ওনিসের কথা বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যের শব্দকোষ প্রকাশ করেছেন, তাতেও ওনিসের উল্লেখ নেই। তাতে জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার, ইহাব হাসান-এর উল্লেখ আছে। উনিও কি একপেশে ?

    মলয়: মহাকরণে যে সরকারই থাকুক না কেন, সরকারি অনুগ্রহপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবিরা একপেশে হতে বাধ্য। সে-সব কথা থাক। ওনিসের কথা, বা পোস্টমডার্ন সাহিত্য-ভাবনার সূত্রপাতের কথা বলি । নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস ১৯৩৪ সনে প্রকাশিত আনতোলোজিয়া দ্য লা পোয়েজিয়া এসপানোলা এ হিসপানোমারিকানা কাব্য সংকলনে সর্বপ্রথম পোস্টমডার্ন শব্দটা প্রয়োগ করেন । উনি এই ভাবকল্পের সূত্রপাত ঘটাতে বাধ্য হন । উনি অনুভব করেন যে স্প্যানিশভাষী দেশ হওয়া সত্ত্বেও স্পেনের সঙ্গে নিকারাগুয়ার বা লাতিন আমেরিকার কোনও ব্যাপারে কোনো মিল নেই । ১৫২২ সনে স্প্যানিশ জলদস্যু গিল গনহালেস দ্য আভিলা ওই ভূখণ্ড দখল করে তাকে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করার পর ১৮২১ পর্যন্ত তা স্পেনের উনিবেশ ছিল । তারপর তা ছিল মেক্সিকোর প্রদেশ। ১৮৩৮ সনে দেশটা স্বাধীন হয় । ১৯১২ সনে মার্কিনিরা মিলিটারি ঘাঁটি গাড়ে । তারা বিদেয় হবার সময়ে সেদেশে জেনারেল আনাসতাসিও সোমোজা নামে একজন অত্যাচারী খলনায়ককে সিংহাসনে বসিয়ে যায়। সোমোজা পরিবার রাজত্ব করেছিল ১৯৭৯ পর্যন্ত। সোমোজা পরিবারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন আগুস্তো সেজার সানদিনো। যে বছর সানদিনো আততায়ীর হাতে খুন হন সে বছরেই ওনিসের বইটা বেরিয়েছিল।

    নিকারাগুয়ার আদিনিবাসী রেড ইনডিয়ানদের সংস্কৃতিতে মিশেছিল ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ, ক্রিতদাস কৃষ্ণাঙ্গ, আর ভারতীয় ইনডেনচার্ড লেবারদের সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগোত্তর মিশ্র ও গরিব উত্তরঔপনিবেশিক জনসমাজের মতন ওই দেশটায় পরিত্যক্ত হল মডার্ন সাহিত্যার আদল ও আদরা । সোমোজার ভয়ে অনেক কবি-লেখক পালিয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে । যাঁরা ব্রাজিলে গিয়েছিলেন তাঁদের বলা হয় লুসো ব্রাজিলিয়া। ব্রাজিল একটা পর্তুগিজভাষী দেশ। লাতিন আমেরিকা থেকে পোস্টমডার্ন ভাবকল্প পৌঁছেছিল ইউরোপে । উত্তরঔপনিবেশিক এই ভাবকল্পটিই জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার রিডিফাইন করে উপস্হাপন করলেন তাঁদের অতিউন্নত সমাজের প্রেক্ষিতে। উন্নত বলতে আর্থিক আর প্রযুক্তির ভিন্নতা । মার্কিন মিলিটারি বুদ্ধিজীবিরা ভাবকল্পটাকে নিজেদের সঙ্গে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে ইংরেজি বইয়ের চল বেশি বলে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের ইতিহাস অবহেলিত। আর নিকারাগুয়া তো একেবারেই অবহেলিত ।

    সুদক্ষিণা: তো, মডার্ন সাহিত্যভাবনার পার্ধক্য ঠিক কোথায় ? কী করে বুঝব যে লেখাটা পোস্টমডার্ন ? নিতাই জানা ওনার বইতে অমিতাভ গুপ্ত, কালীকৃষ্ণ গুহ এবং বীতশোক ভট্টাচার্যকে বলেছেন উত্তরআধুনিক। অঞ্জন সেনের অবক্ষয়ের আধুনিকতা বনাম উত্তরআধুনিকতা বইয়ের তালিকা সত্ত্বেও নিতাই জানা বলেছেন যে উত্তরআধুনিকতা যখন সিনথেসিস বা সংশ্লেষণে গুরুত্ব আরোপ করে, পোস্টমডার্ন তখন বিরোধে জোর দ্যায়। সমীর রায়চৌধুরী বলেছেন, কালের তুলনায় স্হানিকতা পোস্টমডার্ন ভাবনার প্রধান উপাদান। নিতাই জানা স্হানিকতাকে বাতিল করে দিয়েছেন।

    মলয়: আবার প্রশ্নের মধ্যে উত্তর লুকিয়ে বিকল্প খুঁজছ ? ছাত্র পড়াবার ফল বোধহয় !

    সুদক্ষিণা: তাই-ই সই…

    মলয়: আমার মনে হয় সক্রেটিস প্রতিপাদিত ডায়ালেকটিক তত্ত্ব থেকে নিতাই জানাও মুক্ত নন । ত্ত্বটাকে হেগেল ভাববাদী জামা পরালেও, মার্কস-লেনিন-স্তালিন-মাও-এর কাছে তা ছিল মিলিটারি তত্ত্ব । মার্কস বলেছিলেন শ্রমিক মিলিটারির কথা। তত্ত্বটা সময়কে রৈখিক মনে করে । যখন কিনা পোস্টমডার্ন ভাবনায় রয়েছে বহুরৈখিকতা, যে কথা ফেদেরিকো দ্য ওনিস বলেছিলেন । বহুরৈখিকের একটা রেখার সঙ্গে বিরোধ হতে পারে। সবগুলো রেখার সঙ্গে তো বিরোধ হবে না। ডায়ালেকটিক অনুযায়ী সিনথেসিস কপঞে হয়ে দাঁড়ায় থিসিস । ওই তিনজনের কবিতার অবয়ব সত্যিই একরেখ, তাতে আদি-অন্ত থাকে, যার অবয়বের বৈশিষ্ট্য হল বদ্ধসূচনা আর বদ্ধসমাপ্তি । ওনারা টিপিকাল আধুনিক কবি। এতে ভালো-খারাপ খুঁজতে যেও না।

    সুদক্ষিণা: এগুলোই কি আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য ?

    মলয়: আরও কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আছে । প্রধান হল যে তা স্বয়ংসম্পূর্ণ-সমগ্র বা একটা জমাট ঠাণ্ডা পাথরের মতন, কবির ব্যক্তিপ্রতিস্বে ভরাট , নিজের কবিতায় কবি সদা-সর্বদা উপস্হিত থাকেন। মডার্ন কবিতার একটা লাইনের সঙ্গে তার পরের লাইনের সম্পর্ক জরুরি । সাধারণত এক-অভিজ্ঞতানির্ভর হয়। ফলে সুস্পষ্ট চিত্রকল্প থাকে । যুক্তি সাজিয়ে-সাজিয়ে এগোয়। কবি বা লেখক চেষ্টা করেন অন্যদের থেকে আলাদা লিখতে , যাতে তাঁর একটা নিজস্ব ব্র্যাণ্ড হয়। পুরো ব্যাপারটাই ব্রিটিশ রাজত্বে এসেছে। কলকাতা থেকে ওদের রাজত্ব আরম্ভ হয়েছিল বলে ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে প্রথমে আধুনিকতা এসেছিল। আবার মনে করিয়ে দিই যে মডার্ন ভালো না পোস্টমডার্ন ভালো এরকম তর্ক অবাস্তব।

    সুদক্ষিণা: তাহলে পোস্টমডার্ন সাহিত্যের অবয়ব কী হবে ?

    মলয়: পোস্টমডার্ন রচনার বৈশিষ্ট্য হল যে পাঠবস্তুটির অবয়ব থাকবে মুক্ত-সূচনা আর মুক্ত-সমাপ্তির আঙ্গিকে । একটা লাইনের সঙ্গে পরের লাইনের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা কম। রচনাটা পাথরের মতন একশিলা নয়, বরং ছেতরানো । যুক্তির ধাপ দিয়ে গড়া নয় , বা একাধিক যুক্তিফাটল থাকে তাতে । অর্থাৎ তা একটি একক নয়, তা যৌগিক । পরতের পর পরত টুকরো-টুকরো দ্রুতগামী চিত্রকল্প থাকে । রচনাটিতে বিষয়কেন্দ্র থাকে না । লেখকের ব্যক্তিপ্রতিস্ব তাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না । পোস্টমডার্ন সংকলনটা আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে আগামী বইমেলায় বেরোবে । ওতে আমার একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে। যোগাড় করে পোড়ো । তাহলে বিস্তারিত জানতে পারবে।

    সুদক্ষিণা: বইটার প্রথম সংস্করণ উষারঞ্জনবাবুর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছি । তাই তো বিষয়টা সম্পর্কে আরও জানার ইচ্ছা জাগছে ।

    মলয়: নতুন সংস্করণে নতুন সংস্করণে আমি সমীর রায়চৌধুরী আর বাংলাদেশের এজাজ ইউসুফির তৈরি করা তুলনামূলক সারনি দুটো অ্যাড করেছি।

    সুদক্ষিণা: আপনার এই অধম ওই অধম উপন্যাসখানা নিয়ে স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেশ তর্ক চলছে। আপনার বই বেরোলেই তর্কের ঝড় ওঠে। কিন্তু এই বইটি বেশ সাড়া ফেলেছে । আপনি কি পোস্টমডার্ন উপন্যাস লিখবেন ভেবেই রচনা করেছেন গ্রন্হটি ?

    মলয়: হ্যাঁ । এতক্ষণ পোস্টমডার্ন বলতে যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলছিলুম তা সবই তুমি পাবে উপন্যাসটীতে । রচনার সন্দর্ভে রৈখিকতাকে বিপর্যস্ত করে আমি দিতে চেয়েছি ভাঙা আয়নার ব্রিকোলাজ। তাছাড়া উপ্যাসের কথক একজন স্কুলবালক। অত কম বয়সে টানা ভাবনা সম্ভব নয়। তার উড়ো ভাবনা দিয়ে ভাষাবুননটাকে ছেতরানো করার চেষ্টা করেছি। তুমি দেখবে যে এক প্যারার সঙ্গে পরের প্যারার মিল নেই । ওতে যেমন তুলসীদাস, কবির, রহিম, দাদু, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ আর গালিবের ডিসকোর্স আছে, তেমন আছে প্রাগাধুনিক বাংলা কাব্যের ডিসকোর্স। অজস্র চরিত্র আছে । রচনাটায় তুমি মজা, থ্রিল, আহ্লাদ, খুনসুটি, মসকরা, খেলা, আয়রনি পাবে ।

    সুদক্ষিণা: জানি । পড়েছি। এরপর কী লিখছেন ?

    মলয়: এবারের হাওয়া৪৯ পত্রিকায় আমার নখদন্ত নামে একটা পোস্টজেনেরিক উপন্যাস থাকছে । রামায়ণ-এর মতন সাতটা অংশ আছে । তাই সাবটাইটেল দিয়েছি পোস্টমডার্ন সাতকাহন । তবে মহাভারত থেকে একটা আইডিয়া নিয়েছি । তা হল গল্পের ভেতর গল্প । আবার তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলোর তথ্য আছে । কিন্তু নায়ক-নায়িকা, পাত্র-পাত্রী নেই । লাফিয়ে-লাফিয়ে বিষয় পালটেছে । একেবারে ডিন্যারেটিভাইজ করে দিয়েছি। বের হলে পোড়ো। পড়ে তোমার রিঅ্যাকশান জানিও ।

    ( জীতেন্দ্রনাথ হাটুই সম্পাদিত কুবাই পত্রিকার ১৪০৯ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতোকোত্তর ছাত্রী সুদক্ষিণা চট্টোপাধ্যায় )
    Posted in অধুনান্তিকতা, পোস্টমডার্ন| Tagged কুবাই পত্রিকা| মন্তব্য দিন
    গার্গী ঘোষদস্তিদার নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অগাষ্ট 15, 2012by কিছু লেখাপত্র

    গার্গী: আপনি বলেছেন বহির্বঙ্গের বাঙালির যে সাংস্কৃতিক স্হিতি, তাতে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক সংস্কৃতির তুলনায় পোস্টমডার্ন উপাদান বেশি করে চোখে পড়ে। সত্যিই কি তাই ? বাঙালিদের সংস্কৃতিও তো বঙ্গসংস্কৃতি ? প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর পোস্টমডার্ন কান্ডিশানকে গড়ে তুলেছে বহুপ্রকার কার্যকারণ । আপনি বহির্বঙ্গের বাঙালি জীবনে কোন-কোন দ্যোতকগুলোকে এ-ব্যাপারে চিহ্ণিত করবেন ?

    মলয়: নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস ওনাদের দেশে যে বৈশিষ্টগুলোর কারণে ১৯৩৪ সনে ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দ ও ভাবকল্প উদ্ভাবন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে বৈশিষ্টগুলোই তুমি বহির্বঙ্গে বেশি করে দেখতে পাবে। কিন্তু ওই কুণ্ডু স্পেশাল ট্রেনে ভ্রমণ করলে চলবে না। ব্যাপারটা ঠাহর করতে হলে গিয়ে কিছুকাল থাকতে হবে বহির্বঙ্গের বাঙালিদের মাঝে ;সেই সমাজের অঙ্গীভূত হতে হবে । হোমি ভাবা যাকে বলেছেন ‘হাইব্রিডিটি’ বা ‘সংকরায়ন’, ইহাব হাসান ওনার ‘পোস্টমডার্ন’ বিষয়ক আলোচনায় যে জিনিসটাকে বলেছেন বদ্ধ আঙ্গিক থেকে মুক্তি এবং অবিরাম পরিবর্তনশীলতা, তা তুমি পাবে বহির্বঙ্গে । পশ্চিমবঙ্গের সমাজে রিফিউজি অভিঘাতে যে হাইব্রিডিটি তা তো উল্টে পশ্চিমবঙ্গকে বদ্ধকূপে পালটে ফেলেছে , যেখানে সংস্কৃতি নিয়ে রাজনৈতিক নোংরামি হয় । বহির্বঙ্গের হাইব্রিডিটি স্হানিক । এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ‘পোস্টমডার্ন’ ভাবনায় স্হানকে বিশেষ জায়গা দেয়া হচ্ছে। মডার্ন ভাবনায় দেয়া হয় কালকে। তুমি দেখবে বিহারের, মহারাষ্ট্রের, দিল্লির বাঙালিদের মধ্যে তাদের জায়গাটা বাচনিক-নান্দনিক ভূমিকা নিচ্ছে । ভূমিকাটা ইতিবাচক। পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্তন উদ্বাস্তুরা এখনও নেতিবাচক স্হানিকতা বয়ে বেড়াচ্ছে ।

    গার্গী: কিন্তু তার ফলে তারা কি বঙ্গসংস্কৃতির বাইরে চলে যাচ্ছে না ?

    মলয়: না-না, তা কেন হবে ! সংস্কৃতি তো স্হির নিশ্চল ব্যাপার নয়। তুমি তো বেশ কয়েকবার ঢাকায় গেছ । ওঁরাও বাঙালি। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্তরে কলকাতা থেকে প্রচ্ছন্নভাবে আলাদা। অর্থাৎ বঙ্গসংস্কৃতি কলকাতায় পয়দা হয় না। সংস্কৃতির নামে কলকাতায় যা ম্যানুফ্যাকচার হয় তা হল নাচা-গানা-কমার্শিয়াল সাহিত্য , যা এথনিকালি পশ্চিমবঙ্গীয় নয় , কেননা তা গ্রামসমাজ থেকে উঠে-আসা নয়। বহির্বঙ্গের ডিসকোর্স সেই মাইক্রোলেভেল সমাজের ডিসকোর্স । স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত বঙ্গদেশের ডিসকোর্সকে প্রবাসী বাঙালি নিজের বলে মনে করত । তার কারণ তখন স্হান বা স্পেসের তুলনায় কাল বা টাইমকে গুরুত্ব দেয়া হতো। দার্শনিক তর্কে বলা যায় যে মডার্ন ভাবনায় স্পেসকে কনভার্ট করে ফেলা হতো টাইমে। স্বাধীনতার পর, উত্তরঔপনিবেশিকতায়, বহির্বঙ্গ নিজের বিশেষ স্পেসটাকে টাইম থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। ভাষাজীব হিসাবে বহির্বঙ্গের বাঙালি এখন নিজেকে রিডিফাইন করে নিয়েছে। কতজন বাংলা ভাষা লিখতে পড়তে পারে , না পারে না, তা অবান্তর। তুমি তো জানো আমি সাবর্ণ চৌধুরী বংশের । আকবর-জাহাঙ্গিরের আমলে আমার পূর্বপুরুষেরা ফারসি আর সংস্কৃত লিখতে পড়তে পারতেন। দেশের বাড়িতে সেসব বই-পুঁথি ছিল। তবে ? তাঁদেরই এক বংশধরের তুমি ইনটারভিউ নিচ্ছ যেহেতু সে বাংলায় লেখে। কলকাতার এখনকার ভাটিয়া বাঙালিদের চেয়ে তাঁরা তো খাঁটি প্রাগাধুনিক বাঙালি ছিলেন । কলকাতার বাম-বুঢঢা রাজনীতিকরা যে পোশাক পরে বাঙালি সাজেন, সে পোশাক ভারতচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র পরতেন না।

    গার্গী: অমর্ত্য সেন তো পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্যের কথা ওনার ট্রাস্টের রিপোর্টে বলেছেন….

    মলয়: হ্যাঁ । এরাই আবার সেকুলারিজমের বারফট্টাই মারে । এখানে শহরাঞ্চলেও হিন্দু-মুসলমানরা বিয়ে ইত্যাদিতে পরস্পরের পরিবারকে নিমন্ত্রণ করেন না । গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে মধ্যবর্গ ভূস্বামী। নিম্নবর্গ সেখানে বিহারের মতোই অবহেলিত। এই যে কামতাপুরিরা পৃথগন্ন হতে চাইছে, খুনোখুনি করছে, অবহেলার কারণে। বহির্বঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে এ-জিনিস পাবে না। তারা নিজেদের আশে-পাশের সমাজের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু নিজেদের বৈভিন্ন্য বজায় রেখেছে। পোস্টমডার্ন ভাবুকরা যাকে বলছেন , এক্সটার্নাল ইউনিফায়ার , বহির্বঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে তা সক্রিয় । পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় মডার্নিজমের ইনটারনাল ইউনিফায়ার । এখানে তৃণমূল ছাত্র ইউনিয়ানের ছেলে যদি সিপিএম ছাত্র ইউনিয়ানের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তাহলে পলিটিকাল ক্যাম্পাস রায়ট হয়ে যায়। বহির্বঙ্গের বাঙালিরা এই নীচতা এবং মূঢ়তা থেকে মুক্ত। অভেদের সন্ধান করার সামাজিক বোধ, যা পোস্টমডার্ন ভাবনার ভিত্তি, উত্তরঔপনিবেশিক বহির্বঙ্গে তা চুপচাপ কাজ করে চলেছে। বহির্বঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে একটা কথা বেশ প্রচলিত। তাআ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গকে বলে প্যারাসাইটদের সার্কাস।

    গার্গী: বহির্বঙ্গের বাংলা পত্র-পত্রিকায় মডার্ন-পোস্টমডার্ন ব্যাপারটা নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না কেন ? ওপার বাংলার প্রায় প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনে পোস্টমডার্ন দর্শন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা থাকে। এপার বাংলায় কিছু-কিছু পত্র-পত্রিকায় তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়, যেমন জিঞ্জাসা, হাওয়া-৪৯, অনীক, অন্যস্বর, অপর, কবিতা পাক্ষিক, আলোচনাচক্র ইত্যাদি। আপনি ভেবেছেন এদিকটা নিয়ে ? সামাজিক কার্যকারণ নিয়ে ভেবেছেন ?

    মলয়: তা কেন ? জামশেদপুরের কালিমাটি পত্রিকায় প্রায় প্রতি সংখ্যায় প্রবন্ধ থাকে । পোস্টমডার্ন গল্প, পোস্টমডার্ন কবিতা থাকে কোনো-কোনো সংখ্যায়। নাগপুরের খনন পত্রিকা আমার দীর্ঘ প্রবন্ধ পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন ছেপেছিল, যেটা ওখানকার বেঙ্গলি অ্যাসোশিয়েশান গ্রন্হাকারে বের করেছে। তবে সাধারণভাবে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা থাকে না। প্রধান কারণ হল পত্রিকাগুলোর স্বল্প পরিসর। কয়েকটা গল্প-কবিতার পর স্হান সংকুলান হয় না। সিরিয়াস প্রবন্ধ তাই থাকে না। যাঁরা সিরিয়াস প্রবন্ধ পড়তে চান , তাঁরা ইংরেজি বই যোগাড় করে পড়ে নেন । অবশ্য দিল্লি-মুম্বাই-চেন্নাই ইত্যাদি মেট্রপলিটান শহর ছাড়া ইংরেজি বইয়ের লাইব্রেরি নেই বললেই চলে। তার ওপর তুমি যে পত্রিকাগুলোর নাম বললে, তারা কেউ ফ্রি বিলি করে না। বিক্রি করে কেবল কলকাতায় আর ঢাকায় । বহির্বঙ্গে অনেকে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বা হিন্দিতে লেখা পছন্দ করেন । পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের সম্পর্কে তাঁদের রিজার্ভেশান আছে। বহির্বঙ্গের ছোটো-ছোটো জায়গায়, যেমন চক্রধরপুর, ছাপড়া, জামালপুর, হাফলং, ধর্মনগর ইত্যাদিতে ঠিক এই সময়ের ভাবনাচিন্তা পৌঁছোয় না। তাঁরা পুরোপুরি নির্ভর করেন কলকাতার কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনের ওপর , যেগুলো তাঁদের বিপথগামী করে তোলে। এই দূষণ থেকে বেরোবার জন্য দিল্লির অরুণ চক্রবর্তী একটা বহির্বঙ্গ মঞ্চ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন বটে, কিন্তু তিনিও কলকাতার এসট্যাবলিশমেন্টের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।

    গার্গী: বহির্বাংলায় কি পোস্টমডার্ন ফিকশান আর কবিতা লেখা হচ্ছে ? কার-কার রচনা পোস্টমডার্ন বলে মনে হয় আপনার ? কয়েকটি বই বা লেখার নামগুলো যদি বলেন তাহলে বাংলার বাইরে একটু আলোকপাত হয় । প্রভাত চৌধুরী ওনার পোস্টমডার্ন কবিতা সংকলন গ্রন্হে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের কোনো কবিকে কিন্তু অন্তর্ভুক্ত করেননি। জহর সেনমজুমদার এবং সুজিত সরকার পোস্টমডার্ন কবিতা নিয়ে যে প্রবন্ধগ্রন্হ লিখেছেন , তাতে বহির্বঙ্গের কবিরা আলোচিত হননি।

    মলয়: জহর আর সুজিতের বহির্বঙ্গ সম্পর্কে ধারণা ওই কুণ্ডু স্পেশাল ভ্রমণের। প্রভাত চৌধুরী তো পশ্চিমবঙ্গেরই সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি । বহির্বঙ্গের কারো উচিত একটা আলাদা পোস্টমডার্ন সংকলন বের করা। পোস্টমডার্ন কবিতার জন্য তুমি বারীন ঘোষাল, যে জামশেদপুরে থাকে, তার লু, মুখস্ত ডালিম বইগুলো পড়তে পারো। উপন্যাসের জন্য বারীনের উদোমডাঙা বইটা পড়ে দেখো। সুবিমল বসাক, যিনি আদপে পাটনার লোক, ওনার প্রত্নবীজ উপন্যাস অতি অবশ্য পড়বে। দিল্লির দীপঙ্কর দত্ত‘র কবিতা-পুস্তিকা আগ্নেয় বসন্তের জাগলার পড়ে দেখো। গল্পের জন্য সমীর রায়চৌধুরীর ছাতা হারানোর দুঃখু উল্লেখ্য। উনি বিহার সরকারের ডায়রেকটর অব ফিশারিজ ছিলেন। ধানবাদের অজিত রায়ের যোজন ভাইরাস, গুরগাঁওয়ের রবীন্দ্র গুহ‘র শিকঞ্জের পাখি খামোশ উপন্যাসগুলো পোস্টমডার্ন। এঁরা কেউই কমার্শিয়াল পত্রিকায় লেখেন না । এসব বই পড়তে হলে যোগাড় করতে হবে লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। আমাকে তুমি বহির্বঙ্গের সাহিত্যিক বলে মনে করো কিনা জানি না । সৃষ্টি প্রকাশন আমার পোস্টমডার্ন আহ্লাদের কবিতা বের করেছে , আর কবিতীর্থ প্রকাশনী বের করেছে আমার উপন্যাস এই অধম ওই অধম । দুটো বইই কলেজ স্ট্রিট এলাকায় পাওয়া যায়।

    গার্গী: কলকাতায় প্রতি বছর যে সমস্ত গল্পের সংকলন, কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়, বা বাণিজ্য পত্রিকার শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তাতে বহির্বঙ্গের কোনো লেখকের রচনা থাকে না। লক্ষ করেছেন ? আপনি কী ভাবে ব্যাখ্যা করছেন প্রক্রিয়াটাকে ?

    মলয়: আরে ওগুলো স্রেফ ধান্দাবাজি। ঢাকা আর কলকাতার একদল ধান্দাবাজ লেখক মিলে এই কাণ্ডটির মাধ্যমে দিব্বি বাণিজ্য করছেন। সম্পাদক হিসাবে যে লেখক বা কবির নাম থাকে তাঁরা তাঁদের নাম ব্যবহার করতে দিয়ে পাবলিশারের কাছ থেকে টাকা নেন । বাদবাকি কাজটা যারা করে তারা নিজেদের ধামাধরাদের ঢোকায় । বহির্বঙ্গের কবি-গল্পকারদের সম্পর্কে এরা আকাট মূর্খ। এই বইগুলোয়, জানি না লক্ষ করেছ কিনা, সংকলিত রচনা নিয়ে কোনো আলোচনা থাকে না, যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথ, আবু সয়ীদ আইয়ুব কিংবা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় , অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সংকলনে । তিন-চারটে সংকলনে আমার লেখাও আছে । তা উত্তম দাশ আর মৃত্যুঞ্জয় সেনের বন্ধকৃত্য। বহির্বঙ্গের যাঁরা অন্তর্ভুক্ত হতে চাইবেন, তাঁদের মান-সন্মান খুইয়ে কলকাতার ধান্দাবাজদের সঙ্গে ভিড়তে হবে। আমি সবাইকেই বলি এই দূষণ থেকে আত্মরক্ষা করতে ।

    গার্গী: একটি রচনা যে পোস্টমডার্ন তা কী করে বুঝব ? জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার বলেছিলেন, ‘পোস্টমডার্ন মিনস ইনক্রেডুলিটি টোয়ার্ডস মেটান্যারেটিভ’। আমাদের বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, সাঙ্খ্য, সংহিতা কোনো ন্যারেটিভই তো মেটান্যারেটিভ নয়। আমরা তাহলে কী-কী দেখে বুঝব যে একটা লেখা পোস্টমডার্ন ?

    মলয়: এই প্রশ্নটা এর আগেও আমায় কেউ কেউ করেছেন। আমি তাঁদের বলেছি জীবনানন্দের প্যারাডিম কবিতাটি খুঁটিয়ে পড়তে । আমি মনে করি যে বাংলা পোস্টমডার্ন কবিতার সূত্রপাত এই কবিতাটি দিয়ে হয়েছিল। কবিতাটি এক-শিলা নয়, একরৈখিক অভিজ্ঞতা-নির্ভর নয়, তা একক নয়। ছবি আছে একের পর এক, যেন টিভির চ্যানেল সার্ফিং করা হচ্ছে। কবিতাটিতে আছে মজা, থ্রিল, আহ্লাদ, মসকরা, খেলা, বহুদিশাময়তা । আছে যুক্তির ভাঙন । কবিতাটিতে বিষয় নামক সুনিশ্চিত কেন্দ্র নেই । কবিতাটির শিরোনাম তার ভাবের টাইটেল হোলডার নয় ; মর্মার্থের মালিক নয়। কবিতাটি যৌগ, রাইজোম্যাটিক ; তাই দেখা যাবে যে একটি পংক্তির সঙ্গে পরের পংক্তির সম্পর্ক ও সাযুজ্য নেই। অর্থাৎ লাইনগুলো ইনটারলকিং করা ; আধুনিক কবিতার মতো ইনটারলিঙ্কড নয়। রচয়িতার সাবজেকটিভিটি তাতে নেই। পোস্টমডার্ন রচনা তোমায় খুঁটিয়ে পড়তে হবে। এটা সন্দেশ-রসগোল্লা খাবার ব্যাপার নয় যে নিজের ভালো-লাগা খারাপ-লাগা দিয়ে বিচার করবে।

    গার্গী: এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি প্রায় পনেরো-কুড়িটি লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে শুনেছি । বাঁকুড়ার একটি নামি পত্রিকা আপনার বাসাতেই অনুষ্ঠান করে পুরস্কার দিতে চেয়েছিল। আপনি তাদেরও ফিরিয়ে দিয়েছেন । কলকাতায় তো লেখকরা নিজেদের টাকা খরচ করে নিজেদের পুরস্কৃত করছেন, নিজেদের সম্বর্ধনার ব্যবস্হা করছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি আপনার প্রাপ্য সন্মান ফিরিয়ে দিচ্ছেন কেন ?

    মলয়: আমার লেখালিখি থেকে উৎসারিত নৈতিকতা আমায় যে একক বৈধতা দিয়েছে তা আমার নিজস্ব অর্জন। আমি কাউকে আমার অর্জনের অংশ দিয়ে নিজেকে কলুষিত করতে চাই না। পুরস্কারগুলো ফালতু। দেখেছি যে যারা পুরস্কারের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল তাদে বিশেষ ধারণা নেই আমার ডিসকোর্স সম্পর্কে । ওসব পুরস্কার আমার লেখালিখিকে গৌরবান্বিত করার বদলে খেলো আর খাটো করে দেবে । আমার অর্জন সম্পূর্ণ ভিন্ন । আমি অন্যান্য কবি-লেখকদের সঙ্গে সিস্টেমের খাঁচার দর্শনীয় প্রাণী হতে রাজি নই। আর এই যে প্রতিদিন দু’চারজনের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান দেখছ, ওটার উৎস হল ভালগারিটি বা স্বাধীনতা-উত্তর ভালগাসের মূল্যবোধ, যে ভাবধারায় পশ্চিমবঙ্গের ভিখারির দশা হয়েছে । যারা আজকাল পুরস্কার পায় তাদের আগাপাশতলা পরখ করলেই টের পাবে।

    গার্গী: এখন কী লিখছেন ? একটা কাব্যনাট্য আর একটা পোস্টমডার্ন ডিডেকটিভ উপন্যাস লেখার কথা বলেছিলেন একবার । হাত দিয়েছেন ? ( ২০১২ সালে মলয়দার দুটি কাব্যনাট্য সাহিত্যকাফে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। উনি একটি ব্লগে ওনার ডিটেকটিভ উপন্যাস ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক রচনা করেছেন ; উপন্যাসটি একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিতব্য। )

    মলয়: নাহ । হাত এমন কাঁপে যে কিছুই হচ্ছে না । আপাতত মেজর জেনারাল জে এফ সি ফুলারের দি কনডাক্ট অব ওয়র বইটা পড়ছি।

    ( সুমন মিশ্র সম্পাদিত ও জব্বলপুর থেকে প্রকাশিত চরৈবেতিপত্রিকার ডিসেম্বর ২০০২ সংখ্যার জন্য

    মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টমডার্ন গল্পগ্রন্হ

    সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন গার্গী ঘোষদস্তিদার, যিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের সঙ্গে সেসময়ে যুক্ত ছিলেন )
    Posted in বহির্বঙ্গ| Tagged চরৈবেতি পত্রিকা| ১ টি মন্তব্য
    বাপী চক্রবর্তী নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on জুন 29, 2012by কিছু লেখাপত্র

    বাপী: আপনাকে হাংরি আন্দোলন বা ক্ষুধিত প্রজন্ম সাহিত্য আন্দোলনের কবি বলে চিহ্ণিত করা হয়ে থাকে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত ? কেননা হাংরি আন্দোলনের সময়ে আপনার কেবল দুটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত শয়তানের মুখ আর সুবিমল বসাক প্রকাশিত জখম । অথচ আপনার সাহিত্য খ্যাতি মূলত হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার কুড়ি বছর পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর এবং উপন্যাস ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস থেকে শুরু । বিদগ্ধ পাঠকসমাজ তো তা-ই বলেন । আপনি কি ব্যাপারটা নিয়ে আত্মসমীক্ষা করেছেন মলয়দা ?

    মলয়: ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ওভাবে চিহ্ণিত হতুম বটে । তার কারণ , আমিই হাংরি আন্দোলন শুরু করেছিলুম এখন, আরও বইপত্র প্রকাশিত হবার পর, বিসেষ আর কেউ অমন ব্রঅন্ডিং করেন করেন না মনে হয়। আমার গদ্য-পদ্য নিয়ে তপোধীর ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, বারীন গোষাল, অজিত রায়, জাহিরুল হাসান, সমীর সেনগুপ্ত প্রমুখ ২০০১ সালে যে-সমস্ত আলোচনা করেছেন, তাতে তো কই তোলাই হয়নি কথাটা। তুমি কলকাতা থেকে এত দূরে থাক বলে সম্ভবত অতীত গরিমায় আপ্লুত রয়েছ। আমি চাই আমার লেখার মূল্যায়ন হোক । আমার মূল্যায়ন তো চাই না।

    বাপী: আমার মনে হয় যে আপনার ভাবমূর্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে হাংরি ইমেজ , এবং সেই ইমেজের তলায় আবছা হয়ে গেছেন কবি ও গদ্যশিল্পী মলয় রায়চৌধুরী। অজিত রায় আপনার যে হাংরি সাক্ষাৎকারমালা সম্পাদনা করেছেন, তাতে পনেরোজনই হাংরি নিয়ে একঘেয়ে প্রশ্ন করেছেন । রতন বিশ্বাস আপনাকে নিয়ে আহবকাল পত্রিকার যে বিশেষ সংখ্যা ২০০২ সালে বইমেলায় প্রকাশ করেছেন, তাতেও আপনার হাংরি ইমেজকে গ্লোরিফাই করেছেন। এ-বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ?

    মলয়: আধুনিকতাবাদী আলোচকরা লেখাটিতে প্রবেশের সহজ দরোজা হিসাবে লেখকে আঁকড়ে ধরতেন । আর ইমেজ হাতে পেলে তো আরও সুবিধে। ব্যাপারটা ঔপনিবেশিক । ইউরোপের চাপানো । সনাতন ভারতীয় ভাষাসাহিত্যগুলোর রচনাকারকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি । কৃত্তিবাস ওঝা বা ভারতচন্দ্রের ইমেজের কথা ভাবা হয় না । ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এনেছিল কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তির ভাবকল্প । তারা বিদেয় হবার পর আমাদের উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে আধুনিকতাবাদের প্রকোপ শেষ হয়ে আসছে। যে সমস্ত আলোচক এখনও ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের অনুশাসনে মজে আছেন , তাঁরাই পাঠবস্তুকে গুরুত্ব দেবার বদলে লেখককে দ্যান। সাহিত্য আলোচনায় ভাবমূর্তির ক্যানন নিয়ে আদিখ্যেতা তুঙ্গে তুলেছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের অধিবিদ্যাগত মননবিশ্ব। তবে অনেকেই বলেন যে আমি আমার রচনাবলীকে অতিক্রম করে যাচ্ছি। এ-ব্যাপারে আমার করণীয় কিছু নেই।

    বাপী: জন্ম, কৈশোর, যৌবন, পড়াশোনা সবই পাটনায়। বাখরগঞ্জের ইমলিতলা বস্তিতে কেটেছে আপনার ছোটোবেলা । আপনার উৎসভূমির সঙ্গে মধ্যবিত্ত প্রবাসী লেখক বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু, বনফুল, সতীনাথ, সুবোধ ঘোষ প্রমুখের তুলনা অসম্ভব। ঐ পশ্চাৎপটে আপনি বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী লেখক হলেন কীভাবে ?

    মলয়: অন্যান্য লেখকরা অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি, সংবর্ধনা, পুরস্কার ইত্যাদির জন্য লেখেন । আমার সাহিত্যকর্ম হল পশ্চিমবাংলার আদি নিবাসী পরিবারের সদস্য হবার প্রেক্ষাপটে আউটসাইডার হিসাবে পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতিতে প্রবেশের প্রয়াস। আহবকাল পত্রিকা নবম শতাব্দী থেকে আমার বংশলতিকা ছেপেছে । আমার মনে হয় না আর কোনো বাঙালি লেখক নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে এভাবে যুক্ত থাকার চাপ বরদাস্ত করেছেন। তাছাড়া মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুলে পড়ার প্রেক্ষিতও ছিল সাহিত্যের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ।

    বাপী: সাহিত্য নিয়ে আন্দোলন কি একান্ত প্রয়োজনীয় ? কী উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করেছিলেন হাংরি আন্দোলন ?

    মলয়: বাংলা সাহিত্যে আন্দোলন ওই একবারই হয়েছে । সুতরাং তার নিশ্চয়ই সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ ছিল । সমাজতাত্ত্বিকরা ব্যাখ্যা দেবেন। উত্তরঔপনিবেশিক জমানায় আর কোনো আন্দোলন হওয়া সম্ভব নয়। তার কারণ ভোগবাদী সমাজের দ্রুতি। সুতরাং সাহিত্যে আন্দোলন প্রয়োজনীয় কিনা এ প্রশ্ন অবান্তর ।

    বাপী: বাংলা সাহিত্যে এমন একটা আন্দোলনের সূত্রপাত কলকাতা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও হল না না। হল বহির্বঙ্গে , মানে পাটনায় । এমনটা কেন ?

    মলয়: তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে প্রবেশের প্রয়াস ; মজে যাওয়া সাংস্কৃতিক নদীর পলি তুলে প্রবাহকে জীবন্ত করে তোলা। তখনকার ভালগার সাহিত্য-অভিভাবকদের লাথানো। যারা পশ্চিমবাংলায় থাকে তারা তখন নিজেদের নিষ্ক্রিয়তা, স্হবিরতা, স্হিতাবস্হা, রোগ সম্পর্কে স্বভাবতই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। পশ্চিমবাংলার বাইরে ছিলুম বলে অবস্হাটা সহজেই বুঝে ফেলেছিলুম ।

    বাপী: আপনি নিজেকে ‘কালচারাল বাস্টার্ড’ বলেছেন । এ-বিষয়ে একটু ব্যাখ্যা দিন।

    মলয়: অভিব্যক্তিটির দুটি মাত্রা নিয়ে বিশ্বজিৎ সেন আর অজিত রায় যে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন, ওগুলো পড়ে দেখো। যে বাঙালিরা পশ্চিমবাংলার বাইরে থাকেন, তাঁরা কালক্রমে সাংস্কৃতিক জারজে রূপান্তরিত হন । যা তোমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে । বিশ্বজিৎ আর অজিত এরই সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক মাত্রাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন । কিন্তু আমি বলেছি আরও ব্যাপক অর্থে । আমাদের পরিবারে মোগল ও পাঠান সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে আমার পূর্বজ পঞ্চাননের সময় থেকে, যিনি হুমায়ুন আর আকবরের পাঠান সৈন্যদের একাংশের অধিপতি ছিলেন। তাঁর নাতি জিআ, যিনি কামদেব ব্রহ্মচারী নামে খ্যাত হন, তিনি যুগপৎ শাক্ত আর বৈষ্ণব ধারার সহাবস্হানের প্রয়াস করেন, পারিবারিক স্তরে, কালী আর শ্যাম রায় পুজো করে। তাঁর ছেলে লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য থাকার সময়ে, পর্তুগিজ সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হন। আমি নিজে খ্রিস্টধর্মী আর ব্রাহ্ম স্কুলে পড়েছি। বাল্যের ইমলিতলা ছিল অন্ত্যজ বিহারিদের পাড়া। কৈশোরের দরিয়াপুর ছিল গোঁড়া মুসলমান পাড়া। আমার লেখালিখি বিনির্মাণ করার জন্য এতগুলো পরত যাচাই করতে হবে।

    বাপী: আজকের বাংলা সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আপনি কী ভাবেন ? সত্যিই কি আর কোনো সাহিত্য আন্দোলন সম্ভব নয় ?

    মলয়: নিজের লেখালিখি ছাড়া আমি আজকাল আর কিচ্ছু ভাবি না । সাহিত্য কেন, কোনো আন্দোলনই আর সম্ভব নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে তবু একটু চাপ সৃষ্টি করা যায়। যেমন ধরো নর্মদা বাঁচাও অন্দোলন। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে মিডিয়া আর বাজারের দাপট এমন সর্বগ্রাসী ভোগবাদে প্রসারিত যে, কোনোও আন্দোলনই জীবনের দ্রুতিতে রদবদল ঘটাতে পারবে না।

    বাপী: পোস্টমডার্ন সাহিত্য কি আন্দোলন নয় ? পোস্টমডার্ন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলুন ।

    মলয়: না, পোস্টমডার্ন ব্যাপারটা সাহিত্য আন্দোলন নয়। পোস্টমডার্ন সাহিত্য নিয়ে বলতে বসলে তোমার পত্রিকায় আঁটবে না। হাওয়া-৪৯ একটা সংকলন প্রকাশ করেছিল ১৯৯৭ বইমেলায় , তাতে আমার পোস্টমডার্ন মেড ইজি ধরণের একটা লেখা ছিল । মুর্শিদ তার পরিবর্ধিত সংস্করণ বের করছে আগামী বইমেলায়। যোগাড় করে পোড়ো। ইংরেজিতে Postmodern Bangla Poetry 2001 নামে যে সংকলনটা বেরিয়েছে তাতেও আমার একটা দীর্ঘ লেখা আছে ।

    বাপী: মডার্নিজম কি হাংরি আন্দোনের পরিপূরক হতে পারে ?

    মলয়: পরিপূরক মানে ? সাহিত্যের আন্দোলন মাত্রেই মডার্ন , কেননা সমাজকে প্রগতিমুখী রৈখিক ধরে নিয়েই তো আন্দোলনগুলো হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্যে। পোস্টমডার্ন ভাবনায় ওই রৈখিক প্রগতিকেই চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। সময়ের রৈখিক ধারণায় নির্ভর করে যাবতীয় আধুনিক উপন্যাস লেখা হয়েছে। তুমি আমার এই অধম ওই অধম কিংবা নখদন্ত উপন্যাস পড়লে বহুরৈখিকতা ব্যাপারটা আঁচ করতে পারবে।

    বাপী: বর্তমানে বহির্বঙ্গে বাংলা সাহিত্যের চর্চা ক্রমবৃদ্ধিমান। এক ঝাঁক কবি ও গদ্যকার উঠে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে কার-কার লেখা আপনাকে আকৃষ্ট করে ?

    মলয়: সবাই তো আমায় বইপত্র পাঠান না । যোগাড় করার কোনো উপায়ও দেখি না। বহির্বঙ্গের কোনো সর্বভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সন্মেলনে গিয়ে সুমন মিশ্র খোঁজখবর করে জানতে পারেন যে বহির্বঙ্গের অনেক লেখক আমার নাম শোনেননি। মধ্যপ্রদেশ বাংলা অ্যাকাডেমির পত্রিকায় ওনার প্রতিবেদন থেকে জানতে পারলুম। যাঁদের বইপত্র পাই, তাঁদের লেখালিখির আলোচনা করেছি সমীর বসু সম্পাদিত বাঙালির প্রবাস ( ১৯৯৯ ) গ্রন্হে প্রকাশিত আমার ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক প্রবন্ধে। পদক্ষেপ পত্রিকার স্টল থেকে কিনে নিও বইমেলায়। Postmodern Bangla Short Stories 2002 সংকলনে একটা দীর্ঘ আলোচনা লিখেছি বহির্বঙ্গের লেখকদের নিয়ে।

    বাপী: বহির্বঙ্গে বেশ কিছু ভালো বাংলা লিটল ম্যাগাজিন বেরোচ্ছে । সেসব কাগজগুলোকে আপনি কি চোখে দ্যাখেন ?

    মলয়: আন্দামানের অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস ওনার বাকপ্রতিমা-র কপি পাঠাননি তোমায় ? তাতে তো আমার সাক্ষাৎকারে এ-বিষয়ে বলেছি। অবশ্য যেকটা পত্রিকা পাই, তার ওপর নির্ভর করেই বলেছি। আমাকে পত্রিকা পাঠান কমল চক্রবর্তী, কাজল সেন, শ্যামল শীল, মন্দিরা পাল, সুকুমার চৌধুরী, অজিত রায়, শিবব্রত দেওয়ানজি, প্রাণজি বসাক, দীপঙ্কর দত্ত আর তুমি। আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, উত্তরপ্রদেশেও লিটল ম্যাগাজিন বেরোয় শুনেছি । সে সব তো কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন মেলাতেও দেখতে পাই না।

    বাপী: বহির্বঙ্গের বাংলা পত্রিকার লেখক আর সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হওয়া উচিত ? চাকুরিসূত্রে তো আপনি প্রায় পুরো ভারতবর্ষের সেই সব বাঙালির সংস্পর্শে এসেছেন যাঁরা আর কখনও পশ্চিমবঙ্গে ফিরবেন না ।

    মলয়: গত দু’তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে এক বিদঘুটে ভাষাজোচ্চুরি দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে কলকাতায় । পথে-পথে দেখবে অধিকাংশ লোক একরকম পেঁকো বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকলেই ভিন্ন বাংলা। পশ্চিমবঙ্গে লেখকরা বাড়ির ভাষাটা সাহিত্যে প্রয়োগ করেন । অর্থাৎ সবই হাফ-ল্যাংটো নৃতত্ত্ব । বহির্বঙ্গের বাঙালির ভাষার বারমহল-অন্দরমহল ভাগাভাগি নেই। কিন্তু এক রাজ্যের বাংলা ভাষাকাঠামোর সঙ্গে আরেক রাজ্যের বাংলা ভাষাকাঠামোয় , স্হানীয় প্রভাবে, পার্থক্য তৈরি হয়েছে। লখনউ আর মুম্বাই-এর স্হায়ি বাঙালিরা একইরকম বাংলা বলেন না। লেখকের উচিত হবে এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোকে সাহিত্যগ্রাহ্য করে তোলা। কলকাতার অধ্যাপকরা হয়ত ব্যকরণ মানা হচ্ছে না বলে চেঁচামেচি করবেন। কিন্তু তাঁদের পাত্তা দেবার দরকার নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়ার লেখকরা ইংল্যান্ডের অধ্যাপকদের পাত্তা দেননি। সম্পাদকদের কাজ হবে এই সমস্ত লেখককে প্রাধান্য দেওয়া, উৎসাহিত করা। তবে, ‘বহির্বঙ্গের বাঙালি’ শব্দটার বদলে একটা অন্য শব্দ কয়েক করা দরকার । কেননা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বর্তমান দূষণ থেকে বহির্বঙ্গের বাঙালিরা যে মুক্ত, তা স্পষ্ট হওয়া দরকার।

    ( বাপী চক্রবর্তী সম্পাদিত দূরের খেয়া [ কানপুর ] পত্রিকার অক্টোবর ২০০২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল )
    Posted in প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা, লিটল ম্যাগাজিন, হাংরি আন্দোলন| Tagged দূরের খেয়া| মন্তব্য দিন
    শ্যামল শীল নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on জুন 11, 2012by কিছু লেখাপত্র

    মলয় রায়চৌধুরী

    শ্যামল: পোস্টমডার্ন, যা আধুনিকোত্তর । একে সংজ্ঞার মাধ্যমে পরিস্ফুট ও কেলাসিত করে তোলা হচ্ছে। পোস্টমডার্ন কনসেপ্টকে কি আমরা সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করে তুলছি ?

    মলয়: ভালো, সুচিন্তিত প্রশ্ন করেছ । তোমার প্রশ্নের মধ্যেই তো উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে । তোমার ভাবনাটি আরও অনেককে চিন্তিত করেছে । তাঁরা তাই একে কনসেপ্ট বলছেন না । বলছেন রুবরিক। পোস্টমডার্ন কবিতা, গল্প, উপন্যাসের শিরোনামকে সেকারণে টাইটেল না বলে রুবরিক বলা হচ্ছে। রুবরিক-এর বাংলা প্রতিশব্দ দিব্যাংশু মিশ্র এখনও তৈরি করেননি । আমার মনে হয় যাঁরা পোস্টমডার্ন ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করছেন, তাঁরা লক্ষণগুলো চিহ্ণিত করতে চাইছেন । তার দরুন মনে হতে পারে তাঁরা বুঝি সংজ্ঞায়িত করতে চাইছেন। পোস্টমডার্ন ধারণাটা সর্বপ্রথম ১৯৩৪ সনে নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস সে-দেশের ডিসকোর্স ও ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসগুলোয় রেড ইন্ডিয়ান, মায়া, অ্যাজটেক, আফ্রিকান, স্পেনীয় ইত্যাদির সংকরায়নে যে-উত্তরঔপনিবেশিক Post West অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল , তা বুঝতে পেরে তৈরি করেছিলেন। লাতিন আমেরিকার কবিতা ব্যাখ্যা করতে অভিধাটা প্রয়োগ হয়েছে চারের দশকের শেষাশেষিও। লক্ষ করে দ্যাখো যে, স্হানিক লক্ষণ চিহ্ণিত করার উদ্দেশে ব্যবহৃত হয়েছিল শব্দটি। কিন্তু ইউরোপে জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার-এর রচনা দ্য পোস্টমডার্ন কান্ডিশান আলোচনা করতে গিয়ে অনেকে ধরণাটিকে কালিক করে ফেলেছেন। আসলে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয় বলেই ব্যাপারটাকে বলা হচ্ছে এক্সটার্নাল ইউনিফায়ার , যার ভেতর ইন্টারনাল বৈভিন্ন্য ও বহুত্বকে স্বীকার করে নিতে হবে।

    শ্যামল: প্লুরালিজম কনসেপ্ট আমাদের চিন্তাকে খন্ডিত বা বহুরৈখিক করে কি ? আমাদের একক ভাবনার বিষয় কি বিষয়ান্তরে চলে যায় ? সেক্ষেত্রে একটি বিষয়ের চিন্তার সামগ্রিক রূপ তৈরি তো ব্যাহত হয়।

    মলয়: তোমাদের বাড়িতে যদি পুজোর ঘর থাকে, তাহলে দেখবে সেখানে একাধিক দেবী-দেবতার সংকুলান রয়েছে। ওটা প্লুরালিজম । বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি সেখানে পূজার্চনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে টের পাবে যে , তাঁর মস্তিষ্কে বহুত্বটির স্বীকৃতি আছে। অথচ আনুগত্য তো খন্ডিত নয়। তুমি নিজে কি একক কোনো ব্যাপার চিন্তা করে দেখেছ ? চেষ্টা করে দ্যাখো। দেখবে আরো অজস্র ভাবনা মাথা গলাচ্ছে । ছবি আঁকায়-লেখায় এই জন্য রিয়্যালিজম পরিত্যক্ত হয়েছিল। একক করতে গেলে জোর করে করতে হবে। যা হিটলার আর স্তালিন করতে চেয়েছিলেন। গুজরাতে ফেব্রুয়ারি ২০০২-তে যে দাঙ্গা শুরু হল, তাও কিছু লোকের মগজে ভারতীয়তা নামর ব্যাপারটাকে সামগ্রিকতা দেবার ফল। একক বিষয়ে চিন্তা প্রক্রিয়াটা কৃত্রিম বলেই তো এখনকার ছবি-আঁকা বা গল্প-কবিতা-উপন্যাস বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যায়। অমন বৈশিষ্ট্য না থাকলে বুঝতে হবে বাণিজ্য করার চেষ্টা হচ্ছে ।

    শ্যামল: ‘টাইম’ পত্রিকায় একটি গ্রন্হ আলোচনার সময়ে সমালোচক লিখলেন বইটি পোস্ট-পোস্টমডার্ন। পোস্টমডার্ন পরবর্তী একটি ধারা ক্রমশ আসছে না বিদ্যমান ?

    মলয়: তুমি আবার ধারণাটাকে স্হানিকতা থেকে কালিকতার পরিসরে টেনে আনছ। সবকিছু কালিকতার ছকে ফেলে ভাববার দার্শনিক প্রণালীটা এদেশে এসেছিল ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের কাঁধে চেপে । আমেরিকার কাগজে মার্কিন আলোচক যা বলেছেন, তা বুঝতে হবে ওদের দেশের সাংস্কৃতিক লক্ষণ বিশ্লেষণ করে। ওখানে ইহাব হাসান, ড্যানিয়েল বেল প্রমুখ ভাবুক বিভিন্ন সময়ে মার্কিন সাহিত্যে যে পোস্টমডার্ন লক্ষণ চিহ্ণিত করেছিলেন, তা ধেকে ভিন্ন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে ওদের দেশের টেরারিস্ট আতঙ্কের কারণে । পশ্চিমবঙ্গের লক্ষণগুলো ভিন্ন। আবার প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাহিত্যে পোস্টমডার্ন বৈশিষ্টগুলো পশ্চিমবঙ্গের থেকে ভিন্ন। কিন্তু তুমি যদি বিশ্বকে এক্সটার্নাল ইউনিফায়ার হিসাবে নাও, তাহলে সমীর রায়চৌধুরী যাকে বলেছেন ‘অভেদের সন্ধান’ , সেই কমন স্ট্রিকটা লক্ষ করবে।

    শ্যামল: পোস্টমডার্ন চিন্তা-চেতনার সাথে সততা ও স্বচ্ছতা বা ট্রান্সপারেন্সির কী সম্পর্ক ? এর এফেক্ট কবিতায় আসে?

    মলয়: তুমি প্রশ্নটা এই প্রতর্কবিন্দু থেকে তুলছ যে, মানুষ হিসাবে একজন কবির প্রতিস্ব যেন সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়নযোগ্য। আর সেই সঙ্গে অনুমান করে নিচ্ছ যে , প্রতিস্বটি তার যাবতীয় সমস্যা সাবজেকটিভিটির স্তরে সমাধান করে ফেলেছে। অনেকে সততার কথাটা তোলেন এই জন্যে যে , আধুনিকতা সময়কে মনে করেছিল প্রগতির পথে যাত্রা, যার শেষে আছে নিখুঁত মানুষের ইউটোপিয়া । কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় ধাপ্পাবাজিটা ধরা পড়ে গেছে। স্হানিকতার বা কালিকতার, যে পৃষ্ঠপটেই নাও না কেন, মনে হবে উত্তরঔপনিবেশিক ভারতবাসী অধিকতর জোচ্চোর । জোচ্চুরিটা ট্র্যান্সপারেন্ট। ভিজিলেন্স কমিশনের ওয়েবসাইটে জোচ্চোর আই এ এসদের দীর্ঘ তালিকা আছে। তাতে কারোর কিছু এসে যায় না। সাবজেকটিভিটি আরও কমপ্লেক্স ও ব্যাখ্যার অনধীন হয়ে চলেছে । ফলত কবিতা প্রভাবিত হচ্ছে । জীবনানন্দের কবিতা এতকাল পর গ্রাহ্য হল মুলত পাঠকসমাজের সাবজেকটিভিটির কমপ্লেক্সিটির কারণে। আমি মনে করি যে, বাংলা কবিতার স্ট্রাকচারে পোস্টমডার্ন বৈশিষ্ট্যের সূত্রপাত হয়েছে জীবনানন্দ দাশ -এর প্যারাডিম কবিতায়।

    শ্যামল: আপনি বাংলায় নিজস্ব ভাষা তৈরি করে ফেলেছেন । নিবিষ্ট পাঠক সেই ভাষা ধরে ফেলবেন। আপনি কি এটা প্ল্যান করেই এগিয়েছেন ?

    মলয়: আমার প্রতিটি গ্রন্হের নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়। তাকে আমার নিজস্ব ভাষা বলা অনুচিত। গপ্পো ফাঁদা সাহিত্যিকের কাজ নয়। সে নিজের তহবিল সমৃদ্ধ করার ধান্দা করে না। তার দায় মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করা। রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী প্রমুখ সেই কাজই করেছেন। ইচ্ছে করলে তাঁরাও তো দুশো-চারশো উপন্যাস লিখতে পারতেন। বাংলা সাইত্যের ভাষা যে অঞ্চলে উদ্ভূত, আমার পূর্বপুরুষরা সেই অম্চলের মানুষ ছিলেন । বংশপরম্পরায় যা আমার রক্তে রয়েছে তার জন্য কি আর বিশেষ প্ল্যান করতে হয় ?

    শ্যামল: অতিনবীন পাঠক ও পাঠিকা যাঁরা চেঞ্জের মধ্যে দিয়েই বড় হচ্ছেন, চেঞ্জ দেখছেন সর্বত্র, পোস্টমডার্ন কনসেপ্ট গ্রহণ করতে তাঁদের দেরি হচ্ছে কেন ?

    মলয়: আমার তো তা মনে হয় না । যাঁরা অন্যের কবিতা নকল করছেন না, একেবারে নিজের ইচ্ছেমতন লিখছেন, তাঁদের পাঠবস্তু তো পোস্টমডার্ন স্হানিকতার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন । লিটল ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টালেই দেখতে পাই । তাঁরা নিজেরা পোস্টমডার্ন ধারণা সম্পর্কে অবগত কিনা তা অবান্তর। অনেকে কলকাতার সাংস্কৃতিক রাজনীতির কারণে, নিজেরা পোস্টমডার্ন কবিতা লিখলেও , ধারণাটি সম্পর্কে বিরূপ। অনেকে আবার পোস্টমডার্ন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হননি বলে বিরূপ। এ-সমস্ত ব্যাপার দেখে মনে করা উচিন নয় যে পোস্টমডার্ন সাহিত্যধারণা তাঁরা গ্রহণ করছেন না । সে তো কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা কবি দীপক মজুমদারের কবিতা তুমি প্রায় কোনো সংকলনেই পাবে না, অথচ বুদ্ধদেব বসুর কাউন্টার ডিসকোর্সের সূত্রপাত তো করেছিলেন দীপক।

    শ্যামল: এবার কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি । কারাগারে যাওয়া ব্যতিরেকে আপনার লেখালিখির জন্য কখনো হুমকি বা আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন ?

    মলয়: কারাগারে যাওয়ার গল্পটা কী করে ছড়িয়েছে জানি না। হাংরি আন্দোলন মামলায় আমি পাটনায় গ্রেপ্তার হয়ে ওভারনাইট হাজতে ছিলুম। পরের দিন জামিনে ছাড়া পাই । একইভাবে বর্ধমানে দেবী রায়, চাইবাসায় সমীর রায়চৌধুরী আর আগরতলায় প্রদীপ চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়ে ওভারনাইট হাজতে ছিলেন । তবে মামলাটা হয়েছিল কেবল আমার বিরুদ্ধে। তার কারণ সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গিয়েছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও আমার বিরুদ্ধে পুলিশের তরফের সাক্ষী কেন যে হয়েছিলেন জানি না, কেননা ওনাদের বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না । হ্যাঁ, ব্যাংকশাল কোর্টে আমার এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল বটে, কিন্তু সেসব আমাকে পোয়াতে হয়নি । কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাপিল করে আমি জিতে যাই। ১৯৬৪ সনে আমাকে আর সুবিমল বসাককে কফিআউসের সামনে পেটাবার জনভ গিরে ধরেছিলেন একদল অগ্রজ কবি-লেখক । তাঁরা আর তাঁদের চেলারা প্রেসে গিয়ে হুমকি দিতেন যাতে আমার বই-পত্রিকা রাখা না হয় । এসব এলিমেন্ট এখনও আমার বিরুদ্ধে সক্রিয় । তবে এখন আমার একটা নিজস্ব পাঠকবর্গ গড়ে উঠেছে । প্রায় প্রতিমাসেই কোনো-না-কোনো লিটল ম্যাগাজিন আমাকে পুরস্কার দেবার প্রস্তাব নিয়ে আসেন।

    শ্যামল: কিছু ধীজীবীকে উসকে দিলে অসাধারণ লেখা বেরিয়ে আসে । আপনার লেখায় ক্ষুরধার বিশ্লেষণ, অসাধারণ বিন্যাস, বিষয় ও উপমার ব্যবহার আমরা লক্ষ করি । আপনি রাগী ?

    মলয়: আমি তো চাকুরিজীবী ছিলুম। লেখা বেচার ব্যবসায়ে লিপ্ত নই। কাউকে উসকে দিলে ইন্সট্যান্ট রিঅ্যাকশান হয় । আমি ইন্সট্যান্ট লেখা লিখি না । কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, যে পাঠকরতিই হোক, আমি দিনের পর দিন তাতে লেগে থাকি, রদবদল করতে থাকি । অনেক ব্যাপারে আমি ইরিটেটেড হই বটে, তাকে ক্রোধ বলা চলে না । ক্রোধ থাকলে একযোগে ডেপুটি জেনেরাল ম্যানেজার আর অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট হতে পারতুম না ।

    শ্যামল: যে বইগুলি আপনাকে প্রভাবিত করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি….

    মলয়: অজস্র বই, অজস্র বই । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ পর্যন্ত কয়েক হাজার গ্রন্হ ।

    শ্যামল: আপনার পছন্দের ডিশ ?

    মলয়: চিংড়ি মাছের পুর দেয়া পটলের দোর্মা , ভাপা ইলিশ আর আমের আচারের তেলে সাঁতলানো চচ্চড়ি । ভুমেনদার ( কবি, ডাক্তার ও জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ ) আদেশে সবই প্রায় বারণ ।

    শ্যামল: আপনি আঁকেন ? কোন অঙ্কনশিল্পীর কাজ আপনার ভালো লাগে ?

    মলয়: না আঁকি না। আজকাল হাত কাঁপে বলে হিজিবিজি এঁকে কম্পনতত্ত্ব প্র্যাকটিস করি। পাঁজি পড়ো ? ওতে পাবে গায়ের কোন জায়গা কাঁপলে কী হয় । জাস্ট খেলি। বালভস্মৃতিতে ফিরে যাবার আহ্লাদ । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছবি-আঁকিয়ের কাজ দেখে মনে হয়েছে স্টানিং । মুম্বাইতে থাকতে অঞ্জলি এলা মেননএর পেইনটিং আর ইমতিয়াজ ধরকার-এর লাইন ড্রইং । কলকাতায় এসে পরিতোষ সেন আর বিকাশ ভট্টাচার্য। যোগেন চৌধুরী আমার ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কাব্যগ্রন্হের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন , আর থিম্যাটিক ড্রইং এঁকে দিয়েছিলেন প্রকাশ কর্মকার । কিন্তু ওনাদের এগজিবিশান আমার দেখা হয়ে ওঠেনি।

    শ্যামল: গান শোনেন কি ? শুনলে কী ধরণের ?

    মলয়: না, গান আমি দেখি, টি ভিতে । হুইটনি হুসটন আর স্পাইস গার্ল দেখতুম আগে । তারপর দেখতুম সিলিন ডিয়ন। আজকাল ইউকে-ইউ এস টপ টেন চার্ট অনুযায়ী গান খুঁজে এমটিভি দেখি। অ্যালিশিয়া নামে একটি নতুন গায়িকা এসেছে । আশা ভোঁসলের হিন্দি গান থাকলেই দেখি । বাংলায় শিলাজিৎ আর সেলেক্টেড সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । রবীন্দ্রসংগীত আর একেবারেই শুনি না , দেখি না ; ফিউনারাল সং মনে হয় । এম এ পড়ার সময়ে বিঠোফেন আর মোৎসার্টের যেসব রেকর্ড কিনেছিলুম, সেগুলো আমার ছেলে নিয়ে গিয়েছে । কনটেমপোরারি রেকর্ড আর ক্যাসেটগুলো মেয়ে নিয়ে গেছে । রেডিওগ্রাম আর মিউজিক সিস্টেম দুটো বছর আটেক যাবৎ পড়ে আছে জঞ্জাল হয়ে।

    ( শ্যামল শীল সম্পাদিত কবিস্বর পত্রিকার অক্টোবর ২০০২ সংখয়ায় সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল । )
    Posted in পোস্টমডার্ন| Tagged কবিস্বর, লিটল ম্যাগাজিন| 2 টি মন্তব্য
    অরুণেশ ঘোষ নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on ডিসেম্বর 7, 2011by কিছু লেখাপত্র

    কাঁধে চাদর অরুণেশ ঘোষ

    অরুণেশ ঘোষ পশ্চিমবাংলার সত্তর-আশির দশকের খ্যাতনামা কবি। তাঁর সঙ্গে কখনও মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি। হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার এক দশক পর তিনি নিজেকে একজন হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে সেই সময়ের সিপিএম দলের কয়েকজন কবি-লেখকের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে পুনরায় জীবনদানের প্রয়াস করেন। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি জানতেন না যে হাংরি আন্দোলন মামলায় মলয় রায়চৌধুরীরই কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালতে সে আদেশ নাকচ হয়ে যায়। তিনি সেই প্রথম জানতে পারেন যে তাঁরই দুই সঙ্গী শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ সেই মামলায় মলয়ের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন এবং মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন যে তাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্কে ছিন্ন করছেন এবং ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। মুচলেকা দেবার কারণে তাঁরা নিজেদের পত্রিকার নাম রেখেছিলেন ‘ক্ষুধার্ত’, এবং ‘হাংরি’ শব্দটি এড়িয়ে যেতেন। অরুণেশ ঘোষ এই সমস্ত তথ্যাদি পান শিবনারায়ণ রায় তাঁর ‘জিজ্ঞাসা‘ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বিষয়টি খোলশা করার পর। বিশদ তথ্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘জিরাফ পত্রিকার জন্য ১৯৮৫ সালে ডাকযোগে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত তিনি মলয় রায়চৌধুরীর কোনো রচনা এবং হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এই সাক্ষাৎকারটি নেবার পর তিনি আর কখনও মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি; মাথাভাঙা থেকে কলকাতায় এলেও মলয়ের সঙ্গে দেখা করেননি। ২০১১ সালে জলে ডুবে অপঘাতে মৃত্যুর কয়েকবছর পূর্বে তিনি তৃণমূল দলের প্রতি সহানিভূতিসম্পন্ন ও ঘোর সিপিএম বিরোধী হয়ে ওঠেন।

    অরুণেশ: “সঙ্গী-সাথীদের বিশ্বাসঘাতকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে লেখা ছেড়ে দেন”— আপনার সম্পর্কে এরকম একটি ধারণা বাজারে চালু রয়েছে, সেটা কি সত্য ? যদি সত্য হয়, তাহলে বিশ্বাসঘাতক কারা ? কীরকম সেই বিশ্বাসঘাতকতা ? বিস্তারিত বলুন।

    মলয়: তোমার মতন নাছোড় কিছু পাঠক আমার এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোটা পঞ্চাশেক হবে মনে হয়। বাজার পর্যন্ত খ্যাতি আমার নেই। ওটাকে একরকম প্রাতিস্বিক যুক্তি বলা যেতে পারে। কথাটা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকার দ্বাদশ সংকলনে। আর-কেউ বলেছেন কিনা নজরে পড়েনি। শরৎবাবু বলেছিলেন, ‘এরা বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, উচ্চাভিলাষী, আবেগপ্রবণ, অসহিষ্ণু, খ্যাতিলোভী এবং শতবিদ্রোহ সত্ত্বেও পুলিশের রক্তচক্ষু দর্শনে সন্ত্রস্ত। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে যখন ওদের মামলা প্রকাশিত হয়, তখন যুগপৎ বিশ্ববিখ্যাত হওয়া এবং পুলিশের কাছে মুচলেকা দেওয়ার উত্তেজনায় কাতর এদের কারো-কারো চেহারা দেখেছি।’ এই সব কথা বলে শরৎবাবু তারপর আমার লেখা ছেড়ে দেবার কথাটা টেনে এনেছেন। উনি বলতে চাইছেন, পুলিশের কাছে দেওয়া সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষ এর মুচলেকা এবং উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধয়া্য-এর দেওয়া জবানবন্দিগুলো হল বিশ্বাসঘাতকতা এবং ওই মুচলেকা ও জবানবন্দিগুলোর জন্যেই আমি লেখা ছেড়ে দিই। এটা ঠিক যে ওই মুচলেকা ও জবানবন্দিগুলি আর সেই সঙ্গে রাজসাক্ষী-সরকারি সাক্ষী হতে রাজি হওয়ার দরুণই পুলিশ আমার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মামলাটা দাঁড় করাতে পারে। এটাও ঠিক যে, আমাকে চার্জশীট দেবার দিন পর্যন্ত তাঁরা আমায় তাঁদের দিয়ে-ফেলা মুচলেকা-জবানবন্দি আর অ্যাপ্রুভার হবার কথাটা চেপে রেখেছিলেন, যার জন্য আমার উকিলরা উচিত ব্যবস্হা নিতে পারেননি। কিন্তু প্রথমত, একে বিশ্বাসঘাতকতা বলা যায় না কারণ আমি কোনো দিনই তাঁদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করিনি। অবাক লেগেছিল বটে। ছাড়া পাবার জন্যে তাঁদের কাছে অন্য উপায় ছিল না। শক্তি অবশ্য প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, তাঁর ব্যাপারটা ভয়ের নয়। তিনি আমার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ার প্রেমে পড়ে মেয়েটির বাবা-মা’র দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিলেন ( আমাকে ও দাদাকে তার জন্য দায়ি করেছিলেন)। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি— শক্তিবাবুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই ছিল না এফ আই আর-এ। প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি শোধটা তুললেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। সন্দীপন কেন সাক্ষ দিয়েছিলেন, কে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, আমি জানি না। তাঁর বিরুদ্ধে-ও এফ আই আর ছিল না। তিনি নিজেও আজ ওব্দি এ-ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অথচ পেঙ্গুইনের বইটায় নিজেকে হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলনের স্রষ্টা বলেছেন। উৎপলবাবুর নামও ছিল না এফ আই আর-এ। দ্বিতীয়ত, আমি লেখা ছেড়ে দিই–বা লেখা আমাকে ছেড়ে দেয়– সম্পূর্ণ অন্য কারণে। মামলার গণ্ডোগোলের মাঝে আমার জীবনে একের পর এক নানান ঘটনা ঘটতে থাকে । সে সব এত ব্যক্তিগত যে, তার গোপনতাই যেন সুস্হতা মনে হয়। সেগুলো গোপন রাখার মধ্যে একাকীত্বের ভাল লাগা আছে। একজন লেখকের লেখা বা না-লেখার সঙ্গে আমি মনে করি না সঙ্গী-সাথীদের কিছু করার থাকে, কেননা লেখাটাতো প্রাতিস্বিক ব্যাপার। আমি সৃজনশীল লেখার কথা বলছি। শরৎবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া তুমি দেবাশিষ প্রধান-এর ‘কবিতার কাগজ’ শারদ ১৩৯১ সংখ্যায় পাবে। তবে যতটুকু মনে করতে পারি, জুলাই ১৯৬৭-এ হাইকোর্টে মকদ্দমা জিতে যাবার পর আর কোনও লেখা লিখিনি। লেখার জন্য স্হির হয়ে বসার মানসিকতা ছিল না। অস্তিত্বের অদম্য অস্হিরতায় আমি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলুম। হয়তো এই কারণেই সুবো আচার্য দীক্ষা নিয়েছিলেন অনুকুল ঠাকুরের কাছে। হয়তো একই কারণে মার্কসবাদী দলে আশ্রয় নিয়েছেন বাসুদেব দাশগুপ্ত ও ত্রিদিব মিত্র; নকশাল হয়ে গিয়েছিলেন করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর দিকে এগিয়েছিলেন ফালগুনী রায়। সুতরাং তোমার ওই বাজারচালু অভিযোগ বা ধারণাটি অসত্য।

    অরুণেশ: হাংরি আন্দোলনের মূল স্রষ্টা কে ? আপনি না শক্তি চট্টোপাধ্যায় ? না কি কোনো ব্যক্তিকেই বলা যায় না মূল উদ্ভাবক। আপনার কি মনে হয় না স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিভিন্ন ঘটনা-পরম্পরার পরিণামে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ? তার মূল নেতা বলে কেউ নেই ?

    মলয়: তুমি হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবনা, আরম্ভ, গড়ে ওঠা, নেতৃত্ব সব একাকার করে ফেলছ। হাংরি শব্দটা আমি খুঁজে পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর In The Sowre Hungry Tyme বাক্যটি থেকে। কী রকম অপ্রতিরোধ্য শব্দবন্ধ্য দেখছ তো ? মনে হয় যেন আমাদের সময়ের জন্যি লেখা। এই হাংরি শব্দটা আমি প্রয়োগ করি ইতিহাসের দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের The Decline of the West গ্রন্হে তুলে ধরা অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে । প্রথম বুলেটিনটায়, যা আমি পাটনায় ১৯৬১ সালের নভেম্বরে চাপিয়েছিলুম, তুলে দিয়েছিলুম ওই কথাবার্তা। পাটনায় ছাপানো বুলেটিনগুলো সবই ইংরেজিতে কেননা বাংলা প্রেস প্রথম থেকেই ছাপতে অস্বীকার করে। অনেকে, না জেনেই, ভুরু কুঁচকে এর মধ্যে বিদেশি গন্ধ পেয়েছিল। ঠিকানা দেয়া থাকত দেবী রায়-এর হাওড়ার বাড়ির। আন্দোলন করার জন্যেই ভেবে-চিন্তে অনেককিছু করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই বলা হয়েছিল আন্দোলনরূপেই এর আবির্ভাব। আমি বুলেটিন, মুখোশ, পোস্টার, বিয়ের কার্ডে পদ্য, রেড-লাইটে কবিসন্মিলন, চৌরঙ্গীতে আদিবাসী রমণী, ইত্যাদির খরচ জুগিয়ে গেছি। ‘পোপের সমাধি‘ উৎপলকুমার বসু নিজেই প্রকাশ করেন। তখন রিজার্ভ ব্যাংকে একশো সত্তর টাকার কেরানিগিরি করতুম। এক পয়সাও বাড়িতে দিতে হত না। আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে এবং নতুনদের আকৃষ্ট করার জন্যে শক্তির সে সময়ের ইমেজকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ সেসময়ের কবিতার প্রেক্ষিতে ছিল অভাবনীয়। নেতা হিসেবে তাঁর নাম আমিই প্রয়োগ করি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘একা এবং কয়েকজন’ সে তুলনায় জোলো মনে হয়েছিল। শক্তির নামে নেতা যোগ করার জন্যে সুনীল দমদমে একদিন সকালে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি কি শক্তির থুতু চাটব?’ কলকাতার সাহিত্য-রাজনীতি পাটনায় বসে জানা ছিল না। এজন্যেই পরবর্তীকালে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন যে তাঁকে বাদ দেয়া ছিল উদ্দেশ্য। সুনীল যে ভুলটা করেছিলেন তা হল হাংরি ছিল আন্দোলন, আর ‘কৃত্তিবাস’ একটা পত্রিকা। শক্তির জায়গায় সুনীল থাকলে এই আন্দোলন কী চেহারা নিত বলা যায় না, কারণ একদল ভিন্ন চরিত্রের তরুণ আসতেন তাঁর পেছনে-পেছনে। তবে মোটামুটিভাবে আমিই পরিচালনা করেছিলুম। শক্তি ত্যাগ করেন ওই ব্যর্থ প্রণয় থেকে তাঁর কবিত্ব গীতিময় ও কূটবর্জিত হয়ে উঠছিল বলে। দেবী রায়কে আমি টাকা পাঠিয়ে দিতুম। লেখা যোগাড়, ছাপানো, পাঠানো এসব তিনি করতেন, তাই তাঁর অবদানও অস্বীকার করা যায় না। দেবীর কাজগুলো, পাটনায় বসে, যেখানের প্রেস হাংরি বুলেটিন ছাপতে চায়নি, আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তুমি যা বলছ, তাও ঠিক। স্বতঃস্ফূর্ততার ইনটার-অ্যাকশান একটা পর্যায়ে আন্দোলনকে জোরদার করে। তখন আর কেউ নেতা ছিল না। তাই শম্ভু রক্ষিত যখন হাংরি আন্দোলনের হয়ে ‘ব্লুজ’ ছাপান তখন চটে যান অনেকে। এখন তো কুচবিহার ছাড়াও আসানসোল ত্রিপুরা মেদিনীপুরেও হাংরি ছিটমহল গড়ে উঠেছে শুনি। আমি কাউকেই চিনি না।

    অরুণেশ: সারা দেশেই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের জোয়ার বইছে। ঠিক তখনই লেখা বন্ধ করে সরে গেলেন কেন ? ক্ষুধার্ত লেখালিখির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন ? আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ?

    মলয়: তুমি বোধহয় বলতে চাইছ হাংরি খ্যাতি ভাঙিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলুম না কেন , নাকি ? লেখা কেন ছেড়েদিয়েছিলুম তা তো তোমায় বললুম এক্ষুনি। খ্যাতির তালে, গুছিয়ে নেয়া যেতে পারত অবশ্য। কিন্তু তখন আমার মনমেজাজ এমন যে, বেঁচে থাকাটাই মূল জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখালিখি কিংবা ভবিষ্যত ভাবার ফুরসত ছিল না।আর ক্ষুধার্ত লেখালিখির প্রতি বিশ্বাস বলতে কী বোঝাতে চাও? লেখক তো নিজের লেখা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করবে। ওটা তো সবে মিলি করি কাজ গোছের ব্যাপার নয়। যেমন তোমার লেখার সম্পর্কে জীবতোষ দাসের যে মতামতই থাকুক না কেন, তা তো ওর লেখালিখির নিদান নয়। আন্দোলনের ভবিষ্যত সম্পর্কে যে-ধারনাই থাকুক না কেন আন্দোলনকারীর, তার জন্যে তিনি লেখা বন্ধ করে দেবেন কেন ? তুমি বোধহয় নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে পারছ না কেমন করে অত খ্যাতির মাঝখানে লেখা বন্ধ করে দিলুম দুম করে। আমিও মনীষ ঘটককে জিগ্যেস করেছিলুম, কেন উনি লেখা ছেড়ে দিলেন ? উনি বলেছিলেন, ‘মাথায় আসে না, মাথায় আসলেও হাত ওব্দি আসে না।’ তোমার কথাবার্তা থেকে তোমার ওই ঘুঘুমারি গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তখনকার আমার জীবনের একটা ঘটনা তোমায় বলি। বাড়িতে আমার মেজজ্যাঠামশায়ের লাশ পড়ে। মুখাগ্নি করার কথা আমার, আমি সেদিন বিয়ে করছি। শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে এসে অনেকেই তো দক্ষিণার টাকাটা আমার স্ত্রীর হাতে ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস’ বলে দিয়ে গেলেন।

    অরুণেশ: পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতি যদি সত্য হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে যারা হাংরি আদর্শের বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই পরবর্তীকালে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা ও লিফলেট বের করেছেন। তাদের এই সক্রিয়তা দিয়েই কি পুলিশের কাছে দেওয়া সাক্ষ্য, ধরেই নিচ্ছি তা সত্য, মিথ্যা প্রমাণিত হয় না ?

    মলয়: আমি দেখছি জবানবন্দি-মুচলেকাগুলো তোমাকেই দোটানায় ফেলেছে। সবচেয়ে আগে তুমি ব্যাংকশাল কোর্ট থেকে নথিপত্রগুলোর একটা করে সার্টিফায়েড কপি জোগাড় করো। ৯ নম্বর প্রেসিডেন্সি ম্যাজিসট্রেটের এজলাসের ১৯৬৫ সালে মকদ্দমা নং জি আর ৫৭৯। তার পর মুখচোখ ধুয়ে মাথা ঠান্ডা করো। তুমি কখনও পুলিশের খপ্পরে পড়নি মনে হচ্ছে। তুমি তো এখন হাংরি আন্দোলন করছ। ধরো তখন তুমিও একজন আন্দোলনের শরিক। তুমি কী করতে ? মুচলেকা-জবানবন্দি দিয়ে আবার ‘ক্ষুধার্ত‘ বের করতে ? আমার মনে হয় ডক্টর উত্তম দাশ তাঁর আলোচনায় যা বলেছেন সেটাই সঠিক। ‘মহাদিগন্তে’ ওঁর লেখাটা পড়েছ তো জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ সংখ্যায় ? ওঁর বক্তব্য হল, “এই লেখকদের মধ্যে মূল আদর্শের প্রতি আনুগত্য ছিল. ফেঁসে যাওয়া মামলায় মলবকে ডুবিয়ে দিয়ে সরে পড়বার তুমুল ইচ্ছা ছিল না, তবে সাধ্য ও সাহস ছিল না সাহায্যে আসার। কিন্তু কোর্টে মামলা চলাকালীন নিজেদের বিবেক শুদ্ধ রেখেছিলেন শৈলেশ্বর ও সুভাষ। পুলিশের কাছে জবানবন্দির ভয় ও বিহ্লতা নিজেদের মুক্ত করেছেন।” ওঁদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব থাকায় কিংবা বহু খবর তোমার গ্রামে বসে না পাবার দরুণ, তোমার এরকম গ্লানিবোধ হচ্ছে কেন ? আন্দোলনের কুড়ি বছর পর তুমি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে কর বা না-ই কর, তাতে তোমার নিজের লেখার হেরফের হবার তো কথা নয়। কিউবিস্ট আন্দোলনের এত পরেও ওই ফর্মে উৎকৃষ্ট ছবি আঁকা হচ্ছে। তবে ? ওভাবে পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতির সত্য-মিথ্যা যাচাই হয় না। বিবৃতি দিয়েও তাঁরা কোর্টে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেন। সেটাই তো যথেষ্ট। আর নিজেকে হাংরি না বললেও, সুভাষ কিংবা শেলেশ্বরের লেখায় কোনও উৎকর্ষগত পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠে না।

    অরুণেশ: শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে দেবী রায়ের কাছে যে অভিযোগগুলি করেছিলেন, কি করে তার সত্যতা প্রমাণ করবেন? ওই অভিযোগগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ও খোলাখুলি বলুন।

    মলয়: তুমি বোধহয় ‘পথের পাঁচালী’ কিংবা ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকা পড়ে ওই চিঠিটার কথা জেনেছ। চিঠিটা খুব-সম্ভব ১৯৬৭ সালে বা তার আগে লেখা যখন বেশ উত্তেজিত অবস্হায় ছিলুম। দেবীবাবু ওটা যত্ন করে রেখেছেন মনে হয় আর গবেষণা করার জন্য বা কেউ তথ্য চাইলে ওটা মেলে ধরেন। চিঠিটায় কী আছে, এতদিন পর আর খেয়াল নেই, সেসময়ের খেয়োখেয়ি আছে হয়তো। আমার এখনকার মানসিকতায়, আমি ওই চিঠির বক্তব্য থেকে অনেক দূরে। এখন কাউকে সামগ্রিক তাচ্ছিল্য পছন্দ করি না। চিঠিটা গর্হিত।

    অরুণেশ:শৈলেশ্বরের পালটা অভিযোগ, বিদেশের একটি পত্রিকায় The Greatest Poet of Bengal নিজের সম্পর্কে এই প্রবন্ধটি নিজেই লিখে ‘চুরি করে’ শৈলেশ্বর, প্রদীপ, সুভাষ এদের নাম বসিয়ে দিয়েছিলেন। এই অভিযোগ সম্পর্কে খোলাখুলি বলুন।

    মলয়: আমি যতদূর মনে করতে পারছি ও-ধরণের কোনও রচনা কোনও কাগজে আমার নজরে পড়েনি। তুমি তো সেই ১৯৭৫ থেকে শৈলেশ্বরবাবুর বাসায় যাতায়াত করছ এবং যথেষ্ট নুন খেয়েছ। পত্রিকাটা ওঁর কাছে চাইলে না কেন? সত্য-মিথ্যা নিজেই যাচাই করে নিতে পারতে। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে যেখানে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও ওকতাভিও পাজ আসছেন, সেখানে বিদেশের কোনো কাগজে সম্পূর্ণ নাম-না-জানা শৈলেশ্বর, প্রদীপ, সুভাষের সার্টিফিকেটের দরকার হয় কী ? নিজেই ভেবে দ্যাখো। তিনজনের লেখা ওই প্রবন্ধটা জোগাড় করতে পারলে পাঠিও। আর, চুরি করার অভিযোগ থাকলে কেউ লেখা থেকে সরে পড়ে নাকি ? তাহলে তো ‘প্যাপিলন‘ বা ‘আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’ লেখাই হত না। তুমি যখন বলছ, তখন শৈলেশ্বরবাবু কোথাও-না-কোথাও অভিযোগটা লিপিবদ্ধ করেছেন। পাও যদি তো এক কপি সংগ্রহ করে দিও। কিন্তু এই বয়সে শৈলেশ্বরবাবু অমনধারা কথাবার্তা বলেন বলে মনে হয় না। অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমার বহুকাল দেখানেই। তিনি মাঝে একদিন রাত্তিরে একজনের মাধ্যমে আমায় খবর পাঠিয়েছিলেন যে বিবৃতিগুলো এখন জনগোচরে না আনাই ভালো—কিন্তু তখন আমি ওগুলো ডক্টর উত্তম দাশকে দিয়ে দিয়েছি অলরেডি। শুনেছি পুলিশ কমিশনার প্রণব সেন ফাইলটা ক্লোজ করার সময়ে যত্নে রাখার নোটিং দিয়ে যান। ফলে কেউ না কেউ খুঁজে বের করতই।

    অরুণেশ: যে জ্যোতির্ময় দত্ত কুৎসিতভাবে ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে আক্রমণ করেন, সেই জ্যোতির্ময় দত্তের কাগজে হঠাৎ করে লিখতে গেলেন কেন ?

    মলয়: তুমি সপ্তম সংকলন ক্ষুধার্ত পড়েছ তো ? ওতে শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে আমার একটা নিবন্ধ আছে। শৈলেশ্বরবাবুর লেখা নিয়ে বোধ হয় ওটাই আপাতত একমাত্র প্রামাণ্য রচনা। তোমার, জীবতোষ দাস, অশ্রুকুমার শিকদারের ধানাই-পানায়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পার। আমার মকদ্দমায় ওনার আচমকা রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে গিয়ে ৩৫ মাস ব্যাপী আসামি হা…জি…র চিৎকারের নিস্তরঙ্গ অন্ধকারের ধ্বনিপিঞ্জর সত্ত্বেও ওটা লিখেছি। জবানবন্দি-মুচলেকার পরেও লিখেছি। তাঁরই কাগজ । তাঁরই সম্পর্কে। তবু লিখেছি। এতে নৈতিকতার গণ্ডোগোল নেই। তাছাড়া বহু তথ্য তুমি যেমন জান না, সেরকম এটাও জান না বোধ হয় যে ‘সল্টেড ফেদার্স’ পত্রিকায় শৈলেশ্বর, সুবো, প্রদীপ, সুভাষের লেখা উনিই অনুবাদ করেন। যে সময়ে সুবিমল বসাক ছাড়া কোনও ক্ষুধার্ত কোর্টে আসতেন না, জ্যোতির্ময় দত্ত খোঁজ-খবর করেছেন, মকদ্দমা লড়ার পয়সা জোগাড় করে দিয়েছেন, হাইকোর্টের জন্যে করুণাশঙ্কর রায়কে উনিই খুঁজে দিয়েছিলেন। এমনকি, আমার তরফের সাক্ষী হবার জন্যে জ্যোতির্ময় প্রথমে এগিয়ে আসেন। তরুণ সান্যাল-ও,বামপন্হী দলের সঙ্গে তর্ক করে নিজে সাক্ষী দিতে রাজী হন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদিও বলে থাকেন যে , তিনিই সবচেয়ে প্রধম আমার সাক্ষী হতে রাজি হন, ওটা ভুল। জ্যোতির্ময় দত্ত আর তরুণ সান্যাল লেখকের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসেন। সুনীলবাবু প্রথমে রাজি হননি। আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বাল্যবন্ধু। দাদার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য দেন। তবে তাঁর সাক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট ওরকম স্মার্ট কথাবার্তায় বিপন্ন বোধ করেছিলেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে হেয় করার জন্য জ্যোতির্ময় দত্ত ‘দেশ‘ পত্রিকায় কোনও বিশেষ সংখ্যায় নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন আমিও রেগে গিয়েছিলুম। কিন্তু জ্যোতি ক্ষুধিত প্রজন্মের প্রতি অপছন্দ জাহির করেও যত সাহায্য একই সময়ে করেছিলেন, হাপিস হয়ে-যাওয়া ক্ষুধার্তরা সে-সময়ে তা করেনি। আরেকটা জিনিস তুমিও লক্ষ করবে। আমার লেখা থাকলে পত্রিকার চরিত্র পালটায়। জ্যোতির্ময় দত্ত আমার একটা উপন্যাস প্রকাশ করবেন। সম্পাদকের যথেষ্ট সাহস দরকার হয় আমার ক্রিয়েটিভ লেখা ছাপতে। আর উনি তো ‘এমারজেন্সির’ সময়ে ছাদ থেকে লাফ মেরে পা ভেঙেছিলেন। আমরা সবাই তখন কি-ই বা করেছি। সাশ্রুনয়নে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে জন্মান্ধ যে সৌন্দর্যকে বিমূর্ত মনে করে, সেই বনপ্রান্তর, গাঁওবাসা, মেঘসূর্য দেখেই আমাদের জীবন মূর্ত। কেউ আক্রমণ করলে তা সহ্য করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখি। আমি আমার সততা বজায় রাখব এবং জ্যোতির্ময় তাঁর নিজের। আমরা কেন পরস্পরের সঙ্গে ঢলানি করব?

    অরুণেশ: যাঁরা এখন ক্ষুধার্তবিরোধী, যাঁরা ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে মনে করেন ‘মিউজিয়ামের বিষয়বস্তু’, তাঁদের সঙ্গেই আপনার ঘনিষ্ঠতা। আপনিও কি তাই মনে করেন ?

    মলয়: ব্রিটিশ মিউজিয়ামের এনট্রি খাতায় ১৮৭৩ সালের র‌্যাঁবো-র সই দেখার জন্যে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ লোকের ভিড় হয় বলে শুনেছি। আমিও আমার মতনই লিখে আমার মতনই ওরকম অবাক পাঠকের শ্রদ্ধা চাই। তোমার ভাসাভাসা কথায় বুঝতে পারছি না ঠিক কার কথা তুমি বলতে চাইছ ? তুমি, আমার মনে হয়, দীপঙ্কর রায়-এর লেখাটার কথা টেনে এনেছ। তিনি গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে তাঁর পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের মতামত ছেপেছিলেন, আমার এক সাক্ষাৎকারের সঙ্গে। অতয়েব তাঁর সঙ্গে আমার ততটাই ঘনিষ্ঠতা, যতটা তোমার সঙ্গে। আর কার কথা বলছ ? পবিত্র মুখোপাধ্যায়, ধুর্জটি চন্দ, বাসুদেব দেব ? না, তাঁদের সঙ্গেও নেই। তবে যে-কারণে তোমার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে অনিচ্ছা বা লজ্জাবোধ বা গ্লানিবোধ নেই, সেরকম তাঁদের পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে আপত্তি নেই। আমি টোটালিটেরিয়ান নই। আমার চরিত্র এমন, যে কারোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতয় অসুবিধা হয়, যদিও আমি ঘনিষ্ঠতা চাই। আমি কোথাও আড্ডা মারতে যাই না, সন্ধ্যার পর থেকে একলা থাকি, খুব কম কথা বলি, কোনও বন্ধুবান্ধব নেই। পাঠকের ব্যাপারে একটা খবর দিই তোমায়। তোমার বইটা প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত রিভিউ করার পর তোমার বন্ধু ক্ষুধার্তরা সবাই তাঁকে রেগুলার বই-পত্রিকা পাঠিয়েছেন। এতেও নষ্টামির কিছু নেই। এখন প্রণবিন্দু তো সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার মানুষ, অথচ তোমার লেখার প্রশংসা করেছেন। তিনি ক্ষুধার্ত নন বলে তাঁর মধ্যেকার পাঠককে কি তুমি অনাদর করবে ? বহুকাল পরে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র সঙ্গে দেখা হতে, তিনি বলে উঠলেন, ‘বাব-বা কী শান্ত-শিষ্টটাই হয়ে গেছেন, চেনাই যায় না’। শুনে আমার ভালই লেগেছে।

    অরুণেশ: ১৫/১৬ বছর পর আবার লেখালিখিতে ফিরে এসে, এখন নিজেকে আর ক্ষুধার্ত লেখক মনে করেন না। নিজেকে মনে করেন ৮০-র দশকের লেখক। আমরা জানি দশকওয়ারি কবি বা লেখকরা ছোটকাগজগুলোতে হাত মকসো করে চলে যান বড় কাগজে, প্রতিষ্ঠানে। আপনার লক্ষও কি তাই ?

    মলয়: তোমার কি মনে হয় আমার নামের জন্যে প্রতিষ্ঠানের দরকার ? প্রতিষ্ঠান মানে তো তুমি বলতে চাইছ আনন্দবাজার যুগান্তর বসুমতী সত্যযুগ কালান্তর গণশক্তি প্রতিক্ষণ রেডিও টিভি। আমার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই তাহলে। হাংরি আন্দোলনকে এককালে যাঁরা সারা ভারতে প্রচার করেছিলেন সেই কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস এখন ভারত-প্রতিষঠানের কর্ণধার। সেই পুপুল জয়াকর, যিনি আমার মকদ্দমার কথা ইন্দিরা গান্ধীর নজরে এনেছিলেন, তিনি এখন ভারতবর্ষের সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক। গ্যাঁট হয়ে বসতে চাইলে, কলকাতায় আমাকে চেয়ার খুঁজে বেড়াতে হবে না। হাত মকসো করার সময় আমার নেই বলেই মনে করি। আমার লেখা ছাপলে একটা ছোটকাগজ কোন স্তরে পৌঁছোয়, সে অভিজ্ঞতা আমার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর টের পাবে। এতকাল ধরে তো বেশ কিছু সংখ্যা তো বের করেছ ? নিজেকে ক্ষুধার্ত লেখক মনে করি না , কারণ এখন আমার জীবনযাপন, আর্থিক অবস্হা, ভাবনাচিন্তা লেখালিখি সবই অন্যরকম। আমি মনে করি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান—সেখানে সর্বহারা আর বুর্জোয়ার প্রভেদ নেই, যেটা মরিচঝাঁপি থেকেই বেশ পরিষ্কার। আমি একজন সাংস্কৃতিক জারজ যে ওই বাঙালি এসট্যাবলিশমেন্টে সম্পূর্ণ বহিরাগত– দি আউটসাইডার। অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুব সাহেবের চিঠিটা পড়েছ তো ? উনিও সেখানে নিজেকে বঙ্গভাষী ঘোষণা করেছেন। মানে, ভাষাটা তাঁর, আমার নয়। আমার কাছে ‘আনন্দবাজার‘ ও ‘জিরাফ‘ দুটোই ওই পক্ষের জিনিস। আমি যে দেশকে লিখব আমার লেখাটা সেই দশকের। সে-ব্যাপারটা যে তুমি ধরতে পারনি তা তো বুঝতেই পারছি।’ক্ষুধিত প্রজন্ম ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকেই ওই প্রতিষ্ঠান আর দশক ব্যাপারগুলো আমার কাছে ঝরঝরে। কলকাতার বৃষ্টিতে বিহারি মুটের মাথার চুবড়িতে বসে সর্বহারার নেতাকে রাস্তা পার হতে দেখেছি। নিজেকে ‘ক্ষুধার্ত’ বলে মনে করি না মানে এ নয় যে, তোমার কবিতা বা সুভাষ ঘোষের গদ্য-র সৃজনশীলতাকে হালকা হাসি বা জটিল বাক্যাংশ দিয়ে উড়িয়ে দেব। প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে চাইলেই ঢোকা যায় কে বললে তোমায় ? লাল হলুদ নীল যে প্রতিষ্ঠানর যেতে চাইবে তার রং ধরতে হবে তোমায়, কিংবা পালটে-পালটে এ-রং সে-রং করতে হবে, তোমার নিজের রং বজায় রাখা চলবে না। সেখানে আমার রং তো কয়লার, আগুন লাগালেই শুধু বদলায়। রইল বড়-কাগজের প্রশ্ন। তাদের কাজ স্হিতাবস্হা বজায় রাখা। শারদ ১৩৯১ ‘কৌরব‘-এ প্রকাশিত আমার গল্পটা তুমি তো পড়েছ । পড়ে ধারণা হয়েছে কি যে, আনন্দবাজার যুগান্তর গণশক্তি ওটা ছাপত ? আমি তোমায় গল্পটার স্বত্ত্ব দিয়ে দিচ্ছি। তুমি ঘুরে-ঘুরে ফিরি করে এসে জানিও তোমার অভিজ্ঞতা। আমার চেয়ে অক্ষম অথর্ব সহসম্পাদকরা ওখানে লেখা বাছাই করে। আমার লেখা হাতে নিলে তাদের হাতে আঙুলহাড়া হয়ে যাবে, মালিক তাদের চাকরি কেড়ে নেবে। আমার লেখা মলয় রায়চৌধুরীর লেখা হবে, তা যদি তাঁরা ছাপেন তো আপত্তি কিসের ? আমি পাঠকের শ্রদ্ধায় বঙ্কিম মাইকেল মানিক সতীনাথ লোরকা নেরুদা ব্রেখত মায়াকভস্কি জোশ মলিহাবাদীর মতন স্হান চাই। আমি কাগজ চাই না । আমি প্রকাশক চাই—এমন কি শংকর বা বিমল মিত্রের বইয়ের প্রকাশকও যদি আমার বই ছাপতে চান তো আমি ছাপতে দেবো। আমি তোমার মতন পাঠক চাই যাঁরা ওই গণ্ডগ্রামে বসেও আমার লেখাকে প্রশ্রয় দেবেন। তোমার কথার মোটিভ, আমি এর আগে সূত্রপাত, দ্বন্দ্বশূক, আন্তর্জাতিক ছোটোগল্প, এখন এইরকম, বিজ্ঞাপন পর্ব, প্রথমত ইত্যাদি পত্রিকায় দেখেছি। এও দেখেছি যে ওই কাগজগুলোর গায়ে খাঁটি পেডিগ্রিপ্রাপ্ত কলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি এসট্যাবলিশমেন্টের আঁশটে গন্ধ আগাপাশতলা ভরা আছে। তারাও মনে করে পশ্চিমবাংলাই বুঝি বাঙালির একমাত্র পার্থিব-মানস। বস্তুত ওই বহিরাগতের বোধই আমায় হাংরি আন্দোলনে প্ররোচিত করেছিল। ওইসব কাগজে যখন লেখা হয়েছিল হাংরি আন্দোলনের সাথে সামাজিক মূল্যবোধের কোনও যোগ নেই, তখন তোমার উচিত ছিল তাদের বলা যে অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর সভ্যতার অবক্ষয় সম্পর্কিত ইতিহাসের দর্শন মুখস্হ করে আসতে, কেননা সামাজিক অবক্ষয়ের এমন তথ্যনির্দেশ মার্কস-এও নেই । আমার প্রথম বইটাই ছিল ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’।

    অরুণেশ: আপনার ক্ষুধার্ত পর্যায়ের মৌলিক লেখার সঙ্গে পাঠক একেবারেই অপরিচিত। সেগুলি কি বই এর আকারে বের করা যায় না ? পাঠক দেখতে চায় আপনার মৌলিক কাজ। ভাবছেন কিছু ?

    মলয়: হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা আমার কবিতার বই, নাটক, ইশতাহারগুলো অনেকে রেখেছেন নিজেদের কাছে, কিন্তু হাতছাড়া করতে চান না। তুমি এক্ষুনি বলেছিলে মিউজিয়ামের বিঢ়য়বস্তু। ইশতাহারগুলোর কিছু জেরক্স জোগাড় করেছি। ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে কবিতা আর নাটকের কপি করাবার চেষ্টা করছি। তিনটে বই বের করার ইচ্ছে আছে হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত লেখা নিয়ে : ইশতাহার সংকলন, নাটক সংকলন এবং কবিতা সংকলন। সহৃদয় প্রকাশকের খোঁজে। বইগুলোর প্রকাশনা সম্পর্কিত তধ্যও আমি দিতে চাই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার‘, একটা কপি রেখে বাকিগুলো পেট্রল ধরিয়ে আগুন লাগানো হয়েছিল। ‘শয়তানের মুখ‘ বেরোয় কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে, তার বহু কবিতায় ‘ক্যানসেল্ড’ স্ট্যাম্প মারা হয়েছিল। সেরকম একটা কপি সংগ্রহ করতে হবে। ‘ইল্লত’ নাটক প্রত্যাখ্যান নিয়ে ‘বহুরূপী’ ও ‘গন্ধর্ব‘ আপিসে কর্তারা কেলোর কিত্তি করেছিলেন। ইশতাহার বিতরণ করার দরুণ সুবিমল বসাককে কলেজস্ট্রিট কফিহাউসের বাইরে ঘিরে ফেলে প্রহার করা হয়েছিল। সেই ইশতাহারটা সংগ্রহ করতে হবে। আমি নিজের কোনো লেখাই সংগ্রহে রাখিনি। কিন্তু তুমি ক্ষুধার্ত ঘোষণা করলে নিজেকে অথচ তোমার কাছে কেন আমার লেখাগুলো সাপ্রেস করা হল, তা জানবার চেষ্টা করোনি দেখছি। নাকি, কলকাতা থেকে বহুদূরে আছ বলে প্রাথমিক তথ্যে অহরহ বঞ্চিত হও। নাছোড়বান্দা পাঠক কিন্তু খুঁজে বের করে। লেখা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও এই দেড় দশক ধরে অচেনা পাঠক আমার পেছু ছাড়েননি। তাঁরা আমার কৃতজ্ঞতাভাজন। আমিই এতদিন তাঁদের কাছে বোবা হয়ে থেকেছি। ইশতাহারগুলো বিনে পয়সায় বিলি করা হত বলে অনেকে এককালে টিটকিরি মেরেছেন। আমার বই বের হলে, তোমায় কিনতে হবে। আমি কাউকে সৌজন্য কপি দেব না। যে পড়তে চায় সে কিনে পড়ুক।

    অরুণেশ: আপনি বলেছে, ‘আমিই আন্দোলন, আমিই ভেঙে দিচ্ছি’। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ? সে-উদ্দেশ্য কি সফল হল? নাকি ব্যর্থতার জন্যই ভেঙে গেছে ?

    মলয়: ছ্যাঃ, তথ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছ তুমি। আমি অমন বলিনি। আমি বলেছি, ‘যাঁরা নিজেদের এখন হাংরি বলছেন, তাঁরাই হাংরি ক্ষুধার্ত ক্ষুৎকাতর। আমি মলয়, মলয় রায়চৌধুরী হয়ে উঠতে চাই। আমিই আন্দোলন’। তুমি আমার বক্তব্যের ইমপোর্ট ধরতে পারোনি। তুমিও নিজেকে হাংরি বলছ বলে বোধহয় কথাটা তোমার খারাপ লেগেছে। আমি আমার সম্পর্কে যাই ভাবি না কেন, তাতে তোমার অবমাননার কিছুনেই। আমি আমার সম্পর্কে চিন্তা করি, আমার অভিজ্ঞতা, অনুভব, অনুভূতি অনুযায়ী, যা জমে চলেছে বছরের পর বছর। তুমি তোমার বিষয়ে ভেবে যা ঠিক করছ তা তোমার মানসদুনিয়া। তবে, আমি মনে করি, ১৯৬৫ সালের মে মাসের তিন তারিখে হাংরি আন্দোলন প্রকৃত অর্থে ফুরিয়ে যায়। কেননা সেইদিন ব্যাংকশাল কোর্টে আমাকে যে চার্জশীট দেয়া হয়, তার সঙ্গে হাংরিদের দেয়া জবানবন্দি-মুচলেকাগুলো জানাজানি হয়ে যায়। তারপরে আন্দোলনকে আমি কিছুদিন হিঁচড়ে নিয়ে যাই, কিছুদিন শৈলেশ্বর, কিছুদিন সুবিমল বসাক, তারপর তুমি। হাংরি আন্দোলন এবং হাংরিয়ালিজম দুটো আলাদা ব্যাপার, এটা তো জানো ? তেসরা মে ১৯৬৫এর পর আন্দোলন আর ‘মুভ’ করে না, ফলে তা আর ‘মুভমেন্ট’-ও থাকে না, যা থাকে তা হল ভরবেগ। আন্দোলন কী ভাবে ভাঙল এবং কেন, ওই সময়ে তুমি থাকলে টের পেতে। এখন তথ্যের ভিত্তিতে আঁচ করো। আমি বলব তুমি একজন হাংরিয়ালিস্ট, হাংরি আন্দোলনকারী নও। আন্দোলন যে সফল হয়েছিল, তার প্রমাণ তো তুমিই। নয়তো আন্দোলন আরম্ভ হবার দেড় দশক পরে তুমি নেজেকে ক্ষুধিত প্রজন্মের একজন মনে করে গৌরব বোধ করবে কেন ? এই সূত্রে আরেকটা কথা বলি এখন। সমরেশ বসু-র ‘বিবর’ বের হলে সন্তোষকুমার ঘোষ লিখেছিলেন, এবং পরে বাসুদেব দেব তা রিপিট করেছেন, যে, হাংরি আন্দোলন যা করতে চেয়েছিল, সমরেশবাবু ‘বিবর‘-এ তা করে দেখিয়ে দিলেন। হাংরি আন্দোলন যৌনতাকে কমোডিটি করতে চায়নি, তাই যৌন-শব্দ ও বাকপ্রতিমা এমনকি অনুষঙ্গ এসেছে সম্পূর্ণ অযৌন প্রেক্ষিতে, যখন কি না সমরেশবাবু যৌনতাকে পাঠকের সঙ্গে তাঁর মাধ্যম করেছেন। সেই সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ঝড় যে অনুসন্ধিৎসা এনেছিল পাঠকদের মধ্যে, সমরেশবাবু তার বাজার তৈরি করে যৌনতা বেচতে বসে যান। তার আগে তাঁর লেখার বিষয়বস্তু একেবারে আলাদা হত। তাঁর নিজের কোনও গদ্যশৈলী নেই। যৌনতানির্ভর তাঁর লেখাগুলোকে এক্সপোজিশান মনে করা ভুল। হাংরি আন্দোলনের শিক্ষিত সমীক্ষা তেমন হয়নি, কিছু হাফ-লিটারেট এদিক-ওদিক ভাসা-ভাসা মন্তব্য দিয়ে অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাভাষার সমস্যা হল কোনও সমালোচক নেই, সকলেই কবিলেখক। কবি বা গল্প-উপন্যাস লেখকের কাছ থেকে উচিত সমালোচনা আশা করা যায় না। নিজের ঢাক না পিটে তাই সময়ের অমোঘ নির্দেশের অপেক্ষা করো।

    অরুণেশ: এটা কি স্বীকার করবেন যে ক্ষুধার্ত অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত কবি ও লেখক ছাড়া, অনেকেই হয়তো সরাসরি ক্ষুধার্ত নয়, অন্যকারোর দ্বারা সেরকম মৌলিক লেখা হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা মৃত ও অসাড়।

    মলয়: তোমার এই ধারণাটা শঙ্খ ঘোষ তো আগেই ভেঙে দিয়েছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে। আন্দোলন জীবন ও সাহিত্যকে পৃথক রাখেনি। আন্দোলন ঝড় বইয়ে দেয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার। আন্দোলন লেখায় সততাকে প্রধান শর্ত করে। তবু, অনেকে, আলাদা মানসিকতা থেকে যথেষ্ট মৌলিক লেখা লিখতে পেরেছেন। যেমন জয় গোস্বামী, মল্লিকা সেনগুপ্ত, শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, বরুণ চৌধুরী, কেদার ভাদুড়ি প্রমুখ। এছাড়া পুষ্কর দাশগুপ্ত কবিতার আঙ্গিকে চূড়ান্ত অস্হিরতা ঢুকিয়ে তাকে একটা সাবভারসিভ শস্ত্রের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পরেশ মণ্ডলের সঙ্গে— তাকে, সেই প্রচেষ্টাকে, নস্যাৎ করাটা ভুল হবে। শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, বিনয় হাংরি আন্দোলনে ছিলেন বলেই মৌলিক বলা যায় না। তাঁরা আগে থাকতেই লিখছিলেন— আমরাই বরং তাঁদের সাহসের দ্বারা এককালে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ক্ষুধার্তরা বা ক্ষুধার্ত অনুপ্রেরণা ছাড়া আর কিছু মৌলিক নয় মনে করাটা ছেলেমানুষি হয়ে যায়। ক্ষুধিত প্রজন্ম আন্দোলনকে অস্বীকার করে বা হেয় করে অনেকে একইরকম ছেলেমানুষি করেন। তুমি তো কলকাতায় থাক না, মাটিপৃথিবীর কাছাকাছি নিজের গাঁয়ে থাক, তোমার মধ্যে অন্তত উদারতার বিস্তার আশা করা যায়। নাকি, অসুখের বীজ তোমার মধ্যেও সেঁদিয়েছে ? তোমার লেখা যেসব কাগজে বেরিয়েছে তার কয়েকটায় এই রকম মন্তব্য অনেকে করেছে দেখলুম, যে, শক্তি, উৎপল, সন্দীপন কিসুই লিখতে পারেননি ইত্যাদি। একদিকে তুমি বলবে ক্ষুধিত প্রজন্মের লেখকরাই মৌলিক, আবার অন্য দিকে যেই কেউ তোমাদের বিরোধিতা করলেন , কিংবা আন্দোলন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন বলে, তাঁর লেখা মৌলিক নয়, এই যুক্তিটা জোচ্চুরির পর্যায়ে পড়ে। যেমন ,বাসুদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে কী করবে তোমরা ভেবে পাচ্ছ না এখন, কেননা তিনি হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলা আরম্ভ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক মতামতের জন্যে তো তাঁর পূর্বের লেখাগুলো নস্যাৎ হয় না। ‘রন্ধনশালা‘ বইটা এখনও প্রকৃত সমালোচকের অপেক্ষায় পড়ে আছে। আরেকটা নতুন ক্ষুদ্রতা এবার কলকাতায় গিয়ে নজরে এলো। এলাকাভিত্তিক এসট্যাবলিশমেন্ট। উত্তরবঙ্গের লেখকের প্রতি উত্তরবঙ্গের লেখকের সহানুভূতি দয়াদাক্ষিণ্য, সে তার মতাদশ ইত্যাদি যেমনই হোক না কেন। সেরকম মেদিনীপুর-প্রসূতদের, বাঁকড়োদের। জানি না ঘুঘুমারিতে বসে তুমি এটা টের পেয়েছ কি না। আমি এককালে কলকাতায় জুতো-লাথি খেয়েছি অনেক, তাই যেন সহজে অনেককিছু বুঝে ফেলি। তুমি শুনেছ কি না জানি না, ক্ষুধিত প্রজন্ম ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে আর আমার দাদাকে একটা বিশেষ ইনটারোগেটিং বোর্ড জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, একাধিক টেপরেকর্ডারে তা রেকর্ড করা হয়েছিল, হোম মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয়েছিল। দীপক মজুমদার একটা স্বাক্ষর সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন, তাও ভেস্তে দিয়েছিলেন হোমরা লেখক আর চোমড়া সাংবাদিকরা। দীপকের কাছ থেকে তুমি অনেক অজানা তথ্য পাবে। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আগাগোড়া জানতে হলে সংশ্লিষ্ট সবায়ের সঙ্গে তোমায় যোগাযোগ করতে হবে, নয়তো কেবল একটা ডায়মেনশনই পাবে তুমি।

    অরুণেশ: ক্ষুধার্ত লেখালিখি নথেকে সরে গিয়ে, আপনি আপনার ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন, বড় অফিসার হয়েছেন, সমাজের উঁচু সারিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে আবার ফিরে এসেছেন সাহিত্যের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে—- এই অভিযোগ কী ভাবে খণ্ডন করবেন ?

    মলয়: না, এই অভিযোগ খন্ডন করতে চাই না, কারণ আমি জানি, আমি একজন লুমপেন বুর্জোয়া, আরামপ্রিয়, জোয়ার-বাজরার রুটি খেয়ে হজম করতে পারি না, চম্বল এলাকার ডালতরকারি প্রচণ্ড ঝাল লাগে, স্কচ খেতে ভাল্লাগে, ইত্যাদি। তুমি যে বলছ ক্ষুধার্ত লেখালিখি থেকে, তা কিন্তু ঠিক নয়, বলা দরকার লেখা থেকেই একেবারে। তবে, লেখালিখি বজায় রাখলেও যে চাকরি করছি তা-ই করতুম, কেননা বি এ-এম এ তো ভালো চাকরি পাবার মতনই করেই পাস করেছিলুম, নয়ত স্কুল মাস্টারি করতে হত একথা বলতে পার। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে ভর্তি হবার মুহূর্তে ক্ষুধিত প্রজন্ম আন্দোলনের আরম্ভ ঘটে। আই এ এস এর চেষ্টা করার কথা মনে আসেনি তাই। কয়ারিয়ারের জন্যে সুতরাং চেষ্টা করতে হয়নি। বরং খ্যাতির যেখানটায় পোঁছেছিলুম, লেখা বজায় রাখলে সেখান থেকে চাকরির সুবিধা হত। মাইনে কড়ি ভালো পাই এখন। অফিসারিও করি। মানে, যে সব সর্বহারার প্রতিনিধিরা অজস্র টাকা মাইনে পেয়ে কাজ করতে চান না, তাঁদের দিয়ে কাজ করাই। গ্রামে-গ্রামে কৃষকদের কাছে যেতে হয় যখন-তখন, কখনও বুন্দেলখন্ড, কখনও নইনিতাল। এ সি ফার্স্ট ক্লাস থেকে গুমনাম স্টেশনে নেমে দেখি ছোঁচাবার জল নেই; কননৌজের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত গোলাপের চাষ। সমাজের উঁচু সারি বলতে কী বোঝায় তুমি একেবারেই জান না। ওই সারিতে কালীপুজোয় লক্ষ টাকার বাজি পোড়ে, দোলের দিনেরাতে বোমবেটে মাগিরা সোনার বিস্কুট কুড়োয়। সততা নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতার অভিনব আগার গড়ে উঠেছে মেধায়। আমি রজনীশ, মহেশ যোগী, রামকৃষ্ণ মঠ এসব করেও দেখেছি। হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছি। চূড়ান্ত নেশা করেছি হরেকরকম। জোয়ারের ভরাযৌবন নদী যেমন চরিত্রহীন করে তোলে চাঁদকে, এবং জ্যোৎস্নারসে আপ্লুত চরাচরের জলশরীরও। অধঃপতনের মুখে উদ্দাম আনন্দোচ্ছাস। তুমি বলছ সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হবার কথা। আমি যে ধরণের গদ্য লেখা আরম্ভ করেছি তা প্রতিষ্ঠা দিতে পারবে বলে মনে হয় তোমার ? এখানে ? কলকাতায় ? আরে এখানে তো জয়েস প্রুস্ত পাউন্ড র‌্যাঁবো হুইটম্যানের পর্যন্ত চামড়া তুলে ফেলত ধুতিপরা বাবুরা। একজন তো অলরেডি হুঁশিয়ার করেছেন, যে, বন্দুক সাফ করা আরম্ভ হয়ে গেছে, সাবধান। হাংরি আন্দোলনের প্রতি তোমার দুর্বলতা বা আকর্ষণেই হয়ত, কিংবা আন্দোলনের উদ্ভাবনার কথা ভেবেছিলুম বলে, তুমি মনে করছ বুঝি দেড় দশক পরে এসেও হাই তুলতে-তুলতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাব, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ‘দেশ’ পত্রিকার দণ্ডপাণি; সুবো আচার্য আর দেবী রায়-এর পদ্য ছেপেইছেন, শৈলেশ্বর ঘোষকে জাবগা দিয়েছেন সংকলনে, আমারও দু-দশটা লেখা ছেপে যাবে। কিংবা বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট একযোগে দাঁড়িয়ে উঠে বলবে, ওয়েলকাম হোম’ ! নাকি ? সুবিমল মিশ্রের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, গোণাগুনতি পাঠক পাওয়াও সমস্যা। পাঠক এতটা কোরাপ্ট হয়ে গেছে যে সৃজনশীল বাংলা লেখার প্রতি সে আস্হা হারিয়ে ফেলেছে। সোনাগাছিতে বলশয় ব্যালের ব্যবস্হা হয় না। এখানে ল্যাঙাকুকুরে-ভরা বিভূঁই গ্রাম-স্টেশনের নির্জনতা। নকশাল কিশোরের নিভে-যাওয়া চিতা থেকে বুলেট কুড়িয়ে তার মা আঁচলে বেঁধে রাখেন। নাচের ঘাঘরার মতন ফুলে ওঠে ছুঁড়ে-দেয়া খ্যাপলাজাল। প্রতিটি প্রসবে শূকরযুবতী প্রমাণ করে তার হারাম-গরিষ্ঠতা। প্রতিষ্ঠার জন্যে হরতনের টেক্কায় তৈরি হতে থাকে চতুর্দিকের ছিদাম মুখশ্রী।

    ( এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবার পর অরুণেশ ঘোষ নিজেও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা জলাঞ্জলি দিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেছেন। পরে দে বুকস থেকে হাংরি সংকলন প্রকাশিত হলে রাজসাক্ষী শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষে ও বহু অখ্যাত লেখকের সঙ্গে তাতে অন্তর্ভূক্ত হতে কুন্ঠিত হননি। অনেকের মতে জীবনের শেষ দিকে তিনি পরাজিত বোধ করতে থাকেন এবং সেকারণে জলে নেমে আত্মহত্যা করেছিলেন । )
    Posted in বিশ্বাসঘাতকতা, লিটল ম্যাগাজিন, হাংরি আন্দোলন| Tagged তৃণমূল, বাংলা কবিতা, সাহিত্য আন্দোলন, সিপিএম, হাংরি আন্দোলন| ১ টি মন্তব্য
    সৈয়দ সমিদুল আলম নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on ডিসেম্বর 2, 2011by কিছু লেখাপত্র

    লেখার টেবিলে মলয় রায়চৌধুরী

    সৈয়দ সমিদুল আলম পশ্চিমবাংলার একজন প্রখ্যাত অনুবাদক ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক। তিনি তাঁর পত্রিকা মধ্যরাত্রি-র জন্য মলয় রায়চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন । প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সনে। সৈয়দ সমিদুল আলম কাফকার গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি ও পত্রাবলী অনুবাদ করেছেন এবং সেগুলি প্রকাশ করেছেন কবিতীর্থ প্রকাশনী, কলকাতা। সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের স্বার্থে এখানে তুলে ধরা হল।

    সমিদুল: আপনি কী এবং আপনি কে ? এ-বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই কখনও না কখনও ভেবেছেন? আমরা আপনার ভাবনার কথাটুকু জানতে চাই।

    মলয়: আজিজুল হক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মলয় রায়চৌধুরী মানব সমাজের পেরিফেরির জীব। সোজা বাংলায় আমি একজন কালচারাল বাস্টার্ড।

    সমিদুল: বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার ভাবনা আপনার মধ্যে কবে জাগ্রত হয় ? কী ভাবে ?

    মলয়: ১৯৫৯-৬০ নাগাদ । পাটনা শহরে আমাদের বাসা ছিল ক্রিমিনাল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জের ইমলিতলা পাড়ায়। দিনের বেলাতেও লোকে ওপাড়ায় যেতে ভয় পেত। আমি কবিতায় ছুরি-চাকু চালানো রপ্ত করি।

    সমিদুল: বাংলার সো-কলড সাহিত্য ও সংস্কৃতির, আপনার ভাষায়, ধারাকে সমূলে আঘাত করার প্রবণতা কেন এসেছিল ? এই ধারাটি কি সত্যিই কোনওভাবে ক্ষতিকারক ছিল বলে আপনার আজও মনে হয় ?

    মলয়: ওটা প্রবণতা নয়, সংকল্প । আর ওসব জিনিস মোটেই সাহিত্য নয়। প্রথিবীতে আর কোনও ভাষায় এই সমস্ত চুতিয়াপন্হী লেখাকে সাহিত্য মনে করা হয় না । আঁস্তাকুড়ের জিনিস আঁস্তাকুড়েই থাকা দরকার । ঘরে ঢোকালেই প্লেগ, কালাজ্বর, পানিবসন্ত, যক্ষ্মা । তবে, আজকাল আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তদের এইসব মাল ভাল্লাগে। কেরালায় কিছুদিন থেকে আমার মনে হয়েছে যে বাঙালিকে টেনে তোলা মুশকিল।

    সমিদুল: কবিতাকে কি কখনও পয়সা রোজগারের ঝরণা করা সম্ভব ? করে ফেললে, তা কেন ও কী ভাবে কবিতাকে প্রভাবিত করবে বা করবে না ?

    মলয়: বাংলা ভাষায় বোধ হয় সম্ভব নয়। তবে কবিতার মাধ্যমে রাজ্যের বা রাষ্ট্রের বা বিদেশের এসট্যাবলিশমেন্টে ঢুকে পয়সাকড়ি হতে পারে, নাম, যশ, পদ্মশ্রী, নারী। তারপর কবিতা বেরোনো শক্ত। কলকাতার যা কয়জন কবি চাঁদির পয়জার খেয়েছেন, দেখতেই পাচ্ছ, শংকর বিমল মিত্তিরদের মতন তাঁরা গপপো-উপন্যাস ঝাড়ছেন দোল-দুর্গোৎসবে। ওখানে, ঢাকাতেও, আল মাহমুদ নিজের বারোটা নিজেই বাজিয়েছেন। ইংরেজিতে সেরকম ডম মোরেস।

    সমিদুল: একজন কবি, পণ্যগামীতা যাঁর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, তাঁর পক্ষে কি আর কোনও কবিতা লিখে ওঠা সম্ভব ? পণ্যগামীতা তাঁর লেখাকে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পারে বলে আপনি মনে করেন ?

    মলয়: হ্যাঁ, তা হবে না কেন, বেবুশ্যে মাগিরাও তো আনন্দ দে্য, ঝটিতি ফরমুলা অনুযায়ী। শেষে এইডস হয়। সে রোগ অজান্তে ছড়ায়। হাজার-হাজার এইডস আক্রান্ত কবিতা লেখা হয় আজকাল, ছুঁতেও ভয় করে। একজন বেশ্যা তার সঙ্গমে মনের দিক থেকে ইনভলভড নয়। আর আজকাল তো দক্ষিণপন্হী এবং বামপন্হীরা মিলেমিশে বাজার সামলাচ্ছেন। হলুদ এবং লাল সিনড্রোম। ধ্রুপদী জোচ্চোর।

    সমিদুল: আপনি বলেছেন, অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত পারমুটেশান কম্বিনেশান থেকে, অবক্ষয়ী আধুনিকতার খতরনাক গন্ডী থেকে, তুলে এনেও সম্ভব হয়ে উঠছে না কবিতার অস্তিত্বকে ধরা, কেননা কবিতাকে, আপনার কথা অনুযায়ূ, প্রতিদিনই থাকতে হচ্ছে, হেনরি মিলার যাকে বলেছেন– “প্রোফাউন্ডলি অলটারিং দি ওয়র্ল্ড”, এরই কাজে, অর্থাৎ এক তেজস্ক্রিয় প্রক্রিয়ায়। তো, এমনি এক অবস্হা থেকে কবিতার অস্তিত্বকে কী ভাবে তুলে আনা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন ? বিশেষ করে তেজস্ক্রিয়তা যেখানে প্রতিনিয়তই নশ্বরতার অভিমুখী, প্রতিমুহূর্তেই অবস্হান্তর ঘটে তার ।

    মলয়: কবিতার সঙ্গে নশ্বরতার বিরোধ নেই। বস্তু থেকে লক্ষ কোটি বছরে ব্যক্তিমানুষের আবির্ভাব এবং আরও লক্ষাধিক বছর পর এই একই ব্যক্তিমানুষের অন্য কিছুতে উত্তরণ কবিতার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে। কবিত্বের অন্ধকারে নিজেদের হাতড়ে বেড়াই বলে কবিতার অস্তিত্বকে ধরা যাচ্ছে না মনে করাটা অবৈজ্ঞানিক। বস্তুর কোনও ষড়যন্ত্র নেই। নিজের অনৈতিক মানস তার ওপর চাপানোটা ভুল।

    সমিদুল: ক্ষুৎকবিতা পর্যায়ে পৌঁছোনোর আগে লেখা থেকে বিষয়কে লোপাট করে দেওয়া দরকার। মনোভাব, মনোভাব, মনোভাবই আসল, ওইতেই বোঝা যায় রক্তের সঙ্গে মিশতে পেরেছে কি না। আপনি এরকমই বলতেন। কিন্তু বিষয়ের ঊর্ধে কোনো লেখা লিখে ফেলা কি আদৌ সম্ভব ? আপনি কি এ-জীবনে এমন একটাও কবিতা লিখতে পেরেছেন যা বিষয়ের ঊর্ধে ? ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার‘-এ কি বিষয় নেই ? বা ‘লোহার রড’, ‘তুলকালাম আত্মহত্যা’, ‘জখম’, ‘উৎখাত’ বা ‘সনেটের প্রতি মহিলা’-য়? এগুলিকে কি আপনি বিষয়হীন মনে করেন ? আমরা কিন্তু আপনার সমস্ত কবিতাতেই বিষয় আছে লক্ষ্য করেছি। এ-ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

    মলয়: আমি যে-কোনও পিক আপ থেকে কবিতা লিখি। একই কবিতায় একাধিক পিক আপ থাকতে পারে– যেমন ‘এবং’ ও ‘কৌরব‘ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইচ্ছাপত্র‘ কবিতাটা। আমার কোনও কবিতাই বিষয়নির্ভর নয়, শিরোনামটা কেবল ক্লু। পিক আপগুলো যাতে হাইড্রার মতো হয়ে ওঠে, তার চেষ্টা করেছি ‘হাততালি‘ কবিতায়। তুমি দেখবে ‘হাততালি’ কবিতাটা পুরোপুরি অ্যাল্যুসিভ হলেও তা ক্যানটিকাম আঙ্গিকে এবং কোনওরকম লেকসিকন মানা হয়নি। অমুক বিষয়ে লিখব ভেবে কখনই কবিতা লিখিনি।

    সমিদুল: আপনার মতে, সিক্সটিজের পূর্বে আড়াই দশক ধরে একটিও কবি উঠে আসতে পারেননি। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা লেখার সময়েও বোঝেননি একজন লোক কেন লেখে। বেশ, এটা না হয় বুঝলাম। এবার আসি সিক্সটিজ-এ; তো, এই সিক্সটিজ-এ কাকে কাকে আপনার কবি বলে মনে হয় যাঁরা সত্যিই কিছু কবিতা লিখেছিলেন এবং এখনও লিখছেন।

    মলয়: কেবল একটিই লোকের নাম করা যায়। মলয় রায়চৌধুরী।

    সমিদুল: সিক্সটিজ-এর পরেও তো আরও দুটো দশক অতিক্রান্ত। এই দুটো দশকেরই বা কাকে কাকে আপনি কবি বলে মনে করেন ?

    মলয়: একটু অপেক্ষা করো। এর উত্তরটা আমি একশো বছর পর দেবো।

    সমিদুল: বাস্তবকে নিয়েই কবিতা, কল্পনার লাবগুবাগুব নিয়ে নয়— আপনার এই উক্তির মধ্যে দিয়ে এটা পরিষ্কার যে , কবিতার অবস্হান হবে বাস্তবের স্তরেই বিস্তৃত। তাহলে কি বাস্তবতার ঊর্ধে কিছুই নেই ? যদি না থাকবে তাহলে অন্তিম প্রাতিস্বিকতার ব্যাখ্যা আপনি কী ভাবে দেবেন?

    মলয়: বস্তুপৃথিবীকে ছাপিয়ে কিছু নেই। ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ড থেকে কোনও প্রাণের ইশারা যদি কোনোদিন আসে, তাও বস্তুমাধ্যমে আসবে। তোমার ও আমার বাস্তবের ইনটারপ্রিটেশান আলাদা হতে পারে। সেখানেই অন্তিম প্রাতিস্বিকতা। কল্পনার লাবগুবাগুবে মজে থাকার দরুন আমাদের দেশের মার্কসবাদীরা খেই পাচ্ছেন না যে পূর্ব ইয়োরোপের পথে পথে এত জনতা কোথা থেকে এল।

    সমিদুল: এক সময়ে আপনি মনে করতেন যে কবিতার থেকেও জীবনটাই, বেঁচে থাকাটাই, বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সম্প্রতি আপনার এই ধারণা হয়েছে যে , বেঁচে থাকার চেয়ে কবিতাটাই বড়। কী ভাবে আপনার মধ্যে এই ধারণাটা এলো ?

    মলয়: নাঃ, জীবন ও কবিতায় কোনও তফাত নেই। কোনও কালেই।

    সমিদুল: হাংরি আন্দোলনের সময়ে আপনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্যে থেকে অর্জিত জীবনবোধ, আজকের জীবনবোধের সাথে কি মেলে ? না মিললে, বর্তমান জীবনবোধ বিষয়ে কিছু বলুন।

    মলয়: আমাদের জীবনচেতনা গড়ে ওঠে আমাদের, মানে একজন মানুষের, অস্তিত্ব থেকে। সেই মানসিক অস্তিত্ব নির্ভর করে মগজ নামে একটি বস্তুর ওপর। তাতে সংকেতের পরাবর্ত গড়ে তোলে ইন্দ্রিয়গুলো। ইন্দ্রিয় বা রিসেপ্টারগুলো একযোগে কাজ করে— তা যৌথ উদ্দীপক। অজস্র পলিসিন্যাপটিক রিফ্লেক্সের যোগফল হল জীবনবোধ। আমাদের জীবনে জৈবিক আর সামাজিক দুটো উদ্দীপক একই সঙ্গে কাজ করতে থাকে। তবে হ্যাঁ, একটা নতুন পরাবর্ত পুরনো পরাবর্তকে সরিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ বছরের মানবেতিহাস থেকে প্রতিটি মানুষ তার জিন-এ বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে রাখে। জিনগুলো বংশধারা আর পারিপার্শ্বিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই জিনগুলো এক ধরণের রাসায়নিক একক। তাহলে বুঝতেই পরছ যে হাংরি আন্দোলন ঘটে বিশেষ একদল তরুণের ঘিলুতে একই রকম কিছু পরাবর্ত ও উদ্দীপক ক্রিয়া করার দরুণ। জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা গভীরতর হতে থাকে, জীবনবোধে তা বিশেষ তফাত আনে না। যেটুকু তফাত তা তখনকার কবিতা, ‘কবিতা সংকলন’-এ পাবে, আর এখনকার কবিতাগুলো, যা ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর‘-এ পাবে, পড়লে টের পাবে।

    সমিদুল: ‘মানুষ’ এই শব্দটা আপনাকে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করে ? মানুষ বলতে আপনি কী বোঝেন বা বোঝাতে চান ?

    মলয়: দুচার কথায় এর উত্তর দেয়া সহজ নয় ভাই। তাঢ়াড়া আমি এই বিস্ময়ের গিঁট এখনও খুলতে পারিনি।

    সমিদুল: ‘শুন্যতা’ বিষয়ে আপনি কখনও ভেবেছেন ? ভেবে থাকলে এই শব্দটির বিষয়ে আপনার বোধের কথা, অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

    মলয়: হ্যাঁ ভেবেছি বটে, পড়েওছি বেশ কিছু। ওটা খ্রিস্টধর্মীদের ‘নাথিংনেস‘ থেকে আমদানি-করা। বস্তুজগতের শূন্যতা বোঝা যায়, কিন্তু মগজের শূন্যতাবোধ নেহাতই বুজরুকি। আমার ঝাপসা হিন্দুত্বের কাছেও এটা গ্যাঁড়াকল !

    সমিদুল: বাংলাভাষার তথাকথিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারার বুকে যে মারাত্মক ধাক্কা বা মোচড় আপনি দিতে চেয়েছিলেন সেই ধাক্কার নিশ্চয়ই একটা ফলাফল আপনার প্রত্যাশিত ছিল। সেই ফলাফলের মধ্যে দিয়ে আপনারই প্রার্থনীয় অন্তিম প্রাতিস্বিকতা অর্জন সম্ভব ছিল বলে আজ আপনার মেনে হয়? তাহলে বর্তমানে আপনার মধ্যে দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের অবস্হান কেন? কেনই বা আপনি আজ বলছেন “আই অ্যাম কনফিউজড” ?

    মলয়: আমি তো এমন কাউকে দেখিনি যে দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত। আমি এটা স্বীকার করি এই যা।

    সমিদুল: আপনি বলেছেন ইদানিঙ ‘মৃত্যু’ বিষয়ে আপনি ভাবিত । কেন আপনি এখন মৃত্যু সম্পর্কে ভাবছেন ? মৃত্যু সম্পর্কে আপনার এই ভাবনাটা কোন আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে ? আপনার সিক্সটিজ-এর ভাবনার সঙ্গে বর্তমান এই ভাবনার কি কোনও মিল আছে ? ( এখানে উল্লেখ্য যে কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক মলয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে এই সংবাদ তাঁদের সম্পাদকীয়তে প্রকাশ করেছিলেন।তাঁর তথাকথিত মৃত্যু সংবাদে তাঁরা শোকও প্রকাশ করেছিলেন)।

    মলয়: হাংরি আন্দোলন-এর সময় ওব্দি আমি আমার সামনে কাউকে মারা যেতে দেখিনি এবং সেই মারা যাবার দরুন হাহাকারবোধে পীড়িত হবার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। জানতুম না যে মৃত্যু এভাবে আমাকে বিচলিত করে দিতে পারে। একজন নেই, এই বোধ, মৃত্যু সম্পর্কে এরকম বোধ ছিল না।

    সমিদুল: মৃত্যু মানেই তো একটা শূন্যতা, এই নশ্বর দেহের বিলীয়মান একটা দশা। কিন্তু এই নশ্বর দেহটাই কি সব ? ‘মানুষ’ এই শব্দটার মধ্যে কি ওই বস্তুগত নশ্বরতার ঊর্ধে কিছু নেই বলে আপনি মনে করেন?

    মলয়: নশ্বর বলেই তো তার এত গুরুত্ব। আপামর মানুষ তো ব্যক্তিমানুষগুলোকে নিয়েই। জলজ্যান্ত লোকটাই তো যাকিছু। একজন জলজ্যান্ত লোকের ঊর্ধে আর কিছু নেই। প্রতিটি জলজয়ান্ত মানুষ একটা পৃথিবী। লোকেদের ধরে ধরে গায়েব করে মানুষ-সাধারণের জন্যে সমাজ গড়া যায় না। বাংকারে বাংকারে ঘুমন্ত মানুষও এক-একটা লোক। বিমূর্ত সুখের জন্যে মূর্ত পৃথিবীকে নষ্টের চেষ্টাটা ভুল।

    সমিদুল: অমরত্বের ব্যাপারে আপনার ভাবনার কিছু বলুন ।

    মলয়: আগামীর জন্যে বর্তমানকে ধরে রাখা, তাকে অতীত হতে না দেয়া।

    সমিদুল: আপনি জানিয়েছেন, মৃত্যু বিষয়ে আপনার ছয়ের দশকের কবিতাগুলি এক ধরণের ভাবনার প্রকাশ মাত্র। গভীর অনুভূতি থেকে লেখা নয়। অথচ কবিতা বলতে তো আপনি বুঝতেন ঘিলুর বীভৎস শাঁষ থেকে, শাঁষের উত্তরাধিকারহীন নৈরাজ্য থেকে, সারি-সারি বিস্ময়কর শব্দপূঞ্জের ভেতর নিক্ষিপ্ত অসংযত অহং-এর অনুসন্ধান। তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা কি ভুল হবে যে, সিক্সটিজ-এ আপনার লেখা মৃত্যু বিষয়ক কবিতাগুলি কবিতা নয়, কবিতা হয়ে ওঠেনি, তা কিছু শব্দের ফুলঝুরি সৃষ্টি করেছে মাত্র ! এ-বিষয়ে আপনি কী বলবেন ?

    মলয়: মৃত্যুকে বিষয় করে আমি কোনো কবিতা লিখেছি বলে মনে পড়ছে না। তখনকার কবিতাগুলোয় আত্মহত্যার রেফারেন্স আছে, বা বলতে পারো আত্মহত্যার চেষ্টার রেফারেন্স। এখনকার কিছু কবিতায় পাবে নারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার কথা। সেগুলোকে মৃত্যু বিষয়ক বলে কি ঠিক হবে ? মৃত্যু সম্পর্কে আমার বোধের কথা একটু আগেই তো বললুম তোমায়। আর কবিতা হয়েছে না হয়নি সেটা তো পাঠক হিসেবে তোমাকেই নির্ণয় করতে হবে। কেন আত্মহত্যা করতে পারিনি সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার কাছে নেই। তুমি যেগুলোকে মৃত্যুর কবিতা বলছ, সেগুলোকে প্রেমের কবিতা বলেছেন বারীন ঘোষাল। পাঠকের মানস-দুনিয়ায় ঢুকে যেতে পেরেছি প্রেম বা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে, যে পাঠকের যেমন পরাবর্ত।

    সমিদুল: আপনি বলেছেন ‘ঈশ্বর জঞ্জাল’। কেন ? আপনার এই ভাবনার উৎস কী?

    মলয়: তখন, পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে, একজন কনসেপচুয়াল প্রতিদ্বন্দ্বী দরকার ছিল।

    সমিদুল: মধুসূদন খ্রিস্টধর্মকে গ্রহণ করে নৈঃশব্দ্যকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। আপনি এরকমই এক জায়গায় লিখেছিলেন। কেন আপনার এরকম মনে হয়েছিল ?

    মলয়: ওটাই ওনার বিকল্প, এমন মনে হয়েছিল, যখন কি না আমার সামনে কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলুম না।

    সমিদুল: ঈশ্বর নাকি ঈশ্বরকে ? আপনার বিশ্বাস নেই। এবং এ-ব্যাপারে আপনার স্ত্রীর যুক্তিগুলো স্বচ্ছ কিনা সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত নন। আপনার দ্বন্দ্বের উৎসটা আপনি কি ভাবে ব্যাখ্যা করবেন ?

    মলয়: আমি বস্তুবাদী। আমার স্ত্রী তা নন। তাঁর মতে আমার চেতনাশক্তি সীমিত, তাই বস্তুকে ছাপিয়ে ওঠার ক্ষমতা আমার নেই। তিনি হাজি আলি আর মাহিম চার্চ মেরিতেই বিশ্বাসী।

    সমিদুল: না প্রাচ্য না পাশ্চাত্য, কোনও সংস্কৃতির সঙ্গে আপনাদের প্রবর্তিত সংস্কৃতির মিল ছিল না। এই বক্তব্য কতখানি সত্য ? আমরা তো লক্ষ করেছি সংস্কৃতিটা ছিল সম্পূর্ণরূপে হিপি-সংস্কৃতি থেকে ধার করা।

    মলয়: বাঙালি সমালোচক-প্রতিবেদকদের পড়াশুনো ও জ্ঞানের অভাবে এমন ধারণা ছড়িয়েছিল। হিপিরা ছিলেন উচ্চবিত্তের ড্রপআউট, একটা প্রতিসংস্কৃতির জনক। আমরা ছিলুম নিম্নবিত্তের ছোটোলোক, মূল সংস্কৃতিতে আউটসাইডার। মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার মধ্যে কোনও সমর সেনীয় গ্লানির কথা ভাবিনি। কলকাতায় আমাদের থাকার জায়গা জুটতো না। তাই ওটাকে নজরুলী বোহেমিয়ানগিরিও বলা যায় না। সম্ভবত, ছোটোলোকদের সাহিত্য করাটা বঙ্গসমাজের পক্ষে হজম করা শক্ত ছিল। ফলে অমন প্রচার। ( মলয় রায়চৌধুরীর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বাল্যস্মৃতি এই সাক্ষাৎকার নেবার সময়ে প্রকাশিত হয়নি)।

    সমিদুল: অনেকেই বলেন আপনাদের সাহিত্য বিটনিকদের দ্বারা প্রভাবিত। এ-বিষয়ে আপনি কী বলবেন ?

    মলয়: গবেষণা না করে এই ধরনের আলটপকা কথাবার্তা বলা হয় বটে। এসব যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা হয় যে হাংরি আন্দোলনকারীরা শেষ ওব্দি কিছুই করতে পারেনি। যাঁরা বলেন তাঁরা বোধহয় জানেন না যে পাশ্চাত্য সাহিত্যে উইলিয়াম বারোজ-এর ‘নেকেড লাঞ্চ‘ বইটিকে মনে করা হচ্ছে জেমস জয়েস-এর ‘ইউলিসিস’-এর পর প্রথম পথিকৃৎ গদ্য। বাসুদেব, সুভাষ বা সুবিমল কারোর গদ্যই বারোজের মতন নয়। বারোজের পৃথিবী এক ভয়াবহ ফ্যানটাসির জগত। সুভাষ-বাসুদেব-সুবিমল ঘোষ বাস্তবতায় প্রৌথিত। সেরকম শৈলেশ্বর-অরুণেশ-দেবী রায়কে তুলনা করা যায় না কোরসো-স্নাইডার-ফেরলিংঘেট্টি-গিন্সবার্গের সঙ্গে। প্রদীপ চৌধুরীর কাব্যগ্রন্হ ফ্রান্সে আর আমেরিকায় প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু ওখানে কেউই তাতে বিটনিক গন্ধ পায়নি।জনৈক ফুলব্রাইট স্কলার গবেষণা করছেন। তাঁর বই বেরোলে কিছি জানা যাবে। ( বিভিন্ন মার্কিন গবেষকের রচনা থেকে জানা যায় যে হাংরিরাই বিটনিকদের প্রভাবিত করেছিলেন। তথ্য পাওয়া যাবে নেট সার্চ করলে। )

    সমিদুল: আজ এই নয়ের দশকে দাঁড়িয়ে আপনি হাংরি আন্দোলন-এর গুরুত্বপূর্ণ ফসল কী বলে দাবি করেন ? ( এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হবার পর একাধিক ছাত্রছাত্রী হাংরি আন্দোলন-এর অবদান ও মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে এম ফিল এবং পি এচ ডি করেছেন।)

    মলয়: বাংলা ভাষায়, এসট্যাবলিশমেন্টের বাইরে থেকে লেখালিখি হাংরি আন্দোলন-এর জন্যেই সম্ভব হয়েছে। সৃজনশীল লেখালিখি, কেবল এসট্যাবলিশমেন্টের বাইরে যা-কিছু। এই দিক থেকে হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে ওয়াটারশেড।

    সমিদুল: আপনি এখন বলছেন যে , আপনি আজ প্রতিষ্ঠানের অংশ। কেন ? তাহলে আপনার সিক্সটিজের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নিশ্চয়ই একটা পরিসীমা ছিল। এই পরিসীমাটির বিস্তৃতি সম্পর্কে কিছু বলুন।

    মলয়: এসট্যাবলিশমেন্টের জাল ছিঁড়ে কোথা দিয়ে বের হওয়া যায় বলতে পারা শক্ত। তেল-চাল-চিনি বা রেডিও-টিভি কাগজ বা ট্রেন-বাস-স্টিমার প্রত্যেকটায় ফাঁদ। চাপে পড়ে রফা হতেই থাকে, তা সে হাসপাতালে হোক, রেল-স্টেশনে হোক, বা বাজারে হোক। কলকাতায় অবশ্য শুধু আনন্দবাজার গোষ্ঠীকে এসট্যাবলিশমেন্ট মনে করার চল আছে। ওটা ইডিয়টিক। এসট্যাবলিশমেন্ট অতটা সিমপ্লিসটিক ব্যাপার নয়। এর আগেও আমি বলেছি যে আমি পজিটিভ , তাই এসট্যাবলিশমেন্ট আমার বিরোধীতা করে।

    সমিদুল: রাজনীতি বিষয়ে হাংরি ইশতাহারে বলেছিলেন যে, বেশ্যার মৃতদেহ ও গাধার লেজের মাঝামাঝি একজন রাজনীতিকের জায়গা । আবার তারপরেই বলেছিলেন, কখনও রাজনীতি থেকে পালানো হবে না এবং সেই সঙ্গে আমাদের কান্তি-অস্তিত্ব থেকে পালাতে দেওয়া হবে না রাজনীতিকে। এমতাবস্হায় আপনার ভাবনার দ্বান্দ্বিকতা থেকে ‘রাজনীতি’ এই শব্দটির অবস্হানকে কীভাবে কী আঙ্গিকে চিহ্ণিত করা সম্ভব ?

    মলয়: তুমি প্রথম কবি কাকে বলবে ? অনেকের মতে প্রথম কবি হলেন পঁচিশ হাজার বছর আগের ক্রোম্যাগনন মানুষ যিনি একটা ফুল তুলে তাঁর মানুষীকে দিয়েছিলেন। আমি বলতে চেয়েছিলুম, প্রথম কবি হলেন আঠারো লক্ষ বছর আগেকার সেই জিনজানথ্রপাস মানুষটি যিনি একটা পাথরের টুকরো তুলে প্রথম হাতিয়ার আবিষ্কার করেন। সৃজনশীলতা বা কবিত্বকে সেভাবেই টের পেতে চেয়েছিলুম। হাংরি আন্দোলন-এ আমরা সবাই একইরকম ভাবতুম এটা মনে করা কিন্তু ভুল হবে।
    Posted in লিটল ম্যাগাজিন| Tagged হাংরি আন্দোলন| ১ টি মন্তব্য
    অনুপম মুখোপাধ্যায়: মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on জানুয়ারি 1, 2011by কিছু লেখাপত্র

    অ্যামস্টারডামে মলয় রায়চৌধুরৌ

    মলয় রায়চৌধুরী। বাংলা কবিতার নুন-ছাল উঠে যাওয়া চেহারাটা যেন চোখের সামনে জেগে ওঠে যখন এই নামটি উচ্চারিত হয়। ১৯৬১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তিনি বাংলা কবিতা লিখেছেন। সেই চর্চা বাঙালি পাঠককে স্বস্তিতে রাখেনি। যাটের দশকের বিখ্যাত, অনেকের মতে কুখ্যাত, হাংরি আন্দোলনের মলয়ই ছিলেন প্রাণপুরুষ। এই আন্দোলন তাঁকে কারাদণ্ডের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম বাঙালি কবি, তাঁর কোমরে পড়েছিল পুলিশের দড়ি, হাঁটানো হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। অভিযোগ ছিল কবিতায় অশ্লীলতা। শুরু হয়েছিল বিখ্যাত হাংরি মামলা, যা আজও কিংবদন্তি হয়ে আছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,তরুণ সান্যাল, সত্রাজিৎ দত্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত নিম্ন আদালতে সাক্ষী ছিলেন মলয়ের হয়ে। সেই কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার‘। বাংলা কবিতার অন্যতম স্বল্পপঠিত বিখ্যাত কবিতা। আজ সেই মলয় রায়চৌধুরী মুম্বাই প্রবাসী। কলকাতাকে পাকাপাকিভাবে ছেড়ে সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে ধরা গেল। ধরা দিলেন আন্তর্জালে। রাজি হলেন এই সাক্ষাৎকার দিতে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছে ই-মেলের মাধ্যমে। উঠে এসেছে অনেক বিতর্কিত, অস্বস্তিকর, বিস্ফোরক প্রসঙ্গ। হয়তো প্রথমবার মলয় রায়চৌধুরী নিজের বলয়ের বাইরে প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হলেন।

    মলয় রায়চৌধুরীর (জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯) অনেক পরিচয় আছে। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। কিন্তু এখনও তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় তিনি ষাটের দশকের সেই বিখ্যাত হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ। তখন, এবং এখন, সাহিত্যের কোনো অনুশাসন তিনি কখনও মানতে চাননি। সে ষাটের হাংরি আন্দোলন হোক বা শতকশেষের অধুনান্তিক চিন্তা।

    সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান মলয়। বাবা রঞ্জিত রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফোটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন রোনাল্ড রসের সহায়ক কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। বড়দা সমীর রায়চৌধুরীও একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শৈশব কেটেছে পাটনায়। সেখানে সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রথমিক শিক্ষা হয়। পরে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেশজ্ঞ হিসাবে প্রশিক্ষণের পর প্রথমে রিজার্ভব্যাঙ্ক, পরে এ আর ডি সি এবং নাবার্ডে উচ্চপদে ভারতের বিভিন্ন শহরে কর্মরত ছিলেন। সারা জীবন ভারতের চাষি, তাঁতি, জেলে, হস্তশিল্পীদের মধ্যে কাটিয়ে যে অভিজ্ঞতা, তা তাঁর কবিতায় বেশ গভীর ছাপ রেখেছে। অবসর নেন ১৯৯৭ সালে।

    ১৯৬১ সালে দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়-এর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করে আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেন। পরে প্রায় চল্লিশজন কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী এই আন্দোলনে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ফালগুনী রায়, রবীন্দ্র গুহ প্রমুখ। আন্দোলনের মুখপত্র হিসাবে এক পাতার বুলেটিন প্রকাশ করা হত। একশো আটটি বুলেটিন বেরিয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি’ এবং ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমিতে সংরক্ষণ করা গেছে। ১৯৬৫ পর্যন্ত পুরো দমে চললেও, বিখ্যাত হাংরি মকদ্দমার পরে ভেঙে যায় আন্দোলনটি।

    ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। ৩৫ মাস ধরে কোর্ট কেস চলে। কলকাতার নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হলেও, ১৯৬৭ সালে উচ্চ আদালতে অভিযোগমুক্ত হন। মলয়ের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত ও সত্রাজিৎ দত্ত। রাজসাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। এই মামলাই মলয়কে বিখ্যাত করে তোলে। ইউরোপ আমেরিকায় তাঁর নাম পৌঁছে যায়। বিখ্যাত ‘টাইম‘ পত্রিকা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখা প্রকাশ করে। বিভিন্ন ভাষায় মলয়ের কবিতা অনুবাদ করা হয়। সাম্প্রতিককালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘মডার্ন অ্যান্ড পোস্টমডার্ন পোয়েট্রি অব দি মিলেনিয়াম‘ সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এটিই একমাত্র কবিতা বলে জানিয়েছেন সম্পাদক জেরোম রোদেনবার্গ।

    প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ‘ ( কৃত্তিবাস প্রকাশনী, ১৯৬৩ ) থেকেই মলয় রায়চৌধুরী আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতার এক জলবিভাজক ব্যক্তিত্ব । কবিতায় যে-কোনো নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্যকে মলয় চিরকাল নাকচ করেছেন। তুমুলভাবে ব্যবহার করছেন যৌনতা। আবার সামাজিক চিন্তা ছাড়া তাঁর কবিতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কার-চিত্রকল্পে বিপুল ভাঙচুরের মধ্যেই তাঁর কবিতার সুরে একজন অসহায় ব্যক্তিমানুষের আর্তি ও যাতনা প্রকাশিত। তা ফুটে ওঠে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস, যৌন-অনুষঙ্গে। বাঙালি পাঠক এই সুর সর্বান্তঃকরণে আজও গ্রহণ করতে পারেননি। পারার কথাও হয়তো ছিল না। কবিতা এবং গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি অনুবাদক হিসাবে মলয় সার্থক। ২০০৩ সালে অনুবাদকর্মের জন্য তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দিতে চাওয়া হলে সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন, কারণ তার আগে বহু লিটল ম্যাগাজিনের পুরস্কার তিনি নেননি।

    বর্তমানে মলয় রায়চৌধুরী অসুস্হ। লিখতে গেলে হাত বেশ কাঁপে। কবিতা প্রায় দশ বছর লেখেননি। সময় কাটান ইনটারনেটে। কলকাতাকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে চলে গেছেন মুম্বাই শহরে। সেখানে সস্ত্রীক কাটাবেন জীবনটা।

    অনুপম: মলয়দা, কবিতা লেখা এখন তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন আপনি। গদ্য-সাহিত্যে কি মনোনিবেশ করতে চাইছেন পুরোপুরি ? অনেকদিন আপনার কোনো নতুন কবিতা পড়িনি। এই সিদ্ধান্তের কারণ কী ? কবিতা লিখতে ভালো লাগছে না আর ?

    মলয় রায়চৌধুরী: ২০০৪-এর পরে আর কবিতা লিখিনি; লিখতে পারিনি। মাথায় যা-কিছু আসে, মনে হয় একঘেয়েমি হয়ে যাবে। আমি তো সেনটেন্সের ভার্সিফায়ার বা স্বভাবকবি নই। ইদানিং কবিতা লেখা ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল আমার আর পাঠকের প্রয়োজন নেই। পাঠকদের চিঠি বা ই-মেল এলে আশ্চর্য অনুভুতিতে আক্রান্ত হই। সমস্যা আমার আঙুলেরও। বুড়ো আঙুলে আরথারাইটিসের কারণে কলম ধরার পর ইরিটেশান হতে থাকে, যা চিন্তাকে ডিসটার্ব করে। ইন্টারনেটে এক আঙুলে কাজ চালাই, কিন্তু কবিতা লিখতে বসে এক আঙুল কমপিউটারে আর সেই সঙ্গে মগজের রসায়নকে সেই আঙুলের ডগায় নিয়ে যাওয়া বেশ অ্যাবসার্ড। নতুন গদ্য লিখিনি; যা কিছু প্রকাশিত হয় সবই পুনর্মুদ্রণ । এক আঙুলে গদ্য লেখা আরও কঠিন। ফিকশানাল গদ্যগুলো জীবনের টুকরোটাকরা মিশিয়ে বানানো। এমন অনেক-কিছু লিখেছি যা বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েদের পছন্দ হয়নি, ফিকশানালাইজেশান সত্বেও। প্রবন্ধ লিখতে আর ভালো লাগে না। এক আঙুলে সোশাল নেটওয়ার্কিং এবং ব্লগ যেটুকু যা হয়। আজকাল একটা অদ্ভুত সাইটে ঢুকে পড়েছি; ওটা দেখেছো কি? চ্যাটরুলেট ডট কম । খুললেই স্ট্রেট তোমার সামনে অচেনা কেউ দেখা দেবে, তার ভালো লাগলে দু-মিনিট নিজের ভাষায় কথা বলবে, তারপর অন্য কেউ; মুখোশ পরে ল্যাংটো পোঁদে কেউ-কেউ কোন ভাষায় যে কী বলছে টের পাই না। এটাকে কী বলব? ওয়েবক্যাম থাকলে দেখো। কবিতা কি এই নেক্সটিং পর্যায়ে নিয়ে যাবে? তোমার ও পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা নিয়ে যাবেন আশা করি। কমপিউটারে উত্তর লিখচি বলে ইংরেজি শব্দ চলে আসছে; মুম্বাই শহরটাও তো ইংরেজির দিকে দৌড়োচ্ছে।

    অনুপম: মলয় রায়চৌধুরীকে আমরা জানি বাংলা কবিতার নেটিজেন হিসাবেও। আপনার কি মনে হয় ভবিষ্যতে প্রিন্ট মিডিয়া জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ? সেই দিকেই কি এগোচ্ছি আমরা ?

    মলয় রায়চৌধুরী: জাহিরুল হাসান ওঁর ত্রৈমাসিক বার্তায় লিখেছিলেন, “মলয় রায়চৌধুরীও নেটিজেন হলেন।” তার মানে আমার আগে কয়েকজন নেটিজেন ছিলেন। ওঁরা কারা তা জানি না। আমাদের ভাষায় প্রথম নেটিজেন কবি, আমার মনে হয়, রোহন কুদ্দুস। বস্তুত আমি তো ভেবেছিলুম রোহন একজন বাংলাদেশি কবি; লজ্জার কথা নিঃসন্দেহে, পরের প্রজন্মের কবিদের লেখাপত্রের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত নই। রোহনকে পথিকৃৎ বলা যায়। আমি যেভাবে লিটেরারি নেটওয়ার্কিং করি, লেখালিখি করি, ইন্টারভিউ ইত্যাদি দিয়ে থাকি, সেভাবে অনেকেই এই এলাকায় প্রবেশ করেননি, তাই চোখে পড়েন না ওঁরা। ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্যে ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গা মোটেই নিতে পারবে না; অন্তত পঞ্চাশ বছর লাগবে সমান্তরাল মাধ্যম হয়ে উঠতে। বাংলাদেশে কমপিউটার তো বহু বছর ইনট্রোডিউস হয়েছে, কিন্তু এখনও ইনটারনেট প্রিন্ট মিডিয়ার সমান্তরাল নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের লাইব্রেরিগুলোর যা অবস্হা, ছাপা বইয়ের স্হায়িত্ব সমস্যাজনক। স্হায়িত্বের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম জরুরি হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাইবার কাফেগুলোয় বাংলা ফন্ট নেই, ভাবতে পারো ? এদিকে বাংলা ভাষা বাঁচাও নিয়ে কত চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। কমপিউটার ঢুকেছে কুড়ি বছর পর, তার ওপর ইংরেজি শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছিল। নেট স্যাভি একটা কবি-প্রজন্মের উন্মেষ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে, ফলে ইনটারনেটে বাংলা কবিতার জায়গাটা প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি সুধীন দত্ত, আলোক সরকার, অরুণেষ ঘোষ খোঁজো তো পাবে না। গুগল করলে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবির অনুবাদ ( আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে) বা তথ্য পাওয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যেও তাকিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশি নেটিজেনদের দিকে।

    অনুপম: মলয়দা, হাংরি আন্দোলন নিয়ে গত প্রায় পাঁচ দশকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে আপনি হয়তো খুব ক্লান্ত। তবু একটু চর্বিতচর্বণ। এই দু’হাজার দশ সালের মুম্বাই শহরে বসে ষাটের দশকের আন্দোলনটির দিকে তাকালে কীরকম লাগে ? কী করতে চেয়েছিলেন কবিতায় ?

    মলয় রায়চৌধুরী: নাহ । হাংরি আন্দোলন নিয়ে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলনের সময় কবিতার অ্যাডিক্ট ছিলুম; কবিতা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগ। ‘সাহিত্য’ শব্দ দিয়ে ওই ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা যায় না। যারা এর অ্যাডিক্ট তারা নিজেরা বুঝে নিতে পারবে; কবিতা ছাপানো, সমালোচনা, আলোচনা এই সবই এই অ্যাডিকশানের প্রেক্ষিতে অবান্তর।

    অনুপম: ঠিকই মলয়দা। কিন্তু খারাপ লাগে না, যখন মলয় রায়চৌধুরী এই নামটি পরিচিত হয়ে যায়, কিন্তু যা নন তা-ই দিয়েই সকলে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে চায় ? অসহায় লাগে না ? আপনার নামটা জানে, কিন্তু ভুলভাবে জানে, তাই না ? অনেকের কাছে আপনার বয়স ষাটের দশকের পরে আর বাড়েনি। তারা একটা কবিতাতেই আটকে আছে—-’প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’।

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার তা মনে হয় না। বেশির ভাগ পাঠক, যাঁরা নেট-এ যোগাযোগ করেন, তাঁরা আমাকে গদ্য লেখক বলে মনে করেন, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’-এর লেখক, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ওঁরা আমার উপন্যাসের তালিকা আর প্রাপ্তিস্হান জানতে চান। আমার নিজের কাছে যদিও ‘নখদন্ত’ লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি নন-অ্যাকাডেমিক কলকাতাকেন্দ্রিক কফি-হাউস আলোচকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মিলনসাগর ডট কম-এ ‘জখম‘ সবচেয়ে বেশি হিট পেয়েছে। এই পাঠকরা কলকাতার বাইরের বলে অনুমান করা যায়, যাঁদের কাছে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা সম্পর্কে কিংবদন্তি পৌঁছোয়নি। তোমার যতটা মনে হচ্ছে আমি ততটা পরিচিত নই। কেননা ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটা আমি একশোজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে, যাঁরা কুড়ি বছরের বেশি পত্রিকা বের করছেন, ডাকযোগে পাঠিয়ে (বইটা তাই দু-টাকার স্ট্যাম্পযোগ্য করে ছাপানো হয়েছিল ), পরে টেলিফোনে ফিডব্যাক নিতে গিয়ে জানতে পারি যে অধিকাংশ সম্পাদক আমার নাম শোনেননি। এমনকি হাংরি আন্দোলনের নাম শোনেননি। অসহায় লাগেনি।

    অনুপম: ঠিক আছে মলয়দা। কিন্তু ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি আমেরিকায় জনপ্রিয়। হাংরি মামলা চলার সময়ে ওটার অনুবাদ ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস’ -এর দৌলতে আপনার কিছু অর্থাগম হয়েছিল, যা আপনার কিছু সুরাহা করেছিল। সেটা আমেরিকা থেকেই পাওয়া । এখনও আমেরিকা-প্রবাসী আর্যনীলের মুখে শুনতে পাই আপনি নাকি ওদেশে জনপ্রিয় বাঙালি কবি। মার্গারেট রেন্ডাল, ক্যারল বার্জ, জেরোম রোদেনবার্গ আপনার লেখা সংকলনবদ্ধ করেছেন, বই ছেপেছেন —- এসব নিয়ে আপনি কী ভাবেন? আমেরিকা কবিতার পীঠস্হান নয়, বাংলা কবিতার তো একেবারেই নয় । তবু — অন্য একটা দেশ —

    মলয় রায়চৌধুরী: আগের প্রশ্নটার উত্তরে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শুভঙ্কর দাশ দিনকতক আগে ‘আউটসাইডার রাইটার্স ডট অর্গ ‘ -এর জন্যে যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, তাতে বাঙালিদের কমেন্টগুলো এসেছে আমার ফিকশান নিয়ে, আর অবাঙালিদের কমেন্টগুলো ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষিতে আমার লেখার সামগ্রিক মূল্যায়ন। ডঃ কবিতা বাচকনভি লিখেছেন যে ভারতবর্ষে ষাটের আন্দোলনের দশকের পর উদয় হয়েছেন ‘বিকাউ’ বা বেচনদার লেখকেরা । আমার কবিতা বিদেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুয়েনস আয়ার্স থেকে স্প্যানিশ ভাষায়, ‘এল কর্নো এমপ্লুমাদো’ পত্রিকায় । প্রথম বই ‘শয়তানের মুখ’ এর প্রচ্ছদ ওঁরাই আঁকিয়ে দিয়েছিলেন মেক্সিকান চিত্রকর কার্লোস কোহিনকে দিয়ে ( স্প্যানিশ ভাষার উইকিপেডিয়ায় হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠা আছে) । সেই সূত্রে জার্মান সম্পাদক কার্ল ওয়েইসনার ( উইলিয়াম বারোজ-এর সাক্ষাৎকার সংকলক) ওঁর পত্রিকা ‘ক্ল্যাক্টোভিডসেডস্টিন’-এ প্রকাশ করেন। ইউনাইটেড স্টেটস-এর অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ( ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ) সুবিমল বসাক, দেবী রায় আর আমার সঙ্গে কলকাতায় এসে দেখা করার পর আমাদের রচনা আমেরিকায় প্রবেশপথ পেয়ে যায়। ইউনাইটেড স্টেটস-এ বেশি করে নজরে পড়ার কারণ সম্ভবত ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংগ্রহশালার কারণে; আমাদের পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, ফোটোগ্রাফ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি সংরক্ষিত হয়েছে, আবং তা গুগলে স্হান পেয়েছে । ফরাসি ভাষার গুগল সার্চ করলে প্রদীপ চৌধুরীকে বহু পৃষ্ঠায় পাবে। তখন যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁরা অনেকে পরে বেশ প্রতিষ্ঠিত, এবং আমার লেখা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাণিজ্যিক বাঙালি কবিদের প্রচার আমেরিকায় ভালোই । ডেবোরা কার অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে যে বইটা লিখেছেন তা পড়লে টের পাওয়া যাবে । আমার মামলার জন্য নিউ ইয়র্কের সেন্ট মার্কস চার্চে আমার ও অন্যান্যদের কবিতা পাঠ করে টাকা তোলার আয়োজন করেছিলেন ক্যারল বার্জ,; হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড-ও বই প্রকাশ করে হাই কোর্টের খরচ তুলে দিয়েছিলেন। হাইকোর্টে আমার কেস লড়েছিলেন চারজন অ্যাডভোকেট, তখনকার বিখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার মৃগেন সেনের নেতৃত্বে। মৃগেন সেনের ফিজ আমার তখনকার মাইনের একশোগুণ ছিল। ‘ছোটলোকের ছোটবেলা’-র ইংরেজি অনুবাদের প্রস্তাব পেয়েছি। দেখা যাক।

    অনুপম: মলয়দা, “বিকাউ বা বেচনদার লেখক” ব্যাপারটা একটু বলুন। ধরুন গার্সিয়া মার্কেজ বা সলমান রুশডি, এঁরাও তো বিক্রির ব্যাপারে উদাসীন নন। রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমও কি বিমুখ ছিলেন ? কে চায় না তার বই বিক্রি হোক, লোকে পড়ুক ? পাঠকের কাছে একটু স্পষ্ট করুন ব্যাপারটা।

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার মনে হয় আয়ারাম-গয়ারাম অভিব্যক্তি দিয়ে বিকাউ প্রক্রিয়াটা বোঝানো যায় । রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমের সময় বাজার ছিল না। ওঁরা বিনামূল্যে বই বিলি করতেন, ডাকযোগে পাঠকদের পাঠাতেন; তার জন্যে ওঁদের সেক্রেটারিরা ছিলেন। মার্কেজ, বর্হেস , রুশডি প্রমুখ লেখকদের আয়ারাম-গয়ারাম বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষেত্রে বিশেষ করে ( বংলাদেশে নয় ), এবং সাধারণভাবে হিন্দি, তামিল, তেলুগু ইত্যাদি ভাষা-সাহিত্যের জায়গাতে বিগ বিজনেস ও রাজনৈতিক-সরকারি খেলার ফলে আয়ারাম-গয়ারাম বাজারের উৎপত্তি হয়েছে। প্রকাশনা ব্যবসাটা আমাদের এখানে ( কলকাতায় ) তিরিশের দশকের পর সেভাবে কাজ করে না যেভাবে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ভাষায়। এখানে প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার কারিকুরির কারণে আউটস্ট্যান্ডিং লেখালিখিটা আয়ারাম-গয়ারামদের ঢাক-ঢোল দিয়ে চাপা পড়ে যায় । আয়ারাম-গয়ারাম লেখকদের রচনা তো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়, কিন্তু কই, এখনও কেউই এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকায় সাড়া ফেলতে পারেননি, যেমনটা ফেলেছেন অরুন্ধতী রায় বা অরুণ কোলাটকার। আয়ারাম-গয়ারাম স্টক এক্সচেঞ্জ না থাকলে মহাশ্বেতা দেবীও বিশ্বব্যাপী ওপেনিং পেতেন ।

    অনুপম: এই প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করার খেলা কি আপনার সঙ্গেও হয়েছে মনে করেন? আপনার প্রথম বই ‘শয়তানের মুখ’ তো বেরোল ‘কৃত্তিবাস প্রকাশনী’ থেকে ১৯৬৩ সালে। আপনার প্রথম বইয়ের প্রকাশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । উনি আপনার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বন্ধু । আর সুনীলের সাক্ষই তো আপনাকে হাংরি মামলায় কারাবাস থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই না ?

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার প্রথম বই ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ , তার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিৎ দত্ত ( কবি অজিত দত্তের ছেলে ) লোয়ার কোর্টে আমার পক্ষে সাক্ষ দিয়েছিলেন । লোয়ার কোর্টে (ব্যাংকশাল কোর্ট ) আমার একমাসের জেল অনাদায়ে ম্যাক্সিমাম নির্ধারিত জরিমানার আদেশ হয়েছিল। সাক্ষগুলো আমাকে বাঁচাতে পারেনি। আমার দণ্ডাদেশ খারিজ হয় হাইকোর্টে আপিল করার ফলে, তখনকার নামকরা ক্রিমিনাল ল-ইয়ারের যুক্তি-তর্কের কারণে । তবে আমি ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে তরুণ সান্যালের প্রতি যিনি কম্যুনিষ্ট পার্টির নিষেধ সত্বেও আমার পক্ষে সাক্ষ দিয়েছিলেন। সুনীল তখন এই সুনীল ছিলেন না; ‘অরণ্যের দিনরাত্রি‘-র সুনীল ছিলেন। ওটা চাইবাসাভিত্তিক কাহিনি, দাদা তখন চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন। সুনীল সাক্ষ দিয়েছিলেন দাদার অনুরোধে, বন্ধুত্বের খাতিরে, যা উনি লিখেওছেন। তবে ওঁর ‘অর্ধেক জীবন’ পড়লে জানা যায় যে শতাধিকবার দাদার বিভিন্ন চাকুরিস্হলে আতিথ্য নেয়া সত্বেও দাদার সঙ্গে পরিচয়টা উনি লুকোতে পছন্দ করেন। শক্তি চট্টোপাধয়ায় আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ দিয়েছিলেন, তবু উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন; কোনো একটি পত্রিকায় একবার আমার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হলে উনি সঙ্গে-সঙ্গে আমার খোঁজ নিতে এসেছিলেন। না, আমাকে কোনো রুদ্ধ দরজার সামনে থাক্কা খেতে হয়নি ।আমি চেষ্টা করিনি; ওমুখো হইনি কখনও । সম্ভবত লেখালিখি মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলুম বলেই।

    অনুপম: কেন এই ছেড়ে দেওয়া , আর কেন তারপরও আবার ফিরে আসা ?

    মলয় রায়চৌধুরী: মনীশ ঘটককে জিগ্যেস করেছিলুম, “কেন লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন ?” উনি বলেছিলেন, “মাথায় আসে কিন্তু হাত অব্দি আসে না।” একই প্রশ্ন সমর সেনকে করেছিলুম। উনি শুধু মোনালিসা হাসি দিয়ে যা বলার বলেছিলেন। আমার ক্ষেত্রে লেখার ব্যাপারটা আমায় দুম করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, যাকে বলে ‘রাইটার্স ব্লক’ । ফিরে এসেছিল আমার মা মারা যাওয়ার পরদিন থেকে , লখনউতে, যেখানে আমার চেয়ে উনিশ বছরের ছোট এক অবাঙালি তরুণী আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ওই সময় ঢাকায় প্রকাশের আহ্বান পেয়ে যাই একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন থেকে। ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর‘-এর অধিকাংশ কবিতা ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত। গদ্য লেখার জন্যে জোরাজুরি করতে থেকেন , ইন্সটিগেট করতে থাকেন, ‘কৌরব’ পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তী ।

    অনুপম: মলয়দা, বলা কি যায় যে লেখালিখির অক্সিজেন আপনি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেই বেশি পেয়েছেন ? আমেরিকা… বাংলাদেশ… জামশেদপুর… আপনাকে কি বাঙালি কবি সেই অর্থে বলা যায় ?

    মলয় রায়চৌধুরী: প্ল্যাটফর্মগুলো বাইরের তো বটেই। তুমি আমার বাল্যের ফিরে-দেখা গদ্যগুলো পড়েছ কিনা জানি না… সেখানে উত্তরপাড়া (আদিনিবাস ), পাণিহাটি ( মামারবাড়ি ), কোন্নোগর (বড়োঠাকুমার বাড়ি ), আহিরিটোলা (পিসিমার বাড়ি, বিখ্যাত সেন্টুদার আস্তানা ), বড়িশা-বেহালা ( সাবর্ণ জেঠু-কাকুর বাড়ি) ইত্যাদি আত্মীয়স্বজনদের গভীর প্রভাব নিয়ে কথাবার্তা আছে । এই রচনাগুলো পাঠকদের কাছে পৌঁছোয় না , কেননা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশকরা সীমিত সংখ্যায় ছাপেন। ওইসব রচনাগুলো আমার কবিতার জন্যে পড়ে রাখলে ভালো হয়। আমি তো পূর্ববঙ্গ থেকে এসে বলছি না যে আমি পশ্চিমবঙ্গের। পূর্ববঙ্গ থেকে ধর্ম বাঁচাবার ভয়ে পালিয়ে এসে যদি পশ্চিমবঙ্গের কবি হওয়া যায়, তাহলে উত্তরপাড়ার লোক হয়ে হওয়া যাবে না-ই বা কেন!

    অনুপম: আচ্ছা , আপনার আ্ত্মজীবনীমূলক বইয়ের নাম ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ । শুভঙ্কর দাশ যে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেখানে আপনি ঘোষিত হয়েছেন ‘কালচারাল বাস্টার্ড’ বা সাংস্কৃতিক জারজ । অথচ আপনি সন্মানিত পিতার সন্তান। সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর । আপনার মাতামহ কিশোরীমোহনের নামে পাণিহাটিতে রাস্তা আছে । পাটনার কনভেন্টে পড়াশোনা করেছেন। পরে উচ্চপদে চাকুরি করেছেন। সবদিক থেকেই আপনি সামাজিক, সুরক্ষিত এবং মর্যাদাবান। তাহলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেকে ছোটলোক, জারজ, বহিরাগত, বিহারি বাঙালি — এসব বলার কারণ কী?

    মলয় রায়চৌধুরী: সাহিত্যের আঙিনায় নয়; জীবনের আঙিনায় । লেখালিখিটা জীবনের একটা মাত্রা মাত্র । জীবন আরও ব্যাপক, রহস্যময়, ব্যাখ্যাহীন, এলোমেলো, খাপছাড়া, বহুত্বময়, সর্বগ্রাসী। জীবনের সবকিছু লেখা হয়ে ওঠে না, ওঠেনি, উঠবে কিনা জানি না।

    অনুপম: তাহলে আরেকটা প্রশ্ন । যিনি স্বভাবকবি নন, হাংরি পর্বে তিনিই কবিতার অ্যাডিক্ট কী করে হলেন, কবিতাকে মাদক জ্ঞান করে বসলেন ? আর এখন নেটিজেন সেই কবি মগজের রসায়নকে কমপিউটারের কি-বোর্ডে নামাতে পারছেন না কেন ?

    মলয় রায়চৌধুরী: তুমি কি অ্যাডিকশান সম্পর্কে জানো? সাইকোট্রপিক ড্রাগস নিয়েছ কি? স্বভাবকবিত্ব ড্রাগ অ্যাডিকশানের বিপরীত জগতের প্রক্রিয়া, যা মূলত মানসিক। অ্যাডিকশানটা শারীরিক, মানসিক এমনকি সামাজিক। আমি জেনে-বুঝে ‘অ্যাডিকশান’ শব্দটা প্রয়োগ করলুম, কেননা ‘নেশা’ শব্দ দিয়ে সাইকোট্রপিক ড্রাগ অ্যাডিকশান ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর ‘মাদক’ শব্দটা দিয়ে ড্রাগকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ষাটের দশকে সাইকোট্রপিক ড্রাগ আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ওটা হল আশির দশকের পর। এখন আমার কোনো অ্যাডিকশান নেই; কেবল একা বসে মদ খাবার রুটিন আছে প্রতি সন্ধ্যায়। অনেকের সঙ্গে বসে আমি মদ খেতে পারি না, আমার একাকীত্ব নষ্ট হয়।

    অনুপম: মলয়দা, বলুন তো ‘বিস্ময়’ শব্দটা আপনার কাছে কী ? চিরকাল এবং এখন ?

    মলয় রায়চৌধুরী: বিস্ময় শব্দের প্রতিশব্দ ‘সারপ্রাইজ’ নয়। ‘সারপ্রাইজ’ বলতে আশ্চর্য হওয়া বুঝব । অনেক-কিছু আশ্চর্য লাগে বা তাতে সারপ্রাইজড হই, কিন্তু তা বিস্ময়ের নয়। আশ্চর্য হওয়াটা তাৎক্ষণিক। বিস্ময় শব্দের ইংরেজি নেই বোধহয়। অন্তত এখনই মনে পড়ছে না। ‘ডিকশানারি অব ফিলজফি’ দেখে বলতে পারব। বিস্ময় ব্যাপারটা লেখালিখির জ্ঞানজটিল, জীবনব্যাপী, একাকীত্বের প্রশ্ন-উন্মীলক। চুপচাপ বসে এই জিনিসটার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত জরুরি। জীবনকে সতত প্রশ্নমুখী করে রাখার জন্যে জরুরি।

    অনুপম: ‘মলয় রায়চৌধুরী’ কি খুব একা একটা লোকের নাম, মলয়দা ? এই মুহূর্তে ?

    মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ।

    অনুপম: এই একাকীত্ব কি আপনার অর্জন, না একাকীত্বই বেছে নিয়েছে আপনাকে ?

    মলয় রায়চৌধুরী: হয়তো বয়সের জন্যে। ঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। যদি গ্রামাঞ্চলে থাকতুম তাহলে এটা নাও হতে পারত। এই একাকীত্ব কোনো কবিত্বের ব্যাপার নয়; এটা আমি রেলিশ করি। বোদলেয়ারের এনুই-এর সঙ্গে বা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী একাকীত্বের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে।

    অনুপম: এখন পিছন ফিরে তাকালে ষাটের দশকের হাংরি মলয়কে চিনতে পারেন ? যে-মলয় সমাজের গণ্যমান্য লোকেদের মুখোশ পাঠিয়ে মুখোশ খুলে ফেলতে বলতেন…. জুতোর বাক্স রিভিউ করার জন্যে পাঠাতেন…. পুলিশের ভয়ে বেনারসে গঙ্গাবক্ষে লুকিয়ে থেকেছেন…. এখন এই আচরণগুলো সমর্থন করেন ?

    মলয় রায়চৌধুরী: পুলিশের ভয়ে গঙ্গায় কেউই লুকোইনি। হিপিদের সঙ্গে গঙ্গার তীরে কেউ-কেউ অবারিত যৌন-জীবন কাটিয়েছেন। ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা‘ পড়েছ কি? বেনারস ছিল সাইকোট্রপিক ড্রাগস এবং হিপিদের জমায়েত । পুলিশ এড়াতে কেবল সুবো আচার্য বিষ্ণুপুরে এবং প্রদীপ চৌধুরী ত্রিপুরায় চলে গিয়েছিলেন, যেখানে ওঁদের বাপের বাড়ি। পুলিশ তবু ত্রিপুরা গিয়ে প্রদীপকে গ্রেপ্তার করেছিল। পেছন ফিরলে কেবল সেই ষাটের মলয় নয়, বহু মলয়কে মেলানো দুষ্কর হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ছাত্রজীবন, যা তুমি তিন কিস্তিতে প্রকাশিত ‘অভিমুখের উপজীব্য’ লেখায় পাবে। পরে লখনউতে আমার অধস্তন তরুণ-তরুণী আধিকারিকদের সঙ্গে ( বোধহয় প্রথম জেন এক্স ) লাগামহীন-বাঁধনছেঁড়া হুল্লোড়ের জীবন; তারপর আটের দশকে সারা ভারত ট্যুর করতে থাকাকালে নতুন ও অপরিচিত জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়ার জীবন। এই সত্তর বছর বয়সে সবই অচেনা ঠেকে, মেলানো কঠিন মনে হয়। যদি রোজনামচা লেখার অভ্যাস থাকত তাহলে তবু মেলাতে পারতুম। রোজনামচা কিছুদিন লিখেছিলুম, কিন্তু জ্বালিয়ে নষ্ট করে ফেলি।

    অনুপম: আর যৌনতা ? যৌনতা আপনার কাছে কী ? নাকি কামপ্রবৃত্তি বলব ?

    মলয় রায়চৌধুরী: যৌনতা শব্দটার ইংরেজি তো সেক্সুয়ালিটি। তুমি জানতে চাইছ সেক্স আমার জীবনে এবং দৃষ্টিতে কী ? কারেক্ট ? সেক্স আমার জীবনে সবাইয়ের মতন বয়ঃসন্ধিতে ঔৎসুক্য দিয়ে শুরু, কিন্তু নিম্নবর্গের বিহারি সমাজে থাকার কারণে, ইমলিতলা পাড়ায়, তা খুল্লম-খুল্লা বিপর্যস্ত করেছিল। দোলখেলার একদিনের নিষেধহীনতা, ওই সময়ে বয়ঃসন্ধিকালে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ইমলিতলার মেয়েরা, বাঙালিরা যেসমস্ত শব্দকে অশ্লীল মনে করে, সেই শব্দাবলী সহযোগে যাচ্ছেতাই করত। তখন থেকেই সেক্স আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই হিসাবে যে তা অভিমুখ নির্ণয় করে দিয়েছে। পশি-পাখিদের হীট-পিরিয়ড হয়; মানুষের এমন হলে বাকি সময়টা সে তার যৌবন নিয়ে কী করত ? যৌনতা আমার কাছে, আমাদের সংরক্ষণশীল পরিবারে, সীমালঙ্ঘনের, বন্ধন কেটে বেরোবার, হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। আমি ক্যাসানোভা ছিলুম না, কিন্তু প্রেম-সম্পর্কের বাইরে, সমান্তরালভাবে, যৌনসম্পর্ক গড়ে ফেলতে আমার ভালোই লেগেছে। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি যে, বয়ঃসন্ধিতে সেক্স ছিল মগজ আর শরীরের মিশেল-দেওয়া একমাত্রিক তপ্ততা। যত বয়স বেড়েছে, ততই তা ক্রমশ মগজের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। যৌবনে মুখহীন নারীশরীর ভাবতে পারতুম। যত বয়স বেড়েছে, নারীশরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পৃথক-পৃথক ডাক দিয়েছে। একটা কথা, বিহারে হোমোসেক্সুয়ালিটি ছাত্রদের মধ্যে চালু ছিল । হোমোসেক্সুয়ালিটি, কেন কে জানে, আমার স্ট্রেঞ্জ এবং বিসদৃশ মনে হয়েছে। হল্যান্ডে, অ্যামস্টারডামে, গে আর লেসবিয়ানদের বিরাট জমায়েত হয় প্রতি সন্ধ্যায়। জমায়েতের যুবতীগুলোকে দেখে আকৃষ্ট হতুম, তারা জোড়ায়-জোড়ায় চুমু খাওয়াখায়ি করতে থাকলেও। ওখানের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট অ্যামস্টারডামের বেশ্যা পাড়ায় কনডাক্টেড ট্যুর করায়; সব যৌনকর্মী ছ’ফিটের বেশি লম্বা।

    অনুপম: বৌদি এসব জানেন? হাংরি মলয় কি কখনও নিজের চোখে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন ?

    মলয় রায়চৌধুরী: ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ এবং আমার কবিতার বিশেষ ধারা, লেখালিখি নিয়ে কোর্টকাছারি, জাল-জরিমানা, হাংরি আন্দোন, এসব জানে; যৌবনের ঘটনা কিছু-কিছু জানে। তবে সাহিত্যকে অনর্থক সময় নষ্ট মনে করে। সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ নেই, যদিও আমার সঙ্গে বিদেশি বা এখানকার কবিলেখকরা দেখা করতে এলে ওর ভালো লাগে, পত্র-পত্রিকায় এবং ইনটারনেটে ফোটো বেরোলে আনন্দিত হয়। আমার মেয়ে অক্সফোর্ড ওপন ইউনিভারসিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ছাত্রী হওয়ার পর যৎসামান্য আগ্রহ হয়েছিল। দাদা ছাড়া আমাদের পরিবারের আর কেউ সাহিত্যে আগ্রহান্বিত নন। ব্যাংকশাল কোর্টে মামলা চলার সময়ে আমার বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসেমশায় কেউ না কেউ ডেট পড়লে আসতেন। অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিবার থেকে কেউ আসতেন না। তা সাহিত্যের জন্যে নয়। আমাদের বাড়িতে প্রতি প্রজন্মে এক-দুজন পুলিশের মামলায় পড়েছে, তাই এই ঘটনাটা আমার প্রজন্মের প্রাপ্তি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়ে ওঁরা বলেছিলেন, “এধরণের কঠিন-কঠিন পদ্যর কোনো মানে হয় না।” ‘স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাশ’ কবিতাটা ইন্টারনেটে আমার ছেলে পোস্ট করেছিল। আমি তখনও কমপিউটারে টাইপ করতে জানতুম না।

    অনুপম: মলয়দা, তাহলে কি খুব দোষ দেওয়া যায়, যখন সাধারণ বাঙালি ভেবে বসেন যে, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি একজন অসুস্হমনা যুবকের যৌনবিকৃতির ফসল ? তা-ও সেই ষাটের দশকে ? যৌনতার নতুন রূপকথা টেরি করতে চেয়েছিলেন কি ?

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার জ্যাঠা, বাবা, কাকা, মা এমনকি ঠাকুমারও মনে হয়নি যে কবিতাটি নীতিভ্রষ্ট মগজের ফলাফল; ওঁরা কেবল সহজ করে লেখার উপদেশ দিতেন। ‘জখম’ ওই সহজ করে লেখার প্রয়াস। কোনো সাধারণ পাঠক এমন অভিযোগ তো কখনও করেননি, এমনকি অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং শীতল চৌধুরীও করেননি। আনন্দ বাগচী ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি ওঁর সম্পাদিত ‘প্রথম সাড়া জাগানো কবিতা’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন । অভিযোগটা করেছেন অ-সাধারণ পাঠকরা, যাঁরা নিজেরাও কবিযশোপ্রার্থী এবং যাঁরা কলকাত্তাইয়া সাহিত্যের মালিকানা দাবি করতেন। এখন একুশ শতকে পোঁছে ওই অভিযোগকারীরা, যাঁরা বেঁচে আছেন, নিজেরাই টের পাচ্ছেন যে তাঁরা সময় থেকে কত পিছিয়ে ছিলেন। আমি কোনো পাঠককেই দোষ দেব না, কেননা আমি তো জোর-জবরদস্তি পড়তে বাধ্য করছি না। যাঁর যেমন ইচ্ছা তিনি তেমন ভাববেন। কবিতা লিখতে বসে সেক্সকে এইভাবে ব্যবহার করব, ওইভাবে প্রয়োগ করব, এমনটা কখনও ভাবিনি। সেসব ভেবেছি গল্প-উপন্যাস লেখার সময়। কবিতায় সেক্স এসেছে ইমলিতলা পাড়ায় থাকার কারণে । ইমলিতলায় সেক্স জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক উপাদান ছিল। ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ে পড়ে থাকবে যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে যে কুয়ো ছিল সেখানে পাড়ার বউরা বিয়ের অতিঅশ্লীল গান গাইবার জন্যে দল বেঁধে জড়ো হতেন। সেক্সের নতুন রূপকথা তৈরি হয়ে থাকলে তা ওই দলিত মহিলাদের সাংস্কৃতিক অবদান। ভোজপুরি-মঘাই-পাটনাইয়া বুলিতে বহু সিডি আছে এই সব গানের।

    অনুপম: তাহলে কি আপনার কবিতায় সেক্স যখন এসেছে, প্রকৃত কাম-তাড়না থেকেই এসেছে ? হাংরি মলয় তাহলে ঠিক কতটা সেক্সুয়ালি হাংরি, আর কতটা সামাজিকভাবে ক্রুদ্ধ ? দুটিকে আলাদা করা কি খুব সহজ ?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর বুড়ো বয়সে দেওয়া কঠিন, কেননা এখন যৌনতার বোধ মস্তিষ্ক-নির্ভর হয়ে গিয়েছে। হাংরি আন্দোলনের সময় ছিলুম টাটকা যুবক। আত্মমৈথুন কাকে বলে সেটাই শরীরের পক্ষে স্মরণ করা কঠিন। তোমার প্রশ্নের উত্তরটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিতে চাইব। এখন তো আর সেক্স সম্পর্কে সেরকম ভাবনা নেই; সামাজিকভাবে ক্রোধ অনেক বেশি এখন; এখন সমাজকর্তাদের ( রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক ) বিশ্বাসঘাতক, অপদার্থ, চোর, নেপোটিস্ট, পশ্চিমবঙ্গবিরোধী মনে করি।

    অনুপম: আরেকটা হাংরি আন্দোলন হচ্ছে না কেন ? কোনোকিছুই তো সেই অর্থে আজও বদলায়নি। নাকি আপনাদের তুলনায় আমাদের প্রজন্মটাই অনেক বদলে গেছে মনে হয় ?

    মলয় রায়চৌধুরী: হাংরির মতন আন্দোলন কেবল নয়, আর কোনো আন্দোলনই সম্ভব নয়। আমি শুধু বঙ্গসমাজের কথা বলছি না, সারা ভারতবর্ষের কথা বলছি। আমার ‘পোস্টমডার্ন কালখন্ড ও বাঙালির পতন‘ প্রবন্ধটা পড়েছ কিনা জানি না, কিংবা ‘উত্তরদার্শনিকতা‘ প্রবন্ধটা পড়েছ কি? আমরা উত্তরদার্শনিক কালখন্ডতে পোঁছেছি, মূলত প্রজুক্তির দ্রুতগামী রদবদলের কারণে। বিজ্ঞান আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করে চলেছে। এক দশকে যে রদবদল ঘটছে তা আগে এক শতক সময় নিয়ে ঘটত। ফলে রিডিফাইন হয়ে চলেছে ভাবনা-চিন্তার পরিসর। আই-পিল খেয়ে কি কোনো তরুনী প্রেমের কবিতা লিখতে পারতেন ? আই পিল বস্তুত প্রেমিকমুক্ত করে দিয়েছে একজন তরুণীকে। রেভ পার্টিতে কেবল এস এম এস পেয়ে হাজির হওয়া যায়, যেখানে অচেনার সঙ্গে সংসর্গই প্রধান লক্ষ: লেখকরা ‘এমবেডেড’ হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লেখার রসদ যোগাড় করে। দুমদাম বোমা ফেলে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ নামে হাজার-হাজার অসামরিক লোকেদের নিকেশ করা যায় । পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে-স্কুলে রুটলেস কমরেড টিচার পাঠিয়ে উন্নতির নামে গ্রামসমাজকে নষ্ট করা যায়। পূর্ববঙ্গ থেকে-আসা কমরেড নেতারা মন্ত্রী হয়ে এখানকার আদিবাসী-উপজাতিদের দিব্যি ভুলে থাকতে পারেন দশকের পর দশক, অথচ নিজেদের গুষ্টিদের ধোপদুরস্ত জীবনে তুলে ফেলেন। কত আর বলব? আমাদের প্রজন্মের তুলনায় সমস্ত-কিছু বদলে গেছে। আধুনিকতার তত্বগুলো অনুমান করতে পারেনি যে আসল চালক তো ব্যক্তি-মানুষ; মার্কসবাদ বা গান্ধিবাদ বা অন্য কোনো বাদ তো রাষ্ট্রকে চালায় না, চালায় ব্যক্তি-মানুষ। কৌমসমাজ তো ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, সেই ব্যক্তিটাই এখন ভিন্ন, সে চলে গেছে দার্শনিকতার ওই পারে, সেখানে আর কোনো আন্দোলন সম্ভব নয়।

    অনুপম: তাহলে আপনি নিজেকে অধিক সার্থক কোন পরিসরে মনে করেন — হাংরি না অধুনান্তিক ?

    মলয় রায়চৌধুরী: ‘সার্থক’ শব্দটা উনিশ শতকের ভাবুকদের অবদান। সেই সময়ের চিন্তাবিদরা ব্যক্তি-মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে বসিয়ে নানারকম স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখন জানা গেল ব্যক্তি-মানুষকে নিয়ে এমন সরলীকরণ করা যায় না; সে অনেক জটিল, কেননা তার আত্মপরিচয় বহুমাত্রিক, এলোমেলো এবং সে সতত, সারাজীবন নানা ফ্লাক্সের মধ্যে কাটায় । এখন আর উনিশ শতকের মতন ভাবুকও সম্ভব নয় । আমাদের চারিদিকে তাকালে নানা ক্ষেত্রের বহু ব্যক্তিকে দেখতে পাবে, যাদের নিয়ে মিডিয়ার এলাকায় হইচই হয়, কিন্তু তা কেবল বহুমাত্রিকতার একটা মাত্রা মাত্র । স্বাভাবিক যে আমিও নিজেকে কোনো পরিসরে ‘সার্থক’ মনে করি না। তুমি এই ‘সার্থক’, ‘সফল’ অভিধার প্রতি আকৃষ্ট কেন জানি না।

    অনুপম: অনুবাদক হিসাবে কোনো টেক্সটের প্রতি কখন আগ্রহ জন্মায় আপনার ? অনুবাদক হিসায়েই অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ? হাংরিদের কি ওটা নিতে নেই ?

    মলয় রায়চৌধুরী: উইলিয়াম ব্লেকের ‘ম্যারেজ অব হেভেন অ্যান্ড হেল‘ কবিতাটি এমন ফর্মহীন লেখা যে অবাক করার মতো; তখনকার কোনো সাহিত্যিক ও ধার্মিক প্রতিনিষেধ স্বীকার করেননি উনি। তাছাড়া বিষয়বস্তুকে যেমনভাবে ইচ্ছে ব্যাখ্যা করা যায়। স্নাতক স্তরে ব্লেক পাঠ্য ছিলেন, কিন্তু ইংরেজির বাঙালি অধ্যাপক এই কবিতাটির উল্লেখ করতেন না, অথচ ব্লেক সম্পর্কে যাবতীয় কাহিনি আমাদের শোনাতেন। আমি ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম বলে (বিদেশিনী নান-রা পড়াতেন, সংলগ্ন চার্চে প্রতি বৃহস্পতিবার বাইবেল ক্লাস হত ) কবিতাটি চার্চ-ক্লসের রহস্যে নিয়ে যেত। আমি কোনো সাহিত্যিক পুরস্কার নিই না। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পদকরাও পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন , এমনকি আমার বাড়িতেই অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছেন, সেসমস্ত পুরস্কার ও সন্মানও তো নিইনি, তাহলে সরকারি পুরস্কার নিতে যাব কেন ?

    অনুপম: স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে-আসা ছিন্নমূল মানুষগুলোর ওপর আপনার এতটা রাগ কেন, মলয়দা ? এই সাক্ষাৎকারেও সেটা ধরা পড়েছে। ওঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে পারেন না ?

    মলয় রায়চৌধুরী: আমার অভিযোগ সেই লোকগুলোর বিরুদ্ধে যাঁরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পাকিস্তান চেয়েছিলেন, অথচ যেই দেশভাগ হল, তাঁরাই সবচেয়ে আগে পালিয়ে এলেন ( অশোক মিত্র স্বীকার করেছেন )। তাঁদের অনেকেই সত্তর দশক থেকে এখানে মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে বসলেন, এবং পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক উন্নতির বদলে নিজেদের কাজ গোছাবার ধান্দাবাজি শুরু করলেন। গত তিরিশ বছরে তাঁরাই পশ্চিমবঙ্গকে ডুবিয়েছেন। তুমি বলছ এঁদের সাবঅলটার্ন ভাবতে! আদিবাসী-উপজাতিরা ক্রুদ্ধ কেন ? ওঁদের এই আত্মসেবাজনিত অবহেলার জন্যে। ওঁরা পালিয়ে এলেন কেন ? ধর্ম বাঁচাবার জন্যে। এখানে এসে কেউ নিরীশ্বরবাদী, কেউ ধর্মহীন, কারোর কাছে ধর্ম মানে আফিম, কেউ আবার সেকুলার। এই তর্কগুলোর উত্তর একটাই। তাহলে ইসলাম ধর্ম নিয়ে চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটিতে থেকে গেলেন না কেন ? ওঁদের কাছে তার মানে মূল ছিল ধর্ম; ভিটেমাটি নয়। আমি কোনো কিছু লুকোই না, খোলাখুলি বলি, অনেকে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় তা সীমিত রাখেন। আর আমি খোলাখুলি বলি বলে পশ্চিমবঙ্গীয় কবি-লেখকরা আমার সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলতে ইতস্তত করেন না।

    অনুপম: এখন এই অধুনান্তিক পর্বে আপনি বলছেন হাংরি আন্দোলন ছিল একটি প্রতিসন্দর্ভ । হাংরি তো ছিল আচরণ ও জীবনভিত্তিক একটি সাহিত্য আন্দোলন। ষাটের দশক কি কোনোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, হাংরি ছিল প্রতিসন্দর্ভ ?

    মলয় রায়চৌধুরী: সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মালিকদের সন্দর্ভের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল মানেই তো প্রতিসন্দর্ভ। তোমার হয়তো প্রতিসন্দর্ভ শব্দটা বিদ্যায়তনিক লাগছে। প্রতিসন্দর্ভ মানেই তো আর অধুনান্তিক নয়। ফরাসি বিপ্লব তো ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ডাডা আন্দোলন ছিল প্রতিসন্দর্ভ, ইয়ং বেঙ্গল ছিল প্রতিসন্দর্ভ। ওই বিপ্লবী — বিরোধী—সীমালঙ্ঘনকারীরা জানতেন কীসের এবং কাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, আচরণ ও আস্ফালন করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি, হাংরি আন্দোলনকারীরাও জানতেন। শাস্ত্রবিরোধীরা জানতেন, নিম সাহিত্যিকরা জানতেন।

    অনুপম: ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকা সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত আপনার ধারণা কী ? আপনার কি মনে হয় অধুনান্তিক চিন্তা-চেতনাকে বাংলা কবিতায় ব্যবহার করা গেছে ?

    মলয় রায়চৌধুরী: ‘কবিতা পাক্ষিক’ ফাস্ট বোলারের হাতের বলের মতন । ১৫০ কিমি প্রতি ঘন্টার বেগে হাত থেকে বেরিয়েছিল; পিচে পড়ে তা অন্য চেহারা নিল, পিচটার জন্যে। পাক্ষিক কবিতা পত্রিকার জন্যে প্রতিনিয়ত রসদ যোগাড় করা এবং তাকে নির্দিষ্ট স্তরে টিকিয়ে রাখা কঠিন। পাক্ষিক হবার ফলে কবিতা লেখকদের চাপকে বরদাস্ত করা কঠিন। কমার্শিয়াল পত্রিকা নিজেদের মালিকানা অনুযায়ী কবিতা ছাপে; জয় গোস্বামী চলে গেলে তাঁর ক্লোনদের কবিতা বেরোয়। লিটল ম্যাগাজিন, তা-ও বেশ কিছুকাল যাবৎ প্রকাশ হয়ে চলেছে, কবিযশোপ্রার্থীদের নিজস্ব প্রয়াসকে অস্বীকার করতে পারে না। সম্পাদক নিজে কবি হলে ব্যাপারটা আরও জটিল। বাংলা কবিতার আর কোনো সীমা নেই। এটাই তো অধুনান্তিকতার লক্ষণ।

    অনুপম: একজন অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে একজন মলয় রায়চৌধুরী কতটা মেলাতে পারেন নিজেকে ?

    মলয় রায়চৌধুরী: একেবারেই পারি না। অ্যালেন গিন্সবার্গ বিট আন্দোলনের সময়েও প্রচুর টাকার মালিক ছিলেন, পৃথিবীতে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতেন, যে বই ইচ্ছে কিনতে পারতেন। আমার তো প্রতিদিন উত্তরপাড়া থেকে কলকাতা যাওয়া, পাইস হোটেলে খাওয়া, নিজের জামা-কাপড় নিজে কাচা, এই সব ব্যাপারেই যথেষ্ট রেস্ত দরকার হত। পাটনা থেকে কলকাতা পৌঁছোতে হত জনতা এক্সপ্রেসের ভিড় ঠেলে । অ্যালেন তো দিব্বি ঝোলা খুলে ডলার বের করতেন। ওঁর বাবা এবং সৎমাও ধনী ছিলেন। আমি যেখানে পাটনাইয়া, উনি সেখানে নিউ ইয়র্কার । আমি কুড়ি জনের একান্নবর্তী পরিবারে আর উনি বাবা-মা আর ভাই। উনি প্রথম বিশ্বের, আমি তৃতীয় বিশ্বের। কলকাতার ষাটের কবি-লেখকদের সঙ্গেও কি মেলাতে পেরেছি নিজেকে ? পারিনি। ‘দি আদার’ বা অপর থেকে গেছি।

    অনুপম: ষাটের দশকের ক্ষুধার্ত বন্ধুদের সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে?

    মলয় রায়চৌধুরী: না।

    অনুপম: এখন কী ধরণের বইপত্র পড়ছেন? ২০০০ পরবর্তী বাংলা কবিতা পড়েন?

    মলয় রায়চৌধুরী: এক্ষুনি হাতে কোনো বই নেই, তাই কিছুই পড়ছি না। কলকাতায় থাকতে ডিসেম্বর ২০০৯-এ শেষ করেছি উইলিয়াম ড্যারিলিমপল-এর লেখা বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনী। ২০০০ পরবর্তী কবিতার বই কেউ পাঠিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। লিটল ম্যাগাজিনও বিশেষ পাই না। বাংলা ওয়েবসাইটগুলো দেখি। তুমি আর আর্যনীল (আমি জানতুম না ওর আসল নাম নীলাঞ্জন) নতুন পোস্টিং হলেই লিঙ্ক পাঠাও। কেউ-কেউ তাঁদের কবিতা ই-মেল করেন। বাংলাদেশি কবিরা ফেসবুকে ওঁদের লিংক পোস্ট করেন বা ট্যাগ করেন। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে পড়ার সুযোগ নেই। ২০০০ পরবর্তী কবিতা যে বাঁকবদল ঘটাতে চাইছে তা টের পাই, কিন্তু সম্পূর্ণ ছবিটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

    অনুপম: প্রাক-আধুনিক পরিসর থেকে আজ অব্দি দশজন কবির নাম যদি বলতে বলি ?

    মলয় রায়চৌধুরী: বলতে পারব না। প্রাগাধুনিক বললেই স্কুলপাঠ্য কবিদের নামগুলো বেশি করে মনে পড়ে। আধুনিক বললেই তিরিশের দশক মাথায় চলে আসে। মাঝের পর্বটা কী ? যেখানে রবীন্দ্রনাথ ?

    অনুপম: বলা কঠিন মলয়দা। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ একদিকে, আর বাংলা কবিতার বাকি সবকিছু আরেক দিকে, তাহলেও ওঁর দিকে পাল্লা ভারি থাকবে। ওঁর শক্তি-দুর্বলতা, সফলতা-বিফলতা সব মিলিয়ে উনি একাই ‘বাংলা কবিতা’। কারও সঙ্গে কোনো-কিছুর তুলনা হয় না। আপনার কী মনে হয় ? রবীন্দ্রনাথ আপনার চোখে কী ?

    মলয় রায়চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মধ্যবিত্তের অনস্বীকার্য সাংস্কৃতিক আইকন।

    অনুপম: মলয় রায়চৌধুরী কি কবিতা আর লিখবেন না ?

    মলয় রায়চৌধুরী: জানি না লিখব কি না। কবিতার লাইন মাথায় আসে, কেমন যেন লিরিকাল; ফলে কলম নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আঙুলের সমস্যার জন্যে কলম ধরতে হয় তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে, যা বেশ বিরক্তিকর।

    ( কবিসন্মিলন পত্রিকার শারদীয় ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত)

    [অনুপম মুখোপাধ্যায় একজন তরুণ কবি ও আলোচক । তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্হ আছে । তিনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় ইরেজি ভাষার শিক্ষক । ]

    {মলয় রায়চৌধুরীর ছোটোলোকের ছোটোবেলা বইটির প্রকাশক: চর্চাপদ পাবলিকেশন, ১৩বি রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা ৭০০ ০১২, ফোন : ০৩৩-২২৫৭-৩১৮৮, মোবাইল : ০৯৮৩০৩৭৯৮৪২}

    { মলয় রায়চৌধুরীর তিনটি উপন্যাস বইটির প্রকাশক: তেহাই পাবলিকেশান, এবি ২৯ অটল আবাস, দেশবন্ধুনগর, বাগুইআটি, কলকাতা ৭০০০৫৯, মোবাইল: ০৯৮৩১৫৭৯৮৮২ এবং ০৯০৫১৩৬৮৯০৬}

    {মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ২০০৪-১৯৬১ বইটির প্রকাশক : আবিষ্কার প্রকাশনী, ১২এ বাঁশদ্রোণীঘাট রোড, কলকাতা ৭০০০৭০, ফোন : ০৩৩-২৪১০-৫১৩২, মোবাইল: ০৯৮৩০৩৩১০৯২}

    নাগপুরে মলয় রায়চৌধুরী
    Posted in কবিসন্মেলন পত্রিকা| Tagged হাংরি আন্দোলন| 3 টি মন্তব্য
    তরুণ সান্যাল: হাংরি মকদ্দমায় সাক্ষ্য, ষাটের দশক
    Posted on সেপ্টেম্বর 2, 2010by কিছু লেখাপত্র

    পেশকার: নাম বলুন ।

    তরুণ : তরুণ কুমার সান্যাল ।

    পেশকার: বলুন, যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না ।

    তরুণ: যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না ।

    সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় (আসামী পক্ষের উকিল): তরুণবাবু, আপনি তো অধ্যাপনা করেন?

    তরুণ: আমি স্কটিশচার্চ কলেজে ইকনমিক্সের অধ্যাপক । এছাড়া আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে রাত্রি বিভাগে পার্টটাইম লেকচারার হিসাবে ইকনমিক্স ও সট্যাটিসটিক্স পড়াই । আমার লেখা অনেক টেক্সটবুক আছে । আমি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখি এবং সেগুলি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।

    সত্যেন: আপনি এই কবিতাটা পড়ুন । এটা মেটেরিয়াল একজিবিট ওয়ান, ইয়োর অনার ।

    তরুণ: জোরে-জোরে পড়ব কি?

    বিচারক অমল মিত্র: না, মনে-মনে পড়ুন । কবিতাটা কি আগে পড়েছেন?

    তরুণ: সমস্তটা না পড়লে ঠিক বলতে পারব না ।

    সত্যেন: পড়লেন?

    তরুণ: হ্যাঁ, মনে পড়েছে , আগে পড়েছিলাম । এই ইস্যুটা আমি প্রথম দেখি আমৃত কার্যালয়ে ।

    সত্যেন: পড়ে শারীরিক ও মানসিক কোনও বৈলক্ষণ ঘটছে কি?

    তরুণ: না । আমি তো আপনাদের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছি ।

    সত্যেন: পড়বার পর কোনও সাইকো-সোম্যাটিক পরিবর্তন অনুভব করছেন কি?

    তরুণ: সামান্যতম নয়।

    সত্যেন: কবিতাটি কি আপনার অশ্লীল মনে হল?

    তরুণ: অশ্লীল বলতে আপনি কি মনে করেন?

    সত্যেন: বাংলা ভাষায় অশ্লীল বলে একটা শব্দ আছে? এখন সেই শব্দটার যে অর্থ আপনি বোঝেন । আপনার সেই মতামত অনুযায়ী কবিতাটি অশ্লীল কি না ?

    তরুণ: আমার মতে কবিতাটিকে কোনো মতেই অশ্লীল বলা যেতে পারে না ।

    সত্যেন: দ্যাটস অল ইয়োর অনার ।

    সরকারি উকিল: আচ্ছা মিস্টার সান্যাল, এই যে আপনি জিগ্যেস করছিলেন অশ্লীলতা বলতে কি বোঝায়, তা এক্ষেত্রে অশ্লীলতা বলতে আপনি নিজে কি মনে করেন?

    তরুণ: আমার মতে অশ্লীলতা দুই ধরণের । প্রথম, যা ব্যক্তিক । এবং দ্বিতীয়, যা সমষ্টিগত বা সামাজিক । অশ্লীলতা ব্যক্তিবিশেষকে প্রভাবান্বিত করতে পারে, আবার এমন অশ্লীলতা আছে যা সমাজের ক্ষতি করতে পারে । যা কিছু চৈতন্যের অপনয়ন ঘটায়, তাকেই আমি মূলত অশ্লীল বলে মনে করব । যদি ব্যক্তি চৈতন্যের অপনয়ন ঘটে…..

    বিচারক অমল মিত্র: ওয়েল প্রফেসর ইউ বেটার স্পিক ইন ইংলিশ । দিস বেঙ্গলি সিমস টু বি টু হার্ড ফর দি কোর্ট ।

    তরুণ: থ্যাংক ইউ মি লর্দ । আমি আরও সহজ বাংলায় বলার চেষ্টা করছি ।

    বিচারক অমল মিত্র: ইংরেজিতেই বলুন, তাতে আমাদের সুবিধে হবে ।

    তরুণ: টু মি অবসিন মিনস সামথিং হুইচ কজেজ মেন্টাল ডিপ্র্যাভিটি টু অ্যান ইনডিভিজুয়াল । হোয়েন সামথিং বিকামস দি কজ অব ডিপ্রেভিং দি সোসাইটি আই উড কনসিডার দ্যাট টু বি অবসিন ।

    বিচারক অমল মিত্র: হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সোসাইটি ইনদিস প্রিটেকস্ট ? ডু ইউ মিন এ গ্রুপ অব পার্সনস ?

    তরুণ: ইয়েস একজ্যাক্টলি মি লর্ড।

    বিচারক অমল মিত্র: ইফ ইউ ফাইন্ড এনি অব ইয়োর পিউপিলস ইন দি কলেজ রিডিং এ পোয়েম অব দিস সর্ট হোয়াট উড ইউ ডু?

    তরুণ: আই ওন্ট মাইন্ড ।

    বিচারক অমল মিত্র: হোয়াট উড বি দি এফেক্ট অব দিস পোয়েম অন এ ম্যান ওন দি স্ট্রিট?

    তরুণ: আই ডোন্ট ফাইন্ড এনি ডিফারেন্স ।

    বিচারক অমল মিত্র: ডু ইউ মিন টু সে দিস পোয়েম উড হ্যাভ দি সেম এফেক্ট অন এ ম্যান অন দি স্ট্রিট এন্ড এ স্টুডেন্ট অব থ্রি ইয়ার্স ডিগ্রি কোর্স?

    তরুণ: ইয়েস আই থিংক সো । হি উড হ্যাভ দি প্লেজার অব রিডিং এ পিস অব আর্ট ।

    সরকারী উকিল: আপনি নিজেও কি এরকম কবিতা লেখেন?

    তরুণ: নিশ্চই না । এক্সকিউজ মি, এই পয়েন্টটা আমি একটু পরিষ্কারভাবে বলতে চাই ।

    সরকারী উকিল: ডাজন্ট ম্যাটার । ওতেই হবে। আপনি কি এরকম কবিতা আরও পড়েছেন?

    তরুণ: আমেরিকায় একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন, যিনি এইভাবে কবিতা লিখতেন । তাঁর নাম হুইটম্যান ।

    সরকারী উকিল: আমরা বিদেশের কথা জানতে চাই না । আপনি হাংরি জেনারেশানে কখনও কনট্রিবিউট করেছেন?

    তরুণ: না ।

    সরকারী উকিল: তাহলে সাবস্ক্রাইব করেছেন?

    তরুণ: কখনই না ।

    সরকারী উকিল: দ্যাটস অল ।

    (হাওয়া ৪৯ পত্রিকার বৈশাখ ২০০১ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত )
    Posted in হাংরি আন্দোলন| Tagged হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য
    Posted on সেপ্টেম্বর 1, 2010by কিছু লেখাপত্র

    Hungryalists in Sixties

    পেশকার: এই নিন, গীতার ওপর হাত রাখুন । বলুন, যা বলব ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না , কিছু গোপন করব না ।

    শক্তি: যা বলব ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না ।

    পেশকার: নাম বলুন ।

    শক্তি: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।

    বিচারক অমল মিত্র: কী কাজ করেন তাই বলুন । হোয়াট ইজ ইয়োর লাইভলিহুড?

    শক্তি: লেখালিখিই করি । এটাই জীবিকা ।

    সরকারি উকিল: আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, আপনি তো একজন বি. এ?

    শক্তি: হ্যাঁ, পরীক্ষা দিয়েছিলাম।

    বিচারক অমল মিত্র: আপনি বি.এ. কি না তাই বলুন । আপনি কি স্নাতক?

    শক্তি: আজ্ঞে না ।

    সরকারি উকিল: আপনি তো প্রথম থেকে হাংরি জেনারেশানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই না ?

    শক্তি: ছিলাম ।

    সরকারি উকিল: কী ভাবে ছিলেন সেটা ইয়োর অনারকে বুঝিয়ে বলুন তো ।

    শক্তি: সমীরের ছোট ভাই মলয় ইংরেজ কবি চসার আর জার্মান ফোলিজফার অসওয়াল্ড স্পেংলারের আইডিয়া থেকে একটা নন্দনতত্ব দিয়েছিল । সেই আইডিয়া ফলো করে আমরা কয়েকজন মিলে আন্দোলনটা আরম্ভ করি ।

    সরকারি উকিল: আসামী মলয় রায়চৌধুরীকে তাহলে চেনেন ? কবে থেকে চেনেন?

    শক্তি: হ্যাঁ চিনি । অনেক কাল থেকে ।

    সরকারি উকিল: কী ভাবে জানাশোনা হল?

    শক্তি: ওর বড় ভাই সমীর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । সমীরের চাইবাসার বাড়িতে থাকার সময়ে আমি প্রচুর লিখতাম । সেই সূত্রে মলয়ের সঙ্গে ওদের পাটনার বাড়িতে পরিচয় ।

    সরকারি উকিল: কারা-কারা এই হাংরি জেনারেশান আন্দোলন আরম্ভ করেন?

    শক্তি: মলয় রাবচৌধুরী, ওর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী, হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু আর আমি । ছাপাটাপার খরচ প্রথম থেকে ওরা দু-ভাইই দিয়েছে । পরে আরও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন । তাঁদের নাম বলব কী?

    সরকারি উকিল: তা আপনি যখন পায়োনিয়ারদের একজন, তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না কেন?

    শক্তি: এমনিই । এখন আমার লেখার কাজ অনেক বেড়ে গেছে ।

    বিচারক অমল মিত্র: ইউ মিন দেয়ার ওয়াজ এ ক্ল্যাশ অব ওপিনিয়ন? নট ক্ল্যাশ অব ইগো আই সাপোজ?

    শক্তি: আজ্ঞে হ্যাঁ । তাছাড়া এখন আর সময় পাই না ।

    সরকারি উকিল: কতদিন হল আপনি হাংরি জেনারেশানের সঙ্গে যুক্ত নন?

    শক্তি: প্রায় দেড় বছর ।

    সরকারি উকিল: দেখুন তো, হাংরি জেনারেশানের এই সংখ্যাটা পড়েছেন কি না ?

    শক্তি: পড়েছি । কবিতা পেলেই পড়ি।

    সরকারি উকিল: ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়েছেন কি?

    শক্তি: হ্যাঁ । কবিতাটা আমি পড়েছি ।

    সরকারি উকিল: পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?

    শক্তি: ভালো লাগেনি ।

    সরকারি উকিল: ভালো লাগেনি বলতে আপনি অবসিন…..

    আসামী পক্ষের উকিল: আই অবজেক্ট তু ইট ইয়োর অনার । হি কান্ট আস্ক লিডিং কোয়েশ্চেন্স ইন সাচ এ ওয়ে ।

    সরকারি উকিল: ওয়েল, আই অ্যাম রিফ্রেজিং দি কোয়েশ্চেন । আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, ভালো লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?

    শক্তি: ভালো লাগেনি মানে জাস্ট ভালো লাগেনি । কোনো-কোনো কবিতা পড়তে ভালো লাগে, আবার কোনো-কোনো কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগে না ।

    বিচারক অমল মিত্র: সো দি ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন ওয়াজ বেসড অন লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস । হেয়ার ইউ মিন দি পোয়েম ডিডন্ট অ্যাপিল টু ইয়োর ইসথেটিক সেনসেস ? শক্তি: ইয়েস স্যার ।

    সরকারি উকিল: দ্যাটস অল ।

    আসামী পক্ষের উকিল: ক্রসিং হবে না ।
    Posted in হাংরি আন্দোলন| Tagged হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    সুদীপ ঘোষ নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অগাষ্ট 30, 2010by কিছু লেখাপত্র

    সুদীপ : দর্শনই হোক বা সাহিত্য, যেহেতু দুটোই এক সমানুপাতিক বোধ, তাই আপনার জীবনের এই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি এ-রকমটি বলি যা নিম্নে প্রদত্ত হয়েছে, তাহলে আপনি এর কোন বাক্যটি সমর্থন করবেন আপনার বোধ দ্বারা (আমরা যেহেতু কোনো সময়েই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি না আমাদের চিন্তাভাবনায় ) ? বাক্য দুটি হল—

    ক)মরে অমর হও ।

    খ) আমি আমার মৃত্যুর পর অমরতা চাই না ।

    মলয়: লেখকরা কি অমর হন? যে-বাঙালিদের আমরা স্মরণ করি তাঁরা কেবল লেখক ছিলেন না, তা সে লালন, রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিম যেই হোন । অমরত্ব মানে তো আর বাঙালি চরিতাভিধানে দশ লাইন নয় ।

    সুদীপ: যে-কোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষ কিছু না কিছু প্রাপ্তি হিসেবে চায় । এটাই সাধারণ সত্য । আপনার সরষ্টির জন্য, জীবনের যে ভাললাগার জায়গাগুলোর ওপর আপনি এতদিন ভেবে এসেছেন, কাজ করে এসেছেন—তার প্রাপ্তি হিসেবে আপনি এখন কী পেলে নিজেকে সার্থক বলে মনে করবেন?

    মলয়: একাকীত্ব ।

    (কালগাড়ি পত্রিকার গ্রীষ্ম ২০১০ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত)
    Posted in হাংরি আন্দোলন| Tagged হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য, হাংরি মকদ্দমায়, ১৯৬৪ সালে
    Posted on অগাষ্ট 26, 2010by কিছু লেখাপত্র

    হাংরি বুলেটিন , ১৯৬৪

    পেশকার: এই বইটার ওপর হাত রাখুন আর বলুন, “যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না ।

    সুনীল: যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না ।

    পেশকার: আপনার নাম?

    সুনীল: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।

    আসামী পক্ষের উকিল: আপনি কী করেন?

    সুনীল: আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় ফিচার লিখি ।

    আসামী পক্ষের উকিল: শিক্ষা?

    সুনীল: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষায় এম এ ।

    আসামী পক্ষের উকিল: আপনার লেখা কোথায় প্রকাশিত হয়?

    সুনীল: আমি দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, পূর্বাশা এবং আরও আনেক পত্রিকায় লিখি । পূর্বাশা আর প্রকাশিত হয় না । আমার অনেকগুলো বই আছে, তার মধ্যে একটার নাম ‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় বিচার’ । আমি অনেক কবিতা ,ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছি ।

    আসামী পক্ষের উকিল: আপনি মলয়ের কবিতাটা পড়েছেন?

    সুনীল: হ্যাঁ, অনেকবার ।

    বিচারক অমল মিত্র: আরেকবার পড়ুন ।

    সুনীল: জোরে-জোরে পড়ব, না মনে-মনে?

    বিচারক অমল মিত্র: না-না, মনে-মনে ।

    সুনীল: হ্যাঁ, পড়ে নিলুম ।

    আসামী পক্ষের উকিল: পড়ে কী অশ্লীল মনে হচ্ছে?

    সুনীল: কই, না তো । আমার তো বেশ ভালো লাগছে পড়ে । বেশ ভালো লিখেছে ।

    আসামী পক্ষের উকিল: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?

    সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে-সব হয় না ।

    আসামী পক্ষের উকিল: দ্যাটস অল ইয়োর অনার ।

    সরকারী উকিল: আপনি এই ম্যাগাজিনের বিষয়ে কবে থেকে জানেন?

    সুনীল: ওদের আন্দোলন সম্পর্কে আমি প্রথম থেকেই জানি ।

    সরকারী উকিল: আপনি ওই জার্নালে লিখেছেন?

    সুনীল: না, লিখিনি কখনও ।

    সরকারী উকিল: আপনি ওরকম কবিতা লেখেন?

    সুনীল: পৃথিবীর কোনো দুজন কবি একই রকম লেখেন না, আর একই রকম ভাবেন না ।

    সরকারী উকিল: কবিতাটা কি অবসিন?

    সুনীল: না। ইট কনটেইনস নো অবসিনিটি । ইট ইজ অ্যান এক্সপ্রেশান অব অ্যান ইমপরট্যান্ট পোয়েট ।

    [এই মামলায় মলয় রায় চৌধুরীর দুইশত টাকা জরিমানা অনাদায়ে একমাসের জেল দন্ড দেয়া হয় । মলয় রায়চৌধুরী হাইকোর্টে আপিল করে মামলা জিতে যান]
    Posted in কৃত্তিবাস পত্রিকা| Tagged হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে ছোটো ভাই মলয়ের কথাবার্তা
    Posted on অগাষ্ট 21, 2010by কিছু লেখাপত্র

    Samir Roychoudhury

    মলয়: লেখক-কবির কাজ কি কেবল চিন্তা করা ? এবং সেই চিন্তাকে লিখিত ফর্মে আটক করেই তাঁর কাজ শেষ? নাকি লেখার মাধ্যমে তাকে অতিক্রম করা, এবং সামাজিক চিন্তা-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা? উনিশ শতকে তা সম্ভব ছিল । এখন ?

    সমীর: চিন্তার মাধ্যমে ভাব ও ভাষার সামঞ্জস্য গড়া । প্রকাশময়তার সম্প্রসারণ ও ব্যাপ্তি ঘটানো, যার ফলে পূর্ব অবস্হান থেকে ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়ে নবাঞ্চলের সংযোজন করে নতুন প্রজন্মের ভাষা হয়ে উঢ়বে । সম্প্রসারণ মানেই তো অতিক্রম, আর কবি ও লেখকের প্রধান সামাজিক দায়বদ্ধতা ভাষার প্রতি, কেননা, ভাষাকে উত্তরোত্তর সমাজের আরও যোগ্য করে তোলা । ভাষা বদলে গেলে সামাজিক প্রক্রিয়া স্বতঃ প্রভাবিত হয় । উনিশ শতকে যেভাবে প্রভাবিত হত আজ আর তেমন সম্ভব নয় । বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখেরা নিজেদের লেখালিখির মাধ্যমে আইনকানুনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন । আজ যেমন অরুন্ধতী রায়কে দেখা যায় মেধা পাটকরের সঙ্গে আ্ন্দোলন করছেন । নর্মদা বা!ধের উচ্চতা হ্রাস এবং সংলগ্ন জনবসতিগুলোর পুনর্বাসন সম্পর্কে তাঁদের আন্দোলনের ফলে সমাজ, রাষ্ট্র প্রভাবিত হয়েছে, আন্দোলন অনেকটা সফলতা পেয়েছে । মুশকিল এই যে, আজ রাষ্ট্র স্বয়ং প্রতিবাদীর ভূমিকা নেয় । যার ফলে কবি-লেখকের ভুমিকাকে হজম করে নেয় বা বানচাল রাখে । ইনটারনেট এবং ব্লগ ব্যবহার আজ অন্যতম উপায়, এবং কবি-লেখকরা ঠিক তাই করছেন । আরেকটা কথা, বাংলাভাষা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা, প্রত্যেক শব্দের একাধিক অর্থ । ব্যক্তি, দাম্পত্য, সমূহ সবই সেই অর্থময়তার পরিসরে অন্তর্ভূক্ত । যে-কারণে শব্দগুলির অর্থময়তার বীজমন্ত্রে যথেচ্ছ সম্প্রসারণের খোলা সম্ভাবনা । মনুষ্যসমাজ বা মানবপ্রজাতি টিকে আছে তার চিন্তাচেতনার ও ভাষার উত্তরোত্তর সম্প্রসারণের মাধ্যমে ।

    মলয়: রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে যেভাবে সম্পৃক্ত করেছিলেন, তুমি তাথেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি ধারা প্রবর্তন করেছ । তুমি যে-কোনো কবিতা অথবা গল্পকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিনির্মাণ করে সমালোচনার যে নতুন পথ খুলে দিলে, সে-পথে অন্যান্য আলোচকদের দেখা যায় না । পথটি কি অগম্য? নাকি বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহীর অভাব? বা পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার অবনমন জনিত?

    সমীর: পথ অগম্য নয় । তবে বিজ্ঞানদর্শন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গে তুলনামূলকভাবে আগ্রহীর অভাব । শিক্ষার অবনমনও তার কারণ । তাছাড়া দলমত নির্বিশেষে চিন্তাচেতনাকে অবদমিত রাখার জন্য অবিরাম ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন; সমালোচনার ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তি নিয়ে আর কেউ ভাবছেন না । যদিও তরুণ প্রজন্মের বেশ কিছু কবি-লেখকের কাছে আমার আলোচনাগুলি বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে । অনেক কবি-লেখক চান আমি তাঁর সম্পর্কে এই আলোচনাপদ্ধতিতে লিখি । অবশ্য আমার বেলায় তেমন আলোচককে দেখা যায় না । সম্প্রতি নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ প্রধান, ধীমান চক্রবর্তী, অলোক গোস্বামী, মুর্শিদ এ এম প্রমুখ লেখকরা তাঁদের আলোচনায় আমার লেখার এই দিকগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন । বাংলাদেশে পদার্থবিজ্ঞানীরা এই ধারায় লিখছেন, এমনকি ব্লগে এই ধরণের লেখালিখি দেখা যাচ্ছে । আজ বিজ্ঞানপ্রজুক্তি দ্রুতগতিতে জীবনযাপনকে বদলে দিচ্ছে । সাহিত্য এবং আলোচনা বিজ্ঞানদর্শন থেকে গা বাঁচিয়ে থাকতে পারে না । আমার কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধের বইগুলোর চাহিদা থেকে পাঠকের রুচিবোধের পরিবর্তনের ঈঙ্গিত স্পষ্ট ।

    মলয়: তোমার বাঁশদ্রোণির বাড়িতে আশির দশকের শেষ থেকে দেখা গেছে লেখকরা, লেখক-গোষ্ঠীও, জ্ঞানান্বেষণের জন্যে এসেছেন, তোমারই চিন্তাকে তাঁরা লিখিত রূপ দিয়েছেন; কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্প লিখেছেন—-তারপর ভুলে গেছেন তোমায় । এমনকী অনেকে অস্বীকার করেন, আর কেউ-কেউ বিরুদ্ধেও বলেন । এখনও অনেকে প্রায়ই আসেন তোমার কাছে, একই উদ্দেশ্যা । তোমার খারাপ লাগে না?

    সমীর: হ্যাঁ, এনেকেই এসেছেন, গেছেন, থেকেছেন । আমার খারাপ লাগেনি । বরং আনন্দিত হয়েছি সঙ্গোপনে । এক সময় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলুম তরুণরা যেতে আসেন । যেমন প্রেসিডেন্সির ছাত্র-ছাত্রীরা দলবেঁধে নিয়মিত আসতেন । বন্ধুদের মধ্যে যারা পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানে জায়গা খুঁজে নিয়েছেন, কলকে পেতে চেয়েছেন, পুরস্কার চেয়েছেন, বিদেশযাত্রার দলে জায়গা চেয়েছেন, তাঁরা স্বভাবতই আজ উল্টো কথা বলেন । এমনকী তাঁদের স্ত্রী, এবং পূর্বনির্ধারিত আলোচকরা সেই বন্ধুর মৃত্যুর পর ডাহা মিথ্যা কথা নির্লজ্জভাবে বলে যাচ্ছেন । সঙ্কোচ বোধ করেন না । এসবের জন্যে দুঃখ করার সময় পাই না । নতুন-নতুন ভাবনায় মেতে থাকি । তরুণ লেখকরা আজও তেমনই আসেন । সব কাজ তো আমি একা করা উঠতে পারব না । অতএব কাজ ভাগ করে দিয়েছি এবং দিচ্ছি অনেকের মধ্যে । ‘হাওয়া৪৯’-এর মাধ্যমেও অনেক নতুন ধারার লেখক উঠে এসেছেন এই পদ্ধতির মাধ্যমে । আমার এবং তাঁদের কাজের চাহিদা থেকে বোঝা যায় পাঠকমহলের আগ্রহ । যে আলোড়ন সৃষ্টি করে বইগুলোর, আর ‘হাওয়া৪৯’-এর চাহিদা থেকে…কৌরব…কালিমাটি, তাঁদের পত্রিকা-ওয়েবসাইটে দেন । তাঁদের পাঠকমহল বিশাল । বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে প্রত্যেক লিটল ম্যাগাজিনের গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি ।

    মলয়: তোমার কলেজ-জীবনের সময় থেকে দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, বিমল রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ পাটনা, উত্তরপাড়া, চাইবাসা, ধানবাদ, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, মজফফরপুর, দুমকা, ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি বাসায় নিয়মিত যেতেন । তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় তোমার উপস্হিতির অভাব দেখা যায় । তা কি তুমি দীর্ঘ দিন বাইরে ছিলে বলে? নাকি হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলে বলে? অথবা তোমার ট্রাইবাল ইন্সটিংক্ট নেই বলে?

    সমীর: স্মৃতিচারণায় না থাকা স্বাভাবিক । কেননা, অনেক তথভ ও সত্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে । নানা ধরণের পার্থিব ভীতি তাঁদের মনে কাজ করে । হিসেব করে লেখেন । বাদ দেয়াকেই সহজ উপায় বলে মনে করেন । আবার হয়তো দীর্ঘদিন বাইরে থেকেছি, কলকাতার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারিনি । হাংরি আন্দোলন বা অধুনান্তিক চিন্তাচেতনা বা যে কোনো নতুন ধারণা আধুনিকতামনস্ক বন্ধুদের কাছে একটা বিশাল অন্তরায় । তাছাড়া, তাঁরা অনুগামী গড়ে তুলতে অধিক মনোযোগী । তাঁদের বেশিরভাগে আবিষ্কারকের ভূমিকায় দেখি না, সংযোগমনস্ক নয় ।

    মলয়: তোমার সাহিত্যিক সহপাঠী ও বন্ধুরা প্রায় সকলেই ৫০ দশকে কম্যুনিস্টবিরোধী ছিলেন। পাটনায় তুমি সি.পি.আই-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলে । তোমার বন্ধুদের কেউ-কেউ অতুল্য ঘোষের সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । বামপন্থীরা সর্বত্র ক্ষমতা দখলের পর তাঁরা ভোল পালটে ফেললেন । তুমি তখনও ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলে । এখনও রেখেছ । ভোল পাল্টাওনি । তোমার কি কোনো নিজস্ব দার্শনিক-রাজনৈতিক অবস্হান আছে?

    সমীর: হ্যাঁ, সেই বন্ধু প্রথম যৌবনে ‘জনসেবক’ পত্রিকায় রবিবাসরীয় পাতা দেখতেন । আজ অবস্হান বদল করে ঠিক তার বিপরীত-পক্ষের সঠ্গে সম্পর্ক রাখেন । প্রতিষ্ঠানের পক্ষে থাকতে চান । আমার কোনো দলগত অবসহান নেই । বরং প্রতিনিয়ত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে জীবনের লক্ষণ থেকে জীবনর্দনকে আত্মস্হ করি, বিনির্মাণ করি, লিখি । ক্ষমতাকেন্দ্রের মুখাপেক্ষী নই । লোভ ও লোভতাড়িত অবস্হান মৃত ও জীবিত বন্ধুবান্ধবদের আছে, যা আমি গোড়া থেকে পরিহার করেছি । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা সংকলন সম্পাদনা করেন এবং পরিকল্পিতভাবে আমাকে বাদ দেন । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে জেনেশুনে তবু উচ্ছাকৃতভাবে ভুল ব্যাখ্যা করেন । এমনকী অধুনান্তিক সম্পর্কে একই ধরণের চাতুর্যের আশ্রয় নেন । আর হ্যাঁ, আমি অভেদ বা সাম্যে বিশ্বাস করি । অভেদ বা সাম্য থেকেই সামঞ্জস্যে পৌঁছানো সম্ভব । লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরকে মেইনস্ট্রিম পরিসরের ক্রিটিক মনে করি ।

    মলয়: ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ কিংবা ‘মানুষই সবকিছুর কেন্দ্রে’ অথবা ‘ঈশ্বরের সিংহাসনে বসার অধিকার কেবল মানুষের” এরকম কথা গত তিন শতক যাবত আমরা শুনে আসছি । তোমার বক্তব্য কী?

    সমীর: এসব তথাকথিত আপ্তবাক্যের পরিণাম আজ মানুষ হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে । দিনকেদিন কেন্দ্রহীনতা বা একাধিক কেন্দ্রের ধারণা নানা স্তরে স্বীকৃতি পাচ্ছে । ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো থেকে শিখছে । রাজনীতিবিদরা আজও বলেন..মানুষ চাইছে, মানুষ বলছে—অথচ তাঁরা ভালো ভাবেই জানেন, মানুষ তা বলছে না, মানুষ তা চাইছে না…এমন কি তাদের কথা শুনে মনে হয়, সমাজ বা প্রখরতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয় । আজ রাজনীতিতে কান্ডজ্ঞানহীন এবং অর্থশিক্ষিত রাজনীতিবিদদের উপস্হিতি বেড়েছে । বাহুবলি আর অপরাধীরাও প্রতিনিধিসভায়, সংসদে দেখা যাচ্ছে । ক্ষমতার পরিসরের উৎস এবং গঠন মননজাত বা মানসিক নয়, বরং ফিজিকাল…গায়ের জোরের বোলবালা । আরেকটা জিনিস মনে রাখা দরকার । মানুষ বিবর্তনের শীর্ষে এবং বিবর্ধনের একমাত্র উত্তরাধিকারী । প্রকৃতি তাকে সেখানে পৌঁছে দিয়েছে । প্রকৃতির প্রদূষণ মানে তো শুধু আর আবহাওয়ার প্রদূষণ নয়, মননবৃত্তিরও প্রদূষণ, মানবসমাজের প্রদূষণ । প্রকৃতি মানে তো শুধু নেচার বা নিসর্গপ্রকৃতি নয় । মানবপ্রকৃতি প্রকৃতিরই এক স্পৃহা । এই প্রকৃতিস্হ সিংহাসনই তার উচ্চতার পরিমাপ । ‘আপ্তবাক্য’ মানুষকে এক জায়গায় আটকে রাখে । উত্তরোত্তর যাত্রার দিকে নিয়ে যায় না ।

    ( কালিমাটি নং ৯৩ থেকে পুনঃপ্রকাশিত )

    দেবাশিস সাহা নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অগাষ্ট 20, 2010by কিছু লেখাপত্র

    দেবাশিস সাহা : হাংরি আন্দোলনের পরে তেমন কোনো জোরালো আন্দোলন হল না কেন? বাংলা কবিতায়?

    মলয় রায়চৌধুরী: কোনো আন্দোলনই আর সম্ভব নয় । আবিষ্কার ও প্রযুক্তির দ্রুতির কারণে ব্যক্তির বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় আমাদের কৌমসমাজকে অত্যন্ত পরিবর্তনশীল করে দিয়েছে । ষাটের যুগে এক দশকে যে রদবদল সমাজ ও সংস্কৃতিতে আকার লাভ করতো, তা এখন এক সপ্তাহে ঘটে যায় । লেখা প্রকাশের মঞ্চ এবং নিজের পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হত হ্যান্ডবিলের আকারে, একফালি কাগজে যা আজকের দিনে অচিন্ত্যনীয়; এখন তো প্রায় ১৫০০ লিটল ম্যাগাজিন কেবল এই বাংলায় প্রকাশিত হয় ।

    দেবাশিস সাহা: শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কি আপনি সমর্থন করেন ? কেন?

    মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ । শাস্ত্রবিরোধীদের অবদানকে অবশ্যই স্বীকার করি ।

    দেবাশিস সাহা : কবিতা কি শব্দের আলো ? না, আলোর শব্দ?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না । গভীর সমুদ্রের প্রাণিরা, যাদের চোখ নেই এবং যারা আওয়াজের দ্বারা দেখতে পায়, তারা এই রহস্যের কিনারা করতে পারবে । কিংবা আইনস্টাইন থাকলে বলতা পারতেন

    দেবাশিস সাহা : রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী—-কে আপনার প্রিয়?

    মলয় রায়চৌধুরী: তিন জনের লেখা থেকেই মাল-মশলা পেয়েছি, যা আমাকে আমার মতো করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে । বহু ক্ষেত্রর অবশ্য ওনাদের মতামতের সঙ্গে আমার মত মেলে না ।

    দেবাশিস সাহা: কলকাতাত সাহিত্য ‘দেশ’ নির্ভর হওয়ার কারণেই কি এত জোলো ও ছিবড়ে? এখনকার বাংলা সাহিত্য কি শুধুই পুরস্কারের মাংস?

    মলয় রায়চৌধুরী: ‘দেশ’ নয়, আসল ব্যাপার হল বাজারের মালিকানা । সংস্কৃতি আজ বাজারের দখলে, তা সে লেখালিখি হোক বা পুরস্কার । বাজার আজ সর্বনিয়ন্তা ।

    দেবাশিস সাহা : জয় গোস্বামীকে আনন্দবাজার থেকে সরিয়ে দেবার পর কি তাঁর কবিতা ছন্দহীন হয়ে পড়লো? এটা কি নিরাপত্তাহীনতার কারণে?

    মলয় রায়চৌধুরী: ওনার চিন্তাজগতে পরিবর্তনের কারণে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল । ওনাকে নিরাপত্তাহীন ভাবার কারণ দেখি না । সাহিত্য-ক্ষেত্রে যা যা পাবার পেয়ে গেছেন । ওনার ছন্দ নকল করে বহু জয় গোস্বামী ক্লোন বেরিয়েছে, তাই ছন্দ বর্জন করা ছাড়া উপায় ছিল না ।

    দেবাশিস সাহা: কৌরব, শহর, কবিতা ক্যাম্পাস—-এ ধরণের কাগজে যে কাজগুলো হচ্ছে তা সাহিত্যের পক্ষে কতটা ফলপ্রসূ?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই পত্রিকাগুলো যখন তুঙ্গে, তখন যথেষ্ট প্রভাবশালী সাহিত্য-পরিসর গড়ে তুলেছে; নতুন এলাকার খোঁজ দিয়েছে । কাজ ফলপ্রসূ হবে ভেবে তো কেউ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন না । তা সময় ও পরিসরে হস্তক্ষেপ করে ।

    দেবাশিস সাহা: আপনার সাহিত্য-জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? সেটা কি সফল? যদি না হয় তাহলে তার কারণ কি?

    মলয় রায়চৌধুরী: লিখতে আরম্ভ করে, লেখালিখি করা এবং তা প্রকাশ করার বাইরে, আমার মনে হয় না কারো কোনো অন্য লক্ষ্য থাকে । যাঁরা টাকা-পয়সা রোজগারের উপায় হিসেবে লেখালিখি করেন তাঁদের কথা আলাদা । এখন তো চাইলেই লেখা ছাপা হয়, এটাই তো সফলতা । বাংলাদেশের একটি ওয়েবসাইটে আমার কবিতা নিয়ে স্বপক্ষে-বিপক্ষে তর্কাতর্কি চলছে তা আমি জানতে পারি ওই তর্ক শুরু হবার বহুকাল পরে । তর্কটা আজও হয়ে চলেছে ।

    (কালগাড়ি পত্রিকার গ্রীষ্ম ২০১০ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত)
    Posted in লিটল ম্যাগাজিন| Tagged হাংরি আন্দোলন|
    শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ-এর মুচলেকা : হাংরি আন্দোলন
    Posted on অগাষ্ট 19, 2010by কিছু লেখাপত্র

    শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা

    আমার নাম শৈলেশ্বর ঘোষ। আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড় হয়েছি বালুরঘাটে। আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাত হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি, ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে আই এস সি, ১৯৫৮ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বি এ, আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স। ১৯৬৩ সনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন থাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন। তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই। আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি। গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছে কয়েকটা কবিতা চান। তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি। আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি। তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোট দুবার কবিতা লিখেছি। মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দুতিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোন নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি। সাধারণত এইসব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত। এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না। অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয়। ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভদ্রকালীতে ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার। মাইনে পাই দু’শ দশ টাকা। বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশনার পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়, আমি এই সংস্হার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না। বর্তমান বুলেটিনটি ছাপিয়েছেন প্রদীপ চৌধুরী। ( ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, স্বাক্ষর শৈলেশ্বর ঘোষ )

    সুভাষ ঘোষের মুচলেকা

    আমার নাম সুভাষচন্দ্র ঘোষ। গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস যাতায়াত করছি। সেখানে আমার সঙ্গে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয়। সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায়। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি যা ঠিক কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না। আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি তা আমার রুমমেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই। সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল। আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ। আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল ‘হাঁসেদের প্রতি’ প্রকাশিত হবে। আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করি না, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পর আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ( ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ স্বাক্ষর সুভাষ ঘোষ )

    [ হাংরি আন্দোলন মামলায় আদালতে এনারা দুজন মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন , অর্থাৎ রাজসাক্ষী ছিলেন। সে-সময়ে এই মুচলেকা দিয়ে তাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পরে হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা সুযোগ বুঝে নিজেদের আবার হাংরি ঘোষণা করেন। 'হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন' নামে সমীর চৌধুরী সম্পাদিত যে বইটি বাজারে পাওয়া যায় তা একটি চারশো বিশ সংকলন; ওই সংকলনে প্রধান হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউ নেই; পরিবর্তে আছেন এমন লেখক-কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনে ছিলেন না ]

    দেবাশিস সাহা নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
    Posted on অগাষ্ট 20, 2010by কিছু লেখাপত্র

    দেবাশিস সাহা : হাংরি আন্দোলনের পরে তেমন কোনো জোরালো আন্দোলন হল না কেন? বাংলা কবিতায়?

    মলয় রায়চৌধুরী: কোনো আন্দোলনই আর সম্ভব নয় । আবিষ্কার ও প্রযুক্তির দ্রুতির কারণে ব্যক্তির বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় আমাদের কৌমসমাজকে অত্যন্ত পরিবর্তনশীল করে দিয়েছে । ষাটের যুগে এক দশকে যে রদবদল সমাজ ও সংস্কৃতিতে আকার লাভ করতো, তা এখন এক সপ্তাহে ঘটে যায় । লেখা প্রকাশের মঞ্চ এবং নিজের পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হত হ্যান্ডবিলের আকারে, একফালি কাগজে যা আজকের দিনে অচিন্ত্যনীয়; এখন তো প্রায় ১৫০০ লিটল ম্যাগাজিন কেবল এই বাংলায় প্রকাশিত হয় ।

    দেবাশিস সাহা: শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কি আপনি সমর্থন করেন ? কেন?

    মলয় রায়চৌধুরী: হ্যাঁ । শাস্ত্রবিরোধীদের অবদানকে অবশ্যই স্বীকার করি ।

    দেবাশিস সাহা : কবিতা কি শব্দের আলো ? না, আলোর শব্দ?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না । গভীর সমুদ্রের প্রাণিরা, যাদের চোখ নেই এবং যারা আওয়াজের দ্বারা দেখতে পায়, তারা এই রহস্যের কিনারা করতে পারবে । কিংবা আইনস্টাইন থাকলে বলতা পারতেন

    দেবাশিস সাহা : রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী—-কে আপনার প্রিয়?

    মলয় রায়চৌধুরী: তিন জনের লেখা থেকেই মাল-মশলা পেয়েছি, যা আমাকে আমার মতো করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে । বহু ক্ষেত্রর অবশ্য ওনাদের মতামতের সঙ্গে আমার মত মেলে না ।

    দেবাশিস সাহা: কলকাতাত সাহিত্য ‘দেশ’ নির্ভর হওয়ার কারণেই কি এত জোলো ও ছিবড়ে? এখনকার বাংলা সাহিত্য কি শুধুই পুরস্কারের মাংস?

    মলয় রায়চৌধুরী: ‘দেশ’ নয়, আসল ব্যাপার হল বাজারের মালিকানা । সংস্কৃতি আজ বাজারের দখলে, তা সে লেখালিখি হোক বা পুরস্কার । বাজার আজ সর্বনিয়ন্তা ।

    দেবাশিস সাহা : জয় গোস্বামীকে আনন্দবাজার থেকে সরিয়ে দেবার পর কি তাঁর কবিতা ছন্দহীন হয়ে পড়লো? এটা কি নিরাপত্তাহীনতার কারণে?

    মলয় রায়চৌধুরী: ওনার চিন্তাজগতে পরিবর্তনের কারণে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল । ওনাকে নিরাপত্তাহীন ভাবার কারণ দেখি না । সাহিত্য-ক্ষেত্রে যা যা পাবার পেয়ে গেছেন । ওনার ছন্দ নকল করে বহু জয় গোস্বামী ক্লোন বেরিয়েছে, তাই ছন্দ বর্জন করা ছাড়া উপায় ছিল না ।

    দেবাশিস সাহা: কৌরব, শহর, কবিতা ক্যাম্পাস—-এ ধরণের কাগজে যে কাজগুলো হচ্ছে তা সাহিত্যের পক্ষে কতটা ফলপ্রসূ?

    মলয় রায়চৌধুরী: এই পত্রিকাগুলো যখন তুঙ্গে, তখন যথেষ্ট প্রভাবশালী সাহিত্য-পরিসর গড়ে তুলেছে; নতুন এলাকার খোঁজ দিয়েছে । কাজ ফলপ্রসূ হবে ভেবে তো কেউ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন না । তা সময় ও পরিসরে হস্তক্ষেপ করে ।

    দেবাশিস সাহা: আপনার সাহিত্য-জীবনের লক্ষ্য কী ছিল? সেটা কি সফল? যদি না হয় তাহলে তার কারণ কি?

    মলয় রায়চৌধুরী: লিখতে আরম্ভ করে, লেখালিখি করা এবং তা প্রকাশ করার বাইরে, আমার মনে হয় না কারো কোনো অন্য লক্ষ্য থাকে । যাঁরা টাকা-পয়সা রোজগারের উপায় হিসেবে লেখালিখি করেন তাঁদের কথা আলাদা । এখন তো চাইলেই লেখা ছাপা হয়, এটাই তো সফলতা । বাংলাদেশের একটি ওয়েবসাইটে আমার কবিতা নিয়ে স্বপক্ষে-বিপক্ষে তর্কাতর্কি চলছে তা আমি জানতে পারি ওই তর্ক শুরু হবার বহুকাল পরে । তর্কটা আজও হয়ে চলেছে ।

    (কালগাড়ি পত্রিকার গ্রীষ্ম ২০১০ সংখ্যা থেকে পুনঃপ্রকাশিত)
    Posted in লিটল ম্যাগাজিন| Tagged হাংরি আন্দোলন| মন্তব্য দিন
    শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ-এর মুচলেকা : হাংরি আন্দোলন
    Posted on অগাষ্ট 19, 2010by কিছু লেখাপত্র

    শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা

    আমার নাম শৈলেশ্বর ঘোষ। আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড় হয়েছি বালুরঘাটে। আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাত হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি, ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে আই এস সি, ১৯৫৮ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বি এ, আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স। ১৯৬৩ সনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন থাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন। তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই। আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি। গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছে কয়েকটা কবিতা চান। তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি। আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি। তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোট দুবার কবিতা লিখেছি। মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দুতিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোন নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি। সাধারণত এইসব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত। এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না। অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয়। ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভদ্রকালীতে ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার। মাইনে পাই দু’শ দশ টাকা। বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশনার পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়, আমি এই সংস্হার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না। বর্তমান বুলেটিনটি ছাপিয়েছেন প্রদীপ চৌধুরী। ( ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, স্বাক্ষর শৈলেশ্বর ঘোষ )

    সুভাষ ঘোষের মুচলেকা

    আমার নাম সুভাষচন্দ্র ঘোষ। গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস যাতায়াত করছি। সেখানে আমার সঙ্গে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয়। সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায়। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি যা ঠিক কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না। আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি তা আমার রুমমেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই। সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল। আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ। আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল ‘হাঁসেদের প্রতি’ প্রকাশিত হবে। আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করি না, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পর আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ( ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ স্বাক্ষর সুভাষ ঘোষ )

    [ হাংরি আন্দোলন মামলায় আদালতে এনারা দুজন মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন , অর্থাৎ রাজসাক্ষী ছিলেন। সে-সময়ে এই মুচলেকা দিয়ে তাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। পরে হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তাঁরা সুযোগ বুঝে নিজেদের আবার হাংরি ঘোষণা করেন। 'হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন' নামে সমীর চৌধুরী সম্পাদিত যে বইটি বাজারে পাওয়া যায় তা একটি চারশো বিশ সংকলন; ওই সংকলনে প্রধান হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউ নেই; পরিবর্তে আছেন এমন লেখক-কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনে ছিলেন না ]
  • | 69.152.***.*** | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:১২628092
  • স্ক্রল করতে করতে মাউসের হুইল খুলে এল প্রায়। টেক্সটফাইলে কপি করে রাখলাম।

    অ.ট. 'হাংরি' না বলে 'অ্যাংরি' বললে মানাত ভালো!
  • £€¥₩ | 122.79.***.*** | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:৪৭628094
  • এটাই পুরো বইটা তো?
  • asmitaa | 162.79.***.*** | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০২:০৭628095
  • "তাঁরা সব বাঁজা বা হিজড়ে" - বাঃ কবি - এই তো চাই। সন্তানের জন্ম দেওয়াটা মানুষের যৌনতার মাপকাঠি? নাকি যাঁরা হিজড়ে হ'ন তাঁদের যৌনতা থাকে না? যদি নাও থাকে তাতে মানুষ হিসেবে তাঁরা কম হয়ে যান কি? যৌনশক্তি প্রখর হলেই মেধা বেশি - কোন বিজ্ঞান এই কথা বলেছে? তাহলে বোধহয় শিম্পাঞ্জী বা গোরিলা বেশি মেধাবি কবির মতে - তাই না?

    ইন্টারভিউ পড়ে মনে হল কোনো কালের হাংরি কবি আজ পুরোপুরি অ্যাংরি ও সেন্সলেস।
  • | 69.152.***.*** | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৭:৩৪628096
  • ডক্টর দে: আপনার কবিতাকে কেন হাংরি বলা হবে ?

    মলয়: কেননা আমি কবিতা থেকে কিচ্ছু বাদ দিইনি । কবিতা হাঁ-মুখে ছিল সবই গ্রাহ্য । অমুক হলে কবিতা হবে না, তমুক হলে কবিতা অসফল, এই ধরনের তর্ক সদ্য উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলায় মনে হত বুদ্ধিহীন ।

    :) :)
  • Abhyu | 34.18.***.*** | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১১:২২628097
  • এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ টই।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 130.6.***.*** | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১২:২০628098
  • যিনি এই পৃষ্ঠাটি আরম্ভ করেছেন তাঁকে তো ধন্যবাদ দিতেই হয় । ফেসবুকে একজন পাঠকের কাছে জানতে পারলুম । এত খেটে কেউ যে আমার সাক্ষাৎকার পোস্ট করলেন, বেশ একটা আহ্লাদী ফিলিঙ ঘটছে । অমন পাঠকও আমার আছেন তাহলে । থ্যাংকস জনাব বাঘু । যাঁরা মন্তব্য দিচ্ছেন তাঁদেরও। তবে ফলো আপ করার সময় আমার হয়ে উঠবে না, বয়সের কারণে । আশা করি বাঘুবাবু এবং মন্তব্যকারীরা মাফ করে দেবেন ।
  • তাপস দাশ | 122.79.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৩:৪০628099
  • মলয়-টলয়রা চিরকাল সেক্সিস্ট l
  • Ekak | 132.167.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৫:১৪628100
  • toloy দের লেখা পড়িনি বোধায় তবে মলয়বাবুর লেখা কোনকালেই সেক্সিস্ট মনে হয়নি ।
  • কল্লোল | 125.24.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৬:৪০628082
  • মলয়রা সাহস করে একটা আন্দোলন শুরু করেছিলো। যে কোন প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের মতো এতেও বেশ কিছু ধান্দবাজ এসেছিলো। তবে সকলের ধান্দাবাজির প্রকাশ একরকম নয়। তাতে কিছু বাজে লেখাও এসেছে। কিন্তু অদ্ভুত ভালো লেখাও পেয়েছি আমরা।
    সন্দীপন নিয়ে আমার মোহভঙ্গ হয় উনি আজকালে যোগ দেবার পর। আজকালে যোগ দিয়েছিলেন বলে নয়। উনি তখন আমার এক বন্ধুর বাসায় রোজ সকালে "হাজিরা" দিতেন ও বন্ধুটির চাটুকরী করতেন। বন্ধুটি তখন আজকালের প্রায় মাথায়। রবিবার আসতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ও। কিন্তু ওঁকে কোনদিন চটুকারীতা করতে দেখিনি।
  • শিবাংশু | 127.197.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৪:৩০628083
  • এই টইটা মলয় রায়চৌধুরী বিষয়ে একটা জরুরি কর্তব্য পালন করেছে । তিনি সাধারণ বাংলাপাঠকদের উপজীব্য কলমকার ন'ন । তাঁর লেখালিখি ও তৎসংক্রান্ত অভিকর্ষজ বল, ব্যক্তি আমাকে বহুসময়ই বাঁধেনি । কিন্তু তাঁর নিজস্ব অবস্থান, বহুজনপাঠকের থেকে পাওয়া অস্বীকৃতি বা অনাসক্তি, তাঁকে বিশেষ বিড়ম্বিত করেনি এবং তিনি আর্ষ ঔদাসিন্যে শান্ত থাকতে পেরেছেন। এই ব্যাপারটি আমায় ভাবায় । আমাদের ভাষায় আর কি কেউ রয়েছেন এমন ? জানিনা।

    তাঁর দর্শন বা প্রয়োগরীতি অনেক ক্ষেত্রেই আমার কাছে স্বীকার্য নয়। বস্তুত অতোটা র‌্যাডিক্যাল হবার প্রয়োজন ছিলো কি না, নিশ্চিত নই। তিনি প্রথম থেকেই বিচ্ছিন্নতার সাধনা করেছেন এবং আজও নিজস্ব একাকীত্বের গরিমাকে উপভোগ করেন। ব্যক্তি আমি সম্পূর্ণভাবে এই অবস্থানের বিপরীত মেরুতে থাকতে ভালোবাসি । তবে তাঁর ভাবনাচিন্তার, প্রশ্ন করার অধিকার কখনও অস্বীকার করতে পারিনি । আরো অনেকের মতো তাঁর সততা আমাকেও আকর্ষণ করে।

    আমাদের সাহিত্যে মলয় রায়চৌধুরীর উপস্থিতি নিয়ে এই মূহুর্তে কোনও প্রশ্ন থাকার অবকাশ নেই বলেই মনে করি ।
  • তাপস | 122.79.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:২১628084
  • একক খুব ঠিক জায়গায় পয়েন্ট আউট করেছেন l 'টলয়' তো নেই, থাকে না l ইচ্ছে করে বা স্লিপ করে বলা হয় l আমি ইচ্ছে করে বলেছিলাম l তাচ্ছিল্য করার জন্যে l তবে আমি মলয়ের লেখা সেক্সিস্ট বলিনি l যদিও 'অথরের মৃত্যু' ঘোষিত হয়ে গেছে, তবু এ ক্ষেত্রে আমি মলয়ের ভাবনা বৃত্ত কে ধরতে চেয়েছি l যা হয়ত লেখাতেও আছে l আবার আছে তার টুকরো-টাকরা যাপন ছবিতেও l হয়ত কেন, নিশ্চিত ভাবেই লেখার মধ্যেও আছে l সেটা আমি দেখাতে পারব কিনা, সেটা তো আমার ক্ষমতার বা আমার বোঝার উপর নির্ভর করে l

    মলয় বাবু সৎ কিনা তা আমি জানি না l জীবন-যাপনে যাকে সৎ বলা হয় তাই নিয়ে বলছি l মানে চাটুকারিতা ইত্যাদি l সন্দীপনের জীবন নিয়ে জানি, তাই কল্লোলদার সঙ্গে এক মত l তবে চাটুকারিতার জন্যেই চাটুজ্যে ভদ্রলোকের লেখার মান নেমে গেল, নাকি উনি ফুরিয়ে গিয়েছিলেন, রিপিট করছিলেন জানি না l

    মলয় রায়চৌধুরী খুব ঋষিসুলভ ঔদাসীন্যে নিজেকে রাখতে পেরেছিলেন, শিবাংশুদার এই অবস্থান সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই l বিচ্ছিন্নতার সাধনা ও একাকীত্বের গরিমা সম্পর্কেও ওই কথায় প্রযোজ্য l তবে প্রশ্ন করার বা ভাবনাচিন্তা করার অধিকারকে অস্বীকার করার কথা বলার মত ব্যাপার নেই l

    এত কথা বললে, একটা সমালোচনা লিখে দেখাতে হয় l সে বুলশিটটা আপনাদের পাওনা রইলো l
  • Ekak | 132.167.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:২৮628085
  • মলয়বাবুর লেখায় সেক্সিস্ট এলিমেন্ট কি পেলেন যদি একটু বলেন .....
  • তাপস | 122.79.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৪০628086
  • আন্তরিক ভাবেই বলতে চাই l কিন্তু একটু সময় নিয়ে, যাতে একদম কমেন্টের মত না লাগে l অন্তত নিজের কাছে l
  • শিবাংশু | 127.2.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২৩:১০628087
  • স্বাগত তাপস, লেখাটির অপেক্ষা রইলো ।
  • | 214.85.***.*** | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৬:১৪628088
  • এই টইটা কে কে পুরোটা পড়েছেন?
  • pi | 192.66.***.*** | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৬:১৯628089
  • তাপসদা, সেক্সিস্ট এলিমেন্ট নিয়ে লেখাটা কই ?
  • :) | 127.194.***.*** | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৬628090
  • মরাচৌ এর লেখা এতদিনেও একটুও ভালো লাগাতে পারিনি। একটাও না। নান। তবে লেখার বা লিখতে পারার অধিকারটুকুর স্বপক্ষে লড়ে যাবো।
  • তাপস | 233.29.***.*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১৪:১৯628091
  • ফাই কি ফাগল? পেত্যেক মেলায় একটা করে মরাচউ বেরোচ্ছে, পুশ সেল করছি, তারমধ্যে বার খেয়ে এইসব করে নাকি? তবে আগ্রহীরা এই মেলায় প্রকাশিত আয়নানগর পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়তে পারেন।
  • - | 72.102.***.*** | ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ১১:৩৫628093
  • মলয়রা প্রতি দেড়শো বছরে একবার জন্মায়
  • অভিজিত পাল | 106.215.***.*** | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০৫738374
  • মলয়রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অভিজিত পাল
    .......................................................................................................
    অভিজিত :—জানলা দিয়ে কি দেখছেন ? বৃষ্টি ? বর্ষা ?

    মলয়:—না, না, বর্ষাকাল উপভোগ করতে হয়  বৃষ্টিতে ভিজতে -ভিজতে নদীগুলোয় । দিনের বেশ, মতন বৃষ্ট ভিজ । শহরে বৃষ্টির শব্দ বেশ ভালগার আর, ধানখেতে বা জঙ্গলে বৃষ্টি তার নিজের শব্দকে নষ্ট হতে দেয় না, ভারজিন শব্দ শুনতে পাওয়া যায় ।

    অভিজিত:—তাহলে ?

    মলয়:—না, দেখছি সামনের ওই গাছটা একবছরেই শুকিয়ে মরে গেল ।

    অভিজিত :—তার জন্য কষ্ট ?

    মলয় :—কষ্ট ? নাহ । বৃষ্টিও তো দিনকতক হল পড়ছে না । বর্ষাকাল বলে গাছটার শব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । ছাল-চামড়া উঠে গেছে । গাছটা আমার জন্যেই মরে গেল ।

    অভিজিত:—আপনার জন্যে ? বিষ দিয়েছিলেন নাকি ? গাছ মারার তো মাফিয়া আছে । কর্পোরেশানের আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেদের টাকা খাওয়ায়, তা সে তো কোনো হোর্ডিঙের বা ব্যানারের বিজ্ঞাপনকে যদি আড়াল করে, তাহলে ; কিংবা কোনো বড়ো দোকানের শোরুমের সামনে থাকলে। এই গাছ তো আপনাদের আবাসনের চৌহদ্দিতে রয়েছে, কোনো বিজ্ঞাপনের ফলাও করা নিয়নসাইনও নেই , আপনাদের বিলডিঙের তলায় মোটরগাড়ির বা মহিলাদের পোশাকের শোকেসও নেই । 

    মলয়:—এই গাছটা কোনো জংলি গাছ, নাম জানি না ; গোলাপি রঙের ফুল হতো বসন্তকালে, থোকা-থোকা, দেখতে সুন্দর, কিন্তু সেই ফুলগুলো থেকে প্রচুর পরাগ উড়তো একটু হাওয়া দিলেই, আর আমার হাঁপানি, সব জানলা-দরোজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, বেড়ে যেতো, দুবেলা ফোরমোস্ট ফোর হানড্রেড ইনহেল করতে হতো । বছর পঞ্চাশ আগে এটা জঙ্গল ছিল, শহর এগিয়ে এসে দখল করে ফেলেছে ।

    অভিজিত:—তাই গাছটার মৃত্যু চাইছিলেন ?

    মলয়—আমি চাইনি তো । আমার সঙ্গে শত্রুতা করলেই, কেবল মানুষ নয়, গাছপালা আর প্রাণীরাও মারা যায় । অথচ আমি কারোর সঙ্গে কখনও শত্রুতা করিনি । আমি চাইনি গাছটা মরে যাক । শত্রু বলা বোধহয় উচিত হল না, ইনটিমেট এনিমিজ বললে ভালো হয় ।

    অভিজিত:—তাহলে ছয় তলায় দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে কি দেখছিলেন, ওই মরা গাছ ? ওটা তো বছরখানেক হল মরে গেছে বলছেন ।

    মলয়:—গাছটা মারা যাবার দরুণ পায়রাদের সঙ্গমের সুবিধা হয়ে গেছে ।

    অভিজিত:—পায়রাদের সঙ্গম দেখছিলেন ?

    মলয়:—ঠিক সঙ্গম নয়, দেখছিলুম যে পুরুষ পায়রা প্রতিবার সঙ্গম করছে আর ডালের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত নেচে আসছে, গর্বের সঙ্গে ঘাড় নাড়াচ্ছে । মাদি পায়রাটাও একটু খেলিয়ে নিচ্ছে । মানুষ অমন করে না, তার কারণ পুরুষ মানুষের অমন পায়রাক্ষমতা নেই, একবারেই কেলিয়ে পড়ে, তারপর আবার দম নিয়ে পায়রাবাজি করতে হয় । মানুষকে কেন এমন দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, তা এখনকার গণধর্ষণ, সোলোধর্ষণ, গ্রুপধর্ষণ, মেঠোধর্ষণ, মাচাধর্ষণ  ইত্যাদি দুঃসংবাদ থেকে আঁচ করতে পারি । মানুষকে সিংহের ক্ষমতা দিলে তারা ওই কাজকেই শিল্প বলে চালাতো । শিল্প নামের ভাঁওতাটাকে মানুষ বড়ো ভালোবাসে । 

    অভিজিত:—সিংহের কথা বলছিলেন যে ?

    মলয়:—হ্যাঁ, সিংহেরা পনেরো মিনিট অন্তর করে । ইম্যাজিন, পনেরো মিনিট অন্তর !

    অভিজিত:—আপনার আপশোষ হচ্ছে যে অমন সিংহত্ব আপনি পাননি । আপনি তো সিংহরাশি !

    মলয়:—যখন যোয়ান ছিলুম তখন হতো বটে ; এখন তো বুড়িয়ে গেছি । এমনিতেই হাঁপানি হয়, পনেরো মিনিট অন্তরের ব্যাপার হলে ফুসফুস গলার কাছে উঠে আসতো ; অবশ্য ছোটোবেলায় বাবা যদি সুন্নৎ করিয়ে দিতেন, তাহলে মনে হয় এলেমটা সময় বাড়িয়ে দিতে পারতো । যাকগে, পায়রাদের কথায় আসুন । পায়রা হল এই শহরের প্রাণী, যে পাড়াতেই যান, ঝাঁক-ঝাঁক পায়রা দেখতে পাবেন । অন্য ভারতীয়  শহরে এমন গোলা পায়রার পপুলেশান পাবেন না । সব শহরেরই নিজস্ব প্রাণী থাকে, সেখানকার মানুষেরা সেই প্রাণিদের চরিত্র পায়, প্রাণী না বলে রাজ্যেশ্বর-রাজ্যেশ্বরীও বলতে পারেন । এখানকার কবি আর ছবি আঁকিয়েদের দেখুন, পায়রা । ঝাঁকের মধ্যে জোড়ায়-জোড়ায় ; পায়রার তো সিংহদের মতন আলফা মেল নেই । দুটো পুংপায়রা গুঁতোগুঁতি করে ডিসাইড করে মাদি পায়রাটাকে কে পাবে; মাদি পায়রাটা আবার পরের গুঁতোগুঁতিতে জেতা পুংপায়রার সোহাগ খেতে ঢলে পড়ে । কবিতার চরিত্রও পায়রাদের মতন, দেখে বুঝতে পারবেন না কোন পায়রাটাকে সকালে সঙ্গম করতে দেখেছিলেন ।

    অভিজিত:—পায়রা ছাড়াও ইঁদুর তো প্রচুর এই শহরে ? বেরালের সঙ্গে তারা যুঝে যায়, এমন তাদের সাইজ ।

    মলয়:—হ্যাঁ, এই ইঁদুরগুলো পায়রাদের আক্রমণ করে, খায় । কর্পোরেশানের ইঁদুর মারার কর্মচারী আছে । এই বছর তারা নাকি প্রায় তিন লাখ ইঁদুর মেরেছে ; বর্ষায় ইঁদুরগুলোর জন্যে লেপ্টোস্পিরোসিসে প্রতিবছর শতখানেক লোক মারা যায় । ইঁদুরকেও প্রতিনিধিত্বকারী দেবী-দেবতার সিংহাসন দেয়া যায় পায়রাদের পাশাপাশি । জৈন আর গুজরাতি দোকানদাররা ইঁদুরগুলোকে মারে না ; তার ওপর প্রতিদিন আট হাজার টন জঞ্জাল খেয়ে ইঁদুরগুলোর সাইজ বেড়েই চলেছে, এই শহরের বৈভবশালীদের মতন ।

    অভিজিত:—পায়রাগুলো ঘরের ভেতরে যাতে না ঢুকতে পারে, ঘরের ভেতরে পিজনসেক্স করতে না পারে, তাই জানলায় গ্রিলমেশ লাগিয়েছেন ? পায়রাদের কারণে অ্যালার্জি হচ্ছিল বলে ? কিন্তু পায়রা তো শান্তির প্রতীক। 

    মলয়:—গ্রিলমেশ বিল্ডারের বসানো । শান্তির প্রতীক ছিল হয়তো এককালে ; এখন স্হানীয় লোকেরা অসৎ কাজকে বলে ‘ফাকতা ওড়ানো’ বা পায়রা ওড়ানো ; সম্ভবত মাগিবাজি করা থেকে এসেছে উক্তিটা । তবে পায়রা ঘরে ঢুকে পড়লে হয়তো নিজেই বসাতুম । তা ওদের সঙ্গমে বাগড়া দিতে নয় । ওরা তো দুই ইঞ্চ জায়গা পেলেও চট করে সেক্স সেরে নিতে পারে । হাঁপানিতে কাহিল হয়ে গেছি ।

    অভিজিত:—আপনি কি নিজেকে কখনও প্রশ্ন করে দেখেছেন যে আপনার শরীরের যাবতীয় রোগের, ইনক্লুডিং হাঁপানি, আসলে যৌবনে বেহিসাবি জীবনযাপনের কারণে ঘটেছে । যে সমস্ত মাদক নিতেন তা তো শ্বাসকে প্রভাবিত করে দেহের ভেতরে পৌঁছে প্রতিক্রিয়া ঘটানোর জন্য । নয়কি ? তখনকার বেলেল্লাপনার মাশুল দিচ্ছেন বলে মনে হয় না ?

    মলয়:—বলা কঠিন । হাঁপানির ডাক্তারকে বলেছিলুম আমার মাদকপ্রিয় যৌবনের কথা । উনি বললেন,  ধোঁয়ার কারণে আমার ফুসফুস আর হার্ট প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে । আমার হাঁপানির কারণ, ওনার মতে, সুগন্ধ । আমার শরীর সুগন্ধ সহ্য করতে পারে না । উনি ফুল শুঁকতে, যে ফুলেরা পরাগ ছড়ায় তাদের কাছে যেতে, সুগন্ধি সাবান আর পাউডার মাখতে, দেহে আর পোশাকে পারফিউম লাগাতে, রুম ডেওডোরেন্ট ব্যবহার করতে,  বারণ করেছেন । এমনকি রান্নার সময়ে ফোড়নের গন্ধ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন । ফুসফুস ভালোই আছে, অকসিজেন ইনটেক চেক করিয়ে দেখেছি । দ্বিতীয়ত আমার গা থেকে হরমোনের তিতকুটে গন্ধ বেরোয়না বলে আমায় পারফিউম ব্যবহার করতে হয় না । লিফটে অনেকসময়ে যুবতীদের গা থেকে একই সঙ্গে তিতকুটে হরমোনের দুর্গন্ধ, আর তার ওপর চাপানো বডি ডিওডেরেন্টের সুগন্ধ আমায় হাঁচিয়ে-হাঁচিয়ে কাহিল করে দেয় বেশ ; তরুণী দেখলে এড়িয়ে গিয়ে বলি, আপনি যান, আমি পরে যাবো । এই জন্যে কাঠমাণ্ডুতে হিপিনীদের আমার ভালো লাগতো ; ওরা দিনের পর দিন স্নান করতো না, গা থেকে স্বাভাবিক নারীগন্ধ পেতুম ।

    অভিজিত:—একটু আগে বলছিলেন, আপনার সঙ্গে যারা ইনটিমেট শত্রুতা করে তারা মরে যায় ? আপনি কি তার জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন ?

    মলয়:—নাহ, করি না । কারণ যারা মারা যায় তারা নিজের দোষেই মরে, আমার উপস্হিতি তাদের জীবনে আপনি  পাবেন না । যেমন এই গাছটা । আমি কিছুই করিনি, অথচ মরে গেল । গাছটাকে সারা বছর পছন্দ করতুম ওর সবুজের কারণে, কতোরকম সবুজ ছিল গাছটার স্টকে, প্রচণ্ড বৃষ্টি হলে বাফারের কাজ করতো, সামুদ্রিক ঝড়গুলোকে সামলাতো । কিন্তু বাধ সাধল ওর অত্যাকর্ষক ফুল আর তার সুগন্ধজনিত পরাগ ।

    অভিজিত:—আরও উদাহরণ আছে ?

    মলয়:—হ্যাঁ, ইনটিমেট বন্ধুবান্ধব যারা শত্রুতা করেছিল, এমনকি অগ্রজ সাহিত্যিকরা, তারাও একে-একে মারা গেল । অনেক সময়ে পরিচিত  ইনটিমেট কেউ মারা গেলে, অমি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই, ভাবি যে, ইনি কি আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছিলেন, যে মারা গেলেন ? ব্যাপারটা অদ্ভুত, কেননা আমি তো শত্রুতা করিনি, করছি না, কারোর সঙ্গে, কেনই বা করব । তারা করছে, তারা মারা পড়ছে । আমি প্রথম যে চাকরিটার ইনটারভিউ দিতে যাচ্ছিলুম, তা ছিল লেকচারারের । যাবার সময় একটা কাক গাছ থেকে হেগে দিয়েছিল আমার শার্টে ; উড়ে যেতে গিয়ে কাকটা ইলেকট্রিকের তারে ঠেকে গিয়ে ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর , অথচ কাকেরা সাধারণত ইলেকট্রিকের তার এড়িয়ে ওড়ে। তারপর থেকে আমি লেকচারারের আর স্কুল শিক্ষকের জন্য আর দরখাস্ত দিইনি ।

    অভিজিত:—আপনার মস্তিষ্কে এই দুর্ভাবনা এলো কোথ্থেকে ?

    মলয়:—আমি একবার গোরখপুরে ট্যুরে গিয়েছিলুম । সহযোগী আর স্হানীয় হোস্ট নিয়ে গেলেন গোরখনাথ মন্দিরে, ওই যেখানে পূণ্যার্থীরা ত্রিশূল দেয় পুজোয় । সেখানের চত্তরে একজন নোংরা জটাধারী সাধু হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে, মুখে দাড়ি ঘষে বলেছিল, “তোর সঙ্গে যে শত্রুতা করবে সে তোর আগে মরে যাবে।”

    অভিজিত:—আপনি এই সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন ?

    মলয়:—করি না, তবে মৃত্যুর ব্যাপারে দেখছি, এই ব্যাপারটা হ্যারি পটারীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

    অভিজিত:—মৃত্যু নিয়ে কবিতা লেখেননি কেন এখনও ?

    মলয়:—যাঁরা জানেন যে তাঁরা কালক্রমে অমর হবেন, তাঁরা সাধারণত লেখেন । খ্রিস্টধর্মীদের মধ্যে এপিটাফ লেখার চল আছে । সেই দেখাদেখি হয়তো আমাদের কবিরা মৃত্যুবোধ এনেছেন । আমি তো জানি আমি নশ্বর, তাই লিখিনি । তবে শবযাত্রা নিয়ে লিখেছি । একটা কবিতা লেখার ইচ্ছে আছে, সেটাও আমার শব নিয়ে । আমার অনুমান যে আমি এই ফ্ল্যাটটায় মরে পড়ে থাকবো, লোকে পচা গন্ধ পেয়ে পুলিশে খবর দেবে, পুলিশ এসে দরোজা ভেঙে দেখতে পাবে যে শবেতে ম্যাগটস ধরে গেছে আর তারা আমার পচা মাংস খেয়ে কিলবিল করছে । মানে, আমার মৃতদেহ থেকেও প্রাণের উদ্ভব সম্ভব।
     
    অভিজিত:—তা লিখে ফেললেন না কেন ?

    মলয়:—ম্যাগটের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি এখনও ।

    অভিজিত:—সব শহরের নিজস্ব প্রাণী থাকে বলছিলেন, আর সেই প্রাণীরা সেই শহরের চরিত্র নির্ণয় করে, সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির ঝোঁক গড়ে তোলে, কবি-শিল্পীরা তাদের চরিত্র পায়, মুম্বাইয়ের অভিনেতা-শিল্পী-কবিরা যেমন ইঁদুর আর পায়রার চরিত্র পেয়েছে, বলছিলেন । আপনার শৈশবের ইমলিতলায় কোন প্রাণী ছিল ?

    মলয়:—বিহারের পাটনা শহরের কথা বলছেন ? ইমলিতলার বাড়িতে বাঁদর আসতো, লালমুখো-লালপোঁদ বাঁদর, যাদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মানুষ, ওষুধ আর রোগের কারণ-নিদান আবিষ্কার করে । বাঁদরদের ব্যবহার করা হয়, মেরে ফেলা হয়, রোগে ভোগানো হয়, যাতে মানুষেরা ভালোভাবে বাঁচতে পারে । তারা অনেকটা কবিতার মতন রক্ত ঝরায়, কান্নাকাটি করে, ব্যথার সময়ে নিরাময়ের অভয় দেয়, দাঙ্গা আর যুদ্ধের সময়ে কাজে লাগে, তাদের পেট চিরে স্লোগান বের করা যায় ; তারা নিজেদের সমাজে সামাজিক প্রাণী, একে আরেকজনকে চুমু খায়, উকুন বেছে দেয় ; তারা একে আরেকজনকে বড়ো একটা খুন করে না যদি না তা দুজন আলফা মেলের জিজান লড়াই হয়, একপাল মাদি বাঁদর দখলের জন্যে । ওখানকার রাজনীতিকদের দেখুন, মেলাতে পারবেন । এক জাতের বাঁদরের সঙ্গে আরেক জাতের বাঁদরের তফাত বজায় রাখার চেষ্টা করে যায় তার আলফা গোষ্ঠীপতি ।

    অভিজিত:—কিন্তু আপনি যা বলছেন তা তো অন্য রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোয্য ।

    মলয়:—ওই যে বললুম, বাঁদর নানা জাতের হয় । ভারতে নাকি সাত রকমের বাঁদর আর ছয় রকমের হনুমান হয় । বাঁদরগুলো আপনি জানেন নিশ্চয়ই : রেসাস ম্যাকাক, বনেট ম্যাকাক, আসাম ম্যাকাক, অরুণাচল ম্যাকাক, বেঁটেলেজ ম্যাকাক, সিংহলেজ ম্যাকাক আর শুয়োরলেজ ম্যাকাক । আপনি খুঁজলেই এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভারতীয় রাজ্যগুলোর মানুষে পাবেন । এদের নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারা আছে । আপনি একে ঠাট্টা-ইয়ার্কি বলে মনে করবেন না ।
    অভিজিত:—যারা আলফা হতে পারে না সেই সব বাঁদরেরা কি স্বমেহন করে ?

    মলয়:—হ্যাঁ, এছাড়া আর উপায় কি বলুন ? স্বমেহন ছাড়া পুংবাঁদেরেরা পরস্পরকে ধর্ষণ করে, যাতে পরবর্তীকালে আলফা হয়ে উঠলে যন্তরটা অকেজো না হয়ে পড়ে ।

    অভিজিত:—বাঁদরদের কি নাইটফল হয় ?

    মলয়:—হয় না বলেই তো জানি । কিন্তু হওয়া তো উচিত । পুরুষমানুষের নাইটফল হয় শুক্রকীটগুলো মরে গেলে তাদের জেটআউট করার জন্য, স্টকে নতুন শুক্রকীট আনার জন্য । মানুষের যখন হয় তখন প্রাইমেটদেরও হওয়া উচিত ।

    অভিজিত:—নাইটফল নিয়ে কবিতা লেখেননি ?

    মলয়:—না, লেখা হয়নি । প্রেমিকার জন্য প্রেমের কবিতা লেখার দিকে খেয়াল যেতো । তবে আমার এক পাঠিকা, যিনি ‘মায়াজম’ নামে একটি ওয়েব পত্রিকা চালান, তিনি নাইটফল নিয়ে একটা অসাধারণ কবিতা লিখেছেন । তাঁর নাম সোনালী মিত্র । কবিতাটার নাম ‘নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা’ । পড়ে দেখুন :
    তখন রাতগুলো পরী-ভালোবাসায় ভরপুর
    হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আসা
    মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের দুই চাঁদ
    রাতে নাড়িয়ে দিলে গো । ঘুম, ঘুম  আসে না
    অস্হির, বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদি নয়
    ঠিক, ঠিক যেন ভাদ্রের মতো অবস্হান
    আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে
    বুঝলাম না……
    আর নাভি খাচ্ছে, আর কোমর ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে দাঁতে
    দরদর ঘাম ভিজে উঠছে গা
    থামবে না, এ-খাওয়া থামবে না
    সমস্ত বেডকভার ড্রেনড্রাইট চটচটে, আহা মায়াবী আঠা
    ক্রমশ কুকুরের গা-মোচড়ানো শিথিল হয়ে ওঠে
    ঘুম, ঘুম, ঘুম
    সকালে ভুলে যায় আস্ত একটা কুকুর নিয়ে আমার রাতের সংসার
    কেননা তখন আমাদের রাত্রির বুকে অবিবাহিতকলা
    কেননা তখন পায়জামার অন্ধকারে হাজার ওয়াট
    তখন আমার নিজস্ব রাতের নাম ছিল
    নাইটফল মেমারি

    অভিজিত:—তরুণীরা এই ধরণের কবিতা লিখতে পারছেন । আপনার কি মনে হয় যে আপনারা, মানে হাংরি আন্দোলনকারীরা,  ততোটা বোল্ড হতে পারেননি, যতোটা এখনকার যুবক-যুবতীরা পারছেন ।

    মলয়: —প্রতিদিনের জীবনযাপন আমার ভিন্ন ছিল । আমি তো আদপে একজন কালচারাল বাস্টার্ড । এখনকার তরুণ-তরুণীরা কবিতা লেখার সঙ্গে আমার মতন খোট্টাই জীবনযাপনকে মেলাতে চান না কিংবা হয়তো পারেন না । ইমলিতলায় বসবাসের ফলে আমার চরিত্রে বহু অবাঙালি বৈশিষ্ট্য বাসা বেঁধে ছিল, যাকে কেউ বলত বোহেমিয়ান, কেউ বলত ভ্যাগর‌্যান্ট ইত্যাদি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” পড়লে বুঝতে পারবেন । আমি বাড়ি থেকে কয়েকবার পালিয়ে গিয়েছিলুম স্কুলে পড়ার সময় ।

    অভিজিত:—আপনার বইগুলোয় এই “ছোটোলোক” শব্দটা জুড়ে দেন কেন ?

    মলয়:—ইমলিতলা পাড়াটাকে স্হানীয় বাঙালিরা বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া ; তাঁরা সাধারণত আমাদের বাড়িতে আসতেন না, এমনকি আমার স্কুলের বন্ধুরাও আসতো না, বলতো, শালা, তুই ওই ছোটোলোকদের পাড়ায় ক্রিমিনালদের সঙ্গে থাকিস ? পরে বাবা দরিয়াপুরে বাড়ি করলে আমাদের গা থেকে ছোটোলোক খেতাবটা খসে । কিন্তু মগজের ভেতরের ছোটোলোকটা তার ছোটোলোকমি নিয়ে রয়ে গেছে ।

    অভিজিত:—আমার ধারণা ছিল নিজের যৌবলাম্পট্যকে তুলে ধরার জন্য ছোটোলোক শব্দটার প্রয়োগ ।

    মলয়:—যৌবলাম্পট্য বলতে যা বোঝাতে চাইছেন, তেমনভাবে যৌবন কাটাইনি আমি । আমি লম্পট ছিলুম না কখনও, যদিও আমার এক প্রেমিকা আমাকে লেচার বলে ঘোষণা করেছিলেন । অথচ সে নিজেই আমাকে লাথি মেরে চলে গিয়েছিল।

    অভিজিত:—তারপর ?

    মলয়:—তারপরও আমি কখনও ফার্স্ট মুভ করিনি । প্রেমিকারা করেছিল ।

    অভিজিত:—প্রেমে টেকেননি তার মানে ?

    মলয়:—অনেক কারণে ছাড়াছাড়ি হয়েছে । আমিও ছেড়েছি, ঠিকই, একজনকে তার সুগন্ধ বিলাসীতার জন্য, আমার হাঁপানি রোগের দিকে তার খেয়াল ছিল না, সে নিজেকে এতো ভালোবাসতো যে নিজেতেই আটক থেকে গেল । বিদেশিনীও ডাক দিয়েছিলেন, আমি নিজে থেকে যাইনি । একজন অবাঙালি তরুণী হাত আঁকড়ে বলেছিল, “চলুন পালাই” । আমি পালাইনি বলে তিনি আত্মহত্যা করেন । যৌবলাম্পট্য থাকলে তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে, ব্যবহার করে, ফেলে চলে আসা যেতো । আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে পেরেছি, যখন ইচ্ছা হয়েছে, তখন । এমনকি, কবিতা লেখাও দেড় দশক ছেড়ে দিয়েছিলুম ।

    অভিজিত:—সোনাগাছি ?

    মলয়:—বন্ধুদের সঙ্গে গেছি, কিন্তু তা মূলত এলাকাটা সম্পর্কে অভিজ্ঞতার জন্যে । আমি কখনও কোনো যৌনকর্মীর সঙ্গে শুইনি । যৌনরোগ সম্পর্কে আমার প্রচণ্ড ভীতি আছে । আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আমি লিখেছি ব্যাপারটা । বাসুদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে লিখতে বলেছিল ‘বাঘের বাচ্চা’ পত্রিকা, তাতেও একটা ঘটনা লিখেছি । ডেভিড নামে একজন বিদেশী এসেছিল ষাটের দশকে ; সে বললে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে চায় ; কয়েক দিনের মধ্যে তো প্রেমিকা পাওয়া সম্ভব নয়, তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । 

    অভিজিত:—এই আলোচনাকে বিরতি দেয়া যাক । এবার বলুন, পশ্চিমবঙ্গের প্রাণীদেবতা আইডেনটিফাই করতে পেরেছেন।

    মলয়:—ওটা তো সেল্ফডিক্লেয়ার্ড প্রাণীদেবতা ।

    অভিজিত:—কোন প্রাণী ?

    মলয়: —কেন ? বিড়াল, ষষ্ঠীর বাহন ।

    অভিজিত: —একটু বুঝিয়ে বলুন প্লিজ ।

    মলয়:—টি এস এলিয়ট বলেছেন বিড়ালেরা স্বভাবে খুঁতখুঁতে, ব্যস্ততার ভানকারী, আর দলবদলু । রয়াল ভেটেরিনারি কলেজের অধ্যাপক ডক্টর অ্যালান উইলসন পঞ্চাশটা বিড়ালকে জিপিএস আর কলার ক্যাম বেঁধে যে তথ্য যোগাড় করেছেন তা থেকে জানা যায় যে বিড়ালেরা অত্যন্ত চতুর আর বিশ্বাসঘাতক । যে পুষেছে তার কোলে বসে যেমন আদর খেতে-খেতে এপিগ্লোটিস-ল্যারিংস ব্যবহার করে আরামের গরগরানি ওগারায়, তেমনই ওগরাবে অন্য কেউ কোলে তুলে নিলে ; অন্যের আদর আর খাবার পেয়ে ততোটাই খুশি হয়, যতোটা মালিকের । মালিক যদি টেবিলের ওপরে মাছ আর দুধ রেখে নিজের পোষা বিড়ালকে খেতে বারণ করে বাইরে বেরোয়, তবুও খেয়ে নেবে । আজ্ঞাবাহক পোষা কুকুরের বিপরীত চরিত্র ।

    অভিজিত:—এগুলো বাঙালির চরিত্রে পাওয়া যায় বলছেন ?

    মলয়:—দেখুন না, শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে গেল কেন ? ডিসলয়ালটির কারণে । চটকলগুলো লাটে তুলে দিলে বিড়াল-শ্রমিকনেতারা । নতুন দল সিংহাসনে বসতেই লুমপেনরা লাল থেকে সবুজে চলে গেল কেন ? শুধু লুমপেনরা নয়, কবি-লেখক-নাট্যকার-অভিনেতারাও । স্লোগানের গরগরানিতে কোনো পরিবর্তন নেই । গরিবের রাখা মাছ-দুধ খেতে কোনো আপত্তি নেই বিড়ালদের, পনজি স্কিমগুলোর কর্তাদের কাজকারবারের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন । পশ্চিমবঙ্গের সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে লুমপেনদের পিরামিড ।

    অভিজিত:—কিন্তু কুকুরেরা কি অন্যের দেয়ালে গিয়ে মোতে না ? মুতে-মুতে এলাকা চিহ্ণিত করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতন । দেয়ালে স্লোগান লেখার জন্য আগাম হুঁশিয়ারি বলতে পারেন একে ।

    মলয়:—করে কিন্তু তারা নিজের মালিকের প্রতি লয়াল থাকে । বিড়ালের মতন দলবদলু নয় ।

    অভিজিত:—আপনি তো পশ্চিমবঙ্গের, আপনার মধ্যেও তাহলে বিড়ালের বৈশিষ্ট্য আছে ?

    মলয়:—একটু আগেই বলেছি যে আমি হাইব্রিড, বর্ণসংকর, কালচারাল বাস্টার্ড । আমার মধ্যে সবরকম প্রাণীর বৈশিষ্ট্য পাবেন । বাঘ সিংহ হাতি গণ্ডার জিরাফ জেব্রা জাগুয়ার চিতা হায়েনা অক্টোপাস অ্যানাকোণ্ডা প্যাঁচা উটপাখি চিল শকুন, সমস্ত প্রাণীর ।

    অভিজিত:—হাতি ? হাতির মতন লিঙ্গ পেয়েছেন তাহলে । মাটিতে ঠেকেছে কি কখনও ?

    মলয়:—তাহলে একটা ঘটনা বলি আপনাকে । হাংরি আন্দোলনের সময়ে একজন বিদেশি এসেছিলেন, আমাকে আগেই জানিয়েছিলেন । আমি তা সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষকে জানিয়ে ওদের বললুম যে চলে এসো হোটেলটায় । টাইম ম্যাগাজিনে আমাদের সংবাদ প্রকাশিত হবার পর বিদেশি কবিলেখকরা প্রায়ই আসতেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে । সেসময়ে তো স্নানের অসুবিধা ছিল আমার, কেননা কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । কখনও সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানে থাকতুম, কখনও হারাধন ধাড়ার হাওড়ার বস্তিবাড়িতে, আবার কখনও আমাদের উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খণ্ডহরে । হোটেলটায় বাথরুমটা বেশ বড়ো ছিল । আমি পোশাক ছেড়ে উলঙ্গ ঢুকে পড়লুম ; আমার পেছন-পেছন, সেই বিদেশি ছাড়া, সবাই পোশাক ফেলে উলঙ্গ ঢুকে এলো । ভালো সাবান শ্যাম্পু ছিল, একে আরেকজনকে মাখিয়ে হুল্লোড় করে স্নান করা হলো । সবাই স্বীকার করল যে আমার লিঙ্গই মাপে সবার চেয়ে বড়ো । সুভাষ ঘোষের লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে বাসুদেব দাশগুপ্ত বলেছিল, “যাক সুভাষের লিঙ্গ আমার চেয়ে ছোটো”, তার জবাবে সুভাষ বলেছিল, “আমি এখনও ভার্জিন, বুঝলে, এখনও ফুল খোলেনি, একবার খুলে যাক, তারপর সবাইকে দেখিয়ে দেবো”।

    অভিজিত:—তাহলে তো স্বীকার করতে হয় যে কবিতা, কল্লোল, কৃত্তিবাস, ধ্রুপদি, শতভিষার কবিদের থেকে আপনারা একেবারেই আলাদা । ওই দশকগুলোর কবিরা অমন চিন্তা করলেও আঁৎকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন । সরকার যে আপনাদের আলাদা করে চিহ্ণিত করেছিল, তা অন্তত চিহ্ণিত করার ব্যাপারে ভুল করেনি ।

    মলয়:—আরেকবার, সুবো আচার্যের বাড়ি গিয়েছিলুম, বিষ্ণুপুরে, আমি, ত্রিদিব মিত্র আর সুবিমল বসাক । আমরা হাঁটতে-হাঁটতে বেরিয়ে পড়লুম, ধানখেতের মধ্যে দিয়ে, একটা নদী এলো, নাম ভুলে গেছি, কোমর পর্যন্ত জল, প্যাণ্ট-শার্ট-গেঞ্জি খুলে উলঙ্গ পার হলুম নদী, পেরিয়ে একটা গাছতলায় বসে পাতা ফোঁকা হলো । তখনও ওরা স্বীকার করেছিল যে আমার সাইজ বড়ো ।

    অভিজিত :—ভাগ্যিস নিজেদের নিয়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ টাইপের উপন্যাস লেখেননি । অভিনেতাদের উলঙ্গ হয়ে অভিনয় করতে হতো । 

    মলয়:—আমার মনে হয়, আপনি পরের প্রজন্মগুলোতেও আমাদের মতন চরিত্র পাবেন না । স্বমেহন-মুখমেহন প্রসঙ্গ তাঁদের লেখায় আসে বটে, কিন্তু নিজেরা করেছেন কিনা জানতে দেন না । জোট বেঁধে উলঙ্গ হুটোপাটিও করেননি বা করেন না বলেই মনে হয় ।

    অভিজিত:—আপনি ম্যাস্টারবেট করেছেন ?

    মলয়:—অবশ্যই করেছি । নিজেকে ভালোবাসবার কায়দাটা বাৎসায়ন শিখিয়ে দিয়ে গেছেন । খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর ইসলামধর্মাবলম্বীরা আসার পর স্বমেহন “খারাপ কাজ”-এর তকমা পেয়ে গেল । আমরা বলতুম “হাত-মারা” । এখন তো হাত-মারার সুবিধের জন্য বাজারে গোপনে সিনথেটিক নারী-অঙ্গ বিক্রি হয় ; পকেটে নিয়ে ঘোরা যায় । মেয়েদের জন্য ডিলডো আর ভাইব্রেটর বিক্রি হয় । যদিও আইনি পথে ওগুলোর আমদানি নিষিদ্ধ । জেমস জয়েসের সময়ে বাজারে এলে ‘ইউলিসিস’-এ উনি হাত-মারার দৃশ্যটায় প্রয়োগ করতেন হয়তো ।

    অভিজিত:—শুরুর দিকের কথায় আসি । সেসময়ে আপনার যেমন বিরোধীতা হয়েছিল তেমন কি এখনও হয় ?
    মলয়:—হয় বৈকি । তবে সারেপটিশাসলি । যাঁরা বিরোধীতা করেন তাঁরা দেখছেন যে বিবিসি থেকে, ইতালি থেকে, জার্মানি থেকে, আমেরিকা থেকে সাংবাদিক আর গবেষকরা আমাদের খোঁজে আমার কাছে আসছেন, অন্য গোষ্ঠীদের কাছে যাচ্ছেন না, তাই বিরোধীতাটা সাবডিউড ? অনেকে আবার তাঁদের মনগড়া ইমেজের সঙ্গে আমাকে মেলাতে না পেরে বিরোধীতা করেন ; তাঁরা ফেসবুকে নিজেদের মগজ থেকে গোবর বের করে আমার দেয়ালে সুযোগ পেলেই ঘুঁটে দিয়ে যান ।

    অভিজিত:—যেমন ?

    মলয়:—কয়েক মাস আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় শৈলেন সরকার নামে এক ছোকরালোচক প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত আর প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “হাংরি সাহিত্য আন্দোলন, তত্ব, তথ্য, ইতিহাস” বইটা রিভিউ করার সময়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে শিরোনাম দিলেন, “তিনিও কি সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নেননি” । শৈলেন সরকারের বক্তব্য ছিল যে, “তিনি জানতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর রচিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ কবিতাটিকে পছন্দ করেননি এবং সব জেনেও কেন মলয়বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে করে তাঁর খারাপ লাগা কবিতাটিকে বিচারকের সামনে ভালো বলে শংসাদানে অনুরোধ করেছিলেন ? নিজে বাঁচার জন্য বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অন্যকে মিথ্যে সাক্ষী দিতে বলাটা কি কম সুবিধাবাদ ?” ছোকরালোচক শৈলেন সরকার ওই বইতেই আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠিটা ( পৃষ্ঠা ১৪৭ ) পড়ে দ্যাখেনি যেখানে সুনীল বলছেন যে কবিতাটি উনি প্রথম পড়লেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । তার আগে তিনি কবিতাটি পড়েননি ।

    অভিজিত:—প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার ? কুঠার নাকি ! কবিতার শিরোনাম তো প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

    মলয়:—শৈলেন সরকার বারবার কবিতাটাকে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার বলে উল্লেখ করেছেন । কিছুদিন পরে নদীয়া থেকে একজন পাঠক প্রতিবাদ করে সম্পাদকের চিঠিতে লেখেন যে কবিতাটার শিরোনাম প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার । প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার নয় । ছোকরালোচক শৈলেন সরকার যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই । এই কবিতাটির নাম জানেন না এমন  কবিতা পাঠক নেই বলেই মনে হয় ।

    অভিজিত:—এমনও তো হতে পারে যে পাঁচশো পৃষ্ঠার বই পড়ার মতন সময় ছিল না ওনার হাতে ।
     
    মলয়:—তা ঠিক । উনি বইটা পড়েনইনি । কেননা বইতে স্পষ্ট লেখা আছে যে ‘হাংরি’ শব্দটা আমি পেয়েছিলুম জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে । ছোকরালোচক শৈলেন সরকার লিখে দিলেন যে, “ইতিহাসের দার্শনিক স্পেংলারের এই বইয়ের একটি লাইন ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকেই পাটনার মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের আন্দোলনের নাম ঠিক করেন ‘হাংরি জেনারেশন’ ।” আমরা ১৯৬১ সালে ঘোষণা করেছিলুম “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত” ; ছোকরালোচক শৈলেন সরকার তার দু দশক পরে প্রকাশিত ল্যারি সিনারের ‘দ্য মডার্ন সিস্টেম অব আর্ট’ বইতে আমাদের ঘোষণার সমর্থন যোগাড় করেছেন, কেন জানি না ।

    অভিজিত:—আরও উদাহরণ ?

    মলয়:—এই কয়েকদিন আগে আবীর মুখোপাধ্যায় নামে জনৈক ছোকরালোচক শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে, ওই সংবাদপত্রেই, লিখে ফেলল যে হাংরি ম্যানিফেস্টোগুলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ! ছোকরালোচক অ্যালেন গিন্সবার্গকেও হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে দিলেন ।

    অভিজিত:—রিয়ালি ? কেউ কেউ আপনার সম্পর্কে ইমেজ গড়ে ফেলে আপনার আচরণের সঙ্গে তাকে মেলাতে পারছেন না বলছিলেন যে ? মগজের গোবর দিয়ে ঘুঁটে মারার কথা ?

    মলয়:—আমার বই তো এতোকাল পাঠকের হাতে পৌঁছোতোই না । বাংলাদেশে এই সবে পৌঁছোতে আরম্ভ করেছে, তাও কেবল ঢাকায়, আমি ফেসবুকে আমার বইয়ের প্রচার চালাবার পর । কলকাতায় ধ্যানবিন্দুর দরুণ পাঠকদের হাতে পৌঁছোচ্ছে, মফসসলে এখনও পৌঁছোয়নি । যেহেতু আমি আমার বইগুলোর প্রচার করি তাই তাঁরা চটা । তাঁরা বুঝতে পারেন না যে আমার সঙ্গে কলকেতিয়া মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের  তুলনা হতে পারে না । আমার বাবা-মা কখনও স্কুলে পড়েননি, কার্ল মার্কসের একটা ছবি প্রথমবার দেখে বাবা জিগ্যেস করেছিলেন, “এই বুড়োটা আবার কে রে ?” কুড়ি জনের সংসারে বাবা ছিলেন প্রধান রোজগেরে ; বড়োজ্যাঠা জীবন আরম্ভ করেছিলেন ক্লাস ফোর স্টাফ হিসাবে । ইমলিতলা থেকে আমি মধ্যবিত্ত বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে বেরোইনি । বেশ হাতপা ছুঁড়ে ফুঁড়ে বেরোতে হয়েছে সেখান থেকে ।

    অভিজিত:—উনি সোভিয়েত দেশের সংবাদ রাখতেন না ?

    মলয়:—উনি রাশিয়ার কথা জানতেন, সোভিয়েত দেশ বলে যে কিছু আছে তা-ই জানতেন না । বাবার দৌলতে বা দলের দৌলতে আমি রাশিয়া-চিন-কিউবা যাইনি, বিদেশীদের টাকায় কোথাও যাইনি ।   
     
    অভিজিত:–এখন তো আর আপনার বিরোধীতা হয় না । আপনার লেখার একটা পাঠকসমাজ গড়ে উঠেছে ।

    মলয়:–কে বললে হয় না ! ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা কবিতা চেয়েছিল ; আমি এই কবিতাটা পাঠিয়েছিলুম, ওনারা রিজেক্ট করে দিলেন । শুনুন, কবিতাটার শিরোনাম ‘আমার ঠাকুমাকে যেন বলবেন না’ ।
    উনি আমাকে পছন্দ করতে বারণ করেছিলেন
    আপনি কেন করছেন, নীরা ?
    আমি আজো শুঁয়োপোকা-ঠাশা ঈশান মেঘে চিৎসাঁতার দিই
    উনি পঞ্চাশ বছর আমার কাছে কবিতা চাননি
    আপনি কেন চাইছেন, নীরা ?
    আমি আজো জলের দশপা গভীরে দাঁড়িয়ে বরফের লাঠি চালাই
    উনি আমার সাবজুডিস মামলায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন
    আপনি সম্পাদক হয়ে কেন লেখা চাইছেন, নীরা ?
    আমি আজো স্মোকড পেংগুইনের চর্বির পরোটা খেতে ভালোবাসি
    উনি আমার কবিতার বইয়ের প্রকাশক হয়েও স্বীকার করেননি
    আপনি কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নীরা ?
    আমি আজো দুপুর গেরস্হের হাঁমুখে সেঁদিয়ে ফ্যামিলিপ্যাক হাই তুলি
    উনি আমার নাম উচ্চারণ করতে চাইতেন না
    আপনি কেন তরুণদের কাছে করছেন, নীরা ?
    আমি আজো রক্তঘোলা জলে টাইগার শার্কদের সঙ্গে বলিউডি নাচে গান গাই
    উনি বলেছিলেন ওর মধ্যে সত্যিকারের লেখকের কোনো ব্যাপার নেই
    আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
    আমি ইমলিতলায় জানতুম কাঠকয়লা ছাড়া ইঁদুরপোড়ায় স্বাদ হয় না
    উনি বলেছিলেন ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই
    আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
    আমি অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্কনোট পুড়িয়ে মড়ার গন্ধ পেয়েছি
    উনি বলেছিলেন ওর দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না
    আপনি কেন মনে করছেন হয়েছে, নীরা ?
    আমি আমস্টারডমের খালপাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকরা বুড়োদের লিরিক শুনেছি
    উনি সেসময়ে দুঃখ থেকে রাগ আর রাগ থেকে বিতৃষ্ণায় উঠছেন
    আপনি এত উদার কেন, নীরা ?
    আমার ঠাকুমাকে যেন প্লিজ বলবেন না ।

    অভিজিত:—এটা তো রিজেকশান নয় ; এটা চ্যালেঞ্জ ছিল, ওনারা অ্যাকসেপ্ট করতে ভয় পেয়েছিলেন । আদারওয়াইজ, সুরজিত সেন যেমন আপনাকে বলেছিলেন, ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের জন্য আপনার একটা হিরোমার্কা ফোটো দিতে, এই কারণে যে পাঠকদের চেয়ে আপনার নাকি পাঠিকার সংখ্যা বেশি, দুই বাংলাতেই । ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্যও বলছিলেন যে বই মেলায় আপনার বই কিনতে ওনার স্টলে পাঠিকা-ক্রেতাই বেশি আসেন । 

    মলয়:—শুনেছি ।

    অভিজিত:—আপনি এই বয়সেও ফ্লার্ট করেন ?

    মলয়: —তা করি, ভালো লাগে, রিডিমিং মনে হয় ।

    অভিজিত:—ওপার বাঙালির তরুণীদের সঙ্গেও ?

    মলয়:—হ্যাঁ, ওপার বাংলায় সুন্দরী পাঠিকাদের সংখ্যা বেশি । যৌবনে যদি ওপার বাংলায় যেতুম তাহলে আমিও বোধহয় কবীর মলয় হয়ে ন্যাড়া মাথায় ফিরতুম । প্রথমত সুন্দরী আর দ্বিতীয়ত ওনারা রাঁধেন ভালো ।

    অভিজিত:—আপনি কি পেটুক ?

    মলয় :—এককালে ছিলুম, এখন দেখে লোভ হয় কিন্তু শরীরের দরুণ ডাক্তারের নানা বিধিনিষেধের কারণে কুরে-কুরে খেয়ে সন্তুষ্ট হতে হয় । ভূমেন্দ্র গুহ অবশ্য বলেছেন যে এক-আধ বার খাওয়া চলে ; তাই খেয়ে নিই । ইউরোপে গিয়ে সব রকমের মদ আর বিয়ার খেয়ে এসেছি । 

    অভিজিত:—আপনারা দল বেঁধে খালাসিটোলায় যেতেন, মাতাল হতেন কি ?

    মলয়:—আমি কখনও মদ খেয়ে মাতাল হইনি । একবার শুধু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম বেনারসে, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় গাঁজা-চরস-আফিমের কনককশান তৈরি করে ফুঁকিয়েছিল, তখন । তাছাড়া আমি কখনও নেশা করে পোঁদ উল্টে পড়িনি, সুভাষ ঘোষ যেমন পড়ত । আটের দশক পর্যন্ত গাঁজা-চরস-আফিম সরকারি দোকানে পাওয়া যেতো, সত্যমেব জয়তে ছাপ মারা । আমেরিকার চাপে বেআইনি হয়ে গেল । কুম্ভ মেলায় কিন্তু যতো ইচ্ছে কিনতে পাওয়া যায় ।
    অভিজিত:—আপনার কোন নেশা ভালো লাগে ? মদ না গাঁজা-চরস-আফিম ইত্যাদি ?

    মলয়:—এগুলোকে নেশা বলা ভুল । এই জিনিসগুলো মগজে ঢুকে মধ্যবিত্ত রাবীন্দ্রিক ভাষার একচেটেপনাকে ভেঙে দিতে পারে , এমনিতেই কালচারাল বাস্টার্ড হবার দরুণ ভাষার মনোপলি আমার ওপরে তেমন কাজ করে না । এখন শুধু সিংগল মল্ট খাই, কিন্তু মাদকের ব্যাপারে এককালে আমার প্রিয় ছিল গাঁজা আর চরসের মিক্সচারের ধোঁয়া । যাবতীয় সামাজিক মনোপলিকে মগজের মধ্যে ভেঙে ফেলতে পারে ওটা । ধোঁয়া ফুঁকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান, মিছিল দেখলে মনে হবে ভেড়াদের চরাতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের মালিক, এটাই মাদকের ক্রিয়েটিভ দিক ; বহু মানুষের মুখকে মনে হবে কুমিরের হাঁ-করা মুখ, ভাষণকে মনে হবে হায়েনার ডাক ।

    অভিজিত:—মাদকের অভ্যাস কেমন করে হয়েছিল ?

    মলয়:—কেন ? ইমলিতলা পাড়ায় । কেউই ব্যাপারটাকে খারাপ মনে করত না । পাড়ার অগ্রজরা তাড়ি সোমরস গাঁজা ভাঙ সবই শেয়ার করতে চাইতেন । এমনকি বিয়ের বরযাত্রিদেরও তাড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো । দোলের দিন তো সমস্ত সীমা ভেঙে পড়ত । সেই দিনগুলো দারুন ছিল ।

    অভিজিত:—ছাড়লেন কেন ?

    মলয়:—মাদক নিয়ে সিরিয়াসলি লেখালিখি করা যায় না । এমনকি সিংগল মল্ট খেয়েও লিখতে ব্যাঘাত হয় ।

    অভিজিত:—ভাষার মনোপলির কথা বলছেন । সংবাদপত্রগুলো আর কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকারা ভাষাকে মনোপলাইজ করে ফেলেছে, সাধারণ মানুষের ভাবনাচিন্তাকেও ওই ভাষা দিয়ে দখল করে নিচ্ছে । তাই না ? 

    মলয়:—আমি তাই সংবাদপত্র আর কমার্শিয়াল পত্রিকা পড়ি না । তিরিশ বছরের বেশি হয়ে গেল । কোনো কিছু জানাবার থাকলে কলকাতা থেকে কোনো পাঠক বা সম্পাদক কাটিং পাঠিয়ে দেন । 

    অভিজিত:—টিভি দেখেন না ?

    মলয়:—অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, ডিসকভারি, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক ইত্যাদি দেখি ।

    অভিজিত:—ফিল্ম দেখেন না ? এক্সপেরিমেন্টাল কবি-লেখকরা তো ফিল্ম টেকনিকের সাহায্য নেন ।

    মলয়:—না, আমি ফিল্ম বড়ো একটা দেখি না । বই পড়ার সময় যেমন কোনো চিন্তাভাবনা এলে মুড়ে রেখে চিন্তাটার প্রসার ঘটাতে থাকা যায় মগজে, ফিল্মে তেমন হয় না । ফিল্ম আমি দেখেছি যৌবনে, মূলত নায়িকাদের যৌন আকর্ষণের কারণে । সুতরাং ফিল্মের কোনো টেকনিক আমার লেখায় প্রয়োগ করার প্রশ্নই নেই । 

    অভিজিত—আপনার লেখার আঙ্গিকে যথেচ্ছাচার তাহলে আনেন কী করে ?

    মলয়:—যা মনে আসে তাই করি, আর তার জন্য কোনো যুক্তি খাড়া করার দরকার আছে বলে মনে করি না । অনেকসময় ওটা আপনা থেকে মাথায় চলে আসে, যেমন “নখদন্ত” বা “ঔরস” ফিকশানে, কিংবা “টাপোরি”, “ইচ্ছাপত্র”, “গুমরাহীবাঈ-এর সন্ধ্যা” আর “ব্লাড লিরিক” কবিতায়।

    অভিজিত:—কোন অভিজ্ঞতায় আপনি সবচেয়ে বেশি থ্রিলড ?

    মলয়:—গুলি চালানোয় । আমি এনসিসিতে থ্রিনটথ্রি, বারো বোর আর স্টেনগান চালিয়েছি । তখন এখনকার মতন রেসট্রিকশান ছিল না । প্রতিদিন চালানো যেতো । বিন্দেশ্বরী প্রসাদ নামে এক বিহারি বন্ধুর গ্রামে গিয়ে ডাবল ব্যারেল গান আর পিস্তল চালিয়েছি । 

    অভিজিত:—আপনি নাকি বেহালা বাজাতেও শিখেছিলেন ?

    মলয়:—হ্যাঁ, বেহালা শিখছিলুম, প্রেমে পড়ে সব গোলমাল হয়ে গেল । তার চেয়ে গিটার বাজাতে শিখলে ততো দিনে শিখে ফেলতুম । 

    অভিজিত:—কিন্তু আপনার বাবা ওনার বন্ধুদের নাকি বলতেন যে কুসঙ্গে পড়ে আপনি বেহালা বাজানো ছেড়ে দিয়েছিলেন।

    মলয়:—বাবা কুসঙ্গ বলতে নমিতাদির কথা বলেছেন, নমিতা চক্রবর্তী, যিনি আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে সুমিতাদি । মা মনে করতেন যে আমার কুসঙ্গ হল বিহারি বন্ধুরা, যাদের ফোটো আপনি দেখতে পাবেন বিবিসি রেডিও প্রোগ্রামের ফোটোটায় ; তাদের প্রায় সকলের গ্রামে গাঁজা আর পোস্তর গাছ ছিল, সহজেই পাওয়া যেতো ভালো কোয়ালিটির গাঁজা আর আফিম । এরা সকলেই হাইকোর্টের জজ, অধ্যাপক, আই এ এস, আই পি এস, ডাক্তার, ইনজিনিয়ার, গবেষক ইত্যাদি হয়ে অবসর নিয়েছে ; আমার স্নাতকোত্তর রেজাল্ট কিন্তু ওদের সবায়ের চেয়ে ভালো ছিল । আসলে আমার কোনো উচ্চাকাঙ্খা ছিল না । আমি কবিতার কুসঙ্গে পড়ে গিয়েছিলুম, ওরা পড়েনি । উল্টোটাও হয়েছে, ফালগুনী রায়ের দিদি এসে আমার মাকে বলে গিয়েছিলেন যে আমার কুসঙ্গে পড়ে ফালগুনী রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।

    অভিজিত:—আচ্ছা, কবিতা বললে আপনার মনে কোন ছবি ভেসে ওঠে ?

    মলয়:—এটা ভালো প্রশ্ন । কবিতা বললেই একটা ঘটনা মনে পড়ে । হাংরি আন্দোলনের সময়ে কবিতা ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরোজায় রিং দিয়েছি । বুদ্ধদেব বসু দরোজা খুলতেই আমি বললুম, আমার নাম মলয় রায়চৌধুরী, উনি সঙ্গে-সঙ্গে দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন । আমি ভাবলুম হয়তো খুলবেন, প্রায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে রইলুম, খুললেন না । ওনার সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম আর শেষ দেখা । অথচ তার আগে উনি বদল্যার সম্পর্কে বই লিখে ফেলেছেন, বিট আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছেন বাঙালি পাঠকদের জন্য ।

    অভিজিত:—বদল্যার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোও যদি ওনার কবিতাভবনের দরোজায় অমন আনইনভাইটেড টোকা দিতো, তাহলেও হয়তো ওই ভাবেই তাদের বিদায় করতেন ।

    মলয়:—হয়তো । নিজেকে প্রস্তুত করে উনি বোধহয় ওনাদের মুখোমুখি হতেন । চরিত্রের দিক থেকে বিদেশি ছিলেন ভদ্রলোক, আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে তারপর দেখা করতেন । তাছাড়া, তখন তো প্রতিদিন স্নান করতুম না, জামাও পালটাতুম না ।

    অভিজিত:—এরকম অভিজ্ঞতা আরও হয়েছে ?

    মলয়:—মিছিলে উৎপল দত্তের হাতে একটা হাংরি বুলেটিন দিয়ে নিজের নাম বলতেই উনি আঁৎকে উঠে বুলেটনটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, “হাংড়ি জিন্নাড়েশন !” তারপর হনহনিয়ে মিছিলে এগিয়ে গেলেন ।

    অভিজিত:—আর ?

    মলয়:—আবু সয়ীদ আইয়ুবের বাড়ি গিয়েছিলুম । তখন জানতুম না যে পুলিশে যারা কমপ্লেন করেছেন উনি তাঁদের অন্যতম । উনি আমাদের আন্দোলন নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতে চাইলেন না ; ভারতের মুসলমানদের প্রসঙ্গে আমাদের মতামত জানতে চাইলেন । আমি কুলসুম আপার সঙ্গে আমার শৈসবে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা বলতে গম্ভীর হয়ে গেলেন । 

    অভিজিত:—এগুলো আপনাকে প্রভাবিত করেনি ?

    মলয়:—এর চেয়ে বরং এক ন্যুড মডেল অ্যাপ্রুভ করার জন্য সমীর রায়ের সঙ্গে গিয়ে প্রভাবিত বোধ করেছিলুম। বয়স পঁছিশ-ছাব্বিশ হবে । একজন আর্টিস্ট তার স্তনে সবুজ রঙ করে দিয়েছিল । মনে হচ্ছিল খাবার মতন হিমসাগর । 

    অভিজিত:—আপনি তো সেক্সিস্ট বুল, দেখেই আপনার দাঁড়িয়ে গিয়ে থাকবে ?

    মলয়:—হ্যাঁ, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দাড়িয়ে গেল, বুঝতে পারলুম যে আমার দ্বারা পেইনটিঙ সম্ভব হতো না । একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অনিল করঞ্জাইয়ের বেনারসের স্টুডিওয় এক নিউড বিদেশিনীকে দেখে । এই বিদেশিনীকে আপনি পাবেন আমার “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে । 

    অভিজিত:—ওটা তো অলমোস্ট পরনোগ্রাফি ।

    মলয়:—অনেকে তাই বলেন বটে । ওতে একটা প্যারা ছিল লাবিয়া ম্যাজোরায় হিরের মাকড়ি পরানো সম্পর্কে ; তা বাদ দিয়ে দিই কেননা ওটা তাহলে খোলার ঘটনা বর্ণনা করতে হতো । উপন্যাসটা লিখতে বসে, তখন হাতে লিখতুম, কমপিউটারে নয়, আমি দৈহিক আনন্দ উপভো্গ করছিলুম । ঠিকই বলেছেন, সেস্কিস্ট বুল হয়ে গিয়েছিলুম লিখতে বসে । হিমসাগর স্তনের যুবতীকে নিয়ে একটা লেখা ঘুরছে মাথায় ।

    অভিজিত:—আপনার রেপ করতে ইচ্ছে হয় না ?

    মলয়:—না, না । আমি অত্যন্ত ডেলিকেট আর সেনসিটিভ; যার তার সঙ্গে শুতে পারি না । ফার্স্ট মুভ আমি কখনই করিনি । রেপ ব্যাপারটা শরীরের দিক থেকে নোংরা । আজকাল দিকে-দিকে এতো রেপিস্ট গজাচ্ছে শরীর নোংরা হবার দরুণ । নোংরা শরীরে ভরে গেছে সমাজ । পুরুষ মানুষ ভুলেই গেছে যে শরীর একটা ইন্দ্রজালের ওয়র্কশপ । বেশিরভাগ দম্পতি মিশনারি পোজের বাইরে কিছুই জানে না । 

    অভিজিত:—আপনি হাংরি আন্দোলনের আগে ফাক, শিট, আসহোল, সান অফ এ বিচ, মাদারফাকার, কান্ট, ডিকসাকার ইত্যাদি গালাগাল দিতেন বন্ধুদের ?

    মলয়:—হ্যাঁ দিতুম । তবে ইমলিতলায় গ্রুমিঙের কারণে হিন্দি গালাগালই বেশি প্রয়োগ করতুম । সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করতুম “চুতিয়া” আর “ভোঁসড়িকে জনা” । আমি কখনও রাগিনি, তাই রেগে গিয়ে গালপাড়ার স্তরে উঠিনি কখনও । বন্ধুরা রাজসাক্ষী হয়ে গেলেও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলুম, ওরাই পালিয়ে গিয়ে দল বেঁধে ওদের পত্রিকা থেকে আমাকে বাদ দিয়ে দিলে । আমার পাশাপাশি সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র আর দেবী রায়কেও বাদ দিয়ে দিলে । অথচ সম্পাদক বাসুদেব দাশগুপ্ত ঘোষণা করেছিল “আমার ক্ষুধা ছিল মানুষের সার্বিক মুক্তির ক্ষুধা”। সার্বিক মুক্তি কেমন করে সম্ভব কে জানে যখন আপনি নিজের বন্ধুদেরই আপনার পত্রিকায় ল্যাঙ মেরে বের করে দিচ্ছেন । হাংরি আন্দোলন তো কাউকে বাদ দেবার আন্দোলন ছিল না ।

    অভিজিত:—আপনার কি মনে হয় ওনাদের এই বিভাজন প্রচেষ্টা হাংরি আন্দোলনের ক্ষতি করেছে ?

    মলয়:—নিশ্চয়ই, অনেকে এটাকেই আলোচনার বিষয়বস্তু বানিয়ে ফ্যালে । যাকগে, বিষয়ান্তরে যাওয়া যাক ।
     

    অভিজিত:—আপনি হোমোসেক্সুয়ালিটিতে আকর্ষিত হয়েছেন ? বিহারে তো লৌণ্ডাবাজির জন্য বিখ্যাত ।
    মলয়:—না, হইনি । কম বয়সেই নারীসঙ্গের কারণে ওই দিকটা অবহেলিত থেকে গেছে । লৌণ্ডাগুলোও তো বিটকেল দেখতে লাগতো । স্কুলে আর কলেজে লৌণ্ডাটাইপ ছিল না কোনো সহপাঠী ; থাকলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারতুম । তবে শুনতুম বটে যে অমুক হোস্টেলে দুজন ছাত্র মশারির ভেতরে ওয়ার্ডেনের হাতে  ধরা পড়েছে । প্রাইমারি স্তর থেকেই কোএজুকেশান ছিল, খুকি থেকে তরুণীরা স্কুল-কলেজে আশেপাশে ছিলই, ছাত্রও খারাপ ছিলুম না, কুসঙ্গ সত্ত্বেও । দেখতেও মন্দ ছিলুম না । গরিব বলে পোশাক একটু বেখাপ্পা থাকতো, এই যা । 

    অভিজিত:—অনুবাদের জন্য সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ?

    মলয়:—আমি কোনো পুরস্কার নিই না, লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও নয় ; কোনো সম্বর্ধনা নিই না, কোনো সাহিত্য সভায় গিয়ে বক্তিমে ঝাড়ি না । আমার মনে হয় অন্যের নোংরামি আমার ওপরও চেপে বসবে, তাদের মূল্যবোধে আটকে পড়ব । দেখুন না, কতো সাহিত্যিক, নাট্যকার, আঁকিয়ে কেমন নোংরামিতে আটকে পড়েছেন । পনজি স্কিমে গরিবের টাকা মেরে দেবার খেলা চলছে তা তাঁরা টের পেলেন না কেমন করে ? 

    অভিজিত:—উপায় ?

    মলয়:—উপড়ে ফেলতে হবে ; পুরো এসট্যাবলিশমেন্টকে উপড়ে ফেলতে হবে, আর তা করার জন্যে বাইরে থেকেই চাড় দিতে হবে, থুতু ছেটাতে হবে, মুতে দিতে হবে, হেগে দিতে হবে মাথায়, যারা তেল দিতে একত্র হয়েছে, পুরস্কারের জন্য লালা ঝরাচ্ছে তাদের ছিঁড়ে বাঘের খাঁচায় ফেলে দিতে হবে, বামপন্হা-দক্ষিণপন্হা সবই তো দেখা হল, এগুলো চলবে না, নতুন কোনো ব্যবস্হার কথা ভাবতে হবে, অসৎদের ঝোলাতে হবে, অনেক-অনেক কাজ করতে হবে, তবে যদি মানুষের কিছু হয় । আবার ট্রাইবাল হয়ে যেতে হবে, যেমন আদিবাসীরা থাকেন ।
    .

     
      •  
  • জয়িতা ভট্টাচার্য | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৩৭738575
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জয়িতা ভট্টাচার্য
    .....................................................................
    জয়িতা : কবিতা না গদ্য– গদ্যের ক্ষেত্রে প্রবন্ধ না গল্প-উপন্যাস —তুমি নিজে কোনটা লিখতে বেশি পছন্দ করো।
     
    মলয় : আমার নিজের তেমন কোনো প্রেফারেন্স নেই । নির্ভর করে মগজের ভেতরে একটা বিশেষ সময়ে কি ঘটছে । প্রবন্ধ লিখি মূলত সম্পাদকদের অনুরোধে । এখন আর প্রবন্ধ লিখতে ভালো লাগে না, প্রাবন্ধিকের সংখ্যা কম বলে সম্পাদকরা প্রবন্ধ চান, এমনকি সম্পাদক নিজে কোনো বিষয় বেছে নিয়ে লিখতে বলেন। তা কি পারা যায় ? এখন তেমন পড়াশোনা করতে বা সমাজ নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে না । ফিকশান লিখি, কোনো একটা ব্যাপার স্ট্রাইক করলে লিখতে থাকি, অভিজ্ঞতায় তো মাল-মশলার অভাব নেই, নিজের জীবন থেকে কতো চরিত্র তুলে আনা যায় । কেউ চাইলে দিই । কবিতা তো অ্যাডিকশান, যখন নেশাটা পেয়ে বসে তখন না লিখে নিস্তার নেই । সেগুলোও ইমেলের বডিতে লিখে রাখি, কেউ চাইলে পাঠাই , আমার মনে না ধরলে ডিলিট করে দিই। ইন ফ্যাক্ট যে চায় তাকেই পাঠাই, কোনো বাদ বিচার করি না। অনেকে বিষয়বস্তু বলে দেন, তখন গোলমালে পড়ি, কেননা আমি তো বিষয়কেন্দ্রিক কবিতা লিখি না ; নিজের ইচ্ছেমতন লিখি, কারোর পছন্দ হোক বা নাহোক । কবিতার খাতা বলে আমার কোনো ব্যাপার নেই,  ২০০৫ সালের পর থেকে, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির পরে ভুল ওষুধের দরুন আরথ্রাইটিস হল । , তারপর হাঁপানিতে ধরল, হার্নিয়া, প্রোস্টেট, ভেরিকোজ ভেইনস । আরথ্রাইটিসের কারণে লেখালিখির বাইরে চলে যাচ্ছিলুম, সে কষ্ট তুই বুঝতে পারবি না । মগজের ভেতরে লেখার ঘুর্ণি হয়ে পাক খাচ্ছে অথচ কিছুই লিখতে পারছি না । তারপর মেয়ের উৎসাহে কমপিউটার শিখলুম, বাংলা টাইপ করতে শিখলুম, ডান হাতের মধ্যমাটা কম আক্রান্ত, সেটাই টাইপ করতে ব্যবহার করি । ছেলে এই কমপিউটারটা দিয়ে গেছে, ছুটিতে এলে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় । মাঝে তো তিন-চার বছর লেখালিখি করতেই পারিনি আঙুলের সমস্যার জন্য ।
     
    জয়িতা : তোমার বিভিন্ন উপন্যাস পড়লে দেখা যায় প্রতিটির ন্যারেটিভ টেকনিক ও আঙ্গিক এ ভিন্নতা । ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ থেকে ‘জলাঞ্জলি’, ‘নামগন্ধ’, ‘ঔরস’, ‘প্রাকার পরিখা’, সবগুলো একই চরিত্রদের নিয়ে এগিয়েছে, একটাই উপন্যাস বলা যায় তাদের, কিন্তু তুমি প্রতিটির ফর্ম আর টেকনিকে বদল করতে থেকেছো । কেন ? তারপর, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন টেকনিক প্রয়োগ করলে, তিন রকমের বাংলা ভাষার খেলা দেখালে। ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে বেশ কয়েকটা ছোটোগল্প আর নিজের রোজনামচার অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছ । এই বিষয়ে কিছু বলো । এটা কি সচেতন প্রয়াস?
     
    মলয় : হ্যাঁ । পাঁচটা মিলিয়ে একটা অতোবড়ো উপন্যাস তো কেউ ছাপতো না, তাই বিভিন্ন সময়ে আলাদা-আলাদা করে লিখেছিলুম । ‘ডুবজলে’ উপন্যাসটা সহকর্মীদের নিয়ে লেখা, ক্রমে জানতে পেরেছিলুম যে কয়েকজন গোপন মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট । পাঁচটা আলাদা উপন্যাস লিখতে পেরে একদিক থেকে ভালোই হলো, সব কয়টায় নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করেছি । ব্যাপারটা মগজে এলে বেশ কিছুকাল ভাবি আঙ্গিক নিয়ে, উপস্হাপন নিয়ে, তারপর লেখা আরম্ভ করি । অনেক সময়ে লিখতে লিখতে আপনা থেকেই একটা আঙ্গিক গড়ে ওঠে, যেমন ‘নখদন্ত’ বা ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ । ‘নখদন্ত’ বইটার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ট্যুর করার সময়ে চটকল আর পাটচাষ-চাষিদের নিয়ে প্রচুর তথ্য যোগাড় করেছিলুম । তেমনিই ‘নামগন্ধ’ লেখার সময়ে পশ্চিমবঙ্গের আলুচাষি আর কোল্ড স্টোরেজের তথ্য সংগ্রহ করেছিলুম । এই বইদুটোয় বেশ কিছু চরিত্র চোখে দেখা । অভিজ্ঞতার বাইরেও লিখেছি, যেমন ‘জঙ্গলরোমিও’, একদল ক্রিমিনালের বিস্টিয়ালিটি নিয়ে । টানা একটামাত্র বাক্যে ফিকশান লিখেছি ‘নরমাংসখোরদের হালনাগাদ’, এটাও জাস্ট ইম্যাজিনেটিভ, পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে । ‘হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা’ রবীন্দ্রনাথের দাদুর দেহ ইংল্যাণ্ডের কবর থেকে তুলে হৃৎপিণ্ডে কেটে কলকাতায় নিয়ে আসার কাহিনি, রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের বাবারও সমালোচনা করেছি ফিকশানটায় । রবীন্দ্রনাথের দাদু যদি আরও দশ বছর বাঁচতেন তাহলে পশ্চিমবাংলার ইনডাস্ট্রি উন্নত হতো । সেসময়ে ওনাকে ফালতু বাঙালিরা আক্রমণ করেছিল চরিত্রের দোষ দিয়ে অথচ এখনকার ভারতে প্রতিটি পুঁজিপতি ওনার তুলনায় হাজারগুণ চরিত্রদোষে দুষ্ট, এমনকি তাদের মধ্যে জোচ্চোর, কালোবাজারি, চোরাইমালের কারবারি, দেশ ছেড়ে পালানো বজ্জাতরাও আছে । ডিটেকটিভ উপন্যাসটা লিখেছিলুম চ্যালেঞ্জ হিসেবে, কিন্তু সেটাতেও আমি ভারতের সমাজকে টেনে এনেছি । রাজনীতি আর সমাজকে বাদ দিয়ে উপন্যাস লিখতে পারি না, দীর্ঘ গল্প ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ জীবজন্তু-পাখিদের নিয়ে,  কিন্তু তাও পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক ঘটনাবলী আর চরিত্রদের নিয়ে । ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসটা হাংরি আন্দোলনের সময়ের জীবনযাপন নিয়ে । ‘আঁস্তাকুড়ের এলেক্ট্রা’ বাবা আর মেয়ের যৌন সম্পর্ক নিয়ে । নেক্রোফিলিয়া নিয়ে লিখেছি ‘নেক্রোপুরুষ’, সময়ের স্হিতিস্হাপকতা নিয়ে লিখেছি ‘চশমরঙ্গ’ ।
     
    জয়িতা : পোষ্টকলোনিয়াল বা কমনওয়েল্থ লিটেরেচারের ক্ষেত্রে সলমন রুশডিকে আদর্শ পোস্টমডার্ন নভেলিস্ট বলে কি তুমি মনে করো ?
     
    মলয় : রুশডি একজন ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট ঔপন্যাসিক, মার্কেজ প্রভাবিত । যতোই জটিল হোক, পাঠক ঠিকই বুঝতে পারে, যেমন ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর ক্ষেত্রে । আমেরিকার আলোচকরা ম্যাজিক রিয়্যালিজমকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায় না, কেননা টেকনিকটা তাদের দেশে গড়ে ওঠেনি, তাই ম্যাজিক রিয়্যালিস্ট লেখকদেরও পোস্টমডার্ন বলে চালাবার চেষ্টা করে । পোস্টমডার্ন উপন্যাসের কিছু সূক্ষ্ম উপাদান থাকলেও রুশডির ফিকশানকে পোস্টমডার্ন তকমা দেয়া উচিত হবে না । গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে পোস্টমডার্ন বললে স্প্যানিশ আলোচকরা বুল ফাইটের ষাঁড় লেলিয়ে দেবে ।
     
    জয়িতা : তোমার গদ্যে প্রথাগত প্রেম আসেনা । নেই স্টিরিওটাইপ প্রটাগনিস্ট । সেটা কি সচেতন ভাবে পরিহার করেছো স্বকীয়তা আনতে? ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ উপন্যাসে মানসী বর্মণ, শেফালি, জুলি-জুডি ; ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে খুশিরানি মণ্ডল, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটায়’ কেকা বউদি, ‘ঔরস’-এ ইতু, এরা একজন আরেকজনের থেকে পৃথক এবং কেউই স্টিরিওটাইপ নয় । এমনকি উপন্যাসের শেষে চমক দিয়েছ যে খুশিরানি মণ্ডলকে পূর্ববঙ্গ থেকে তুলে আনা হয়েছিল, সে প্রকৃতপক্ষে জনৈক মিনহাজুদ্দিন খানের নাতনি । আত্মপরিচয় নিয়েও খেলেছো খুশিরানি মণ্ডলের ক্ষেত্রে, সে নিজের উৎস না জেনেই লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে, ব্রত রাখে, চালপড়ায় বিশ্বাস করে । মলয়রচনার আঙ্গিক সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইবো ।
     
    মলয় : তার কারণ আমি প্রথাগত প্রেম করিনি আর দ্বিতীয়ত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ব্যাপারটা ইউরোপ এনেছিল, মেট্রপলিটান সিংহাসনের প্রতীক হিসাবে । বয়সে আমার চেয়ে বড়ো নারীরা আমার জীবনে প্রথমে প্রবেশ করেছিলেন । তাই হয়তো যুবকের চেয়ে যুবতীর বয়স বেশি হয়ে যায়। নারী চরিত্রগুলোয় আবছাভাবে কুলসুম আপা আর নমিতা চক্রবর্তীর উপস্হিতি রয়ে যায় । হাংরি আন্দোলনের সময়ে যে যথেচ্ছ জীবন কাটিয়েছি, তার ছাপও নারী চরিত্রদের ওপর রয়ে গেছে । খুশিরানি মণ্ডলের মাধ্যমে দেখিয়েছি যে নিজের আইডেনটিটি ব্যাপারটা কতো গোলমেলে । এখনকার ভারতীয় সমাজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, আইডেনটিটি পলিটিক্সের দরুন সমাজ ভেঙে পড়ছে, প্রতিনিয়ত লাঠালাঠি হচ্ছে, দলিতদের পেটানো হচ্ছে, মুসলমানদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে । গোরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে কতো লোকের জীবিকা নষ্ট করা হয়েছে । ইসলামে শুয়োর মাংস নিষিদ্ধ, কিন্তু দুবাইয়ের মলগুলোয় শুয়োরের মাংস বিক্রির আলাদা এলাকা আছে । আইডেনটিটি পলিটিক্স থেকে আমরা পৌঁছে গেছি জিঙ্গোইজমে । আমার বিয়ের কথা বলি ; আমি সলিলাকে বিয়ে করেছি তিন-চার দিনের আলাপের মধ্যেই, দুজনে দুজনকে হঠাৎই ভালো লেগে গিয়েছিল। এই নিয়ে একটা দীর্ঘ স্মৃতিকথা লিখছি, ‘আমার আজব বিয়ে’ নামে, অজিত বলেছে বই হিসেবে বের করবে । সলিলার মা-বাবা ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন ; তাই শাশুড়ির আদর খাবার সুযোগ হলো না আমার ।
     
    জয়িতা : ‘ডুবজলে’ উপন্যাসে টেবিলের ওপরে রাখা মানসী বর্মণের পাম্প দিয়ে বের করা দুধ অতনু চক্রবর্তী টুক করে চুমুক দিয়ে খেয়ে নিয়েছিল । এটা কেন ?
     
    মলয় : অতনুর মা সম্প্রতি মারা গিয়েছিলেন, সে কয়েকমাস মিজোরামে জুলি-জুডি নামে দুই সৎবোনের সঙ্গে যৌনজীবন কাটিয়ে পাটনায় ফিরে মানসিক গুমোটের মধ্যে আটক হয়ে গিয়েছিল। দুধটা দেখে আপনা থেকেই মায়ের অনুপস্হিতি তার মনে কাজ করে ওঠে । পরে ‘ঔরস’ আর ‘প্রাকার পরিখা’ উপন্যাস দুটোয় মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তীর জটিল যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে, ওরা তখন ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী জমায়েতে যোগ দিয়েছে ।
     
    জয়িতা : বাংলা সাহিত্যে বিশ্বায়নের প্রভাব কতটা প্রতিফলিত বলে তোমার মনে হয় ? বিশ্বায়নের রেশ ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় তোমার ?
     
    মলয় : এখনকার ব্যাপারটা বলতে পারব না । আমি আর বিশেষ পড়াশুনার সময় পাই না । বুড়ো-বুড়ি মিলে সংসার চালাতে হয় বলে সময়ের বড্ডো অভাব, বাজার করা, ঝাড়-পোঁছ, কুটনো কোটা, রান্নায় হেল্প ইত্যাদি । বিশ্বায়নের পর যে সব বাংলা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে তার কিছুই প্রায় পড়িনি,  বিশ্বায়ন তো বলতে গেলে ব্রেক্সিট আর ট্রাম্পের গুটিয়ে ফেলার রাজনীতির দরুন উবে যেতে বসেছে, কেবল চীনই আগ্রহী ওদের মালপত্তর বিক্রির জন্য, আমাদের দেশের বাজার প্রায় কবজা করে ফেলেছে চীন । তবে ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্য তো ইউরোপের অবদান । বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপীয় ফর্মে । মাইকেল অমিত্রাক্ষর আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপের ফর্মে । তিরিশের কবিরা কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন ইউরোপের ফর্মে, এমনকি জীবনানন্দের কবিতায় ইয়েটস, বিষ্ণু দের কবিতায় এলিয়টের উপস্হিতি খুঁজে পান বিদ্যায়তনিক আলোচকরা । ব্রিটিশরা আসার আগে আমাদের সাহিত্যধারা একেবারে আলাদা ছিল । প্রতীক, রূপক, চিত্রকল্প, মেটাফর ইত্যাদি ভাবকল্পগুলো তো ইউরোপের অবদান । আধুনিক সঙ্গীত সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই, কিন্তু অনেকে রবীন্দ্রনাথের গানে ইউরোপের প্রভাব পান, এমনকি হুবহু গানের সুরের নকল । কবির সুমন আসার পর গানে রদবদল হলো।
     
    জয়িতা :  শূন্যদশকের কবি সাহিত্যিকদের কাছেও পুনরাধুনিক ,উত্তরাধুনিক বা আধুনান্তিক সাহিত্য সম্পর্কে ধোঁয়াশা। এর কারণ কি বলে মনে হয় ? বাংলা সাহিত্য সামগ্রিকভাবে আজকের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে কতটা সমান্তরাল ?
     
    মলয় : ধোঁয়াশা হলেও তাদের লেখায় ছাপ পাওয়া যাবে । আর সকলেরই মগজে ধোঁয়া ঢুকে আছে বলা যাবে না । অনেকে যথেষ্ট শিক্ষিত । আবার অনেকের আগ্রহ নেই, তারা নিজের মতো করে লিখতে চায় । পুনরাধুনিক, উত্তরাধুনিক, অধুনান্তিক, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্টস্টাকচারালিম, ফেমিনিজম সম্পর্কে না জেনেও দিব্বি লেখালিখি করা যায় । কবিতা সিংহ তো ফেমিনিজমের তত্ব না পড়েও ফেমিনিস্ট কবিতা লিখে গেছেন । বাংলা কমার্শিয়াল পত্রিকায় এখন যে ধরনের মিল দেয়া কবিতা লেখা হয়, ইউরোপে আর তেমন কবিতা লেখা হয় না, ওদের কবিতায় ছবির ভাঙন অনেক বেশি আর দ্রুত । প্যারিস রিভিউ আর পোয়েট্রি পড়লে দেখা যায় যে অনেকে সহজ ভাষায় কবিতা লিখছেন, জটিলতা বর্জন করে, যখন কিনা বাংলায় বহু তরুণ কবিতাকে জটিল করে তুলছেন । আসলে কবিরা লেবেল পছন্দ করেন না । সকলেই চায় তাকে তার নামে লোকে জানুক, লেবেলের ঘেরাটোপে নয় । আমি নিজেই হাংরি লেবেলের দরুন বিরক্ত বোধ করি । বহু পাঠক তো ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ছাড়া কিছুই জানে না।
     
    জয়িতা : একটু ব্যক্তিগত প্রশ্নে আসি । ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ও ‘ছোটোলোকের যুববেলায়’ নিজের বড়ো হয়ে ওঠার কথা লিখেছো । হাংরি আন্দোলনের সময়কার ঘটনাগুলো  ‘হাংরি কিংবদন্তি’ ও ‘রাহুকেতুতে’ লিখেছ । কিন্তু পরবর্তী পর্বের মলয় রায়চৌধুরী বেশ কিছুকাল অপ্রকাশিত । এই সময়টার কথা বলো । সত্যি কি লেখোনি না লিখেছ তা অপ্রকাশে । এই ট্রান্সিশনাল সময়টার কথা বলো।
     
    মলয় : লিখেছি তো, সবই লিখেছি । ‘আখর’ পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যায় লিখেছি “ছোটোলোকের জীবন” শিরোনামে । ওটা প্রতিভাস থেকে “ছোটোলোকের সারাবেলা” নামে প্রকাশিত হবার কথা । ‘ছোটোলোকের জীবন’ তোকে পাঠিয়েছি, পড়ে দেখিস । অমিতাভ প্রহরাজ লিখেছে ‘আখর’ ওই সংখ্যাটা লোকে গান্ধী জয়ন্তীর আগের দিনে রামের বোতল কেনার মতন কিনেছিল ।
     
    জয়িতা : ব্যক্তি মলয় ও লেখক মলয়ের মধ্যে ফারাক কতটা? তুমি নিজেকে কিভাবে দ্যাখো ।
     
    মলয় : কোনো তফাত আছে বলে মনে হয় না, তবে আমি ব্যক্তি মলয়ের ইমেজ ভাঙার চেষ্টা করি, কেবল ভাষা ভেঙে হাত গুটিয়ে বসে থাকি না । আমিও যেকোনো লোকের মতন বাজার যাই, দরাদরি করি, যৌবনে মেছুনির সঙ্গে ফ্লার্ট করতুম, এখন সন্ধ্যাবেলা সিঙ্গল মল্ট খাই । হাংরি আন্দোলনের সময়ে গাঁজা চরস আফিম এলএসডি বাংলা  খেতুম, এখন আর খাই না । বাড়িতে যে পোশাক পরে থাকি সেটাই অতিথিদের সামনেও পরে থাকি, মহিলারা এলেও । কথা বলার ধাঁচেও কোনো তফাত নেই, যদিও বেশ কিছু সাহিত্যিককে দেখেছি কেমন ক্যালাটাইপের গলায় কথা বলতে । তারা সব বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র বা ছাত্রদের ছাত্র । আমি হুগলির বুলিতে ইমলিতলা মিশিয়ে চালিয়ে যাই । ব্যক্তি আর লেখক দুইই ইমলিতলার, তাই সহজেই নিজের ইমেজ ভাঙতে পারি ।
     
    জয়িতা : তোমার সমসাময়িক কোনো সাহিত্যিকের কথা বলো যাঁর সঠিক মূল্যায়ন কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্য গোষ্ঠি করতে পারেনি যথাযথ ।
     
    মলয় : মূল্যায়নই হয় না, তো আবার সঠিক মূল্যায়ন । এতো বেশি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীবাজি হয় যে বেশির ভাগ প্রতিভাবান লেখক-কবির মূল্যায়ন হয় না, বিশেষ করে যারা গদ্য নিয়ে কাজ করছে তারা অবহেলিত থেকে যান । পুরস্কারগুলো নিয়ে টানাটানি হয় । সিপিএমের লোকেদের বাংলা অকাদেমি থেকে বিদেয় করে দেয়া হলো ওই একই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কারণে, তাঁরাও জ্ঞানী-গুণী ছিলেন । এখন একদল নতুন মুখ এসেছেন যাঁরা তাঁদের প্রিয় সাহিত্যিক আর সংস্কৃতিকর্মীদের কাঁধে উত্তরীয় দিচ্ছেন । যারা দুটো দিককেই এড়িয়ে গেছে তাদের প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব দেয় না । যেমন কেদার ভাদুড়ি, সজল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে ।
     
    জয়িতা : জীবনের ইমনকল্যাণে এসে তোমার চেতনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে ? জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে বলছি।
     
    মলয়: এখন আমার একাকীত্ব ভালো লাগে, বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না, আমার স্ত্রীও বেশি কথা বলা পছন্দ করে না । আমরা কোনো অনুষ্ঠানে যাই না । খাবার নেমন্তন্ন এড়িয়ে যাই, শরীরের কারণে । এখানে মুম্বাইতে আত্মীয় বলতে আমার এক মামাতো ভায়রাভাই, যার বয়স আমার চেয়ে ছয় বছর বেশি ।  কিন্তু এও মনে হয় যে মরার পর শ্মশানে নিয়ে যাবার লোক জোটানো বেশ কঠিন হবে । মাকে যেখানে দাহ করা হয়েছিল সেখানেই পুড়তে চাই । নয়তো বেস্ট হবে দেহ দান করে দেয়া । সেটা মরার পর বডির অবস্হা কেমন থাকে তার ওপর নির্ভর করে । আমার স্ত্রীর আপত্তি নেই । স্ত্রী আগে মারা গেলে আমারও আপত্তি নেই । ভীতিকর  হলো যে আরথ্রাইটিসের জন্য সই করতে পারি না, স্ত্রীকে সই করতে হয়, সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয় ব্যাঙ্কে ।
     
    জয়িতা:  তোমার জীবন ও সাহিত্যচর্চার ওপর দেশে বিদেশে গবেষণা হয়।  সে সম্পর্কে কলকাতার পাঠক মহল জানতে চায় ।
     
    মলয়: বছর দশেক আগে থেকে আরম্ভ হয়েছে । প্রথম পিএইচডি করেছিলেন বিষ্ণুচন্দ্র দে আর এমফিল করেছিলেন স্বাতী ব্যানার্জি । আমেরিকা থেকে মারিনা রেজা এসে হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করে গেছেন, এখন গুটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করছেন ড্যানিয়েলা লিমোনেলা, রূপসা নামে একটি মেয়ে এমফিল করছে, প্রবোধচন্দ্র দে এম ফিল করছেন, নয়নিমা বসু, নিকি সোবেইরি, বিবিসির জো হুইলার, ফরজানা ওয়ারসি, জুলিয়েট রেনোল্ডস, শ্রীমন্তী সেনগুপ্ত ।  এনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে জানি । অনেকে যোগাযোগ না করেই, সন্দীপ দত্তর লাইব্রেরি বা অন্য কোথাও থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কাজ করেছেন, যেমন রিমা ভট্টাচার্য, উৎপলকুমার মণ্ডল, মধুবন্তী চন্দ, সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইমতিয়াজ, নন্দিনী ধর, তিতাস দে সরকার, এস মুদগাল, অঙ্কন কাজি, কপিল আব্রাহাম প্রমুখ । উদয়শঙ্কর বর্মা পিএইচডি করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, পুরো আন্দোলন কভার করেননি উনি, উত্তম দাশের সঙ্গে দেখা করলে নথিপত্র পেতেন । ডেবোরা বেকার আমাদের কারোর সঙ্গে বা সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে না গিয়ে তারাপদ রায়ের কাছ থেকে তথ্য যোগাড় করেছিলেন আর আবোল-তাবোল লিখেছেন । সুতরাং কে কোথায় গবেষণা করছেন বলা কঠিন। পেঙ্গুইন থেকে মৈত্রেয়ী চৌধুরীর বই ‘দি হাংরিয়ালিসটস’ বেরোবে এই বছর । আগামী বছর রাহুল দাশগুপ্ত আর বৈদ্যনাথ মিশ্রর সম্পাদনায় বেরোবে ‘লিটারেচার অফ দি হাংরিয়ালিস্টস’ । সমীরণ মোদক আমার সম্পাদিত ‘জেব্রা’ পত্রিকা সংকলিত করছেন, ‘হাংরি আন্দোলকারীদের চিঠি’ নামে একটা সংকলন বের করার তোড়জোড় করছেন।
     
    জয়িতা:  সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা নিয়ে নানা কাজ করেছো । কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে কাজ করবার ইচ্ছে আছে ?
     
    মলয়: আপাতত একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি । বাউল যুবক যুবতী জুটিকে নিয়ে, যারা তারুণ্যে একজন নকশাল আর একজন কংশাল ছিল । কিন্তু তাদের ঘিরে যে চরিত্ররা থাকবে সেই লোকগুলোকে গড়ে তুলতে পারছি না, সুরজিৎ সেনের ‘ফকিরনামা’ বইটা পড়ে আইডিয়াটা এসেছে মাথায়, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই বলে এগোইনি । এতেও যুবতীর বয়স যুবকের চেয়ে বেশি। পরস্পরকে মা-বাবা বলে ডাকে । সরসিজ বসু অনুরোধ করেছেন একটা গদ্য তৈরি করতে বর্তমান ভারতের জাতীয়তা, দেশপ্রেম, দাঙ্গা, গরুর মাংস খাওয়া, নিম্নবর্গের মানুষকে কোনঠাসা করার চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে । ‘বসুধৈব জিঙ্গোবাদম’ নিয়ে লিখেছি । ওকে আরেকটা লেখা দিয়েছি, ‘কফিহাউস – অন্তর্ঘাতের পলিমাটি’ নামে, অন্য একটা পত্রিকায় । আশি পেরোতে চললুম, আর বিশেষ কিছু লিখতে ভাল্লাগে না । একঠায় কমপিউটারে বসে থাকতেও তো পারি না ।
     
    জয়িতা :তোমাকে প্রাচীন স্পার্টান বীরের মতো মনে হয় ।এই যে নানা ঘাত প্রতিঘাত নিন্দে মন্দ সব কিছুকে অবজ্ঞাভরে কেবল কাজ করে যাওয়া ,এই জীবনিশক্তির মূলমন্ত্র কি। অনুপ্রেরণাদাতা বা দাত্রী কে ?
     
    মলয় : হলিউড-বলিউডের ফিল্ম দেখে বলছিস বোধহয়, সিলভিস্টার স্ট্যালোনের র‌্যামবো, থর-এর নায়ক, গ্ল্যাডিয়েটরের নায়ক, নাকি ?  কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পরে সাতজন ক্রিমিনালের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার পর, ‘ক্ষুধার্ত গোষ্ঠী’ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াবার পর, নিন্দে-মন্দ গায়ে লাগে না, লিখেও তো কতো লোকে গালমন্দ করে, বিশেষ করে রাজসাক্ষীদের ছেড়ে যাওয়া ‘ক্ষুধার্ত গোষ্ঠীর’ চেলারা ।   যখন লেখা আরম্ভ করেছিলুম তখন কুলসুম আপা, নমিতা চক্রবর্তী, বাড়ির চাকর শিউনন্নি, বাবার দোকানের কাজের লোক রামখেলাওন সিং ডাবর ছিল, শেষের দুজন রামচরিতমানস আর রহিম কবির দাদু থেকে কোটেশান ঝেড়ে আমাদের বকুনি দিতো , ব্যাপারগুলো ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলায়’ লিখেছি । আমার লেখালিখি নিয়ে আমার স্ত্রী আর ছেলের কোনো আগ্রহ নেই ; মেয়ের আছে, কিন্তু তার হাতে সময় একেবারে নেই, সম্প্রতি সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছিল । বস্তুত অনু্প্রেরণা বলে সত্যিই কি কিছু হয় ? আমার তো মনে হয় আমি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা, রাস্তায় হাঁটার সময়ে অনুপ্রেরণা মগজে জমতে থাকে।
     
    জয়িতা : তোমার বর্তমান যাপন সম্পর্কে তোমার অনুরাগী পাঠকসমাজকে কিছু জানাও।
     
    মলয়: আমার অনুরাগী পাঠক সত্যিই আছে ? মনে তো হয় না । আমি প্রথমে উঠি, স্ত্রী দেরিতে কেননা ওর রাতে ঘুম হয় না, রাতে উঠে হোমিওপ্যাধি ওষুধ খায় । দাঁত ব্রাশ করে ফ্রি হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ করি, ফিজিওথেরাপিস্টের শেখানো । এক গেলাস গরমজল খাই যাতে পেট পরিষ্কার হয় । ব্রেকফাস্ট বানাই, ওটস । তারপর ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ বসে টাইমস অফ ইনডিয়া পড়ি । আমার পাড়ায় বাংলা সংবাদপত্র পাওয়া যায় না, এটা গুজরাটি ফাটকাবাজদের এলাকা, একটা ফাইনানশিয়াল টাইমস কিনে দশজন মিলে শেয়ারের ওঠানামা পড়ে । আমি কখনও শেয়ার-ফেয়ার কিনিনি, তাই কোনো উৎসাহ পাই না ওনাদের সঙ্গে গ্যাঁজাতে । হকারকে বললে চারদিনের বাংলা কাগজ তাড়া করে একদিন দিয়ে যায়। নতুন যে লিটল ম্যাগাজিন আগের দিন পেয়েছি সেটা পড়ি । ফিজিওথেরাপির পর চা বানাই, গ্রিন টি । ততক্ষণে স্ত্রী উঠে ওটস ভাগাভাগি করে আর আপেল বা কিউই বা যে ফল হোক কাটে । আমি খেয়ে নিই । স্ত্রী এগারোটায় ব্রেকফাস্ট করে । তারপর বাজার যাই । মাছ-মাংস আর মাসকাবারি চাল-ডাল-তেল-মশলা কেনার থাকলে ফোন করে দিলে দিয়ে যায় । ফিরে এসে এগারোটা নাগাদ কমপিউটারে বসি আর ভাবি । ফেসবুক খুলে, জিমেল খুলে, চোখ বুলিয়ে নিই । তারপর বই আর পত্রিকা পড়ি । একটায় স্নান, খাওয়া, ঘুম । তিনটের সময়ে উঠে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখি, ইউরোপের, ভারতের থাকলে ভারতের । সাড়ে চারটের সময়ে বিবিসি । ছয়টা থেকে আটটা কমপিউটারে লেখালিখি আর সিঙ্গল মল্ট খাওয়া, এখন যদিও আর খাই না । তারপর রুটি তরকারি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা আর সেই ফাঁকে লেখার সম্পর্কে চিন্তাভাবনা, কেননা ঘুম আসতে দেরি হয় । অনেক সময়ে আমার ছেলের বউ রিয়াধে বসে সুইগি কিংবা ফুড পাণ্ডাকে অর্ডার দিয়ে দেয় আমাদের জন্য, বিরিয়ানি, মিষ্টি দই, নলেন গুড়ের সন্দেশ ইত্যাদির । ফোন বন্ধ করে দিই, যাতে কেউ ঘুমের দফারফা না করে ।
     
    জয়িতা :আজকাল কবিতাকে দশক হিসেবে ক্যাটিগোরাইজ করা হচ্ছে ; জেলা ও বিষয় ভিত্তিক ক্যাটিগোরাইজ করা হচ্ছে । কতটা প্রাসঙ্গিক বলে তোমার মনে হয় ?
     
    মলয়: এটা এই সময়ের ব্যাপার । সময় আপনা থেকে ঝরিয়ে দেবে যারা প্রাসঙ্গিক নয়, তাদের । প্রতিটি জেলায় কবিদের সংখ্যা তো কম নয় । হয়তো অমন সংকলন বেরোলে জানা যাবে তাদের ওপর জেলা-বিশেষের কথ্যভাষা আর ভূপ্রকৃতির প্রভাব পড়েছে কিনা । আমি নিজে তো জানি না আমি কোন জেলার । পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত এসেছিলেন যশোর থেকে কলকাতায়, তাঁর বংশধররা বেহালা-বড়িশায় ঘাটি গাড়েন । একজন শরিক ১৭০৩ সালে নদীর এপারে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন, আমি তাঁর বংশধর । উত্তরপাড়ার জমিদার বাড়ি ভেঙে আবাসন হয়েছে, আমি আমার শেয়ার বেচে দিয়েছি । তারপর ছিলুম নাকতলায় । নাকতলার ফ্ল্যাট বেচে চলে এসেছি মুম্বাই ; বইপত্র আর আসবাব বিলিয়ে দিয়েছিলুম নাকতলায় । যে বাসা আমি একবার ছেড়েছি, সেখানে আর দ্বিতীয়বার ফিরে যাইনি । আমি একই ঘরে, একই বাড়িতে, একই পাড়ায়, একই শহরে, সারাজীবন কাটাইনি।
     
    জয়িতা :অনুকবিতা সাহিত্যপত্র গুলির নতুন আবিষ্কার । তোমার কি মতামত ? কবিতাকে কি সম্পাদক শব্দসীমায় বেঁধে দিতে পারে? কবি অসহায় বোধ করে অনেক সময়ই ।
     
    মলয় : এটাও কবির সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে ঘটছে, অনেককে জায়গা দেয়া যায় অনুকবিতা পত্রিকায় । যে কবি অসহায় বোধ করে তার তো লেখাই উচিত নয় অমন সংকলনে । তবে চীনা আর জাপানি কবিতার প্রভাবে এজরা পাউন্ড ‘ইমেজিজম’ নামে অনুকবিতার আন্দোলন করেছিলেন । In a Station of the Metro নামে ওনার একটা দুই লাইনের কবিতা আছে, যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুকবিতার মান্যতা দেয়া হয়েছে, কবিতাটা শোন
    The apparition of these faces in the crowd ;
    Petals on a wet, black bough.
    জয়িতা : তোমার আন্তর্জাতিক যোগসুত্র  বিশ্ব পরিচিতি সম্পর্কে বলো ।এখানকার পাঠকদের জানা দরকার। কোন বিদেশী সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছো ? কার বন্ধুত্ব নিবিড় হয়েছে । এখন বিদেশে তোমার রচনা নিয়ে বাংলা প্রেমী বিদেশী ছাত্রছাত্রীরা কতটা সচেতন ?
     
    মলয় : হাংরি আন্দোলনের সময়ে হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড, ডিক বাকেন, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, মার্গারেট র‌্যানডাল, ডেইজি অ্যালান, ক্যারল বার্জ, ডায়না ডি প্রিমা, কার্ল ওয়েসনার, অ্যালান ডি লোচ প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত ছিলুম । অ্যারেস্ট করার সময়ে পুলিস ওনাদের চিঠিপত্রের ফাইল নিয়ে চলে গিয়েছিল, আর ফেরত পাইনি । এখন মাঝে-মাঝে প্রিন্ট বা মিডিয়ার সাংবাদিকরা যোগাযোগ করেন, সাক্ষাৎকার নিয়ে যান । স্কটল্যাণ্ডের একটা সংবাদপত্রের পক্ষে নিকি সোবরাইটি নামে এক তরুণী সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন । বিবিসির পক্ষ থেকে দুবার, একবার জো হুইলার আর আরেকবার ডোমিনিক বার্ন সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছেন । ড্যানিয়েলা লিমোনেলার কথা আগেই বলেছি, যাঁকে আমার স্ত্রীও ভালোবেসে ফেলেছে, ড্যানিয়েলা বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান বলতে পারে, হাত দিয়ে ভাত খায় আমাদের বাড়ি এলে । আমি আর নিজে থেকে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করি না । জার্মানি থেকে স্হানীয় আর্টিস্ট শিল্পা গুপ্তাকে নিয়ে এসেছিলেন মাইলিওন ; ওনারা একশো কবির প্রদর্শনী করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে, আমার কবিতাটাও অন্তর্ভুক্ত করেছেন । শিল্পা গুপ্তাই আমাকে ছবি আঁকার নানা রকম রঙ, ব্রাশ, পেনিল ইত্যাদি পাঠিয়েছেন, তাই দিয়ে ছবি আঁকছি, দেখেছিস তো? ব্লগে পাঠকের সংখ্যা থেকে মনে হয় নানা দেশ থেকে অনেকেই টোকা মেরেছে কিন্তু তাদের মধ্যে কতোজন পড়েছে বলতে পারব না ।
     
    জয়িতা : কবিতা প্রথম কবে লিখেছ? কেন? সমীরদা লিখতেন বলে?
     
    মলয় : ১৯৫৮ সালে বাবা একটা সুন্দর ডায়েরি দিয়েছিলেন, তাতে লেখা আরম্ভ করি, ইংরেজিতেও লিখতুম । দাদা আমার পরে লেখা আরম্ভ করেছিল । তবে ওই ডায়রি থেকে কবিতা নিয়ে দাদা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিতে, উনি কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৫৯ সালে প্রকাশ করেছিলেন । সুনীল তখন পাটনার বাড়িতে আসতেন । পরে হাংরি আন্দোলনের জন্য চটে গিয়েছিলেন । ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার জন্য বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘মলয় ইচ্ছে করে আমার আমেরিকাবাসের সুযোগটা নিয়েছিল।”
     
    জয়িতা: হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারে না গিয়েও সেই সময়কার কবিতার ডিক্সান কি কোনোভাবে নিকোনার পারার বা  বিট আন্দোলনের প্রভাবিত?
     
    মলয় : তখনও আমি ওনাদের কবিতা পড়িনি, নামই শুনিনি । বিদেশি কবি বলতে রোমান্টিক ব্রিটিশ কবিদের পড়েছিলুম । আমার কবিতায় ইমলিতলার মগহি আর ভোজপুরি ডিকশানের প্রভাব থাকতে পারে ; ফণীশ্বরনাথ রেণু, যিনি বাংলা জানতেন, এই কথাটা বলেছিলেন । বিটদের বইপত্র লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি পাঠিয়েছিলেন অ্যালেন আমেরিকা ফিরে যাবার পর । আর বিটদের সকলের কবিতা আর গদ্য  একই রকম নয়, সকলের রচনাতেই যৌনতা থাকে না । তাছাড়া নিকানর পাররার মতন কবিতা বিটরা লেখেনি । হাংরি আন্দোলনেও আমরা একজন আরেকজনের মতন কবিতা ও গদ্য লিখিনি । ‘ক্ষুধার্ত গোষ্ঠীর’ কবি-লেখকরা সিপিএম করা আরম্ভ করে লেখার ধারা পালটে ফেলেছিলেন । শ্রুতি আন্দোলনে কংক্রিট পোয়েট্রির প্রভাব কিছুটা ছিল বিশেষত পরেশ মণ্ডলের কবিতায় কিন্তু তাঁরাও একই রকমের কবিতা লেখেননি ।
     
    জয়িতা : প্রথম পর্বের কবিতার সঙ্গে এখন যে কবিতাগুলো লিখছ তার শৈলীতে যে পরিবর্তন এসেছে সে সম্পর্কে বলো। প্রথম পর্বের কবিতায় একটা নাড়িয়ে দেওয়া ঝাঁকুনি দেওয়া ব্যাপার ছিলো । তার সিনট্যাক্স ,ডিক্সন স্ট্রাক্চার ছিলো অভূতপূর্ব। দ্বিতীয়পর্বে এসেছ মাঝে অনেকটা সময়,অভিজ্ঞতা ,সংসার ….কবিতা মাঝসমুদ্রের মতো গভীর ও সমাহিত।মিল নেই তবু চেনা যায় এ কবিতা র কবি কে। এই বিষয়ে কিছু বলো ।
     
    মলয় : সে সময়ে কবিতায় টেসটোসটেরন, অ্যাড্রেনালিন থাকত, নিজেদের পত্রিকা আর বুলেটিনে বেরোতো, উদ্দাম নেশা আর যৌনতার ঘনঘটা ছিল । এখন অভিজ্ঞতার আর পড়াশুনার দরুন কবিতায় বদল এসেছে, আপনা থেকেই । যে দেড় দশক লিখিনি, সেই সময়ে প্রচুর পড়াশুনা করেছি । সব বিষয়ে বই পড়তুম।
     
    জয়িতা :বাংলায় উত্তরাধুনিক কবিতা কি লেখা হয় ?
     
    মলয় : হয় তো । উত্তরাধুনিক বলতে যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয় তা হাল আমলের বেশির ভাগ কবির রচনায় পাওয়া যাবে । অনেক তরুণ-তরুণীর কবিতায় বিস্ময়কর পংক্তি-কারিগরি দেখতে পাই ; বস্তুত ঈর্ষা হয় তাদের কবিতা পড়ে । বারীন ঘোষাল, অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল, ধীমান ভট্টাচার্য প্রমুখের কবিতা পড়লে টের পাবি ।
    কিন্তু পোস্টমডার্ন নামের দার্শনিক তত্বের সঙ্গে পোস্টমডার্ন সাহিত্যের সম্পর্কে নেই । পোস্টমডার্ন সাহিত্য মূলত আঙ্গিকের প্রাধান্যের ব্যাপার । ঠিক যেমন আধুনিক কবিতার সঙ্গে মডার্নিটির দর্শনের সম্পর্ক নেই ।
     
    জয়িতা :তোমার পছন্দের কবি কারা (আন্তর্জাতিক ও বাংলা সাহিত্যে)
     
    মলয় : বাংলায় বিনয়, ফালগুনী, কেদার ভাদুড়ি, জহর সেনমজুমদার, প্রদীপ চৌধুরীর চর্মরোগ, মণীভূষণ, যশোধরা, মিতুল, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখ । সব নাম এক্ষুনি মনে পড়ছে না । বিদেশি পল সেলান, সিলভিয়া প্লাথ, মায়া অ্যাঞ্জেলু, জন অ্যাশবেরি, আমিরি বারাকা, ইভস বনেফয়, জ্যাক দুপাঁ প্রমুখ । আর বলছিনা, তুই প্রভাব খুঁজবি ।
     
    জয়িতা : হাংরি আন্দোলন আর তোমাকে নিয়ে বাংলা আর ইংরেজিতে গবেষণা হচ্ছে । এতে তোমার গর্ববোধ হয় ? নাকি যা চাইছিলে তা পেয়ে গেছো বলে মনে হয় ?
    মলয় : আমার কিছুই হয় না । যারা আক্রমণ করতেন তাঁদের বিরক্তি হয় বলে মনে হয় । কিছুদিন আগে প্রতিদিন পত্রিকায় অরুণেশ আর আমার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল কমল চক্রবর্তী, হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রশ্রয় দিলেও তারা ওর বেদনার কারণ হয়েছে । সত্যি কথা বলতে কি আমার আর অরুণেশের কাব্যগ্রন্হ অত্যন্ত বাজে নিউজপ্রিন্টে ছেপেছিল, কভারও ফালতু করেছিল, তাই আমাদের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যখন কিনা ওদের  নিজেদের বইগুলোর প্রোডাকশান দারুণ হয়েছিল । যাকগে, আর তো নিজের বইপত্তর রাখি না, সব বিলিয়ে দিই ।
     
    জয়িতা : উচ্চারণ না অক্ষর কোনটা মানা উচিত ছন্দের ক্ষেত্রে।
     
    মলয় : আমি তো মাত্রা গুণে লিখি না । উচ্চরণ অনুযায়ী লিখি ।
     
    জয়িতা: তুমি বিদেশী কবিতা পড়ে আপডেটেড হতে বলো কিন্তু কবিতায় ষোলোয়ানা বাঙালি সেন্টিমেন্ট তার নিজস্ব ডিক্সনেরও কি প্রয়োজন নেই।সেই রূপান্তর কে অনুসরণ বা নকল বলা যায়কি? যেটা জীবনানন্দ বা অনেককেই শুনতে হয়েছে ।
     
    মলয় : বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য পড়লে জানা যায় যে পৃথিবীর ভাষা সামগ্রিকভাবে কোনদিকে যাচ্ছে । নকল করার দরকার হয় না ।
     
    জয়িতা: কবিতা ও গল্পে প্রান্তিক ভাষার সংলাপ ব্যবহার তোমার সময় বেশি লোক করেনি।কী ভাবনা কাজ করেছে এর পেছনে।
     
    মলয় : সেসময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকরা লিখতেন । পরে মফসসলের লেখকরা লেখা আরম্ভ করলে প্রান্তিক ভাষার প্রবেশ ঘটে । সুবিমল বসাক ১৯৬৫ থেকেই প্রান্তিক ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন । রবীন্দ্র গুহ আর অরুণেশ ঘোষও প্রান্তিক ভাষাকে ওনাদের গল্পে এনেছেন ।
     
    জয়িতা : সাহিত্যে যৌনতা এসেছে শিল্প হয়ে কিন্তু একদম নগ্ন ও আপোষহীন। পাঠক চমকে উঠেছে। যা বিছানায় যা জৈবিক তাকে সৃজনেও ঠিক সেইভাবেই আনা প্রয়োজন এটা তোমরাই করেছ। আমি তোমার কথাই বলবো। সাহিত্যে যৌনতা উন্মুক্ত ও আলোকিত হয়েছে নানাভাবে কখনো চরিত্রের মধ্যে কখনো কবিতা বা আত্মকথায়, বিশেষ করে ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসে । সে ব্যাপারে কিছু বলো।
     
    মলয় : যৌনতা অনেককাল থেকেই ছিল সংস্কৃত আর বাংলা সাহিত্যে । ইভানজেলিকাল পাদরিরা স্কুল-কলেজের সিলেবাসে মাথা গলানোর পর আর তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠার পর যৌনতা নিয়ে দোনামোনা আরম্ভ হয়েছিল । তারপর ব্রাহ্মদের প্রভাব, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের । সাহিত্য যখন মধ্যবিত্তের আওতা থেকে বেরোলো তখন যৌনতা নিজের স্বাভাবিক চরিত্র পেলো ।
     
    জয়িতা : তুমি সলিলাদির সঙ্গে পরিচয়ের পরের দিনই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলে আর উনি তক্ষুনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, সলিলাদের অভিভাবকরা ইতস্তত করছিলেন বলে তোমরা নাকি পালিয়ে যাবার টিকিট কেটে ফেলেছিলে ।  তার পর এক সপ্তাহেই বিয়ে সেরে বউকে নিয়ে পাটনায় ফিরলে । তোমার অবাক লাগেনি ওনার তখনই রাজি হয়ে যাওয়ায় ? তোমার বাবা-মা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাননি ?
     
    মলয় : না, সলিলা ছিল হকি খেলোয়াড়, ডিসিশন নিয়েছিল স্পোর্টসগার্লের মতনই । তাছাড়া ওর বাবা-মা ছিলেন না । মামার বাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে চলে যেতে চাইছিল । মামারা দোনামোনা  করেছিলেন সলিলার মাইনে ওনাদের সংসারে কাজে দিতো। আমরা তো দুজনে নাগপুর ছেড়ে চুপচাপ পাটনায় চলে যাবার টিকিট কেটে ফেলেছিলুম, কিন্তু তা করলে ওর অফিস থেকে ছুটি নিতে হতো, বিয়ের প্রমাণ না দিলে পরে ট্রান্সফারের সমস্যা হতো, ও চাকরি ছাড়তে চায়নি ; তুই তো স্কুলে পড়াস, মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা কতো জরুরি তা জানিস  । সলিলার মামাতো বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল দুদিন পরেই । ওরা বিয়ে করে উঠল আর আমরা সেই পিঁড়িতে বসে পড়লুম । আমি আমার বিয়ে নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি, অজিত বই করে বের করবে । বাবা-মা তো বউ পেয়ে যাকে বলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন । মা বলেছিলেন সিঁদুর পরিয়ে বাড়ি আনলেই হবে, আচার-টাচারের দরকার নেই । সত্যই বিয়ের আচার বলতে যা বোঝায় তা সম্ভব হয়নি । পাটনায় ফিরে তো কিছুই হয়নি ।
     
    জয়িতা: বিয়ে করে তুমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে চলে গেলে এআরডিসি লখনউ, সেখান থেকে মুম্বাই নাবার্ডে, তারপর কলকাতার নাবার্ডে। এতো পরে কলকাতায় এসে তোমার কি মনে হলো যে হাংরি আন্দোলনের দিনগুলো আর নেই ।
     
    মলয় : লখনউ যাবার পরেই আমি ভারতের গ্রামসমাজের সঙ্গে পরিচিত হলুম । তার আগে চাষবাস, কলকারখানা, তাঁত, ছুতোরের, কামারের, হাতের কাজের মজুরের ব্যাপারে কিছুই জানতুম না । কতোরকমের গোরু, ছাগল, শুয়োর, উট হয় জানতুম না ; তাদের ব্রিডিং সম্পর্কেও জানতুম না । সারা ভারত ঘুরেছি অফিসের টাকায়, পশুগুলোও এক এক জায়গার এক এক রকম । শেষদিকে আমি সলিলাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতুম, যখন ও চাকরি ছেড়ে দিলো,  যাতে পরিবারগুলোর বাড়ির ভেতরের অবস্হা জানতে পারে । সব অভিজ্ঞতা উপন্যাস আর প্রবন্ধ লেখায় কাজে লাগিয়েছি । হ্যাঁ, যখন ফিরলুম তখন পশ্চিমবাংলার সমাজ নানা দিক থেকে পালটে গিয়েছিল । আমি ‘আরেকবার ক্ষুধিত পাষাণ’ নামে একটা প্যাশটিশ লিখেছি, সাঁইবাড়ির হত্যাকাণ্ড নিয়ে । ঝুমা চট্টোপাধ্যায় ভাঙা আর বন্ধ সাঁইবাড়ির প্রচুর ফোটো তুলে পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো দেখে আইডিয়াটা হলো। অনেকে লেখে আমি সরকারি চাকরি করতুম ; ধারণাটা ভুল । সরকারি চাকরি করলে ফাইনান্স কমিশন যখন সরকারি কর্মীদের মাইনে আর পেনশন বাড়িয়ে দেয়, তখন আমার বাড়ে না, সরকার কর্মী নই বলে । পেনশন সেই ১৯৯৭ সালে যা ছিল সেখানেই আটকে আছে ।
     
    জয়িতা : তুমি বাংলা সিরিয়াল দ্যাখো ? ফিল্ম দ্যাখো ?
     
    মলয় : সলিলা কোনো-কোনো বাংলা সিরিয়াল দেখে, পছন্দ না হলে অন্য সিরিয়ালে চলে যায় । আমিও খেতে বসে দেখি যেগুলো সেসময়ে সলিলা দেখে । আমার মনে হয় যারা বাংলায় কথা বলে তাদের সঙ্গে আমাদের দুজনের যোগাযোগ বাংলা সিরিয়ালের মাধ্যমে । এখানে সারাদিনে বাংলায় কথা বলা আর শোনার সুযোগ নেই। ইউ টিউবেও বাংলা কবিতাপাঠ বা শর্টফিল্ম দেখি । কিন্তু আমার কমপিউটারটা এতো পুরোনো যে প্রায় কিছুই শোনা যায় না । ইনবক্সে গাদাগাদা ভিডিও পাঠায় অনেকে, কিছুই শোনা হয়ে ওঠে না । কমপিউটারের সামনে ঝুঁজে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না । সিনেমা হলে প্রায় চল্লিশ বছর যাইনি ।
     

     
  • কবিতার দেশ | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪০738576
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল ত্রিবেদী

    উৎপল : খুব সংক্ষেপে হাংরি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন ।
    মলয় : ১৯৬০ সালে সাধারণভাবে ভারতের এবং বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার উত্তর-ঔপনিবেশিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনেটিক অবস্হা যা হয়েছিল, দেশভাগের অজস্র ঘরভাঙা মানুষদের দেখতে-দেখতে এবং সেই সময়ের বাংলা কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়েছিল একটা সম্পূর্ণ ওলোট-পালোট দরককার । ১৯৬১ সালে অক্টোবরে আমি, দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আমার বন্ধু হারাধন ধাড়া ( দেবী রায় ) সবাই মিলে হাংরি আন্দোলনের পরিকল্পনা করি । ১৯৬১ সালের পয়লা নভেম্বর পাটনা থেকে আমি ইংরেজিতে একটা বুলেটিন ছাপিয়ে দেবী রায়কে পাঠাই ; উনি কলকাতায় বিলি করার পরই তুমুল চর্চা আরম্ভ হয় এবং ক্রমে প্রায় তিরিশ জন আন্দোলনে যোগ দেন । প্রথম বুলেটিন ইংরেজিতে ছাপাতে হয়েছিল, তার কারণ পাটনায় বাংলা প্রেসগুলো কেবল উপনয়ন, বিয়ে আর শ্রাদ্ধর কার্ড ছাপতো । হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম জিওফ্রে চসারের ‘ইন দ্য সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকে আর দার্শনিক বনেদটা পেয়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেংলারের সংস্কৃতি বিষবক বিশ্লেষণ থেকে ।
    উৎপল : কোন তাড়না থেকে আপনার কবিতার জগত এবং হাংরি আন্দোলন নিয়ে জড়িয়ে পড়া ?
    মলয় : কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলুম ১৯৫৯-৬০ নাগাস । দাদা সিটি কলেজে পড়তেন এবং তিরিশের দশকের কবিদের আর কল্লোলের লেখকদের বই এনে দিতেন । উনি মামার বাড়ি পাণিহাটিতে থাকতেন এবং ছোটোমামার মার্কসবাদী ভাবনা-চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন । পরে বিহারের জাতপাতের প্রেক্ষিতে ওনার মনে হয়রছি যে বাস্তব সমাজের সঙ্গে তা খাপ খাচ্ছে না । ১৯৬০ সালে আমি এই মর্মে “মার্কসবাদের উত্তরাধিকার” নামে একটা বই লিখেছিলুম, যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় । ১৯৬৩ সালে আমার কাব্যগ্রন্হ “শয়তানের মুখ” কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । তোমার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের উত্তর আগেই দিয়েছি ।
    উৎপল : ১৯৬৪ সাল । ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ লেখার পর আপনার নামে আদালতে মামলা হলো । বাংলা সাহিত্যে বোধহয় এই প্রথম কোনও কবিকে অশ্লীলতার দায়ে প্রকাশ্যে হাতে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এই যে শুধু কবিতার জন্য জেল খাটা, একের পর এক মামলায় রাষ্ট্র আপনাকে নাজেহাল করে দেয়া — এই মুহূর্তে সেই বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
    মলয় : একটা ব্যাপার বেঝতে পেরেছিলুম যে যাবতীয় লড়াই একজনকে একাই লড়তে হয় । সুবিমল বসাক ছাড়া আর কারোর সঙযোগীতা তখন পাইনি । এখন এটা নিয়ে বিশেষ ভাবি না ; তবে শৈলেশ্বর ঘোষ আর ওনার শিষ্য সব্যসাচী সেন যেভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে চলেছেন, তাতে বিরক্ত বোধ করি । আর এনাদের দুজনকে উৎসাহ জুগিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, দে’জ থেকে বিকৃত ইতিহাস প্রকাশ করিয়ে, তাতে তাঁরও লেখা আছে, আরও অনেকের লেখা আছে যারা হাংরি আন্দোলনে ছিল না । অথচ ওই বই থেকে যারা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল তাদের সবাইকে বাদ দেয়া হয়েছে ।
    উৎপল : সমীর রায়চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে আরও কুড়িটা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে” — পরবর্তীতে কোন আন্দোলনে হাংরির প্রভাব আছে বলে আপনার মনে হয় ?
    মলয় : নিম সাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, অপরসাহিত্য, নতুন-কবিতা, কংক্রিট কবিতা, ভাষাবদলের সাহিত্য, অধুনান্তিক সাহিত্য, উত্তরআধুনিক সাহিত্য — এরকম বেশ কয়েকটা, সবগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না ।
    উৎপল : বর্তমান সমাজ ব্যবস্হায় হাংরি আন্দোলনের প্রভাব কি ফুরিয়েছে ?
    মলয় : হাংরি আন্দোলন ছিল একটা ক্রোনোট্রপিকাল ( সময়/পরিসর ) ঘটনা । আন্দোলন তার কাজ করে গেছে । ত্রিপুরা, উত্তরবঙ্গতেও কবিরা সেসময়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন । যেমন সুররিয়ালিজম, ডাডাবাদ, ইমেজিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম ইত্যাদি আন্দোলন কবেই শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তারা এখনও ভেতরে-ভেতরে কাজ করে চলেছে । তারা যখন আবির্ভূত হয়েছিল, তখন তাদের বিশেষ প্রয়োজন ছিল । তেমনিই হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল ওই সময়ে ।
    উৎপল : আন্দোলনের একপর্যায়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী হন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবী রায় প্রমুখ পিছুটান দেন এবং আপনাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অপপ্রচার চালান । আপনি এ বিষয়গুলো কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন ?
    মলয় : শক্তি রাজসাক্ষী ছিলেন না, আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন, যেমন ছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু । আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ, যা ওরা চেপে গিয়ে বহুকাল আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছে । আমেরিকা থেকে সন্দীপনকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি থেকে জানা গেছে যে সুনীল ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়েছে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীকে ভেঙে ফেলার জন্য । এটা বোকার মতন কথাবার্তা । উনি বিদেশে বসে বোধহয় ভাবছিলেন কলকাতায় সবাই লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে, ওনার জন্যে খুদকুঁড়োও থাকবে না । আমার কেস যখন আদালতে চলছে, উনি কেসের সাবজুডিস অবস্হায় কৃত্তিবাস পত্রিকায় হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন । আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠি থেকে এখন জানা গেছে যে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন পুলিশের নির্দেশে । দেবী রায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, ছাড়া পান, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ওনার ক্রোধের কারণ মামলার কারণে চাকরি চলে যাবার ভয় । উনি সেসময়ে বস্তিতে থাকতেন, গরিব পরিবারের লোক, বলেছিলেন যে চাকরি চলে গেলে আত্মহত্যা করতে হবে । অপপ্রচার তো এখনও বজায় আছে । কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না । আমি তো নিজের যেমন ইচ্ছে দিব্বি লেখালিখি করে যাচ্ছি । এই ধরণের নোংরা ব্যাপার পৃথিবীর সব সাহিত্যসমাজে হয়ে এসেছে আর চলছে । আমাদের এখানে পণ্যসাহিত্যের আনন্দবাজারি কারবারের কারণে তা পচে পোকাধরা লাশ হয়ে গেছে ।
    উৎপল : বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সেসময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন বলে সমালোচনা করেন । এই কারণে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,  সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী ?
    মলয় : না, না, সন্দীপন আন্দোল ছাড়েন পুলিশের হুমকির কারণে । ওনাকে, শক্তিকে, উৎপলকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিয়েচিল পুলিশ । আনন্দবাজারের মাধ্যমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও চাপ দিচ্ছিলেন ওনাদের । উৎপলের তো যোগমায়া দেবী কলেজে লেকচারারের চাকরিও চলে গিয়েছিল ; তারপর অ্যালেন গিন্সবার্গের সুপারিশে লণ্ডনের একটা স্কুলে চাকরি পান । সতীন্দ্র ভৌমিক হাংরি আন্দোলনে ছিলেন না । উনি ‘এষণা’ নামে একটা পত্রিকা বের করতেন । ১৯৬৩ সালে সেই পত্রিকায় শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা পড়ে আমি দেবী রায়ের মাধ্যমে শৈলেশ্বরকে হাংরি আন্দোলনে এনেছিলুম । শৈলেশ্বরের সঙ্গে একই ঘরে থাকতো । আর ডাডাবাদের প্রভাব সম্পর্কে বলি, আগে যে সমস্ত আন্দোলন বা লেখালিখি হয়ে গেছে তাদের প্রভাব পরের লেখালিখিতে থাকবেই ।
    উৎপল : অচলায়তন ভাঙার যে শ্লোগান দিয়ে হাংরি আন্দোলন শুরু করেছিলেন, আপনার কি মনে হয় তা স্তিমিত হয়ে গেছে অথবা আজও চলছে ?
    মলয় : সিপিএম সরকার আসার পর প্রমোদ দাশগুপ্ত সারা পশ্চিমবাংলায় যে স্ট্যালিনিস্ট নেটওয়র্ক গড়ে তুলেছিলেন, যেটা পরিশ্রম না করেই পরের সরকার পেয়ে গেছে, তারা তো অচলায়তনের পাইক-বরকন্দাজের রক্তচোষার দিগ্বিজয় আরম্ভ করে দিয়েছিল । বিধবা মায়ের মুখে ছেলের রক্তমাখাভাত গুঁজে দিয়েছে, পেট্রল ঢেলে সাধু-সন্ন্যাসীদের পুড়িয়েছে, জিপগাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে মহিলা অফিসারদের গণধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে, গ্রামবাসীদের খুন করে বা জ্যান্ত মাটির তলায় পুঁতে দিয়েছে । ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে ফেলেছিল সাহিত্যিকরা ; সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত সুযোগ বুঝে সিপিএমে ঢুকে পড়েছিল । আমি এই ভয়াবহ অবস্হা সম্পর্কে আমার “পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন” পুস্তিকায় বিশ্লেষণ করেছি । এখন বহু সাহসী যুবক-যুবতীদের দেখা পাই, যারা আমাদের পতাকা এগিয়ে নিয়ে চলেছে ।
    উৎপল : আপনি একজন অবস্হাপন্ন পরিবারের সন্তান । বাবা কাকা সরকারি চাকরি করতেন । তাঁদের দৃষ্টিতে ‘অশ্লীল’ কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন । সে সময়ে আপনার পপতি বাড়ির প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ?
    মলয় : আমি অবস্হাপন্ন বাড়ির ছেলে কে বলল তোমায় ? বংশটা সাবর্ণ চৌধুরী বলে অনেকে মনে করেন অবস্হাপন্ন । সাবর্ণ চৌধুরীরা উত্তরপাড়ায় রিকশ চালাচ্ছে দেখতে পাবে তুমি । আমার বাল্যস্মৃতি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা পো” পোড়ো । ছোটোবেলায় আমরা থাকতুম পাটনা শহরের অন্ত্যজ বিহারি আর অত্যন্ত গরিব মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায় । পাড়ার নিবাসীরা ছিল চোর, ডাকাত, পকেটমার ইত্যাদি। দাদা যাতে না কুসঙ্গে পযে খারাপ হয়ে যায় তাই কলেজে পড়ার জন্য দাদাকে মামার বাড়ি পাণিহাটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । কুড়িজনের পরিবারে বাবা ছিলেন একমাত্র রোজগেরে । ওনার ফোটো তোলার আর ফোটো থেকে ছবি আঁকার দোকান ছিল পাটনা শহরে । পরে বড়ো জেঠা পাটনা মিউজিয়ামে পেইনটিঙ আর মূর্তি ঝাড়পোঁছের চাকরি পেয়েছিলেন, ক্লাস ফোর স্টাফ । ছয় ভাই একবোনের পরিবারে জেঠা-কাকারা কোনও কাজ করতেন না । উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির ট্যাক্স আর ঠাকুমার খাইখরচও বাবাকে পাঠাতে হতো প্রতি মাসে ।আমাদের পোশাক আর জুতো কেবল পুজোর সময়ে কেনা হতো ।  দাদা খেলতে গিয়ে জুতো হারিয়ে আসতো আর সারা বছর খালি পায়ে স্কুলে যেতো । আমাদের বাড়ি চিল ফোটোগ্রফার-আর্টিস্টের । জেঠা কাজ করতেন মিউজিয়ামে । তাই শ্লীলতা সম্পর্কে মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতায় বাড়ির লোক ভুগতেন না । মামলার সময়ে কলকাতার আদালতে বাবা-জেঠা-পিসেমশায় আসতেন সাহস যোগাবার জন্যে ।
    উৎপল : সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল কীভাবে নির্ধারিত হয় ? অশ্লীলতার মাপকাঠি আদৌ কি আছে ?
    মলয় : ইংরেজরা আসার আগে আমাদের সাইত্যবোধে শ্লীল-অশ্লীল ভেদাভেদ ছিল না । ধাকলে বাৎসায়ন, জয়দেব, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্র  আমাদেরভাষায় হতে পারতেন না, কবিয়ালদের আবির্ভাব হতো না । খাজুরাহো, কোণারক, পুরীর মন্দিরের স্হাপত্য হতো না । অলঙ্কারশাস্ত্রে প্রথম রসই তো আদিরস । সাম্রাজ্যবাদীরা এসে তাদের ভিকটোরীয় মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়ে গেছে ; তা থেকে বেরোবার আর উপায় নেই । এখন তো বিজেপির লোকেরা শ্লীল-অশ্লীলের বিচারক হয়ে দাঁড়িয়েছে । কোনো লেখায় ভাষার কাজ থাকলে, তা যদি পাঠককে উত্তেজিত করেও, তাকে অশ্লীল বলা চলে না ।
    উৎপল : এ পর্যন্ত আপনার কাব্যগ্রন্হ, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা কতগুলো ?
    মলয় : সত্তরটার মতো হবে । আমি বইপত্র সংগ্রহে রাখি না, তাই সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না । আমার সম্পর্কে পিএইচডি করেছেন বিষ্ণুচন্দ্র দে, উনি এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছেন ।
    উৎপল : আপনি প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন যা নারীর, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলুন । সেটা কোন সময়ে ?
    মলয় : সময়টা ১৯৫৪-৫৬ । নারী বলা ভুল হবে । তিনি ছিলেন স্কুলছাত্রী । তাঁর সমর্থনে মারপিট করতে গিয়ে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে । কিন্তু ওনার পরিবার কোনোকিছু না জানিয়েই হঠাৎ পাটনা থেকে উধাও হয়ে যান। আমার উপন্যাস ‘রাহুকেতু’তে আমি লিখেছি এই বিষয়ে । গাঙচিল থেকে প্রকাশিতব্য আমার রচনাসংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে । ( গাঙচিল মলয়বাবুর রচনাবলী কোনও রহস্যজনক কারণে প্রকাশ করতে অস্বীকার করে )।
    উৎপল : নতুন যারা লেখালিখির জগতে আসছে, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী ?
    মলয় : যেমন ইচ্ছের তেমন লেখো, প্রচুর পড়াশুনো করো, একা থাকার চেষ্টা করো, ডায়েরি রাখো, আর অবশ্যই মনে কিছু এলেই তক্ষুনি লিখে রাখো, পরে প্রয়োগ করার জন্য ।
    উৎপল : এই সময়ে বিশ্বকাব্যে বাংলা কবিতার স্হান কোথায় বলে মনে করেন ?
    মলয় : পোয়েট্রি, প্যারিস রিভিউ, লণ্ডন ম্যাগাজিনের কবিতাগুলো পড়ে বুঝতে পারি, বাংলায় যা লেখা হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক কবিতার স্তরে । দুর্ভাগ্য যে অনুবাদ হয় না, যোগ্য অনুবাদক নেই । বিদেশে কবিতা একটা অ্যাবসট্র্যাক্ট আঙ্গিক নিয়েছে, বাংলা কবিতায় অ্যাবসট্র্যাক্ট কবিতা লেখার ধারা তো চলছে নানা কবিতার পাশাপাশি ।
    উৎপল : হাংরি ইশতাহারের একটা পয়েন্ট ছিল, “আত্মআবিষ্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে”—এই নীতি আপনারা কতোটুকু মেনে চলেছেন ?
    মলয় : সেসময়ে মনে হয়েছিল জীবনের কোনো একটা সময়ে আত্মআবিষ্কার সম্ভব । এখন বুঝতে পারি যে বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে জীবনে এতোপ্রশ্ন জমতে থাকে যে তার উত্তর দেয়া অসম্ভব । ফলে, আত্মআবিষ্কার শেষ হয় না, আরও কঠিন হয়ে উঠতে থাকে ।
    উৎপল : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উগ্রপন্হীদের হাতে খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়, আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু প্রমুখ মুক্তমনা ব্লগারদের । ভারতেও গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবার্গিকে হত্যা করেছে কট্টর হিন্দুবাদীরা । সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন । আপনার কি মনে হয় না যে শেষ অবধি উগ্রপন্হা এই শতাব্দীর চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়াবে ?
    মলয় : হ্যাঁ, তাই মনে হয়, এবং তার ফলে একসময়ে কোনো দেশ আণবিক বোমা ব্যবহার করে ফেলবে, যার দরুন হয়তো বিশ্বযুদ্ধও বেধে যেতে পারে ।
    উৎপল : কাশ্মীরের মানুষ ভারত রাষ্ট্রের শোষণ, অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে, লড়াই করছে রাষ্ট্রের সেনার সাথে । কাশ্মীরিরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচতে চায় । আপনি কাশ্মীরের এই আজাদির লড়াইকে কীভাবে দেখছেন ?
    মলয় : আমি চাকুরিসূত্রে জম্মুকাশ্মীরে গেছি । হোটেলে পৌঁছোতেই দুজন কাশ্মীরি যুবক ভুল করে আমাকে সাংবাদিক ভেবে গাড়ি নিয়ে এসেছিল বারামুলা নিয়ে যাবার জন্য । পরে, জম্মু ফেরার যে বাসে বসেছিলুম, তার পেছন দিকে বোমা ফেটে আমার অধস্তন অফিসাররা আহত হয়েছিল । আর পি এফের লোকেরা আমাকে আপেল আর আখরোট নিয়ে মুম্বাই ফিরতে দেয়নি । বলেছিল, নিয়ে গেলে এদের সাহায্য করা হবে । তখনই অবস্হাটা ব্যক্তিগতভাবে আঁচ করতে পেরেছিলুম । কাশ্মীর একটা ছোট্ট জায়গা, জম্মু আর লাদাখ থেকে আলাদা, সুতরাং সেখানের লোকেদের স্বাধীনতা দেয়ার অসুবিধা হবার কথা নয় । কিন্তু ভারতে হিন্দুত্ব একটা কায়েমি স্বার্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে ; ভারতীয় পুঁজিবাদের দোসর হয়ে গেছে । কাশ্মীর পাকিস্তানে ঢুকলেই সারা দেশে দেশভাগের সময়ের চেয়ে ভয়াবহ দাঙ্গা আরম্ভ হবে । পাকিস্তান আর ভারত একসঙ্গে বসে ওদের স্বাধীনতার আর ওদের ব্যাপারে নাক না গলাবার গ্যারেন্টি দিলে সুরাহা সম্ভব । জেনারাল মুশররফ নাকি এরকমই একটা পরিকল্পনা ফাইনাল করে ফেলেছিলেন বাজপেয়ির সঙ্গে আলোচনায় । সমস্যা হলো ভারতীয় এসট্যাবলিশমেন্ট পাকিস্তানের সরকারকে বিশ্বাস করে না ।
    ( ‘কবিতার দেশে’ পত্রিকার বৈশাখ ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত )
     
  • জ. ভ. | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৬738577
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো
    Introducing the Poet
    Malay Roychoudhury (1939) was born in Patna, Bihar, in a family of Bengali Brahmins, claiming to descend from the clan of Sabarna Roychoudhury, the  zamindar family who handed over rental rights of Dihi Kalikata, Gobindapur and Sutanuti  to the British in what is today’s  Kolkata. Malay’s grandfather was a mobile photographer and on his sudden death at Patna his seven sons and a daughter became penniless. While Malay’s eldest uncle Pramod got a job of dusting statues at Patna Museum, Malay’s father started a photography shop. His mother was a housewife. His childhood was spent in Patna’s  Imlitala slum area inhabited by low-caste ( at that time called ‘untouchables’) Hindus and poor Shia Muslim communities . His maternal grandfather was laboratory assistant to Sir Ronald Ross and the maternal uncles, who were comparatively richer and educated, stayed in Panihati, north Kolkata, the place where Samir stayed during his education at City College, Kolkata. Malay used to visit Panihati during summers to keep in touch with sophisticated Bengali language and culture. His elder brother Samir studied in Kolkata, where he befriended a group of young poets (Shakti, Sunil, Ananda, Dipak and others) with whom he shared his passion for poetry and literature. Malay joined his brother Samir in Kolkata only later. In 1961, he and other fellow poets published the Manifesto on Hungryalist Poetry from Patna, which announced the foundation of the avant-garde and anti-establishment movement the Hungry Generation. In 1961 he along with his brother Samir, Shakti and Haradhon Dhara started the movement Hungry Generation (from Patna), a group of wild and rebellious poets who were tired by the lyricism of most Bengali poetry as well as with the literary establishment that, according to their view, was bourgeois and exclusive in taste and values. The movement and its poets were arrested on charges of obscenity ( Section 292 Penal Code ) and conspiracy against the State ( Section 120B Penal Code ) in 1964. Though the rest of the writers were released, and after a trial by lower court, Malay was sentenced to either serve jail for one month or pay a fine. He lost his job. Copies of Hungryalist writings were seized by the police. He was sentenced for his poem “Stark Electric Jesus’ ‘ which was judged obscene by the lower court magistrate. Some poets were defence witnesses at his trial, like Sunil Gangopadhyay, Jyotirmoy Datta and Tarun Sanyal. However some of his friends testified against him, like Shakti Chattopadhyay, Sandipan Chattopadhyay, Saileswar Ghose, Utpalkumar Basu and Subhas Ghose. There was national and international pressure, especially from Hindi, Gujarati and Marathi writers and the American avant garde writers and from the Beat poet Allen Ginsberg. The sentence was overturned by Kolkata High Court  in 1966. 
    Malay has continued to write and publish collections of poems, novels, short stories and translation of poems. Since the 1990s, with his brother Samir, who edited the avant garde magazine Haowa49, he contributed to discussions on postmodernism and magical realism in Bengali. He is a prolific writer who has written about 80 books since he launched the Hungry movement. Worthy of mention are his poetry collections Shaitaner Mukh (1963),  the long poem Jakham (1965 ), Medhar Batanukul Ghungur ( 1987 ) and Kounaper Luchimangsho ( 2003 ). His prose writings are mostly from the 1990s, such as the five-part postcolonial novels Dubjaley Jetuku Prashwas (1994); Jalanjali (1996); Naamgandho (1999), Ouras ( 2020 ) and Prakar Parikha ( 2021 ) reminiscent of the format and textual design of the Mahabharata, which have been defined as “the novels of rebellious counter discourse” and “a real time post-Independence socio-political nightmare”.  Nakhadanta (2002), a narrative segmented into seven-day stories (drawn from Ramayana) related to the decline of the jute industry around Kolkata in particular and political violence that took place around that time. In Chhotoloker Chhotobela ( 2004 ) he has written his memoir of Imlitala days. This book has been revised to include his entire life and published as Chhotoloker Jibon in 2022. In 2003, he was awarded the prestigious Sahitya Akademi prize for his Bengali translation of Dharamvir Bharati’s Suraj ka satvan ghora but he refused it. He has translated into Bengali works by William Blake, Baudelaire, Arthur Rimbaud, Tristan Tzara, Andrè Breton, Jean Cocteau, Blaise Cendrars, Jean Genet and Allen Ginsberg as well as Arab, Uighur and Pakistani poets.. Malay’s translation of Illuminations by the French poet Rimbaud and Paris Spleen by Baudelaire have come out in early 2020. 
    Geographies of Youth

    Question 1. Malay, you belong to a Bengali family from Patna. Your family claims to descend from Sabarna Roychoudhury family but by the time your great grandfather was born, your family had lost the lands and privileges of the title ‘roychoudhury’ – which was traditionally assigned by the Nabobs  under Mughal rule – and what remained was only the name and the social history behind that title. I think that already this contradiction in narrating about yourself sums up your style and your work. How do you think Patna, Imlitala and the history of your family was significant to you and to your literary persona?
    Answer 1: Though we lived in Imlitala slum, our house was full of Sabarna Roychoudhury items brought by boat from the ancestral zamindari villa at Uttarpara which has since been dismantled and a housing colony constructed in its place. Myself and Samir have sold off our share to the builder. Items brought were Iranian perfumes, very big golden frame mirrors, a mantle piece, gramophone records, silver tobacco stand, big utensils, mounted heads of tiger, deer, wolf etc and musical instruments such as organ, sitar, tabla, clarionet, harmonium etc. which reminded us of our past ancestry. My cousins, uncle Promod’s daughters, Sabu and Dhabu, used to play them before their marriage. Problem was that  my father was the main earning person  running the extended family of twenty members. Ancestry remained only as a miasma. What mattered was the real world of Imlitala. Uncle Pramod did not have a son ; so he purchased a baby boy from a prostitute, obviously of lower caste. Though Brahmin, our family did not prohibit us from mixing with our low caste neighbours, who were mostly petty criminals, and poor Shia Muslims, who had fled from Lucknow when the city was attacked by the British.  We had no restriction on entering their houses. We brothers ate roasted bandicoots, pork meat and drank palm toddy and rice liquor, smoked cannabis at those neighbours’ festivities right from childhood.  My eclectic persona and urge to rebel against restrictions was a gift from these people. Our parents did not stop us from entering Muslim houses from whom we purchased duck eggs. We also entered the local mosque to hide behind namaz mats while playing hide-and-seek. They also gave us goat legs during the celebration of Bakrid. Since uncle Pramod worked at Patna Museum, I sat behind his bicycle and visited the Museum on holidays. It was a wonderful experience for me. You just cross a door and  step into prehistoric life, Mohenjodaro, Egypt or Shivaji’s Fort. I came across the dead as living beings. These were the main influences. There was no burden from my ancestry. Though a Hindu-Muslim mixed locality, there were no riots at Imlitala before, during or after partition of India. I used to roam the lanes with a cross made of two wooden planks from my Dad’s parcels and shout ‘Hip Hip Hurray’ with Imlitala urchins, like Samir’s football team, not knowing much about Christ at that time. Imlitala being an ignominious locality, Bengalis of Patna avoided visiting our house ; to them we were “Cultural Outsiders.” Bihari friends of uncles and aunts visited our house without qualms. In fact my mother and aunts did not know that the ‘Imlitala Hindi’ they were speaking was not sophisticated and some expressions were indecent. The Imlitala tap was just in front of our house ; ladies who had babies with them handed infants over to an old man who rested on the outside platform of our house, where our windows opened. This old man used to teach abuse to the infants and the infants often asked, “Grandpa, shall I tell him/her this abuse?”
    Question 2. You grew up in the Patna slum of Imlitala, inhabited by Shia Muslims and Dalit Hindus alike. Your maternal uncles stayed in Panihati, north of Calcutta, and they were comparatively richer and educated, and this is where Samir was sent for study after High School and you were sent during summers to keep in touch with Bengal.  What about Kolkata? What did it mean for you and your peers to move (back) to West Bengal? Do you remember having any particular “imagination” or expectation about the city of Kolkata before you reached it?
    Answer 2. Firstly, nobody from our family thought of moving back to West Bengal. Samir did, when he was in his sixties,  to launch his magazine ‘Haowa49’, and prove that he was not a “Cultural Outsider”. Haowa49, according to Rigveda,  means Unopanshash Vayu representing fortynine storms of madness. Except for Utpalkumar Basu, all of his Krittibas friends avoided writing in Haowa49. I lived in Kolkata from time to time but not permanently. In fact I have not lived permanently in any city. Uttarpara, where we had our ancestral villa and Panihati, were pristine villages during my childhood. Compared to Imlitala, those were completely different. My maternal uncles had a huge garden with various fruit trees and two ponds full of fishes. Samir learned swimming and I learned angling as well as climbing trees. They had a library with photographs of famous Bengalis hanging on the wall. We used to visit Ahiritola, at the centre of Kolkata, from our childhood, where Aunt Kamala ( Dad’s sister) lived with her husband, six sons and two daughters. During Durga puja we visited the main Sabarna Roychoudhury house at Barisha but had a dislike for the slaughters of goats and buffaloes and their blood offered to the deity in earthen pots.. It seemed strange because at Imlitala the pigs were also slaughtered before roasting. The partition refugees did not come to Kolkata till then, when I first visited the city. No new imagination grew as I had the experience of the city whenever I went to Aunt Kamala’s house. In the late 1950s, Samir and I got disturbed when we saw hundreds of destitute refugees living at Sealdah station, through which we had to go to Kolkata city from Panihati. It created a scar in our conscience and worked as the fuse of the Hungryalist bomb against the Establishment.  But I experienced real hardships of life at Kolkata during the thirty five months’ trial when I had no place to stay at night, no certainty of lunch and dinner. I had to wear the same shirt-pant for months without a bath. I used the toilets of long distance trains waiting on the Sealdah platform. The hearing at the court used to be only for ten fifteen minutes initially where I had to wait for my turn to come. I was friendless at that time and roamed the streets. I had seen the nightlife of Kolkata during that period. Aunt Kamala’s eldest son Sentu used to advice me to sleep on footpath with cheap prostitutes, in their mosquito nets. Kolkata told me in clear terms that “Malay Roychoudhury is a cultural outsider”.
    Question 3. How was your relationship with your mum and dad? Do you remember it as a conflictual opposition or did you get along well? What did they do for a living, and in what way have they influenced your career as a poet, if so? What did they have to say about your poetry and your Hungryalist movement?
    Answer 3. Dad being the main source of income, had no time and my mother was in charge of the family. Both of them had never gone to school. Dad was self-taught. I was much closer to my mother. She would shout from the kitchen, “read loudly so that I may hear”. She had only one anxiety that I should not become like Arun, our brother who was purchased by uncle Pramod as Arun had become a ruffian, stole items from home, fled away many times after breaking uncle Pramod’s cash-box, and secretly brought women at night when everybody slept. Arun died young and that solved everybody’s problem. Samir was sent to Panihati so that he was not influenced by Imlitala. When I was in High School Dad purchased a house at Dariapur to avoid Imlitala influence. I lived alone in that house with uncle Biswanath’s brother in law who had come to learn photography.  Mother was not religious minded. Except for uncle Promod’s wife Aunt Nandarani, none of the aunts and uncles were religious minded. None of them visited temples or went on pilgrimage. I do not know why. Maybe because we could not afford it. Uncle Promod was the guardian and children were punished by him ; main punishment being a few sticks on the palm or cleaning his bicycle. After we shifted to Dariapur, Dad appreciated that I had started writing and gave me a beautiful diary ; he also told me to identify books at a local shop to deliver at home and collect payment. I had purchased a lot of English books to start my own library. Prof. Haoward McCord and Lawrence Ferlinghetti had also sent a lot of books. Since Hungryalist movement initially attracted publicity, both of them were happy that we brothers were becoming famous. When the police came to arrest me both of them were angry with them as they broke open Dad’s glass-showcase and mother’s wedding trunk, handcuffed and tied a rope around my waist while arresting me.  Dad and other uncles had come to Kolkata to select a lawyer for me and Samir.  Aunt Kamala’s husband used to visit the lower court to keep Dad informed. Dad had said that there was nothing to worry as I may fall back on the photography business if anything untowards happened. Dad had met the Kolkata Police Commissioner and complained about the vandalism by the policemen. The Police Commissioner had told him that they were not aware that ours was a serious literary activity. Mr. A.B.Shah, Executive Secretary of Indian Committee for Cultural Freedom had written to me on 27 January 1965, “I met the Deputy Commissioner of Police the day after we met at the office of the Radical Humanist in Calcutta. I was told that they would not have liked to bother themselves with the ‘Hungry Generation’ but for the fact that a number of citizens to whom the writings of your Group were made available, insisted on some action being taken.”
    Question 4. You went to a Catholic school and then to the Ram Mohan Roy Seminary in Patna , an institution run by the Brahmo Samaj, the monotheistic religion that aimed at reforming Hinduism in colonial Bengal. We could say that even your poem “Stark Electric Jesus”, or at least its title, carries the traces of that period. Your father was an orthodox Brahmin, and you too were invested with the sacred thread ceremony. Do you think that having been brought up in religious institutions made you more rebellious or transgressive? What was your relationship with Brahmanism – in the sense of practising the rules of purity and caste hierarchy – and with the daily rituals and practises of Hindu religion?
    Answer 4. The poem has several strains. The complexities of my life are included in it. My teenage and only love dominates. It took more than a month to write it. You are the first person asking this question. Nobody so far has asked what signified ‘Chhutar’ in the original poem and why it had been translated as Jesus. Yes, Samir and I had a sacred thread ceremony but we discarded the thread in a few months and did not observe the rules of Brahminism attached to it. If Brahminism had been observed by our family uncle Promod would not have purchased a baby boy from a low caste prostitute. Both the schools influenced my thinking and writing.  I got admission at Catholic school because of Father Hillman, an ameteur photographer who saw me playing at Dad’s shop and got me admitted for free. At the Catholic school I had to attend Bible classes every Thursday and came to know about the story of Jesus, and that carpentry was his profession. I also came to know about Moses, Joseph, Mary Magdalene and that Jesus’s mother remained virgin.  The wish to see the earth through cellophane hymen is possible only if your lover Mary is a virgin and you are in her womb. She was of snow white marble at the church which is Shubha in Bengali. Brahminisim was wiped off from  life during my days at Imlitala. Kulsum Apa’s house, a Muslim girl of very dark complexion, probably having African slave blood,  had intiated me into urdu poetry at Imlitala. Namita Chakraborty, the lady librarian, had introduced me to Brahmo Bengali poets and writers including Ram Mohan Roy, Shivnath Shastri, Rabindra Nath Tagore,  Jibanananda Das and others.  None of the schools in which I studied allowed Hindu functions. When I was urinating at the bank of the Ganges river, Allen Ginsberg shouted at me, “Hey, what are you doing ? It is a holy river !”
    Question 5. You and other Hungryalists wrote a manifesto on Religion, which started with “God is Shit”. Why is that? Which God were you thinking about? How important was religion for you and for your writing?
    Answer 5. Since no God existed for us, we had to attack the press whose owners had their God. I have pilloried orthodox religious views of others in my novels and stories. During my tours in villages throughout India I have seen people consider anything to be God, even a brick or piece of wood. My daughter presented to me three wooden gods of an African tribe. Kulsum Apa’s family had a flying horse made of tin which they revered. My erotic novel ‘Aroop Tomar Ento Kanta’ is based in Benaras and it deals with the city’s religious shenanigans ; even foretells the arrival of a conservative Hindu Political Party. Another novel ‘Naamgandho’ deals with a kidnapped Muslim baby girl during partition of Bengal by a refugee Communist-turned-landlord Hindu who becomes village chief. The baby girl grows up in a Hindu household and observes Hindu rituals as she is unaware of her antecedents. Her childhood lover of refugee colony days,, a Bengali Christian, who wanted to rescue her, is murdered. She never knows about her origin. 
    Question 6. Let us now move to sex, sexual education, porn and sexuality back in the 60s for Bengali Hindus. What kind of stuff did you have access to? Any female or male sex icon you remember from cinema? Why sex was so central in the Hungryalist early writings? Would you say it was also a metaphor for something else? 
    Answer 6. There was no sexual education. As a child when I visited the Museum I had seen men touching the vagina and breast of  Apsaras whereas ladies touching the penis of Alexander. Continuous touches made those portions polished. When asked, uncle Promod had said, “grow up, you would know.” At Catholic school during piano class I had to stand between the legs of the piano Madam and my head touched her breasts and Do Re Mi Fa So La Ti Do resonates at the back of my head even now.  At Ram Mohan Roy Seminary ( it was a coeducation school ) a friend had a small triangular mirror to look at the breasts of girls which did not excite me. Large prints of naked Apsaras used to be processed by Dad but I had become accustomed to their open breasts and vaginal slits. I first read a porn in Hindi in which the penis was the hero and recorded its adventure. The second was ‘Fanny Hill’, which I do not consider as porn. There were no porn films at that time. My ejaculations had started before I came to know of masturbation from my class fellow Subarna. He had advised that the penis should be kept clean through masturbation otherwise lints would gather as we Hindus are not circumscribed like to Jews and Muslims. My first encounter with a female body was when Kulsum Apa stood naked in their dark dirty damp room full of ducks, hens, goats and sheeps. After embracing me and finishing what she wanted to do, she declared that “you are no more a kafir.”  These lines in SEJ are from the  encounter with Kulsum Apa : The surroundings of your clitoris were being embellished with coon at that time. Fine rib-smashing roots were descending into your bosom. Then again in the poem a reference to her : Though I wanted the healthy spirit of Aleya’s fresh China-rose matrix/Yet I submitted to the refuge of my brain’s cataclysm”. Aleya, as you know, means ‘jack-o-lantern’. Before I talk about my female icons, let me tell you that uncle Sushil and his Hindu priest friend Satish Ghoshal used to watch Hindi films on Tuesdays on which Dad’s shop remained closed. Dad remained busy in photographic dark room but these two persons discussed about sex of Madhubala, Nargis, Suraiya, Rehana and others. Just imagine the atmosphere of our family. Four school friends Tarun, Barin, Subarna and myself would watch English films on Sunday mornings funded by Tarun who was from a rich family. Barin had a bicycle and visited the halls to have a look at the posters and decide which film was to be watched. I was fascinated by sexual appeal of Rita Hayworth, Elizabeth Taylor, Gina Lollobrigida, Sofia Loren, Brigitte Bardot, Audrey Hepburn. Among Bengali actresses I liked Suchitra Sen and Madhabi Mukhopadhyay. Among Hindi actresses I liked Madhubala and Nargis. All older than me and dead by now. Sex for me was a challenge that posed questions around self-awareness, right from my experience with Kulsum Apa telling me “you are no more a kafir”. But she really taught me to be an infidel. It was beyond my conscious fantasies, maybe even unconscious fantasies, though sexual desire were vital components of what it meant to be adult. During my undergraduation, at Patna, prostitutes, even housewives to make quick money, used to come from other side of Ganges, around student hostels, from evening onwards ; granite slabs of a discarded graveyard were used as beds for quick sex. Biharis are more open about sex than Bengalis. Imlitala had converted me to be a Bihari. Biharis are more beatnik than American Beat writers. Even now explicit songs are sung in village weddings in Bihar, with which I have been acquainted since childhood. Each year at Imlitala, during the festival of Holi, the ladies and gents both sang explicit songs and the people became so intoxicated with palm-toddy, rice liquor and cannabis that Samir, Arun and I were warned not to venture out. But we did go out in torn clothes to enjoy the merriment. Since you know Hindi, here is an example of a song: Daye Or Baye Ke Hile Ta Lage Better/Hai Tor Duno Indicator/Daye Or Baye Ke Hile Ta Lage Better/Hai Tor Duno Indicator/Joban Hoi Fuse Je Karbe Tu Use/Hai Chadhal Tor Jawani Chhodata Kahe Pani/Ae Rani/Hai Chadhal Tor Jawani/ Chhodata Kahe Pani.” Thus, sex was not a taboo for the Imlitala boy.
    Question 7. Did age have anything to do with that (young boys in their 20s)? Or would you say that this hype about sexuality (in aesthetics and as a taboo in real life) was something rather social and historical that was rooting all over the world in those days?
    Answer 7. I had only a faint knowledge of what was happening all over the world. There was no Television and Internet in those days. The newspapers were more interested in Indian news than international. Whatever I could gather was from the magazines at the British Library and USIS Library and those libraries avoided such news to be presented to Indians. Confessional poetry underlining sex had not been written till then in Bengali and to a young man from Imlitala nothing was obscene or taboo. I enraged the Cultural Guardians of Kolkata who had no idea of the lingo of even lower caste/strata of Bengalis. Their aesthetic reality was upper caste/class and different from ours. I was from Imlitala, Debi Roy from Howrah slum, Saileswar, Subhas, Pradip, Abani, Subo were from refugee families, Subimal Basak was from a family of weavers. If you go through poetry magazines of that time, you would not find low caste names therein. You might have known that the present generation of Bengali female poets write in explicit language.
    Question 8. What did your wife Shalila and the other poets’ wives think about what you were writing back then? What was their role and place vis-à-vis the Hungryalist poets?
    Answer 8. Shalila did not have interest in literature. She can read Bengali but can not write. When I was introduced to her by a lady named Sulochana Naidu, it was she who showed Shalila my literary activities and photographs published in Hindi magazines. She was a field hockey player when I married her. My children and even grandchildren are proud of me. Initially my blogs were started by my son. But Shalila wonders why mostly two of my poems have been recited on youtube by more than fifteen vocal artists, one is SEJ and the other one being ‘Matha Ketey Pathachhi Jotno Kore Rekho’, which translates as ‘Sending my cut-off head, please keep it safe’. Other Hungryalist writers and poets got full support from their wife. Saileswar’s wife was a poet herself. Subhas Ghose’s wife was his financial backbone. Tridib’s wife Alo was a poet and financially supported him. In fact, Tridib’s wife arranged poetry readings at various places, and edited the English magazine ‘The Wastepaper’. Pradip Choudhuri, Subo Acharya, Abani Dhar, Basudeb Dasgupta and Subimal Basak’s wife did not have any interest in literature. Arunesh Ghose’s wife knew about his activities as he was living near a brothel during his formative days. Falguni Ray did not marry. Falguni was from a zamindar family which became so poor that the members started uprooting floor and wall marble plates and sold them.
    Question 9. We know that only one female poet participated in your movement – Alo Mitra, wife of Tridib Mitra. What was her role in the movement? Were there other female participants of which we don’t know about?
    Answer 9. When male poets were hesitant in joining us, how can you expect female poets would join ? Saileswar’s wife Sunita had joined but that was after my trial. Female poets of my generation even now are shy of writing sex oriented poems though such poems are being written these days by young female poets. I would like to say that they are more bold than we were during our movement. About Alo Mitra’s role I have already talked about. She also edited a collection of letters written to me.
    Question 10. Does it bother you when people, readers and even scholars to some extent remind you of the obscene & wild writer of Stark Electric Jesus? What is your current relationship with that poem?
    Answer 10. Yes, it does. Many readers, mostly from Bangladesh, are stuck at SEJ. When they interview me or write about me they focus mainly on this poem though I have written hundreds of poems and written several novels and plays. Even young ladies are mesmerised with SEJ. I want to tell readers, please look beyond SEJ to my other works, especially essay collections on the socio-political condition of India in general and West Bengal in particular. Recently, Pooja Gupta, a painter, arranged installation of Hundred Prosecuted Poets in various cities of the world in which SEJ was included. The installation shows pierced poems on sharp rods in a dimly lit hall and voices reciting the poems one after another. SEJ to me is a double edged weapon.
    Question 11. In your confessional poetry, as well as in other Hungryalist poets from the 1960s, the “male gaze” is easily recognizable. And in fact, about the Hungry Generation poetry, someone once stated that “all Hungries must prove that they are Alpha males” (who was it?). One can say confessional poetry written by male writers, as if there was a clear intention of representing the ‘personal’ as a masculine “I”. Would you agree with that? 
    Answer 11. Yes, I agree. Miss Sreemanti Sengupta of ‘The Odd Magazine’ talked about Hungryalists trying to prove they are Alpha males.  I have written poems titled ‘Alpha Female Bidalini’ and ‘Alpha Purusher Kobita’, Saileswar Ghose and Arunesh Ghose’s poems have strong ‘male gaze’ and the masculine “I”. There is nothing unethical about the “male gaze”. Greek, Roman and Hindu epics are all stories of Alpha males. In the animal world the male elephant and tiger is able to pick up the fragrance of a female in heat from ten kilometres away. Human  beings have lost that power.
    Question.12. Why do you think you and other Hungryalist poets were accused of “misogyny”? Do you consider yourself one?
    Answer. 12 . No, I do not consider myself a misogynist. None of the Hungryalist poets were misogynist. These imputations were made by middle class Bengali academicians and not by academicians of other Indian languages in which our poems were translated. Famous Hindi writers like Phanishwar Nath Renu, Kamaleshwar, S.H.Vatsyayan Ajneya, Dharmavir Bharati wrote about us and published translated works in Hindi periodicals. Poet Nagarjun arranged to get Jakham translated and published in Hindi. Gujarati writer Umashankar Joshi wrote about us. Marathi poets Arun Kolatkar and Dilip Chitre wrote about us. Misogyny  is hatred or contempt for women. It is a form of sexism used to keep women at a lower social status than men, thus maintaining the societal roles of patriarchy. People who have read my novels would not say that I am a ‘misogynist’. Even in poetry I have offered my severed head to my beloved. Several of my poems talk about the fingers or feet or eye movement of my beloved.
    Question.13. How has your perception on sex and love changed in your works – from Stark Electric Jesus to later poems ?
    Answer. 13. You can not stick to the same type of poetry throughout your life. It changes with reading world poetry as well as  experience. Otherwise there is no use of publishing poetry collections after the first one. Love is a maddening experience. Moreover the idea sex changes with age. I had published a book titled ‘অ’, the first vowel in Bengali, in 1998, and in that book I have dissected twenty three poems of mine including the vocal speed factor in SEJ. Love is maddening, fascinating, intoxicating and sometimes disastrous. My cousin sister Meenakshi wanted to marry a Bihari non-Brahmin boy; no one in our family was agreeable – I completed the solemnization wearing a pink dhoti, yellow cotton shawl and cohl in my eyes according to their custom, at a mas marriage in a temple in Khusrupur, Bihar. My sister in law Ramola wanted to marry a non Brahmin boy for which none in Nagpur was agreeable ; I had to bring the couple to Patna and solemnise their marriage at Arya Samaj. Aunt Omiya, wife of uncle Anil was in love with a person who did not marry, went to live at Aurobindo Ashram, Pondicherry. Aunt Omiya maintained relations with him and often visited Pondicherry, an affair which imbalanced uncle Anil who became a recluse, washed his own clothes, gave up wearing shoes, ate only once a day and stopped talking to everyone except Dad. He died alone at Uttarpara weeping for aunt Omiya, who had died of breast cancer. Uncle Sunil’s daughter Puti fell in love with a boy working as a bearer at her father’s catering job ; since nobody agreed, she died by hanging herself. Puti’s brother Khoka knew that his father would not agree and therefore eloped with the lower caste girl he loved and went to live at Hyderabad. The girl was brilliant in mathematics and became a famous convent teacher at Thane, near Mumbai.  Samir was in love with a married lady named Gouri to whom he dedicated his first collection of poems ; in order to maintain relations with her family he married her younger sister Bela. A junior lady officer at Lucknow was in love with me and caught hold of my hand at a bus station when I was going on tour and said, “let us elope. I have told your wife that I love you.” I was stunned and convinced her that we may think over the issue calmly afterwards. She committed suicide after her marriage. Another junior lady officer at Mumbai, came to me one day and introduced herself by declaring, “you know, I do not have a uterus.” I had to avoid talking to her thenceforth. Youngest uncle Biswanath married a tenant’s daughter Kuchi at Uttarpara though granny did not approve of it, since the girl belonged to same gotra. Because of Biswanath’s threats, granny had to agree. The couple used to sleep in Dad’s studio at Dariapur ; when they left Patna and went to live at Kotrong, a hut with land,  purchased by Dad, after about five years, Sentu and myself found in the trunk left by them several photographs of naked aunt Kuchi in various poses copying western artists. They were childless. Aunt Kamala’s daughter Geeta eloped with her husband’s nephew, an incident which had to be approved in a family meeting in which I was present. They did not marry, just lived-in together. Aunt Kamala’s husband committed suicide. Love has such strange getaways.
    Question.14. Politics seems to be more relevant to your novels than to your poetry. We have seen your narrative shifting to economic disorder, terrorism, political scam, government corruption etc. Would you say that your poetry (or that poetry in general) is political? And if yes, how?
    Answer.14. Why ? The long poem Jakham and the short poem Kamor I wrote during the Hungryalist movement were political. Jakham has been reprinted five times. Some poems in Medhar Batanukul Ghungoor, Ja Lagbey Bolben and Kounoper Luchimangsho are political. If you listen to Indian urdu poets you would know how poetry is being used as a political tool. Indian lady poet Iqrar Khalji writes and recites poems against religious restrictions. Literature in general has always been utilised to speak on important issues in a way that articulates an author’s feelings of injustice. Hungryalist movement itself was a result of Samir and my feelings about refugees on Kolkata’s Sealdah station platforms. Politics has become more relevant because of experience gathered by me during my tours in Indian villages. I have dealt with exploitation of tribals in my novels Ouras and Nongraporir Konkal Premik ; the second one is a detective love story.
    Malay Roychaudhury On Writing
    Question.15. You are both a poet and a prose writer, perhaps more of a poet in your youth and a prose writer in your adulthood. Would you say this is a historical shift? Do you still write poems?
    Question. 15. Yes, I still write poems. I have published a total of thirteen collections in India ( the last one titled ‘Domni’ in 2020, love poems of a poet as a Baul ) and one in Bangladesh in 2019 which contains about hundred poems from various periods. A collection which includes novella, poetry, short story, translated poems, interview and analysis of my works was published in 2019. I have also written four poetic dramas. I am in search of a publisher who will publish all my poems and poetic dramas in one volume. I write prose to unburden myself of the nightmares seen by me during my tours. I have included real life incidents in some of my novels. In essays I try to present the human condition seen by me throughout India. During some of my tours in West Bengal I used to take Shalila with me so that she could enter the houses and find out the real state of the families.
    Question.16. How different is it to write a piece of prose and a poem? How different is the Malay-poet from the Malay-prose writer? 
    Question.16. They are very different. Poems require a flash in the form of an image or line or idea or even a word ; one has to work on its diction, rhythm, images and choice of words. Earlier, when my fingers were not struck by arthritis, I used to keep a paper when I went out of home and note the ‘flash’ for using it later.  For writing novels I generally think of the entire story for days together and start writing ; I keep on working on the language and structure so that I do not repeat the same. It takes several months. For essays I start writing and keep on reading on the subject. 
    Question.17. What kind of things do you write or like writing today?
    Answer.17. I am thinking of writing a novel on the Marichjhapi massacre as a magical realist novel. Marichjhapi massacre refers to the forcible eviction of thousands of Bengali Hindu Dalit  refugees who settled on  forest land in Marichjhapi island in the Sundarbans, West Bengal, in 1979, and the subsequent death of hundreds refugees due to gunfire by police, rape, party atrocities,  hutments set on fire, blockades and resultant starvation, and disease. Several tigers became man eaters after eating floating corpses. I shall be using real life characters and that is the reason for resorting to magic realism. Otherwise I contribute to little magazines at the request of their editor.
    Question.18. Which writers/books/genres do you like reading today?
    Question.18. To be frank, I do not get time to read others. I go through the little magazines sent to me and read a piece or two. We have become old and I help Shalila in cutting vegetables and cooking, loading washing machine, drying clothes etc. 
    Question.19. Tell us a bit about the writing process, if there is one. How do you come up with the right idea at the basis of a novel, and how do you feel it is right? How was it for you in the past? What is it that inspires you and pushes you to write?
    Question.19. I have become addicted to writing. Writing has become some sort of drug. I do not drink or smoke anymore. These days I write several  novels and essays in draft form at the same time. I am a loner and I write every day. My tours throughout India have enriched my stock of experience in such a way that I use  incidents in my novels and essays. If a poem crops up I make a draft thereof as well , and after finishing it send it to any little magazine editor when requested.
    Question.20. In the last decade, young people in India and elsewhere in South Asia have been protesting for various reasons, and especially against the conservative measures taken by the BJP government. Freedom of speech and censorship have come back to the centre of political discussion, and university campuses have been one of the main battlefields. What is your take on that, having been a censored and banned poet in the past? Is there any continuity you see in India’s censoring policy since then?
    Answer.20. The censoring policy and process now has become more draconian. During Left rule in West Bengal, several plays were barred from being enacted, even famous writers like Nabarun Bhattacharya were denied permission.. Ananda Margies were burnt alive in Kolkata ; massacres took place in Nanoor, and Nandigram. I have used Rabindra Nath Tagore’s story ‘Kshudhita Pashan’ to impose on it the Sainbari killings in which the mother was fed  rice soaked in her sons’ blood. The leftist strategy of territorial control, called ‘elaka dokhol’ in Bangla, by slaughtering opponents, was one of the Left’s most potent political weapons. The new menace is fascist BJP. The Bharatiya Janata Party is a steam roller party, far more dangerous,  levelling all citizens into an idea of vague Hindu Nationalist ‘Indian Culture’ conceived by them. During my tour I had visited Ayodhya and what they called Ram Janmabhoomi ; I found that except for a sleeping constable on a charpoy the premises were completely empty. Now a huge temple is coming up in its place. I think because of poet Tulasidas’s Ramcharitmanas, Ram acquires an important place in the Hindi speaking population. These days reporters are murdered and cases do not reach the courts. BJP is funded by crony capitalists and most of the print and electronic media are controlled by them. Problem with fascism is that only few at the top decide and millions follow them.
    Question.21. Do you think that poetry can be a means to protest?
    Answer.21. Yes, it certainly can and is being used as a means of protest in various languages in India. The relationship between protest and poetry is not new in India and it goes back to before partition. This relationship can be traced back to the formation of the Progressive Writers Association in the 1930s. Hindi and Urdu language writer Premchand was made the president. Writers, poets, play writers joined the association in great numbers. Some of them included Faiz Ahmed Faiz, Saadat Hasan Manto, Ismat Chugtai, Mulk Raj Anand, Maulana Hasrat Mohani, Sahir Ludhayanvi, Kaifi Azmi, and others. Recently, Nabina Das has edited an anthology of protest poems in English titled Witness – The Red River Book of Poetry of Dissent (2021)’.Telugu poet Varvara Rao, presently on bail,  was in jail for a long time. In 2021 I published an anthology of poems translated by me titled ‘Anti Establishment Foreign Poets’ which includes poems of Afghan, Ugandan, Israeli, Iranian, Cuban, Uighur, Chilean, Tibbettan, Nigerian, Pakistani, French, Indian and Russian poets.
    Question.22. If you could meet the young Malay in the early 60s, what would be your suggestion to him? Would you do anything differently, would you change anything?
    Answer.22. Recently I saw an Anti-Establishment little magazine editor in North Bengal  hired a vehicle with a loudspeaker and read out the poems and essays while moving throughout the town. He was obviously called by Police. I liked the idea and would have used the method to spread our presence throughout Kolkata and other West Bengali cities. In the 1960s our reach was limited to editors and academicians. I would have contacted young writers at district level and invited them to join. We remained Kolkata-centric and did not spread. 
    Question.23. In what way, with which feelings, do you look back at the Hungry Generation and at that period? Do you have any regrets?
    Answer.23. My regret is that I could not prevent the insult of my parents by the Kolkata Police.  Afterwards when my Dad died I could not be present ; I was on tour in Orissa at that time.
     
  • সজ্বল দত্ত | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৮738578
  • ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার  মুখোমুখি মলয় রায়চৌধুরী 

    ( ” বারাকপুর স্টেশন ” কবিতা পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায়   মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজ্জ্বল দত্ত। সাক্ষাৎকার সহায়তা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রাজদীপ ভট্টাচার্য) 

    সজ্জ্বল দত্ত: মলয়দা , বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনি এই সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়েছেন এজন্য আমরা যারপরনাই উল্লসিত। শুরুতেই আপনার ছোটবেলার কথা, জন্ম, পারিপার্শ্বিক এবং বাল্যশিক্ষার বিষয়ে আমাদের যদি একটু জানান।

    মলয় রায়চৌধুরী : প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ধন্যবাদ । কিন্তু প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার কোনো বই পড়ে করা হয়নি । আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ের চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রতিভাসের, নাম ‘ছোটোলোকের জীবন’ । আমি জন্মেছিলুম পাটনায় সরকারি হাসপাতালে ১৯৩৯ সালে । আমরা থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা মহাদলিত আর গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা বস্তিতে । বাবা ছিলেন কুড়িজনের পরিবারের প্রধান রোজগেরে । পরে বড়োজেঠা পাটনা মিউজিয়ামে মূর্তি আর পেইনটিঙ ঝাড়পোঁছের ক্লাস ফোরের চাকরি পান । শিক্ষা পাটনাতেই, রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে। সেখানকার গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম।
    সজ্জ্বল :  বাংলা সাহিত্য ও কবিতার প্রতি আপনার ভাব-ভালোবাসার শুরুয়াত হল কীভাবে?
    মলয় : আমার পড়াশোনা পাটনায় হলেও, দাদা সমীর রায়চৌধুরীর চরিত্র পাড়ার প্রভাবে খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে ওনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । দাদা পাটনায় আসার সময়ে প্রচুর বাংলা বই আনতেন । আমি তিরিশের দশকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই । পাশাপাশি ইংরেজি কবিদেরও পড়া আরম্ভ করি, যাদের কবিতাপাঠ ম্যাকলে সাহেবের চাপে স্কুল আর কলেজের পাঠ্যে ঢুকেছিল । ১৯৫৯ নাগাদ বাবা একটা সুদৃশ্য ডায়েরি দিয়েছিলেন, তাতেই কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলুম ।
    সজ্জ্বল :  আপনার দাদা আপনার সাহিত্যচর্চায় কতটা প্রভাবিত করেছেন আপনাকে?
    মলয় : দাদা পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক প্রভাবে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিলেন । আমার বিপরীত । উনি ছিলেন সোফিসটিকেটেড । আমি মিশতুম পাটনার লুচ্চা-লাফাঙ্গাদের সঙ্গে। ইমলিতলায় ছোটোবেলাতেই শুয়োরের মাংস, ইঁদুর পোড়া আর তাড়ি খেয়ে ভিন্ন ধরণের জীবনে ইনিশিয়েশন হয়েছিল । ইমলিতলার বন্ধুরা আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল । দোলখেলার সময়ে পাড়ার মহিলারা যৌনতার ইনহিবিশিন বাদ দিয়ে মেতে উঠতেন রঙ খেলায় । আমার প্রথম বন্ধুনি ছিলেন কুলসুম আপা নামের এক কিশোরী, যিনি আমার সঙ্গে গালিব আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজের পরিচয় করান । ওনার সম্পর্কে মন খুলে লিখেছি বাল্যস্মৃতিতে । একজন যুবতীর যোনি উনিই প্রথম প্রত্যক্ষ আর অনুভব করতে দিয়েছিলেন।

    সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলন বিষয়ে অবহিত নন যে পাঠক তাঁদের কথা ভেবে আপনাদের আন্দোলনের পশ্চাদপট এবং শুরুর দিনগুলির কথা সংক্ষেপে  একবার আমাদের জানান ।  
    মলয় : হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ৯৯% বাঙালি পাঠক অবহিত নন। পাঠক কেন, তরুণ কবি-সাহিত্যিকরাও জানেন না। অনেকে তো আমার নামই শোনেনি । তাই তাঁদের কথা আর ভাবি না । 
    সজ্জ্বল : ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহুপাঠকের ভেতরে অবধারিতভাবে উঠে আসবেই  মলয় দা, আপনার কবিতা কি আদৌ বুভুক্ষুদের কথা বলে নাকি অহৈতুকী যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?
    মলয় : কী আর বলি ? আমার লেখাপত্র তো পড়ো না । পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম । আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল । আমি ক্ষুধা শব্দটা ব্যবহার করিনি । চিরকাল হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি । ‘হাংরি’ শব্দটা প্রথমে পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের ‘In Swore Hungry Time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Decline of the West’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম হলো: 
    “কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।”
    এই হাঙ্গার  শুধু আক্ষরিক অর্থেই হাঙ্গার ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের হাঙ্গার, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষার হাঙ্গার। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছিল যে কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে আমি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চেয়েছিলুম। এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যৎবাণী বলে মনে হবে ।
    সজ্জ্বল :খুব সত্যি কথা , এ’ বিষয়ে আপনিও নিশ্চয়ই অবগত আছেন , হাংরি আন্দোলনের অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করতেন যে আপনিই এই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন! আপনার কী বক্তব্য ? 
    মলয় : আমি আর ছুরি মারব কেমন করে ? আমার বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল ৩৫ মাস। বন্ধুরা বেশির ভাগ রাজসাক্ষী হয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশে বয়ান দিয়েছিল আর কেটে পড়েছিল । সাক্ষী হবার জন্য আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকাও পেয়েছিল । এইসমস্ত বন্ধুদের ঘৃণ্য মনে হয়েছিল। হাইকোর্টে মামলা জেতার পর ঘেন্নায় আমি এদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম । সৌভাগ্যবশত পাটনায়  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর চাকরি ছেড়ে এআরডিসিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের চাকরি পেয়ে লখনউ চলে যাই । নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে টের পাই যে চাষবাস, পশুপালন, জলসেচ, গ্রামজীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না । এই সমস্ত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হয়েছিল । সাহিত্যের বই পড়া আপনা থেকেই পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলুম । তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার ফলে এখন আমার পেনশন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওনের চেয়েও কম ।
    সজ্জ্বল : রমানাথ রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বিষয়ে আপনার কি মত?
    মলয় : রমানাথ রায় তো কবিতা লিখতেন না ! শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখেছি। নেটে পাবে প্রবন্ধটা ।
    সজ্জ্বল : কবিতা রচনায় বেশি মনোযোগ না দিলেও আসলে রমানাথ রায়ের কিছু ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্পনির্ভর কবিতার কথা বলতে চেয়েছিলাম । যেমন – ‘ রাস্তায় রাস্তায় ‘ , ‘ চালের বদলে ‘ , ‘ আমার বুক ‘ ইত্যাদি । যাইহোক আপনার উত্তরে বুঝতে পারছি এগুলো আপনার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি । থাক সে প্রসঙ্গ । রমানাথ রায়ের কথা যখন উঠলোই , এই অবসরে বরং আপনার কাছ থেকে একটু জেনে নেওয়া যাক হাংরি আন্দোলনেরই প্রায় সমসাময়িক রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ দের ‘ শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন ‘  সম্পর্কে । হাংরি আন্দোলনের ঠিক পাশাপাশি এই আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী ? আরো একটু নির্দিষ্ট বিন্দুতেই আসা যাক । ধরুন আপনার সম্পাদিত পত্রিকা ‘জেব্রা ‘র সঙ্গে সেইসময় শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ‘ এই দশক ‘ এর দৃষ্টিভঙ্গী ও লেখা নির্বাচনে ঠিক কী ধরনের মিল-অমিল আপনি চিহ্নিত করবেন ?
    মলয় : শাস্ত্রবিরোধিরা গল্প লেখায় প্রশংসনীয় কাজ করেছেন সেসময়ে । হাংরি আন্দোলনে কেবল সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত গল্প বা ফিকশানাল ন্যারেটিভ লিখতো । সুবিমল লিখেছে বাঙাল বুলিতে আর ডায়াসপোরিক বাংলায় । সুভাষ ঘোষ লিখেছে ক্রিপটিক ডিকশানে । কেবল বাসুদেব দাশগুপ্ত যে ধরণের গল্প লিখেছে তার সঙ্গে শাস্ত্রবিরোধিদের তুলনা করা যায় । আমি, ফালগুনী, অরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার অনেক পরে ফিকশান লেখা আরম্ভ করি । জেব্রার মোটে দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, শাস্ত্রবিরোধিদের বহু পত্রিকা আর বই প্রকাশিত হয়েছিল । 
    সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা গভীরতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী  কবি কে বা কে কে? কার কার নাম করবেন ? 
    মলয় : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত । আমি এনাদের সবায়ের সম্পর্কে লিখেছি । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার মূল্যায়ন আমিই প্রথম করেছিলুম, কিন্তু উনি যতোদিন বেঁচেছিলেন আমাকে গালমন্দ করে গেছেন, এমনকী নিজের মেয়েকেও বলে গিয়েছিলেন যে উনি মারা যাবার পর ওনার মেয়ে যেন তা বজায় রাখেন । হয়তো ওনার নাতিও বড়ো হয়ে তা বজায় রাখবে ।
    সজ্জ্বল : খুব স্পষ্ট এবং খোলাখুলিভাবে জানতে চাইছি মলয়দা , হাংরি আন্দোলনের ভাষাতেই জানতে চাইছি , জীবনের এই প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে আপনি কী মনে করেন ? তরুণ হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরীর ” প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ” তদানীন্তন থেকে প্রবহমান বাংলা কবিতায় আদৌ কিছু কী ‘ছিঁড়তে’ পেরেছিল , বা পারল ? 
    মলয় : এটা বাঁকবদলের কবিতা । অনেকে বুঝতে পারেনি ‘ছুতার’ শব্দটা কিসের দ্যোতক ! এই কবিতার প্রভাবে বাংলা কবিতার শব্দভাঁড়ারে অভূতপূর্ব সব বদল ঘটে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শব্দভাঁড়ারকে বর্জন করার ফতোয়া ছিল কবিতাটা । দানিয়েলা কাপেলো আর শীতল চৌধুরী এই কবিতাটার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাংলা কবিতায় কেমন প্রভাব ফেলেছে । দানিয়েলার বিশ্লেষণ পাবে অ্যাকাডেমিয়ার সাইটে । শীতল চৌধুরীর প্রবন্ধটা নেট সার্চ করলেই পাবে।
    সজ্জ্বল দত্ত : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ শয়তানের মুখ ‘ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে । কৃত্তিবাসের কর্ণধার যিনি ছিলেন তার সঙ্গে তখন আপনার সম্পর্কের রসায়ন যাইই থাক , পরবর্তীকালে তার গোটা জীবনের সাহিত্য কর্মকাণ্ড এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা ও প্রকাশনীর সাহিত্যধারার ওপর বড় করে আলো ফেললে পরে কখনো কি আপনার মনে হয়নি যে আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি আপনার  আদর্শগত জায়গার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করা কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ?
    মলয় : কৃত্তিবাস তখনও মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হয়নি । সুনীল তখনও পত্রিকাটা কৃত্তিবাসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আনন্দ বাগচীর থেকে ছিনিয়ে নেননি । আনন্দবাজারে সুনীল ঢোকার পর কৃত্তিবাস পালটি খেয়ে যায় । আমার ‘রাহুকেতু’ আর ‘চাইবাসা আবিষ্কার’ উপন্যাস পড়লে ব্যাপারটা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে । আমার স্কুলে পড়ার সময় থেকে সুনীল আমাদের পাটনার আর উত্তরপাড়ার বাড়িতে আসতেন । সুনীল যখন বেকার তখন দাদা কৃত্তিবাস চালাবার খরচ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বইতে পাবে । সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’ দাদা ছাপিয়েছিলেন ‘সাহিত্য প্রকাশক’ নামে প্রকাশনার নাম দিয়ে। তাই বইটা কৃত্তিবাস থেকে বেরিয়েছিল বলে আমার অবস্হানের কোনো বদল ঘটেনি । সুনীল অবশ্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমার আর দাদার কাছে কবিতা চাননি ।
    সজ্জ্বল : এটা কিন্তু আজ সর্বস্তরেরই সাহিত্যপাঠক বিদিত একটি সত্য যে হাংরি আন্দোলন তাৎক্ষণিক একটা হৈচৈ পাঠকমহলে তৈরী করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত এই সাহিত্যআন্দোলন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং  সমাজমানসে দীর্ঘ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি । এর কারণ কী বলে মনে করেন ? অন্ত:সারশূন্যতা ?
    মলয় : তোমার বোধহয় জানা নেই যে এই আন্দোলন নিয়ে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় আর বিদেশি ভাষায় গবেষণা হয়েছে আর এখনও হচ্ছে । এখনও পিএইচডি আর এমফিল করছেন অনেকে । ইতালি থেকে দানিয়েলা কাপেলো এসে তথ্য সংগ্রহ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডক্টরেট করেছেন জার্মানি থেকে । ওনার গবেষণার বইটা ইংরেজিতে প্রকাশের তোড়জোড় চলছে । উনি ফালগুনী রায় সম্পর্কে বাংলায় যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেটা আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি । সম্প্রতি  ইংরেজিতে পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা বই বেরিয়েছে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে । রাহুল দাশগুপ্ত আর বৈদ্যনাথ মিশ্র দুজনে একটা ইংরেজি সংকলন প্রকাশ করেছেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকা নিয়ে জুলিয়েট রেনল্ডস ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ’ নামে একটা বই লিখেছেন ২০১৮ সালে । জনমানস বলতে তুমি বোধহয় কফিহাউসের আড্ডাবাজদের বোঝাতে চেয়েছো ।
    সজ্জ্বল : ঠিক তা নয় । একটু আগেই এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বললেন “এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হবে” । আপনার ওই বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন যদি আপনার কবিতা তথা সমগ্র হাংরিকবিতা হয়, তবে এখনকার পশ্চিমবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘Gungshalik school of poetry’ কে সরিয়ে ‘আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও’ কিংবা ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়’ –এর মতো লাইনের কবিতাধারা পুরোপুরি বা অংশতঃ কোনোভাবেই কি ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিম কবিতা হয়ে উঠতে পারতো না ? ঠিক যেমন ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের রোম্যান্টিক কবিতাধারাকে ঠেলে সরিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এজরা পাউণ্ড , এলিয়ট , ইয়েটস্ – দের modern movement কবিতাধারার মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠতে পেরেছিল , colonial literature ধারাকে পরবর্তীতে ঠেলে সরিয়ে আফ্রিকায় চিনুয়া আচেবে বা যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকায় সলমন রুশদি ও গার্সিয়া মার্কেজরা তাদের post colonial literary movement কে অনেকখানি মেইনস্ট্রিম করে যেতে পেরেছিল ? … জনমানসে প্রভাব বলতে হাংরি সম্পর্কে এটাই জিজ্ঞাস্য ।
    মলয় : কবিতার মেইনস্ট্রিম সরকার আর অকাদেমির সমর্থন ছাড়া হয় না । এখন কবিতার মেইনস্ট্রিম মানে চটিচাটার দল । তবে, তার বাইরে আমাদের প্রভাব লক্ষণীয়, অন্তত ফেসবুক আর ব্লগজিনগুলোতে নজরে পড়ে । ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের লিফলেট আর লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের তুলনা করা উচিত নয় । আমার তো প্রকাশকই জোটে না । গাঙচিল নামে এক প্রকাশনার কর্ণধার বললেন, “আপনার বই কেন ছাপবো ? আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোবে না” । মেইনস্ট্রিম ফিকশান হতে হলে, যে বিদেশিদের নাম তুমি করলে, বড়ো প্রকাশনা দরকার, অনুবাদক দরকার, রিভিউকার দরকার । হাংরি আন্দোলনের কারোরই সেসব জোটেনি । বাংলা থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ না হলে ওনাদের মতন নজরে পড়া অসম্ভব । ইংরেজিতে অনুবাদের পরও রিভিউকারদের নজরে পড়া দরকার, নেটওয়র্কিঙ দরকার । শঙ্কর, সুনীল প্রমুখের বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু বিদেশে আলোচিত হয়নি । 
    সজ্জ্বল : একবিংশ শতকের লেখক-কবিদের উপর হাংরি প্রভাব কতটা পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
    মলয় : এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । এসব গবেষকরা বলবেন ।
    সজ্জ্বল : ঠিক দু’বছর আগে হাংরি পরবর্তী বাংলা কবিতার আর এক আন্দোলন ” শতজল ঝর্ণার ধ্বনি “র অন্যতম প্রধান মুখ কবি দেবদাস আচার্য এই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকাতেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন ” প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নয় , সঠিক শব্দটা বোধহয় হওয়া উচিত অপ্রাতিষ্ঠানিক ” । আপনি এই দুই শব্দের মধ্যে কোনটা পছন্দ করবেন? 
    মলয় : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । উনি বোধহয় প্রতিষ্ঠান বলতে সংবাদপত্রের কথা বলতে চেয়েছেন । প্রতিষ্ঠান বলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে, অর্থনৈতিক কঙগ্লোমারেটদেরও বোঝায় । আমি ফেসবুকে এই পোস্টটা দিয়েছিলুম, দেখেছো কিনা জানি না : “গৃহবধূর চটি মারার সাবাশি বিষয়ক: –সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য রাজনৈতিক চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।” বিরোধিতা না করলে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র নামের ডিকটেটরশিপে পরিণত হবে ।
    সজ্জ্বল : আপনার সাহিত্য জীবনের প্রায় গোটাটাই বাংলার বাইরে কেটেছে। ২০১৩ সাল নাগাদ একবার কোলকাতায় এসে কিছুদিন এখানে থাকার চেষ্টা করেও অবশেষে ফিরে গিয়েছেন। সাহিত্য জগতে আজীবন নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আপনাকে কোথাও হতাশ করে? নাকি তা শাপে বর হয়েছে?
    মলয় : না । কলকাতায় যতোদিন পিসেমশায় ছিলেন ততোদিন মাঝে-মাঝে গেছি । পিসেমশায় আত্মহত্যা করার পর পিসিমা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোতরঙ চলে গেলেন । কলকাতায় তো কোনও আত্মীয় স্বজন ছিল না তাই আদিবাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খণ্ডহরে গিয়ে থাকতে হতো। উত্তরপাড়ায় ইলেকট্রিসিটি আর জলের কল ছিল না, ঠাকুমার হবিষ্যি খেতে হতো, নয়তো মুড়ি-মুড়কি, সেসময়ে খাবার হোটেল ছিল না উত্তরপাড়ায় । ১৯৮৮ সালে নাকতলায় একটা ফ্ল্যাট কেনার পর নিয়মিত থেকেছি । ১৯৯৫ সালে কলকাতা অফিসে বিভাগীয় আধিকারিক হয়ে গিয়েছিলুম । ওই সময়েই দাদা হাওয়া-৪৯ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । ১৯৮৮ এর আগে বারুইপুরে উত্তম দাশের বাড়িতে গিয়ে থাকতুম । ১৯৮৫ নাগাদ উত্তম আমার বেশ কয়েকটা বই প্রকাশ করেছিলেন । আমি আর উত্তম সন্ধ্যাবেলায় কেদার ভাদুড়ির ঘরে মদ খেয়ে নাচার আড্ডা জমাতুম । ওদের কাজের মাসি খুব ভালো মাছ রাঁধতে পারতেন । আসলে আমি সাহিত্যসভা বা কফিহাউসে যাতায়াত করিনি বলে তোমার মনে হচ্ছে কলকাতায় থাকিনি । কলকাতায় চাকরি করার সময়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে চষে ফেলেছিলুম । নামগন্ধ আর নখদন্ত উপন্যাসে সেসব অভিজ্ঞতা পাবে । নামগন্ধ উপন্যাসে আলুচাষের রাজনীতি আর নখদন্ত উপন্যাসে পাট চাষের রাজনীতি নিয়ে লিখেছি ।
    সজ্জ্বল : হাংরি লেখালেখির বাইরে যে বাংলা সাহিত্য সেখানে সাহিত্যিক হিসেবে আপনার পছন্দের মানুষ কারা?
    মলয় : অনেক, অনেক, অনেক । বিশেষ করে তরুণদের লেখা আমার ভালো লাগে ।
    সজ্জ্বল : একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক মলয় রায়চৌধুরীকে কীভাবে মনে রাখবে বলে আপনি মনে করেন ?
    মলয় : মনে রাখার দরকার তো নেই ! দুশো-তিনশো বছর আগের কবিদের অনেককেই কেউ মনে রাখেনি, অনুসন্ধানী গবেষকরা ছাড়া ।
    সজ্জ্বল : সম্প্রতি জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ আমাদের বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য খানিকটা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এমত পরিস্থিতিতে মলয় রায়চৌধুরীর ঈশ্বরভাবনা জানতে ইচ্ছে করে। 
    মলয় : হিন্দুধর্মে ঈশ্বর বলে কিছু নেই । ওটা এসেছে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আর ব্রাহ্মরা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। হিন্দুদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই পূজ্য । তাই আমাদের আছেন দেবী-দেবতারা । আমি কোনো কালে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনি, গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরী ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য হয়েও । জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের বিস্ময় আর জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে ; ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই ।
    সজ্জ্বল : মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আপনার চেতনায় মৃত্যু কীভাবে ধরা দেয়?
    মলয় : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবার দরকার নেই । বরং অসুখে পড়লে হাসপাতালের আর দাহ করার খরচ কেমন করে মেটানো হবে সেটাই চিন্তার। 
    সজ্জ্বল : দীর্ঘ বিরাশি / তিরাশি বছরের ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয় আজ? কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে হয়? জীবনকে বদলে নিতে ইচ্ছে করে? 
    মলয় : হ্যাঁ। বাবাকে মুম্বাই নিয়ে আসিনি বলে রিগ্রেট হয় । এখানে ওনার ভালো চিকিৎসা করাতে পারতুম । ইন ফ্যাক্ট, আমরা বুড়ো-বুড়ি মুম্বাই চলে এসেছি চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার জন্য ।
    সজ্জ্বল : এই প্রজন্মের নবীন কবিকে পোড় খাওয়া বরিষ্ট কবি মলয় রায়চৌধুরী কী উপদেশ দিতে চাইবেন?
    মলয় : বিন্দাস লিখে যাও । কে কী বলছে ভাবার দরকার নেই ।
    সজ্জ্বল : ভালো থাকবেন মলয় দা। পত্রিকার পক্ষ থেকে আরও একবার ধন্যবাদ এবং নমস্কার জানাই।
    মলয় : তুমিও ভালো থেকো, সুস্হ থেকো আর আমার অন্তত একটা উপন্যাস পোড়ো, বন্ধুদের পড়িও । তোমরা তো আমার কোনো বই পড়োনি বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের পত্রিকাও দীর্ঘ জীবন লাভ করুক।
  • দে.চ. | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৫০738579
  •  দেবরাজ: মলয়দা, আপনার লেখার জন্য রাষ্ট্র যখন আপনাকে গ্রেপ্তার করেছিল, তখন আপনার কী মনে হয়েছিল ?

    মলয়: অবাক লেগেছিল । কেননা বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য তার আগে তো রাষ্ট্র এই ধরণের পদক্ষেপ কখনও নেয়নি বলে জানতুম । তাছাড়া আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে ; কলকাতার তৎকালীন কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ ছিল যে আমাকে যেন ওভাবেই হিউমিলিয়েট করা হয় ।

    দেবরাজ: যে-সময়ে রাষ্ট্র আপনার কন্ঠরোধ করেছিল, সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন ।

    মলয়: সে-অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে তোমাদের পত্রিকায় স্হান সংকুলান হবে না । অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু হল যে, সাহিত্যিক লড়াইটা একাই লড়া যায় আর লড়তে হয় ।

    দেবরাজ: আপনার লেখায় বাংলা সাহিত্য এক নতুন ধরণের ভাষা পেল । আপনি কেন এই ভাষাকেই বেছে নিলেন ?

    মলয়: আমি তো ফিকশান লেখায়, কবিতায় আর প্রবন্ধ লেখায়, ভিন্ন ভিন্ন ভাষাকাঠামো ব্যবহার করি । হ্যাঁ, আমি শব্দ আর বাক্যের ব্যাংক তৈরি করেছিলুম আর তা থেকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতুম । ‘সমার্থশব্দকোষ’ও ব্যবহার করেছি বিকল্প শব্দের খোঁজে । ফিকশানের ক্ষেত্রে ‘নখদন্ত’ লেখাটায় খাপছাড়াভাব আনার প্রয়াস করেছিলুম । কবিতায়, ২০০৫ সাল পর্যন্ত কমপ্লেক্স কাঠামোর পর, এখন অবন্তিকাকে নিয়ে যেগুলো লিখেছি, সেগুলো থেকে কমপ্লেকসিটি বাদ দেবার চেষ্টা করেছি । এক্সটেমপোর লেখা লিখে দেখতে চেয়েছি । এক্সটেমপোর গদ্য লিখছি জুবিন ঘোষদের ক্ষেপচুরিয়ান ই-জাইনে । আসলে আরথ্রাইটিসের কারণে কলম ধরতে পারি না বলে কমপিউটারে লিখি ; ফলে এক্সটেমপোর লেখার তাগিদ গড়ে উঠেছে । ‘ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক’ নামের রহস্যোপন্যাসও লিখেছি একই প্রক্রিয়ায় ।

    দেবরাজ: আপনি কি সচেতন ভাবেই এই ভাষাশৈলীকে বেছে নিলেন ?

    মলয়: সব লেখার ভাষাবিন্যাস সচেতন ভাবেই তো করেছি ।

    দেবরাজ: রাষ্ট্র আপনাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল কেন ? ‘অশালীন’ ভাষা ব্যবহারের জন্য , না রাজনৈতিক সচেতনতার জন্য ? আপনার কি মনে হয় ?

    মলয়: সে-সময়ে যারা পশ্চিমবঙ্গের এসট্যাবলিশমেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করতো তারা, যে কারণেই হোক, ভয় পেয়ে গিয়েছিল । এসট্যাবলিশমেন্ট বলতে আমি সংবাদপত্রগোষ্ঠীর কথা বলছি না । আমি বলছি ক্ষমতাধিকারীদের কথা । বলছি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মসনদে আসীন লোকেদের কথা । ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সর্বভারতীয় কর্তা এ.বি.শাহকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার তেমনটাই জানিয়েছিলেন ।

    দেবরাজ: রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী মনোভাবের জন্যই কি আপনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ?

    মলয়: যে-কোনো পুরস্কারই পুরস্কারদাতার মূল্যবোধটি প্রাপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দ্যায়, ওই পুরস্কারের মাধ্যমে । বাংলা অ্যাকাডেমির দিকে তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে ; আগের লট চলে গিয়ে নতুন লট এসেছে, তাদের পুরস্কার-প্রাপকদের তালিকা একেবারে আলাদা । আমি কোনো পুরস্কার নিই না, লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও নয় । আমার নাকতলার বাড়িতে অনুষ্ঠান করে পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন এক সম্পাদক ; তিনি বোঝার চেষ্টাই করেননি আমার অবস্হান । আমি কোনো সম্বর্ধনাও নিই না । এই সব ব্যাপারগুলো আমাকে প্রচণ্ড ডিসটার্ব করে ।

    দেবরাজ: সেই সময়ে আপনার কাছের মানুষ ও সমকালীন লেখকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

    মলয়: কাছের মানুষ বলতে যদি আত্মীয়দের কথা বলছ, তাঁরা ডেট পড়লে  ব্যাংকশাল কোর্টে আমাকে সমর্থন জানিয়ে যেতেন । হাংরি আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সুবিমল বসাক নিয়মিত, আর দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র-আলো মিত্র মাঝেমধ্যে কোর্টে আসতেন । কিন্তু সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে পুলিশের তরফের সাক্ষী হয়েছিলেন ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য ।  দীপক মজুমদার একটা চিঠি তৈরি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে লেখা, আমাকে গ্রেপ্তার আর আমার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করে । সেই চিঠিতে আনন্দ বাগচী ছাড়া আর কোনো সাহিত্যিক সই করতে রাজি হননি ; অনেকে এমনকী দীপককে ভর্ৎসনা করেছিলেন ।

    দেবরাজ: হাংরি আন্দোলনের প্রথমদিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন পরে এই আন্দোলন থেকে সরে যান । এর কী কারণ ছিল বলে আপনি মনে করেন ?

    মলয়: যাঁরা মুচলেকা দিয়েছিলেন তাঁরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন ; শৈলেশ্বর ঘোষ তো কাঁদছিলেন লালবাজারে যখন জেরা করা হচ্ছিল । বোধ হয় চাকরি খোয়াবার ভয় ছিল । কৃত্তিবাস গোষ্ঠী থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা ছেড়ে চলে যান প্রধানত আয়ওয়া থেকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠির আঘাতে-আঘাতে । প্রতিদানে পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হবার পর ওনাদের গ্রন্হ-প্রকাশ, পুরস্কার ইত্যাদির ব্যবস্হা করেছিলেন । সুনীল আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীকেও বলেছিলেন, “তোর ওই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছাড় ; আমার কাছে আয়, আমি প্রকাশকদের বলে তোর বইগুলো বের করে দেবো আর পুরস্কারও পাইয়ে দেবো, দেখতেই তো পাচ্ছিস  কারা-কারা পুরস্কার পাচ্ছে ।

    দেবরাজ: তৎকালীন কোনো সংবাদপত্র কি আপনাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন ? তৎকালীন লিটল ম্যাগাজিনগুলির এই আন্দোলনের প্রতি কী ভূমিকা ছিল ?

    মলয়: না, কোনো সংবাদপত্রের মালিক সমর্থন করেননি বলেই জানি । তবে সে-সময়ে ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রে দুটি সম্পাদকীয় আমাদের সমর্থনে লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর । ‘আনন্দবাজার’, ‘স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্রে কয়েকবার টিটকিরি মেরে কার্টুন বেরিয়েছিল আমার আর দেবী রায়ের । ‘দর্পণ’, ‘জনতা’ ইত্যাদি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে আমাদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখা হতো বা কার্টুন বেরোতো ; আমি গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে দেখা করার পর ‘দর্পণ’-এ তা বন্ধ হয় । হাংরি আন্দোলনের কারণেই লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ ঘটে ; তার আগে হাতে গোণা গুটিকয় লিটল ম্যাগাজিন ছিল যাকে এলিটিস্ট বলাই ভালো । তার সম্পাদকেরা আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলার আগে আমাকে পেডেস্ট্রিয়ান ভাবতেন ।

    দেবরাজ: মলয়দা, এবার একটু অন্য প্রশ্ন করি । এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের পরিস্হতি ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনার কী মত ?

    মলয়: যাঁরা পটবয়লার সাহিত্য করেন তাঁরাই চতুর্দিক ছেয়ে ফেলেছেন । লিটল ম্যাগাজিন স্তরে অনেক কাজ হচ্ছে । আমাদের অ্যাকাডেমিয়া ওই পটবয়লার-জগতের বাইরে বেরোতে চান না । বিদেশি সাহিত্যিকদের নিয়ে আমাদের অ্যাকাডেমিয়া যতটা আগ্রহী ততটা তাঁরা লিটল ম্যাগাজিনের নন-কনফরমিস্ট বাংলা লেখালিখির সঙ্গে নন । তবে বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা যাঁরা অ্যাকাডেমিক জগতে প্রবেশ করছেন তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলা ক্রিয়াটিভ লেখালিখির দিকে নজর দেবেন বলে মনে হয় । এটা যে হবে তা এইজন্য বলছি যে তা না হলে আমার সম্পর্কে একজন তরুণ লেকচারার পিএচ ডি করবেন কেন ! আমাকে বেশ কয়েকজন লেকচারার বলেছেন যা তাঁরা বাংলা অ্যাকাডেমিয়ায় পরিবর্তন ঘটাবেন ।

    দেবরাজ: বর্তমান বাংলা সাহিত্য জগৎ কি ক্রমশ রাজনীতি-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে ?

    মলয়: সমগ্র সাহিত্য জগৎ নয়, তবে সাহিত্যিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়ে গেছেন দলাদলিতে । দলাদলি না করলে স্বীকৃতি মেলা, বই প্রকাশ ও বিক্রি, পুরস্কারপ্রাপ্তি ইত্যাদি আজ অসম্ভব । বঙ্গসমাজ সহজে এই ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না । বহু লেখকই মনের কথা আর লিখতে চান না ।

    দেবরাজ:  আপনার অনেক লেখা আমরা ই-ম্যাগাজিন বা ইনটারনেটে দেখতে পাই । লেখার জন্য এই মাধ্যমটিকে আপনার কতটা গুরূত্বপূর্ণ বলে মনে হয় ? এর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে ?

    মলয়: ইনটারনেটের মাধ্যমে আমি সারা পৃথিবীর পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমার লেখা পৌঁছে দিতে পারছি । তার আগে আমার এত পাঠক-পাঠিকা ছিল না । উন্নত দেশগুলোয় ইনটারনেট বেশ গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । কিন্ডল-এ অনেক বই আপলোড করে যখন ইচ্ছা পড়তে পারছেন পাঠক । ওপার বাংলায় ইনটারনেটে বাংলা ভাষায় যা ঘটছে তা থাকে অনুমান করা যায় যে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গেও এর গুরুত্ব বাড়বে । নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক অবস্হা আর শিক্ষা কোন দিকে যায় তার ওপর ।

    দেবরাজ : এই সময়ের কার-কার লেখা আপনার ভালো লাগে ?

    মলয়: একটা লেখা ভালো-খারাপ বাইনারি দিয়ে যাচাই করার ব্যাপারটা এনেছিল  প্রাগাধুনিক ইউরোপীয়রা । একটা লেখায় কী করার প্রয়াস করা হয়েছে সেইটেই দেখার । জেমস জয়েস বা মার্সেল প্রুস্ত পড়ে অনেক কম পাঠকের ভালো লাগবে । কিন্তু তাঁদের জন্যই তাঁদের মাতৃভাষা আজ এত উন্নত ।

    ( পারেজিয়া পত্রিকার সম্পাদক দেবরাজ চক্রবর্তীর নেওয়া সাক্ষাৎকার।২০১৩ সালে পারেজিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত। )
  • জ.ভ. | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৫৯738580
  • মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলাদেশের কবি মেহদী হাসান স্বাধীন
    .................................................................
    মেহেদী হাসান স্বাধীন : হাংরি কি দাদাইজমের একটা নতুনরূপ?

    মলয় রায়চৌধুরী : সমস্যা হলো যে বাংলাদেশে হাংরি আন্দোলনকারীদের বই বহুকাল যায়নি । এখন যাচ্ছে । তাও সবায়ের বই পৌঁছোয়নি । অনেকে ইনটারনেট থেকে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে । অর্থাৎ ষাট বছর আগে । অথচ বইপত্র পৌঁছোয়নি । তার মানে যিনি খবর পাচ্ছেন তিনি নিজের মনে ভাসাভাসা ধারণা গড়ে নিয়েছেন । ডাডা আন্দোলনের পর ইউরোপ-আমেরিকায় আরও বহু আন্দোলন হয়েছে, পশ্চিমবাংলাতেই হয়েছে নিম-সাহিত্য, শাস্ত্রবিরোধী, শ্রুতি ইত্যাদি আন্দোলন । এমনকি পরাবাস্তববাদ আন্দোলনকেও ডাডা আন্দোলনের নতুন রূপ বলা হয় না । ত্রিস্তান জারার রচনার সঙ্গে যেমন আঁদ্রে ব্রেতঁর রচনার ভাবনাধারার মিল নেই, তেমনই ওনাদের ভাবনাধারার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকারীদের মিল নেই । তুমি ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত, সুভাষ ঘোষ, অরুণেশ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখের রচনা ডাডাবাদীদের পাশাপাশি রেখে পড়ে দেখতে পারো, তাহলেই টের পাবে । আমার প্রায় দুশোটা বই আছে, কবিতা, ছোটগল্প, স্মৃতিকথা, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ ইত্যাদি নিয়ে । এর মধ্যে কয়টা যে বাংলাদেশের পাঠকের কাছে পৌঁছেচে তা জানি না । তার ফলে অমন ধারণা তৈরি হয়েছে । এখন অবশ্য ঢাকার কয়েকজন প্রকাশক আমাদের বই প্রকাশ করায় আগ্রহ দেখিয়েছেন । সংগ্রহ করে পড়লে স্পষ্ট হবে ধারণা ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : হাংরি আন্দোলনকে কেন ইন জেনারেল ভিত্তি দেয়া যায়নি?

    মলয় রায়চৌধুরী : ঠিক কী বলতে চাইছ বুঝতে পারলুম না । হাংরি আন্দোলন নিয়ে তো প্রচুর পিএইচডি আর এম ফিল হয়েছে, হয়ে চলেছে । ভারতের অন্যান্য ভাষায় এই আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা হয়েছে । কেবল আমার কবিতা নিয়েও একজন ডক্টরেট করেছেন। জার্মানিতে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএই্চডি করেছেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে । হ্যাঁ, বলা যায় যে বাণিজ্যিক প্রচার হয় না কেন ! তার কারণ পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক রাজনীতি । তাছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীরা কোনও সংবাদপত্রে আর রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিতে চায়নি । যারা নিয়েছে তাঁরা নিজেরাই আন্দোলন ত্যাগ করেছিলেন ; যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ । বিনয় মজুমদার কিন্তু আন্দোলন ত্যাগ করেননি ; একটা সাক্ষাৎকারে উনি আপশোষ করেছেন যে আন্দোলনের নেতা হবার কথা ছিল ওনার কিন্তু ওনাকে নেতা করা হয়নি । ওনার ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো তো হাংরি আন্দোলনের কবিতা । বিনয় তাই উপেক্ষিত ; ওনাকে অকাদেমি পুরস্কার দেয়া হয় জীবনের শেষ পর্বে। আরেকটা কারণ হল কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ । আমার বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাস ধরে মামলা হয়েছিল ; প্রদীপ চৌধুরীকে বিশ্বভারতী থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল, উৎপলকুমার বসুকে যোগমায়া দেবী কলেজের অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল ; সুবিমল বসাক আর দেবী রায়কে সরকারি চাকরিতে কলকাতার বাইরে ট্রান্সফার করে দেয়া হয়েছিল । ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্হ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, বইটা পড়লে জানতে পারবে,  হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা  । উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন । একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় । সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর  নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সাংবাদিকরা,  ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না ।  তাঁরা গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ছোটো গল্পকার । 

    গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ
    শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।
    উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ । 
    ১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই রকমই ছিল তখনকার প্রতিক্রিয়া ।
    মেহেদী হাসান স্বাধীন : আন্দোলনটা ধপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল ?
    মলয় রায়চৌধুরী : বাংলাদেশে বসে সম্ভবত এরকম একটা ধারণা হয়ে থাকবে । মামলা হবার দরুন আমি বন্ধু-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলুম । কিন্তু হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা তো নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে । আমার মতন অরগ্যানাইজিং কেপেবিলিটি ছিল না বলে সেই সব পত্রিকা তেমন প্রচারিত হয়নি । প্রদীপ চৌধুরীর ‘ফুঃ’ পত্রিকা গত বছর ওনার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে । সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত নিয়মিত ‘ক্ষুধার্ত’, ‘ক্ষুধার্ত খবর’ প্রকাশ করেছেন । ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার সব কয়টা সংখ্যা নিয়ে ভারতের সাহিত্য অকাদেমী থেকে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । আমি ‘জেব্রা’ পত্রিকা প্রকাশ করতুম । সেগুলো নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘অখণ্ড জেব্রা’, সমীরণ মোদকের সম্পাদনায়, ঢাকায় তক্ষশীলাতে পাওয়া যায় । সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, অরুণেশ ঘোষ সম্পাদিত ‘জিরাফ’ পত্রিকার সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করেছেন সমীরণ মোদক, একত্রে সংকলিত করার জন্য, কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছেন না । শিলিগুড়ি, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি থেকে আশির দশক জুড়ে অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, মনোজ রাউত, মলয় মজুমদার, সমীরণ ঘোষ, জীবতোষ দাশ প্রমুখ প্রকাশ করতেন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, ‘রোবোট’, আর ‘ধৃতরাষ্ট্র’ — কলকাতা থেকে দূরে বলে তেমন আলোচিত হয়নি । এই যে আমি এতোগুলো পত্রিকার নাম বললুম, আমি নিশ্চিত যে তোমার চোখে পড়েনি ; সম্ভবত এনাদের রচনাও পড়োনি । তাই মনে হতে পারে যে জ্বলেই নিভে গেল । তিন বছর আগে পেঙ্গুইন র‌্যানডাম হাউস থেকে হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটা বই বেরিয়েছে, মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা ; ইংরেজিতে আরেকটা বই বেরিয়েছে বৈদ্যনাথ মিশ্র এবং রাহুল দাশগুপ্তর সম্পাদনায়, ‘লিটারেচার অফ হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট – আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট’ নামে । গতবছর অলোক গোস্বামীর স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে, ‘মেমারি লোকাল’ নামে । বাসুদেব দাশগুপ্ত আর সুভাষ ঘোষকে নিয়ে প্রায় পাঁচশো পাতার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘মানুষের বাচ্চা’ পত্রিকা । ওদের দুজনের রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে গাঙচিল প্রকাশনী । সুবিমল বসাকের রচনাসমগ্র দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী । অরুণেশ ঘোষকে নিয়ে ছয়শো পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে কবিতীর্থ পত্রিকা । শৈলেশ্বর ঘোষকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘কারুবাসনা’ পত্রিকা । এবাদুল হক আমাকে নিয়ে ‘আবার এসেছি ফিরে’ পত্রিকার দুটো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন । জানি না এই বই আর পত্রিকাগুলো বাংলাদেশে যায় না বলে তোমার মনে হয়ে থাকবে ধপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল । তুমি যদি ইউটিউব দ্যাখো তাহলে সবচেয়ে পঠিত যে কবিতাটা পাবে তা হল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ আর আমার সাম্প্রতিক কবিতা ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ । আলোচনা অবিরাম হয়ে চলেছে । 

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : মলয় রায়চৌধুরীর চোখে হাংরি আন্দোলনের সময়কার সামাজিক বাস্তবতা এবং ইজম কনফ্লিক্টটা কেমন ছিল? 

    মলয় রায়চৌধুরী :এটা দুচার লাইনে ব্যাখ্যা করা যায় না । তুমি আমার সাক্ষাৎকারসমগ্র ‘কথাবার্তা সংগ্রহ’ আর ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইদুটো পড়ে দেখতে পারো । প্রকাশক কলকাতার প্রতিভাস । ঢাকায় পাওয়া যায়। অবশ্য সাত-আটশো টাকা দাম বলে পাঠকের নাগালের বাইরে থেকে গেছে ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন :আমরা শুনেছি একটা ইশতেহারের মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল হাংরি আন্দোলন। আসলে ইশতেহারে কী লেখা হয়েছিল যা সে সময়কার তারুণ্যকে নাড়া দিয়েছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী : হ্যাঁ, প্রথম দিকে হ্যাণ্ডবিলের মতন এক পাতার বুলেটিন বা ইশতেহার প্রকাশ করা হতো আর তা বিলিয়ে দেয়া হতো কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ম্যানিফেস্টো আর ১৯৬২ সালের শুরুতে বাংলা ম্যানিফেস্টো । পত্রিকা বের করলে পাঠকের কেনবার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হতো। এক পাতার বুলেটিন পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছে যেতো, প্রায় প্রতি সপ্তাহে । এইভাবে পৌঁছে যাওয়াটাই সাড়া ফেলার প্রধান কারণ । সংবাদপত্রে খবর, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি বেরোবার ফলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল । যুগান্তর সংবাদপত্রে পরপর দু’দিন প্রধান সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল । আন্দোলন যেভাবে দ্রুত সাড়া ফেলেছিল, তরুণরা আপনা থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পঁয়ত্রিশ-চল্লিশজন ছিলেন প্রথম কয়েক বছর । তারপর পুলিশের হস্তক্ষেপের কারণে অনেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং আন্দোলন থেকে দূরত্ব গড়ে নিয়েছিলেন । আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ বইটায় তুমি প্রায় সব কয়টা ইশতেহারের কপি পাবে । তক্ষশীলা, বিদিত, পাঠক সমাবেশ, বাতিঘরকে বললে আনিয়ে দেবে ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : সমীর রায়চৌধুরীমলয় রায়চৌধুরীশক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের হাংরিয়ালিস্ট প্রভাব পরবর্তিতে বাংলা সাহিত্যের লেখনীতে কী ধরনের বিশেষত্ব দিয়েছে?

    মলয় রায়চৌধুরী : এই প্রশ্নের উত্তর অভিজিত পালের একটা প্রবন্ধে দেয়া আছে, ‘ভূবনডাঙা’ সাইটে, । তোমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য সেটা থেকে খানিকটা তুলে দিচ্ছি। অভিজিত লিখেছেন, বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকের হাংরি জেনারেশনের ন্যায় আর কোনও আন্দোলন তার পূর্বে হয় নাই । হাজার বছরের বাংলা ভাষায় এই একটিমাত্র আন্দোলন যা কেবল সাহিত্যের নয় সম্পূর্ণ সমাজের ভিত্তিতে আঘাত ঘটাতে পেরেছিল, পরিবর্তন আনতে পেরেছিল। পরবর্তীকালে তরুণ সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাহস যোগাতে পেরেছে । তাঁদের অবদান, ১ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্ণিত করতে অস্বীকার করেছিলেন । কেবল তাই নয় ; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন । তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা, ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন । পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ফোলডারে স্কেচ আঁকতেন সুবিমল বসাক  । ত্রিদিব মিত্র তাঁর ‘উন্মার্গ’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিজে আঁকতেন। পরবর্তীকালে দুই বাংলাতে তাঁদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ২ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই । সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয় ; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার । নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, ডিকশন, উদ্দেশ্য, শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্হী সরকার সত্বেও বামপন্হী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে নিষ্কৃতি পান নাই । শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই । তা প্রথম করেন হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগন ; উল্লেখ্য হলেন অবনী ধর, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখ । সুবিমল বসাকের পূর্বে ‘বাঙাল ভাষায়’ কেউ কবিতা ও উপন্যাস লেখেন নাই। হাংরি জেনারেশনের পরবর্তী দশকগুলিতে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিদের রচনায় এই প্রভাব স্পষ্ট । ৩ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে ল্যাবিরিনথাইন করে প্রয়োগ করা । এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস । মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলার সমাজে ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন । বামপন্হীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো ।উল্লেখ্য তাঁর নভেলা ‘ঘোগ’, ‘জঙ্গলরোমিও’, গল্প ‘জিন্নতুলবিলদের রূপকথা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ ইত্যাদি । তিনি বর্ধমানের সাঁইবাড়ির ঘটনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে লেখেন ‘আরেকবারে ক্ষুধিত পাষাণ’ । বাঙাল ভাষায় লিখিত সুবিমল বসাকের কবিতাগুলিও উল্লেখ্য । পরবর্তী দশকের লিটল ম্যাগাজিনের কবি ও লেখকদের রচনায় এই প্রভাব সুস্পষ্ট । ৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের চতুর্থ অবদান হলো পত্রিকার নামকরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হতো ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ ইত্যাদি । পরবর্তীকালে তার বিপুল প্রভাব পড়েছে । পত্রিকার নামকরণে সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে । ৫ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সর্বপ্রথম সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল । ‘কবিতা’, ‘ধ্রুপদি’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘উত্তরসূরী’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিম্নবর্গের কবিদের রচনা পাওয়া যায় না । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিনগুলির সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন । এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,  জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি । পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল। ৬ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের ষষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো রচনায় যুক্তিবিপন্নতা, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা, আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু হওয়া ও শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না দেয়া, ক্রমান্বয়হীনতা, যুক্তির দ্বৈরাজ্য, কেন্দ্রাভিগতা বহুরৈখিকতা ইত্যাদি । তাঁদের আন্দোলনের পূর্বে টেক্সটে দেখা গেছে যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়, সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতন যুক্তি ধাপে-ধাপে এগোতো, কবিতায় থাকতো আদি-মধ্য-অন্ত, রচনা হতো একরৈখিক, কেন্দ্রাভিগ, স্বয়ংসম্পূর্ণতা । ৭) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে লেখক-কবিগণ আশাবাদে আচ্ছন্ন ছিলেন মূলত কমিউনিস্ট প্রভাবে । ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখতেন । বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁরা বিচ্ছিন্ন ছিলেন । হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ প্রথমবার হেটেরোটোপিয়ার কথা বললেন । হাংরি জেনারেশনের কবি অরুণেশ ঘোষ তাঁর কবিতাগুলোতে বামপন্হীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। হাংরি জেনরেশনের পরের দশকের কবি ও লেখকগণের নিকট বামপন্হীদের দুইমুখো কর্মকাণ্ড ধরা পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে মরিচঝাঁপি কাণ্ডের পর । ৮ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে কবি-লেখকগণ মানেকে সুনিশ্চিত করতে চাইতেন, পরিমেয়তা ও মিতকথনের কথা বলতেন, কবির নির্ধারিত মানে থাকত এবং স্কুল কলেজের ছাত্ররা তার বাইরে যেতে পারতেন না । হাংরি জেনারেশনের লেখকগণ অফুরন্ত অর্থময়তা নিয়ে এলেন, মানের ধারণার প্রসার ঘটালেন, পাঠকের ওপর দায়িত্ব দিলেন রচনার অর্থময়তা নির্ধারণ করার, প্রচলিত ধারণা অস্বীকার করলেন । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার সঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতার তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে । ৯ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে ‘আমি’ থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক আমি থাকতো, লেখক-কবি ‘আমি’র নির্মাণ করতেন, তার পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড থাকতো, সীমার স্পষ্টিকরণ করতেন রচনাকার, আত্মপ্রসঙ্গ ছিল মূল প্রসঙ্গ, ‘আমি’র পেডিগ্রি পরিমাপ করতেন আলোচক। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ নিয়ে এলেন একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব, মানদণ্ড ভেঙে ফেললেন তাঁরা, সীমা আবছা করে দিলেন, সংকরায়ন ঘটালেন, লিমিন্যালিটি নিয়ে এলেন । ১০ ) হাংরি  জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে শিরোনাম দিয়ে বিষয়কেন্দ্র চিহ্ণিত করা হতো । বিষয় থাকতো রচনার কেন্দ্রে, একক মালিকানা ছিল, লেখক বা কবি ছিলেন টাইটেল হোলডার। হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিগণ শিরোনামকে বললেন রুবরিক ; শিরোনাম জরুরি নয়, রচনার বিষয়কেন্দ্র থাকে না, মালিকানা বিসর্জন দিলেন, ঘাসের মতো রাইজোম্যাটিক তাঁদের রচনা, বৃক্ষের মতন এককেন্দ্রী নয় । তাঁরা বললেন যে পাঠকই টাইটেল হোলডার। ১১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে । তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি । এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্হের কাহিনির অনুকরণে ; তাঁরা সময়কে মনে করতেন তা একটিমাত্র দিকে এগিয়ে চলেছে । আমাদের দেশে বহুকাল যাবত সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের । সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের ইতিহাস অবহেলিত ছিল । বহুরৈখিকতারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘মহাভারত’ । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন । যেমন সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ উপন্যাস, মলয় রায়চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হ ‘আমার চাবি, ‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট’  ইত্যাদি । তাঁরা গ্রহণ করলেন প্লুরালিজম, বহুস্বরের আশ্রয়, দিকবিদিক গতিময়তা, হাংরি জেনারেশনের দেখাদেখি আটের দশক থেকে কবি ও লেখকরা বহুরৈখিক রচনা লিখতে আরম্ভ করলেন । ১২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে মনে করা হতো কবি একজন বিশেষজ্ঞ । হাংরি জেনারেশনের কবিরা বললেন কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য । পরবর্তী প্রজন্মে বিশেষজ্ঞ কবিদের সময় সমাপ্ত করে দিয়েছেন নতুন কবির দল এবং নবনব লিটল ম্যাগাজিন । ১৩ ) ঔপনিবেশিক প্রভাবে বহু কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতেন । ইউরোপীয় লেখকরা যেমন নিজেদের ‘নেটিভদের’ তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করতেন । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ একজনকে তুলে ধরা, নায়ক-কবি, সরকারি কবির শ্রেষ্ঠত্ব, হিরো-কবি, এক সময়ে একজন বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ড বিশিষ্ট কবি  আইকন কবি ইত্যাদির প্রচলন ছিল । হাংরি জেনারেশন সেই ধারণাকে ভেঙে ফেলতে পেরেছে তাদের উত্তরঔপনিবেশিক মূল্যবোধ প্রয়োগ করে । তারা বিবেচন প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা সরিয়ে দিতে পেরেছে, কবির পরিবর্তে একাধিক লেখককের সংকলনকে গুরুত্ব দিতে পেরেছে, ব্যক্তি কবির পরিবর্তে পাঠকৃতিকে বিচার্য করে তুলতে পেরেছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথা বলেছে । সার্বিক চিন্তা-চেতনা ও কৌমের কথা বলেছে । তাঁদের পরবর্তী কবি-লেখকরা হাংরি জেনারেশনের এই মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন । ১৪ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল । রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন । হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই । নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি । রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে । হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা । এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ১৫ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত ছিল ‘বাদ’ দেবার প্রবণতা ; সম্পাদক বা বিশেষ গোষ্ঠী নির্ণয় নিতেন ‘কাকে কাকে বাদ দেয়া হবে’ । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সাংস্কৃতিক হাতিয়ার ছিল “এলিমিনেশন”। বাদ দেবার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের আয়ত্বে রাখতেন । হাংরি জেনারেশনের সম্পাদকরা ও সংকলকরা জোট বাঁধার কথা বললেন । যোগসূত্র খোঁজাল কথা বললেন । শব্দজোট, বাক্যজোট, অর্থজোটের কথা বললেন । এমনকি উগ্র মতামতকেও পরিসর দিলেন । তাঁদের এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য পরবর্তীকালের সম্পাদক ও সংকলকদের অবদানে স্পষ্ট । যেমন অলোক বিশ্বাস আটের দশকের সংকলনে ও আলোচনায় সবাইকে একত্রিত করেছেন । বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া সমস্ত লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে এই গুণ উজ্বল । ১৬ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত একটিমাত্র মতাদর্শকে, ইজমকে, তন্ত্রকে, গুরুত্ব দেয়া হতো । কবি-লেখক গোষ্ঠীর ছিল ‘হাইকমাণ্ড’, ‘হেডকোয়ার্টার’, ‘পলিটব্যুরো’ ধরণের মৌরসি পাট্টা । হাংরি জেনারেশন একটি আন্দোলন হওয়া সত্বেও খুলে দিল বহু মতাদর্শের পরিসর, টুকরো করে ফেলতে পারলো যাবতীয় ‘ইজম’, বলল প্রতিনিয়ত রদবদলের কথা, ক্রমাগত পরিবর্তনের কথা । ভঙ্গুরতার কথা । তলা থেকে ওপরে উঠে আসার কথা । হাংরি জেনারেশনের পরে সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন জগতে দেখা গেছে এই বৈশিষ্ট্য এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব । ১৭ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্ব পর্যন্ত দেখা গেছে ‘নিটোল কবিতা’ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ এলিটিস্ট কবিতা রচনার ধারা । তাঁরা বলতেন রচনাকারের শক্তিমত্তার পরিচয়ের কথা । গুরুগম্ভীর কবিতার কথা । নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক মডেলের কথা । যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ নিয়ে এলেন এলো-মেলো কবিতা, বহুরঙা, বহুস্বর, অপরিমেয় নাগালের বাইরের কবিতা । তাঁদের পরের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের মাঝে এর প্রভাব দেখা গেল । এখন কেউই আর ঔপনিবেশিক বাঁধনকে মান্যতা দেন না । উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় অলোক বিশ্বাস, দেবযানী বসু, ধীমান চক্রবর্তী, অনুপম মুখোপাধ্যায়, প্রণব পাল, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা । ১৮ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল স্হিতাবস্হার কদর এবং পরিবর্তন ছিল শ্লথ । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ পরিবর্তনের তল্লাশি আরম্ভ করলেন, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দিলেন । পরবর্তী দশকগুলিতে এই ভাঙচুরের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন কমল চক্রবর্তী, সুবিমল মিশ্র, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, দেবজ্যোতি রায় ও নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে ; তাঁরা ভাষা, চরিত্র, ডিকশন, সমাজকাঠামোকে হাংরি জেনারেশনের প্রভাবে গুরুত্ব দিতে পারলেন । ১৯ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো, শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন । বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের । অভেদের সন্ধান করলেন । একলেকটিকতার গুরুত্বের কথা বললেন । বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন । উল্লেখ্য যে বুদ্ধদেব বসু মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর দ্বারে দেখামাত্র দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালের লিটল ম্যাগাজিনে আমরা তাঁদের এই অবদানের প্রগাঢ় প্রভাব লক্ষ্য করি । ২০ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল ইউরোপ থেকে আনা বাইনারি বৈপরীত্য যা ব্রিটিশ খ্রিস্টানরা হা্রণ করেছিল তাদের ধর্মের ঈশ্বর-শয়তান বাইনারি বৈপরীত্য থেকে । ফলত, দেখা গেছে ‘বড় সমালোচক’ ফরমান জারি করছেন কাকে কবিতা বলা হবে এবং কাকে কবিতা বলা হবে না ; কাকে ‘ভালো’ রচনা বলে হবে এবং কাকে ভালো রচনা বলা হবে না ; কোন কবিতা বা গল্প-উপন্যাস  উতরে গেছে এবং কোনগুলো যায়নি ইত্যাদি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা এই বাইনারি বৈপরীত্য ভেঙে ফেললেন । তাঁরা যেমন ইচ্ছা হয়ে ওঠা রচনার কথা বললেন ও লিখলেন, যেমন সুভাষ ঘোষের গদ্যগ্রন্হগুলি । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন বহুপ্রকার প্রবণতার ওপর, রচনাকারের বেপরোয়া হবার কথা বললেন, যেমন মলয় রায়চৌধুরী, পদীপ চৌধুরী ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা । যেমন মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা ও ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাস । যেমন সুবিমল বসাকের বাঙাল ভাষার কবিতা যা এখন বাংলাদেশের ব্রাত্য রাইসুও অনুকরণ করছেন । হাংরি জেনারেশনের পরের দশকগুলিতে  তাঁদের এই অবদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, এবং তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে ।২১ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে ছিল আধিপত্যের প্রতিষ্ঠার সাহিত্যকর্ম । উপন্যাসগুলিতে একটিমাত্র নায়ক থাকত । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ আধিপত্যের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন তাঁদের রচনাগুলিতে । বামপন্হী সরকার থাকলেও তাঁরা ভীত হলেন না । হাংরি জেনারেশনের পূর্বে সেকারণে ছিল খণ্ডবাদ বা রিডাকশানিজমের গুরুত্ব । হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন কমপ্লেকসিটিকে, জটিলতাকে, অনবচ্ছিন্নতার দিকে যাওয়াকে । যা আমরা পাই বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ প্রমুখের গল্প-উপন্যাসে । পরবর্তী দশকগুলিতে দুই বাংলাতে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ২২ ) হাংরি জেনারেশনের পূর্বে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভকে । হাংরি জেনারেশনের কবি লেখকগণ গুরুত্ব দিলেন মাইক্রো ন্যারেটিভকে, যেমন সুবিমল বসাকের ‘দুরুক্ষী গলি’ নামক উপন্যাসের স্বর্ণকার পরিবার, অথবা অবনী ধরের খালাসি জীবন অথবা তৎপরবতী কঠিন জীবনযাপনের ঘটনানির্ভর কাহিনি । পরবর্তী দশকগুলিতে দেখা যায় মাইক্রোন্যারেটিভের গুরুত্ব, যেমন গ্রুপ থিয়েটারগুলির নাটকগুলিতে । ২৩ ) হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকগণ নিয়ে এলেন যুক্তির ভাঙন বা লজিকাল ক্র্যাক, বিশেষত দেবী রায়ের প্রতিটি কবিতায় তার উপস্হিতি পরিলক্ষিত হয় । পরের দশকের লেখক ও কবিদের রচনায় লজিকাল ক্র্যাক অর্থাৎ যুক্তির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে । যেমন সাম্প্রতিক কালে অগ্নি রায়,  রত্নদীপা দে ঘোষ, বিদিশা সরকার, অপূর্ব সাহা, সীমা ঘোষ দে, সোনালী চক্রবর্তী, আসমা অধরা, সেলিম মণ্ডল, জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, পাপিয়া জেরিন,  প্রমুখ । ২৪ ) হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পূর্বে রচনায়, বিশেষত কবিতায়, শিরোনামের গুরুত্ব ছিল ; শিরোনামের দ্বারা কবিতার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করার প্রথা ছিল । সাধারণত বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত এবং সেই বিষয়ানুযায়ী কবি কবিতা লিখতেন । শিরোনামের সঙ্গে রচনাটির ভাবগত বা দার্শনিক সম্পর্ক থাকতো । ফলত তাঁরা মৌলিকতার হামবড়াই করতেন, প্রতিভার কথা বলতেন, মাস্টারপিসের কথা বলতেন ।হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীগণ শিরোনামকে সেই গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলেন । শিরোনাম আর টাইটেল হোলডার রইলো না । শিরোনাম হয়ে গেল ‘রুবরিক’ । তাঁরা বহু কবিতা শিরোনাম র্বজন করে সিরিজ লিখেছেন । পরবর্তী দশকের কবিরা হাংরি জেনারেশনের এই কাব্যদৃষ্টির সঙ্গে একমত হয়ে কবিতার শিরোনামকে গুরুত্বহীন করে দিলেন ; সম্পূর্ণ কাব্যগণ্হ প্রকাশ করলেন যার একটিতেও শিরোনাম নেই ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : ফ্রয়েডীয় মনোবীক্ষণ কি কোনো ভাবেই হাংরি মুভমেন্টের গভীরতাকে সরলীকরল করতে পারে?

    মলয় রায়চৌধুরী : ফ্রয়েড সম্পর্কে জীবনানন্দের বক্তব্য পড়েছ ? মাল্যবান উপন্যাসে মাল্যবান বলছে, “স্বপ্নের কী জানেন ফ্রয়েড? ভিয়েনা শহরে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্নায়ুরোগীদের স্বপ্ন নিয়ে কোনো স্বপ্নতত্ত্ব বানানো যায় না। চড়কের মাঠে কোনোদিন তো আর যাবেন না ফ্রয়েড সাহেব,স্বপ্নের আর কী বুঝবেন।” এই প্রসঙ্গে গৌতম মিত্র বলেছেন, “কী ভয়ঙ্কর রকমের আধুনিক একজন চিন্তক জীবনানন্দ দাশ ভেবে অবাক হই। ঠিক এখানেই ফ্রয়েডেরই শিষ্য কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংও ফ্রয়েডের থেকে আলাদা হয়ে যান। ইয়ুংও মনে করেন, শুধু ব্যক্তি নির্জ্ঞান নয়, স্বপ্নের ক্ষেত্রে যৌথ নির্জ্ঞানেরও একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে।আর সেজন্যই কি জীবনানন্দ চড়কের ইঙ্গিত করেন? ফলিত বিজ্ঞানের ফ্রয়েড থেকে তত্ত্ব বিজ্ঞানের ইয়ুং বেশি কাছের।” হাংরি আন্দোলন একটা যৌথ মুভমেন্ট, তাকে ফ্রয়েডের তত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ভুল হবে; তাছাড়া ফ্রয়েড বিশ্লেষণ করেছেন পাশ্চাত্য দৃষ্টিতে যার সঙ্গে প্রাচ্যের কৌম-মননের বিস্তর ফারাক।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন :আমরা দেখেছি সে সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদোর দালি পরাবাস্তব চিত্রকাণ্ড নিয়ে মেতে আছেন। অথচ তার চিত্রগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দাদাইজমের শিকড় পাওয়া যায়। ইজম কেন্দ্রিক সুন্দর নির্মাণ কিংবা আঁকবার চেষ্টাটা কি হাংরি আন্দোলন ভেঙে দিয়েছিলো? হতে পারে সেটি কবিতায়, গদ্যে কিংবা আঁকা ছবিতে। বাস্তবতা তো কবিতার মতো সুন্দর না, আঁকা ছবির মতো কালার কনট্রাস্টে ভরা না! আপনার অভিমত কী?

    মলয় রায়চৌধুরী : পরাবাস্তববাদের নেতা আঁদ্রে ব্রেতঁ দালির পেইনটিঙগুলো পরাবাস্তব প্রদর্শনী থেকে বের করে ফেলে দিয়েছিলেন । তা জানো ? অথচ দালি নিজেকে বলেছেন পরাবাস্তববাদী, ডাডাবাদী নয় । দালির পেইনটিঙ সুন্দর নয় বলতে চাইছ ? ভাউল ধারণা । তাহলে পিকাসোকে কী বলবে । আমি ইউরোপে গিয়ে ওনাদের পেইনটিঙ দেখেছি আর হর্ষ অনুভব করেছি । হাংরি আন্দোলনে কয়েকজন পেইনটার ছিলেন, যাদের মধ্যে অনিল করঞ্জাই অগ্রগণ্য । ওনাকে নিয়ে ইংরেজিতে একটা বই বেরিয়েছে ২০১৮ সালে, জুলিয়েট রেনল্ডস-এর লেখা, ‘রোডস অ্যাক্রস দ্য আর্থ’ নামে । আমি নিশ্চিত যে এই বইটাও বাংলাদেশে যায়নি । বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি যদি হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত বইগুলো ওনাদের লাইব্রেরিতে রাখেন তাহলে ওখানকার পাঠকদের সুবিধা হবে। তোমরা অনুরোধ করে দেখতে পারো ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : হাংরি মুভমেন্ট নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার যখন সরব তখন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীকে লিখে পাঠালেন, কলকাতা শহরটা আমারফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দুএকজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা  আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। যতো খুশি আন্দোলন করোবাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না।”  সুনীলের এই বক্তব্য জানবার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কিংবা আপনার সহযোদ্ধা কবি-বন্ধুদের কী বলেছিলেন?

    মলয় রায়চৌধুরী : আমার চিঠির জবাবেই সুনীল ওই চিঠিটা আমাকে লিখেছিলেন। উনি ভেবেছিলেন ওনার অবর্তমানে আমরা বাংলা সংস্কৃতির দখল নিয়ে নিচ্ছি । ওই সময়েই উনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসুকে লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেতে । ওনার মনে হয়েছিল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার বিরুদ্ধে খাড়া করা হয়েছে হাংরি আন্দোলনকে । কিন্তু কৃত্তিবাস তো ছিল একটা পত্রিকা, ফিরে এসে আবার শুরু করে চালিয়েছেন মৃত্যু পর্যন্ত । আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলুম ওনার চিঠি পড়ে । শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল চটে গিয়েছিলেন । আমেরিকা যাবার আগে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে উনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন. “আমি কী শক্তির থুতু চাটবো?”  ফিরে এসে ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মলয় আমার আমেরিকাবাসের সুযোগটা নিয়েছিল’ ।যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে । তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা । হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার । বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে ( অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও ) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত । ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম , কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না । এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক । সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে  পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি  ছিল না । ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে। হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল-করা ত্রিভাষিক  (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি )  বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দ্যফের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্হাপন করতে চাই্ছে তা স্পষ্ট করার জন্যে । তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে :
    প্রথাগত সাহিত্য সন্দর্ভ
    প্রাতিষ্ঠানিক
    শাসক সম্প্রদায় (টিরানি)
    ভেতরের লোক ( অন্দরুনি)
    এলিটেতর সংস্কৃতি ( ঢাকোসলা )
    তৃপ্ত
    আসঞ্জনশীল
    লোকদেখানো ( দিখাওয়া )
    জ্ঞাত যৌনতা (পরিচিত )
    সিশিয়ালিস্ট
    প্রেমিক (দুলারা )
    একসট্যাসি
    নিশ্চল ( আনমুভড )
    ঘৃণার কামোফ্লাজ
    আর্ট ( ফিল্ম )
    শিল্প
    রবীন্দ্রসঙ্গীত ( সুগমসঙ্গীত )
    স্বপ্ন ( ড্রিম )
    শিষ্ট ভাষা ( টিউটর্ড )
    রিদিমড ( দায়মুক্ত )
    ফ্রেমের মধ্যে
    কনফরমিস্ট ( অনুগত )
    উদাসীন ( ইনডিফারেন্ট )
    মেইনস্ট্রিম ( মূলস্রোত )
    কৌতুহল
    আনন্দ ( এন্ডোক্রিন )
    পরিণতি অবশ্যম্ভাবী
    সমাপ্তি প্রতিমা ( আনুষ্ঠানিক )
    ক্ষমতাকেন্দ্রিক ( সিংহাসন )
    মনোহরণকারী ( এনটারটেইনার )
    আত্মপক্ষ সমর্থন
    আমি কেমন আছি ( একপেশে )
    প্রতিসম
    ছন্দের একাউন্ট্যান্ট
    কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা
    রিভাইজ
    কল্পনার খেলা
    হাংরি প্রতিসন্দর্ভ
    প্রতিষ্ঠানবিরোধী
    শাসকবিরোধী ( প্রটেস্টার )
    বহিরাগত ( হামলাবোল )
    জনসংস্কৃতি
    অতৃপ্ত
    খাপছাড়া (ব্রিটল)ছামড়া ছাড়ানো ( র বোন )
    অজ্ঞাত যৌনতা ( অপরিচিত )
    সোশিয়েবল
    শোককারী ( মোর্নার )
    অ্যাগনি
    তোলপাড় ( টার্বুলেন্ট )
    খাঁটি ঘৃণা
    জনগণ ( সিনেমা )
    জীবনসমগ্র
    যে কোনো গান
    দুঃস্বপ্ন ( নাইটমেয়ার )
    গণভাষা ( গাট ল্যাংগুয়েজ )
    আনরিডিমড (দায়বদ্ধ )
    ফ্রেমহীন (কনটেসটেটরি )
    ডিসিডেন্ট ( ভিন্নমতাবলম্বী )
    এথিকস-সংক্রান্ত
    ওয়াটারশেড ( জলবিভাজিকা )
    উদ্বেগ
    উৎকন্ঠা (অ্যাড্রেনালিন )
    উন্মেষের শেষ নাই
    সতত সৃজ্যমান ( উৎসব )
    ক্ষমতাবিরোধী ( সিংহাসনত্যাগী )
    চিন্তাপ্রদানকারী ( থটপ্রোভোকার )
    আত্মআক্রমণ
    সবাই কেমন আছে
    অসম্বদ্ধ ( ট্যাটার্ড )
    বেহিসাবি ছন্দ খরচ
    জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ
    কল্পনার কাজ

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : ’৬৫ সালে নিজের দাদার সাথে আপনিসহ ৬ জন কবি গ্রেপ্তার হন। বাংলা সাহিত্য ইতিহাসের এই বিরল ঘটনার পর হাংরি মুভমেন্ট কোন পথে ধাবিত হয়েছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী : সবাই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল । মামলাটা কেবল আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার বিরুদ্ধে, পঁয়ত্রিশ মাস । কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । চাকরি থেকে সাসপেণ্ড ছিলুম বলে টাকাকড়িরও টানাটানি ছিল, এক বেলা খেয়ে চালিয়ে দিতুম । কিন্তু আন্দোলনের পত্রপত্রিকা নিয়মিত বেরোতো তা তো এক্ষুনি উল্লেখ করেছি । এক পাতার বুলেটিন ছাপানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেননা প্রেসগুলো হাংরি শুনলেই ভয় পেতো । বই-পত্রিকা ছাপাতুম বহরমপুরের একটা প্রেসে । মামলার পর হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা ও গদ্যের সৃজনশীলতায় ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : আন্দোলন সংশ্লিষ্ট তরুণ কবিদের হাংরি জেনারশন বলে সম্বোধন করা হলো। তো এই জেনারেশন হাংরি মুভমেন্টের মাধ্যমে আসলে কী অর্জন কিংবা কী তুলে ধরতে চাইছিলো?

    মলয় রায়চৌধুরী : ওই তো, অভিজিত পালের লেখাটায় সবই তো বলা হয়ে গেছে।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : কোনো কারণে কি এই আন্দোলন জনবিচ্ছন্ন ছিল? থাকলে সেটি কী? কিংবা এই আন্দোলনকে দালাল শ্রেণির মানুষ সাধারণের বিপরীতে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছিল?

    মলয় রায়চৌধুরী : জনসাধারণের সঙ্গে সাহিত্য আন্দোলনের যোগাযোগ কোনো দেশেই হয়নি কখনও ।  এক পাতার বুলেটিনে যা করা গিয়েছিল তাই যথেষ্ট । আমাদের বইপত্র কোনোকালেই কমার্শিয়াল ছিল না । বড়ো প্রকাশকরা আগ্রহ দেখায়নি, আজও দেখায় না । আমার বিরোধী লেখক-কবিতে এখনও কফিহাউস ছেয়ে আছে । তাদের যদি দালাল বলো তো আমার আপত্তি নেই ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন :একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। হাংরি আন্দোলন সূত্রপাত হওয়ার আগেকার মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে জানতে চাই। কেমন ছিল ২১ বছরের তরুণ মলয় রায়চৌধুরী?

    মলয় রায়চৌধুরী : আবার একই কথা বলতে হচ্ছে । আমার স্মৃতিকথাগুলো পোঁছিচ্ছে না বাংলাদেশে । তুমি যোগাড় করতে পারলে আমার ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা; ছোটোলোকের যুববেলা’ আর ছোটোলোকের শেষবেলা পোড়ো । যদি চাও তো তোমার সাইটে ‘আমার জীবন’ প্রকাশ করতে পারো, তাতে সব পাবে । বলো তো পাঠিয়ে দিই ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : আর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বার পর একজন মলয় রায়চৌধুরীকে আপনি নিজে কীভাবে খণ্ডন করবেন?

    মলয় রায়চৌধুরী : খণ্ডন করতে যাবো কেন ? সব আন্দোলনই তার সময়ের প্রডাক্ট । এখন কেউ কি মহাকাব্য বা মঙ্গলকাব্য লেখে ? লেখে না ,কারণ ওগুলো ছিল তাদের সময়ের প্রডাক্ট । মলয় রায়চৌধুরীর লেখালিখি সম্পর্কে জানতে হলে তুমি গোটাকতক বই অন্তত পড়ো । তাহলে নিজেই টের পাবে ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন :হাংরি মুভমেন্ট পরবর্তি সময়ে হাংরি জেনারেশনের অবস্থানটা সামাজিকভাবে কেমন ছিল? মানুষ কীভাবে গ্রহণ করেছিল তাদের?

    মলয় রায়চৌধুরী : বললুম তো, জনসাধারণের স্তরে সৃজনশীল সাহিত্য সেইভাবে পৌঁছোয় না যেমন যায় কমার্শিয়াল লেখা বা পাল্প ফিকশান । এই যে ষাট বছর পর তুমি হাংরি আন্দোলনে আগ্রহী, এটাই তো প্রমাণ যে আন্দোলন একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্হান গড়ে ফেলতে পেরেছে ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন :হাংরি আন্দোলনে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বটা কেমন ছিল? আন্দোলনটা চিমসে যাওয়ার পর শক্তির সমাজ এবং আত্ম পরম্পরাটা কেমন দেখেছেন?

    মলয় রায়চৌধুরী : শক্তি ওই এক বছরই ছিলেন । শক্তি ছেড়ে যান কারণ উনি দাদার শ্যালিকা শীলার সঙ্গে প্রেম করতেন । দাদার চাইবাসার বাড়িতে তিন বছর ছিলেন, প্রেম করবার সময়ে । শক্তির কাব্যগ্রন্হ ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্যর’ কবিতাগুলো শীলাকে নিয়ে লেখা।  দাদার শশুরবাড়ি চাইবাসায় । দাদার শশুর একজন মাতাল আর বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাননি । শক্তি ভেবেছিল আমি আর দাদা বিরোধিতা করেছি বলে শীলার সঙ্গে ওনার বিয়েটা ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে । ব্যাস চটে গেলেন আমার আর দাদার ওপর। বদলা নিলেন কাঠগড়ায় সরকারি সাক্ষীর রূপে দাঁড়িয়ে ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : ‘The Decline of the West’ বইটি হাংরি মুভমেন্টের সাথে কীভাবে জড়িয়ে গেল? একইসাথে জানতে চাইছি হাংরির দার্শনিক অবয়বটা আসলে কী?

    মলয় রায়চৌধুরী : অসওয়াল্ড স্পেঙলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট বইটা পড়ার পরই আমার ধারণা হয় সমাজ কী ভাবে কাজ করছে ভারতে, বিশেষভাবে পশ্চিমবাংলায় । সেই সময়ে আমি ইতিহাসের দর্শন নামে একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখছিলুম বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় । অসওয়াল্ড স্পেঙলার বলেছেন যে, স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা লিনিয়র নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবিক প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশ কোন দিকে কার বাঁকবদল ঘটবে, তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে থাকে ; তার নিত্য নতুন স্ফূরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয়, যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই ‘আত্মসাৎ’ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ঙ্কর অবসাদের মুখে পড়েছে । কলকাতা থেকে পাণিহাটি যাবার সময়ে (  দাদা সমীর পাণিহাটিতে মামার বাড়িতে থেকে কলকাতার সিটি কলেজে যাতায়াত করতেন ) আমি আর দাদা উদ্বাস্তুদের অসহায় জীবন প্রত্যক্ষ করতুম প্রতিদিন, কলকাতার পথে দেখতুম বুভুক্ষুদের প্রতিবাদ মিছিল । ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্য আমাদের দুজনের মনে হয়েছিল হাংরি আন্দোলন জরুরি । আমার মনে হয়, তাঁরা না করলেও অন্যেরা এই ধরণের আন্দোলন করত, প্রতিষ্ঠানকে নাস্তানাবুদ করত । আমি ওই সময়টাকে ধরার চেষ্টা করেছি ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে ; বইটা ঢাকায় পাওয়া যায় ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : হাংরির ঢেউ বাংলাদেশেও এসেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে আশির দশকের কবিদের লেখনীতে কদাচিৎ আঁচ পাওয়া যায়। কারণ তখন বাংলাদেশের যুব সমাজ একটা বিশৃঙ্খল আর স্বৈরাচারী শৃঙ্ক্ষলে আটকা পড়েছিল। ফলে সে সময় কবিরা শিল্পীরা একাট্টা হয়ে লড়তে থাকে। আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, বাংলাদেশের আশির দশকের সাহিত্য?

    মলয় রায়চৌধুরী : বাংলাদেশের সাহিত্যে আঁচের ব্যাপারটা জানি না । তোমার মুখেই প্রথম শুনছি ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : এটা বলার অবশেষ থাকে না যে, হাংরি জেনারেশন দেশ ছাড়িয়ে মহাদেশে তার ঢেউ খেলিয়ে দিয়েছে। হাংরিয়ালিস্টদের রুখতে রাষ্ট্রযন্ত্র তার কূটকৌশলের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তো, হাংরিকে আপনি কতোটা সমাজবান্ধব আন্দোলন বলে মূল্যায়ন করবেন?

    মলয় রায়চৌধুরী : ওসব মূল্যায়ন তোমরা করবে, সমাজ-বিশ্লেষকরা করবেন। ওটা আমার কাজ নয় ।

    মেহেদী হাসান স্বাধীন : সবশেষ জানতে চাই, হাংরিয়ালিস্ট যদি একটি মতবাদ হয়ে উঠে তবে বাংলাসাহিত্যে এর প্রভাব এবং বর্তমান সাহিত্যে এর মেলবন্ধনটা কী? 

    মলয় রায়চৌধুরী : যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে । তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা । হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার । বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে ( অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও ) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত । ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম , কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না । এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক । সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে  পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি  ছিল না । ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে। হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউন্সিল বা সম্পাদকের দপতর ধরণের ক্ষমতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকার ক্ষমতাকেন্দ্র সেই বাড়িতে চলে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায় , যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া মরাঙী ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল ।  হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলে ভূমিকম্পের মতো। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্হ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা।’’ এইধরণের সাহিত্য বোধেরপ্রয়োজন এখনও ফুরায়নি। মুক্তচিন্তা-বাকস্বাধীনতা এসব শুধু টার্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মতপ্রকাশের অধিকার আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। এখনকার এই প্রচলিত সাহিত্যচর্চা সমাজকে কতোটা পরিবর্তন করতে পারছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বস্তুত সেই থ মেরে থাকা অবস্থা সাহিত্যে আজো কাটেনি, সাহিত্য এখনও কর্পোরেট দাসত্বে আটকে আছে। বিভিন্ন বাধ্যবাধকতায় লেখকের স্বাধীনতা এখন খাঁচায় বন্দী।  এখনও মাঝে-মধ্যে কিশোর-তরুণরা এখান-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন । ফেসবুকে হাংরি জেনারেশন নামে তরুণদের কয়েকটা গোষ্ঠী নজরে পড়েছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন