এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | 127.197.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৮:০১572689
  • বেশ কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে একটি বিশেষ বাংলা শব্দের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সেই সংক্রান্ত বিতর্কে অন্য কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমিও যোগ দিয়ে ছিলুম ও সেই বিষয়ে আমার ধারণাটি অতি সংক্ষেপে ব্যক্ত করার প্রয়াসও পেয়েছিলুম। কিন্তু আমার প্রথম বন্ধু সেই ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেননি,যেহেতু তাঁর বিচারে উদ্দিষ্ট শব্দটি একটি স্ল্যাং শব্দ। একটি 'শব্দ' কীভাবে মানুষের বিচারবোধকে আচ্ছন্ন পারে এটি তার একটি দৃষ্টান্ত। সম্ভ্রান্ত মানুষের কাছে অপাংক্তেয় এই গোত্রীয় শব্দাবলী, যাকে বেশ অসূয়াসহকারে স্ল্যাং বলা হয়, সে বিষয়ে যৎসামান্য আলোচনা করার ইচ্ছে হলো ।
  • শিবাংশু | 127.197.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৮:০৭572694
  • ১.
    পরিভাষা হিসেবে অক্সফোর্ড অ্যাডভান্স লার্নার বলছে, 'very informal words and expressions that are more common in spoken language,especially used by a particular group of people,for example, children,criminals, soldiers, etc' । আর অক্সফোর্ড রেফারেন্স বলছে প্রায় একইকথা, 'very informal words and phrases that are more common in speach than in writing and are used by a particular group of people'।

    'স্ল্যাং' শব্দটি মূলত বাংলা ভাষার অংশ না হলেও কালক্রমে বাঙালির ভাষার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। শব্দটির মধ্যে সুশীল ভদ্রজন সম্ভ্রমের অভাব বোধ করেন। সরকারিভাবে হিন্দি ভাষায় ব্যবহৃত 'অপশব্দ' নামক প্রতিশব্দটি অনেকে বাংলাতেও গ্রহণ করার পক্ষে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অপশব্দের পরিভাষা হিসেবে লিখেছেন, অপকৃষ্ট শব্দ, ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ শব্দ, অশুদ্ধ শব্দ,গ্রাম্য শব্দ, সংস্কৃতভিন্ন ভাষা, অপভ্রংশ ভাষা। এখানে উল্লেখ করা যায়, স্ল্যাং কোনও ভাষাভিত্তিক ভাবপ্রকাশ নয়, স্ল্যাং-য়ের অবয়ব 'শব্দভিত্তিক'। এই 'অপশব্দে'র সমাহারেই 'অপভাষা' গড়ে ওঠে। পুনশ্চ, এই প্রসঙ্গে হরিচরণ তাঁর শব্দকোষে 'অপভাষা'র নানা পরিভাষার সঙ্গে অন্যতম একটি পরিভাষা দিয়েছেন,সেটি অনুধাবনযোগ্য। তিনি বলছেন 'অপভাষা ' মানে 'ইতরজাতির ভাষা ; গ্রাম্য ভাষা'।

    এইখান থেকেই 'স্ল্যাঙ'এর উৎসসন্ধান করতে হবে। যে শব্দগুলি প্রনিধানযোগ্য, তাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করা যায়,

    ১. very informal
    ২. spoken
    ৩. particular group
    ৪. অপকৃষ্ট
    ৫. ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ
    ৬. অশুদ্ধ
    ৭. গ্রাম্য
    ৮. ইতরজাতি

    এই তালিকার শব্দগুলি যদি পর পর পড়ে যান তবে স্ল্যাং শব্দের স্বরূপ, উৎস, ব্যবহার ও ব্যঞ্জনার দিকনির্দেশটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবেই আমরা অনুধাবন করতে পারি স্ল্যাং শব্দাবলীর রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য কী? স্ল্যাং হঠাৎ উচ্চারিত কোনও অসম্ভ্রান্ত, দুঃশীল, পীড়াদায়ক সম্বোধনমাত্র নয়। তার পশ্চাদ্পটে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শৃঙ্খলা বর্তমান।

    ২.
    শব্দ হলো সরস্বতী, শব্দই ব্রহ্ম। শব্দ কখনো অপবিত্র হতে পারেনা, হতে পারেনা অচ্ছুত। শব্দ মানুষের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, নিহিত, প্রোথিত যাবতীয় ভাব, অনুভূতি, উপলব্ধি, সিদ্ধির প্রতীকী অক্ষরমালা। তাই শব্দের প্রত্যয় বা উপসর্গ হিসেবে 'অপ' বিশেষণ যোগ করাটা অবিবেচনা। শব্দের 'রূপ' হচ্ছে তার ঝংকার আর অক্ষরবিন্যাস। শব্দের শক্তি হচ্ছে তার প্রয়োগ বৈচিত্র্য। একই শব্দ বেদমন্ত্র বা বিদূষকের তাচ্ছিল্যে প্রয়োগ ভিন্নতায় অন্য মাত্রা নেয়। মানুষের চিন্তা বা আবেগ যেহেতু শব্দের শরীর ধরেই অপর মানুষের কাছে পৌঁছোয় তাই পূজামন্ত্র বা সাধারণ স্ল্যাং একই উদ্দেশ্যসাধন করে থাকে। এই উদ্দেশ্যটি হলো বক্তা ও শ্রোতার মনোজগতের সঙ্গে একটা সেতু রচনা করা। এই সেতুটি দাঁড়িয়ে থাকে স্থান-কাল-পাত্র এই তিনটি স্তম্ভের উপর। যা বলতে চাইছি সেটা সব থেকে কার্যকরীভাবে বলতে গেলে যদি সুশীল শব্দবিন্যাসের চেয়ে 'দুঃশীল' স্ল্যাং বেশি উপযোগী বোধ হয়, তবে তার দাবি আগে।

    একটা প্রিয় কবিতার অংশবিশেষ,

    '.... অধ্যাপক বলেছিলো, 'দ্যাটস র-ঙ, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?'
    মাস্টারের কাশি ওঠে, 'কোথায় বিপ্লব,শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!'
    উকিল সতর্ক হয়, 'বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে।'
    চটকলের ছকু মিঞা, 'এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ও-সি-কে।'

    উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজী রক্তধারা,

    গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা।'

    ( গান্ধীনগরে এক রাত্রিঃ মণিভূষণ ভট্টাচার্য)

    শ্রেণী বিন্যাস অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ছকু মিঞা ব্যবহার করছেন দুটি স্ল্যাং। এর বদলে তিনি যদি বলতেন, 'ওসি-কে খুব মারবো', এই কবিতাটি কি পরিণতি লাভ করতে পারতো?

    তার পরেই আসছে মন্ত্রের মতো একটি রবীন্দ্রউচ্চারণ। প্রয়োগ কুশলতায় স্ল্যাঙের অনুগামী পড়ছে এই মায়াবী লাইনটি আর পাঠকের চিত্তাকাশে একটি ধ্রুবতারার জন্ম হচ্ছে।

    আমার মনে পড়ছে, বেশ কিছুদিন আগে একটি বেশ জনসমাদৃত গ্রাম্ভারি রবি স্মরণ সভায় রবীন্দ্রকবিতার অধুনা প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে যখন কিছু বলতে হচ্ছিলো তখন আরো অনেক কবিতার সঙ্গে এই কবিতাটিরও উল্লেখ করেছিলুম আমি। তা সেই সভার পৌরহিত্যের দায়িত্বে থাকা একজন কলিকাতার শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞ সারস্বত ব্যক্তিত্ব আমার বক্তব্য বা বাককুশলতা বিষয়ে ভূয়সী প্রশংসাশীল হয়েও আপত্তি জানিয়েছিলেন উপরোক্ত কবিতাটিকে আলোচনায় স্থান দেবার জন্য। এভাবে এটা স্পষ্ট হয়, ভাষার সুশীলতা ও দুঃশীলতার আরোপিত শর্তগুলিকে প্রাজ্ঞতার দীপ্তি বিসর্জন দিতে পারেনা।

    ৩.

    স্ল্যাঙের শারীর লক্ষণ যদি বিচার করি তবে উপরোক্ত তালিকাটির দিকে একবার ফিরে যাই।

    'ইনফর্ম্যাল' আমরা কখন হই? উত্তর, যখন আমরা প্রিয়জন সান্নিধ্যে থাকি। যখন আমাদের মুখোশ পরে থাকতে হয়না। যখন গোষ্ঠীগত নৈকট্যের স্বাচ্ছন্দ্য ও আয়াস আমাদের কাছে প্রেয় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এইভাবে একটা 'পার্টিকুলার গ্রুপ'কে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে,যেখানে ভাববিনিময়টি বাচিক, 'স্পোকেন'। এই গোষ্ঠী হতে পারে বন্ধুত্বের ঘনিষ্টতায় জড়িত কয়েকজন মানুষ, যাদের পরস্পরের কাছে মুখোশ পরে আসার কোনও প্রয়োজন বা অভীপ্সা নেই। তারা হতে পারে সুশীলতার ভানহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক কিছু মানুষ, অপরাধী বা সমাজবিরোধীদের জমায়েৎ বা রণউন্মুখ সেনাদলের অংশ। এই জাতীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে বিশেষ প্রগাঢ় মাত্রায় কামারদরির বন্ধন সঞ্চারিত থাকে। এরা নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময়ের সময় সুশীলসমাজ স্বীকৃত সম্ভ্রান্ত ভাষা শৈলীর শাসন প্রত্যাখ্যান করে। সভ্যতার একেবারে উপরিতলের সুভদ্র,সম্ভ্রমশীল সৌজন্যে স্নিগ্ধ স্বর্ণিম বাগধারা তাদের কাছে পরিত্যজ্য এক কৃত্রিম নির্মাণ। জীবনযাপনের কয়েকটি অনিবার্য মানুষী জান্তব অঙ্গ,যাদের প্রকাশ্য চর্চাকে 'সভ্য সংস্কৃত' ভদ্রতাবোধ অপাংক্তেয় করে রেখেছে, যেমন হিংস্রতা, অপরাধ, নেশাসক্তি বা যৌনতা, তাকে এই গোষ্ঠীগত প্রয়াসগুলি শিরোনামে নিয়ে আসতে স্বনিযুক্ত হয়ে পড়ে। তাদের এই প্রচেষ্টা শুরু হয় মুখের ভাষার স্বীকৃত ভদ্র পদ্ধতিকে অস্বীকার করে তথাকথিত ব্যাকরণ-বিরুদ্ধ, অপকৃষ্ট, অশুদ্ধ ভাষাশৈলীকে আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে। এই গোষ্ঠীগুলির শিকড় থাকে গ্রাম্য ইতরযানী যাপনের গভীরে। তথাকথিত স্ল্যাং শব্দাবলী এই জনগোষ্ঠীর কাছে মূল ভাষাস্রোতের অঙ্গ। শহুরে সম্ভ্রান্ত নাগরিক রুচি এই ঐতিহ্যকে শুধু যে অস্বীকার করে তাই নয়, রীতিমতো ঘৃণাপরবশও হয়ে থাকে। স্ল্যাং শব্দাবলীর উৎপত্তি ও বিবর্তন যদি অতি সংক্ষেপে বোঝার প্রয়াস পাই, তবে স্পষ্ট হবে শহুরে 'শিক্ষিত' মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত বাচিক ভাষার সমান্তরাল এই ইতরযানী ভাষাশৈলী কীভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে বিকশিত হচ্ছে এবং পারিপার্শ্বিক থেকে প্রাণ রস আহরণ করে চলেছে।

    ৪.

    প্রতিটি শব্দ যেন প্রজনন দেবতার প্রতীক। বহুপ্রজা নারীর মতন সে সতত নিজের নতুন নতুন অর্থ সৃষ্টি করে চলেছে। ব্যাকরণের পরিভাষায় তাকে বলে অর্থ সম্প্রসারণ। প্রতিটি শব্দের উৎপত্তির নিজস্ব ইতিহাস আছে। আমাদের ভাষায় মূলতঃ চারটি উৎসকে স্বীকার করা হয়েছে, তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি । বাংলা ভাষার উৎস মাগধী প্রাকৃতে এবং তার মূল জননী সংস্কৃত ভাষা। 'প্রাকৃত' শব্দটি এসেছে প্রকৃতি থেকে। অর্থাৎ এই ভাষাটি প্রকৃতির মতন স্বাধীন, মৌলিক ও সামগ্রিকভাবে সংখ্যাগুরু জনসমষ্টির ব্যবহৃত ভাষা। অভিজাত, সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর ব্যবহৃত ভাষা সংস্কৃত থেকে এটি প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই পৃথক অস্তিত্ব যাপন করছে। সংস্কৃতমাতার বখে যাওয়া পুত্র অপভ্রংশ বাকরীতি প্রাকৃত ভাষার পিতা। প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি লগ্ন থেকেই তার 'লজ্জা' বা 'গৌরব' হলো সে সংখ্যাগুরু ইতর জনগণের ভাষা। সমাজের উচ্চকোটী অভিজাতদের ব্যবহৃত ভাষা সংস্কৃত তার জননী হলেও অভিজাতবর্গ প্রাকৃতভাষাকে নিম্নবর্গের ভাষা হিসেবে চিরকাল অবজ্ঞা করে এসেছে। সংখ্যাগুরু ভাষাগোষ্ঠীর প্রতি উচ্চবর্গের এই মনোভাব তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই ছিলো। পরবর্তী উত্তরইংরেজকালে নাগরিক শিক্ষিত বাঙালির নিম্নবর্গের মৌখিক ভাষার একটি বৃহৎ অংশকে 'অপরিশীলিত' আখ্যা দিয়ে মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার উদ্যম তার ইতিহাসকেই পুনরাবৃত্তি করেছে। এককালে প্রাকৃতভাষা সংস্কৃত চর্চাকারীদের কাছে নেহাৎ 'স্ল্যাং' বলে গণ্য হতো, পরে এই প্রাকৃতভাষা থেকেই উদ্ভূত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাতেও তাদের গ্রাম্য দেশজ উৎস থেকে গৃহীত শব্দগুলিকে যথেষ্ট 'পরিশীলনে'র অভাবের যুক্তিতে 'স্ল্যাং' বলে চিণ্হিত করা হয়েছিলো। এই বিবর্তনের পথে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। স্ল্যাং শব্দাবলীর যে 'গোষ্ঠীগত' স্বীকৃতির প্রসঙ্গ আগে এসেছে, তার প্রমাণ প্রাকৃতভাষাপর্ব থেকেই আমাদের ইতিহাসে নথিভুক্ত আছে।

    স্ল্যাঙের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রথম আসে বিভিন্ন সেনাদলের নিজেদের মধ্যে ব্যবহৃত নানা শব্দ, উপমা, প্রবাদ, ব্যঞ্জনা নিয়ে গঠিত ভাষার লোকপ্রিয়তা থেকে। ইতিহাসপূর্ব কাল থেকেই সাধারণ সৈন্যদল নিযুক্ত করা হতো কৃষিজীবী নিম্নবর্গের জনসমষ্টির থেকে। যারা শান্তিপর্বে হলকর্ষণ করে এবং আপৎকালে অস্ত্রধারণ করে। এই জনগোষ্ঠী তাদের মুখের যে ভাষাকে সৈন্যশিবির পর্যন্ত নিয়ে আসতো, তা ছিলো দেশজ লৌকিক ভাষার প্রভাবশালী নির্যাস। শুধু শব্দ নয়, তা ছিলো নিতান্ত এক নিজস্ব বাগধারা, যা প্রত্যন্ত গ্রামীন ক্ষেত্র থেকে এসে নাগরিক বিশ্বের সেনাশিবিরে ব্যবহৃত হতো। তবে তা ছিলো একান্ত মৌখিক চর্চা, কখনও লিখিতরূপে নথিবদ্ধ হতোনা। সেই ভাষা ও তার বাগভঙ্গি শুনলে ব্রাহ্মণ্য পন্ডিত সমাজ অশুচি হবার ভয়ে শ্রবণ আবৃত করতো, কারণ তাদের কাছে সেই ভাষা আজকের শহুরে মধ্যবিত্তের ধারণায় যা 'কাঁচা খিস্তি' তারও অধিক ছিলো।

    ৫.
    একটি ঊদ্ধৃত কবিতাংশে যে শব্দটিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুরু হয়েছিলো তার ইতিহাসভূগোল নিয়ে কিঞ্চিৎ ভাবা যেতে পারে।

    সংস্কৃতে একটি শব্দ আছে, 'রন্ডা' ।এর মূল অর্থ হচ্ছে পতিহীনা রমণী। ভাবসম্প্রসারণ করে এর অর্থ দাঁড়ালো বিধবা রমণী। প্রাকৃতভাষায় শব্দটির প্রাথমিক রূপ হলো 'রংডা' , সেখান থেকে হয়ে গেলো 'রাঁড়া' । বাংলা ভাষায় এই শব্দটি অবিকৃত 'রাঁড়া' রূপেই গৃহীত হলো 'বিধবা রমণী' এই অর্থ নিয়ে। এর পর এই অর্থেরও সম্প্রসারণ ঘটতে থাকলো। উৎসে যেহেতু অর্থ ছিলো 'পতিহীনা' রমণী, সেহেতু প্রবল পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার প্রভাবে শেষ পর্যন্ত 'রাঁড়' বা 'রাঁড়া' শব্দের অর্থ দাঁড়ালো, যে নারীর উপর একটি সমাজস্বীকৃত পুরুষ প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আবরণ নেই। তখন এই শব্দটির মূল অর্থকে ম্লান করে দিয়ে তিনটি নতুন অর্থের ব্যঞ্জনা সমাজে স্বীকৃতি লাভ করলো। প্রথম অর্থটি 'গণিকা' এবং দ্বিতীয় অর্থটি 'ব্যভিচারিণী বিবাহিতা স্ত্রী' এবং তৃতীয় অর্থে 'বৈষ্ণবী'। ।

    উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ভাষাগুলিতে বাংলার তুলনায় তৎসম শব্দের আধিক্য অনেক বেশি। তাই 'রন্ডা' শব্দটি ঈষৎ অপভ্রংশে স্ত্রীলিঙ্গবাচী ইকারান্ত উপসর্গ নিয়ে 'রন্ডি' বা 'রেন্ডি' রূপে প্রচলিত হয়ে গেলো। প্রচলিত অর্থটি কিন্তু প্রাকৃতভাষা নির্ভর বাকি সব ভাষার মতো একই থাকলো। মজার কথা এই 'রন্ডি' বা 'রেন্ডি' শব্দটির অর্থ দ্রাবিড়দেশে , তেলুগু ও উত্তর কর্নাটকের ভাষায় হলো সম্মানসূচক স্বাগত জানানো। তাই শব্দটির রূপ এক হওয়া সত্ত্বেও একই দেশে অন্য ভাষায় প্রচলিত অর্থের মধ্যে এ রকম বহু মেরুপ্রমাণ ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়।

    এই শব্দটি কিন্তু সমস্ত স্বীকৃত শব্দকোষ ও অভিধানে সসম্মানে গৃহীত হয়েছে। তাই এর মধ্যে কতোটা 'স্ল্যাং'ত্ত্ব' বর্তমান, তা ভেবে দেখার ব্যাপার।
    প্রায় একই ভাবে আরেকটি শব্দ, যেটিকে সুশীলসমাজ স্ল্যাং অভিধা দিয়ে থাকেন এবং ব্যঞ্জনাগতভাবে তার প্রতি 'রাঁড়ি'র মতো-ই নারীর সামাজিক মর্যাদা অবনমনের অভিযোগ আছে , তা হলো 'মাগী'। এর উৎসটি এসেছে হিন্দি 'মাঙ্গ' শব্দটি থেকে। মাঙ্গ মানে হলো সীমন্ত বা বাংলায় সিঁথি। যে নারীর মাঙ্গ বা সিঁথি ( অস্যার্থে সিঁদুর সহ) আছে, সে সীমন্তিনী ও কল্যাণী। হিন্দি থেকে মৈথিলি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে সেই নারীর বিশেষণ হলো ( মাঁগসম্পন্না, বিবাহিতা ও পতিসোহাগিনী) 'মৌঁগি'। এই মৌঁগি শব্দটি বাংলায় মাগী রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। পরবর্তীকালে সুশীল সমাজে এই শব্দটি নারীর পক্ষে অমর্যাদাসূচক বিশেষণ হয়ে উঠলো। কী অদ্ভুত অর্থ আর প্রতিঅর্থের বিক্রিয়া, (পুরুষ)মানুষ হয়ে গেলো 'মিনসে' আর তার সমাপতিত স্ত্রীলিঙ্গ হয়ে গেলো 'মাগী'।

    সুশীল শিক্ষিত সমাজ এ জাতীয় শব্দগুলিকে 'পতিত' ঘোষণা করলেও গ্রামীণ কৌম সমাজে এখনও এই শব্দগুলি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়। এভাবে আমরা দেখি কোনও শব্দকে একতরফা স্ল্যাং বলার পিছনে এক জটিল আর্থ-সামাজিক সমীকরণ কাজ করে।

    ৬.
    গোপাল ভাঁড়ের নামে একটি উপকথা প্রচলিত আছে। রাজামশাই যখন কোন উপায়েই একজন সভাসদের জাতি নিরূপন করতে পারলেন না, তখন গোপালের প্রতি এই কাজটির দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি যখন সেই সভাসদকে অতর্কিতে ল্যাং মারলেন এবং আক্রান্ত ব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্তভবে কাতরোক্তি করে বলে উঠলেন, 'সড়া অন্ধা'। গোপাল তখন অভ্রান্তভাবে এই ব্যক্তির জাতি নিরূপন করতে সক্ষম হলেন।

    এই কেচ্ছাটি কে বানিয়েছিলেন জানা নেই,তবে এর মাধ্যমে প্রচ্ছন্ন জাতিদ্বেষের সঙ্গে একজন সফল মনোস্তাত্ত্বিকের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একই রকম একটি ঘটনা আমার স্মরণে আসছে। পাটনায় থাকা কালীন একজন সহকর্মী বিদেশ থেকে বদলি হয়ে আমাদের কার্যালয়ে এলেন। তো স্যামচাচার দেশে বেশ কিছুদিন থাকার ফলে কোনও ইতিবাচক শিক্ষা পেয়েছেন কি না বোঝা গেলোনা, কিন্তু প্রচুর ইয়াংকি মুদ্রাদোষ যে রফ্ত করেছেন তা পদেপদে বুঝিয়ে দিতে থাকলেন। কথায় কথায় শিট বা উপস বা এ জাতীয় হাস্যকর শব্দ উচ্চারণ করে তাঁর কৌলীন্য প্রচারে তাঁর কুণ্ঠা ছিলোনা। প্রথম প্রথম আমরা ব্যাপারটা নিয়ে হাসিঠাট্টা করতাম, কারণ আশা ছিলো যথাসময় তিনি 'দেশের মাটিতে' ভূমিষ্ট হবেন।কিন্তু দেখা গেলো ভবী ভুলবার পাত্র নয়। তখন আমার এক ভূমিহর সহকর্মী অনিল কুমার সিং এসে বলে, 'দে'সাব, একর কা বিমারি হম ইলাজ করবে করি।' আমি বলি, 'রৌয়া, কুছো কর, পর দফতরমেঁ হাথাপাহি মত কর।' তখন একদিন সিংজি সেই সহকর্মীটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে আরেকজনকে ( যে পূর্বোক্ত সহকর্মীটির সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলার কষ্টকৃত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলো) বললো, ' হই তিওয়ারিয়া, বহোত অংরেজি বতিয়ায়ছি হো। অবরি পিছে মুড়ি না তো শালা তোহার গঁ..... ( পড়ুন পশ্চাৎদেশ) মেঁ অইসন লথিয়াই কি তোহার কো বাপ কা নাম ভোজপুরি মেঁ হি নিকলি ইয়া অংরেজি মেঁ, ওকরা কা ফইসলা হো জাই।'

    এতে কাজ হলো। সেই পাতিসাহেব সহকর্মীটি অচিরে পাটনার কাদামাটিতে নেমে এলেন।

    এই দুটি দৃষ্টান্ত থেকে আমরা একটা মূল্যবান শিক্ষা পাচ্ছি। আদি মানুষের প্রথম ভাষা ছিলো শুদ্ধ ধ্বন্যাত্মক, এখন যেমন আমরা অন্যান্য পশুপাখিদের মধ্যে শুনে থাকি। সময়ের স্রোতে মানুষের বিভিন্ন বেসিক আবেগগুলি ( মূলতঃ অস্তিত্ত্বরক্ষার তাড়নার সঙ্গে যুক্ত) বিশেষ ধ্বন্যাত্মক শব্দরূপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে 'ভাষাসৃষ্টি'র প্রথম ধাপটি অর্জন করে ফেললো। এই বিবর্তনটি আমাদের শেখাচ্ছে মানুষ যেই মাত্র তার অস্তিত্ত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বিপন্ন বোধ করে, অর্থাৎ তার অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরণ শুরু হতে থাকে, তার উত্তেজিত মুখের ভাষা যেসব শব্দের আশ্রয় নেয় সেগুলি প্রাথমিকভাবে ধ্বন্যাত্মক নির্মাণ এবং তার সঙ্গে বিষয়যোগ হলেই সাজেস্টিভ শব্দগুলি ন্যাচরাল 'স্ল্যাং'য়ের সৃষ্টিপথ উন্মুক্ত করে দেয়। শত্রুর আক্রমণ বা ক্ষুধা নিবৃত্তি জাতীয় জৈব চ্যালেঞ্জ তাকে এভাবেই অধিকতর কার্যকরী বাক্য নির্মাণে বাধ্য করে।

    ৭.

    আমাদের জোয়ান বয়সে গোবিন্দ নিহলানির 'আক্রোশ' নামের একটি ছবির কথা মনে পড়ে। সেখানে একটি চরিত্রের ( সম্ভবত নাসির ছিলেন তাতে) একটি সংলাপ আমরা চান্স পেলেই পুনরুক্তি করতুম। ' আদমি কা ভুখ হ্যাঁয় দো জগহ পে, এক পেটমেঁ অওর দুসরা পেট কে নিচে'।
    এই সত্যটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বস্তুত সমগ্র প্রাণীজগতের জন্যই তা সত্য। এই তত্ত্বটিকে ডারউইন সাহেবের বিজয় পতাকা হিসেবে স্বীকার করা যায়। ডারউইন সাহেবের বৈজয়ন্তী প্রকৃত অর্থে স্ল্যাং শব্দাবলীর উৎসমুখ। মানুষ প্রথম ভাষা ব্যবহার করেছিলো হয় উদরক্ষুধা নয় যৌনক্ষুধার তাগিদে, অন্যান্য সব পশুর মতো-ই। এই দুই বোধ এখনও মানুষের মৌলতম জৈব আবেগের চালিকাশক্তি। তাই আমরা লক্ষ্য করি প্রচলিত স্ল্যাং শব্দাবলীর বৃহত্তম অংশ এই দুই ক্ষুধাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। অনিবার্য শারীরক্রিয়ার সঙ্গে ওতোপ্রোত ভোজন, রেচন ও বর্জনের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে অসংখ্য স্ল্যাং শব্দ নিষিক্ত শব্দবন্ধ, প্রবাদ ও লোকোক্তি। তবে নিঃসন্দেহে যৌন অনুষঙ্গ সম্পৃক্ত স্ল্যাং সংখ্যায় অনেক বেশি। কারণ সমগ্র জীবজগতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার উদরক্ষুধার পরিতৃপ্তি অনেক সহজে হয়ে যায়, কিন্তু যৌনতাড়নার কোনও অন্ত নেই। মানুষের পরিত্রাতা বলছেন, 'নট বাই ব্রেড অ্যালোন', অর্থাৎ শুধু উদরক্ষুধা শান্ত হলেই মানুষ থেমে যায়না। অন্যান্য সব স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মতো বছরকার দিনে এক আধবারমাত্র স্ত্রী-পুরুষ উপগত হবার প্রথা মনুষ্যমননে স্থান পায়না। তার যৌনমানচিত্র অতি জটিল ও ব্যাপক। শারীর ও মনন বৃত্তের যৌনক্ষুধা যেহেতু একান্তভাবে ইনস্টিংক্টিভ তাড়নায় শুরু হয়, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্ল্যাং শব্দগুলিও ইনস্টিংক্টিভ, মৌলিক ও অকৃত্রিম। এই জন্য শালীন, শিল্পিত, কৃত্রিম 'ভদ্র'জনের ভাষায় তাদের স্থান নেই।

    (ক্রমশঃ)
  • শিবাংশু | 127.197.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১৮:৩৩572695
  • ৮.

    সুশীল সমাজের বাংলাসাহিত্য ঐতিহ্যে স্ল্যাং-য়ের ব্যবহার খুবই বিরল ও নিয়ন্ত্রিত। মঙ্গলকাব্যে ও ভারতচন্দ্রের আমলে স্বতস্ফূর্তভাবে এই জাতীয় শব্দরাজি সাহিত্যে স্থান করে নিতো। পরবর্তীকালে বাবুসংস্কৃতি ও বটতলার সাহিত্যেও বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়। তার পরবর্তী যুগে দেখা যায় নাট্যসাহিত্য ব্যতিরেকে বাংলাসাহিত্যের মূলস্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন বঙ্গভাষী য়ুরোপীয় ( পড়ুন ভিক্টোরিয়) বা ব্রাহ্মসমাজের প্রতিভাবানেরা। এই দুই গোষ্ঠীই বাঙালি জীবনে আপোসহীন ভাবে মার্জিত, সুশীল রুচি সঞ্চারে যত্নবান ছিলেন। এর পিছনে ইংরেজ রাজশক্তিরও আনুকূল্য ছিলো। কিন্তু বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু-গিরিশ-অমৃতলালের সময় থেকে বিজন-উৎপলের নাটক পর্যন্ত খুব কার্যকরীভাবে তথাকথিত স্ল্যাং-য়ের ব্যবহার দিয়ে নাটকের উপজীব্যকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

    যেহেতু বঙ্গদেশের পশ্চিম প্রান্তে একটি বিশেষ ভূখন্ডে ইংরেজ রাজশক্তি নিজস্ব ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি করেছিলো, তাই সেখানেই বাঙালির সুশীল জীবনচর্চার কেন্দ্রও বিকশিত হতে থাকে। এর বাইরে পূর্ব বা দক্ষিণ-পশ্চিম অথবা উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে এই সুশীল সমাজের নিয়ন্ত্রণ ছিলোনা বললেই চলে। এই সব ভূভাগের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা কলিকাতা-কেন্দ্রিক নাগরিক সভ্যতা থেকে ভিন্ন ছিলো। কারণ কৃষি ভিন্ন অন্যতর বৃত্তি এখানের মানুষজনের নাগালের ভিতরে ছিলো না। এছাড়া এই সব অঞ্চলে কোথাও অতিবৃষ্টি বা কোথাও অনাবৃষ্টির কারণে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষ সতত তটস্থ থাকতেন। তাঁদের ন্যূনতম জৈব প্রয়োজনও অনেক সংগ্রাম করে অর্জন করতে হতো। তাই তাঁদের বাগরীতিতে মার্জিত, পরিশীলিত অলঙ্করন বিশেষ দেখা যেতোনা। কিন্তু তথাকথিত স্ল্যাং-য়ের 'শিল্পিত' ব্যবহারে তাঁরা সিদ্ধ ছিলেন। এখনও পূর্ববঙ্গে, উত্তরবঙ্গে ও দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়বঙ্গের মানুষ স্ল্যাং-'সংস্কৃতি' তে ( নেহাৎ অক্সিমোরোন) নিত্যনব উদ্ভাবনার দাবি রাখতে পারেন। তবে নাগরিক বঙ্গভাষীদের ব্যবহৃত স্ল্যাং শব্দের মধ্যে উত্তরভারতে প্রচলিত বহু স্ল্যাং শোনা যায় তার কারণ ভিন্ন। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে কলেকারখানায় বা অন্যান্য দৈহিক শ্রমজীবীর পেশায় বিপুল পরিমাণে ইতরযানী মানুষ উত্তরের গাঙ্গেয় অববাহিকা থেকে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজস্ব অধ্যবসায়ের জোরে সমাজে আর্থিক কৌলীন্য অর্জন করে পূর্বতন শ্রেণী থেকে উন্নীত হয়েছিলেন হয়তো, কিন্তু সংখ্যাগুরু মানুষ সেটা পারেননি। এঁদের মধ্যে আবার অনেকেই অপরাধজগতের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে আশ্রয় নেন। তার ফলে এঁদের মুখের ভাষার, বিশেষ করে স্ল্যাং-য়ের ব্যবহার, তাঁদের বাংলাভাষী সহযোগীদের মধ্যে বেশ ভালো মাত্রায় চলে আসে। আমরা কমবয়সে কলকাতার 'মস্তান'দের মুখে বিচিত্র উচ্চারণে হিন্দি স্ল্যাং-য়ের ব্যবহার শুনে আমোদ পেতাম। এক্ষেত্রেও ' বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি..... ' সিনড্রোম ভালো-ই কাজ করেছে।

    ৯.

    পিরিতির আঠা মানুষের মধ্যে কাঁঠালি ঘনিষ্টতা সৃষ্টি করে। কিন্তু স্ল্যাং সম্বোধনের যে আঠা তার ঘনিষ্টতার মাত্রা , কাঁঠাল কেন, ফেভিকুইকের থেকেও অনেক বেশি কার্যকরী। আমরা যখন বহুদিন পরে ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসি, তখন স্ল্যাং-য়ের ফুলঝুরি যেন দিগন্তের শেষ প্রান্তকেও আলোকিত করে রাখে। আমাদের প্রজন্ম বাল্য বা যৌবন পেরিয়ে এসেছে। আড্ডাধারীদের এই মূহুর্তের বেঁচে থাকার মধ্যে হয়তো নানা আর্থসামাজিক স্তরের ব্যবধানও তৈরি হয়ে গেছে । কিন্তু আমাদের পরস্পর বিনিময়ের স্ফুলিঙ্গ তিরিশ বছর আগের মতো-ই এখনও সমান চমক জাগাতে পারে। যখন আড্ডা শুরু হয়, তখন সুশীল ভাষা, সম্ভ্রান্ত বাক্য হয়তো কিছুক্ষণ চলে। কিন্তু সেটা বারুদ উষ্ণ হবার কালক্রম। একজন একটা ফুলকি জাগালেই তার পর মনে হয় অস্ত্রাগারে আগুন লেগেছে। কোথায় হারিয়ে যায় মাঝখানের দীর্ঘ বছরগুলি। টাটা মোটরসের বরিষ্ঠ দায়িত্বে থাকা বড়ো সাহেবের সঙ্গে টাটা ট্রাকচালক বন্ধুর সামাজিক অবস্থানের বিস্তৃত ব্যবধান আর নজরে পড়েনা। কোন এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিখ্যাত চিকিৎসক সামান্য ছড়ালেই আরেক হরিপদ কেরানি সুহৃদ তার চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করে দেয়। স্ল্যাং-য়ের আঠায় জুড়ে থাকে গোত্র ও গোষ্ঠী, আত্মনেপদী সম্পর্কের ছড়িয়ে থাকা জাল।

    মৃত্যুর মতো-ই স্ল্যাং-য়ের ভাষাই বোধ হয় সার্বভৌম নির্মাণ।

    এতোদূর পর্যন্ত পড়ে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এই লোকটার হলো কী? এ কী আমাদের চেনা সুজলা-সুফলা বাংলাভাষার অন্তর্জলী করার জন্য কিবোর্ডেবসেছে?

    তবে আবার ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করেছিলুম।

    স্ল্যাং-ভাষা জৈবরসে সমৃদ্ধ । রক্ত-মাংসে বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই, অমেধাবী কামনা-বাসনা, জান্তব তৃপ্তি-অতৃপ্তি, সব কিছুকে কোল দিতে পারে এই নিম শব্দাবলী। যে সুশীল আমি সমাজনির্দিষ্ট মুখোশের আড়ালে স্বচ্ছন্দ থেকে কালাতিপাত করে যাই, সেই আত্মসন্তুষ্টি থেকে আমাকে হিঁচড়ে টেনে আনতে পারে কয়েকটি অক্ষরনির্মাণ শব্দ, দুঃশীল, দুর্বিনীত, দুর্নিবার।

    কিন্তু স্ল্যাং শব্দের লেখ্য আবেদন এখনও স্বীকৃত নয়। এ নিতান্ত মৌখিক মাধ্যম। তা বন্যার জলের মতো বেগবতী, অমোঘ, কিন্তু চিন্তাশীল মানুষের বৌদ্ধিক তৃষ্ণা নিবারনে অক্ষম। সমাজবদ্ধ মানুষ যাবতীয় যাপন পরিস্রুত না করে গ্রহণ করতে পারেনা। সময় পরীক্ষিত যে শিল্পভাবনা আমাদের সমাজবন্ধনের শর্তগুলি সৃষ্টি করে, স্ল্যাংভাষা সেখানে দুয়োরাণী।

    তাতে আর কী হয়েছে ? আমাদের সব রূপকথাতে দুয়োরাণীই তো আসল রাণী, দুঃখে, বেদনায়, বিফলতায়। ঠিক যেন রোদেপোড়া, কাদাজলে আমগ্ন এলেবেলে মানুষগুলি। যাঁরা আমাদের থালায় প্রত্যহ শষ্যের শূশ্রূষা এনে দেন। কিন্তু তাঁদের হেঁসেলে আবহমান শোনা যায়, ' ভাত দে, ভাত দে হারামজাদী।'

    (শেষ)
  • shanku | 134.3.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:২৭572696
  • অসাধারণ পরিশীলিত একটি রচনা, শিবাংশুদা। আপনি দেখালেন বটে, লিখতে জানলে বিষয়বস্তুর অভাব হয় না।
  • siki | 132.177.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২২:৪৩572697
  • অ্যাজ় ইউজু়য়াল, শিবাংশুদা অসাধারণ।
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.***.*** | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২৩:০১572698
  • মানুষ যেই মাত্র অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে বিপন্ন বোধ করে, তখন তার মুখের ভাষায় যা আসে তা 'প্রাথমিকভাবে ধ্বন্যাত্মক নির্মাণ'। বিষয়যোগ হয়ে সাজেস্টিভ শব্দ ও বাক্য তৈরি হয়। এই শব্দগুলি ন্যাচরাল 'স্ল্যাং'য়ের সৃষ্টিপথ উন্মুক্ত করে দেয়। বাক্যও তৈরি হয়। ভালো লাগলো। পুরো লেখাটাই খুব ভালো লাগলো।
  • bslg | 37.125.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০০:৫৩572699
  • কোথা থেকে আসে স্ল্যাং কেউ শুধোবেন না,
    নেচে গেয়ে আসে সে তো ধিগ্ ধিগ্ ধেন্না ।
    মিটি মিটি চেয়ে হাসে,
    কখনও বা এট্টু কাশে,
    নিমেষে উগলে দেয় লজ্জা বা ঘেন্না ...
  • aranya | 78.38.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১০:১৩572700
  • এই টই-টা মিসিয়েছিলাম। অসাধারণ লিখেছেন শিবাংশু।

    'গান্ধীনগরে এক রাত্রি-কে আলোচনায় স্থান দিতে আপত্তির ক্থা শুনে সেই লেজেণ্ড হয়ে যাওয়া কাহিনী মনে পড়ল - সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা আধুনিক কবিতার উদাহরণ প্রসঙ্গে 'যমুনাবতী সরস্বতী'-র কয় লাইন অবৃত্তি করায় বুদ্ধদেব বসু-র আপত্তি।
  • b | 135.2.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১১:৩৪572701
  • ওখানে ওনার আপত্তি ছিল 'ভাত' শব্দটি নিয়ে। হয়ত বু-ব-র কাছে শব্দটি স্ল্যাং!
  • aranya | 78.38.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১১:৩৮572690
  • আমি পড়েছিলাম শঙ্খ ঘোষের 'কবিতার মুহূর্ত' বইটায় - বু ব-র ধারণায় ওটা কবিতা হয় নি, এইটুকুই শুধু মনে আছে।

    হয়ত উনি কম্যুনিস্ট রাজনীতি খুঁজে পেয়েছিলেন, 'ভাত'-এর মধ্যে।
  • কল্লোল | 125.24.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ২০:০৩572691
  • শিবাংশুর কি বোর্ড অক্ষয় হোক।
  • ranjan roy | 131.245.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ ০৯:১৬572692
  • কী মিস করেছিলাম! অক্ষয় হয়ে গেছে। স্ল্যাং নিয়ে পরিশীলিত বাংলায় অতীব স্বাদু এবং গভীর লেখা।
  • শিবাংশু | 127.197.***.*** | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ ১২:২৯572693
  • অরণ্য,

    বুদ্ধদেব সারা জীবন 'শুদ্ধদেব' হয়ে কাটিয়ে গেলেন। শিল্পের 'শুদ্ধতা' খুঁজতে খুঁজতে আটকে পড়লেন বেনোজলে।

    আমাদের ক্ষতি।
  • pi | 172.69.***.*** | ০৮ মার্চ ২০২০ ১৬:২৮729891
  • তুলি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন