এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ভাট: ভার্চুয়াল থেকে রিয়্যাল (৩)

    Samik
    অন্যান্য | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ | ১১৩৬১৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tim | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:৫৭510198
  • না না দিল্লিভাটের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে আছে। শুদু একটু ট্রিগার করতে হয়, ব্যস!

    উফ সে ক্ষি হসপিটালিটি। আমরা তো জম্মু থেকে আসছিলাম, পথে দিল্লিতে টেরেনবদল। জম্মুতে যাচ্ছেতাই সব কান্ড হলো। সেসব নাহয় কাশ্মীর টইতে বলবো।
    এদিকে হয়েছে কি, দিল্লিতে আগে থেকেই চমৎকার সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো সিকি। ভোর পাঁচটারও আগে থেকে উঠে স্টেশনে এসে সে রেডি। বাড়িতে লোক লেগেছে কাজ করতে কিন্তু সিকি অকুতোভয়ে আমাদের কিচ্ছুটি টের পেতে না দিয়ে চলে এলো। কোনমতে টেরেন থেকে নেমে তার জিম্মায় পড়ে যাওয়া। চা টা খেয়ে চানটান করে ফিটফাট হয়ে দু এক ঘন্টা ভাটিয়ে আমরা রওনা দিলেম কবি সন্দর্শনে, ফরিদার আপিসপানে। সেখেন থেকে তারে উঠিয়ে নিয়ে গাড়ি চললো বার্বিকিউ নেশন। তারপর ঘন্টাদুয়েক চমৎকার আড্ডা ও ভয়ঙ্কর খাওয়াদাওয়া চললো। ফরিদার সাথে সেই আমাদের বিয়ের সময় দেখা হয়েছিলো। দিল্লির বাকি ভাটুরেরা আসতে পারেক নাই, সোম্বার ছিলো। তারোপর দিল্লি তো শুদু দিল্লি না নয়ডা ফরিদাবাদ গুরগাঁও এইসব জঘন্য সব দূর দূরান্তরের ব্যাপার। তবু যে কয়েকঘন্টা দেখাসাক্ষাৎ হলো, সে আমাদের ভাগ্যি। একবার মাইরি শুধু দিল্লি যাব কয়েকদিনের জন্য, সেবার লাগাতার ভাট হবে। ইয়ে হমারা ওয়াদা হ্যায়।
  • Tim | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:২২510199
  • এবাদেও একটা মিনিভাট হয়েছিলো কল্কেতায় উইথ স্যানিনি। এবং একটি অ্যাটমিক ভাট হয়েছিলো ব্যাঙদির সঙ্গে, তা সে তো আর আসে না এখানে। অসংখ্য আরো মিনিভাট রদ হয় শরীলগতিক সুবিধের নয় বলে, সে দুঃখের কথা কয়ে আর কী হবে।
  • dc | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৫৩510200
  • অ্যাটমিক ভাট মানে, পিঠে অ্যাটম বোম ছিল নাকি?
  • Tim | ***:*** | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৫৭510201
  • হুঁ
  • | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ১২:২৬510202
  • ! ইন্টারেস্টিং !
  • pi | ***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৫:৪৬510203
  • সল্টলেক ,১৩ নং tank IA 204 , পুরবাচল এর কাছে, গুরুর নতুন অফিসে ২:৩০ থেকে ভাট, পরশু নবমীতে।
    যে যে পারবেন, চলে আসুন!
  • pi | ***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ২২:১০510204
  • *পূর্বাচলে
  • র২হ | ***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:৩৩510205
  • স্থির ও সচল ছবি টবি চাই, আর ভাটের গপ্পোগাছা।
    কে কে এল?
  • pi | ***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ২১:৩৫510206
  • অনেকে!!
    দারুণ হল
  • শঙ্খ | ***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ২২:২০510208
  • আমি খুব মিস করলুম। গল্প আর ফোটো চাই
  • | ***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ২৩:০৮510209
  • আমি অনেক মনের দুঃখে মিনিভাট থেকে নিজেকে উইথড্র করে নিয়েছি।

    নাহলে একটা সময়ে এ ব্যাপারে আমি খুবই উৎসাহী
    ছিলাম। এবং অনেক ভাটে দায়িত্ব নিয়ে লোক জড়ো করেছি

  • শক্তি দত্তরায় করভৌমিক | ০৮ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:০২510210
  • আজকে দশমীর সন্ধ্যেবেলায় যখন মায়েরে ভাসাতে জলে কেঁদে কেঁদে তারশানাই তান ধরবে তখন বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাবো। যদিও মাকে জলে বিসর্জন দিয়ে এসে শান্তিজল নিয়ে, অপরাজিতার রাখি পরে নিয়ে প্রণাম, আশীর্বাদ, স্নেহচুম্বন, আলিঙ্গনে বিজয়া পালনের রীতি। অনেক পোস্টকার্ড এনভেলাপ, ইনল্যানড লেটার লিখতে হবে, লিখে দিতে হবে শুভবিজয়ার শুভকামনা জানিয়ে।সম্বচ্ছর যে রাঙ্গা ঠাকুমা একা ভিটে পাহারা দেন তাঁর জন্য ও হরকরা দুচারটি চিঠি আনবেন; পিতৃগৃহ, শ্বশুরগৃহ ভুলে কি আর গেছে? ওই দিকে ভাঙা দেশের ভিটেহারা মামী কাকিমা ও বানিয়ে রেখেছেন এলোঝেলো, নারকেল বরফি।মিষ্টিমুখ হবে।

    বিজয়ার শুভেচ্ছা সবারই জন্য, ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনী, ছাত্র ছাত্রী। বন্ধুত্বে আত্মীয়তায় কাছের যারা। আর এখন ক‘বছর ধরে আছেন ফেসবুকের বন্ধুরা।বয়সে ছোট আছেন, বড় সমবয়সীও। তারা কেউ চোখেও চেনা কারোকে হয়তো চোখে দেখিনি। তাদের সঙ্গে দেখা হতে পেরোতে হয়না মন্দির বাহির কঠিন কবাট /চলয়িতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট। যাদের জন্য চা করতে হয়না কফি খরচ হয়না। মুখে হাসি ফুটিয়ে ওমলেটের ডিম ফেটাতে হয় না। বেশ গল্প হয়, ডিপ্রেসন ভাগ হয়, তর্ক করা যায় বিক্রমে। ঝগড়া করতে চাইনা সজ্ঞানে তবে যদি ঝগড়া হয়ে যায় তখন কিন্তু হাম ভি মিলিটারি তুম ভি মিলিটারি। কখনো মনে হয় দোষ করলাম কি? কখনো মনে হয় বেশ করেছি। তা কিছু কাঁটা তো হৃদস্পন্দনে বিঁধেই থাকে, ভোলার তলে তলে উত্স জলের ধারা।ওই দিয়ে কবিতা ছানতে হয়, ছবির রঙ গুলতে হয় কারো কারো আসন থাকে জীবনের গভীর অন্ধকারে। কবিরা কাপুরুষ হয় না, স্বীকার করে। জীবনদেবতাকে বলি, "আমার বিচার তুমি কর তব আপন করে।...... যদি পূজা করি মিছা দেবতার শিরে ধরে থাকি মিথ্যা আচার "।

    ছিলাম নারকেল নাড়ু, এলোঝেলোতে চলে এলাম কোন্ বিচারসভায়। বিচার আর তার রায় সব আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে উড়ে যাবো।এখন নবমীর সন্ধ্যার গুরুচণডা৯র ভাটের কথা একটু না বললে সুবিচার হবে না। আমরা পুরোনো দিনে গম্ভীর করে হয়তো বলতাম অধিবেশন। এরা এখনকার এই ঝকঝকে ছেলেমেয়েরা বলে গুরুর ঠেক বা গুরুর ভাট। আলোচনা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে উত্সব কোলাহল। ভেতরে এন আর সি র বিপদ, কাশ্মীর সমস্যা, ভাষা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা। এরা স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েও সমাজ সচেতন। নিজের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে চায়, অন্যেরটাও জানতে চায়। লেখে, পড়েও। পাকা চুল দেখলাম, শ্রদ্ধেয় পুণ্যব্রত গুণ, শ্রদ্ধেয় অমর মিত্র। আমি তো আছি পক্বকেশের ধ্বজা উড়িয়ে। প্রতিভা, ঈপ্সিতা, পারমিতাদের উদ্যম আমাকেও প্যানপ্যানানি নিয়ে ঘরে থাকতে দিলো না। আমিও দেখি তিন ঘণ্টা দিব্যি শুনলাম, বললাম। পাভেল দুজন, দুজনেই প্রখর বুদ্ধি। ঋতম মঞ্জীস শান্ত, ধীমান। কবি বিদ্যুতলেখা, সে আবার আমাদের ত্রিপুরার কবি ননীগোপাল চক্রবর্তীর নোয়াখালি ভাষার কবিতা সম্পর্কে জানে। কবি যশোধরা রায়চৌধুরী। মধুর ব্যক্তিত্ব, চাকুরীর পদমর্যাদা সেই মাধুরী ছাপিয়ে ওঠেনি। তাঁর সম্পাদিত নূতন লক্ষ্মীর পাঁচালি।পড়া হোলো সবাই মিলে। পরিবেশ চেতনা, স্বাস্থ্যবিধি, সমাজবিনির্মান, নারী চেতনা সব নিয়ে নূতন আন্দোলনের স্বপ্ন নিয়ে লেখা। শুধু মেয়েদের পড়লেই হবে না, ছেলেরাও পড়বে। কালকে যেমন পড়লেন অমর মিত্র সহ সবাই। রৌহিন ঐকান্তিক ভাবে পুরো অনুষ্ঠানটি নিজের খাটুনি দিয়ে উতরে দিতে চেষ্টা করেছে। মারিয়া তো সবদিকে চোখ রাখে, যাতে কোথাও অসুবিধা না হয়। খাবারদাবার ছিলো কিন্তু, ভালো ভালো সন্দেশ, বিস্কুট, কাঁচের কাপে সুদৃশ্য লিকার চা।

    ধন্যবাদ রৌহিনকে। ব্যধিগ্রস্ত আমাকে রৌহিন নিয়ে আসার ঝক্কি না নিলে কালকের সন্ধ্যেটাও আমি শুয়ে শুয়ে বিষাদ বন্দনা করতাম।
  • i | ***:*** | ১১ অক্টোবর ২০১৯ ০৬:০৯510211
  • ছবি দ্যান। ভিডিও দ্যান।
  • Sarbani | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৬:৪৫510212
  • আইডিয়াটা বলতে গেলে সুমিতের। আমাদের দেখা হলেই গল্পগুজবের একটা বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে থাকে নানারকম খাবার ও রেসিপীর কথা।এরকমই এক ঘরোয়া গল্পের আসরে ডিনারে সদ্য বিরিয়ানি ইত্যাদি খেয়ে ওঠা আমরা নানা জায়গার খাবারের আলোচনায় যখন মগ্ন, সুমিতের মুখে শোনা গেল শান্তিনিকেতনের বরিশালের রান্নাঘরের নাম।
    এ হল পুজোর কিছুদিন আগেকার কথা এবং আমাদের দুজনের পুজোর ঠিক পরে পরেই আগেপিছে কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান আছে, সেখানে দেখা হবে মিঠুর সাথে।
    বরিশালের রান্নাঘরের নামে ভোজন ও রন্ধন রসিক ডাক্তারবাবু উৎসাহে একেবারে বাঁধনহারা।
    “চল তাহলে শান্তিনিকেতন। সকালে বেরিয়ে বেলা নাগাদ পৌঁছে যাব। দুপুরের খাওয়াদাওয়া বরিশালের রান্নাঘরে সেরে, একটু এদিক ওদিক ঘুরে, বিকেলে রওনা দিলে, সন্ধ্যেরাত্তিরে কলকাতা ফেরত আসতে পারব।“
    আমি তো শুনে একপায়ে খাড়া। মিঠুকে বলাতে সে শুধু রাজী যে তাই নয়, প্রস্তাবে যাকে বলে ভ্যালু অ্যাডিশন তাই করে ফেলল। মিঠুর পরামর্শে ঠিক হল যেকোনো দিন নয়, যাওয়া হবে শনিবার। শনিবার সোনাঝুরির বড় হাটের দিন, খেয়েদেয়ে আমরা হাটে ঘুরব।

    নানা কাজের ব্যস্ততায় এরপরে আর এনিয়ে তেমন কথা হয়নি। মিঠু এসে গেছে পুজোর মধ্যে, সুমিত কলকাতা গেল আমার যাওয়ার দুদিন আগে। আমি ষোল তারিখের রাতে পৌঁছেই দুজনকে মেসেজ করে জানালাম, এসে গেছি। প্রথমে জবাব এল সুমিতের, শনিবার আমরা তিনজন মিট করছি, খেতে যাব, তারপরে একটা নাটক দেখব।
    আমার দুগালে মাছি। তাহলে শান্তিনিকেতন? সুমিত উত্তরে জানালো, একদিনে গিয়ে ফিরে আসা একটু চাপ হবে, এযাত্রায় তাই শান্তিনিকেতন মাইনাস। হায়রে বরিশালের রান্নাঘর, হায়রে সোনাঝুরির শনিবারের হাট!

    মনখারাপের দিস্তার মধ্যে ঘরদোর অল্প রাতের মত গুছিয়ে, খেয়েদেয়ে বসেছি, হইহই করে মিঠুর ফোন এল। মিঠুর গলাতে এমন একটা হইচইয়ে ব্যাপার থাকে যে মনের মেঘ উড়েটুড়ে গিয়ে রোদ উঠতে বাধ্য।
    কথায় কথায় আমি যেই বলেছি শান্তিনিকেতন তো এবার আর হলনা, মিঠু তাই শুনে আকাশ থেকে পড়ে। আমি এবার মিঠু কিছু জানেনা দেখে আর একবার বিষম খাই।
    দুজনে খুব খুব রেগে যাই সুমিতের ওপর। শান্তিনিকেতনের আইডিয়াটা ওর, যাকে বলে গাছে তুলে দিয়ে এখন মই কেড়ে নেওয়ার যোগাড়।দুজনে ঠিক করলাম সুমিত না গেলেও আমরা দুজন যাবই যাব।আমার এক চেনা ভদ্রলোক আছেন যিনি প্রয়োজনে গাড়ি দেন, তাকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা হবে।
    সব কথা পাকা করে সুমিতকে জানাতে গিয়ে দেখা গেল, শেষমেশ সেও যেতে পারবে আমাদের সঙ্গে। এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছুই হয়না। ঘন ঘন মেসেজ আদানপ্রদান হতে লাগল তিনজনের মধ্যে, যাত্রার নানা খুঁটিনাটি ব্যাপারে, কাকে আগে তুলবে গাড়ি, সময়সূচী ইত্যাদি।

    শনিবারের সকালের সূচনাটা একেবারে দিব্য হল। গাড়ি মিঠুকে তুলে নিয়ে এল আমার বাড়ি, হিসেবের মাত্র দশ মিনিট দেরীতে। তাও হতনা যদিনা গাড়ির ড্রাইভার দিক নির্দেশ গুলিয়ে মিঠুদের গেটের এসবিআই এটিএমের বদলে অন্য আর এক এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত।
    সুমিতকে তোলা হল জয়া সিনেমার সামনে থেকে, এবং তারপরে গাড়ি চলল সুমিতের নির্দেশমত শর্টকাট দিয়ে যা বাকী দুজনের মনে হল গলিঘুঁজি, এবং এয়ারপোর্টের ওদিক দিয়ে বেরোলে সুবিধে হত।হাইওয়েতে আসার পর অবশ্য সুমিত স্বীকার করল যে হয়ত তার বাতলানো রাস্তাটা তেমন শর্টকাট ছিলনা।

    রোদ ঝলমলে সকাল, সাথে বন্ধুরা, গন্তব্য শান্তিনিকেতন, এমন দিনের টুকরোটাকরায় আঁকা ছবিতে সচরাচর যেমন নানা রঙ উপচিয়ে পড়ে, এ যাত্রায়ও তার অন্যথা হয় না।
    আমাদের হা হা হি হি তে এতই গুলজার থাকে গাড়ির অন্দর যে ভালোমানুষ ড্রাইভার শ্যামল কার স্টিরিওতে গান চালাতেই ভুলে যায়।মিঠুই প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল করে, যাত্রাপথে কী যেন একটা মিসিং,
    “আরে গান চলছেনা যে গাড়িতে, ও শ্যামলবাবু”।
    “না মানে আপনারা গল্প করছেন, তারমধ্যে গান.........”।
    শ্যামলবাবুর আমতা আমতা জবাবের উত্তরে আমরা সবাই মিলে তাকে মহা উৎসাহে
    “গান চালান, গান চালান। গান না হলে গাড়িতে দূরে যাচ্ছি ভাবটা ঠিক আসেনা”
    সমবেত আর্জিতে শেষে সে গান চালিয়ে দিল, সমস্ত হিন্দি পুরনো গান।
    সেসব শুনে আবার সুমিতের মনে পড়ে যায় নব্বইয়ের পুজো প্যান্ডালের গান এক এক করে। মরশুমটা পুজোর, চারিদিকে চোখ মেললে তখনো প্যান্ডেল গেট এসবের অংশবিশেষ নজরে পড়ছে, অতএব মওকা ও দস্তুর দুইই ভরপুর!
    “আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও” এরকম সব গানের কথা মনে করাচ্ছে এক এক করে আর সবার হেসে কুটোপাটি অবস্থা, বাকীরাও স্মৃতির সুরেলা সফরে তাল দিচ্ছি যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী। শ্যামল আবার তারমধ্যে দেখি স্টীয়ারিংয়ে তবলা বাজায়, আমি জিজ্ঞেস করতে জানালো তার নাকি গানবাজনার চর্চা আছে!

    হাইওয়েতে দেশী ট্রাকেদের ও গাড়িদের বেনিয়ম চলা নজরে পড়লে মিঠুর অস্বস্তি ও বাকীদের তাকে সাহস জোগানো ছাড়া বাকীটা পুরোপুরিই গান গল্প হা হা হি হির ওভারডোজ!
    আর একটি অভিনব আবিস্কার হল এ যাত্রায়, সপ্তপদীর নামে প্রথমেই আমাদের যে শুধু ইনফাইনাইট ল্যুপে “তুমি বলো” মনে পড়ে তেমনটি বোধহয় আর আমার বা মিঠুর হবেনা। এর চেয়ে বিশদ আর এখানে বলা যাবেনা, তবু উল্লেখ করছি কারণ আমাদের হা হা হি হি র অনেকটা জুড়ে এটিও ছিল।

    এপথে সবচেয়ে বেশী যাতায়াত করেছে সুমিত, তাই পুরো প্রোগ্রাম বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটায় তার কথামতই হয় সব। শক্তিগড়ে থামা হয় ব্রেকফাস্ট করতে।
    প্রায় দেড় বছর ধরে আমি প্রতি মাসে এই রাস্তা দিয়ে দুর্গাপুর গেছি কাজে। প্রথম একবার শক্তিগড়ের অসংখ্য ল্যাংচা নামাঙ্কিত দোকানসমূহের মধ্যে একটি ভিড়েভরা দোকান থেকে একবার ভয়ঙ্কর আকৃতি ও স্বাদের ল্যাংচা কিনে ঠকার পর থেকে ওই জায়গাটিতে গাড়ি থামলেও আমি কখনো নামার ভুল করতাম না। সুমিত আমার সে ভয়ের কথা শুনে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়, “আরে, তোমাদের এমন শিঙারা খাওয়াবো না, কোনদিন স্বাদ ভুলতে পারবেনা, আমার চেনা দোকান আছে।“
    এমনিতে সে ল্যাংচার স্বাদও আমি কোনোদিন ভুলতে পারব বলে মনে হয়না, দুঃস্বপ্নে ফিরে ফিরে আসবে, অবশ্য সে কথা সুমিতকে বলে বিশেষ লাভ হলনা। অনেককাল পরে আসছে সে চেনাপথে, যদিও আর একটু হলেই প্রোগ্রামটা ভন্ডুল করে দিচ্ছিল সে তবু গাড়িতে উঠে থেকে দেখা যাচ্ছে উৎসাহে সে আমাদের দুজনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে!

    ল্যাংচার পরে নিবাস, মহল, নিকেতন, হাউস ভবন ভুবন এবং আগে আদি নতুন ইত্যাদি নামের নানা দোকান রাস্তার দুপাশে সারি সারি, তার মধ্যে ঠিক চিনে গাড়ি ঢোকালো নির্দিষ্ট দোকানটিতে। দেখা গেল বেশ কিছুদিনের অদর্শনেও কর্মচারী থেকে মালিক প্রত্যেকেই মনে রেখেছে ডাক্তারবাবুকে।
    মিঠু আর আমি ভয়ে ভয়ে আছি। এর আগে বরিশালের রান্নাঘরে ফোন করে খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। শিঙারা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে এরপরে বরিশালের রান্নাঘরে খাবার অবস্থায় থাকব কিনা সে নিয়ে দুজনেই ঘোর সন্দেহে।

    “শিঙারার সঙ্গে যে চাটনিটা যা দেয় না, দারুন। কচুরিও খাব আমরা এর সঙ্গে।“ শুনে হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই পাতে গরম গরম খান দুই শিঙারা আর তেঁতুলের চাটনি।সুমিত আবার মহা ডায়েটে থাকে, এ দিনে বোধহয় তার ছমাসের ডায়েটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। শিঙাড়ার মন মাতানো গন্ধে আর থাকা গেলনা, জয় শান্তিনিকেতন বলে আমরাও খেয়ে ফেলি, দুটোই, চাটনি সত্যিই দেবভোগ্য। খেতে না খেতেই এল কচুরি, সেও দিব্যি, তবে শিঙাড়ার মত অত ভালো নয়। খাওয়ার মাঝে নানাজনে এসে ঘুরেফিরে যাচ্ছে আমাদের টেবিলে, সুমিতের সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে। এরপরে মিষ্টির কথা উঠলে আমরা জোর আপত্তি জানাই, অবশ্য সুমিতও সায় দেয় এতে, মিষ্টিতে সেও নেই। কিন্তু জানা যায় আমাদের জন্যে স্পেশ্যাল চা হয়ে আসছে দোকানের পিছন দিক থেকে, স্পেশ্যাল হাতে বানানো হয়ে।

    মন ও ক্ষুধিত পরাণ দুই ভরিয়ে, শক্তিগড় ছাড়িয়ে, বর্ধমানে পৌঁছে আমরা হাইওয়ে ছেড়ে বাঁক নিই শান্তিনিকেতনের পথে।আমি এসব রাস্তা বিশেষ চিনিনা, এর আগে একবারই ঘুরে গেছি, তাও সেবার ট্রেনে এসেছিলাম।
    মিঠু অনেকবার এসেছে, রাস্তাঘাটও অনেকটাই চেনে। রাস্তা এখানে কিছুটা সরু তবে খারাপ নয়, শুধু মাঝে মাঝে ছাগলরা একটি দুটি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, নিজের বাড়ির উঠোনের মত করে, আরামে, নিশ্চিন্তে।তাদের বাঁচিয়ে রাস্তা চলাটা রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার, শ্যামল খুবই ভালো চালাচ্ছিল ভারতীয় নিয়মে কিন্তু মিঠু ঠিক ভরসা করতে পারছিল না।
    ছাগলের এহেন ছাগলামিতে সে বেশ বিরক্ত, আমরাও কম নই। আমরা নানাদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকলাম রাস্তা থেকে চোখ সরাতে, দুধারের পুকুর, বাড়ির উঠোনের ঝিঙেফুল ভরা লতানে গাছ, সবুজ ধানের ক্ষেত। এবারে এত বৃষ্টি হয়ে চাদ্দিক সবুজে ভরা, চোখের যা আরাম সে আর বলার নয়। এরমধ্যে অবশ্য ছাগল গাড়িতে কাটা পড়লে কী হয়, মানে কারা খেতে পায়, এ নিয়ে তিনজনের ঘোর আলোচনা শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ নানা মত শোনার পর শ্যামল জানালো ছাগলের মালিক ছাগল বাবদ টাকাও নেয় আবার মরা ছাগলও!

    বোলপুরের কাছে এসে শুরু হল কালীপুজোর চাঁদার অত্যাচার। দু পা যেতে না যেতে একই গ্রামের তিন চারটে দল রাস্তা আটকাচ্ছে, সব অল্পবয়সী ছেলেপিলে, বড়রা সম্ভবত এদের এগিয়ে দিয়েছে। শ্যামল অবশ্য এসব সামলাতে খুব দড়, তাই আমাদের বেশী ঝামেলা পোহাতে হলনা, যদিও আগেপিছে অনেক গাড়িই বেশ নাকাল হচ্ছিল চাঁদার দলের হাতে।

    শান্তিনিকেতনে পৌঁছলাম যখন তখন সবে বারোটা বেজেছে, সুমিত জানালো একটার আগে খাবার রেডি হবেনা। তাই ট্যুরিস্ট চত্বরে গাড়ি থামিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে নেওয়া ঠিক হল, এমনিতে আর কিছু দেখার খুব একটা ইচ্ছে এযাত্রা ছিলনা। শনিবারের ছুটির দিন, ভিড় মোটামুটি, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীর দল, সঙ্গে শিক্ষক শিক্ষিকা এবং স্থানীয় গাইড, এছাড়া শহুরে দলবল, উইকেন্ডের শুরুর ভিড়।
    আমরা কাঁচের ঘরের ওদিকটায় ঢুকলাম, বাগানে কাঁকর বিছানো পথে অল্প ঘোরাঘুরি, প্রাণের আরামের সামনে ফোটোঅপ। কিছুটা গিয়ে ছাত্রীনিবাসের দিকটায় যেখানে বাইরের লোকেদের জন্যে পথ শেষ হয়ে গেছে, সেখানে দেখা গেল পাহারায় দাঁড়িয়ে আমাদের আজকের দিনের গোমাতা এক।
    সুমিত তাকে নানাভাবে হ্যাট হ্যাট করে সরানোর চেষ্টা করে বিফল, ফোন ক্যামেরা তাক করে মিঠু এবার পরামর্শ দেয় ফুল ছুঁড়তে, শান্তিনিকেতনের গরু, শুধু হ্যাট হ্যাটে সরবে কেন।
    আমি সুমিতকে সাহায্য করতে যাই ফুল ছাড়াই এবং মিঠু দূর থেকে ফোন ও দাঁত বার করে শাসাতে থাকে যে আমাদের গোমাতার ন্যাজে নাকাল হওয়ার পর্ব সে ভাইরাল করবেই করবে!

    এদিক ওদিক ঘুরে ঘড়িতে একটা বাজলে আমরা বাইরে আসি, শ্যামলকে ফোন করে গাড়ি আনতে বলে দিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনের শুধু মানুষজন নয় পশুরাও সুমিতকে দিব্যি চেনেমানে বোঝা গেল কারণ একটি খোঁড়া সারমেয় আমাদের পিছু নিয়েছে, তার দৃষ্টি সুমিতের দিকে।
    সেই কাতর দৃষ্টিতে আকুল সুমিত রাস্তা পেরিয়ে ছুটল দোকানে বিস্কিট কিনতে। এবার সুমিতের যাওয়ার অর্থ সম্যক উপলব্ধি না করতে পেরে সে চলে যাওয়াতে নিরাশ হয়ে আমাদের দুজনকে মোটে পাত্তা না দিয়ে কুকুরটি স্থানত্যাগে উদ্যত হল। সুমিত তাই দেখে রাস্তার ওপার থেকে তাকে হইহই করে ডাকতে থাকে। শেষে না থামাতে পেরে তার পেছনে বিস্কিট নিয়ে ধাওয়া করে। এবার কুকুরটি তো আর পিছন ঘুরে হাতের বিস্কিট বা সুমিতকে দেখতে পায় না, তাই সে তার পেছনে সুমিতের দৌড়নোর সম্ভবত অন্য মানে করে আরো জোরে দৌড়ে পালায়।

    সুমিতের তো বটেই, আমাদেরও খুব মন খারাপ হল বিস্কিটটা ওকে না দিতে পারাতে। একটা বেজে গিয়েছিল, কুকুরের খাওয়া হলনা কিন্তু ঘোরাঘুরি ও কুকুরকে তাড়া করারা উত্তেজনায় আমাদের শিঙারা কচুরি দিব্যি হজম হয়ে খিদে পেয়ে গেসল জবর, অতএব চালাও পানসি বরিশালের রান্নাঘর! সারথি শ্যামল হলেও দিশারী সেই সুমিত, রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলল।
    বনভিলা বাসস্টপ থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলে একদিক গেছে বনলক্ষীর পথে আর উল্টোদিকের পথে গেলে বরিশালের রান্নাঘর। সুমিতের কাছেই জানা গেছে যে মালিক নাকি বলতে গেলে একই, মানে বনলক্ষী দাদার নামে আর বরিশাল বৌদির নামে। তবে বরিশাল এত স্পেশ্যাল কারণ এখানকার রান্নাবাড়া বৌদির সহস্তে অথবা তত্বাবধানে হয় এবং আগে থেকে অর্ডার করলে তবেই পাওয়া যায়, অল্প ও বাছাই খদ্দেরের জন্যে এই রান্নাঘর।

    এখানেও সেই শক্তিগড়ের পুনরাবৃত্তি, সুমিতের সবই চেনা সব জানা। দাদা নিজে ছুটে এলেন বনলক্ষী থেকে, দুপুর রোদের গরমে কিঞ্চিত কাহিল আমরা, বসালেন যত্ন করে কুলারের কাছের টেবিলটিতে। একটি একটু বড় আকারের ঘর, খান পাঁচেক টেবিল পাতা লম্বা আকারের, এক একটিতে জনা ছয়েক বসা যাবে। বাইরে তাকালে মনে হবে গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, মাটির দুয়ার, উঠোন,গাছপালা, পিছনদিকে পড়শির বাড়ির উঠোনে রোদে শুকচ্ছে জামাকাপড় গমের কুলো, খালি কলতলা।

    যদিও অর্ডার করার সময় শুনেছিলাম ফোনের এদিকে সুমিত শুধু ইলিশ আর রুই মাছের কথা উল্লেখ করেছিল, আমাদের মতামত নিয়েই, খাবার সময় দেখলাম একেবারে পঞ্চব্যাঞ্জনের ব্যবস্থা। এল ডাল, ঝুরি আলুভাজা, শুক্তো, নারকেল আর ছোলা দিয়ে কচু শাক, গোটা পটলের পেঁয়াজ আদা দিয়ে রসা এবং রুই মাছের কালিয়া ও ইলিশ মাছের সর্ষে। শেষ পাতে চাটনি এল যদিও আমরা খুব ভালো বুঝতে পারলাম না কিসের তবুও আমড়া বা জলপাইয়ের দুইয়ের মধ্যে একটি মনে হল। অন্য রান্নাগুলি কী আর বলব নিরামিষ বা আমিষ দুইই এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে আমায় দ্যাখ গোত্রের মানে যাকে বলে লাজবাব। চাটনিটি সে তুলনায় নিরেস, বৌদির নজর এড়িয়ে কেউ সম্ভবত ভুল করে গুচ্ছ কারিপাতা ফেলে দিয়ে ওটিকে এমন বরবাদ করেছে যে আমাদের মোটামুটি অভিজ্ঞ রসনাও জলপাই অথবা আমড়ার স্বাদ বুঝতে ফেল মেরে গেল!

    এরকম গায়ে হলুদের খাওয়াদাওয়ার পরে ভরদুপুরে চোখ জুড়ে ঘুম আসারই কথা কিন্তু সুখের ব্যাপার আমাদের কারোরই ওই অভ্যেস না থাকার জন্য আর সবকিছুর মাঝে হ্যা হ্যা গল্প জারি থাকার দরুন আবার হইহই করে গাড়িতে ওঠা হল। বলতে নেই শ্যামলবাবুও সবকিছুতে আমাদের স্পিরিটটিকে যথোচিত সম্মান করে এতটুকুও বেজার না হয়ে বরং হাসিমুখেই নির্দেশমত এদিক ওদিক করছিলেন।

    এত খাওয়াদাওয়ার পরে তখন মনে হল চা খেতে হবে। মিঠু যাত্রার শুরুতেই বলে রেখেছিল যে কোপাইয়ের ধারে যেতে হবে এবং সেখানকার চায়ের দোকানে চা খাওয়া হবে।গিয়ে দেখি আহা, এতো আমার সেই নদীর ধারে ঝুরি নামানো বটের ছাওয়ায় ঝিরিঝিরি বাতাস বওয়া নিকোনো মাটির দাওয়ার মাঝের স্বপ্নের চায়ের দোকান, যদিও নাম দেখলাম লেখা আছে খোকনদার চায়ের দোকান!
    দোকানের সামনের দাওয়ায় বাঁশের বাতার বেঞ্চিতে বসলাম চায়ের কথা বলে। ওদিকে বাউল একজন গাছের ছাওয়ায় বিশ্রাম করছিল, লোক দেখে উঠে পড়ে গান ধরল, “আমার ঘরে বসত করে কয়জনা“, দুই এক করে এদিক ওদিক থেকে এল সঙ্গীরা সংগতে। লালমাটি, হাওয়া এবং কোপাইয়ের জলের গুণে সে গান কানে অসামান্য ঠেকল, বেশ ভালো সুরেলা গান ও মানানসই সঙ্গত সঙ্গীদের।

    ঘরের বাসিন্দা দুটি কুকুর এসে অতিথি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় জুটল দোকানের বাইরে, ভেতরে তখন বৌদি চায়ের জল চড়িয়েছে, খোকনদার বৌ বা বৌমা কে হন কে জানে। সুমিতের এক কুকুরের জন্যে কেনা বিস্কিট, শেষে যা হোক অন্য কুকুরেরা খেলো। যার নামে যেখানে যা লেখা থাকে, “দানে দানে পর লিখা হ্যায় খানেওয়ালা কা নাম”।
    নদীতে জল তেমন নেই, সেতুর নীচে সবুজ ঘাসের চড়া, জল সব লকগেটের ওদিকে। নদী এমন শুখো, ওদিকে হাটের পাশের খাল দেখলাম ভরভরন্ত, বানভাসির হাল।
    চা খেয়ে আমরা রাস্তা থেকে কিছুটা নীচুতে নদীর পাড়ে নামলাম, ঘোরাঘুরি হল খানিক। মিঠু সুমিতকে তাল খেজুরের গাছ চেনাতে গিয়ে হতাশ হল, দেখা গেল সুমিত ওগুলো ঠিকঠাকই চেনে!

    আমাদের পরবর্তী ও শেষ গন্তব্য শনিবারের হাট। এবার রাস্তা বাতলাতে অগ্রণী ভূমিকা মিঠু নিল।খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার আর নেই, তাই বোধহয় সুমিত কিছুটা দমে পিছন সীট নেওয়ার উপক্রম। ব্যাপার দেখে আমরা দুই মহিলা চোখ চাওয়াচায়ি করে নিলাম।ওসব আমাদের ঘরে বাইরে কম দেখা নেই, দোকানপাট দেখলেই জুজু এমন মানুষদের নিয়ে চলতে হয়, নতুন নয়।
    কিন্তু আজ অন্তত এক যাত্রায় পৃথক ফল মোটেই হতে দেবনা, আমাদের সঙ্গে সুমিতকে হাটেই ঘুরতে হবে, কেনাকাটি দেখাদেখি দরাদরি আমরা যা করব তাতেই থাকতে হবে।

    সুমিত অবশ্য আমাদের আশংকাকে নেহাত আজগুবি সাব্যস্ত করে দিয়ে কোনো ওজর আপত্তি ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরেছে, উৎসাহ দিয়েছে, মাঝে নিজের বন্ধুবান্ধবদেরও দেখা পেয়ে, গল্প করেছে।
    সে অর্থে হাটে মনে হয় তার সময় খারাপ কিছু কাটেনি।
    এমনিতে শনিবারের শহুরে ভিড় ছিল বেজায়, আর সারাদিনের খটখটে রোদ্দুরের কারণে ভ্যাপসা গরম চারধারে।দু জায়গায় কলসী মাথায় নাচ হচ্ছিল, কোনো কোনো ট্যুরিস্টের দল থেকে এক দুই করে মহিলা পুরুষ নাচের দলে ঢুকে তালে তালে পা মেলানোর চেষ্টা করছিল, ফিল্মী ও ফেসবুকীয় ব্যাপারস্যাপার আর কী! এক জায়গায় বাউল গান চলছিল, কেউ শুনছিলনা, নাচ আর ছবি তোলাতেই উৎসাহ সবার বেশী।
    সব মিলে এমনি ভালো লাগলেও এত বেশী শহরের খরিদ্দার জড় হওয়ায় হাটের স্বাভাবিক ভাব মিলিয়ে গিয়ে কোথায় যেন কিঞ্চিত কৃত্রিমতার আভাস।আমার এটা বিশেষ করে লাগল কারণ আমি কর্মসূত্রে ও জন্মসূত্রে এরকম বিখ্যাত না হলেও গ্রামের হাট দেখেছি বাংলা ও বাংলার বাইরে দুইই।

    আমরা টুকটাক কেনাকাটা করি ঘুরে দেখতে দেখতে। নানারকমের গয়না কাপড় কাঁথাকাজ, ডোকরার কাজ শোলার কাজ, ছবি, পশরায় বৈচিত্র ভরপুর।দাম শহরের হিসেবে বেশ কম লাগলেও দেখেশুনে কিনে ওঠা গেলনা তেমন করে, কারণ কেনবার পরিকল্পনা ছিলনা।আমি শুধু গয়না কিনবই স্থির করে গেছিলাম একরকম কিন্তু ওখানে অত কিছু দেখে কেমন একটু মানানসই হওয়ার ব্যাপারে ধন্দে পড়ে আর কেনা হলনা।
    মিঠু একটি বিশালাকৃতি নেকপিস পছন্দ করেছিল এবং সেটি পরল যখন ছবি তুলে দেখালাম যে বেশ মানিয়েছে কিন্তু শেষমেশ সেটিও নেওয়া হলনা কারণ লকেটের মুখটির নাক ভোঁতা বেরোলো!

    হাটের নানারকমের খানাপিনার মাঝে বিশেষভাবে কতবেল মাখা আর কামরাঙা খাবার লোভ আমরা দুজন কোনোমতে সামলেছি। সুমিত আমাদের উৎসাহ দিতে চেষ্টা করেছিল এই বলে যে বোলপুরের হাসপাতালে তার ভালো চেনাজানা আছে, আমরা যেন খাওয়া পরবর্তী ফলাফলের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা না করি। সে কথা শোনার পর আরো আমরা জোর করে কতবেল কামরাঙার অগণিত ঠ্যালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছিলাম পুরো সময়টা।

    ভালো মন্দ, দুনিয়ার সবকিছুরই শেষ আসে, তবে আমার মতে ভালো জিনিসের তাড়াতাড়ি শেষ না হওয়াই ভালো। ফেরার পথে আমাদের কাটানো দিনের সুন্দর মুহূর্তগুলোর মত সারাদিন ধরে সঙ্গে থাকা লাল সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেল গাড়ি হাইওয়েতে ওঠার আগেই।

    আবার শক্তিগড়। এবারে খাওয়াদাওয়ার কোনো সিন ছিলনা, শুধু চা খাব আমরা। রাস্তার এপারের ভবন ভুবনের মাঝে ফিরতি পথে দেখা গেল সুমিতের তেমন কোনো বিশেষ পছন্দ কিছু নেই। আমাদের কথার সুর ধরে তাই শ্যামল জানালো যে বালাজী নামের দোকান তার চেনা, পরিচ্ছন্ন, আমরা বললে সে সেখানে থামাবে। তাই সই, একটু নেমে হাত পা ছড়িয়ে নেওয়া আর শ্যামলকে চা খাইয়ে চাঙ্গা করে রাখাই মূল উদ্দেশ্য, সে গাড়ি চালাবে অন্ধকারে হাইওয়েতে। সন্ধ্যে রাত্তিরের হাইওয়ে ট্র্যাফিক সক্রিয় হয়ে উঠেছে, বড় বড় ট্রাক, তার আবার অনেকের বিপার কারুর বা টেইললাইট গায়েব, কান্ডকারখানা দেখে মিঠুর সকালের কাঁপুনি ফিরে এসেছে। আমরা আবার যথারীতি, সেই কুকুরের মালিকের মত “কিছু করবেনা কিছু হবেনা, দেখতে অমন ভারী, কামড়ায় না মোটে” এইসব সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে তাকে অভয় দিচ্ছি, দেশের ট্রাক ওরকম লাইট টাইট ছাড়াই অন্ধকারেও ঠিক দেখতে পায়, আমরা অমন কত যাতায়াত করি, কিচ্ছুটি হয়নি কোনোদিন, ইত্যাদি প্রভৃতি!

    চা কফি খেয়ে, জোয়ানের প্যাকেট কিনে, আমরা আবার গাড়িতে উঠি এবং মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে যাই কলকাতায়।আর একটু আগে ঢুকলে তিনজনের হাল্কা করে কলেজ স্ট্রীটে একবার ঢুঁ দেওয়ার কথা ছিল, সে আর হলনা।
    এক একটা দিন হয় যখন মনে হয় হায় কখন শেষ হবে, আবার জীবনে এমনও দিন আসে যা শেষ হয়েও হয়না। আমাদের তিনজনের শান্তিনিকেতন যাত্রা ছিল এমন একটা দিন, তার পর থেকে প্রতিটা দিনেই এখন পাই ওই একটি দিনের রেশ।
    আমাদের কথায়, চ্যাটে, ছবি চালাচালিতে বার বার ভেসে ওঠে অনাবিল আনন্দের মুহূর্তগুলি, কোপাইয়ের ধার, সোনাঝুরির হাট, বরিশালের রান্নাঘরের খাবার ঘর, খোকনদার চায়ের দোকানের বেঞ্চি, বাউলগান, সুমিতের কুকুরের পিছনে দৌড়, রাস্তার মাঝখানে ছাগল দেখে মিঠুর চোখ বুজে ফেলা, আমার গরু তাড়ানো! আমাদের সব কথাই এখন একটি কথায় গিয়ে শেষ হয়, আবার হবে, পরেরবার আবার হবে, এমনটা হবেই, হতেই হবে।
  • b | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৮:৪৯510213
  • খুব ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন