এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা : ভিন

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ | ১১৭৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ ২০:১১509036
  • কুলদা রায়
    এমএমআর জালাল

    লিও কুপার জেনোসাইড নামে একটি বই লিখেছেন। বাংলা অর্থ গণহত্যা। বইটির প্রচ্ছদ করা হয়েছে কিছু সংখ্যা দিয়ে। লেখা হয়েছে—১৯১৫ : ৮০০,০০০ আর্মেনিয়ান। ১৯৩৩-৪৫ : ৬০ লক্ষ ইহুদী। ১৯৭১ : ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী। ১৯৭২-৭৫ : ১০০,০০০ হুটু। নিচে লাল কালিতে বড় করে লেখা জেনোসাইড। এই অংকের মানুষ গণহত্যার শিকার। এই আট লক্ষ, ৬০ লক্ষ, ৩০ লক্ষ, এক লক্ষ সংখ্যাগুলো এক একটি প্রতীক। গণহত্যার প্রতীক। ক্যালক্যালেটর টিপে টিপে হুবহু মিলিয়ে দেয়া পূর্ণ সংখ্যার হিসেব এখানে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে পরিকল্পিত গণহত্যার মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাসের প্রতীক।

    কুপার বিশ্ববিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ। তার জেনোসাইড বইটিও সাড়া জাগানো দলিল। এখানে পাওয়া যাচ্ছে ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসে ৩০ লক্ষ মানুষকে গণহত্যা করা হয়েছিল। এটি কাল্পনিক কাহিনী নয়। সত্যি ঘটনা। এখনো বিভিন্ন বিদেশী সংবাদপত্রে-ম্যাগাজিনে তার প্রকাশিত প্রমাণ রয়েছে।

    ১৯৭১ সালে জুন মাসে লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার কোলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। তাঁরা দুজনে একটি গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন শরণার্থীদের চিত্র। কখনো তাঁরা গিয়েছেন সীমান্ত এলাকায়। কখনো কোলকাতায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। সে সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর বুলেটে-বেয়নেটে গণহত্যা, ধর্ষণ আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা। যাঁরা বেঁচে গেছেন—তাঁরা প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। একজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক জন সার। শরনার্থীটি বলেছেন, পাক বাহিনীরা আমাদের গ্রামকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যখন আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি, পালাতে চেষ্টা করেছি—তারা তখন মেশিন গানের গুলি ছুড়েছে। আমাদের স্বজনদের মেরে ফেলেছে।

    সেই সময় একজন ক্রন্দনরত মহিলার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জন সার। মহিলাটি শরণার্থীদের দলের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে এসেছে। মহিলাটি বলেছে, তারা আমাদের পিছনে তাড়া করেছে। আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। আমার কাঁধের উপরে ছিল আমার শিশু সন্তান। লাঠির আঘাতে শিশুটির মাথা গুড়িয়ে গেছে। তার রক্ত আছে আমার গায়ে। সে নেই। তখুনি মারা গেছে।
    লাইফ ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮ জুন ১৯৭১ সাল। লাইফ ম্যাগাজিনের এই প্রতিবেদনটিতে পাকবাহিনীর সরাসরি গুলিতে গণহত্যার কাহিনীটি সাংবাদিক জন সার বলছেন না। বলছেন ভীন্ন একটা কাহিনি। সেটাও হত্যাকাণ্ডের। সেই হত্যাকাণ্ড আরও ভয়ঙ্কর গণহত্যা।

    ভিন্ন গণহত্যার সন্ধানে :
    সময়টা জুন মাসের মাঝামাঝি। জন সার গিয়েছেন করিমপুরে। বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবক্তা চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের এই গ্রামটি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। এখানে রাস্তা দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার শিকার হয়ে এরা হারিয়েছেন এদের স্বজন, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ। ধারাবাহিক মৃত্যুর তাড়া খেয়ে এইসব ভর্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে জন্য ভারতে ছুটে আসছে। সরাসরি গুলির হাত থেকে ঈশ্বরের দয় এরা বেঁচে এসেছে। কিন্তু নতুন করে পড়েছে নতুন নতুন মৃত্যুর ফাঁদে। এদের পিছনে মৃত্যু। সামনে মৃত্যু। বায়ে মৃত্যু। ডানে মৃত্যু। সর্বত্রই মৃত্যুর ভয়ঙ্কর থাবা এদের তাড়া করে ফিরছে।

    সাংবাদিক জন সার করিমপুরের রাস্তায় দেখতে পেলেন অসীম দৈর্ঘের লম্বা শরণার্থী মানুষের মিছিল। তাদের কারো কারো মুখে রুমাল গোজা। একটা লোকের কাছে তিনি গেলেন। কোনোভাবে রুমালটি মুখ থেকে সরিয়ে লোকটি শুধু বলতে পারলেন, কলেরা। কলেরা। আর কিছু বলার নেই। পিছনে পাক সেনাদের গুলি। আর সঙ্গে কলেরা। সামনে অন্ধকার। কোথায় চলেছে তারা—কেউ জানে না। মৃত্যুকে সঙ্গী করে তবু তারা এগিয়ে চলেছে।

    করিমপুরের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে কোলকাতা বরাবর, তার বামদিকে শরণার্থী শিবির। এখানে আশ্রয় নিয়েছে ১৫০০০ মানুষ। এই শরণার্থী শিবিরে কলেরা নির্মমভাবে হানা দিয়েছে। ৭০০ জন ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে। বাকীরা শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পালাবে কোথায়? কলেরাও তাদের সঙ্গে চলেছে। খোলা জায়গায় পড়ে আছে মরা মানুষ।

    জন সার দেখতে পাচ্ছেন-- ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে এসেছে। তীক্‌ষ্‌ঞ ঠোঁট দিয়ে ছিড়ে খুড়ে খাচ্ছে মরা মানুষের দেহ। তাদের চোখ চক চক করছে। কিন্তু মৃত মানুষের সংখ্যা এত বেশী যে শকুনের খেয়ে শেষ করতে পারছে না। শকুনদেরও খাওয়ায় অরুচি এসে গেছে। মরা মানুষের গা থেকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে জামা কাপড়। তাদের অনেকের তখনো গা গরম। সবেমাত্র মরেছে। পথে ঘাটে নালা নর্দমায়—সর্বত্রই কলেরায় মরা মানুষ পড়ে আছে। জন সার দেখতে পেয়েছেন একটি শিশুর মৃতদেহ। শিশুটির গায়ে একটি শাড়ির অংশ পেঁচানো। তাঁর হতভাগী মা পেঁচিয়ে পুটুলি বানিয়েছে। ট্রাকের চলার সময় অসুস্থ শিশুটি মারা গেছে। চলন্ত ট্রাক থামেনি। মৃত ছেলের জন্য ট্রাক থামানো কোনো মানেই হয় না। আরও অনেক মৃতপ্রায় মানুষ এই ট্রাকেই ধুঁকছে। আগে পৌঁছাতে পারলে হয়তো কোনো হাসপাতাল পাওয়া যেতে পারে। তাদের সুযোগ মিলতে পারে চিকিৎসার। বেঁচেও যেতে পারে। এই আশায় সময় নষ্ট করতে কেউ চায় না। শিশুটির পুটুলী করা মৃতদেহটিকে ট্রাক থেকে রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে ছুড়ে ফেলা দেওয়া হয়েছে।

    একটি ওয়ান ডেকার বাসের ছবি তুলেছে জন সারের সঙ্গী ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। বাসটির হাতল ধরে ঝুলছে কয়েকজন হতভাগ্য লোক। আর ছাঁদে বসে আছে--সব মিলিয়ে জনা সত্তর জন। কেউ কেউ বমি করছে। কারো কারো মুখে রুমাল চাপা। কেউ কেউ রুমালের অভাবে হাতচাপা দিয়েছে। ছাঁদের মানুষের বমি জানালা দিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর বাসের মধ্যের বমি জানালা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়ছে। পথে। ঘাটে। মাঠে। খালে। জলাশয়ে। হাটন্ত মানুষের গায়ে। বমির সঙ্গে জীবনবিনাশী কলেরার জীবাণু। এইসব হতভাগ্য মানুষের চোখ গর্তের মধ্যে ঢোকানো। আর তার মধ্যে জ্বল জ্বল আতঙ্ক। বাসভর্তি করে কলেরা চলেছে। বাইরে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ ।

    ‘এই সব মানুষ এত বেশী সংখ্যায় মরেছে যে আমরা গুণতে পারিনি। গোণা সম্ভব নয়।‘ একজন স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক জন সারকে বলছেন, এরা জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা চলছে তো চলছেই। তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত—অবসন্ন। তৃষ্ণার্ত হয়ে পথের পাশ থেকে আঁজলা ভরে কলেরাদুষ্ট পানি পান করছে। তারা এত দুর্বল হয়ে পড়ছে যে, আক্রান্ত হওয়ার পর একদিনও টিকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়ছে।

    ১৯৭১ সালে জুন মাসের মাঝামাঝি তখন। সবে বর্ষা শুরু হয়েছে। একটানা চলবে সেপ্টেম্বরের মাঝামঝি পর্যন্ত। তারপর ঢিমেতালে বৃষ্টি হতে পারে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। জুন মাসের প্রথম বর্ষার মাঠগুলো সবুজ। সাংবাদিক জন সার শরণার্থীদের চলার পথে চলতে চলতে দেখতে পাচ্ছেন-- খালনালায় শাপলা ফুটে আছে। এই শান্ত সৌন্দর্যের আড়ালে ভবহ মৃত্যুর খেলা চলছে--ঘটে চলেছে অসহনীয় মানবিক বিপর্যয়। তিনি চোখে দেখে প্রতিবেদনটি লিখছেন।

    তিনি লিখেছেন, কাঁটাখালি গ্রামে রাস্তার পাশ থেকে হৈঁচৈ করে একটি ট্রাক থামাতে চেষ্টা করছে একদল শরণার্থী। তারা করুণ স্বরে আবেদন করছে ট্রাকচালককে তাদেরকে ট্রাকে তুলে নিতে। তাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারা রাস্তার পাশে মাটির উপরে শুয়ে আছে। তাদের পরিবার পরিবার অসহায় হয়ে চেয়ে। তাদের হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই। যাদের সঙ্গে কিছু টাকা পয়সা আছে তারা কোনোমতে ট্রাকে উঠে পড়েছে। ট্রাকে করে তারা কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে যেতে পারবে। সেখানে চিকিৎসা পাওয়ার চেষ্টা করবে।

    করিমপুরের আশেপাশে গ্রামগুলোতে কোনো ডাক্তার নেই। কলেরা ভ্যাক্সিন নেই। নেই কোনো প্রতিষেধক অষুদপত্র। কাছাকাছি কৃষ্ণনগরে একটি হাসপাতাল আছে। হাসপাতালের উদ্দেশ্যে অসুস্থ মানুষ চলেছে মানুষের কাঁধে চড়ে। ঝোড়ায় করে। কেউবা বা বাঁশের তৈরি টেম্পোরারী স্টেচারে করে। গরুর গাড়িতে। কেউবা রিকশায়।

    কৃষ্ণ নগর হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। যারা হাসপাতালে এর মধ্যে এসে পড়েছে—তখনো বেঁচে আছে, তাদের রাখা হয়েছে বাইরে খোলা মাঠে। যাদের চিকিৎসা শুরু হয়েছে তাদের রাখা হয়েছে অস্থায়ী ছাউনিতে। বাঁশের কাঠামোতে কাপড় বসিয়ে ছোটো ছোটো শিবির করে চাউনি তৈরি হয়েছে। সেখানে কিছু কিছু মানুষ বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাঁদের চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। অর্ধচেতন বা অচেতন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়ে আছে। তাদের মুখে মাছি পড়ছে। মশা ঘুরছে। অনন্তবিদারী দুর্গন্ধ। স্বজনদের কেউ কেউ হাত দিয়ে, তালে পাখা দিয়ে বা কাপড়ের আঁচল দিয়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করছে। সাদা এপ্রোন পরা নার্সরা তাদের শিরায় ঢোকানোর চেষ্টা করছে সেলাইন। তাদের চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু নার্সের বা ডাক্তারের সংখ্যা হাতে গোণা। অপ্রতুল।

    এই হতভাগ্যদের অর্ধেকই শিশু। সাংবাদিক জন সার একটি সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। তার চোখ বড় করে খোলা। তার হাত ঝুলে পড়েছে। নার্স এক পলক দেখেই বলছে, সব শেষ। কিছু করার নেই। মেয়েটি মরে গেছে। একজন ক্লান্ত ডাক্তার বলছেন, এর চেয়ে কুকুর-বেড়ালেরাও ভালো করে মরে। কিছুটা হলেও তারা চেষ্টা তদ্বির পায়। আর এই শরণার্থী মানুষদের কলে পড়া ইঁদুরের মত মরা ছাড়া কপালে আর কিছু লেখা নেই।

    এইসব মানুষেরা কেউ কেউ এসেছে ৩০০ মাইল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে—দু:স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে এসেছে খালি পায়ে হেঁটে-- পাক বাহিনীর তাড়া খেয়ে। পুষ্টিকর সামান্য খাবারও অনেকের সঙ্গে নেই। বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। তাদের পায়ে গায়ে কাদা, ময়লা, আবর্জনা তাদের সারা গায়ে কিলবিল করছে। এই লক্ষ কোটি শরণার্থীর পদভারে পথঘাট কাদাময়। একদা ভক্তির রসে ঢুবে যাওয়া গৌরাঙ্গের কৃষ্ণনগর এক আতঙ্কের মৃতের শহর হয়ে উঠেছে।

    পূর্ব পাকিস্তানে সঙ্গে ভারতের ১৩৫০ মাইল সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এই সীমান্ত পার হয়ে যারা আসছে তারা কলেরা, টাইফয়েড, পোলিও, চর্মরোগ ও মানসিক রোগে আক্রান্ত। জুনের মাঝামাঝি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় অর্ধকোটি শরণার্থী এসেছে। এদের মধ্যে কোলকাতার আশেপাশে রয়েছে ১৫ লক্ষ। আর ৩০ লক্ষ রয়েছে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জুনের পরে এই শরণার্থীর সংখ্যা পৌঁছে গেছে এক কোটিতে।

    এই শরণার্থীদের জন্তুর মত তাড়া খাওয়া দু:খের কাহিনীটা কি? জন সার লিখেছেন, সোজা কথায় পাক বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের স্বজনকে মেরে জীবিতদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। একটি গোটা জাতিকে নিশ্চহ্‌ণ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দুজন বুড়োবুড়ির সঙ্গে দেখা হয়েছে এই সাংবাদিকের। এদের স্বাভাবিক চলার ক্ষমতা নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। বুড়ো মানুষটির সঙ্গিনী বুড়ি ব্যবহার করছে ১৫ ইঞ্চি লাঠি। একদম কুঁজো হয়ে চলছে। সোজা হয়ে দাঁড়াবার শক্তি নেই। তারা এক সঙ্গে চলছেন। কিন্তু তারা কেউ কারো নয়। দুজনই দুজনের কাছে অচেনা। তারা জানে না তাদের পরিবার পরিজন কোথায়। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে। সামনে গেছে না পিছনে আছে—কিছুই জানে না। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি হাঁটছেন। মাঝে মাঝে বসছেন। আবার হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে ভিক্ষেও করছেন। সঙ্গে কোনো খাবার নেই। খাবার বহন করার শক্তিও তাদের নেই। জন সার দুদিন পরে আবার দেখতে পেলেন বুড়োটিকে রাতের অন্ধকারে। সঙ্গে বুড়িটি নেই। টর্চের আলো ফেলে কাছে এসে বুঝতে পারলেন, না—ইনি সেই বুড়ো নন। আরেকজন। অন্য আরেকজন বুড়ো লোক। আগের বুড়োবুড়ি কোথায় গেল?

    এইসব মানুষদের দেখে, তাদের মুখ থেকে শুনে লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার ভয়ঙ্কর একটি চিত্র পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি লিখেছেন—পাক বাহিনী শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। এরপরে তারা সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। মেরে ফেলে দেওয়ার পরেও যারা বেঁচে ছিল—তাদেরকে এবং পরে প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারগুলোকে আক্রমণ করেছে। তাদের ঘরবাড়ি ছাড়া করেছে। তাদের তাড়া করেছে এমনভাবে যাতে তারা সীমান্ত পার হয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সীমান্ত পার হওয়ার সময় পাক বাহিনী তাদেরকে পেছন থেকে আক্রমণ করেছে। তাদেরকে পরিজনপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে টাকা পয়সা, কাপড়চোপড়। সঙ্গে থাকা সোনা দানা লুটে নিয়েছে। ছুটন্ত মহিলাদের গা থেকে খুলে নিয়েছে পরণের কাপড়। মেয়েদের নির্বিচারে ধর্ষণ করছে। শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে জন সার দেখেছেন—সেখানে সংখ্যাআনুপাতে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশ কম। এইসব মেয়েরা কোথায় গেল? এর উত্তরে শরণার্থীরা অভিযোগ করেছে—তাদের মেয়েদের কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী আর তাদের দোসররা। এদেরকে বন্দী করে রেখেছে। ধর্ষণ করছে।

    বৃষ্টির সন্ত্রাস
    বর্ষা শুরু হওয়ায় বৃষ্টির সন্ত্রাস শরণার্থী শিবিরের লোকজনকে আক্রমণ করেছে। কোলকাতা থেকে ৩০ মাইল দূরের এক খোলা মাঠে বিশ হাজার লোক অবস্থান করছিল। সে জায়গাটির নাম কল্যাণী। এটা একটি নতুন শরণার্থী শিবির। শুরুতে মাঠটি ছিল শুকনো। জন সার লিখেছেন, বর্ষা আসন্ন। মাথার উপরে মেঘ জমছে। ধুসর থেকে কালো হয়ে উঠেছে আকাশ। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি ঠেকাতে এইসব ছিন্নমূল মানুষের মাথায় শুধু পাতলা হোগলার চাটাই ছাড়া আর কিছু নেই। কিছু কিছু আচ্ছাদন থাকলেও তার সংখ্যা খুবই কম। যখন দক্ষিণপশ্চিম দিক থেকে বাতাস ধেয়ে এলো—বাতাসের সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লো গুলির মত বৃষ্টি মাঠের উপর দিয়ে, তখন বৃষ্টি বিদ্ধ করতে শুরু করে এইসব মানুষদেরই। তারা ভিজে একসারা। দিনে ভিজছে। রাতেও ভিজছে। সকালে ভিজছে। সন্ধ্যায়ও ভিজছে। মাথার উপরের হোগলার চাটাই গলে গেছে। উড়ে গেছে ছাতি। আর ফুটো হয়ে গেছে ছোটো ছোটো তাবুর মত চালগুলো।

    এই বৃষ্টি কোনো বিলাস নয়, মৃত্যুরই অন্য নাম। বৃষ্টি কল্যাণীর মত শরণার্থী শিবিরের মাটি কর্দমাক্ত করে দিয়েছে। ছোটো ছোটো খুপরির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বৃষ্টির হাত থেকে অসহায় মানুষগুলো বাঁচার চেষ্টা করেছে। মাঝে মাঝে বজ্রপাত হয়েছে। ঝড়ো হাওয়া এসেছে। চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে। শিশুদের অধিকাংশেরই ছিল খালি গা। বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রাও নিচে নেমে এসেছিল। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তারা সর্দি কাশি নিউমেনিয়ায় ভুগেছে—সারা ঘ্যান ঘ্যান করছে। যখন বন্যার জল এলো-- তখন সঙ্গে এসেছে বিষধর সাপ। তারা বসত গেড়েছে শরনার্থীদের মধ্যে।

    কল্যাণি পাঁচ নম্বরে কিছু শরনার্থী বাঁশের খুটিঁর উপরে কাপড় টানিয়ে ছাতার মতো তৈরি করে থেকেছে। এটা ছিল একটা স্থায়ী শিবির। তাদের কোনো খাবার ছিল না। বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে তিনচারদিন এদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে।

    এই মধ্য জুন মাস পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ছিল ঢিলেঢালা। তারা বাঙ্গালী শরণার্থীদের মনে করেছে আপদ। শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে পর্যাপ্ত সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগ ছিল অপ্রতুল। আবার অনেক শরনার্থীর কাগজপত্রাদিও ছিল না। তাদের জন্য রেশন কার্ড ছিল না। ফলে তারা চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। অষুদপত্রাদি পায়নি। না খেয়ে, রোগে ভুগে অনাহারে মরেছে। অনেকে পাগল হয়ে গেছে। অনেকে আত্মহত্যা করেছে। বাসের নিচে—রেললাইনে মাথা পেতেছে। অনেকে চিরতরে জন্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছে। এরা ভুলে গেছে এরা কি ছিল। কোথা থেকে এসেছে। কোথায় যাবে। তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল মৃত্যু। মৃত্যু ছাড়া এদের আর কিছু চাওয়ার নেই এই পৃথিবীর কাছে—সভ্যতার কাছে—মানবতার কাছে—জীবনের কাছে। এই মৃত্যু কি? এইসব মৃত্যু কি হত্যাকাণ্ড নয়? পাকবাহিনীর বিনা গুলিতে পরিকল্পিত গণহত্যা নয়?

    এই প্রশ্নের উত্তর কি?
    ১৯৪৮ সনের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এ-র অধীনে সংজ্ঞাঅনুসারে অনুযায়ী গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এই গণহত্যা বলতে বুঝায় এমন কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাঙ্কিÄকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রস নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে।

    সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ২৬০ (৩) এ-র অনুচ্ছেদ-২ এর অধীনে যে কর্মকাণ্ডকে আইনগতভাবে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা হল-

    (ক) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ।
    (খ) তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন।
    (গ) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধনকল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
    (ঘ) এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন ধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নয়, সেই সাথে তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেয়া হয়।
    (ঙ) একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্মপরিচয় ও জাতিগত পরিচয়কে মুছে ফেলাকেও গণহত্যা বলা হয়।

    তাহলে? যারা বলছেন, বলার চেষ্টা করছেন—পাকবাহিনী গণহত্যা করেনি, পাকবাহিনী তিরিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেনি—পাকবাহিনীর হত্যা করার সংখ্যা খুবই কম, তারা—তারা কি বলবেন এই গুলিবিহীন লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাকে? গণহত্যার হিসাবের মধ্যে এই সংখ্যা কি যোগ হবে না? কত—পঞ্চাশ হাজার, এক লক্ষ, দুই লক্ষ, দশ লক্ষ... বিশ লক্ষ... তিরিশ লক্ষ....

    ছবির সূত্র :
    . লাইফ, ১৮ জুন, ১৯৭১।
    . ডন ম্যাককুলিন, ইনডিয়া।
    . ব্লিডিং বাংলাদেশ : সাগর পাবলিশার্স, কোলকাতা।
    . জেনোসাইড : লিও কুপার
  • Biplab Pal | 63.118.***.*** | ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ ০০:১৫509037
  • আমার বাড়ি করিমপুরে। বাবা মা এখনো ওখানেই থাকেন। তিন বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে করিমপুরে এসেছিলাম-মা করিমপুরের হাইস্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষকতা নিয়ে চলে আসেন তখন। এখনো বছর কালে একবার যায়। ওখানেই আমার শৈশব এবং মাধ্যমিক।

    করিমপুরে একাত্তর নিয়ে প্রচুর গল্প শুনেছি। ঐ সময় ওটা ছিল নগণ্য একটা ছোট জনপদ। নাটনার কাছে একাত্তরের যুদ্ধে ট্যাঙ্ক নিয়ে যাওয়ার জন্যে মাত্র ২৪ ঘন্টায় একটা সেতু বানানো হয়-যে সেতু আজো আছে। পাটাবুকো বলে শহরের একদম বাইরে খরে নদীর ধারে অনেক শরণার্থী ছিল। যাদের অনেকেই ফিরে যায় নি। ঐ এলাকাতে মূলত ৭১ এর সময় উঠে আসা হিন্দু নম:শুদ্রদের বাস। আসলে বর্নহিন্দু নম: সবাই ছিল শিবিরে। যুদ্ধের পরে যাদের বাংলাদেশে জায়গা জমি আছে, তারায় ফিরেছিল। সর্বহারারা রা আর ফেরে নি।

    করিমপুর থেকে শিকারপুর বর্ডার তিন মাইল না, ৭ মাইল। তখন করিমপুর ছিল দুর্গম। কৃষ্ণনগর থেকে একটাই সংকীর্ন রাস্তা-৮০ কিমি পথ। দিনে তিনটে বাস কৃষ্ণনগর পর্যন্ত। লাগত ৪ ঘন্টা। হাঁসপাতাল ছিল না তখন- হাঁসপাতাল করিমপুরে হয়েছে ১৯৮০ সাল নাগাদ। এখন অনেক বাস, রাস্তাও চওড়া-দেড় দু ঘন্টাতে পৌছানো যায় কৃষ্ণনগর। ঐ রাস্তার দুধারে ছিল প্রচুর শরনার্থী। ছিল করিমপুর-শিকারপুর রোডেও। এখনো এই রাস্তার ধার বাংলাদেশ থেকে আসা উদবাস্তুদের প্রথম পছন্দ!
  • Kallol Karmakar | 203.223.***.*** | ২৪ ডিসেম্বর ২০১১ ২২:৫১509038
  • পাকিস্তান অবজারভারের চোখে
    ১৬ ডিসেম্বর রক্তরেখা নয়, জলরেখা!

    বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা।

    তবে যুদ্ধের সময়ে নিজেদের আসন্ন পরাজয় মেনে নিতে পারছিল না পাকিস্তানিরা। বাঙালিদের বিজয় নিশ্চিত জেনে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশকে মেধাশূণ্য করতে এক ঘৃনিত নীল নকশা আঁটে। আর ঐ নীল নকশার অংশ হিসেবে ত্‌ৎকালীন প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখকদের তারা ধরে নিয়ে গিয়ে ঢাকার রায়েরবাজারে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে ১৪ ডিসেম্বর ।

    ফলে আমাদের কাছে যা এক সাগর রক্তের, তা পাকিস্তানিদের কাছে রক্ত নয় বরং পানি। আমাদের মুক্তিবাহিনী তাদের কাছে ‘মুক্তি বানি’ হয়ে যায়। পত্রিকায় যারা কাজ করেন তাদের কাছে টাইপো মানে মুদ্রণপ্রমোদ একটি পরিচিত শব্দ। কিন্তু যখনই একই মুদ্রণ ভুল বারবার ঘটে যায় তখন তা আর ভুলের পর্যায় থাকে না। হয়ে যায় উদ্দেশ্যমূলক লেখা। এছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর চেয়ে বড় হয়ে যায় স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহতদের সংখ্যা।

    গত ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘পাকিস্তান অবজারভার’এ ছাপা হয় ‘ডিসেম্বর ১৬: দ্য ওয়াটারশেড’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ। নিবন্ধটি লিখেছেন তারিক খলিল নামের একজন।
    তার ভাষায়:‘3rdweekofmarchAwamiLeaguewithsupportofsocalledMukhtiBanioperatedIndianRAW (consistedalsoWestBengalHindus) seizedthecontrolofallthecitiesacceptthecantonments...onthecollapseofnegotiationonMarch25th, pakistanarmywasorderedtorestorethewritofthegovernment.’

    কতটুকু অবজ্ঞা এবং অস্তিত্বের টানাপোড়েন থাকলে মুক্তি বাহিনীকে ‘মুক্তি বানি’ (MukhtiBani) বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, লেখক এখানে তাই করেছেন। যদি ধরা হয় এটা সম্পাদনাজনিত ভুল, তাহলে হয়তো একবার এই ভুল হওয়ার কথা। কিন্তু পুরো লেখায় যতবার মুক্তি বাহিনীর কথা আছে ততবারই এই ভুল লেখা আছে। আর এ থেকে স্পষ্টই প্রমাণ হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেও তারা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি নিজেদের হার। আর তাই যুদ্ধের ৪০ বছর পরও তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে পাকিস্তান যে এখনও তার সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে বের হতে পারেনি, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই লেখা। মুক্তিবাহিনী পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের দ্বারা সমর্থিত বলে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে তারা।

    এবার বোধকরি লেখকের পরিচয়টা দেওয়া জরুরি। তারিক খলিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন ব্রিগেডিয়ার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন আরও এক বিশ্ব মিথ্যাবাদী হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যের। ইনিই সেই কিসিঞ্জার যিনি যুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। একেই বলে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। আর তাই মাসতুতো ভাইয়ের জবানি দিয়েই তিনি তার নিবন্ধ শুরু করেছেন।

    তিনি আরও লিখেছেন, OntheeconomicfrontrightlyorwronglytheybelievedthatWestPakistaniseatingawaytheirshareofresources....। তার ভাষ্য মতে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে এমন একটা ভুল ধারণা বাঙালির মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, এক হাজার মাইল ডিঙিয়ে পূর্ব পাকিস্তান শাসন করা তাদের জন্য অনেক কষ্টকর। তাই যতটুকু সম্ভব শোষণ করা যায়, তা তারা করেছে। সকল ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তান থাকে শূণ্য। এদেশে পাটের অধিক ফলন হয় বলে অনিচ্ছা সত্বেও তারা নারায়াণগঞ্জে ‘আদমজী জুট মিল’ স্থাপন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর মালিকানা থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে।

    কর্মক্ষেত্রগুলোতেও বাঙালিদের চেয়ে বিহারী জনগোষ্ঠীর বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর প্রধান কারণ ছিল তারা ভালো উর্দু বলতে পারতো এবং নির্দেশ পালনে বেশ পারদর্শী ছিল। কর্মক্ষেত্রে সংখ্যালঘু বাঙালিদের ওপর সুযোগ পেলে ওরাও অত্যাচার করত। এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও বিহারী কর্মীদের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। হানাহানিতে অনেক বাঙালি আহত হলেও পাকিস্তান সরকার বিহারীদের কোনো শাস্তি দেয়নি।

    মিথ্যা আর অপপ্রচার চালাতে চালাতে তাদের অবস্থা এখনও এমনই যে তাদের মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন এবং তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছে, তা বেমালুম অস্বীকার করছে তারা। এই অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তার জবানিতেও উঠে এসেছে একই বক্তব্য। তার ভাষায়:‘theplaceswerefilledupwithslaughteredhumanbeingsbytheBengalitroopsandMuktiBanisupportedbyIndia...Manymassgraveslaterrecovered, wereofnonBengalipopulationkilledandburiedcollectively.’ মিথ্যা কথা আর কেমন হতে পারে তার উৎকৃষ্ট নমুনা। ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু তার কাছে কোনো অর্থই বহন করে না। যতটা তার কাছে অর্থবাহী মুক্তিকামী যোদ্ধাদের হাতে নিহত রাজাকার আর বিহারিদের ব্যাপারে।

    কুপার বিশ্ববিখ্যাত গণহত্যা বিশেষজ্ঞ। তার জেনোসাইড বইটিও সাড়া জাগানো দলিল। এখানে পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এটি কাল্পনিক কাহিনী নয়। সত্যি ঘটনা। এখনো বিভিন্ন বিদেশি সংবাদপত্রে-ম্যাগাজিনে তার প্রকাশিত প্রমাণ রয়েছে।

    ১৯৭১ সালে জুন মাসে লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি। তারা দু’জনে একটি গাড়িতে করে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন শরণার্থীদের চিত্র। কখনো তারা গিয়েছেন সীমান্ত এলাকায়। কখনো কলকাতায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায়। সে সময়ে পাকিস্তান বাহিনীর বুলেটে-বেয়নেটে গণহত্যা, ধর্ষণ আর নির্যাতনের শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। যারা বেঁচে গেছেন— তারা প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। একজন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক জন সার। ঐ শরণার্থী বলেছেন, পাক বাহিনীরা আমাদের গ্রাম তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। যখন আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, পালাতে চেষ্টা করি— তারা তখন মেশিন গানের গুলি ছোড়ে। তারা আমাদের স্বজনদের মেরে ফেলেছে।

    ১৯৪৮ সনের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন ২৬০ (৩) এ-র সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এই গণহত্যা বলতে বুঝায় এমন কর্মকাণ্ড, যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাঙ্কিÄক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রস নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে।

    কিন্তু প্রশ্ন জেগে ওঠে মনে। যুদ্ধের এতগুলো বছর পর পাকিস্তান শুধু কি ক্ষতের ব্যথা ভুলতেই এই অপপ্রচার চালাচ্ছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। ঠিক যখনি জাতিসংঘে গণহত্যার বিচার নিয়ে কথা উঠছে, যখনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের সহচর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে, তখনি চালানো হচ্ছে এই অপপ্রচার। নিজেদের দোসর, ভাইদের বাঁচাতে তাই এতো দূর থেকেও চলছে আরেক নীল নকশা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন