এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আমার বড়মামার কবিতা : গন্ধ বিধুর ধ

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ | ৫৪৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Nina | 12.149.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০১১ ২২:৫৭490917
  • এমন অদ্ভুত সুন্দর লেখা আমি আগে কক্ষণো পড়ি নাই--------
  • ranjan roy | 115.118.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০১১ ২৩:১৭490918
  • কুলদা,
    প্রতীক্ষা সার্থক; আরো আরো চাই!
  • I | 14.99.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০১১ ২৩:৩০490919
  • লেখা পড়ে জন্ম সার্থক। মায়াবী লেখা এইরকম হয়।
    ঘোড়া চড়ি কোথা যাও , হে রায়রায়াণ !
  • I | 14.99.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০১১ ২৩:৩৪490920
  • লেখা পড়ে জন্ম সার্থক। এই লেখার নাম চাঁদ-লাগা লেখা।

    ঘোড়া চড়ি কোথা যাও, হে রায়রায়াণ !
  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১১ ০০:০১490921
  • আমার এই মাসির নাম কুমুদিনী। আমার মায়েরা সাত বোন। কুমুদিনী মাসি পঞ্চম। নৌকা বেয়ে জল আনতে যেত বটবাড়ি। বিয়ে হয়েছিল বরইবাড়ি। সেটাও জলের গ্রাম। জলে জলে থাকত। ঝিনুক তুলে মুক্তো খুজে রাখত। মলিন মুক্তো। বাকি মাসিদের গল্প বলব ধীরে ধীরে।
    এখানে মেজোমামা বিষয়ে কিছু লিখেছি। আরেকটা পূর্ণ লেখা আছে-মেজোমামা বিষয়ে। সেটা এক সময় দেব।
  • i | 137.157.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০১১ ০৩:৫৯490922
  • শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে পড়ছে আবার। পরী কথা নাম শুনলে মনে তো পড়বেই।
  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০১১ ২১:২৪490923
  • সর্ষেদিদি
    কুলদা রায়

    একবার আমি মারা গিয়েছিলাম। দিব্যি দেখতে পেয়েছিলাম –নাকের ভিতর দিয়ে সরু সুতার মত বেরিয়ে আসছি। হাওয়ায় ভাসছি। ড্যাব ড্যাব করে বুঝতে পারছি—কে একজন রোগা পটকা শুয়ে আছে বিছানায়। চুলগুলো কপালের উপরে লেপ্টে আছে। লোকজন হায় হায় করছে। মা তখন রান্নাঘরে ডালে ফোঁড়ন দিচ্ছে। পারুল কাকীমা চেঁচিয়ে বলছেন, অ বিনাদিদি, আইসা দেখো। শিগগীর আইসো।

    বাবা দোকানে। ঠকুর্দা মারা গেছেন। তার আগে আমাদের পাগল ঠাম্মা। দাদা দিদি স্কুলে। পরের বোনটি চুপি চুপি আখ খাচ্ছে। ওর নাম অপর্ণা। খেতে খেতে একবার জিজ্ঞেস করল—ও দাদা, তুই কি মইরা গেছিস?
    মারা গেছি না বেঁচে গেছি ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে বেশ লাগছে। দুটো মানুষ হয়ে আছি। একজন দেহআমি। নড়ন চড়ন নট। আরেকজন ধেয়োআমি। হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছি। বেশ ফুর ফুরে। শরীরে কোনো কষ্ট নাই। ঠা ঠা গরমের দিন—কিন্তু গরম লাগছে না। শান্ত হাওয়া। ফুলের গন্ধ আসছে। জুঁই ফুল। পাড়ার সুধীর ডাক্তার ইনজেকশন রেডি করেই এলেন। দেহআমি র হাতটা একটু তুলে ধরে সুঁইটা ফোটাতে যাবেন। কী মনে করে—হাতটা রেখে রেখে দিলেন। শুক কাকাকে বললেন, অর বাবারে খবর দেও।

    শুক কাকা পাড়ার লোকদের খবর দিতে ছুটলেন। কাকীমার দিকে তাকিয়ে অপর্ণা বলল, দাদা কি সত্যি সত্যি মইরা গেছে? আর আখ খাবে না?
    পারুল কাকীমার এসব শোনার সময় নাই। তিনি ছুটলেন চন্দন বাটতে। আমার কপালে ফোঁটা দেবেন। আর চোখে দেবেন দুটো তুলসী পাতা। অপর্ণা খুব খুশী মনে আখ চিবুতে লাগল। রস গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর গাল বেয়ে। নরোত্তম খুড়ো বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাগানে শুকনো ডাল খুঁজতে গেলেন। বাবা ফেরার সময় ধুপ নিয়ে আসবে। মাইজারদি মায়ের কপালে তার অতি নরম হাতটি রাখল। বলল, বিনা, তুমি কাইন্দো না। ছাওয়ালডা তোমাগো দিন দিয়া গেছে। কী ভাগ্যি! কী ভাগ্যি!

    শ্রীধর কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। হুটহাট করে মরে যাওয়াটা ওর পছন্দ না। ক্ষেতে সবেমাত্র মটরশুটি ফলতে শুরু করেছে। গেল বছর দুজনে মটরশুটি পুড়িয়ে খেয়েছি। এবার একা একা যেতে হবে। রেগে মেগে বলল, হালার পো হালা। মরার সময় পাইলি না।
    পারুল কাকীমা বড়ো সড়ো দুটো তুলসী পাতা তুলে এনেছেন। পাতা দুটো দেহআমির চোখের উপর দিয়েই শ্রীকৃষ্ণের শতনাম পাঁচালী পড়তে শুরু করবেন।

    কাকীমা তুলসী পাতাদুটো যেই চোখের পাতার উপর দিতে যাবেন তখনি আমার মা ঝট করে মাইজারদির কোল থেকে উঠে এল । ছোঁ মেরে কাকীমার হাত থেকে পাতা দুটো কেড়ে নিল। বলল, খাড়াও, আমি আইতাছি।
    পারুল কাকীমা বিমূড় হয়ে থমকে গেছেন। মাইজারদি তাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ঝামটি মেরে বললেন, বিনা তার মরা ছাওয়ালের লাইগা পাগল হইছে। তুমি খাড়ায় রইছ ক্যান। নাম করো—ছাওয়ালডা একটু শান্তি পাক। কাকীমা মাথা নিচু করে শ্রীকৃষ্ণের শতনাম পড়তে শুরু করলেন সুর করে—

    জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর।
    কৃষ্ণচন্দ্র দ কর করুণা সাগর।অ।
    জয় রাধে গোবিন্দ গোপাল বনমালী।
    শ্রীরাধার প্রাণধন মুকুন্দ মুরারী।অ।

    ধান সিদ্ধ করার একটা বড় তাগারি ছিল। মা ওটাকে টেনে পেয়ারা গাছের নিচে নিয়ে এল। আর কল চেপে চেপে জল ভরল। ততক্ষণে বাবা এসে পড়েছে। কিছুটা দিশেহারা। কী করবে বুঝতে পারছে না। নরোত্তম খুড়ো বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ভাইডি চিন্তা কইরো না। কাঠের জোগাড় হইছে। সন্ধ্যার আগেই লৈয়া যামুআনে।
    এই ফাঁকে মা দেহআমিকে পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়েছে। মাইজারদি করখর করে বাবাকে বলছেন, অ শঙ্কর। তর বউ পাগল হইছে—তুই কি পাগল হইবি? বউরে সামলা। খাড়া হৈয়া দাঁড়া। হ্যাষে কি একটা অমোঙ্গল ডাইকা আনতি চাস? অনাছিষ্টি যত।

    মায়ের কোলে দেহআমি। খুব পলকা। হাত দুটো ল্যাতর প্যাতর হয়ে ঝুলছে।অআর পলকা হাওয়ায় ধেয়োআমি হাওয়ায় ভাসছি। দেহআমির সঙ্গে ধেয়োআমি একটি সরু সুতোর বন্ধনে জুঁতে আছি। খুব বেশি দূরে যেতে পারছি না। সুতো টেনে ধরে রাখছে দেহআমির কাছেপিঠে।অপুরো আটকাঠি ঘুড়ি। সুতোটি ঠিক নাকের সুড়ঙ্গ পথে ঢুকে গেছে। যে কোনো সময় ছিড়ে যেত পারে। ছিড়ে গেলে কী হবে? অ মা, ছিড়ে গেলে কী হবে গো মা?

    মা জলপূর্ণ তাগারিতে আমাকে বসিতে দিয়েছে। মাথা –হাত-পা-বুক বাইরে।অআর জলে ভাসছে নাইকুণ্ডলী। পেট। পা দুটো একটু মুদে গেছে দেখে বাবা সোজা করে দিল। দেখে আমার মায়ের চোখ থেকে দরদর করে জল পড়তে লাগল। ঠোঁট দুটো চেপে রেখেছে।

    কয়েকটি পিঁপড়ে আমার গা বেয়ে উঠেছিল। একটি বাবার হাতের নিচে চাপা পড়েছে। তাই দেখে বাবার হাতে কয়েকটি পিঁপড়ে কামড়ে দিচ্ছে। বাবা টের পাচ্ছে না। আমাকে ধরে স্তদ্ধ হয়ে আছে। রোদ মাথার উপরে। ঝিকিমিকি ছায়া নেমেছে। একটি দাঁড় কাক আমাদের রান্নাঘরের টালির উপরে চেয়ে আছে। ডাকতে ভুলে গেছে। বাবাকে পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে—তাতে আমার ভয় করছে। বলতে ইচ্ছে করছে—অ বাবা। বাবাগো। হাত সরাও। তোমারে বিষ পিঁপড়ে কামড়াচ্ছে। হাত সরাও না বাবা।

    বিষ পিঁপড়েগুলো বিরক্ত হয়ে আমাকে কামড়ে দিতে দাঁত বের করছে। এখনই কামড় দেবে। ওদের সরাতে পারছি না। কুট করে সত্যি সত্যি কামড় দিয়েছে। আর দাঁড় কাকটা কা কা করে ডাকতে ডাকতে পশ্চিমে উড়ে যাচ্ছে। মাইজারদি চেঁচিয়ে উঠছে—ধৈ ভগমান। ধৈ ভগমান। আর কাউরে নিও না। পিঁপড়ে কুট করে কামড় দিয়েছে। ব্যাথায় ভয়ে আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম। আরও কামড়ে দেবে। ওদের সরাতে হবে। সুড় সুড় করে সুতো বেয়ে ধোয়াআমি দেহআমির ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি। তারপর কঁকিয়ে উঠছি—আহ।

    বাবা চোখ ফেরাল। মা মা উঠোনের উপরে আছড়ে পড়ে পড়ল—ঠাকুর। ঠাকুর। পিঁপড়ে কামড়ে চলেছে কুট কুট করে। আর ছুট ছুট করে আমার ব্যাথা লাগছে।
    এরপর মনে নেই।অমন কোথায় উড়ে গেল। যেতে যেতে কানে এল—কে যেন গুণ গুণ করে গান করছে। অস্ফুট সুর। ভাঙা ভাঙা। কিছু বোঝা যায়—কিছু বোঝা যায়।

    তুমি মাগো লক্ষ্মীদেবী কমল বরণী।
    কমললতিকা কৃপা কর নারায়ণী।অ।
    সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান।
    আসিয়া মাগো কর ঘটেতে অধিষ্ঠান।অ।

    ধীরে ধীরে আমার চোখ খুলছে। দেখতে পাচ্ছি-মা ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। মাথার উপরে পেয়ারা গাছ। আলোঅন্ধকারের পাতা। ক্রমশ সবুজ হচ্ছে। এ সবুজ মধুময়।অসূর্য উঠেছে। এ সূর্য মধুময়। ঝিরঝিরে বাতাস আসছে। এ বাতাস মধুময়। মা একফোঁটা মধু আমার ঠোটের ভিতরে ঢেলে দিল। তখন স্পষ্ট গলায় শুনতে পেলাম—

    মনের মতো করব পূজা মা তোমার ঐ চরণে
    ফুলও দিব জোড়ায় জোড়ায় মা বসন যত লাগে
    মনের মতো করব পূজা মা তোমার ঐ চরণে
    মালা দিব জোড়ায় জোড়ায় মা বসন যত লাগে

    বুঝতে পারছি জলে আছি—জলে ভাসি। শীত নেই। গ্রীষ্ম নেই। সকাল নেই। দুপুর নেই। রাত্রি মাঝে মাঝে তারা হয়ে ফোঁটে। ফোঁটা তারাগুলো ঝপঝপ করে ঝরে পড়ে। সকাল হয়ে যায়। কাছে পিঠে মোরগ ডেকে ওঠে। আর শুনতে পাই—শুক সারির গান। শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদন মোহন। একটু ঘাড় উঁচু করে দেখতে পেলাম, একজন খুনখুনে বুড়ি পাশে বসে আছে পা ছড়িয়ে। চুল তার শনপাঠ। চুলের মত সাদা তার বসনভুষণ। দোক্তা বানাচ্ছে খুটুর খুটুর করে। আমাকে ঘাড় উঁচু করতে দেখে কিরি কিরি করে কাকে ডাকতে লেগেছে। একটা লাল মোরগ পাখনা ফুলিয়ে বুড়ির কাছে ছুটে এসেছে। বুড়ি কোঁচড় থেকে কয়েকটি দানা ছিটিয়ে দিচ্ছে। মোরগটি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
    দুটো পাখি পেয়ারা ডালে বসে ছিল। এরা হিটি হিটি করে ডেকে উঠল। বুড়ি গানের মত করে বলল, আয় না। খাবি যদি আয় না। খাবি যদি আয় না।

    পাখি দুটি উড়ে এসেছে। বুড়ি ওদের দিকে দানা ছুড়ে দিয়েছে। দানা খেতে যাবে এ সময় মোরগটি কুকরু-কুকরু কু করে তেড়ে এল। পাখি দুটো ভয়ে ভয়ে উড়ে গেল। বুড়ি হেসে হেসে বলতে লাগল—খাবি যদি ভয় না। খাবি যদি ভয় না। পাখি দুটি এদিক এদিক তাকিয়ে দেখছে। উঠোনে ভুলু কুকুরটি কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। অপর্ণা মোরগটিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মোরগটি খেতে পারছে না। বুড়ি হেচড়াই ঠাকুরের গান ধরেছে। কোনো এক হরি ঠাকুরকে বইন্যার ফুল দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে গাঁয়ের মেয়েরো, ও ঠাকুর—এই বইন্যার ফুল তোমার চাই? হরি ঠাকুর হ্যাচড়াই ঠাকুর—তার প্যাচড়াই চুল। চুল নেড়ে নেড়ে তার চ্যাতন হচ্ছে। মাথা নেড়ে বলছে-- হু। চলবে। তখন ছোট ছোট বালিকারা নাও বেয়ে ফুল তুলতে চলে যাচ্ছে। জলের ভেতরে বইন্যা গাছ। ফুল তুলে মালা গাঁথতে যাবে। এমন সময়ে উত্তরে বাও বাতাস এসে বইন্যা ফুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর বলছে—এখন? এখন কী হবে? মেয়েরা বলছে—ও ঠাকুর—তুমি চ্যাতন কর। উইঠা দাড়াও। বাও বাতাস থিকা ফুল ধইরা আনো। আমরা মালা গেঁথে তোমার গলায় পরাব। ঠাকুর নড়ে চড়ে উঠছে। আর বক ফুল ফুটছে ডালে।

    এই হেচড়া পূজার গান গাইতে গাইতে বুড়ি হাসতে হাসতে কুটি কুটি। মুখে আঁকিবকি বলি রেখা। চূল শনপাঠ। চোখ রূপকথা। মোরগটি ছুটতে ছুটতে বলছে—কুকরু কু—আর না। আর না অপর্ণা দিদি।

    মা রান্না ঘর থেকে বলছে—ও দুর্গা খুড়ি। তুমি কিছু খাইয়া ন্যাও। দুর্গা বুড়ির তখন হেচড়াই ঠাকুরে পেয়েছে। ঠাকুর জলে নেমে পড়েছে। সাঁতরে সাঁতরে চলেছে উত্তুরে হাওয়ার খোঁজে।অপাখিদুটো দানা খুঁটে খাচ্ছে। আর মোরগটি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছে—অ অপর্ণা দিদি। ছাইড়া দ্যাও। ছাইড়া দ্যাও। আর ত্যাক্ত কৈরো না। বিরক্ত লাগছে। রেগে বলছি—অপর্ণা!
    মা ছুটে এল। তার ডাল সম্বরার জন্য পাঁচ ফোঁড়ন ঝেড়ে নিচ্ছিল।অফোঁড়ন রেখে ছুটে এসে বলল, অ খোকাই। অ খোকাই।
    অপর্ণা থমকে গেছে। মোরগটি দুর্গাবুড়ির কোঁচড়ের তলায় লুকিয়েছে। পাখি দুটো সাদা বসনের কাঁধে বসেছে। মাঝে মাঝে একটা উড়ে উড়ে যাচ্ছে পেয়ারার ডালে। আরেকটা উড়ে এসে বসছে বুড়ির কাঁধে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আসছে। নরোত্তম খুড়োর খড়মের চটাং চটাং শোনা যাচ্ছে। তিনি স্বস্তি নিয়ে বলছেন—অ বৌমা, যাই গিয়া—তাইলে হাতীশুঁড়ের পাতা নিয়া আসি।

    শ্রীধর নারিকেল গাছে উঠেছিল। সড় সড় করে নেমে এসেছে। হাতে দুটো কচি ডাব। বুকের কাছে সামান্য আঁচড় লেগেছে। লাল হয়ে আছে। নরোত্তম খুড়ো ডাব আনলে কচি ডাব কেটে দেবে। হাতিশুঁড়ের পাতার রস ডাবের জলে মিশিয়ে খাইয়ে দেবে। শ্রীধর রেগে মেগে বলছে--হালার পো হালা। উইঠা খাড়া। ভিটকি মাইরা আছস ক্যান। মাঠে ল। মটরশুটি খাওনের সুমায় চইল্যা যায়—বোঝস না।

    দূর্গাবুড়ি হাসে। কয়েকটি মটরদানা আমার হাতে তুলে দেয়। হাতটা তিরতির করে নড়ে। পাখিদুটো হা হয়ে চেয়ে আছে। মুঠো থেকে দানা খাবে। বুড়ি বলছে—দানাগুলান দে না দাদা। ছুইড়া দে—পঙ্খিগুলান খাইয়া নোক।

    মুঠোর মধ্যে দানাগুলো ঘেমে উঠেছে। শ্রীধর গজগজ করতে করতে বলছে—তর দেওনের কাম নাই। আমি দিতাছি। আইলসার ঢ্যাপ।
    অপর্ণা চেচিয়ে বলছে—না, দাদা দেবে। দাদা দেবে।

    একটু একটু করে মুঠো খুলে গেল। হাতটা এগিয়ে গেল একটু সামনে। পাখিদুটো নেমে এসেছে বুড়ির কাঁধ থেকে। টলটল করে হেটে এসে হাতের উপর বসে পড়েছে একটি। দানা খুটে খুটে খাচ্ছে। হাতটি শিরশির করছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আরেকটি উড়ে উড়ে হাতে বসার চেষ্টা করছে। মোরগটি থেকে থেকে ডাকছছে—কুকরু কু। কুকরু কু। মোরগটিকে বলে উঠছি—আয়। আয় না। আয়। উঠোনে ভুলু কুকরটি উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে শুরু করেছে।

    মোরগটি এল। পাখিদুটোর সঙ্গে খুটে খুটে দানা খেতে লাগল। মা চোখের জল মুছে ঝিনুকে করে সাগু মুখে তুলে দিচ্ছে।অদুর্গাবুড়ি আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলছে—অ দাদা। সুয্যুঠায়ুরতো দক্ষিণায়ণ থেইকা উত্তরায়ণে যাইতেআছে। উইঠা বইসোগো দাদা। আর কত জলে রইবা।

    দুর্গাবুড়ি তখন এক ভীষ্ম ঠাকুরের কথা বলতে শুরু করেছে। ভীষ্ম ঠাকুর শুয়ে আছে শর শয্যায়। নড়ে না। চড়ে না। সূর্য ঘুরে আসছে। ইচ্ছে মৃত্যু তার। মৃত্যু তার বশ। যম বেটা উসখুস করছে। বলছে, অ দাদু। কী করবা? তুমি আমার লগে যাবা কবে? আমারতো আরও কাম কাজ আছে। তোমার কাছে বইসা থাকলি তো চলে না।
    ভীষ্ম বলে—বেটা ভাগ।অতর লগে যাওয়ার জন্য বাঁইচা আছিরে হতভাগা? আমার ইচ্ছে অইলে যামু। না অইলে যামু না। ব্যাস। কথা শ্যাষ।

    যম বেটা মন খারাপ করে চলে যায়। পায়ে পুরনো স্যাণ্ডেলের ফিতে ছিড়ে গেছে। তার ঘুম পেয়েছে। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে নেবে। এ কাজটি তার ভাল লাগছে না। মজা নাই।

    অর্জুন লেবেঞ্চুস খাচ্ছিল। তাকে ডেকে ভীষ্ম ঠাকুর বলল, নাতিলো, আমারে একটু ধরতো।
    অর্জুন লেবেঞ্চুস চুষতেই আছে। তার ধরার সময় নাই।
    নিজে থেকে বুড়ো উঠে দাঁড়িয়েছে শরশয্যা থেকে।অশরীর থেকে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে তীর গুলো। অদূরে সরোবর। পদ্ম ফুটে আছে। পদ্মের উপর পেরজাপতি। ডানা নাড়ছে। বুড়ো দেখতে দেখতে গণ্ডুষ ভরে জল খাচ্ছে। যমবেটা তখন বাড়ি ফেরার আগেই একটা শেওড়া গাছের তলায় ঘুমে কাদা।অদূরে পড়ে আছে ফিতে ছেড়া স্যান্ডেল।
    ভীষ্মের চোখে পড়ে দূরে সরিষা ক্ষেত। হলুদ হয়ে আছে। সরোবর থেকে উঠে সরিষা ক্ষেতের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। ভীষ্ম ঠাকুর সরিষা ফুলের রেণু মুখে লাগাবে। রং মেখে বুড়ো কালে সঙ সাজবে। নেচে নেচে গাইবে—

    মাইহে
    কলঙ্কিনী রাধা
    কদম গাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা।
    মা তহে জলে না যাইও।অ।

    তখন মনে হল আমারও এইরকম একটি গান গাওয়া দরকার। তার আগে মাঠে যেতে হবে। সরিষা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাটতে হবে। সারা গায়ে লাগাতে হবে ফুলের রেণু।
    অপর্ণা ছুটেছে সঙ্গে সঙ্গে। ওর ফ্রক উড়ছে। বলছে—অ দাদা, দ্যাখ দাদা—হুইযে সর্ষে খ্যাত।

    শ্রীধর সর্ষে ক্ষেত পেরিয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ে মটরশুটি ফলেছে। আগে নাড়া কুড়াতে হবে। শুটি পুড়িয়ে খাবে। আজ তার আনন্দ হচ্ছে। চেঁচিয়ে বলছে—তাড়াতাড়ি আয়। ঢ্যাপসার মত ল্যাদর প্যাদর কইরা হাটস ক্যান। বাগডাসের মত দৌঁড়া।

    পেছনে পেছনে একটা লাঠি ঠুক ঠুক কানে আসছে। বুড়ি হেঁটে আসছে কুজো হয়ে—লাঠি ভর দিয়ে। চূল শনপাট। সাদা বসন ভুষণ। মুখে দোক্তা। একটু বসছে। আবার উঠছে। ঠুক ঠুক করে লাঠিতে ভর দিচ্ছে। সর্ষে ক্ষেতে যাবে। সর্ষে দিদি হবে। এই তার মনে স্বাদ।
    মা উঠোনে দাঁড়িয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলছে—দুর্গা। দুর্গা।
    পেয়ারা ডালে পাখি দুটো বলছে—দুর্গাদিদি।
    সর্ষেদিদি—দুর্গাদিদি। দুর্গাদিদি—সর্ষেদিদি।

  • Kulada Roy | 74.72.***.*** | ০৪ জানুয়ারি ২০১২ ২০:৪০490924
  • লক্ষ্মী দীঘা পক্ষী দীঘা
    কুলদা রায়

    গোলরুটির চেয়ে গোলারুটিই বেশি মজার। বড় মামী এ ব্যাপারে ফার্স্টক্লাশ। নানারকমের গোলারুটি বানাতে তার জুড়ি নেই। আটা গুলে তার মধ্যে পিঁয়াজ কুচি দিয়ে পিয়াজ রুটি। কাঁচা মরিচ দিয়ে মরিচ রুটি। আর কালো জিরা দিলে বেশ টোস্ট টোস্ট ভাব আসে।

    আজিমার পছন্দ শুকনো মরিচ। এটা ছোটোদের জন্য একেবারে নো। তাদের জন্য গুড়ের ঢেলা। না পেলে ছেঁচকি শাক। কখনো পুঁই রুটি। পুঁইশাক কেটে গোলা রুটির মধ্যে ছেড়ে দেবেন। ভাপে সিদ্দ হবে। তার বর্ণ দেখে দেখে, ওগো মা, আঁখি না ফেরে।

    এ বাড়ির পুরনো আদ্যি কালের কড়াইটার একটা হাতল নাই। ৯ মাস পুকুরে চোবানো ছিল। সারা দিনমান পুকুরে ঢুবে ডুবে খুঁজে বের এনেছিল নিমুইমামা। আজিমা পেয়ে মহাখুশি। বলেছিল, পলানোর সুমায় হাতলডাও ছেলো। দেখ, খুঁইজা পাস কিনা। আবার ডুব দে মন কালি বলে।
    মামা ডুবে ডুবে পিতলের ঘণ্টা পেয়েছিল। আজিমা মুখ ব্যাজার করে বলেছিলেন, এইটা দিয়া কী করুম।
    --ক্যান পূজা করব। ঘণ্টা বাজাইয়া আরতি দিবা।
    --পূজা তো হারা জীবন ভইরাই করছি। তবুও তো সব হারাইছি। ভিটা ছাড়ছি। বাপকাগারা বেঘোরে মরছে। পূজা কইরা লাভ কি রে বাপ। হাতলডা খোঁজ।

    হাতলডা খুঁজে পাওয়া যায়নি। হাতল ছাড়াই এই কড়াইতে বড় মামী সুন্দর করে গোলারুটি ভাজতে পারে। ছেঁচকি শাক রানতে পারে। ভাতউয়া টাকির ঝোল বেশ তেড়মেড়ে হয়। সুযোগ হলে ফস ফস করে ফ্যান ত্যালানিও করা যায়। আর কি চাই। শুধু কড়াইটা ধরতে হবে একটু সাবধানে। সাবধানের মাইর নাই। নিমুই মামা বলে, সময় আইলে আরেকটা নতুন কড়াই কেনা হবে।
    মামী বলে, ওগো সুমায়, তুমি সত্যি সত্যি আসিও। হ্যালা কইরো না বাপ।

    আজা মশাইর কিছু বাহ্যে সমস্যা আসে। তার জন্য গোলারুটির বদলে রান্না হয় নোঠানি। আটার ভাত। সঙ্গে থানকুনির ঝোল। শিংমাছ দিতে পারলে বেশ হয়।
    আজা মশাই পেঁপে গাছটার নিচে বসে নোঠানি খেতে খেতে দেখতে পেলেন, আগামি ঋতু এলে মাঠে মাঠে ধান ফলবে। আর তরী বেয়ে রবীন্দ্রমশাই বেড়াতে আসবেন। ঘাটে এসে ঝরঝরে গলায় বলবেন, দুটো ফেনা ফেনা ভাত রাঁধতে বলো তো হে। মেলাদিন পরে জুত করে খেতে চাই।

    খেয়ে দেয়ে তিনি গগন হরকরার খোঁজে বের হবেন। তার ইচ্ছে আজা মশাই আজ তার সঙ্গে থাকুক। কিন্তু আজা মশায়ের মনটা আজ খারাপ। রবীন্দ্রমশাইকে তিনি বেশ মানেন। কিন্তু মাত্র পাঁচটি ছেলেমেয়ে। তিনটি আগেভাগে মরে গেছে। বউটাও নাই। চৌদ্দটি হলে আরেকজন রবীন্দ্রকে পাওয়া যেত। সেটা সম্ভব হল না। আজা মশাই অবশ্য নিজে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বারো-তে তাকে থেমে যেতে হয়েছে। আজ হাহাকার জাগে।
    রবীন্দ্রমশাই রিনরিনে গলায় বলবেন, চিন্তা করো না বনিকবাবু। কেউ না কেউ পারবে। অপেক্ষা করতে হবে।

    এই বলে কবিমশাই নাও ছেড়ে দেবেন। দাঁড় টানবেন। রাশি রাশি ধান তার নাও ভরা। ঠাই নাই ঠাই নাই ছোটো সে তরী। একটু কাত হলেই জলের মধ্যে ভুস। এর মধ্যে আজা মশাই চেঁচিয়ে বলছেন, সাবধানে যাইয়েন গো মশাই।
    ধান কই। সব শুকনো খড়। বন্যায় সব শেষ। খড় ডুবলে ক্ষতি কি!

    নৌকা ততোক্ষণে আড়াল হয়ে হয়ে যাচ্ছে। তিনি শুনতে পেলেন কি পেলেন না বোঝা গেল না। শুধু দূর থেকে ভেসে এলো—আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আসতে আসতে গানটি আবার বহুদূরেই ভেসে যাচ্ছে। এরপর খুব চুপ। কয়েকটা দাঁড় টানার শব্দ শুধু। ছপ। ছাপ। ছাঅপ।

    এইবার আজা মশাইয়ের ডাক পড়েছে। আজিমার জন্য গন্ধ ভাদুল তুলতে যেতে হবে। দুপুরে ভাতউয়া টাকির সঙ্গে রান্না হবে। টাকি বড়শিতে ধরা পড়েছে। বড়মামী দুটো রসুন কোঁয়া খুঁজতে লেগেছে। সঙ্গে ধানী লংকা। রসুন কোথায়? ঘরের চালের আড়ায়। আড়াটি দরমার বেড়ার। তার উপরে পুরনো রসুন শুকিয়ে কড়কড়া। কবেকার বলা মুশকিল।

    ততক্ষণে উত্তরপাড়ার সালাম মামা এসেছে। বরইতলা থেকে ঊঠোনে আসতে আসতে সামান্য হেঁকে বলছে, নিমুই, বাড়ি আছিস? নিমুই মামা বাড়ি নেই। তালতলা গেছে। পথে জাঙ্গালিয়া যাবে। শেখ বাড়ি ঘুরে আসবে। তালতলায় ফেলা পাগলার থানে পৌঁছাবে।

    সালাম মামার কাঁধে ধামা। আজা মশায়ের পেছন দিয়ে পা টিপে টিপে রান্না ঘরে এসেছে। কাঁধ থেকে ধামাটি রেখেছে। আজিমা চল্লায় ধানী লংকা খুঁজছে। মামী রসুনের আশায় ঘরের মধ্যে আড়ার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটা টিকটিকির কঙ্কাল পায়ের কাছে ঝরে পড়েছে।

    চুলার পাশে হাতল ভাঙা কড়াই। সেখানে একটা গোলারুটি ঢাকা দেওয়া। নিমুই মামা এলে খাবে। ঢেঁকির উপরে চোখ বুজে আছে তিলকি বিড়াল। ধামা দেখে বলল, মিঁয়াও।

    এই বাড়িটির উঠোন পশ্চিমে নিচু হয়ে নেমেছে পুকুরে। সেখানে রোদ্দুর থিকথিক করছে। তারপর শূন্য মাঠ। দূরে জাঙ্গালিয়া গাঁও দেখা যায়। মেঘের পরে তালতলা। সেখানে নিমুই মামা গেছে।

    সালাম মামা ঢাকনা তুলে এক টুকরো গোলারুটি ছিড়ে মুখে দিয়েছে। মুখটা ভরে গেছে। এ স্বাদের বাক্য নাই। আরেক টুকরো খাবে কি খাবে না ভাবতে ভাবতে দেখতে পেল, বড় মামী ঘর থেকে রান্না ঘরে এসে পড়েছে। সালাম মামাকে কড়াইয়ের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল, খাও না সালাম দাদা, খাইয়া নেও।
    --কার জন্যি রাখছিলা গো বড় ভাবী?
    --নিমুই—নিমুইর জন্যি।
    বড় মামীর খিদে পেয়েছে। তার কপালে ফোঁটা নেই। পেটের মধ্যে কে একজন গোটা গোটা উসক করছে। বলছে খিদে, খিদে খিদে। তবু রুটির টুকরোটি সালাম মামার হাতে গুঁজে দেয়। বলে, খাও।
    সালাম মামা গোলারুটি খেতে খেতে বলে, তুমার হাতে অমেত্ত আছে। শিখলা কোথায়?
    --ইন্ডিয়ায়। রিফুজি ক্যাম্পে।
    --ও। সালাম মামা গোলারুটি চিবুয়। এক মাথা ঘুরিয়ে পেঁপে গাছটার দিকে আড় চোখে তাকায়। তারপর বলে, ও, ইন্ডিয়ায়। আমিও গেছিলাম। বছর তিন আগে।
    আলগোছে হাঁটুর নিচু হাত রাখে। হাঁটুতে একটা গুলির দাগ আছে। মাঝে মাঝে টাটায়। শেখ বাড়ির বড় শেখই প্রথম দেখেছিল। রক্ত ঝরছে। সালাম মামা গুলি করতে ব্যস্ত। ব্যথা ট্যাথা টের পাচ্ছে না। নিমুই কাঁধে নিয়ে না ছুটলে সব শেষ হত। এর মধ্যে শকুন উড়ে এসেছিল। বুকটা শিউরে ওঠে। আস্তে করে বলে, ফেলা পাগলা কি কয়?
    --কিছু কয় না। শুধু আসমান পানে চায়।

    শুনে সালাম মামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রান্না ঘরের পিছনে বেড়াটা ভেঙে পড়েছে। উত্তরে নালাখালায় নলবন দেখা যায়। শুকনো পাকা। খটখটে। পটপট করে শব্দ হয়।

    ধামাটি মামীর কাছে ঠেলে দিতে দিতে বলে, আম্মায় দিছে। লক্ষ্মী দীঘার প চাল। আর নাই। কইছে, বিনার পোলা আইছে মামাবাড়ি। হ্যারে কি খালি গোলারুটি দেওন যায়?

    একটা কুড়হা হলে ভালো হত। কুড়হা আছেও। উমে বসেছে। এখন কদিন কুক কুক করে না। কদিন পরে বাচ্চা ফুটবে। এখন কুড়হা দেওন যায় না।
    মামীর চোখ ভিজে আসে। পেটের মধ্যে কচি কুড়হা নড়েচড়ে। মাথাটি ঘুরিয়ে মাটির হাড়ির সন্ধান করে। মেলাদিন পরে দীঘা ধানের ভাত রান্না হবে। ভাতউয়া টাকির সালুন হবে। রসুন হলে স্বাদে গন্ধে হবে অমেত্ত। আড়ার উপরে রসুন। রোদে কড়কড়া। গন্ধে পোকা পলায়--পিঁচাশ দৌড়ায়। খাম বেয়ে কেউ না কেউ পেড়ে দেবে।

    সালাম মামা তখন উঠে পড়েছে। বটবাড়ি যেতে হবে। সেখানে একটা লঙ্গরখানা খোলার আলাপ আছে। বড় মামীকে জিজ্ঞেস করল, বাপের বাড়ির খবর পাইছ কিছু?
    --সেখানে শকুন নামছে। গেল সপ্তায় শুনতি পাইছি।
    --চিন্তা কইরো না ভাবি। ফেলা পাগল বাক্যি দেবেন। শকুন তো শকুন—শকুনের বাপেও খাড়াতি পারবি না। চইল্যা যাবেআনে।

    সালাম মামা পশ্চিম দিকে পুকুর পাড়ের দিকে নেমে যাচ্ছে। আজা মশাই ততক্ষণে গন্ধ ভাদুলের কথা কিছুটা ভুলে গেছেন। কিছুটা ঝিমুনিতে পড়েছেন। মাথার উপরে পেঁপে গাছে ফুল নাই। কটা দড়ি দড়ি পেঁপে ঝুলে আছে।

    এ সময় ঝিমের মধ্যে আজা মশাই মাথাটা নিচু রেখেই বলে উঠেছেন, সালাম আইছিস?
    সালাম মামা পুকুর পাড় পার হয়ে যাচ্ছে। পেছন ফেরার ইচ্ছে নেই। যেতে যেতে বলছে, আমি আসি নাই। আসি নাই।
    আজা মশাই আরও আরও গভীর ঝিমের মধ্যে ডুবে যান। ডুবে যেতে যেতে বলেন, কবে আসবি রে বাপ?
    --জানি না। জানি না।

    আজা মশাই ঝিমের মধ্যে গড়িয়ে পড়তে পড়তে পড়ে যান না। দুহাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে দেন। কানদুটো হাঁটুতে চেপে ধরেছেন। গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে গলা থেকে। রোদ্দুর এইবার মাথার উপরে উঠে যায়। আকাশটা খনখনে করে ওঠে।

    এই ছন্ন ভাবটা পেঁপে গাছটার পছন্দ নয়। শ্মশান শ্মশান লাগে। ফিস ফিস করে বলে, মাস্টার মশাই ঘুমাইলেন নিকি?
    আজা মশাই হাউশী ছাড়েন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মন খারাপ। দুটো ফেনা ভাত হলে রবীন্দ্র মশাইকে নেমতন্ন করা যেত। কবি মানুষ। কোনোদিন খেতে চান না। আজ চেয়েছিলেন। আজা মশাই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখেই উত্তর দেন—না, ঘুমাই নাই। ঘুমাই কি কইরা?

    চারদিকে বিল। মাঝখানে এই বাড়িটা। খা খা করে। পেঁপে গাছ বলে, কিছু কথা কই আপনের লগে?
    --আজা মশাই, মাথা নাড়ে। বলেন, কইয়া কইয়া তো জীবন গেল। কইয়া লাভ কি?
    আজা মশাই বিড় বিড় করেন। পেঁপে গাছের গা শির শির করে। ফির ফির করে জানতে চায়--
    এই গেরামে আপনেরা আইলেন কুন সুমায়?
    --চার পুরুষ আগে।
    --হ্যার আগে আছিলেন কোথায়?
    --ভুষণায়। নদ্যা জেলায়। রানী ভবানীর কালে।
    --সেখান থিকা আইলেন ক্যান?
    --শকুন নামছেলো।
    --শকুন কি করে?
    --মরা ধরা খায়।
    --তারপর কি করে?
    --আসমানে ওড়ে।
    --আসমানে যাইয়া কি করে?
    --আবার নাইমা আসে। মাঠে ঘাটে বাড়িতে নাইমা আসে।
    --তারপর কি হয়?
    --আমরা পলাই।
    --পলান ক্যান?
    --পলান ছাড়া এই জীবনে আর কুনো উপায় আছে রে বাপ?

    এইটুকু শুনে পেঁপে গাছটার পাতা নড়া থেমে যায়। দড়ি দড়ি পেঁপেগুলো সামান্য কাঁপে। কাঁপতে থাকে। ঘরের আড়ায় রসুন শুকোচ্ছে। আরেকটা টিকটিকি গড়িয়ে পড়ে। গণ্‌ধ ভাসে। আজা মশাই এইবার আর কোনো কথা বলেন না। মুখটা হা। হা-এর মধ্যে অন্ধকার। বহু পুরনো। এই অন্ধকারের কটু কটু ঘ্রাণ আছে।

    এই ঘ্রাণ লক্ষ্মী দীঘা ধানের। মাটির হাড়িতে ফেনা ভাতের মধ্যে এই ঘ্রাণ পটর পটর করে। পটর পটর থেকে টগবগ হয়ে যায়। শোনা যায়।

    এইবার পাড়া জুড়াবে। রসুন শুকোচ্ছে।

    .........................
    ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১
    নিউ ইয়র্ক।
  • Nina | 12.149.***.*** | ০৫ জানুয়ারি ২০১২ ০৩:৪২490925
  • কুলদাভাই
    আপনি ম্যাজিসিয়ান--আপনার লেখার জাদুতে চারিপাষ হয় মায়াময়--আমিও হাওয়য় হাওয়ায় ভাসছি---শরীরে কোনো কষ্ট নাই--মনেও নাই---কি চমৎকার লেখাই না পড়ছি----আহা!
  • Kulada Roy | 67.243.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০১২ ১১:২৪490927
  • একটি নিশিন্দাগাছের গল্প
    কুলদা রায়

    একদিন খুব ভোরবেলা বাবা বসে আছে নিমগাছের তলায়। একটু একটু করে সূর্য উঠছে। ভুলু কুকুরটা তখনো উঠোনে পায়ের মাঝে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। পড়ছি-- রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে। বাবা হঠাৎ ডেকে বলল, যাতো, বিমলকে ডেকে নিয়ে আয়।

    বটতলা পেরিয়ে ইরানী ফুফুদের বাড়ি। তার পরে মোহন দারোগা। খুব পুরনো বাড়ি। দোতলা লাল ইটের। ছাদের কার্ণিশে জলপড়া পাইপের মাথায় কাল কাল বাঘোমামা হা করে চেয়ে আছে। হায়ের মধ্যে চড়ুই পাখির বাসা। একটি চড়ুই বের হয়ে বলল, চিড়িক চিড়িক। কাকে চাও?
    --বিমলকাকাকে।
    --বিমলকাকা কেডা?
    --চুল কাটে। দাড়ি কাটে।
    --হু। শ্রী বিমল চন্দ্র পরামানিক। হুই যে নিশিন্দা গাছের আড়ালে গোলপাতার ঘর। হোগলার বেড়া।

    চড়ুই পাখিটার ঘুম পেয়েছিল। আবার ঢুকে গেল বাঘোমামার হায়ের মধ্যে। নিশিন্দা গাছের নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। পাতা থেকে টুপ টাপ শিশির ঝরে। উঠোন ভিজে যায়। ঘর থেকে কেউ বের হয় না। কী করি? কাকে বলি?
    চড়ুই পাখিটা আবার বেরিয়ে এসে বলল, নাম ধরে ডাক দেও।
    --কার নাম?
    --বিমলের নাম।
    --সে কি কইরা হয়? উনি কত বড়।
    --তাইলে কাকা বইলা ডাক দেও।
    কাকা? কে কাকা? কার কাকা? কোন কাকা? মাথাটা হয়ে যাচ্ছে ফাঁকা।
    --মহাঝামেলা। তাইলে খাড়ায়া আছ ক্যান। বাসায় যাও।

    বাসায় যাওয়া যাচ্ছে না। বাবার দেরী হয়ে যাচ্ছে। ভেড়ার হাটে যাবে। চাল কিনতে। ফিরে বাজারে বসবে ছালা পেতে । ফেরার পথে আজ একটি কুড়হা কেনার কথা। দিদি পুষবে। কুড়হা ডাকবে--কুক কুক কুক। কুকরো কু।
    খুব ধীরে ধীরে ডাক দিলাম—বিমল কাকা। বিমল কাকা।
    কেউ শুনতে পাচ্ছে না। চড়ুই পাখিটা বিরক্ত হয়ে বলল, পাখির মত পু পু করছ কেন? বড় মানুষের জোরে ডাক দেও। ভাত খাও না?
    জোরে ডাক দিতে গিয়েই ঝামেলা হয়ে গেল। কাকা শব্দটি বাদ পড়ে গেল। বললাম, বিমল। বিমল।

    এইবার দরজা খোলার শব্দ হল। আর তখনই মনে হল-- বিমল কাকা যদি দেখেন তার নাম ধরে ডাকছি-- কী মনে করবেন। ওর দেখার আগেই দৌঁড় দিলাম। বিমলকাকা কি জানতে পারবেন কাদের বাড়ি থেকে ডেকে গেল? কোন বাড়ি তাকে যেতে হবে? এই ভেবেই পা থেমে গেল। বাসায় ফেরা যাচ্ছে না। নিশিন্দাগাছের সামনেও আবার যাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে? তাহলে বড়গাছের কাছেই ধন্যা দেওয়া গেল। ও বটগাছ। আমাকে বাঁচাও। দুটো দুব্বা ঘাস দেব। লতিবুড়ির বাগান থেকে দুটো করমচা এনে দেব। চোখ বুজে বুজে বলছি। খুব ভনক অবস্থা। বটগাছ আমার কাঁধে হাত রেখেছে। বলল, ওঠো খোকা। বাসায় চলো।
    তাকিয়ে দেখি বিমল কাকা দাঁড়িয়ে আছেন। বগলে ছোট্ট বাক্সটা। ঘুম ভাঙতে দেরী হয়েছে। মুখটা ফোলা ফোলা। পাশে ভুলু কুকুরটা ল্যাজ নাড়ছে। বললেন--চল।

    বাবা ততক্ষণে একঘটি জল নিয়ে বসেছিল আমাদের নিমগাছের নিচে। বলল, দেরী কইরো না বিমল। শুরু কর।
    বিমল কাকা বাক্স খুলে খুব সাবধানে খুরটা শানে ধার দিলেন। সাবানটা গুলতে যাবেন। বাবা আমার হাত ধরে জলচৌকির উপর বসাল। আর বিমল কাকা হাসতে হাসতে কেঁচিটা ক্যাচ ক্যাচ করলেন। কি করবেন কিছু বোঝার আগেই আমার মাথায় বসিয়ে দিয়েছেন একটি বাটি। তারপর চুলে পোচ বসালেন। মনে হল চুলতো নয়--আমার মাথা কেটে দিচ্ছেন। বাবা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ভরে এল জলে।

    সেদিন ছিল আমার প্রথম স্কুলজীবন। মাথা ছাড়াই হুজুর স্যারের সামনে যেতে হল। তিনি বেশ গদগদ হয়ে বললেন—হা হা হা। খাসা। খাসা। এইটারে কী বলে জানিস?
    সারা ক্লাশ চেঁচিয়ে জানতে চাইল—কী স্যার? কী স্যার?
    --বাটি ছাট হেয়ারকাট।
    --কী কাট?
    --চুউপ।

    এই চুউপ করেই বিমলকাকার সামনে প্রতি বিশ দিন পর পর মাথা পেতে দিতে হয়। আর কাকা অম্লান বদনে আমার, দাদার, আমাদের সবার মাথা কেটে নেন। আমরা মাথা তুলে দাড়াতে পারি না। ছোট্টটি থেকে যাই। কবে বড় হব!

    একবার দাদা লুকিয়ে সেলুন থেকে চুল কেটে এল। পরদিন বিমলকাকা দাদার-সেলুনে-টেরি-করে-কাটা চুল আরেকটু মিহি করে বাটি ছাট ছাট দিলেন। সে এক দৃশ্য বটে। বাবা হাটে যাবে। যাওয়ার আগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেড়ারহাটের চাল, চিড়া, মুড়ি, আনাজের দরদাম নিয়ে আলাপ করছে। গোলপাতার বদলে টালি দিয়ে ঘর বানালে কী রকম হয় এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর দাদা চোখ বুঝে আছে। আর কোনোদিন দাদা এই চোখ খোলে নি। খোলে নি বলেই দাদা সারা জীবন কোনো সেলুন টেলুন খুঁজে পায় নি। খুঁজে কী হবে? বিমল কাকা কী এ শহর ছেড়ে চলে যাবে? নাই হয়ে যাবে?

    ক্লাশ নাইনে ব্যাঙের ঠ্যাং কাটব বলে বাবা একটা ডিসেকশন বক্স কিনে দিল। বিমলকাকা খবর পেয়ে এসে গেলেন। বক্সটি খুব কায়দা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর এক ঘটি জল খেলেন। ধীরে ধীরে যত্ন করে বক্সটি খুললেন। ভেতর থেকে বের হল একটা ঝকমকে ছোট কেঁচি। চেমটি। কয়েকটি পিন। বড় সড়ো একটা নিডল। আর শাদা বাটের খুর।অহালকা কালচে লাল রঙের কী একটা লতাপাতা খাড়া। খুরটি দেখেই কাকার চোখে ঢেউ খেলে গেল। বললেন—দাদা, এইবার আশা পূর্ণ হবে।
    বাবা গদগদ গলায় বলল, আশা পূর্ণ না হয়ে যায় কই।

    বিমলকাকা খুরটি নিয়ে বাজারে ছুটলেন। কামারবাড়িতে বড় র‌্যাত আছে। তিনি খুব করে ঘষলেন। যতবার ঘষেন ততবার গুড়ো হয়ে যায় খুরের ধার। ঘেমে চেমে গেলেন। এই খুরে ধার হয় না। ক্ষতবিক্ষত খুরটি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন—দাদা, কী হবে?
    --চিন্তা কইরো না। ভাল খুর কেনা হবে।

    বিমল কাকা আর কোনোদিন চিন্তা করেন নি। বাবার প্রতি বিশ্বাস অটুট ছিল। বাবা নিশ্চয়ই কিনবে একদিন একটি নতুন খুর। খুব বাহারী। চকচকে। সত্যি সত্যি ধার হবে। ভেঙে গুড়ো হবে না। তার নিজের খুরটি বেশ পুরনো। বাটটি কালো হয়ে গেছে। একপাশে একটু চিড় ধরেছে। ওটা ছিল তার বাবার। তার বাবা পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তার বাবার বাবা পেয়েছিলেন তার তার বাবার কাছ থেকে। অনেক খয়ে গেছে। ভেঙে গেলে বিপদ। তার ছেলের জন্য কী রেখে যাবেন তিনি?

    এইভাবে একদিন ম্যাট্রিক পাশ করে স্কুল থেকে কলেজে যাওয়ার দিন এসে গেল। মাকে বলে কয়ে লঞ্চ ঘাটে দুরু বুকে চলে গেলাম। তখন নদীতে জোয়ার কী ভাটা বোঝা কঠিন। ঘাটে পানের লঞ্চ ভিড়েছে। টাবুরে মাঝিরা হাকাহাকি করছে—আসেন, ঘোষের চর। ঘোষের চর। নীলুফা। বেদগাঁ।
    এর সামনেই ছোট একটি খুপড়ি ঘর। দরমার বেড়া। বেড়ার গায়ে অরুণ-বরুণ-কিরণমালা সিনেমার পোস্টার। নায়ক বাঁশি বাজাচ্ছে। নায়িকার চোখে জল। নাম বিউটি সেলুন। এই বিউটি কি সিনেমার কোনো নায়িকার নাম? একটি ভাঙা রেডিওতে বাজছে—ম্যায় আওয়ারা হু।

    সেদিন খুব ভোরে বিমল কাকা এলেন। বাবা আরও ভোরে বৌলতলীর হাটে চলে গেছে। ওখানে রায়েন্দা চালের দর কম। কাকা বাক্স খুলতে যাবেন। মা একবাটি মুড়ি আর এক টুকরো নলেন গুড় এনে দিল। বলল, খাইয়া লন দাদা।
    ততক্ষণে আমার কাকস্নান হয়ে গেছে। পরণে সাদা একটা পাজামা। ফিতাটা নতুন করে লাগানো। কাকা মুড়ি খেতে খেতে হুকুম করলেন—পাজামা পরছো ক্যানো? লুঙ্গি পইরা আসো।
    শুনে আমার মুখ চুন। মা আর কিছু মুড়ি দিয়ে বলল, অ বড় অইয়া গেছে দাদা। আইজ থাউক।

    বিমল কাকা বেশ বড় একটা বিষম খেলেন। নাকে মুখে মুড়ি ঢুকে গেছে। মা এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল। জল খেতে খেতে বললেন, বড় হয়ে গেছে অরা বৌদি। অরা বড় হয়ে গেছে।
    উঠোনে ভুলু কুকুরটি শুয়ে নেই-- ল্যাজ তুলে একটি ধাড়ি দাসমাছির পেছনে পেছনে ছুটছে।

    সেদিন থেকেই আমরা সত্যি সত্যি বড় হয়ে যাচ্ছি। বাটিছাট হেয়ার কাট থেকে টেরি কাট এসে গেছে। টের পাচ্ছি বাবার দুএকটা করে দাড়ি সাদা হচ্ছে। চুল পাকতে শুরু করেছে। তালু ফাকা হচ্ছে। খুব বেশি দূর দূর হাটে আমার দাদা যাওয়া শুরু করেছে। আর বিমল কাকা খুব ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো এসে পুরনো খুরটা দিয়ে নিমগাছের নিচে বাবার দাড়ি কাটছেন। নিমগাছের হাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর। গাছটির নাম ঘোড়া নিম। ঘোড়া নিমগাছটার তলায় বিমলকাকা বাবার দাড়ি কাটছেন। বাবা তার কাছে টিনের চালের বদলে টালির চালের উপকারীতা বর্ণনা করছে। বিমল কাকা মন দিয়ে শুনছেন। খুরের ফেটে যাওয়া বাটটায় ছোট একটি পট্টি লাগাতে হয়েছে। বাবা বলছে, চিন্তা কইরো না বিমল-- নতুন খুর কেনা হবে।

    বিমলকাকা জানেন বাবার কথায় জোর আছে। সেই জোরে বাজারে একখানা ইট পেতে বসেন। পুরণো জীর্ণ খুর দিয়ে হাটুরে লোকজনের দাড়ি কামান। কেঁচি দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে চুল কাটেন। পাশে হা করে দেখে তার ছেলে অমল-- শ্রীঅমলকুমার পরামানিক। অমলের চোখ ভরা ঘুম। কাজ সারতে সারতে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে যাবে। মোহন দারোগার বাড়িটা ঝোপে জঙ্গলে ঘিরে গেছে। মাঝে মাঝে দুএকটা ইট খসে পড়ে। ধস করে শব্দ হয়। বাঘোমামা হায়ের মধ্যে কালপেচার বাসা। তারা মাঝে মাঝে গম্ভীর স্বরে ডাকে--ভুতুম! ভুতুম!!

    নিশিন্দাগাছের নিচ দিয়ে বিমলকাকা আর তার ছেলে অমল বাড়ি ফিরবে। আমাদের সেই মফস্বল শহরটির সবেধন নিশিন্দা গাছটি এখন আরও দীর্ঘ হয়েছে। কিছু নূয়ে পড়েছে। হাওয়ায় কাঁপে থরথর করে। ঠিক ঠিক পাতায় পাতায় জমে নিশিরও শিশির। নিশিন্দাগাছের হেতু মশা নেই। গাছটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভাল লাগে।
  • T | 14.139.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০১২ ১৩:০৪490928
  • @কুলদা রায়, 'যার যতবড় শৈশব তিনি ততবড়ো লেখক',আপনার লেখা পড়ে আমার বারবার এটাই মনে হয়।
    অন্যান্য লেখাগুলির মতৈ এটিও ভাল লাগল।
    প্রায়শ:ই আপনার লেখা পড়ার পর মনে হয় যেন শেষ বিকেলের ধারে বসে আছি। হাওয়ার টানে দীর্ঘশ্বাস সমেত সবকিছু শুষে নিচ্ছে এক প্রকৃত ডিমেন্টর।
  • pi | 72.83.***.*** | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ০৬:৪৮490929
  • কুলদাদা, তুলে দিলাম।
  • Kulada Roy | 67.243.***.*** | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ১১:১২490930
  • গন্নিবিবির পন্নিকথা : একটি থ্রি ডি থ্রিলার
    কুলদা রায়

    বাল্যে আমাদের জুতা ছিল না। এ কারণে অবাল্যে কখনৈ জুত করতে পারি নি। এ বিষয়ে আমাদের ঠাকুরদা সাফ কথা বলে গিয়েছিলেন—জুতো থাকলেই জুতোজুতি হয়। সুতরাং নো জুতো। নো টুতো। তাইলে জীবন উইদাউট খুঁতখুঁতো।

    সুখের কথা আমাদের ঠাকুরদার জুতো কোনো জুতো ছিল না। জীবনের শেষে দিকে তিনি প্রায়ই জুতোর কথা বলতেন। যেদিন আমাদের পুকুরে সত্যিকারের জ্যোৎস্না ফুটত—রজনীগন্ধ্যা জুটতো, সেদিনই ঠাকুরদা চুলে ঘন করে চিরুনি করতেন। তারপর ঝেড়ে কাশতেন। ভাইসগোল, যেদিন আমাগো চরে প্রিন্স অব ওয়েলসের বার্থডে উপলক্ষ্যে ব্যান্ডপার্টি বাইজা উঠল, সিকদার বাবুগো গদিঘরে গন্নিবিবি ঝননে ঝনেন ঝা বলে পা দিয়া দাপানি তুলল—হ্যার আগের দিনই একজোড়া পাম্পসু কেনা হইছিল।

    কাহিনী এইটুকু। এরপরে আর খুব বেশী জানা নেই। এইটুকু শুনেই দিদি বা ছোটো বোন হা করে চেয়ে থাকত। এ সময় ঠাকুরদা চক্ষু বুজে গান ধরতেন, কেনো চেয়ে আছ মা।

    ঠাকুরদার উপর্যুক্ত ভাষ্য থেকে দুটো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে–

    . গন্নিবিবি সিকদারবাবুদের গদিঘরে পা রেখেছিল। গান গেয়েছিল। পা দাপিয়ে নেচেওছিল।

    . একজোড়া পাম্প-সু কেনা হয়েছিল।

    জুতা কেনার সময়টাও বলে দেয়া আছে। গন্নিবিবি যেদিন গদিঘরে গেয়েছিল–নেচেছিল, তার আগেরদিনই কেনা হয়েছিল জুতাজোড়া। প্রশ্নটা হল, পাম্প সু কার জন্য কেনা হয়েছিল? ঠাকুরদার নিজের জন্য? কিন্তু আমাদের ভূভারতে কেউ কখনো পাম্প টাম্প সু পরেনি। আমার ঠাকুরদাও পরে নি। আমার বাবাও না। বংশধারা মানলে আমিও না। তাহলে সিকদার বাবুর জন্য? সেন্ট মথুরানাথ সরকারের জন্য? ব্লা ব্লা ব্লা…

    এই পাম্প সু বিষয়ে আমাদের বাড়িতে তেমন কোনো নথিপত্র কখনো পাওয়া যায় নাই। পাওয়ার কথাও নয়। পুরনো একটি সিন্দুক বড় ঘরের এক কোনে ছিল বটে। রটনা ছিল—জলের তলা থেকে তোলা হয়েছিল সিন্দুকটা। এই হেতু সারা গায়ে জং ধরা। সেটায় বিশ্বকর্মা পূজার দিনই কেবল তেল সিন্দুর পড়ত। আর সারা বছর সিন্দুকটার উপর বসে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলেছি, খুল খুল সিম যা। আমাদের ছোটো ছোটো পায়ের আঘাতে যেদিন সত্যি সত্যি লোহার সিন্দুকটির দরোজা সামান্য একটু খুলে গেল, আমরা কজন মিলে পুরোটা খোলার জন্য দরোজা ধরে টান মেরেছি, মড় মড় শব্দ করে সেদিন দরোজাটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। উঁকি মেরে দেখা গেল সিন্দুরটার মধ্যে শুধু পুরনো অন্ধকার—আর কিছু নেই। সেই অন্ধকার একটু সয়ে গেলে বোঝা গেল ওটা ঠিক অন্ধকার নয়, গন্ধের ছায়া। ঠিক ছায়াও নয়–এক ধরনের মায়া। একে আমরা বাসি গন্ধ বলি। আর টিকটিকির ডিমের দুটো খোসা। নো নথি। নো টথি। তবে একটা জিনিস। সেটা পরে বলব।

    তাহলে কি আমার ঠাকুর মার জন্য কেনা হয়েছিল সু-জুতাটি? অন্য কোনো মহিলার জন্য?

    . তার আগে ঠাকুরমা : জ্ঞানদানন্দিনী দাসী
    ------------------------------------

    আমাদের ঠাকুরমার মাথায় কিছু ঝামেলা ছিল। সারাদিন গজগজ করে যেত। তাঁর অর্থ কোনো খুঁজে নাহি পাই। দীর্ঘদিন ধরে এই গজগজানি শুনে আমাদের মা জননী কিছুটা সূত্র আন্দাজ করতে পেরেছিল। তার একটি ছোটো খাটো তালিকা নিম্নরূপ—

    . সত্যি সত্যি ঠাকুরদা একজোড়া পাম্প সু কিনেছিল।

    . মেইড ইন চায়না। ১০০% লেদার।

    . প্রাপ্তিস্থান, চিনে বাজার। ক্যালকাটা।

    . জুতা উইদাউট লেস। ব্লাক। ইহাকে জুতা নহে—মোকাসিন কহে।

    . জুতা পরিলে ধুলো লাগিতে পারে—এই হেতু ঠাকুরদা কর্তৃক জুতা কদাপি পরিহিত হয় নাই। কর্তৃক শব্দটির ফন্ট কালার আদার দ্যান ব্লাক।

    . জুতোটা নিয়ে ঠাকুরদা ঘুমুতে যেতেন। আর তার জীবিত ছোটি বহু জাগিয়া থাকিতেন বিছানার পার্শ্বে। তার চক্ষু নিমীলিত। এইভাবে বেশীদিন নহে—মাত্র একযুগ। জনশ্রুতি আছে ঠাকুমার সিঁথির সন্দুর অক্ষয় হয়েছিল। তার হাতের নোয়া- শাঁখা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

    . এই জুতাটার জেন্ডার ইস্যু নিয়ে পরে ঠাকুরমার একটা সন্দো হয়েছিল। জুতোটা কার ? জুতোটা কি পুরুষের? না, মহিলার? মহিলাদের?—না, পুরুষদের?

    .বলা হল — জুতোটি নিয়ে যে ঠাকুরদা বিছানায় যেতেন—সে জুতোটি কিন্তু কেউ দেখে নি। অথচ জুতোটি না দেখলে ঠাকুরমা জুতোটার জেন্ডারত্ব নিয়ে সন্দো করল কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুরমার কণ্ঠ থেকে উদ্ধার করা যেত—হিরি হিরি। হিরি কিরি।

    . ঠাকুরমাকে দেখে শুনে কেসির মা ডায়াগনোসিস করেছিল, নন কিউরেবল মাথা খারাপ। ওরফে ক্লাসিক্যাল ডিপ্রেশন।

    ডিপ্রেশনের কারণটা ঠিক স্পষ্ট নয়। কেসির মাদের চিকিৎসা ভুবনে ডায়াগনোসিস কালচারটা নেই। তাদের সব কিছুই ধ্যানে আসে—জ্ঞানে আসে। এই জ্ঞানকে দর্শনে স্বজ্ঞান কহে।

    ১০. দ্যাটস ইট।

    কিন্তু অই জনপদের জনচিত্তে এর ঘটনাগুলো চিরকাল গুপ্ত থেকেছে। ঘটনা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নাই। তারা চিরকাল মাথাহীন—ব্যাথাহীন। তারা চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ঢাক-ঢোলাদির বাদ্যসহযোগে আমাদের বাড়িতে আগমণ করেছে। ছোটোখাটো মেলাও বসেছে। তার নাম ছিল সু-এর মেলা। এ মেলায় আমার ঠাকুরদার সেই ঐতিহাসিক সু-র একটা কাঠের রেপ্লিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন ত্‌ৎকালীন বিশিষ্ট সমাজসেবক সেন্ট মথুরানাথ সরকার। শুধু একটিমাত্র শর্ত ছিল। সমাগত পাপীদিগে সদাপ্রভু যীশুখ্রিস্টের সুনমাচার বিনামূল্যে বিতরিত হবে। উইথ চা ও কুড়মুড় ভাজা। খ্রিস্টের কাছে না হলেও সুজোড়ার কাছে মানত করে কেউ কখনো ব্যর্থ হয় নাই। তাই হে ভাই ও বেরাদরে মিল্লাত–

    শুন সবে ভক্তি ভরে করি নিবেদন।

    জুতা বাবার শক্তিধারা করিব বর্ণন।অ।

    . এক যে ছিল গন্নি বিবি
    ------------------------------------

    গন্নিবিবির রিলেশন পাওয়া যায় মতিবিবির সঙ্গে। মতি বিবির সেকালে মাসে হাজার টাকা দর ছিল। বৃটিশ ইতিহাসে উল্লেখ আছে– প্রিন্স দ্বারকানাথ তাকে ইংলন্ডে নিয়েছিলেন। ইংলন্ডে যাওয়ার পরে একদিন ভোরবেলা নিত্য পূজোয় বসেছেন। এর মধ্যে রাজবাড়ির এক লর্ড এসে হাজির। বলে, বাবুকো বোলাও। বাবুর গেটম্যান সোজা হাকাইয়া দিয়ে বলে, পরে আসো। এখন নো এ®¾ট্রন্স।

    অন্য লোক হলে লর্ড ক্ষেপে যেত। একটা বিদিকিচ্ছিরি কান্ড কারখানা হত। কিন্তু সেটা করল না। প্রিন্স দ্বারকানাথ মহারাণীর পেয়ারা লোক। মহারাণী তার ব্যক্তিগত ডাইরীতে দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভাল ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চম্‌ৎকার মানুষ।

    সেবার তাঁর বিলেতের সফরসঙ্গী ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক ডা. ম্যাকগাওয়ান, তাঁর ভাগনে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী, ব্যক্তিগত সহকারী পরমানন্দ মৈত্র, তিন জন হিন্দু ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। আরও কজন এসেছিলেন। তার কথা সুপ্ত আছে—গুপ্ত নাই। বিলেতে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পীল, বোর্ড অব ক®¾ট্রাল এর প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজার্যাল্ড, প্রিন্স এলবার্ট, কেন্ট-এর রাজকুমারী এবং রানী ভিক্টোরিয়া। প্রিন্স ভারত থেকে বিস্তর ভেট এনেছেন। তাঁকে একটু খাতির না করে উপায় নেই। তাই ঝামেলা না করে লর্ড সোজা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

    ঠিক এক ঘটিকা পার হলে প্রিন্সবাবু দরোজার বাইরে এলেন। হেসে বললেন, আইসেন। আইসেন হে লর্ড মহোদয়। কখন আইসাছেন? অধিক সময় নহে তো?

    বহির্বাটিতে অবস্থানকালে লর্ড বিলক্ষণ ক্ষোভ চেপে গেল। তার নজর গবাক্ষপথে। ক্ষণে ক্ষণে তার শিহরণ হচ্ছে। বলল, ডোন্ট অরি। আমি এইমাত্র আসিয়াছি।

    –সহি বাত। তবে কিনা পূজার সময় আমি দেবদ্বিজেও দেখা দেই না। তারপর মাংস আহার করি। কিঞ্চিৎ মদ্যপান।

    সাহেব হেসে কহে, জানি, জানি হে প্রিন্স। আপনি কদাপি দেখা না দিলেও চলিবে। বাই দি বাই, আপনার মিসেস কি আসিয়াছেন?

    –তিনি আমার সঙ্গে সহবাস করেন না।

    –সহমরণ তো করিবেন তিনি?

    এই প্রশ্নে কঠিনভাবে তাকিয়ে রইলেন প্রিন্স। ঠিক করলেন, এই জীবনে আর বঙ্গদেশে ফিরিয়া জাইবেন না। ফিরিয়া লাভ কি?

    সাহেব কিঞ্চিৎ সহানুভূতিসূচক স্বরে বলে বলল, ডোন্ট অরি, ডোন্ট অরি প্রিন্স মহোদয়। সময় নির্ধারণ করিবে কে কাহার সহিত জাইবে। তবে—

    –তবে?

    –তবে, আপনার রত্নটির সাক্ষাৎ পাইতে যাঞ্চা করিতেছি। তাহা হইলে কিঞ্চিৎ ক্লেশ দূর হইবে।

    –নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আমাদিগের রত্নের অভাব নাই।

    অতপর বাবুর খানসামা চাকরাদি নানাবিধ মনিমুক্তা হাজির করিল। সাহেব যাহা যাহা দেখে তাহা তাহা দেখে কহে, আর কুছু, আর কুছু।

    ঘণ্টা খানেক দেখিয়েও যদাবধি লর্ডের কুছু কুছু থামল না, খানসামা ঘেমে গেল, চাকরাদি কাঁপিত হল, তখন প্রিন্স খাটি প্রিন্সের মত হেসে বললেন, বুঝেছি। মুক্ত নয়, মতি চাহিতেছেন। খাঁটি মতিবিবি আইস।

    মতিবিবি গবাক্ষ হতে সেই আলোঅন্ধকারে এল। বিলোল কটাক্ষে যখন হাতের কাছে তার চম্পাকলির মত আঙুল রেখে গান ধরল, আ আ আ..আও মে গিরিধারি লাল, তখন সাহেব কুছ কুছ হোতা হ্যায়। কহিল, গ্রেট। গ্রেট। ইহাতে একঘণ্টা কেন, আপনার দরোজায় এক যুগও দাঁড়াইয়া থাকিতে ক্লেশ হইবে না। জীবন সদর্থক। প্রভুর মহিমা অপার।

    মতিবিবির এরপর কী হল—জানা যায় না। শুধু বিলেত হতে একপাটি জরিদার মতিপূর্ণ জুতো ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখার জন্য ইন্ডিয়ায় এসেছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ দেশে আর ফিরে আসেন নাই। শোনা যায় তিনি একটি গ্রামে উপাসনারত অবস্থায় সাধনোচিত ধামে গমন করেছিলেন। জুতোজোড়া কোন মিউজিয়ামে গিয়েছিল বা আদৌ গিয়েছিল কিনা—সুস্পষ্ট তথ্য নেই। শুধু কদিন পরে তদিয় পুত্র দেবেন্দ্রবাবুর নিকট টেলিগ্রাম আসিয়াছিল, প্রিন্স এক্সপায়ার্ড। বিলেতে মানুষ মরে না–এক্সপায়ার্ড করে– এই দু:খে দেবেন্দ্রবাবু বহুদেশ ঘুরলেও বিলেতে যান নাই। তার পিতার সমাধি দর্শন করেন নাই। সমাধি দর্শনও পুতুল পূজার সামিল। বুৎপরোস্তি নৈব নৈব চ।

    সেই মতিবিবির নাতিনিলো নাতি ওরফে গন্নিবিবি যখন আমাদের পাড়াগাঁয়ে পাড়া দিলেন, তখন চারিদিকে গণগণ ঢেড়া পিটিল, গন্নি আইসাছে। গন্নি আইসাছে। মুকিমপুর পরগণার পত্তনিদার সিকদারবাবুর তখন সবে নতুন দোতলা উঠেছে। কার্নিশে ঢেউ খেলানো পদ্মপাতা খাড়া হয়েছে। সিঁড়িতে সিংহচিহি্‌ণত আসন। এটা সিকদারবাড়ি। গুইড়ে পট্টিতে বিল্ডিংটির অবস্থান হওয়ায় এর সামনে গুড়ের হাট বসে। একজন দুজন করে যেসব হাটুরে এলো বা আসার কথা ছিল তারা দেখতে পেল, গদিঘর সাফসুতোরো করা হচ্ছে। ঝালর লাগানো হচ্ছে। একটা ঝাড়বাতিও এসেছে। তবে পড়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সেটা লাগানো হয় নাই। একটি বাঁশের আগায় ঝোলানো হয়েছিল বাড়ির সামনে। লাল শালু টানানো হয়েছিল—রাজপুত্র প্রিন্স অব ওয়েলস শুভাগমন উপলক্ষ্যে মাইফেল। তারিখ ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ। কোনো হাটুরে এই বাক্যটি পড়তে পারে নাই। সেরকম এলেম তাদের কভি নেভি। দবে লাল রঙের শালু কাপড় দেখে তাদের কৌতুক জেগেছিল।

    এই ঝাড়বাতি দেখের আমাদের বিলা এলাকার লোকজন জীবনে প্রথমবারের মতো শুনেছিল গন্নিবিবি আইছে। তারা শুধাল, গন্নিবিবি কি মাতা বসুমতি?

    -তিনি লখনৌর গন্নিবিবি।

    –গন্নিবিব কী করে?

    –ঝা না না ঝা না না করে।

    –এইটা কি জিনিস?

    –ঝা না না ঝা।

    তাইলে গন্নিবিবি ধা করে লোকের অভাব দূর করতে পারে। এইটুকু। এইটুকুতেই এলাকার লোকজন ঢাক ঢোল সহযোগে সিকদারবাড়ির সামনে এসে পড়ল। তাদের এলাকায় গন্নিবিবির আগমণহেতু দুই দিন ঢপকেত্তনের আয়োজন হল। লোকে পথের উপর কলস কলস জল ঢেলে কাদামাটি করে নেচে গেয়ে ফিরে গেল। এই পর্যন্ত। মাইফেলে কারো মতি নাই। সকলে সন্ধ্যাকালে নিন্দ পাড়ে।

    গদিঘরে গন্নিবিবির আসর বসার মত লোক আর পাওয়া গেল না। সিকদারবাবুর ডাক পড়ছে অন্দরে। তিনি হন্তদন্ত করে ছুটে গেছেন। তার ছোটো তরফ ঘরে খিল দিয়েছেন। ভেতর থেকে কিল পেড়ে বলছেন, গন্নিবিবিরে আনছ ক্যান?

    সিকদার বাবু কোঁচা সামলাতে সামলাতে জবাব দিলেন, ট্যাকা পয়সা হইছে। এখন বিবি-বাই না আনলে রাজপুত্রের মান থাকে ক্যামনে?

    –রাজপুত্র কেডা?

    –মহারানী ভিক্টোরিয়ার বড় পোলা।

    –হ্যাগো বাড়ি কই—কাড়ারগাতি, না, ডোমরাসুর?

    –বিলেইত।

    –বিলেতে কি আছে?

    –সাহেব আছে।

    –সাহেবে কি করে?

    –দণ্ড চালায়।

    –দণ্ড মানে কি?

    –দণ্ড মানে লাঠি।

    লাঠির কথা শুনে বউ ঢোক গিলল। বউ সোজা সাফটা বলে দিল, আনছ আনছ। মানসে দেখুক। তুমার যাইয়া কাম নাই।

    হুট করে দরোজা খুলে গলে। এবং তখনি সিকদারবাবুসমেত অন্দর বন্ধ হল। ক্লোজ সাইনে ডাই। বাইরে যাওয়া নিষেধ।

    . সোনার তরী : একখানি সর্প সঙ্গীত
    ------------------------------------
    গন্নিবিবি বিলা পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। কিন্তু মাইফেল নাই। তার তবলচিরা পড়ে পড়ে ঘুমায়। সারেঙ্গিদার নাক ডাকে। গন্নিবিবি বজরায় থেকে থেকে ক্লান্ত। মাঝিমাল্লারা বহুদিন পরে পুটিমাছ ধরতে ব্যস্ত। একদিন গন্নিবিবি বজরা হতে বের হলেন। বাইরে ঝুকি ঝুকি চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে থৈ থৈ জল। এর মধ্যে পদ্ম ফুটেছে। দূরে ধান ক্ষেত। সবকিছু সাফসুতোরো। এর মধ্যে কে একজন গান গেয়ে তরী বেয়ে ওপারে যাচ্ছে। কানটি খাড়া করে শুনলেন, সেই কে একজন গাইছে—

    কী সাপে কামড়াইল আমায় রে সাপুড়িয়া

    জ্বলিয়া পুড়িয়া মইলাম বিষে

    আমার বিষগুণে জ্বলেছে এ বিষ

    জুড়াইব কিসে।অ।

    হাসনা হেনা হাসতেছিল সন্ধ্যার আকাশে

    দাড়িয়ে ছিলাম কত আমি তার তরে

    ও সেই সাপ ছিল সেই রে ঝোপের আড়ে

    ওঝার পরে মিশে।অ।

    গাইতে গাইতে নাও তরী বেয়ে ওপারে চলে গেল। আর সেই সুর শুনে স্পেলবাউন্ড–সম্মোহন দশা। জলের মধ্যে পা ফেলতে যাবে আনমনে, বিপদ হতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি বজরায় বড় মাঝি পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, মাইজি।

    মাইজি থেমে গেল। তার পা থেকে জলের মধ্যে পড়ে জরিদার মতিচিহি্‌ণত জুতা। জলের মধ্যে ভাসতে ভাসতে ডুবে গেল। সেদিকে তাকিয়ে গন্নিবিবি শুধু বলে উঠল, মুঝে সাপ নে কাটা হ্যায়।

    –হা ভগওয়ান। সাপ কাটনে সে জীবন খতম। আর্তনাদ করে বড় মাঝি এক পাল্লা তাগা নিয়ে নিয়ে এলো। তাগাটা পায় বাঁধবে, না, হাতে বাঁধে দিশা পেল না। শুধু বলল, সাপ কাহা হ্যায় মাইজি? তাঁর বক্ষদেশ ফাঁকা। সেখানে নিলা দাগ।

    সাপ গান গাইতে গাইতে তরী বেয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী। উঠিতে পারিলে বলে জলে ডুবে মরি।

    গন্নিবিবি নীলা হতে হতে চেঁচিয়ে আদেশ করল, অই সাপকো বোলাও।

    তখন তবলচি সারেঙ্গীদাররা ঘুম থেকে উঠে ছুটল সাপকে খুঁজতে।

    চারিদিকে জল করে খল খল। চারিদিকে সাপ নয়–সর্প উধাও। তাঁদের খুজতে দেখে লোকসকল শুধায়, কারে খোঁজেন গো কত্তা?

    তবলচি বলে, সাপ ঢুঁড রহি হুঁ।

    লোকে বলে, তাইলে নাগপুরে যান। এইহানে ক্যান।

    সারেঙ্গীদার কেতা করে বলে, ইয়ে ঠিক সাপ নহি হ্যায়—সর্প-গায়ক।

    লোকে হেসে বলে, অ বুজছি। সর্প-গায়ক। উনি আমাগো কৃষ্ণ ঠাকুর।

    —কৃষ্ণ ঠাকুর?

    —পাগল কিসিমের গায়ক। মন চাইলে গাইতে পারে। থামাথামি নাই। তিনি গাইলে ঘরে ঘরে রাধাদের নিন্দ টুটে যায়। তারা মাথা নেড়ে বলল, ঠিক ঠিক। ঘরে থাকা দায়।

    তবলচিরা বলল, ইস কৃষ্ণ ভগবান কো হমারে নাও মে লে আইয়ে। গন্নি বিবি ইন্তেজার কর রহি হ্যায়।

    কৃষ্ণ ঠাকুর তখন চাঁই দিয়ে মাছ ধরার ধান্ধা করছিল। দুটো কচুর লতি দিয়ে খাওয়ার হাউস। পায়ে কাদা। কোমরে লেংটি। উর্ধাঙ্গ নাঙ্গা। এই রূপে এসে বলল, আমি রেডি। বলল, চাইলে চল যাই।

    কৃষ্ণ ঠাকুরের তর সইছিল না। যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই আছে। তবলচিরা তাকে অপাঙ্গে দেখে শুনে বলল, এয়য়সে লেংটি প্যহনকে আপ জা নহি সক্তে?

    –তাইলে কি লেংটি খুইল্যাই যামু?

    –রয়েল ড্রেস–রয়েল । কপরা চাহিয়ে । রাজকীয় কপরে কে বিনা গন্নি বিবি কে পাস জা নহি সকতে।

    গন্নিবিবির কাছে বিনা রয়েল ড্রেস নো যাওয়া। ফাইনাল। অনেক খুঁজে পেতে সখের যাত্রার দল থেকে যোগাড় হল রয়েল ড্রেস। মাথার একটা মুকুটও জুটল। তার আগায় হাসপাখির পালক ফরফর করছে। কিন্তু সমস্যা হল, পায়ের জুতো লাগে না, সাইজে ছোটো কিংবা বড় । আটে না। জুতো ছাড়া রাজবেশে যায় কি প্রকারে! সব দেখে শুনে তবলচিরা বলল, তো কোলকতা জাইয়ে কৃষ্ণ ভগবান।

    –জাইলে তো যাওনই যায়। কিন্তু ট্যাকা দেবে কেডা?

    এলাকার লোকজন মুখ চাওয়া করতে লেগেছে। জমিতে ফসল পুড়ে গেছে। গোলা ঘরে ধান নাই। ট্যাকসো দেওয়ার উপায় নাই। সিকদারবাবু অন্দরে আটকা পড়ছে। ভরসা সেন্ট মথুরানাথ সরকার। তার একহাতে বাইবেল—অন্যহাতে ছাই বেল। ছাইয়ে পোড়া বেল খেতে খেতে শুধালেন, কী যাঞ্চা করিতে আগমণ?

    লোকে খিন্নশীর্ণ কণ্ঠে হাত জোড় করে বলল, জুতা। জুতা। একজোড়া সু-জুতা কিন্যা দেন।

    –তোমাদিগের জুতা ক্রয়ের হেতু কি?

    –কৃষ্ণ যাবে রাধার কুঞ্জে—জুতা ছাড়া যায় ক্যামনে। মান আছে না!

    সেন্ট মথুরানাথ মাথা নাড়লেন। বললেন, ওকে। ডোন্ট অরি। কিন্যা দিতে আছি। শুধু তোমাদিগের প্রভুর মহিমাকীর্ত্তন করিতে হইবে। রাজী?

    –রাজী। রাজী। রাজী।

    -তোমরা তো সকল সময়েই রাজী রাজী। কিন্তু কখনো তো কাজের কাজী হইতেছো না ব্‌ৎসগণ। প্রভুর কথাতো কেহ বলে না।

    –রাজী। রাজী। রাজী।

    কৃষ্ণঠাকুর সেই রাজবেশ খুলে রওনা হলেন কোলকাতায়। কিছুটা নৌকায়। কিছুটা হেঁটে। কিছুটা স্টিমারে। তিনি কোলকাতায় গেলেন।

    এদিকে দিন যায়। রাত যায়। গন্নিবিবি বজরায় বাইরে বসে থাকেন। ভেতরে ঢোকেন না। পায়ে নূপুর। মাথার ভেতরে সেই সুর—কী সাপে কামড়াইল রে। আহার নাই। নিদ্রা নাই। এদিকে কৃষ্ণ ঠাকুরের খবর নাই। তিনি তখন যাত্রাপালা দেখতে ব্যস্ত। শোনা যায়–একদিন তাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছেন। তাদের সতী বেউলা পালায় বিবেকের গায়কের কাজ নিয়েছে। শ্রীমতি মিস টুয়েনটি নাইন বেউলা সুন্দরী। তারপর আর কোনো খবর জানা যায় না। মিস টুয়েনটি নাইনের একটা গান তখন বাজারে প্রচলিত ছিল, কাল তোর তরে কদম তলে চেয়ে থাকি।

    এদিকে গন্নিবিবির মাথার উপর দিয়ে চাঁদ ওঠে। চাঁদ ডোবে। শিশির ঝরে। তারা খসে। সূর্য ওঠে। গণগণে আগুন ঝরিয়ে সূর্য ডুবে। আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। তবলচিরা সারেঙ্গিদাররা চেঁচিয়ে বলে, মাইজি, ভিতরে আইসেন। মাইজী ভিতরে আসেন না। তাকে সাপে কেটেছে। অঙ্গ নীলা হয়ে গেছে। সেই সাপবিনা এই বিষ জাইবে না। সাপ আসিলে তার ভাও মিলিবে। তিনি ভিতরে জাইবেন।

    এইভাবে গ্রীষ্ম বর্ষা শর্ৎ হেমন্ত, শীত বসন্ত ঘুরে ঘুরে আসতে লাগল। আর বজরাটিও ধীরে ধীরে জলের মধ্যে মাটিব্‌ৎ গলে গলে পড়তে লাগল। লোকজনও কোনো মতে সাঁতরে উঠতে উঠতে ডুবে মরল। কিন্তু গন্নিবিবি জলে ডোবে না– জলের উপরে সেই ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দিন যায় আর গন্নিবিবি কায়া থেকে ছায়া—ছায়া থেকে মায়ায় উঠে গেলেন। লোকে এই দৃশ্য দেখে ধন্যি ধন্যি করতে লাগল। বলল, গন্নি মাইকী জয়।

    গন্নি মায়ের কথা অমৃত সমান।

    কুলদা রায় ভনে শুনে পূণ্যবান।অ।

    . একটি সম্বাদপত্রের সংবাদ : ১৮৭৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ
    ------------------------------------
    ঘটনাটি ঢাকাপ্রকাশ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের ঢাকা শহরের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র যা বাংলা তারিখ ২৫ ফাল্গুন, ১২৬৭ (মার্চ ৭, ১৮৬১) প্রথম প্রকাশিত হয়। ঢাকার বাবুবাজারে প্রতিষ্ঠিত ‘বাঙ্গলাযন্ত্র‘ নামে বাংলা মুদ্রণযন্ত্র বা প্রেস থেকে ঢাকাপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। বাঙ্গলাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকার সাভারের তেঁতুলঝোড়া গ্রামের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ব্রজসুন্দর মিত্র। প্রেস স্থাপনে তাকে আরও যারা সাহায্য করেন তাদের মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়েরডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দীনবন্ধু মৌলিক, মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর কাকা) ও মালাখানগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রামকুমার বসু অন্যতম। কারও মতে ঢাকাপ্রকাশ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ৭ই মার্চ বৃহস্পতিবার ১৮৬১ সালে, আবার কারও মতে তারিখটি ছিল, ৮ই মার্চ ১৮৬১।

    সাপ্তাহিক পত্রিকাটি প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো। এর প্রথম পৃষ্ঠার উপরে বড় আকারে ‘ঢাকাপ্রকাশ’ এবং তার নিচে ছোট আকারে ‘সপ্তাহিক’ শব্দ লেখা থাকতো। এর নিচে থাকতো একটি ঋষি বাক্য ‘সিদ্ধি: সাধ্যে সমামুস্ত।’ পরে এর সাথে আরও যুক্ত হয় ‘প্রসাদাদিহ ধূর্জ্জটে:’.ঘটনাটি শ্রবণপূর্বক ঢাকাপ্রকাশের সাপ্তাহিকীর সম্পাদক কাম প্রকাশক মহাশয় সশরীরে মুকিমপুর পরগণায় এসেছিলেন। ঢাকা হতে অকুস্থলে পৌঁছাতে পঞ্চ দিবস লেগেছিল। চোখের উপরে চশমার কাঁচ পুটুলীতে ঘষে ঘষে তারা দেখেছিলেন দূরে দূরে দ্বীপের মত ছাড়া ছাড়া বাড়ি জেগে আছে। আর তার চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। পথ নাই। ঘাট নাই। লোকজন—হাট নাই। তেজা কোনো ঠাই নাই। তার মধ্যে রাজগঞ্জ বাজার। লোকে গেছে কোথায়?—মধুমতির পাড়ে।

    বার বার ঢাকা প্রকাশে লেখা হয়েছিল—মুকিমপুর পরগণার বিলে বজরার সলিল সমাধি। আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা মারফ্‌ৎ জানিতে পারা গেল, ঐ বিল এলাকায় দীর্ঘদিবসযাব্‌ৎ একখানি বজরা নৌকা ভাসিতেছিল। দীর্ঘকাল জলে ভাসিয়া থাকিবার ফলে বজরাটির নাটবল্টু খুলিয়া গিয়াছিল। একদিন নিশীথকালে বজরাটি যাত্রীসমেত জলের মধ্যে খণ্ড খণ্ড হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়ে এবং নিশীথমধ্যে তাহা ডুবিয়া যায়। বজরাটিকে আর কেহ দেখিতে পায় নাই। তবে যাত্রীদের পরিচয় পাওয়া যায় নাই।

    এই খবরটাতে কিছু ঝামেলা আছে। দেখা যাচ্ছে—খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ। তখন বর্ষা শুরু হয়েছে। সে সময় আমার ঠাকুরদার জন্ম হওয়ার কথা নয়। তার পিতাঠাকুর স্বর্গীয় সৃষ্টিধর রায়ের জন্ম হলেও হতে পারে। তবে ঠাকুরদার যে সময়ে জন্ম আর ঢাকাপ্রকাশের প্রকাশিত খবরের যে তারিখ তাতে সৃষ্টিধর রায় নহেন, উনি সৃষ্টিধর রায়ের পিতাঠাকুর—অর্থাৎ আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা হতে পারেন সেই কৃষ্ণঠাকুর। তবে আমাদের পরিবারে কোনোকালে কষ্টি করার চল ছিল না—এখনো নাই। আমাদের জন্ম যথাতথা, বিয়ে হেথাসেথা, মৃত্যু আধা ধাঁধাঁ। আমরা এমনি এসে ভেসে যাই। সুতরাং ঠাকুরদার ঠাকুরদার নাম ঠিক ঠিক জানা যায় না। তার নাম রাম শাম যদু মদু এন্ড ব্লা ব্লা ব্লা হতে পারে।

    লোকমুখে শোনা যায়—তিনি ভালো গীত গাইতে পারতেন। একটা গীত পরবর্তীকালেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। জহির রায়হান সাহেব ১৯৭০ সালে তার বেউলা সুন্দরী সিনেমাতে ব্যবহার করেছিলেন। গায়িকার নাম –নীনা হামিদ। গানটি নিম্নরূপ—

    কী সাপে দংশিলো লখাইরেহে বিধির কী হইলো…

    সুতানলি সাপোরে ছিল

    ও তার কৃষ্ণবরণ দেহ

    সুতাসম ছিদ্র দিয়া হায় রে

    বাসরে পশিল

    ও বিধি কী হইল।অ।

    রাত্রি নিশাকালে রে সর্প

    ও ঘুমে সুযোগ নিল,

    সিথান হইতে কালিয়া নাগ রে

    পৈথানে আসিল–

    পৈথানে আসিয়া সর্প পতিরে কাটিল

    ও বিধি কী হইল। ।

    এই গানটি আমার ঠাকুরদা বেশ মনপ্রাণ দিয়ে আমাদের গেয়ে শোনাত। আমার বাবাকেও গাইতে শুনেছি। আমার বোনসকল ভালোভাবেইই গাইতে পারত। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে আমারও কিছু কিছু স্মরণে আছে। একদিন আমার কন্যাদের গেয়ে শোনাতে হয়েছে।

    লক্ষ্যণীয় : দুটৈ সর্পসঙ্গীত। কিন্তু দুরকম। দুরকম হাহাকার।

    . ট্রেজারিতে রক্ষিত আত্মজীবনী থেকে : প্রভু অপার মহিমাময়
    ------------------------------------
    সেন্ট মথুরা নাথ সরকারের একটি আত্মজীবনী হাতে লিখিত কপি ফরিদপুরস্থ কাছারিতে রক্ষিত আছে। ফরিদপুর জেলার জেলাপ্রশাসক (এই নামে কোনো অনুমোদিত শব্দ নাই, উহা ডেপুটি কমিশনার) মুহাম্মদ আহকাম উল্লাহর পাটোয়ারী সাহেবের পারমিশনপূর্বক ডাইরিটি দেখার সুযোগ আছে। ডাইরিটির ১১৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে—

    মধুমতী অত্র এলাকার ভয়ঙ্কর স্রোতোস্বিনী নদী। বর্ষাকালে মাঝে মাঝে কুম্ভীরের উৎপাত দৃষ্ট হয়। ইহার অন্তর্গত মানিকদহ এলাকায় একটা ঘূর্ণিস্রোত রহিয়াছে। উহাকে দহ কহে। মাঝেমধ্যে অইখানে নৌকা ডুবিবার খবর পাওয়া যায়। প্রতিব্‌ৎসর শস্যহানি হয়। গতকাইল শোনা গিয়াছে, একখানি বিদেশী বজরা নৌকার সন্ধান মিলিতেছে না। জলের উপর হইতে উধাও হইয়া গিয়াছে।

    আত্মজীবনীটি লেখা হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। আর তেমন কিছু জানা যায় নাই। এরপরের পৃষ্ঠায় শুধু লেখা আছে–প্রভু অপার মহিমাময়। তাহার সুসমাচার জগতে ব্যক্ত হোক। তবে ১২০ পৃষ্ঠার পরে আর কোনো পৃষ্ঠা নাই। কালের গর্ভে ছিড়ে গেছে।

    সেন্ট মথুরানাথ সরকারের আদি বাড়ি ছিল যশোহরে। জন্ম ১৮৪৩ সালে। ১৮৬০ সালে হিন্দু কলেজ হতে স্নাতক হয়েছিলেন। সে সময়ের ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ওয়ারলেস কলকাতা মিশন কর্তৃপক্ষকে এ এলাকায় একজন মিশনারি পাঠানোর আবেদন জানান। কিন্তু কেউই তখন এখানে এ কাজে আসতে রাজি হননি। অবশেষে মথুরানাথ বোস এ গণ্ডগ্রামে আসতে রাজি হন। তিনি কলকাতার ভবানীপুরে লন্ডন মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ১৮৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে নৌকাযোগে রওনা হয়ে পনের দিন পর গোপালগঞ্জে এসে পৌঁছান।

    মুকিমপুর পরগণায় দরিদ্র নমশুদ্রপূর্ণ বিল এলাকায় তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন—পাপীতাপীদের উদ্ধারের মানসে। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সেখানে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। একটির নাম মিশন স্কুল। এইখানে পরবর্তীকালে শেখ মুজিবর নামে টুঙ্গিপাড়া হইতে একটি কিশোর লেখাপড়া করতে এসেছিল। ১৯৭২ সালে সেই কিশোর নামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম হয়। মথুরানাথের নামে নয়।

    সেন্ট মথুরানাথের স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পিছনে একটি সমাধিক্ষেত্র আছে। সেখানে লেখা আছে—সেন্ট মথুরানাথ সরকার। জন্ম ১৮৪৩ খ্রী। মৃত্যু ১৯০২ খ্রী। একটি এপিটাফও ছিল। সেটা মুছে গেছে। তবে সমাধীক্ষেত্র সংলগ্ন উপসনাগৃহে কতিপয় রমণীরত্ন থাকে। তারা গীত করে—আমার যেমন বেনী তেমন রবে চুল ভেজাবো না। পূরোটা মাগনা শোনা নিসেদ। ফেলো কড়ি মাখো তেল।

    সমাধীক্ষেত্রে মথুরানাথ একটু বিশ্রামেই ছিলেন। তার চুলে ও দাড়িতে ধুলো মাটি। মাথার কাছে একটি শতবর্ষী হাসনুহেনার ঝাড়। সেখানে দুটো টুনটুনি পাখি ঘুরছে। আর চিড়িক চিড়িক করছে। মথুরানাথ সরকার নড়ে চড়ে বললেন কী চাহ ব্‌ৎস?

    আমাদের কৌতুহল ছিল—তাঁর ডাইরীর আত্মজীবনীতে উল্লেখিত ঘটনার বাকী অংশ জানতে। তাঁর গলা কিছুটা বসা ছিল। তিনি জানালেন, গন্নিবিবির ঘটনাটি তিনি শুনেছিলেন। তবে তিনি গন্নিবিবি কিনা স্মৃতি ধুসরতা হেতু নিশ্চিত নন। এলাকায় কথিত আছে—বজরাটি ডুবে যাওয়ার পরে জলের তলা থেকে ভেসে উঠল গন্নিবিবির সেই জরিদার মতিপূর্ণ সু-জুতো। কিছুটা শ্যাওলা লেগে সবুজ হয়ে গেছে। ধরতে গেলে ধরা যায় নি। পিছলে পিছলে যায়। দূরে দূরে সরে যায়। ডুবে যায়।

    কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীকুল হতে ঘূর্ণির নিচে ডুব দিল। সেখান হতে জুতাটি পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল একটি সিন্দুক। তার গায়ে আকা বাঁকা অক্ষরে লেখা—ঝা না না ঝা না না ঝা।

    ফলে এলাকার লোকসকল গভীরভাবে মর্মাহত। আশাহত। আমার নিকট তাহারা আসিল। বলিলাম, ওহে প্রভুর মেষশাবক দল, তোমরা আমার নিকট আসিয়াছ কেন? সিকদারবাবুর কাছে যাও। তিনিই তোমাদেগর পত্তনীদার।

    তাহারা বলিল, সিকদারবাবু অন্দরে আছেন। সদরে আসিবার সামর্থ্য নাই। আপনিই আমগো নিদান। ব্যাদোনা তাড়ান।

    বলিলাম, ব্যাদোনা নহে—উহাকে পাপ কহ। উহা পাপ। তোমরা প্রভুর পদতলে আশ্রয় লও। পাপ হইতে তিনি তারণ করিবেন।

    তাহারা কাঁদিয়া কহিল, প্রভু কেডা আমরা চিনি না। আপনেরে চিনি।

    –কী প্রয়োজন?

    –গন্নিবিবির জুতা আইন্যা দেন।

    –আনিব কি প্রকারে। আমার সাইধ্য নাই। উহা জুতা নহে—ব্ল্যাক ম্যাজিক।

    –তাইলে আপনে কী করিতে পারেন?

    সেন্ট মথুরানাথ বললেন, তাহারা পাপীতাপী হইলেও উহারাদের আত্মাসকল পীড়িত হইয়া পড়িয়াছে। তাহাতে আমার ক্লেশ লাগিল। কহিলাম, তোমাদিগের প্রশান্তির জন্য একখানা কাষ্ঠনির্মিত সু-জুতা নির্মিত তৈরীর ব্যবস্থা করিতেছি। আর সঙ্গে প্রভুর ক্রুশকাঠি।

    তাহারা আমার নামে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। উহারা অভয় বানীতে তুষ্ট।

    তখন বাকেরগঞ্জের বিখ্যাত সুতারমিস্ত্রী অনন্ত ঘরামি আসিল। যথাযথ পরিপক্ক সেগুন কাঠ আনা হইল। তাহা কুদিয়া কুদিয়া তৈরী হইল নৌকাসদৃশ সু-জুতা।

    সেদিন ছিল প্রভুর পবিত্র ভোজ পরবের দিবস। বহুদিন পরে এলাকার লোক সকলে পেট পুরিয়া চাটিয়া পুটিয়া ভোজন করিল। উহারা সু-জুতা জোড়াকে স্থানীয় বটতলায় স্থাপন করিল। সকলে বটতলায় আসিয়া ধ্বনিতে লাগিল—জুতা মইকী জয়।

    সে দিবসে সেখানে প্রভুর ক্রুশপ্রতীকটি লইয়া প্রবেশ করিতে পারিলাম না। বৃদ্ধ বয়সে সর্বত্র যাওয়া করা যায় না। মুগ্‌ধ বিস্ময়ে দেখিলাম—লোকে আত্মহারা। তাহাদের বসুমাতা জাগিয়াছে। বসুমতির কল্যাণে একবেলা ভালোমন্দ আহার জুটিয়াছে। ব্যাদোনা জাইলেও জাইতে পারে।

    মথুরানাথ থামলেন। একসঙ্গে বহু কথা বলেছেন বলে তার গলা ঘড় ঘড় করতে লেগেছে। একটু খুস খুস করে কাশলেনও। বয়স হচ্ছে। ফুস ফুস হাসলেন।

    রমণীরত্নবৃন্দ এসময় উপসনাগৃহ হতে বের হয়ে এল। তাদের চক্ষে কাজল টানা। তাহাতে তাকানো মানা। পায়ে আলতা। ঠোটে রং। হাতে চুরি ঝন ঝন করতে করতে বলল, ব্‌ৎসগণ, এইখানে ফাউ আড্ডা মাইরা আমাগো বিজিনেস মাটি করতি পারো না। যাও। কাটো।

    অতপর তাহাদের সমবেত লাস্যময় গীতধ্বনী সমাধীক্ষেত্র প্লাবিত হল। এবং প্রভু প্রভু করতে করতে সেন্ট মথুরানাথ নিষ্কোআন্ত হলেন। অদ্যাবধি এই সমাধীক্ষেত্র এবং উপসনাগৃহটি প্রাচীন ইষ্টক নির্মিত। দর্শন প্রার্থনীয়।

    . সিন্দুকপর্ব
    ------------------------------------
    সমাধীক্ষেত্র, উপসনাগ্রহের অদূরেই নদী। নদীর নাম মধুমতি। মধু না মতি। জ্যোৎস্না উঠলে মতির মত ঝকমক করে। তার মধ্যে শ্রীযুক্তবাবু বিজয়কুমার সিকদার এন্ড কোং বাটি থেকে দশধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে রাস্তায়। এখানে অরিজিনাল অর্গানিক আলু পটল উচ্ছে ঝিঙ্গে কুমড়ো বসে। কিছু ঢেপের খই। আর বসে গুড় ও দীঘা ধানের চিড়া। ঠিক সামনেই মোটা খিলান ঘেসে আইকা অলা বাঁশে পুরনো জুবুথুবু মার্কা একটা ঝাড়বাতি ঝোলে। আর পতপত করে ওড়ে লালশালু। একটু খেয়াল করলেই ঠাওর করা যায়—শালু কাপড়ে কিছু বাক্য ছিল। কালের মত্ততা হেতু তা ধুসর। গদি ঘরে এখন মাছের আড়ত। জলের গন্ধ। আষটে মন্দ। লোকে বলে অন্দরমহলটি এখনও বন্ধ। সিকদারবাবু আর বাইরে আসেন নি।

    লোকে সিকদার বাবুর বাটির সামনে কিছুদিন ঘোরাফেরা করে কালো মুখে ফিরে এলো। সেন্ট মথুরানাথ সরকারের সমাধীক্ষেত্রে ঢোকা যাবে না। সেখানে ধারাবাহিক চুল ভেজাব না। এর মধ্যেই একদিন আমাদের ছোটো ছোটো পায়ের আঘাতে পুরনো সিন্দুকটির বন্ধ দরোজা সামান্য খুলে গেল। এর পরে একটু টান মারতেই দরোজাটা পুরোটা খুলে গেছে। জংধরা হেতু লোহার দরোজাটি খুলে আমাদের ছোটো ছোটো হাতের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। ভেঙে যাওয়ার শব্দ হয়েছে

    শব্দ শুনে রান্না ঘর থেকে জননী ছুটে এসেছে। একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে—সিন্দুকটি একবারে খোলা। সিন্দুকটিকে কেউ এর আগে খোলা দেখেছে বলে কোনো ইতিহাস নেই। এর কোনো চাবিও ছিল না। আর সিন্দুকে রাখার মত কিছু সহায় সম্পদ ছিল না। এই একটি মাত্র সিন্দুক ছিল এই রাজগঞ্জ এলাকায়। লোকে এ কারণে মান্য করে। বছরে একবার বিশ্বকর্মা পূজার দিনে তেল সিঁদুর পড়ে।

    সিন্দুকটার মধ্যে কিছু পুরনো অন্ধকার। ঠিক অন্ধকারও নয়—গন্ধের ছায়া। জননী এই ছায়া দেখে মাথা নাড়ে। আর বলে, মায়া মায়া। আর টিকটিকির দুটো খোসা কাঁপতে কাঁপতে সিন্দুকের বাইরে এসে পড়ে।

    এর মধ্যে আমাদের পাগল ঠাকুরমা পুকুর পাড় থেকে ছুটে এসেছে। কাঁপতে কাঁপতে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে সিন্দুকের উপর হামলে পড়েছে। ভিতরেটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছে। পায়ের পাতায় আলতা রঙের মত রক্ত এসেছে। দেখে আমাদের বোন চেঁচিয়ে বলে, অ ঠাকুরমা, কি করতিছো। ওটা মদ্যি মাতা দিও না।

    শুধু মাথা কেন, পারলে ঠাকুরমা নিজেই সেঁধিয়ে যেতে চাইছে সিন্দুকের মধ্যে। মা জননী ঠাকুরমা হাত ধরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ঠাকুরমাকে সরানো গেল না। নিজেই সরে এলো। কপালের একপাশটা ছুলে গেছে। মুখে কালিঝালি। দুহাতে কালো কালো গুড়োর। সেগুলোকে দেখিয়ে বহুদিন পরে সুস্থ মানুষের কথা বলে উঠল। মাকে শুধাল, দেখতো বউমা, জরি দেখতি পাইতিছো?

    ঠাকুরমাকে কথা বলতে দেখে মা জননী দুর্গা দুর্গা বলে কেঁদে উঠেছে। শোনা যায় ঠাকুরদার সঙ্গে পশ্চিম থেকে চলে আসার পরে এই বাড়িতে আর কথা বলে নি। গুমরে গুমরে থেকেছে। এই ধরনের আরও কিছু রটনা প্রচলিত আছে। সেটা বড় মহলের কথা।

    ঠাকুরমা মাকে শুধাল, দেখতো বউমা, জরি দেখতি পাইতিছো?

    আমরা জরি দেখতে চেষ্টা করি। কালো কালো গুড়ো চোখে পড়ে। মা ঠাকুরমাকে দেখতে চেষ্টা করে।

    ঠাকুরমা বলে, মতি দেখতি পাইতিছো?

    আমরা মতি খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। কালো কালো কালো গুড়ো।

    ঠাকুরমা চেঁচিয়ে বলে—জরিদার মতিপূর্ণ সু-জুতা দেখতি পাইতিছো?

    ঠাকুরমা হাতে কালো কালো গুড়ো। জরিও দেখা যায় না। মতিও না। সু-জুতার লেশমাত্র নাই। ছিল কিনা বলা মুশকিল। থাকলেও শত বছরে সিন্দুকের মধ্যে থেকে থেকে কালো হয়ে গুড়ো হয়ে চিহ্‌ণহীন হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাকুরমা আমাদের দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। যেন আমাদের একটি জবাবের উপর নির্ভর করছে তার জীবন অথবা মরন।

    মা জননী ঠাকুরমার দুহাত ধরে বলে, হ্যা মা, ওটা জুতা। সু-জুতা। আমরা সবাই দেখতি পাইতিছি।

    ঠাকুরমা চোখের সামনে গুড়ো গুলো ধরে আবার জানতে চায়, এটা পুরুষ মাইনসের, না, মাইয়া মাইনসের জুতা?

    মা জননী বলে, ওটা মাইয়া মাইনসের জুতা।

    –গন্নিবিবির জুতা। তোগো ঠাকুরদার না। তাইলে তোগো ঠাকুরদা নিজের জন্যি জুতা কেনে নাই। জুতা পইরা গন্নি বিবির লেগে দেখা করতে যায় নাই। আমারে ফাঁকি দেয় নাই। দুর্গা। দুর্গা।

    ঠাকুরমা একটি বড় করে শ্বাস নেয়। তার বুক থেকে বহুযুগের চেপে থাকা একটা পাথর নেমে গেছে। এইবার ঠাকুরমার কাঁপুনি থেমে যায়। বহুদিন পরে তাকে হাসতে দেখা যায়। হাসতে হাসতে গুড়ো গুলো বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। গুড়োগুলো একটি একটু করে হাওয়ায় ওড়ে। তারপর মাটিতে ঝরে পড়ে। পায়ে পায়ে মুছে যায়।
  • Kulada Roy | 67.243.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১২ ০৭:৪৪490931
  • ঢেঁকি লক্ষ্মীর বেত্তান্ত
    ------------
    কুলদা রায়

    হীরাবাড়ি আমার বাবার মামাবাড়ি। সে বাড়ি ভরা বাগান। বাগান থেকেই গাবগাছটি কেটে আনা হল। ফলমন্ত গাছ। তখনো পাকা গাব ধরে আছে। বাবার মেজো মামী একটু গাইগুই করে করেছিল। বাবামশাই হীরাবাড়ির সবেধন একমাত্র ভাগ্নে। চাইলে আমগাছটাও কেটে আনা যায়। মামীর দিকে চেয়ে বাবার মেজো মামা হুক্কা মুখ থেকে নামিয়ে শুধাল, কি করবি গাছ দিয়া?
    বাবা গাছের গোড়া কাটতে কাটতে বলে দিল, পুকুরে ফেলব।

    সুতরাং গাছটি কাটা হল। ডালপালা ছেটে বাবার মামারা কাঁধে করে গাবগাছটি আমাদের পুকুরেই ফেলে এল। পুকুরে পড়ে শব্দ হল—ঝপ্পাৎ। আমরা গাব খেতে খেতে বললাম অ বাবা, এইবার কী করবা?
    বাবা বলল, ঝপ্পাৎ।
    গাছটার কথা এইভাবে শেষ হয়ে গেল। আর কিছু নয়। জলের মধ্যে তলিয়ে গেলে সব কিছু গলে যায়। তারপর নাই।

    এর মধ্যে আমাদের বাড়ি বদল হয়েছে। দোতলা থেকে আমরা প্রভু যীশুর গোয়াল ঘরে উঠে এসেছি। দাড়িয়াল রামকৃষ্ণর ছবির উপরে কার্ল মার্কসের ছবি বসেছে। রান্না ঘরটি ভেঙে আনা হয়েছে। হীরাবাড়ির বাঁশঝাড় থেকে বাবার মামারা খুশি মনে বাঁশ কেটে দিয়ে গেছে। সেই বাঁশ ছেঁচে ছুঁচে হয়েছে রান্না ঘরের খুঁটি। তার উপরে চাল। চালে পোড়া মাটির টালি। চারদিকে দরমার বেড়া।

    এর মধ্যেই কদিন পরে পুকুর থেকে তোলা হল গাবগাছটি। ততদিন গা থেকে বাঁকলগুলো খসে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে কাঠের কঙ্কাল। আর বাকলপচা গন্ধ। কদিন ছায়ার মধ্যে পড়ে থাকল।

    গন্ধ যেদিন উবে গেল—সেদিনই হরিদাস পিসেমশাই এলেন। গাবগাছটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। একটি কুড়াল দিয়ে কেটে কুটে গড়ে ফেললেন ঢেঁকি। ঢেঁকির মাথার দিকে মোনাই। কামার বাড়ি থেকে আনা হল লোহার খাড়ু। আর নোটটি তৈরি হল মাটির কলসির ভাঙা চাড়া দিয়ে। লেপে পুছে সত্যি সত্যি আমাদের রান্না ঘরের পশ্চিম ধারে ঢেঁকি বসল। বাবা মাকে বলল, এই নেও তোমার ঢেঁকি। দেখে মায়ের চোখে জল। জীবনে আর কিছু নয়—একটি ঢেঁকির সাধ ছিল। নতুন বাড়িতে এসে পূর্ণ হল।

    ঘুল্লীবাড়ির বালা ঠাকুরুণ সব টের পান। তিনি এলেন তেল সিন্দুর দিতে। তার নাকে নোলক দোলে। মাথায় লম্বা ঘোমটা। একটু বয়েস হয়েছে। চুল পাকে নি। তেল সিন্দুর মেখে গান ধরলেন--

    তোমার ঢেঁকি হইলে যাইতেম বেঁইচে
    রাঙা চরণতলে নাইচে নাইচে ।অ।
    ঢিপ‍‍ঢিপাইয়ে যাইতেম মারা, মাথা খুইড়ে হইতেম সারা—
    কানের লগে কচ্‌কচাইয়ে মানটি তোমার নিতেম যাইচে ।অ।

    গান শেষে বালা ঠাকুরুণ বললেন, এবার আলা চাইল আনোতো বউমা। নোটে দিয়া পাহার দেওন করতি পারি।
    মা তখন এদিন ওদিক চায়। হাড়ি কুড়ি হাতায়। গলা সরু করে বলল, সেদ্ধ চাইলে হইবে না খুড়ি?
    বালা ঠাকুরণ এক গাল হাইসা কয়েন, সে কি কইরা হয়। ত্যালের কাম কি জল দিয়ে হয় গো মা?

    তিনি নিজের বোঁচকাটি খুললেন। বোঁচকার মধ্যে বোঁচকা। তার মধ্যে বোঁচকা। বোঁচকার মধ্য ছোটো ছোটো পুট্টুলী। একটার মধ্যে রূপেশ্বর ধান। আরকটার মধ্যে লক্ষ্মী দীঘার আলা চাল। লক্ষ্মীদীঘা চাল বের করে মায়ের হাতে দিলেন। বললেন, তুমি লক্ষ্মীমতি বউ। লক্ষ্মীর পা দিয়া পাহার দেও তো মা। তোমার পায়ের লক্ষ্মী ফুটুক।

    ঢেঁকির নোটে আলা চাল ঢেলে দিয়েছে মা। সেখানে বসেছেন বালা ঠাকুরুণ। ঢেঁকির গোড়ায় মায়ের পা। পাহার দিতে গিয়ে থেমে গেছে। বালা ঠাকুরুণ বলেন, কী হইল মা। পাহার দেও।
    মা বলল, মাইজা জেঠী আসে নাই।

    মাইজা ঠাকুরমা এল। তিনি আমাদের মাইজ্জাদ্দি। এসেই রেগেমেগে বলল, করতিছ কি তুমি? ঢেকির পাহারের ২০ গ্রামের মাটি কাঁপে। তুমি কি আমার দালান বাড়ি ভাঙবার চাও?
    ঢেঁকির পিছন থেকে সরে এল মা। নোটে মধ্যে আলা চাল। বালা ঠাকুরুণ বোঁচকা বাঁধতে শুরু করেছেন। পারুল কাকীমা থির হয়ে হয়ে চেয়ে আছে। বড়দ্দি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

    ঢেঁকিতে পাহার পড়ল না। আমেনা বুবুর আম্মা বড় চাচী এসেছেন। তার মুখটি খুব খুশী খুশী। উঠোন থেকে মাকে ডেকে বললেন, তাইলে আমগো পাড়ায় ঢেঁকি আইসে। চাইল কুটতি আর নীচা পাড়ায় যাওন লাগবে না।

    শুনে ঢেঁকির মুখে বাক্যি নাই। ঢেঁকিটা নড়ে না। চড়ে না। বড়চাচী ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।

    বালা ঠাকুরুণের বোঁচকা বাঁধা হয়ে গেছে। মুখে এক খিলি পান দিতে গিয়ে দিলেন না। নোটের দিকে এগিয়ে গেলেন। খুড়ে খুড়ে আলা চালগুলো নোট থেকে বের করে আনলেন। ঘাড় নীচু করে দেখে নিলেন আর একটি দানাও সেখানে পড়ে নাই।

    সেই চালগুলো মা শিল নোড়ায় বাটলেন। একটি থালায় জলে গুলে পিঠুলি তৈরী করলেন। মাথা নিচু করে ঢেঁকিটার চারদিকে খাড়লেন লতা-পাতা। আর টগর ফুলের ছবি। একটি পক্ষীরাজের ছবি খাড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখন ইচ্ছেটা নেই।

    আমেনা বুবুর ছোটো বোনটি এক ফাঁকে পিঠুলির থালে পা রেখেছে। গুটি গুটি পা ফেলেছে লেপাপোছা ঘরের মেঝেতে। হেঁটে হেঁটে বারান্দা অব্দি চলে গেছে। সারা ঘরটি জুড়ে পায়ের ছাপ পড়েছে। লাক্ষ্মী ঠাকুরুণের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে অতি সাবধানে পা ফেলে বালা ঠাকুরুণ বেরিয়ে গেছেন। তার তাড়া আছে। ও পাড়ার মেজ বউ বাড় বউ ঘুল্লিবাড়ি চাল কুটতে আসবে। যেতে যেতে বালা ঠাকুরুন বলে গেছেন, লক্ষ্মী ঠাকুরুণ আইসা পড়ছে। ঠেকাইয়া রাখবা কেমনে!

    বালা ঠাকুরুণ উঠেনের মাঝখানে এলে তার গায়ের পরে দালানটার ঘন ছায়া এসেছে পড়েছে। আযুফা টুপ টুপ করে সঙ্গে হেঁটে এসেছে। তার পায়ে পিঠুলী গোলা। ছায়ার মধ্যে পা-টি কালো কালো দেখায়। রোদ্দুরের মধ্যে শাদাকে আরো শাদা করে। এই দেখে আযুফা একবার ছায়ার মধ্যে একবার রোদ্দুরের মধ্যে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। তালি দিয়ে বলছে, পিঠা লক্ষ্মী। পিঠা লক্ষ্মী।

    লক্ষ্মীর পাড়া ধরে লক্ষ্মী পূজার সময় চুনু পিসি এলো দখিন দেশ থেকে। কচা নদী থেকে কালিগঙ্গা—কালিগঙ্গা থেকে মধুমতি নদীর বেয়ে পিসিদের নৌকাটি এসেছে। বাঁধা মাঝি সোনা মিয়া মাঝে মাঝে নামাজ পড়ে। আর মাঝে মাঝে সুর করে গীত গায়। শুনে চুনু পিসি বলে, সোনা ভাই, আপনে কী গান করতেছেন?
    সোনা মিয়া কথা ভরে না। গানটি একটু জোরে ধরে—
    ও ধান ভানোরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
    আমি নাচি ঢেঁকি নাচে হেলিয়া-দুলিয়া,
    ও ধান ভানোরে।

    বেলা পড়ে আসে। নদীতে ভাটা গোন লেগেছে। সোনা মিয়া বলে, ভাবীজান, আপনের বাপের বাড়ি ঢেঁকি আছে?
    পিসি হাই ছেড়ে বলে, নাই। নিচা পাড়ায় আছে। ঘুল্লিবাড়ি।

    সোনার মিয়া আরেকবার গীতটি ধরার আগে বলে, ফরিদপুইরা পিঠা বড়ো মিঠা।

    দীর্ঘ পথ বেয়ে নৌকা এসেছে। ঢেঁকিটা দেখে চুনু পিসি খুশীতে বাক বাক। মাইজাদ্দির ঘর থেকে আলা চাল এনে নেটে রাখল। মাইজ্জাদ্দি বসেছে নোটের কাছে। চুনু পিসি গোড়ায়। আর চুনু পিসি ঢেকির গোড়ায়। শব্দ হল—কিক।

    সেই প্রথম আমাদের ঢেঁকিতে চাল কোটা হল। চুনু পিসি পিঠা বানাল। মাইজাদ্দি প্রথম খোলার পিঠা অন্ধকারে ছুড়ে দিল। ভুত পিচাশে খাবে। সে পিঠার বড়ো সুঘ্রাণ। আযুফা সেই রাত্রিরেও টের পেয়ে গেছে। টুপ টুপ করে বড় চাচীর সঙ্গে হাজির। ঝোলা গুড় দিয়ে পিঠা খেতে বসেছে। বাইরে চাঁদ ফুটেছে। চুনু পিসি দালানের বারান্দা থেকে হেঁকে বলল, বৌদিগো, ঢেঁকিটা খুব সুন্দর। এ রকম লক্ষ্মী ঢেঁকি মোগো দখিনে নাই।

    ঢেঁকিটা সত্যি সত্যি খুব লক্ষ্মী। মা সকালে দুপুর সন্ধ্যায় রান্না করে। তেল হলুদ ছিটে আসে। ঘরের মধ্যে মেথি, ধনিয়া আর তেজপাতার গন্ধ ম ম করে। ঘন বর্ষায় দরমার বেড়া ফুড়ে বৃষ্টির ছাট ঢোকে। তীব্র শীতের মধ্যে ঠাণ্ডা হাওয়া আসে—সব কিছু কুঁকড়ে যায়। গরমের মধ্যে হাসফাস করে ওঠে চারিদিক। এর মধ্যেই মা ডালের ঢোঁড়ন দেয়। কচুর লতির ছেচকি করে। রান্ধুনি দিয়ে লাউ রান্না হয়। ভাদুরে তালের বড়া উম উম করে। তিনবেলা লেপে পুছে মেঝে টেঝে সোর করে রাখে। এর মধ্যে আযুজা আসে আমেনা বুবুর সঙ্গে। বড় চাচীর সঙ্গে। ঢেঁকির উপর বসে বসে পাক্ষীরাজে চড়ে। ঠিক নিচে নোটের ভিতরে দুটো কোলা ব্যাঙ নিরবে ঘুমায়। মিনি বিড়ালটা গোড়ার দিকে বসে থাকে। মিউ মিউ করে। দুপুর হেলে গেলে ঢেঁকিটার গা ধুয়ে মুছে মা সিনানে যায়। সিনান থেকে ফিরে ঢেঁকির কপালে একটা চন্দন ফোটা পড়ে। চন্দন বলে, পেরণাম হে মা জননী। আযুফা তার কপালটা এগিয়ে দিয়ে বলে, আমালে একটা দেও।

    ঢেঁকিটায় পাহার পড়ে না বলে কারো মন ভার নেই। এ বাড়িতে একটা ঢেঁকি আছে—এই জেনেই সবাই খুশি। বড় চাচী মাঝে মাঝে বলেন, আমগো আযুফা বড় হইলে এই ঢেঁকি পাহার দেবে। মাইজাদ্দি ঠুক ঠুক করে হেঁটে আসে দালানের বারান্দা থেকে। বলে, ঢেঁকি পাহার দিবা না। পাহারে দালান নইড়া যাবে।

    এর মধ্যে চুনু পিসি চলে গেল। যাওয়ার দিন মায়ের গলা ধরে একটু কাঁদল। রান্না ঘরে ঢুকে বলল, এইভাবে অযত্নে ফেইলে রাইখো না গো বউদি ঢেঁকিটারে। হ্যারও জেবন আছে। হেলা করলি টের পায়। যত্ন কইরো।

    মাইজাদ্দি বলল, দুগ্গা দুগ্গা। সোনা মিয়া বলল, লা ইলাহা সোবহানকা আন্না ইন্নি কুন্তু মিনাজজ্জলেমিন। দখিনে নৌকা চলে গেল।

    কিন্তু দিন দশেক পরে নৌকাটি আবার ফিরে এলো। সোনা মিয়া ফেরত এসেছে। সঙ্গে এনেছে বরিশালের দুধ কলম ধানের আলা চাল। এক গাল হেসে বলল, ভাবীজানগো আপনেগো ফরিদপুইরা বড় মিঠা।

    ঘুল্লীবাড়ি থেকে আলা চাল কোটা হল। সোনা মিয়া পিঠা খেয়ে বলল, এমুন পিঠা মোরা সাপল্যাজায় খাই নাই কুনোকালে। মোগে পিঠা পাডিসাপটা।

    সোনা মিয়া তিনদিন পরে ভোর বেলা নৌকা ছাড়বে। তার আগে কালুদাদা, শুককাকা আর লিকির বাবা ঢেঁকিটাকে ধরে নৌকায় তুলে দিল। সেদিন ভোর বেলা সূর্য তখনো ওঠে নি। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মাঠের মধ্যে ঠাঠা পড়েছিল। তার বারুদগন্ধ এখনো বাতাসে ভাসছে। আযুফা ঘুমিয়ে আছে। বড় চাচী নামাজ পড়ছেন। সোনা মিয়া বলল, যাইগো ভাবী। দোয়া কইরেন। ফরিদপুইরাঁ ঢেকি—হয় না কোনো মেকি। চিন্তা কইরেন না।

    আমাদের মা কখনো চিন্তা করে নাই। রান্না ঘরটাও করে নাই। নোটটাও না। বাড়িটাও না। ছোট্ট আযুফাও না। মিনি বিড়ালটাও না। কোলা ব্যাঙ দুটূ না। দরমার বেড়াও না।

    ঠিক পরদিন বিহান বেলা আমাদের উঠোনে নারদ গোসাই এলেন। হিমালয় থেকে এসেছেন। হাঁপিয়ে গেছেন। মাথায় ধরাচূড়া। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। নারদ গোসাই বলল, এ বাড়িতে কেউ নাই?

    মা ঘাটে ছিল। নারদ গোসাইয়ের গলা শুনে ছুটে এলো। মাকে দেখে বলল, চারটে ফেনা ফেনা ভাত ফুটাও তো বউদিদি। ঢেঁকি ছাটা চাইলের ফেনা ভাত। খাইয়া নেল্লা হই।

    মা কিছু বলল না। মাইজাদ্দি দালান থেকে বের হর। বলল, এ বাড়িতে ঢেঁকি নাই। ঢেঁকি ছাটা চাইল পাইবা কই! হাউস দেইখা বাঁচি না।

    নারদ গোসাই একটু থম মেরে গেল। তারপর বলল, তাইলে তোমাগো ত্যালের বাটিটা দেও। চানটা সাইরা আসি।
    নারদ গোসাই খুব ডলে টলে গায়ে তেল মেখেছে। মাজায় বেঁধেছে লাল গামছা। মাকে বলল, তুমি রান্নার জোগাড় করতি লাগো। আমি আসতেছি।
    সেই বিহানবেলা নারদ গোসাই সুড় সুড় করে পুকুরে নেমে গেল। শান্ত পুকুর। পাড়ে বইন্যা গাছ। আর পাড়ে তালগাছ। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে টুপ করে ডুব দিয়েছে নারদ গোসাই।

    এর মধ্যে ঘুল্লীবাড়ির বালা ঠাকুরুণ এসে পড়েছেন। বগলে বোঁচকা বুঁচকি। বোঁচকার ভিতরে বোঁচকা। তার ভিতরে বোঁচকা। তার মধ্যে পোটলা পুটলি। একটাতে রায়েন্দা ধান। আরেকটাতে ষাইটা আউশ। আলা না-- সেদ্ধ।

    মা বলল, ধান দিয়া কি করবেন গো জেঠি?
    বালা ঠাকুরুণ হাসলেন। বললেন। ঢেঁকি ছাটা চাল বানাইবা। নারদ গোসাই আইছে। হারে ফেনা ফেনা রাইনদা দেবা।
    --ঢেঁকি কনে পাবো?
    --হেইডা তোমার ভাবনা কি? নারদ গোসাই জানে। তুমার ঢেঁকি আসতেছে।

    সত্যি সত্যি ঢেকি এল। পুকুর থেকে উড়ে। পক্ষীরাজের মত ডানা মেলে। সড় সড় শব্দে। সঙ্গে নারদ গোসাই। গা থেকে জল ঝরছে। হাসছে।
    রান্না ঘরে ঢেঁকিটা এসে গেল। গামছা দিয়া গা মুছতে মুছতে নারদগোসাই বলল, ঢেঁকিটার চউক্ষে একটা চন্দন ফোটা দিয়া দাও।

    বালা ঠাকুরুণ বসেছেন মোনাইয়ের সামনে। মা পিছনে। ঢেঁকির গোড়ায় পা রেখেছে। নোটে আলা চাল। বালা ঠাকুরুণ মুখে এক খিলি সাচি পান পুরে নিলেন। বললেন, দুগ্গা দুগ্গা। মা ঢেঁকিতে পাহার দিয়েছে। পাহার পড়েছে। কিক। কিক।

    আযুফা আমেনা বুবুর সঙ্গে এসেছে। বড় চাচী আসেন নি। নামাজ পড়ছেন। আযুফা উঠোনময় ছোটো ছোটো পা ফেলে ঘুরছে। আজ তার দাওয়াত। নারদগোসাই তার সঙ্গে ফেনাভাত খাবে। আযুফা হাততালি দিয়ে বলছে, লক্ষ্মী লক্ষ্মী।

    আমরা শুনছি, পক্ষী। পক্ষী।
  • dd | 110.234.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১২ ১৪:৫৪490932
  • কুলদা বাবুর লেখা পড়ে যেমন হয় - অদ্ভুর গা সিরসিরে ভালো লাগে।

    তবে পরপর কয়েকটি লেখা পড়ে মনে হয়,শুনছেন কুলদা বাবু ? আপনি কি এই আপনার ছোটো বেলা আর জলে ভাসা গাঁয়ের থেকে কখনো বেড়োবেন না? আপনারে মাউসে আম্রিকান নগরদৃশ্য কেমন হয় - সেটাও জানতে চাই।
  • porimanob | 67.243.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১২ ১৮:৪১490934
  • এ ব্রিফ ডাইরি অফ হারিকেন এই বিভাগের সমস্ত লেখা
    কুলদা রায়

    ২৫ আগস্ট, ২০১১
    ---------------

    নিউ ইয়র্ক হাতে হারিকেন নিয়ে উড়িতেছে। নো বাস। নো টেন্র। নো প্লেন। নো ক্লেইম। বুঝলা বাপা, আইরিন ইজ কামিং। আইরিন আসিতেছে। লে লে লে হালুয়া।

    --আইরিন ক্যাডা?

    --মিস আইরিন।

    এই পর্যন্ত শুনিয়া বেঞ্জামিন বেনী দাঁড়াইয়া গেল। বেনী টলিতেছে। এখন তাহার টলিবার সময়। বেনী মাথাটি একটু ইষত ঝুকিয়া পড়িল - বোঁ করিয়া কহিল, মিস আইরিন ইজ সেক্সিয়ার দ্যান মিস সাকিরা।

    সাকিরা গাহিয়াছে, হিপ ডোন্ট লাই। সাকিরা বেনীর দেশি। কলাম্বিয়ার মেয়ে। গৃহহীন বেনীর প্রিয় বন্ধুও বটে। সুতরাং বেনী কখনো মিথ্যা কথা বলিতে পারে না। বেনী ইজ অলায়েজ রাইট। আইরিন নামে ঝড় আসিতেছে - তাহা মোটেই ঝড় নহে, কড় কড় নহে, ফড় ফড়ও নহে। তাহা মিস আইরিন নাম্মী এক সেক্সি লেডি। ঘাগরা তুলিয়া বেলি ড্যান্স দিতে পারে। গাহিত পারে - হাওয়ামে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মল মল ও যায়ে।অ।অ।অ।অ। নিউ ইয়র্ক এই গান শুনিয়া ড্যান্স দেখিয়া ভাবের ঘোরে উড়িতেছে। আর বেনী ঢুকু ঢুকু রামের বোতল চুমিতেছে। তাহার সাকিরা আসিবে। তাহার শূন্যজীবনে পূন্য করিয়া দিবে। প্রথমবারের মত কোনো রমনী কহিবে--হাই ডার্লিং। আই লাভ ইউ।

    ২৬ আগস্ট, ২০১১
    ----------------

    লোপেজের মাথা খারাপ। নতুন গাড়িটা নিয়ে ছুটে এসেছে। ধা করে ছুটে এসে বলেছে, রায়, তুমি কি ফিওনাকে দ্যাখছো?

    ফিওনা চেয়ারের উপরে ঠ্যাং তুলে টেক্স মেসেজ করছিল। মুখ না তুলেই আওয়াজ দিল, হেরে কেরে ক্যাট ক্যাট।

    লোপেজ ফিওনার ঠ্যাঙ্গে হামলে পড়ল, এলেনা খবর পাঠাইছে। বুঝলি ছুড়ি। এলেনা খবর দিছে।

    ফিওনা উঠে খাড়াল। একপাক নেচে বলল, কী খবররে ব্যাটা। এইরকম? আমার ড্যান্সের মত?

    লোপেজ জিব কেটে বলল, আও ছি। এরকম বলে না মেরেজান। শি ইজ মাই এক্স ওয়াইফ। তারে আমি মিস করি।

    --হ্যায় কি কইছে হেইডা কইয়া ফ্যালা মাউড়ার পো। বেশি ভ্যাড় ভ্যাড় করিস না।

    লোপেজ ফোন থেকে এলেনার ছবি বরে করে দেখাল। এলেনা হাসছে। আর লোপেজ কাশছে। পঁচিশ বছর আগেকার ছবি। চুক চুক করে চুমু খেলে। ফিওনা বলল, আমার চাইয়াও সুন্দর রে হেই নটি গার্ল?

    --তুমি অইলে সুন্দর না, সুন্দরের মা। কইতে পার সুন্দরের খুড়ি মাও।

    শুনে ফিওনা জব্বর খুশী। লোপেজকে ধরে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করেছে। নাচ থামিয়ে লোপেজের ইনবক্স থেকে পড়ছে, এলেনা মেসেজ দিয়েছে, ডার্লিং লোপেজ, জরুরী জিনিসপত্র কিইন্যা স্টক করো। শুকনো খাবার, পানির বোতল, ফ্লাশ লাইট, ম্যাচ লাইট, মোমবাতি, টিস্যু পেপার, জুস, ওসুদপত্তর ইত্যাদি ইত্যাদি।

    লোপেজ পড়ে মিচকি মিচকি করছে। আর ফিওনা মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে, খাসা বলছে। বেড়ে বলছে। ভাল বলছে। লক্ষ্মী মাইয়া। এই মাইয়ার তুলনা নাই।

    সুতরাং লোপেজ ছুটল গ্রোসারীতে। সঙ্গে ফিওনা। গ্রোসারীতে লম্বা লাইন। তার আগামাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। গাড়ি নিয়ে এ গ্রোসারি থেকে সে গ্রোসারিতে যায়। সবটাতেই ভিড়। ঠেলে ঢোকা যায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এই ভিড় দেখেই দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ক্লান্তি দূর করার জন্য একটা মদের দোকানে ঢুকলো। সেখানে কোনোক্রমে ঢুকে দুজনে দুবোতল গিলল। গিলে দুজনের মনে হল - এখন মদ সংগ্রহ করাটাই ইমারজেন্সী। তারা গাড়ি ভর্তি করে মদ স্টক করে ফেলল। লোপেজ বলল, আর চিন্তা আছে।

    --নো। এভিরি থিং ইজ অলরাইট। আসুক হারিকেন। আমাগো আর টেনশন নাই। প্রিকওশন নেওয়া শেষ। তবে?

    --তবে কিগো ডার্লি?ং

    --একটা বাইবেল কেনন দরকার।

    --বাইবেল কিন্যা লাভ কি। তার চাইয়া চল একটা চার্চ কিন্যা ফ্যালাই।

    ওরা দুজনে মদ গিলতে গিলতে চার্চের খোঁজ করতে লাগল।

    এর মধ্যে সন্ধ্যাসন্ধী গ্রোসারীর স্টকও শেষ। লোকজন কিনে কেটে বাড়ি ফিরে গেছে। গ্রোসারিগুলোতে ঝাপ পড়ে গেছে। আর এ সময়ের মধ্যে যারা কেনে নাই তাদের হাতে সত্যি সত্যি হারিকেন।

    ২৭ আগস্ট, ২০১১
    ---------------

    আকাশটা গুমোট। গরম গরম লাগতেছে। ছিটে ছিটে বৃষ্টি হইতাছে। ওকাম্পো নামের মেয়েটা রাস্তায় ব্যাগপ্যাক নিয়ে অপিক্ষা করতেছে। তার বন্ধুর গাড়ি নিয়া আসনের কথা। হ্যার খবর নাই। হালায় কি অন্য মাইয়ার লগে কি অন্য স্টেটে পালাইলো? ওকাম্পো তাইলে অখন কি করে?

    এর মইদ্যে আলেক্স আইসা পড়ছে। ওকাম্পোরে দেইখা কয়, হ্যাল্লো মেরেজান। খাড়াইয়া আছ ক্যান?

    --ইভাকুয়েশনে যামু।

    --তাইলে দেরী কইরো না। আইসা পড়।

    ওকাম্পো ব্যাগপ্যাক নিয়া আলক্সের গাড়িতে উইঠা পড়ল। তার পেয়ারা জানেমনের আসনের কথা ভুইল্যা গেল। আলেক্সের গালে চুম্মা খাইয়া বলল, তাইলে আমরা বাঁচতেছি।

    --বাঁচতেও পারি। নাও বাঁচতে পারি। হেইডা নিয়া চিন্তা কি? হেইডা নিয়া চিন্তা করবো প্রভু যীশু আর সরকার। গভর্নমেন্ট। গাড়ি উড়ে চলল মল মল কইরা।

    হেয়ার মইদ্যে সিমন ফোন দিল। বলল, রায়, তুমার কাছেপিঠে কি টয়্র ভেস্টরে দ্যাখছো?

    --হ্যারে দিয়া অহন কি করবা?

    --হ্যারে দরকার। আইরিন তো আমাগো মাইরা ফেলাইবে। হ্যার আগে ভেস্টের লগে আখেরি মহব্বতটা সাইরা লই। আর চান্স তো পামু না জান।

    ভেস্ট নাই। সে ব্যাটা কোন কুঞ্জবনে আছে হ্যার খবর হ্যায় নিজেও জানে না। জাইনা লাভ কি। আইরিন আইতাছে। হগ্গলের ল্যাঞ্জায় হারিকেন জ্বালাইয়া দেতোছে। বাই সিমন। টেক কেয়ার বেবি।অ।

    দুপরের মইদ্যে বাস টেন্র বন্ধ হো গিয়া। বৃষ্টি পড়তাছ ঝিরিক ঝিরিক। রাস্তা দিয়া প্রাভেট কার হুসহাস কইরা বারাইতেছে। লোকজনে টেলিভিশনের সামনে হুমড়ী খাইয়া বইসা আছে। আর প্রভু যীশুর যশোগান করতাছে। তিনিই জীবন। তিনিই পথ। তার পথে হাটন ছাড়া উপায় নাই।

    পাকিস্তানী সোহেল শফি একটা টেক্সি ক্যাব লইয়া আইছে। আইসা কয়, বোঝলা রায়, কোমে লুদ আইতাছে। দজ্জাল আইতাছে। আল্লা আল্লা কর।

    --কোমে লুদ কেডা? আর দজ্জাল কেডা? হ্যারা কি ইভাকুয়েশন পার্টি?

    --নারে বাপা। আম্রিকা গে ম্যারিজ চালু করছে। আর গাদ্দাফিরে তাড়াইতেছে। আল্লায় খেইপা লাল। কইছে, ওরে কোমে লুদগণ আম্রিকায় যাও। ওহে এক চোখা দজ্জাল নিউ ইয়র্কে যাও। কেয়ামত নামাইয়া দাও। কুফরীগো মাইরা ফাতা পাতা কইরা দ্যাও।

    তখনতো পরলউকে ইলকেটিসিটির লোড শেডিং চলতোছে। কোমে লুদগণ কহিল, এই আন্ধারে যাই ক্যামনে?

    দজ্জাল কইল, ক্যান হারিকেন আছে না। হারিকেন লইয়া চল। মহাবেপদ।

    শুনে বুড়ো ফ্রাই দজ্জাল দজ্জাল করতাছে। আর কমেলুদের উদ্দেশ্য প্রার্থনা ধরছে, বাপা কোমেলুদ, বুইড়া কালে আমারে আর মাইরো না। ক্ষ্যান্ত দিও গো নাতি।

    রাত বারোটার আগে মেয়র ব্লুমবার্গ দুই দুইটা ভাষণ দিয়া ফালাইছেন। ইংরেজি আর স্প্যানিশে। কইছেন, যারা পালান নাই, হ্যাগো পালানোর আর দরকার নাই। ঘরে থাইকেন। বাইরে আমাগো লোকজন আছে। হ্যারা খোঁজ খবার লইতাছে। নো প্রবলেম। আমি আপনাগো লগে জাইগা আছি। ঘুইরা ঘুইরা নিজ চইক্ষে দেখতাছি। রাইত চারটায় হারিকেন আইসবে।

    রাস্তায় পুলিশের গাড়ি। এম্বুলেন্স। পুরা আতঙ্কের নগরী। গা ছম ছম করে গো।

    রাত ১২।০১, ২৮ আগস্ট, ২০১১
    ---------------------

    বৃষ্টি হচ্ছে নানা কিসিমের। আমার বড়ো মেয়েটা নতুন কেনা টর্চ লাইটটা বারবার জ্বালাচ্ছে। আর ছোটো মেয়েটা মোমবাতি ধরিয়ে হাসছে। তার দীপাবলী দীপাবলী লাগছে। বলছে, লাইট ফ্যাস্টিভেল করছি। ভালো না বাবা?

    মেয়ে দুটো জেগে আছে টর্চ লাইট আর মোমবাতি নিয়ে। ওদের মা বাথটাব জলে ভরে রেখেছে। তখনো আমাদের ইলেকটিসিটি ইন্তিকালে যায় নাই। ম্যানহাটন আর ব্রুকলিনে ইলেকটিসিটি বন্ধ রাখছে। সাগর এলাকায় কিছু কিছু জল উঠছে। তার মধ্যে সাংবাদিকরা লাইভ টেলিকাস্ট দেখাচ্ছে। আর লং আইল্যান্ডে বাতাসে গাছ নড়ছে। আমিও নড়তে নড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত চারটায় বড় মেয়েটা ডেকে তুলল। বলল, হারিকেন শুরু হইছে। মেয়েটা ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। মোমবাতিও জ্বালায় না। টর্চ লাইটও বন্ধ। হাতে রসুনের কোয়া। বললাম, লাইট জ্বালা।

    বড় মেয়ে বলল, লাইট জ্বাললে তো বাইরের হারিকেন দেখতি পারব না। হারিকেন হাতে ভ্যাম্পায়ার আইরিনকে দেইখা লই।

    --হাতে রসুন ক্যান?

    --রসুন থাকলে ভ্যাম্পায়ার আসতি পারে না। পলাইয়া যায়। ভ?যাম্পায়ার খুব খারাপ। রক্ত চুইষা খাইতি পারে না।

    আমার বড় মেয়েটি এই ঝড়জলের মধ্যে হাতে রসুনের কোয়া নিয়ে জানালার কাছে বসে আছে। নিউ ইয়র্কের ঝড়জল হারিকেন ওরফে আইরিন দেখতে চেষ্টা করছে। আইরিন নামের এক ভৌতিক ভ্যাম্পায়ারকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে।

    আমাদের দেশের কালবৈশাখির মত শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে। গাছের ডাল নড়ছে। পাতা পড়ছে। এরকম ঝড়বাতাস আমাদের দেশে বছরে গণ্ডায় গণ্ডায় আসে যায়। সরকার ঘুমায়। আর জনগণ তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত ছুটে বেড়ায়--পোকামাকড়ের মত মরে।অ। আবার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনলাম, ছোটে মেয়েটা গলা খুলে গাইছে, ওরে ঝড় নেমে আয়, আয়।

    সকাল ২৮ আগস্ট, ২০১১
    ----------------------

    সকাল আটটায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। ডানকিন ডোনাট খোলা। অন্যসব দোকানপাট বন্ধ। এককাপ মিডিয়াম কাপ রেগুলার কফি কিনলাম। তিনটে চিনি। আর মিল্ক। সঙ্গে গরম গরম ডোনাট। খেতে খেতে দেখি, বাতাস হচ্ছে। বাতাসে মাঝে মাঝে উড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু নেয় না। বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা মেলা যায় না। মাথায় পলিথিন প্যাকেট বেঁধে পরীর পার্কের কাছে পোছে যাই। পরীর গায়ে গাছের ছোটো ছোটো ডাল। আর ঝরে পড়া পাতা। এর মধ্যে জল পড়ছে। পার্কে একজন লোক দিব্যি গুটি গুটি হয়ে শুয়ে আছে। তাকিয়ে দেখি, আমার বন্ধু বেঞ্জামিন বেনী। আমাকে দেখে বলছে, ওরে ছোড়া, হারিকেন কি অখনো জ্বলতেছে?

    হারিকেন নিভিয়া গিয়াছে। জ্বলিয়া ওঠিবার সময় পায় নাই। শুনিয়া বুড়ো বেনী হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে ফের নাক ডাকিতে শুরু করিয়াছে। ঘাসের মধ্যে তাহার রামের বোতল গড়াগড়ি খাইতেছে। আজ তাহার মিস আইরিন আসিবে না। ভালবাসিবে না। জাগিয়া থাকিয়া লাভ কি! এ জগতে কে কাহার?

    বাই।
  • Kulada Roy | 67.243.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০১২ ১৮:৪৮490935
  • ডিডিদা, এই টইতে আমার জলে ভাসা শহরটির আত্মজীবনী লিখি মাঝে মাঝে। আমার বাবাবাড়ি-মামাবাড়ি, শহরের মসজিদটি, পাদরীগণ, সাঁকো, জেলখাটা বিপ্লবী, অথবা ঝিমধরা কবি,জুতো, খুড়ম, হুতুম পেঁচা, নৌকার গলুই, পুটি মাছ, মাথুরকীর্ত্তন, কাইজা, ফুলগাজা, নীলপাটের অষ্টক--এইগুলো নিয়েই লিখছি। এটা একটা ধারাবাহিক লেখা। গ্রাম এবং সম্পন্ন শহরের মাঝখানে একটা ছোট্ট জলেভাসা শহর, যে শহরটি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, হাঁকপাড়ে, হাসে, লাফায়, দাপায়, ক্লান্ত হয়, ঝিমোয় এবং হাতপা ছড়িয়ে ঘুমোয়--এটা তো কম কথা নয়। এটা লিখতে অনেক সময় লেগে যাবে। তারপরও হয়তো লেখা রয়ে যাবে। অন্য কেউ লিখবেন। তারপরও আরেকজন লিখবে। তবু লেখা রয়ে যাবে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন