আগেরটা শেষ করিনি। তবুও অকুতোভয়ে নতুন সর্ষে লিখি। সেই কবে থেকে আশায় আশায় বসে আছি বেড়াতে যাবো ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক - পৃথিবীর প্রথম জাতীয় উদ্যান। আগের বছর সমস্ত প্ল্যান করে হোটেল ক্যাম্পগ্রাউন্ড ইত্যাদি বুক করে ফেললাম- এমনকি মিঠুন্দা একখানা দূরবীন অবধি কিনে পাঠিয়ে দিল জীবজন্তু দেখার জন্য। কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া গেল ভেস্তে আর মেজাজ গেল বিগড়ে। সেই থেকে তক্কে তক্কে আছি কবে টুক করে ঘুরে নেয়া যায় সেই সুপ্রাচীন আগ্নেয়গিরির দেশ। কথায় বলে সবুরে মেওয়া ফলে। আগের প্ল্যানটা ছিল যারপরনাই ঊর্ধ্বশ্বাসে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরা। এই বছর একটু রয়ে সয়ে সময় নিয়ে বানিয়ে ফেলা গেল ইয়োলোস্টোন আর গ্র্যান্ড টিটন পার্কের ভ্রমণসূচী - পাঁচ দিনের রোডট্রিপ আর টেন্ট ক্যাম্পিং। ইয়েলোস্টোনের বেশ ক'টা সিগনেচার ছবি দিয়ে অ্যালবাম শুরু করলাম - সময় সুযোগ মত টুকটাক গল্প লিখে রাখবো।
ইয়েলোস্টোন পার্কটা বিরাট জায়গা জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে - তিনটি রাজ্য মিলিয়ে- আইডাহো, মন্টানা আর ওয়াইয়োমিং, যদিও বেশীটাই ওয়াইয়োমিং- এ। পার্কে ঢোকার পাঁচটা দরজা- উত্তর, উত্তরপূর্ব, পুব, পশ্চিম, দক্ষিণ। আমরা যেখানে আছি, মানে বোল্ডার শহর মোটামুটি এই পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে - কাজেই দক্ষিণ বা পূর্ব দিক দিয়েই ঢোকা হবে সবথেকে সহজ। সহজ বলতে ওই ধরা যাক এক ঘণ্টা কম সময় গাড়ি চালাতে হবে আর কি! কিন্তু বেরনোর দিন যতোই এগিয়ে আসে, ততই দেখি ইয়োলোস্টোনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বরফঝড়ের সম্ভাবনা বাড়ে। একজন সান্ত্বনা দেয় যে পাহাড়ে তো এই রোদ, এই বৃষ্টি, হয়তো ঝড় অন্যদিকে সরে যাবে। কিন্তু এই করে করে যাত্রার ঠিক দুইদিন আগে থেকে শুরু হল স্নোস্টর্ম - তার চোটে পার্কের পুব আর "দখিন দুয়ার খোলা" না থেকে গেল বন্ধ হয়ে। কাজেই পশ্চিমে ম্যাডিসনের দিক দিয়ে ঢুকতে হবে বলে রাত থাকতে থাকতেই ১৩ই মে পৌনে তিনটের সময় আমরা রওনা দিলাম- প্রায় ১১ ঘণ্টার ওপর রাস্তা। মোটামুটি দুপুর দুপুর পৌঁছে গেলে তবুও কিছু ঘুরে দেখা যাবে।
ইয়োলোস্টোন গোটা শীতকাল স্তূপ স্তূপ বরফে ঢাকা থাকে - স্নোমোবিলে চেপে ঘুরতে হয় - সেও হয়তো যাওয়া হবে বা হবে না কোন একদিন। তবে নিজের গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যাবার সময় ওই মোটামুটি এপ্রিলের শেষ থেকে ওদিকে অক্টোবরের শুরু। মে মাসে পার্কের ভেতরের সব রাস্তা খোলে না, আবহাওয়াও খামখেয়ালি - কখন যে দুম করে এক ফুট বরফ পড়ে যাবে তার ঠিক নেই। তবু এই সময়েই পার্ক থাকে সামান্য ফাঁকা; নয়তো আরও গরম পড়লে মাসে প্রায় দশ লক্ষ লোক এসে হাজির হয় এখানে। আর ইশকুল কলেজও ক'দিন ছুটি গ্রীষ্মকালীন কর্মব্যস্ততা শুরু হবার আগে। এই যে নানা জায়গায় ঘুরতে যাই আমরা থাকি তাঁবু খাটিয়ে- পার্কের ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। এক তো এতে একদম পার্কের ভেতরে থাকা যায় আর খরচ বাঁচে। আর তাছাড়াও ইয়োলোস্টোনের মত জনপ্রিয় গন্তব্যে হোটেলপত্তর বহু আগে - প্রায় ৬-৭ মাস আগে থেকে বুক হয়ে গেলেও ক্যাম্পসাইট ১-২ মাস আগেও পাওয়া যায়। আমরা ট্রিপ প্ল্যান করেছি মার্চে।
আমাদের ১১ ঘণ্টার যাত্রাপথে দেখলাম এক বিশাল মুজ হাইওয়ের ওপারে একটা জলাশয়ে সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে নিচ্ছে। তার শিঙের আকারই প্রায় চার-পাঁচ হাত হবে। কিন্তু তখন ঘন্টাপ্রতি ৭৫-৮০ মাইল বেগে গাড়ি ছুটছে, চট করে দাঁড় করানোর প্রশ্ন তো নেইই আর চলন্ত গাড়ি থেকে ফোনে ভালো ছবিও আসবে না। এই হল এইবারের বেড়ানোর প্রথম আক্ষেপ! তবে ঘাবড়াও মাত, ইয়োলোস্টোন ঢুকতে না ঢুকতেই নদীর পাশে রাস্তার পাশে ঝোপে বনে জলে জংগলে দলে দলে বাইসন দেখা দিতে লাগলেন। তাদের ছোট্ট ছোট্ট রাঙা বাছুরের মত ছানা - দেখলে যতোই শখ হোক না কেন যে গিয়ে একটু আদর করে দি, বড় বাপ-মা বাইসনের চেহারা দেখলে সে শখ জানলা দিয়ে উড়ে পালাবে। এই ছানা বাছুরেরা আবার যাবে ভাল্লুকের গুবলু গাবলু ছানাদের পেটে - প্রকৃতির নিয়ম!
ক্যাম্পসাইটে নামঠিকানা ইত্যাদি নথিভুক্ত করে আমরা চটপট বেড়িয়ে পড়লাম গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিক স্প্রিং- এর উদ্দেশ্যে। ইন্টারনেটে চোখ ঝলসানো ছবি দেখেছি এর - প্রায় ২০০-৩০০ ফুট ব্যাস জুড়ে গাঢ় নীল সবজে জল, চারপাশে হলদে কমলা লাল বর্ডার আর গলগল করে ধোঁয়া উঠছে গরম জল থেকে - এই হল হটস্প্রিং। কিন্তু এই এত গরম জল আসছে কোথা থেকে? আসলে ইয়োলোস্টোন পার্কের কেন্দ্রের এক তৃতীয়াংশই হল এক বিরাট সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বা ক্যালডেরা (৭০ কিমি বাই ৪৫ কিমি)। যে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ এত বড় তাকে নাম দেয়া হয়েছে সুপারভলক্যানো - ২১, ১৩, ৬.৪ লক্ষ বছর আগে বার তিনেকের বিশাল অগ্ন্যুত্পাতে তৈরী ইয়েলোস্টোন। তারপরেও খান আশি ছোটোখাটো লাভা উদ্গীরণ হয়েছে - শেষেরটা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে। সেইজন্যেই ইয়োলোস্টোন সদা পরিবর্তনশীল, রহস্যময়- এখানে ভূস্তরের মাত্র ৩-১২ মাইল নিচেই শুরু ম্যাগমার স্তর। সেই ম্যাগমার তাপেই ভূগর্ভের আর ভূস্তরের জল গরম হয় - বড় বড় ফাটল বেয়ে ওপরে উঠে আসে, উপরের ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া জল পালায় নিচে, আবার গরম হয়। এই ঘুরপাক চলতেই থাকে আর তৈরী হয় হট স্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণ - যেন বিরাট একখানা গরম জলের পুকুর, কোথাও জল বুরবুরি কাটছে, কোথাও ভকভক করে ধোঁয়া উঠছে, গরমের লোভে লোভে এসে জোটে কিছু ব্যাকটেরিয়া। প্রস্রবণের মধ্যিখানের সব সবথেকে গরম (প্রায় ৮৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস), যতো কিনারার দিকে যাওয়া যাবে জলের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমবে - এবার যে ব্যাকটেরিয়ার যেমন গরম পছন্দ সে সেইখানে দল বেঁধে তৈরী করে নানা রঙের বলয় - আর আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে প্রিজমের মত রঙের বিচ্ছুরণ।
গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিক স্প্রিং হল মিডওয়ে গিজার বেসিন অঞ্চলের অংশ- ইয়োলোস্টোনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর একটা। এবার প্রস্রবণের একদম ধারে গিয়ে পড়লে অতো বিশাল পুকুরের ভালো ছবি তো উঠবে না, যত বেশী উঁচু জায়গা থেকে ছবি তোলা যাবে তত সুন্দর ছবি উঠবে - তাই আমরা এগোলাম সামনের পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের গায়ের ট্রেল বেয়ে খানিক উঠলে এক ভিউপয়েন্ট থেকে অসামান্য ছবি ওঠে গ্র্যান্ড প্রিজমাটিকের। কিন্তু বিধি বাম - এখন শীতঘুম ভেঙ্গে গ্রিজলিদের জেগে ওঠার সময় আর জেগে উঠলে তারা সামনে নাকি যা পায় তাই খায় - অতএব ট্রেইল বন্ধ- কিছুদিন পর খুলবে, জুন মাসে। মে মাসে ইয়েলোস্টোন আসার এই এক অসুবিধে - ভিড় কম হলেও বেশ কিছু জায়গা তখনো জনসাধারণের জন্য খোলা নয়।
লামার ভ্যালী - বন্যপ্রাণী দেখার আর ছবি তোলার জন্য দারুণ জায়গা। ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকা বাইসনের দলের ছবি তুলতে জনৈক এমনই মশগুল যে ট্রাইপড সমেত সে উঠে গেছে রাস্তায়। গাড়ির হোক বা বাইসন- কারোর ঢুঁসোকেই পরোয়া নেই!
শুধু পায়ের ছাপ দেখেই ফিরতে হবে ভেবে যখন একটু মুষড়ে পড়েছি, ঠিক তখন গাড়িতে বসে দেখলাম পাশের পাহাড় থেকে ইনি হেলতে দুলতে নেমে এসে ঘাসজমিতে ইতিউতি কিছু শোঁকাশুঁকি করে নিরাশ হয়ে উলটোদিকের পাহাড়ে রওনা দিলেন। পিঠের অল্প কুঁজ থেকে বোধ করি ইনি হয়তোবা একজন গ্রিজলি ভালুক।
আর্টিস্ট পয়েন্ট - ইয়েলোস্টন নদীর খাত আর জলপ্রপাত।
কাদায় ভাল্লুকের পায়ের ছাপ। এ আবার যেমন তেমন কাদা নয়- ভূগর্ভের তাপে গলে যাওয়া শিলাস্তর।
গ্র্যান্ড প্রিজমাটিক স্প্রিং - বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম উষ্ণ প্রস্রবণ। গরম জলে ব্যাকটেরিয়ার রমরমায় এমন অপূর্ব রং।
মিডওয়ে গীজার বেসিন চত্বরে গ্র্যান্ড প্রিজম্যাটিকের মত বড় না হলেও এমন ছোট ছোট অজস্র রঙিন ডোবায় ভর্তি।
বাইসন পরিবার ম্যাডিসন নদীর ধারে।
ওল্ড ফেইথফুল গীজার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভূগর্ভের তাপে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা জল আর বাষ্প ফোয়ারার মত উঠে আসে ফাটল বেয়ে।
ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে ঠিক করে জলটাই দেখা যাচ্ছে না।