মজলিশ
যেমন বলেছিলাম, মজলিশের আর্কাইভ খুঁজতে সম্ভবত দুটো ইউআরএল খুঁজতে হবে। বিভিন্না তারিখের ক্যাপচার-এ। এখন দেখছি * ওয়াইল্ড ক্যারেকটার হিসেবে সার্চে নিচ্ছে আর্কাইভের ওয়েব্যাক মেশিন। সুতরাই, এই হল দুটো লিংক, মজলিশের জন্য।
এবং
মোট ৭৬২ টা ক্যাপচার। রিপিট বা লগিন পাতা যদি কিছু থাকেও, তা বাদ দিলে অন্তত ৭৫০ টা পাতা অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার মন্তব্য ফিরে পাওয়া যাবে। যে যার মত করে চেষ্টা করুন, বা লসাগু বা আর কেউ পাইথন ব্যবহার করে স্ক্রিপ্ট লিখে যদি সব পাতা একলপ্তে নামিয়ে, (ট্রান্সলিটারেট করে বা না-করে) কোনো ক্লাউডে রাখেন, তাহলে তো মিটেই যায়।
চোখে পড়া তিনটে আর্কাইভ-মজলিশের পাতা থেকে নিয়ে জোড়া দেওয়া একটা লেখা রইল -
======================================================
পূজো পুজো [সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৬]
সাদা শাড়ি পড়ে হাঁটছিল তিতির। একা, সজাগ অথচ উদাসী। সজাগ, কারন সেটাই থাকা উচিত। উদাসী, কারন সেটাই নিয়তি। ফুটপাথ জুড়ে রঙিন কাপড়ের ডাঁই প্যান্ডেলের জন্য উৎসর্গীকৃত। পা বাঁচিয়ে চলতে হয়। পাছে রং লেগে যায় পায়ে, পা বেয়ে উঠে আসে শরীর, মনে।
চারদিকে পুজোর রোশনাই। তিতির চোখ মেলে শুষে নেয় সেই আলো। ছোট্টো একটা মেয়ে দৌড়ে আসে ধূপের প্যাকেট হাতে নিয়ে "দিদি ধূপ নেবে"?
দশটাকা, বারোটাকা প্যাকেট। আগের অভিজ্ঞতায় তিতির জানে, কোনো গন্ধ নেই তেমন ধূপগুলোয়, কেবল ধোঁয়া হয় খুব। মশা তাড়ানোর কাজে লাগে কিনা কে জানে! তবে মেয়েটার হাতে যেটা জ্বলছে সেটার গন্ধ খুব সুন্দর। মিঠে, মনকাড়া। মেয়েটার ময়লা নখের আগায় হলুদ দাগ।
নাও না দিদি, এই দ্যকো এটা চন্দনের গন্ধ, এটা গোলাপের....
তিতির দেখে ফ্রকটা, চিরুনি হীন লাল চুল, রোগা হাত আর কালো শরীর বেয়ে নেমে আসা ততোধিক কালো খালি ফাটা পা। সারাদিনে ক"বার রাস্তা পারাপার করে মেয়েটা?
ভাল গন্ধ হবে? তিতিরের সাদা শাড়ীতে সাদা বিশ্বাসের ফুল তোলা। মেয়েটা হাসিমুখে তাকায়।
খুব হবে গো , দ্যাকো না বাড়ি যেয়ে জ্বালিয়ে। ঠাকুরের সামনে জ্বালিয়ে দেকো
তিতির টাকা বার করে - দুটো প্যাকেট দাও
কোনটা কোনটা দেবো?
তোমার পছন্দ মত দুটো দাও।
মেয়েটা অবাক হয়ে তাকায়, যেন জীবনে প্রথম শুনল ওরও পছন্দ থাকতে পারে।
বড় ভীড় রাস্তায়। তিতির অন্যমনস্ক জরীপ করে। কত খুশি খুশি লোকজন, মনটা ভাল হয়ে যায়। ষষ্টির সকাল। কলকাতার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় ছোট্টোবেলার মামাবাড়ির ওখানে। মাত্র দুটো পূজো হত গোটা গ্রামে। ভোররাত থাকতে উঠে পড়ত তিন বোন। হাতে ফুলের সাজি আর একটা ব্লেড নিয়ে দৌড়ে শিউলিতলায়। সাজি ফুলের জন্য, আর ব্লেড শুঁয়োপোকার দাওয়াই। শিউলির ডাল ধরে নাড়া দিলে অনেক সময় শুঁয়োপোকা পড়তে গায়ে এসে। ব্লেড দিয়ে চেঁছে শুঁয়ো তুলতে ওস্তাদ ছিল তিনজনেই। উঠোনের দুপাশে দুটো বড় বড় স্থলপদ্ম গাছ নিয়ে পড়ত খুশিতে। এত ফুল তাদের ডালে সারাবছর আসে না তো! ইচ্ছা করত না ফুলগুলোকে তুলতে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সাদা ফুলে গোলাপী রং ধরত। ঠিক যেন কিশোরী বেলার থেকে তরুনীবেলায় পা। গোলাপী আভা মেখে কার পথ পানে চেয়ে থাকা। দুপুর বেলায় ঢাকীদের বিশ্রামের সময় চন্ডীমন্ডপের ধারে গিয়ে ওদের ঢাকের পালক গালে চট করে বুলিয়ে নেওয়া। কি থাকে ঐ বাজনায়? পা দুটো যেন অজান্তেই নেচে উঠতে চায়। তিনবোনে আলোচনা চলত, বড় হয়ে ঢাকী হবে। কেমন সুন্দর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় কেবল বাজনা বাজিয়ে বেড়াও। ছুটকির মনে হত কাঁসি বাজানোটা বেশি আমোদ। মাথা বেশি নাড়ানো যায়।
গ্রামের শেষে বড়ডাঙার মাঠ। গাজনের মেলা বসত ওখানে। আর ভাদ্র মাসে ভাদুর উৎসব। মাঠ পেরিয়ে লাইব্রেরী। খুব ফাঁকা ছিল ওদিকটা। একটু বড় হওয়ার পর তিতির একা একা পূজোর দিনগুলোতে লাইব্রেরীর বারান্দায় চলে যেত। ধারে কাছে বাড়ি নেই কোনো। । মাঠের ডান দিকে কোন বরাবর বড় ঝিল। দিদু বলতেন পদ্মঝিল। কি ভীষন পদ্ম ফুটত! আর সারা দুপুর হাঁসেদের জলে নামা আর ওঠা। নতুন জামা পড়া তিতির লাইব্রেরীর বারান্দায় বসে থাকত হাতে একটা গল্পের বই নিয়ে। দুপুরের গন্ধ, নতুন জামার গন্ধ, নতুন বইয়ের গন্ধ মাখা তিতির দু চোখে পূজো মাখত নিজের মত করে।
ক্লাস টেন । স্কুলের শেষ বছর। বাবা বললেন পূজো শেষে টেস্ট, এবছর আর ওখানে যেতে হবে না। পড়াশুনার ক্ষতি হবে । মন মানে নি একদম। কেঁদে কেটে দাদু দিদাকে দিয়ে বলিয়ে রাজী করেছিল বাবাকে। ডাইনে পদ্মঝিল, বাঁয়ে লাইব্রেরী আর সামনে যেদিকে দু চোখ যায় ঘন কাশের বন হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ডাক দেয় তিতিরকে।
তিতির পায়ে পায়ে এগোতে থাকে।
দিদি, কি নেবেন?
এক পথ শিউলি মাড়িয়ে বাস্তবে ফিরে আসে তিতির।
ওমা ! কাশবন কখন দোকান হয়ে গেছে!
তিতির কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়। টুকি টাকি কেনার আছে কিছু।
সেল ফোনে চেনা শব্দ। তিতিরের মনে জল ছলকে ওঠে, কিন্তু ফোনের দিকে তাকিয়ে মনের জল চোখে আসে। না: সে নয়, সে নয়। কত কাজের মানুষ অকাজে ফোন করে , মেসেজ পাঠায়, কিন্তু তার শব্দ আর শোনে না, শোনেনি কতকাল। কি অসীম আগ্রহে প্রথম প্রথম ফোন হাতে নিয়ে জাগত, ফোন হাতে ঘুমোতো। যদি আসে তার ডাক, একবার যদি ফুটে ওঠে সেই নাম!
এক সুগন্ধী সম্পর্ক বুকে নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে মরতে থাকে তিতির।
ডাক আসে না তার, কিন্তু ডাক দেয় নিত্যপ্রয়োজন। হাতের টাকা গুনে দিতে গিয়ে খেয়াল হয়, মেয়েটা দুটো একই রকমের ধূপের প্যাকেট দিয়েছে। হয়ত এই একটাই ওর পছন্দের। মেয়েটাকে কিছু দিলে হত হয়ত। ফেরার রাস্তায় খুঁজবে , যদি দেখতে পায়।
আবার অনেক রং , অনেক আলোর বাল্বের সারি সারি নিÖপ্রভ চোখের চাউনির মধ্যে দিয়ে তিতির হাঁটে। আবার বাড়ি ফেরা । বাইরের রোশনাই, আলো, হাসি সবাইকে পাপোষে ঘষে মুছে বাড়ি ঢোকা।
ছোটোবেলার দেখা স্থলপদ্মগুলোকে গোলাপী হতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগত। কোন খুশিতে ওরা বেলা বাড়লে অমন রঙিন হাসি হাসে! এখন মনে হয় ঐ সাদা ফুলগুলো ই আসলে সুখী। এখন বোঝে, আনন্দের শুভ্রতায় বিষাদের রক্তক্ষরণ মিশে ফুল হয় গোলাপী।
তিতির আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখে নিজেকে গোলাপী হতে, তিতির ঠোঁটে দাঁত বিঁধিয়ে ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করে দুধ সাদা হতে চায়।
বিকেলে বাড়িতে বন্ধুরা আসবে । তিতির নিজেকে গোছায়। সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে। আপ্যায়নের হাসির জারকে লিপস্টিক চুবিয়ে ঠোঁটে মেখে নিতে হবে সযত্নে। খুশি থাকতেই হয়, উৎসবের দাবী। দাবী মেটায় তিতির, যেমন মিটিয়েছিল আগেও। যেমন দাবী মিটিয়েছিল শুধু তার জন্য গান গাওয়ার , তাকে ভালবাসার, তার জন্য দিনের পরে রাত আর রাতের পরে দিনের অলো মাখার।
দূরে কোথায় ঢাক বাজে। তিতির আলমারীর পাল্লায় হাত রাখে। কি রঙ জড়াতে হবে আজ? যখন সে ছিল, তার আবদার, অধিকার, দাবী, সব ছিল উজ্জ্বল লাল, হলুদ, কমলা, সোনালী হয়ে । সব রঙের ওপরে ছিল ভালবাসার নীল পালকের হালকা ছোঁয়া। কিন্তু এখন কি আছে? কোন রঙ ?
সে নেই। কোন অজানা কারনে সে এসেছিল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই সে সরে গেছে পাশ থেকে, তিতিরকে মুঠিতে ধরে উড়িয়ে দিয়েছে সব রঙটুকু কেড়ে নিয়ে। কখনও খোঁজ নেয় নি আর। চেনা পরিবেশে মুখো মুখি হলে অবহেলায় পরিচিত থেকেছে দিনের পর দিন। ভারি ভাল ছবি আঁকত মানুষটা। কি সুন্দর জলছবি স্বপ্ন। বিশ্বাসের তরল ঢেলে মিঠে রঙ গুলে তাতে আঙুল ডুবিয়ে এক টানে ছবি আঁকত সে। নেহাতই কেজো ছবি। তবু বড় সত্যি, বড় সুখ মনে হত বোকা পাখীর। কথা আর স্বপ্নের খড়কুটো মুখে নিয়ে ডানা মেলেছিল তিতির, কিন্তু বেশিদূর উড়তে পারার আগেই ছবি ছিঁড়ে শতখান।
জল বুকের গভীরে জমতে থাকে, জমতেই থাকে। তিতির সব আবরণ খুলতে থাকে একে একে। ধূপের প্যাকেট দুটো খোলে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে। মন খারাপের কি আর দুরকম গন্ধ হয়? সব ধূপগুলো জ্বেলে দেয় ঘরে। ধোঁয়া মাখা নরমগন্ধী মনখারাপ গায়ে মেখে নয় নগ্ন কাঙাল তিতির। টেনে নেয় পছন্দের শাড়িটা । সাদা বিশ্বাসের ওপর অপমান আর অবহেলার ঘন কালো লতাপাতার নক্সা পরতে পরতে গায়ে জড়াতে থাকে, তারপরে বুকের নোনা পদ্মদীঘিতে ডুব দেয়। কোথাও এতটুকু ঢেউ ওঠে না। কাশের দল হাতছানি দেওয়া ভুলে অবাক চোখে তাকায়। দীঘির নিস্তরঙ্গ জলে ছড়িয়ে যায় অগুন্তি নীল পালক ।
লাল লাইব্রেরীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেসে থাকা চুলের গোছা দেখতে থাকে তিতিরের ভালবাসা, তিতিরের সব রঙ, তিতিরের সোমদেব।
ঢাকটা বাজতে থাকে , বাজতেই থাকে ...
--------------------------------------
সুখ দুখ মেশানো এই পূজোয় সকলকে ভালবাসা আর শুভেচ্ছা জানিয়ে
সঙ্গীতা
--------------------------------------------
পূজো পূজো - ২ [অক্টোবর ১, ২০০৬]
খুব সুন্দর সাজবে এখন তিতির। আজ , যখন নীল পালকের মধ্যে চুল ভাসিয়েছিল বুকের পদ্মদীঘিতে, তখন পেয়েছে তার সাড়া। উদাসী সেই মনুষটি তিতিরের দিকে একবার চোখ ফিরিয়েছে মাত্র, একবার শুধু জানিয়েছে "আমি আছি"। তাতেই মন ময়ূরী পেখম মেলেছে আজ। গালে কৃষ্ণচূড়ার রঙ লেগেছে।
গাঢ় নীলের অহঙ্কার গায়ে জড়ায় তিতির। কুসুমে রতনে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছা করে খুব। ভিজে চুলের জলের কুচিতে মেখে নিতে ইচ্ছা করে ধুনোর গন্ধ । অষ্টমীর অঞ্জলীর ঘোষণা ভেসে আসে মাইকে।
খুব ভোরে ওঠে সুবল। ছেলেকে ডেকে দেয় ঠেলা মেরে মেরে। আকাশে তাকায় একবার। আজও বৃষ্টি হবে। মনটা তেতো হয়ে যায়। স্যাঁতস্যাঁতে ঢাকে আওয়াজ তেমন ওঠে কৈ? কিন্তু আওয়াজ তুলতেই হবে। এই কাঠি দুটো বড় প্রিয়। পূজোর গন্ধ মাখানো ঢাকের কাঠি।
ছেলেটা সবে বারোয় পা দিয়েছে। পড়াশুনোয় মন আছে কিন্তু সুযোগ নেই তেমন। মাঝে মাঝে কাগজে পড়ে বাবাকে এসে বলে কোথায় কোন গরীবের ছেলে মেয়ে ঠোঙা বানিয়ে, চা বিক্রি করেও পড়ার খরচ তুলছে। সুবল বোঝে না ঠিক। ছেলেটাকে এখনই কোনো দোকানে লাগিয়ে দিতে পারলেই তো ভালো হত। সম্বচ্ছর ট্রেনে ফিরি করে পেট ভরে। বৌ এক বাড়িতে বাচ্চা সামলানোর কাজ করে, তাই একটা বাঁধা পয়সা আসে সংসারে। মা বুড়ি যদ্দিন বেঁচে ছিল এবাড়ি ওবাড়ি রান্নার কাজ ধরে দুটো পয়সা আনত ঘরে। সেও গেছে বছর পাঁচেক। বৌ তখন পোয়াতি। সুবলের মাথায় বাজ পড়েছিল। সেবছর ঢাকের চামড়া ভিজে গিয়েছিল ঘরের চাল ফুটো হয়ে জল পড়ে। ছেলেটা তখন বছর সাতেকের। সুবল অন্ধকার দাওয়ায় বসেছিল চুপ করে। ঘরে আলো জ্বলে নি। ঘোর কালো রাত, পাশের ঘরের পারুল আর ওর বর ওদের ভ্যান রিক্সায় করে ফুলিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বিকেলে। ছেলেকে নিয়ে সুবল ঘরে ছিল একা। ভোর রাতে দাওয়ায় একটা টিয়া এসে বসেছিল। সুবলকে দেখেও একটুও ভয় পায় নি, উড়েও যায় নি। বেলা দশটার সময় ফুলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সুবলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল "মেয়ে হল এবার"। মা এসেছে, সুবল মনে মনে বলেছিল। ভোর রাতে তাই বোধহয় দাওয়ায় বসে জানান দিয়ে গেল।
এখন টিয়া পাঁচ বছরের। মেয়েটার কথা ভেবে বুকটা টনটনায় সুবলের। ছেলের থেকে মেয়ে বেশি প্রিয়। সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসলেই মেয়েটা গলা ধরে ঝুলে পড়ে এসে, পকেটে হাত ঢোকায়। কোনো কোনো দিন সুবল ইচ্ছা করে একটা দুটো লেবু লজেন্স কি বাদামের প্যাকেট রেখে দেয়। মেয়ের সেদিন কি আনন্দ। রোগা কালো মুখে কি যে আলো, সুবল প্রাণ ভরে মেয়ের সাথে আহ্লাদ করে।
পূজোর কদিন আগে থেকেই ঢাকের বায়না পাওয়ার জন্যে ইস্টিশনে এসে দাঁড়ায় বাপ ব্যাটায়। বড্ড কম্পিটিশন । হাতের শিরা বের করে বাবা ছেলেতে মিলে ঢাক পেটাতে থাকে। নীচু , ঝুঁকে পড়া অবয়ব কঞ্চির মত বেঁকে চুরে বোল তোলে । সুবল ঢাকীর নাম আছে বাজারে। অফিস মুখো বাবুরা, দিদিরাও হাতে সময় থাকলে একদন্ড দাঁড়িয়ে শুনে যায়। গামছাটা কোমরে টাইট করে পেঁচিয়ে সুবল ঢাকী ঢাকের কাঠিটাকে হাতিয়ার বানিয়ে নেয়।
এই প্যান্ডেলটা সুবলের চেনা। ফ্ল্যাট বাড়ির পূজো। গত বছর এখানের এক বাবু শিয়ালদা স্টেশনে ওর বাজনা শুনে ডেকে এনেছিলেন।
সুবল ছেলেকে নিয়ে বেরোচ্ছিল, টিয়ার মা অনেকটা চিঁড়ে আর বাতাসা বেঁধে দিয়েছেল। বরাত না পাওয়া পর্য্যন্ত ইস্টিশনেই থাকতে হয়। ঐ কদিন এক বেলা পাউঁরুটি আলুরদম আর একবেলা চিঁড়ে বাতাসা জলে ভিজিয়ে খেয়ে নিলে পেটটা শান্ত থাকে দুজনেরই। বেরোনোর মুখে টিয়া দৌড়ে এসে সুবলের হাতে একটা লম্বা পালক ধরিয়ে দিল, হলদেটে পালক, ধারে সাদার ছিট ছিট। পেছনের ছাতিম গাছে হরেক কিসিমের পাখী এসে বসে। গাছতলা থেকেই কুড়িয়ে এনেছে মেয়েটা। সুবল বেরোনোর আগে মেয়েকে কোলে নেয়, আদর করে একটু তারপরে পালকটা ওর ঢাকের গায়ে গুঁজে নিয়ে যাত্রা করে।
ওর বিশ্বাস ঐ পালক খুব শুভ। ওটা ঢাকে লাগানোর পরে যেন সুবলের হাত আরো খুলে গেছে। পালকটা যেন দুলে দুলে বলে "বাবা, আরো জোরে, আরো মিঠে হাতে বাজাও।"
মেয়েটা কি বোঝে, এই বাজনাই ওর উঠোনে পূজোর গন্ধ আনবে?
বাবুরা বলে "সুবলের হাত ঢাকের সাথে কথা বলে"
অষ্টমীর সকাল হয়ে গেল, সব মেয়ে বউরা চান সেরে নতুন কাপড়ে মন্ডপে আসছে। ফুলির পরনে আজও একটা পুরোনো শাড়িই থাকবে জানে সুবল। কাজের বাড়ির বাবুরা ওকে শাড়ি দিতে চেয়েছিল, ও নিজেই টাকা চেয়ে নিয়েছে। নিজের অল্প জমানো টাকা আর কাজের বাড়ির বোনাস মিলিয়ে ছেলে মেয়ের জন্য দুটো জামা আর সুবলের একটা গেঞ্জী আর পাজামা কিনেছে ফুলি। গত বছর কোন এক প্রাইজওয়ালারা ওদের সকলকে একটা করে সাদা টিশার্ট আর একটা টুপি দিয়েছিল। সেগুলোকে কেচে কুচে পরিস্কার করে পড়েছে এবছরেও।
এই যে সব বাবুরা কেমন ছাপ তোলা পাঞ্জাবী পড়ে চাদর গলায় ঝুলিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে ফুল নিচ্ছে, গঙ্গাজল নিচ্ছে, ওদের দেখে সুবলের কেমন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় সব রাজপুত্তুর এক একজন। আর ওদের বৌ রা, কেমন নরম নরম হাত পা, কেমন চিকন গায়ের চামড়া। কি সাবান মাখে এরা?
সুবল ঠাকুরের দিকে তাকায় "মাগো, একটু বেশি বকশিশ পেলে ফুলির জন্য একখান সাবান আর এক শিশি ক্রীম কিনে নিয়ে যাব"। সাতসকালে সুবলের চোখে ঘোর লেগে যায়। প্যান্ডেল ম ম করে ধুপ, ধূনো, ফুল বেলপাতা আর সাজগোজ করা পরীদের গায়ের গন্ধে। রাতের বেলায় ফুলি ঠেলে সরিয়ে দেয় অনেক সময়, বলে "বিড়ির গন্ধে টেকা যায়নে বাপু"
সুবলের ইচ্ছা করে ফুলিকেও অমন সাবানে চান করিয়ে ক্রীম মাখিয়ে পাশে নিয়ে শোয় মুখে এলাচ নিয়ে। ব্যান্ডেল স্টেশনের এলাচ দেওয়া পান খেয়েছিল একবার। ফুলির সেদিনের সোহাগ এখোনো মনে আছে সুবলের।
আরতির প্রদীপ জ্বালেন ঠাকুরমশাই। চওড়া পেড়ে শাড়ি পরা তিন চারজন গিন্নী গুছিয়ে দেন হাতে হাতে সব উপকরণ। কুমারী পূজা শুরু হবে এবার। দুটো ছোট্টো মেয়ে বাবার কোলে চড়ে আসে। লাল বেনারসী, লাল চেলি, কপালে লাল টিপ, চন্দন , মাথায় মুকুট। টিয়ার বয়সী-ই হবে বাচ্ছা দুটো। একজন মনে হয় একটু ভয় পেয়েছে, শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে আছে। সুবল নিজের গলায় হাত বোলায়, টিয়াটাও ঠিক অমনি করেই ......
মেয়েদুটোকে বসিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরমশাইয়ের সামনে, গলায় ফুলের মালায় চন্দন মাখা বেলপাতা ছোঁয়ান বড় ঠাকুর। বাঁ হাতে ঘন্টা বেজে ওঠে । সুবল পিঠ ঝাঁকিয়ে তুলে নেয় হলদে পালক গোঁজা ঢাক। প্রাণপণে কাঠিতে বোল তোলে। ভুলুটা ছোটো, ঢাক মাটিতে রেখে বাজায় মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে। ধুনুচিতে ছোবড়ার গায়ে ধুনো গলতে থাকে, শুকনো ছোবড়ার আগুনে ফ্যানের হাওয়া লেগে ফুলকি ওড়ে। কুমারী দের মায়েরা ব্যস্ত হাতে মেয়ের চেলি সরিয়ে দেয় ধুনুচির কাছ থেকে। ঠাসাঠাসি প্যান্ডেলে পূজোর গন্ধ পাক খায়, সুবল ঢাকীর চোখের সামনে কুমারী শিশুদুটি টিয়া হয়ে খিলখিলিয়ে হাসে।
সুবল নাচের ছন্দে ঢাক পেটায়। বকশিশ পেতেই হবে ভাল। অনেক গুলো টাকা দরকার।
বড় ঠাকুর মন্ত্র পড়ছেন। ছোটো ঠাকুরমশাই যোগাড়ে ব্যস্ত। কত বছর ধরে শুনছে এই মন্ত্র সুবল, মুখস্ত হয়ে গেছে একরকম। মানে জানে না এই সব কথার, তাই নিজের মত মানে করে নিজের মনে সুর করে বিড়বিড় করে সুবল - মাগো, আমার টিয়া আর ভুলুকে দেখো মা। মা গো , ওরা যেন ভাল থাকে মা ..
"বড্ড ভাল বাজাও তুমি "
নীল শাড়ি পড়া এক দিদিমণি সামনে এসে দাঁড়ায়
এদের সকলেরই মুখ এত চিকন কেমন করে হয়? সুবল মাথা নামিয়ে কোমরের গামছা খুলে ঘাম মুছে নেয় মুখের।
নীল শাড়ি নড়ে না সামনে থেকে । কি অস্বোয়াস্তি । সুবল ঠাকুরের দিকে তাকায়। কুমারী মেয়েদুটো ঘেমে নেয়ে একশা। চোখের কাজল ধ্যাবড়ানো, মাথার চুলে ফুলের কুচি এদিক ওদিক । ছোট্টো ছোট্টো আলতা পড়া পা দুটোর দিকে চেয়ে থাকে সুবল। টিয়াকে আলতা পড়লে কেমন দ্যাখাবে কে জানে? মায়ের পায়ের কাছে পূজোর আলতা ডাঁই করা। ঠাকুরমশাইয়ের কাছে চাইলে হয় এক শিশি, কিন্তু লজ্জা করে সুবলের। তার চেয়ে এক শিশি আলতাও না হয় কিনবে ফুলির জন্যেই।
"আর একটু বাজাবেন? আমার জন্য?"
সুবল ঘাড় ঘোরায়। ভুলুটা এক দৃষ্টিতে দেখছে কয়েকটা ছেলের ক্যাপ ফাটানোর খেলা। নীল শাড়ি আবার কথা বলে। কথা? না জল গড়িয়ে দেয়? কি মায়া গলার আওয়াজে। বাবুদের মেয়েরা কি এরকম মায়া মাখা কথা বলে?
বলে না, জানে সুবল। অহোরাত্রই তো দেখছে। কিন্তু নীল দিদিমণি অন্যরকম।
আপনার জন্য বাজাব ?
হ্যাঁ। আমার জন্য, বাজাবে আর একবার? আমি শুনব?
সুবল অবাক চোখে তাকিয়েই থাকে
বাজাও না ভাই, আমি ছোট্টোবেলায় খুব ভালবাসতাম ঢাকের বাজনা শুনতে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ....
চুপ করে যায় নীল শাড়ি। সুবল বোঝে না কি হত গ্রামের বাড়িতে, কেবল বোঝে দিদিমণি ছেলেবেলা খুঁজছে। হাতে কাঠি তুলে নেয় সুবল ঢাকী। নিজের খুশিতে বাজাতে থাকে, বাজাতেই থাকে। নীল শাড়ী দিদি সামনে দাঁড়িয়ে থাকে চোখে মায়ার আলো জ্বেলে। লোক জড়ো হতে থাকে এক এক করে । চোখ বন্ধ করে সুবল বাজিয়ে চলে, নাচের ছন্দে দোলে হলুদ পালক।
"অ্যাই তিতির, এখানে কি করছিস? চল , বেরোবি না? অঞ্জলী দিয়েছিস? " বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়ায়। সুবলের নীল শাড়ি দিদিমণি তখন চোখ বন্ধ করে ভাসছে। শাড়ী ছেড়ে ফ্রকের ঘেরাটোপ, শিউলির বোঁটায় রঙিন হাতের আঙুল, কোলে নতুন বই, চোখে পদ্মদীঘি।
"কি ভাল বাজাও তুমি! " দিদি হাত বাড়ায় "এ জিনিস আমি টাকা দিয়ে কিনতে পারি না, কিন্তু তবু তুমি এটুকু রাখ। তোমার ছেলেমেয়ের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও " নীল চুড়ি পরা হাতের মুঠির দিকে তাকায় সুবল।
নীল দিদি সরে যায় সামনে থেকে। যাওয়ার সময় মেঘলা মায়া মাখা গলায় বলে যায় "কাল আবার শুনিও, কেমন!"
সুবল হাতের টাকা গুনতে থাকে। আরো বাজাতে হবে। লম্বা ফর্দ মনে লেখা। সাবান, ক্রীম, ছেলে মেয়ের জামা, এক শিশি আলতা, আর হ্যাঁ, এলাচ। ফুলির একটা শাড়ি হলে মন্দ হত না তবে সেটা বাবুদের মজুরী থেকে করতে হবে। নীল শাড়ি অনেক দুরে চলে গেছে। ভুল হলে গেল বড্ড। জিজ্ঞাসা করে নিলে হত ওঁরা কি সাবান মাখেন!
সঙ্গীতা
------------------------------------------
পুজো পুজো - ৩ [অক্টোবর ১৬, ২০০৬]
সকালের এক ঝলক রোদের মত এক চিলতে হাসি হাসে দ্যুতি, আয়নায় ঘুরিয়ে দেখে নিজেকে, আবার হাসে, অল্প, এমনি-ই। নিজেকে তৈরী করতে এমন করে হাসাটা জরুরী খুব। জানতে হবে ঠিক কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললে প্রোফাইল ভাল দেখায়। অনেক দিনের অধ্যাবসায় লাগে, অনেক ধৈর্য্য। বন্ধুরা সবাই বলে ওর ফিগার একদম মডেলদের মত, ওর হাসি ভীষন ঝকঝকে। কলেজের ছেলেগুলো তো একদম ফিদা। দ্যুতি ক্লাসে থাকলে অতি অগা ছেলেও ক্লাস কাটেনা অনেক সময় ।
চুলগুলো চূড়া করে বাঁধে দ্যুতি, নরম রেশম চুলের পনিটেল ঘাড় ছুঁয়ে থাকে, গলার ডানদিকে একটা ছোট্টো তিল ভীষন অহংকারে স্পষ্ট। ড্রেসিং টেবল থেকে মাসাজ ক্রীম তুলে নেয়। অনেক কাজ এখন। মুখে ক্রীম মাসাজ করে প্যাক লাগিয়ে বসতে হবে খানিক্ষন। তারপরে স্নান সেরে সাজগোজ শুরু, আজ নবমী। মাকে বলে রেখেছে, একটা শাড়ী পরবে মায়ের । বন্ধুরা আসবে সাড়ে এগারোটায়। তার আগেই নিজেকে ঝাঁ চকচকে করে ফেলতে হবে।
দরজায় টোকা শুনে ঘাড় ঘোরায় দ্যুতি। মা নিশ্চই, টুকাই-এর তো টোকা দেওয়ার অভ্যেস নেই, আর বাবা তো এখন মাইথনে।
একটু সামনের দোকান থেকে চিনি এনে দিবি ? তাপসী ঘরে এসে ঢোকে
এখন? না আমি পারব না, তুমি টুকাইকে পাঠাও
টুকাই বেরিয়েছে, তুইই একটু এনে দে
না আমি যাব না। এই ভাবে, তৈরী না হয়ে বেরোব না আমি
আরে:! তৈরী হওয়ার কি আছে, এই তো সামনেই যাবি, যা, নিয়ে আয়
উ:। খুব বিরক্ত লাগে। আর কদিন বাদে র্যাম্পে হাঁটার স্বপ্ন দেখছে যে মেয়ে, তার এখন পাড়ার মুদীর দোকান থেকে চিনি আনা শোভা পায় নাকি?
দ্যুতি কথা না বারিয়ে তোয়ালে টেনে বাথরুমে ঢুকে যায়
পুজোর দিনে সক্কাল সক্কাল মাথা গরম হয়ে যায় তাপসীর। দিন দিন মেয়েটা কি যে হচ্ছে। আজকাল ঘরের ড্রয়ারেও চাবি দিয়ে রাখে। একদিন তাপসী ড্রয়ার ঘেঁটে দেখতে গেছিল, মেয়েটা ঠিক পথে চলছে কিনা যদি আন্দাজ পাওয়া যায়। টুকাইকে নিয়ে এখোনো অতটা চিন্তা শুরু হয় নি, কিন্তু মেয়ে দিন দিন যেমন ষোলো কলায় বাড়ছে!
তাপসী আয়নার সামনে চুপ করে দাঁড়িতে থাকে একটু। নিজেকে দেখে। চুলে একটু রূপোলী আভা, চোখের পাশ দিয়ে বয়স হাঁটছে। কি তাড়াতাড়ি এতটা পথ পেরিয়ে গেল! এই তো কিছুদিন আগেও দ্যুতির মতই নবমী হত। সকালের শাড়ী বিকেলে সালোয়র কামিজে। এত রকম পোষাক অবিশ্যি পেত না তখন, তাপসী নিজের মনেই হাসে। দ্যুতি যখন ওর মত হবে, তখন বাজারে কেমন পোষাক আসবে? এখনই তো কমতে কমতে নেই তে গিয়ে ঠেকেছে। নিজের দিকে আর একবার তাকায় তাপসী। পার্লারে গেলে হত হয়ত, এখন আর লাভ নেই, ভীড়ও হবে খুব।
মা, লেবু আছে? দ্যুতির গলা একদম স্বাভাবিক
আছে , দিচ্ছি , দাঁড়া
রান্নাঘরে গিয়ে দুটো লেবু কেটে, রস করে বীজ ছেঁকে মেয়ের হাতে দেয় তাপসী। স্নানের পরে জলে গুলে চুলে ঢালবে মেয়ে। অনেক রকম রূপটান ব্যবহার করে দ্যুতি। তাপসীও ঠিক ঠাক যোগান দিয়ে যায়। মাও তো তাই দিতেন।
এক ঢাল পিঠ ছাপানো চুল ছিল তাপসীর। এখোনো যা আছে তাই অনেকের কাছে ঈর্ষনীয়। মা খুব যত্ন করতেন ওর চুলের। রিঠা, শিকাকাই আর আমলা ভিজিয়ে রাখতেন রাতে। পরের দিন দুপুরে মাথায় ঘষতেন সেই ফেনা ওঠা জল। চোখ জ্বালা করত, লাল হয়ে যেত একফোঁটা জল ঢুকে গেলে। কিন্তু চুল সত্যি ভাল ছিল ঐ সময়। দ্যুতির মধ্যে তাপসীর আদল খুব স্পষ্ট। তবে স্বভাব একদম অন্যরকম হয়েছে। মা, বাবা কারুর স্বভাব পায়নি মেয়েটা। নাকি এটা বয়সের দোষ!
ঐ বয়সে তাপসী নিজে কেমন ছিল? খুব শান্তই ছিল, মনে আছে। লাজুক, শান্ত, একটু হয়ত ভীতুও।
ক্লাস টুয়েলভে উঠে আলাপ হয়েছিল অভিকের সাথে। সকলের অভিদা, স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বেশ চেনা নাম। টিপ্যিকাল ইউনিয়ন লিডারদের মত না । কাঁধে ঝোলা নেই, বড় পাঞ্জাবী পরে না। দিনের মধ্যে বত্রিশবার দেখতে পেত ওকে ক্যান্টিনে, ইউনিয়ন রুমে, আর নয়ত মাঠের ধারে বড় কদম গাছটার তলায়। খুব ছটফটে মনে হত দেখে অথচ লাইব্রেরীতে গেলেই কি শান্ত মানুষ। এক মনে পড়ত, নোটস লিখত ঘাড় গুঁজে। ঐ লাইব্রেরীতেই আলাপ হয়েছিল দুজনের।
তারপরে প্রথম পুজো। উ: কি উত্তেজনা! বাড়িতে কি বলে বেরোবে, মাকে কোন বন্ধুর বাড়ির কথা বলবে, যার বাড়িতে ফোন নেই, যদি ধরা পড়ে তো কি হবে? হাজার সমস্যা, সমাধান আর সম্ভাবনার পারম্যুটেশন কম্বিনেশন করে ঠিক করেছিল বেরোনো হবে নবমীর সকালে।
একটা চওড়া মেরুন পাড়, ছাই রঙা শাড়ী পড়েছিল তাপসী। খোলা চুল, চোখের কাজলে লুকোনো বিদ্যুৎ, কপালে টিপের আলো , ঠোঁটে ভিজে মিষ্টতা, তাপসী একেবারে বধ্যভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অভিকে। তারপরে কতবার যে অভির চোখের মুগ্ধতা গায়ে মেখেছে তাপসী, কিন্তু সেদিনের সেই চোখ আজও উঁকি দেয় মনে। অভির চোখের পাতা খুব বড় বড় আর ঘন। মনে হত কাজল পরেছে। তাপসী নিজেও ঐ মুগ্ধ চোখে হারিয়ে গিয়েছিল একেবারে।
খুব ঘুরেছিল দুজনে। শেষে কলেজস্কোয়্যারে গিয়ে মেজমণি আর মেসোর মুখোমুখি। তাপসী আপ্রাণ চেষ্টা করছিল বোঝাতে যে অভিক শুধু বন্ধু , আর কিচ্ছু নয়। মেজমনি হাসছিল মুখ টিপে। শেষে তাপসী বলেই ফেলল "মা কে বলে দিও না যেন মেজমণি"
খুব হেসেছিল ওরা। গালের টোলে দুষ্টুমী মাখিয়ে মেজমণি বলল "ওরে আমিও তুই ছিলাম একদিন। আমি কি জন্মেই এমন বুড়ি হয়েছি ভাবিস?"
তারপর থেকে বাড়িতে ঢুকেই আগে মেজমণি তাপসীর ঘরে হানা দিত "কি রে? হিরো কেমন আছে?"
কয়েক বছর পড়ে আবার আর এক পুজো। অভি চাকরীর খোঁজে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছে শুকনো মুখে অষ্টমীতে দেখা করেছিল।
কি হয়েছে?
কিছু না - অভি মাথা নাড়ে
আমি এখন খুব পুরোনো হয়ে গেছি তোমার কাছে, তাপসী অভিমান মাখিয়ে বলেছিল
মানে? সে আবার কি কথা? কি করে জানলে এত বড় তথ্যটা?
নয়ত কি? এত সুন্দর করে সেজেগুজে এলাম, সবাই বলল ভাল দেখাচ্ছে, অথচ তুমি আমার দিকে দেখছও না -
অভিক হেসে ফেলে - যে সারাদিন চোখের মধ্যে আছে তাকে আর নতুন করে কি দেখব শুনি?
সেই তো, ঐজন্যেই বল্লুম, পুরোনো হয়ে গেছি আমি - তাপসী মুখ ঘোরায়
দুজনে বসেছিল গঙ্গার ধারে, বেলুড়ে। খুব ভাল লাগছিল, চারিদিকে ধুনোর গন্ধ, মঠে পূজারীদের গমগমে গলায় মন্ত্রোচ্চারন, কি অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি! অনেক্ষন চুপ করে বসে থেকে অভি পকেট থেকে বার করেছিল জিনিসটা, তাপসীর হাতটা টেনে নিয়েছিল নিজের হাতে। তাপরে যেন অনেক দ্বিধায় প্রায় অস্ফুটে বলেছিল
"আমার তো এখন কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা নেই তোমাকে , তাই এটা দিলাম"
তাপসী মুঠো খুলে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা বেশ বড় সাইজের মার্বেল, দুধ সাদা, শাঁখের মত, কোনো দাগ নেই, কোনো ভেইন নেই। নিটোল গোল একটা মার্বেল।
অভি তাপসীর হাতটা মুঠিতে ধরেছিল
"এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলম রাজগীরে, বাবার সাথে বেড়াতে গিয়ে, খুব ছোটোবেলায়। আমার খুব প্রিয় জিনিস এটা, কাউকে হাত দিতে দিইনি কখোনো। ছোটোবেলায় রোজ একবার করে বার করে মুছে তুলে রাখতাম , জানো? আমার বহুদিনের সঙ্গী এই মার্বেলটা "
"তাহলে আমায় দিচ্ছ কেন?"
"কারন আমার কাছে টাকা নেই এখন একদম, তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা সবথেকে প্রিয়জনকে দিলাম"
ভাললাগায় অবশ হয়ে গিয়েছিল তাপসী। মার্বেলটা বুলিয়েছিল গালে, ঠোঁটে, যেন ছোট্টো অভির নরম হাতের স্পর্শ মেখে নিয়েছিল তখনই। আলতো গলায় বলেছিল "আমিও যত্ন করেই রাখব, দেখো।" আর অভিকে জানতে না দিয়ে মনে মনে বলেছিল "ভালবাসি, ভালবাসি"
অভি এখন একদম কেজো স্বামী । চাকরীর উন্নতি, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ, আফটার রিটায়ারমেন্ট সিকিওরিটির দিকে চোখ রাখতে রাখতে সেই মুগ্ধ চোখ হারিয়ে গেছে কোথাও। বাড়ির কাজ, দ্যুতি, টুকাই , জিনিসের দাম আর মাঝে মধ্যে আত্মীয় স্বজন সম্বন্ধে নোটস এক্সচেঞ্জ ছাড়া কথাই বা কোথায় হয় দুজনের মধ্যে? একসাথে জীবন কাটানোর সেই স্বপ্নটা কি এতই কেজো স্বপ্ন ছিল আসলে? কানের পাশের প্রায় না দেখতে পাওয়া রূপোলী গৌরবে ছোঁয়ায় তাপসী। ভীষন ইচ্ছা করছে একবার কথা বলতে। আবোল তাবোল কিছু। আজ বিকেলে ফিরবে অভি ট্যুর থেকে, কিন্তু অতক্ষন অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না। তাপসী ফোন তুলে নেয় হাতে । কথা সেরেই স্নানে যাবে, অঞ্জলী হবে সাড়ে দশটায়। তারপর একটু বেরোবে , কত আর ভীড় থাকবে পার্লারে!
মা, আমি এই শাড়িটা পড়ছি আজ
হ্যঁ পর। যেটা খুশি পর, সবই তো নতুন
শখ করে এবার বেশ কয়েকটা শাড়ী কিনেছে তাপসী। দ্যুতি গায় ফেলে দেখছে চোদ্দবার, কোনটা মানাবে ওকে।
তাপসী মনে মনে মেয়ের কপালের ডানদিকে কাজলের টিপ এঁকে দেয়। ও যা পরবে তাতেই তো মানাবে।
তুমি কোনটা পড়ছ?
তাপসী গাঢ় বেগুনী শাড়িটা বার করে আলমারী থেকে। সোনালী কুসুম হলুদ পাড়ে জরির কাজ।
ম্যাচিং ব্লাউজ আছে?
তাপসী হেসে ফেলে। এই মেয়ের ওপর রাগ করেই বা কতক্ষন থাকবে?
হ্য`ঁ, আছে, পাড় বসিয়ে করিয়ে নিয়েছি
ও: গুড, কার মা দেখতে হবে তো? দ্যুতি শাড়ি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কাঁধ ঝাঁকানোর ভঙ্গী করে, তারপরে সব ফেলে মাকে এসে জড়িয়ে ধরে - মা, তুমি যখন আমার মত ছিলে, তুমিও এরকম ছিলে? আমার মত?
তাপসীর গলায় মেজমণি ভর করে - না:, আমি কোনোদিন তোর মত ছোটো ছিলাম না। একেবারেই এমন বুড়ি হয়ে জন্মেছি
- ইশ্শ্শ, কে বলে তুমি বুড়ি? জান, আমার বন্ধু কৌশিক বলে আমি সুযোগ পেলে মাসীমাকে নিয়ে একদিন কফি খেতে যাব ঠিক, লোকে টেরিয়ে যাবে"
তাপসী অবাক চোখে তাকায় - সেকিরে? তোরা মা মাসিদেরও নিয়েও আলোচনা করিস?
করি, cool mom দের নিয়ে করি and I am very proud to be your daughter
দ্যুতি মাকে ছেড়ে আবার নিজের দিকে মন দেয়।
নবমীর সকালে প্যান্ডেলে খুব ভীড়। সুবল ঢাকি এদিক ওদিক তাকায়। নীল দিদিমণি কি আজ আসবে? কাল মুঠি খুলে দেখেছে, অনেকগুলো ট্যাকা দিয়েচে দিদি। আজ শুধু ও দিদির জন্যেই বাজাবে আর একবার।
সবাইকেই এক রকম দেখতে লাগে। তেমন লক্ষ্য করে দেখে নি কাল, আজ কি চিনতে পারবে? এই দিদিমণিরা তো ওদের ঘরের মেয়ে বৌদের মত নয় যে এক শাড়ী পড়েই গোটা পুজো কাটাবে । আজ যদি নীল না পড়ে? রাগ হয়ে যায় নিজের ওপর, ইস, একটু খেয়াল করে দেখে নিলে কি হত?
আরতি শুরু হয়েছে, সুবল শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে কাঁধে ঢাক বসিয়ে নেয় ঠিকঠাক। কাঠি দুটোর মধ্যে ভর করে সুবল মেয়ের কাছে পৌঁছে যায় । বড় ঠাকুরের মন্ত্র সুবলের কম বেশী মুখস্ত, তাই আজও নিজের মত মানে তৈরী করে সুবল বিড়বিড় করে " ফুলিরে আর টিয়ারে দেখো মাগো। আমি সব নে যাব, সব কিনে নে যাব ইস্টিশন বাজার থেকে। ওদের ভাল রেখো মাগো"
ধুনোর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। সুবল চোখ বুঁজে বাজাতেই থাকে, আরতির ঘন্টাধ্বনি শেষ হয় একসময়, ভীড় হালকা হয়ে আসে। সুবল সেই গন্ধটা অনুভব করে আশে পাশে, কালকের সেই গন্ধ, নীল দিদিমণি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। চোখ খোলে না ঢাকী । দ্বিগুন উৎসাহে কাঠি নাচে ঢাকের ওপর, নাম জিগানোর দরকার নেই আর। সুবল দোকানে গিয়ে গন্ধ শুঁকে বুঝে নেবে কোন সাবান"
বাহ, কি অপূর্ব হাত তোমার। কি অদ্ভুত সুন্দর বাজাও!
সুবল চোখ খোলে, নীল দিদিমণি দাঁড়িয়ে হাসছে মিটি মিটি, আর তারপাশে আর একজন বৌদিদি। বেগুনী শাড়ী, হলুদ পাড়। সদ্য চান করেছে মনে হয়, চুলের ঘেরে জলের কুচিতে রোদ পড়েছে। এরা সব কোন দেশ থেকে আসে? খুব সুখী মুখ এদের। কিসের সুখ? টাকার? সুবল মাথা নিচু করে।
ঢাকী বিদায়ের দিন আমার কাছে এসো, কেমন? আমি ঐ ফ্ল্যাটটায় থাকি
বৌদিদি দূরে আঙুল তুলে দেখায়। খয়েরী পর্দা ওড়া একটা জানলা দেখে নেয় সুবল
নীল দিদিমণি চুপ করেছিল এতক্ষন, এবার অল্প হেসে বৌদিদির দিকে তাকায় "আমি যাই তাপসী দি, বাড়িতে বন্ধুরা আসবে, বিকেলে দেখা হবে"
চল, আমিও যাব, বেরোবো একটু
ওদের হেঁটে যাওয়া ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সুবলের মনে একটা প্রশ্ন আসে - আচ্ছা, ফুলি কি কখোনো এমন করে দাঁড়িয়ে ওর বাজনা শুনেছে? কখোনো বলেছে, আহা, কি মিঠে হাত তোমার! মনে করতে পারে না সুবল, হয়তো শোনেই নি, বরং পুজোর শেষে বাড়ি ফিরলে কড়া পড়া হাতে , কাঁধে গরম তেল মালিশ করে দিয়েছে সবসময়।
সব কিছু কিনে নিয়ে যাবে সুবল, তারপরে মেয়ে বৌকে সাজিয়ে দাওয়ায় বসিয়ে চাঁদের আলোয় ঢাক বাজিয়ে শোনাবে। মূর্তি ছাড়াই নিজের আঙনায় মায়ের পুজো করবে সুবল ঢাকী।
(ক্রমশ:)
সঙ্গীতা
--------------------
পুজো পুজো- ৪ [অক্টোবর ১৬, ২০০৬]
জানলার পর্দা ওড়ে শব্দ করে। ঝড় উঠছে । কলেজে এক বন্ধু ছিল রফিক, গ্রামের ছেলে। আশ্বিনের ঝড়কে ও বলত আশনাই। দশমীর সকালের ঝোড়ো হাওয়ায় মুখে হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙানোর পরে এই কথাটাই প্রথমে মনে এলো অভির । তাপসী এখোনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একদম বাচ্চাদের মত ঘুমোয় তাপসী । শাড়ীর প্রান্ত তুলে উঁকি মারছে পায়ের গোছ। অবিন্যস্ত আঁচল, হাতখোঁপা ভেঙে চুল ছড়িয়েছে বালিশে। ভোরের না ফোটো আলোয় কি মায়া মাখিয়েছে মুখে। অভিক অনেক দিন পরে এত মনোযোগ দিয়ে এতক্ষন ধরে দেখছে তাপসীকে।
আচমকা মাইথনে বসে ফোন পেয়ে অবাক লেগেছিল । তাপসী কিচ্ছু বলেনি, হাসছিল শুধু। শেষে হালকা গলায় বলে "তাড়াতাড়ি চলে এসো। ভাল লাগছে না পুজোর দিনে তোমায় ছাড়া"।
অভিক আলতো হাত রাখে তাপসীর কপালে ।
ঘুমের মধ্যে খুব খুশি লাগছিল তাপসীর। একটা বড় ঘর, ঘরের মধ্যে অনেক অনেক অচেনা আসবাব , জানলা দিয়ে খুব অষ্পষ্ট আলোর আভাস। একটা ইজিচেয়ার, এটি চেনা। ওদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় পাতা থাকে, আর সেই চেয়ারের ওপরে আধশোয়া হয়ে আছেন বাবা। ভীষন , ভীষন ভাল লাগে দেখে। তাপসী দৌড়ে কাছে যায়, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে "তুমি এসেছ বাবা? দেখ, আমি নতুন শাড়ি পড়েছি। ভাল না? দেখ ... " বাবা খুব সুন্দর করে হাসেন । খুব ভাল লাগে তাপসীর । কত্ত গল্প জমে আছে, অনেক অনেক কথা বলার আছে বাবাকে। কিন্তু পায়ের কাছে আসন পিঁড়ি হয়ে বসতে বসতে আচমকাই ঘুমটা ভে`ঙে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় সক্কাল বেলা, আরো একটু বেশিক্ষন ঘুমটা থাকল না! আরো একটু বেশি সময় কাছে বসতে পারত মানুষটার....
তিতিরের ঘুম ভেঙেছে মাঝরাতে। বন্ধুদের সাথে প্যান্ডেলে বসে আড্ডা দিয়েছে অনেক রাত অবধি। ওরা সবাই মিলে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেল। ডেকেছিল অনেক করে, কিন্তু যেতে ইচ্ছা করল না একদম । বোধহয় মনের মধ্যে একটা আশা ছিল আজ একবার ফোন আসবে, আসবেই। হাতের মুঠিতে ফোনটা নিয়েই শুয়েছিল, যদি ঘুমিয়ে পড়ে! মাঝরাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভাঙল। অনেক দূর থেকে কেউ যেন ডাকছে তিতি ই ই ই ই। খুব মিহি আওয়াজ গলার, ঠিক যেন কোনো বাচ্ছার গলা, নরম চিকন বালির মত অল্প দানা মেশানো আওয়াজ । তিতির প্রাণপনে মনে করার চেষ্টা করছিল কোথায় এই আওয়াজ শুনেছে। ঘুমচোখে অন্ধকার ঘরে চোখ সইয়ে নিতে নিতেই মনে পড়ে যায় নামটা। রুনার গলার আওয়াজ। ঠিক এমনি করেই ডাকত রুনা, তিতি ই ই ই ই- সুরেলা নরম ভাসিয়ে দেওয়া গলায় ডাক দিত। ক্লাস সেভেনে উঠে রুনারা এসেছিল ওদের স্কুলে। বম্বে থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন ওর বাবা। স্কুলের তৃতীয় দিনে ওর সাথে ভাব পাতিয়েছিল নিজেই। দেখতে দেখতে বন্ধুত্ব। স্কুলের শেষের দিকে তো মনে হত এর পরে এক জন আর একজনকে ছেড়ে থাকবে কি করে। কিন্তু সে দিনও এল টুয়েলভের পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল দুজনের। কাকু ট্রান্সফার হলেন কানপুরে। ওখানে গিয়েও মাঝে মধ্যে চিঠি চাপাটি চলেছে কিন্তু আস্তে আস্তে তাতেও ভাঁটা পড়ে গেল। কত বছর হয়ে গেছে রুনার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আজ নবমীর শেষ প্রহরে কেন যে রুনার ডাক কানে এলো কে জানে!
একবার ঘুম ভাঙলে ঘুম আসে না সহজে, তিতির উঠে বসে , রাইটিং প্যাড টেনে নেয়। এবছর আবার অনেক দিন পরে বিজয়ায় চিঠি লিখবে । ফোনে, ই-মেল-এ শুভেচ্ছা আর প্রণাম পাঠানো রেওয়াজ হয়ে গেছে আজকাল। কম্পিউটার খুললেই দেখবে গোছা গোছা ই-কর্ড শুভেচ্ছা মুড়ে পৌঁছে গেছে বাক্সে। কিন্তু তিতিরের এখন খুব লেখা পাচ্ছে, কিছু লিখতে হবে এখন । চোখ বন্ধ করে একটু ভাবে তিতির , তারপরে একটা সাদা পাতা টেনে লিখতে বসে তাকে, যার ফোনের অপেক্ষায় দিন রাত কাটে তিতিরের।
সুবল আজ মহা খুশী। এই বাবুরা নিয়ম মেনে দশমীর দিনেই মায়ের বিসর্জন করবে, তার মানে আজই সব গুছিয়ে গাছিয়ে ছেলেকে নিয়ে লাস্ট ট্রেন ধরে নিজের ঘরের দুগ্গার কাছে পৌঁছবে সুবল। অত রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়বে জানে, কিন্তু তবু কি খুশি যে লাগে মনটায়। ছেলেকে তাড়া দেয় বার বার । চটপট কাজ সার। সকালেই বড় ঠাকুর বিসর্জনের মন্ত্র পড়বেন। বিকেলে সিঁদুর খেলা সেরে মাকে রওনা করানো হবে । এই কদিন খাওয়া বেশ ভাল হয়েছে। এদের এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সপ্তমী থেকে নবমী,দুবেলা। বাবুরা বলে দেছলেন খাবার সময় ঐ দালানে গিয়ে খেয়ে নিতে, টিকিট লাগবে না। বাপ ব্যাটায় মিলে পেট পুরে খেয়েছে এই কদিন। ভুলুটা বারবার বলছিল "মা আর টিয়া কি খেলো কে জানে!"
খুব ভালো কোরে বাজার করবে কাল, বৃষ্টি বাদলায় পেছনের ডোবাটায় জল বাড়ে। আজ ভোররাতে এখানে তো এক পশলা ঢালল, ওখানে কি হয়েছে কে জানে । ছাতিমগাছের গোড়া থেকে পিঁপড়ের ডিম তুলে ছিপ ফেলে বসলে হয় একবার কাল। নিজের মনেই হাসে ঢাকী। ঐ ডোবায় ছিপ দিলেই ফুলি হাসে "যাও, বড় দেখে হাঁড়ি নিয়ে যেও, বড় বড় ইলিশ উঠবে দেখো"। ইলিশ কতদিন খায়নি, স্বাদ ভুলে গেছে । এক এক করে প্যান্ডেলে লোক জড়ো হচ্ছে। এরা নিশ্চয়ই প্রায়ই ইলিশ খেতে পায়! সুবলের হঠাৎ ইচ্ছা করে বাবু হতে। মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতজোড় করে সুবল বিড়বিড় করে "আমাকে একদিনের জন্যি বাবু করে দ্যাও মাগো, বৌ বাচ্চাদের দুটি ভাল মন্দ খাওয়াই"
মোড়ের মিষ্টির দোকানে খুব ভীড়। শোকেস ভর্তি মিষ্টি, ওপরেও হলুদ প্লাস্টিক ঢাকা মিহিদানা উঁচু করে ঢালা। কড়াইয়ে গরম জিলিপী আর সিঙাড়ার ভাপ উঠছে। অভিক অনেকগুলো জিলিপি সিঙাড়া কিনে ফেলে। ছোট্টোবেলায় বাবার হাত ধরে এমনই কচুরী, জিলিপি, সিঙাড়া কিনতে যেত মহালয়ায় আর বিজয়া দশমীতে। বাড়িতে মা মুচমুচে নিমকি ভাজতেন কালো জিরে দিয়ে। তাপসীও ভাজে নিমকি, খুব খাস্তা করে, কিন্তু তবু মায়ের নিমকির মত লাগে না জিভে। কেন কেন জানে? নিমকি ভাজার মানুষটা অন্য হয়ে গেছে বলে, নাকি জিভটাই পাল্টে গেছে এখন? কাল সকলে মিলে যাবে মা বাবাকে প্রণাম করতে, মাকে বলবে একটু নিমকি বানিয়ে দিতে। তাপসী কি রাগ করবে? মনে হয় না, তাপসী সব বোঝে, সব। এটাও বুঝবে নিশ্চই।
স্নান সেরে নেয় তাপসী। সাদা চওড়া পাড় শাড়ি পরে একটা। ফ্ল্যাটবাড়ির এক চিলতে কোনে ঠাকুরের আসনের সামনে গিয়ে বসে,বাবার ছবিটা হাতে তুলে নেয়। নতুন শাড়ির আঁচল দিয়ে যত্ন করে মোছে ছবিটা, যেন নিজের আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুরের আসনের ফুলের গন্ধ , ধূপের গন্ধ ছাপিয়ে তাপসী বাবার সিগারেটের গন্ধটা খোঁজে। এক বছর সাত মাস হল বাবা চলে গেছেন। দশমীর সকালে বাবার ছবি বুকে নিয়ে তাপসীর গাল ছাপিয়ে জল নামতে থাকে ।
"মা, চলো, খেতে দেবে, বাবা কত্ত জিলিপি এনেছে" দ্যুতি সামনে এসে দাঁড়ায়। বাসি জামায় বাসি চুলে মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কদিন পুজোর তালে হুল্লোড়ও হয়েছে খুব। তাপসী রান্নাঘরের দিকে এগোয়।
রোদ চড়ে গেছে মাথার ওপর । ছোটো ঠাকুরমশাই বড় পিতলের পাত্রে দই, চিঁড়ে, মুড়কি, কলা, বাতাসায় দধিকর্মার যোগাড়ে ব্যস্ত। বড় ঠাকুরমশাই কোশাকুশির জলে রাখার বেলপাতা খুঁজছেন। মায়ের যাবার আয়োজন প্রায় সারা। ইচ্ছে করছিল না আসতে, তবু নেমে এসেছে তিতির। সারারাত ধরে লেখা চিঠিটা সকালে কুচি কুচি করে ফেলে দিয়েছে কাগজের ঝুড়িতে। মাঝরাতে লেখা চিঠিতে অনেক নগ্ন সত্যি থাকে, নিজের ভালবাসা, রাগ, অভিমান সবই বড় তীব্র সুরে বাজে। ভোরের আলোয় সে চিঠি নিজেকেই লজ্জা দেয়। অমন আকুতি, অমন ডাক কি তিতিরের বুক থেকে বেরিয়েছে? পড়ে নিজেই লজ্জা পায় তিতির। একবার মনে হয়েছিল লেখা যখন হয়েই গেছে, পাঠালেই বা ক্ষতি কি? কিন্তু মন সায় দেয় না পুরোপুরি। সারারাত ধরে লেখা চিঠিখানা একরাশ সাদা শিউলি হয়ে যায়। স্নান সেরে তিতির নেমে আসে প্যান্ডেলে, আজ ঐ ঢাকীকে বলতে হবে আরো একবার অমন করে ঢাকটা বাজাতে। গ্রামের সিংহবাহিনীর নাট
অমন্দিরে দাঁড়িয়ে প্রণাম সারতে গেলে ঐ ঢাকের আওয়াজের পথটুকুই ভরসা।
সন্ধ্যের মুখেই বাবুদের দুটো লরি এলো। একটাতে মা আর অন্যটাতে ছেলেমেয়েকে ওঠানো হবে। তাপসীর গালে কপালে লাল টুকটুকে সিঁদুর মাখা। অভিক ক্যামেরা চার্জ করিয়ে রেখেছিল। অনেক ফটো তুলবে আজ। লালপেড়ে সাদা শাড়িতে মাকে দেখে খুব ভাল লাগে দ্যুতির। সকলেই বলে ও মায়ের থেকেও বেশি সুন্দর হবে, কিন্তু আজ ঐ সিঁদুর মাখা খুশি মুখটা দেখে মনে হচ্ছে দুজনে পাশাপাশি র্যাম্পে হাঁটলে এখোনো লোকে আগে মাকে দেখেই মুগ্ধ হবে। বড্ড ভাল লাগে হঠাৎ। ঠাকুর ভাসান যায়নি এখোনো কিন্তু দ্যুতি হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে তাপসীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেলে।
তিতিরও সেজেছে লাল পেড়ে শাড়িতে, ভেতরে চাঁপা রঙের ওপর লাল ফুল তোলা প্রিন্টেড তাঁত। সবাই কি উচ্ছাসে সিঁদুর খেলছে। তিতিরের বন্ধুরা যারা বিবাহিত, তারা হোলি খেলার মত করে সিঁদুর মেখেছে। তিতিরেরও ইচ্ছা করে ঐ অহঙ্কার মেখে নিতে মুখে, গলায়। খুব খুব ইচ্ছা করে। মনের মধ্যে ফিসফিসিয়ে ডাক দেয় তাকে। শুনতে কি পায় সে?
সুবলের বাঁধাছাঁদা সারা। বাবুদের পাওনাগন্ডা , ঢাকী বিদায়ের বকশিশ মিলে বেশ কিছু টাকা এসেছে হাতে। তাড়া তাড়ি এগোতে পারলে শেয়ালদা ইস্টিশন থেকেই সব কিনে নেবে। যা যা ভেবে রেখেছে।
নীল দিদিমনিকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেমন বৌ বৌ। সামনে এসে দাঁড়ায় দিদিমনি "ঢাক বাজাবে না এখন?" সুবল আর একবার নিশ্বাসে মেখে নেয় গন্ধটা তারপরে মাথা নেড়ে ঢাকে কাঠি ছোঁয়ায়। বাজাবে বৈ কি, প্রাণ খুলে বাজাবে। আজই তো বাজাবে, এর পরেই তো সুবল ঢাকী থেকে হয়ে যাবে সুবল ফিরিওয়ালা। তার আগে একবার কলজে নিংড়ে না বাজলে কি চলে?
সুবল কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে ঢাক সোজা করে।
তাপসির বুকের মধ্যে একা এক মেয়ে পাগলের মত তার বাবাকে খোঁজে। অভিকের ক্যামেরায় অনেক অনেক খুশি মুখের ভীড়। দ্যুতি বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যেবেলায় আইসক্রীম খেটে যাওয়ার প্ল্যান করে। সুবলের বন্ধ চোখের ওপারে পুজো মন্ডপটা ওর বাড়ির উঠোন হয়ে যায়, আলতা পরা পা দুলিয়ে টিয়া মাথা দোলায় বাজনার তালে তালে। বাজনার তালে । তিতির জোড় হাতে চোখ বন্ধ করে একবার দাঁড়ায় চন্ডীমন্ডপের চাতালে, তারপর ফ্রকের ঘের উড়িয়ে দৌড়োতে থাকে কাশবনের গা ঘেঁষে পদ্মদীঘির পাড় বরাবর।
-------------------
সমস্ত মজলিশিদের জন্য রইল শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
ভাল থাকুন সকলে, ভাল রাখুন সকলকে
সঙ্গীতা
sangita | - | -