সত্যিকথা বলতে কি একের পর এক ছোট বড় ধাক্কার মধ্যে দিয়ে যেমন টের পাওয়া যায় যে জীবনে তরঙ্গ আছে, তেমনি বারবার একইরকমের ধাক্কা যখন আসতে থাকে তখন তরঙ্গমুখের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও খুব বেশি ভয় বা রোমাঞ্চ হয় না। শুধু ব্যালেন্স করে নেবার কায়দাটুকু যা রপ্ত করবার ব্যাপার। চতুর্দিকে গোল হয়ে ঘিরে রয়েছে দর্শকেরা, সার্কাসের দড়ির খেলা দেখাবার সময় যেমন সব উদগ্রীব হয়ে দেখতে থাকে। একটার পর একটা খেলা তুমি দেখাতে থাকবে, তারা হাততালি দেবে, আরও কঠিন কিছু দেখবার অপেক্ষায় থাকবে, বলবে বাহ বাহ কী দারুন কী ট্যালেন্ট হাউ ব্রেভ ইউ আর।
সেদিন বড়োসায়েবের নতুন বৌ এবং সেক্রেটারী সজ্ঞানে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন উডল্যান্ডসে। সকাল থেকেই বড়োসায়েব নেই, তবু সেই ঘরের সামনের ঘরটায় সেক্রেটারীর কাজ আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। মুহূর্মুহু আসছে শুভেচ্ছাবার্তা ফুল মদ উপহারের প্যাকেট। বড়োসায়েবের চেয়েও তার মোসায়েবদের আহ্লাদ কয়েক গুণ বেশী।
এক এক সময় থমকে যাই, ভাবি, এই মোসায়েবরা কি নিজেদের সন্তানের জন্মের সময়ও এতটাই উৎফুল্ল হতো? স্বয়ং বড়োসায়েবের আনন্দের বহর কি এর চেয়েও বেশি না কম? তাঁকে তো দেখা যাচ্ছে না, তিনি উডল্যান্ডসে বসে রয়েছেন গিন্নির বেডের পাশে। খবরে প্রকাশ নবজাতকের দৈর্ঘ্য ওজন স্বাস্থ্য সবই পারফেক্ট। পুত্রসন্তান জন্মানোর কারনে মোসায়েবের দল তাদের উল্লাসে অতিরিক্ত একটা মাত্রা জুড়ে দিল। বড়োসায়েবের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, আমার সামনে দিয়েই লোকজন সেখানে ঢুকছে বের হচ্ছে। সবাই সায়েব, এদের কারোকে এর আগে কখনও দেখিনি। কোত্থেকে সব খবর পেয়ে এসেছে কে জানে! মিঠুবাবু খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত মিঠুবাবুর গিন্নিও। ফ্লুরিজ থেকে ইয়াব্বড় কেক এনে রাখা হয়েছে বড়ো সায়েবের টেবিলের ওপর। আজ আমায় কেউ ট্রে হাতে ধরিয়ে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব দেয় নি। আমি জাস্ট দর্শক। লোকগুলো সকাল দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেল। টেলিফোনে কনফারেন্স কল বসেছে হাসপাতালের ঘর থেকে বড়োসায়েবের ঘরে। লাউডস্পীকারে কথা শোনা যাচ্ছে। গদোগদো হয়ে সায়েবেরা তাদের আনন্দের অভিব্যক্তি জানাচ্ছে বড়োসায়েব ও বড়োগিন্নিকে। একজন তো কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল, আনন্দাশ্রু। টানা দুঘন্টা এ জিনিস চলার পর লাঞ্চব্রেক হয়ে গেল। মিঠুবাবু আমাকে বলে গেলেন যে ঘরটা যেন বেয়ারাদের ডেকে একদফা গুছিয়ে দিই। টিপিনের পর আবার এরকম হবে, তবে তখন যদি বড়োসায়েব হুট করে এসে পড়ে তবে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না, তাই ঘরটা নীট অ্যান্ড ক্লীন করে রাখা জরুরি। এর মধ্যে কয়েকজন মাতাল মেয়েদের টয়লেটে চলে গেছে, তাদেরকে সামলানোর জন্য সাশাকে দরকার, মিঠুবাবু চেঁচাচ্ছে ― সাশা, প্লীজ ওদের লেডিস টয়লেটে পেচ্ছাপ করতে বারণ করো।
সাশা চোয়াল শক্ত করে হনহনিয়ে লেডিস টয়লেটের দিকে ছুটে গেল। সুইপার ঘর পরিস্কার করতে এসে বলল, ম্যাডাম এই কেক কি রেখে দেব না ফেলে দেব? কেকের হয়ত বিশ শতাংশ খাওয়া হয়েছে। বাকিটা একটু কেৎরে পড়ে আছে। বললাম, এখন সরিয়ে রাখ, মিঠুবাবু যদি চায় তো বের করে দিস। তারপর ভাবলাম ভুল বললাম কি? এই ফেলে যাওয়া কেক কি ওরা আর ফিরে খেতে চাইবে? সে কেক নিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি দৌড়ে যাই পেছন পেছন, তোরা খেয়ে নে বাকিটা, ও কেক আর এখানে আনতে হবে না।
আমি লাঞ্চের আগে তিনতলায় নিজের জায়গায় যেতে গিয়ে দেখলাম চাকরির প্রথম দিনে যে ঘরটায় বসতাম, তার উল্টোদিকের তালাবন্ধ ঘরটা আজ খোলা, শুধু খোলাই না, সেই ঘরের দরজার পাল্লা ঠেলে বেরিয়ে এল এক যুবক। আমার চেয়ে সামান্য ছোট হবে বয়সে। দেখে মনে হচ্ছে বাঙালি। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নতুন নাকি?
ছেলেটা হাসল। না মানে আমি অল্প কদিনের জন্য এসেছি।
― কেন? অল্প দিনের জন্য কেন? কী কাজ?
― অডিটের জন্য।
― অডিট মানে?
ছেলেটা হোহো করে হাসে। আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাই। বলি, চলো ঐ ঘরে, চা খাবে তো? ওখানে চা আছে বিস্কুট আছে। আড্ডাও দেওয়া যাবে।
সে আমায় বোঝায় অডিট কী বস্তু ও কতপ্রকার। আমরা অল্প সময়েই বন্ধু হয়ে উঠি। ছেলেটি একটা অডিটিং ফার্মের হয়ে এসেছে, এমনিতে সে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সীর ছাত্র, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে পড়াশোনা, বেকবাগানের মোড়ে যে বাড়িটা বিয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় তার পাশেই ওদের ফার্ম। অনেক কথা বলে যায় ও। হাসতে হাসতেই বলে যদিও, কিন্তু শুনলে একটু ভয় ভয় করে।
মানুষ যখন আনন্দে থাকে, সে তার চারপাশের সব কিছু দেখতে পায়, নিজেকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করে না। কিন্তু যখন আনন্দের পাল্লা খালি, চারদিক থেকে নিরানন্দ চেপে ধরছে তাকে, কোণঠাশা হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার, তার আর কিছু দেখতে পাবার ফুরসৎ থাকে না। তখন কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবনা আর দুশ্চিন্তা। প্রত্যেক দিন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে কত কম মানুষ আমি, একজন সম্পূর্ণ মানুষের থেকে কত হীন, সবাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমার নিকৃষ্টতা। এক এক সময়ে মনে হত, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি, না কি পাগল হয়েই গেছি? আবার নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি তা কী করে হবে, পাগল হয়ে গেলে রোজ সেজেগুজে অফিসে যাই, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত টিপটপ থাকে নিখুঁত সাজগোজে কী করে? অফিসে আমার কাজে সবাই সন্তুষ্ট, কখনও কোনও অভিযোগ করে নি কেউ, অবশ্য যদিনা সেই গ্লাস বোতল ভেঙে ফেলার ঘটনাটা ধরা না হয় তবেই। কিন্তু সেটা তো আমার দোষ ছিল না। আমার ব্যবহারেও সবাই খুব খুশি, যত কাজই দেওয়া হোক না কেন সব করে দিই সময়মত, কখনও কারোকে ফিরিয়ে দিই নি। এতসব যে করে চলেছে সে পাগল হবে কেমন করে? পাগলে এত সব পারে? কিন্তু আমার মন নিরানন্দে ভরা, অথচ কত খুশিতে থাকার কথা ছিল, মেয়েকে কাছে পেয়েছি, লোকে শুনলে বলবে তোমার আর কী চাই? এক এক করে যা চেয়েছ সবই তো পেলে। আমি যুক্তিতে এসব খণ্ডাতে পারব না। আমি গুছিয়ে তর্ক করতে পারব না এমন যুক্তির সামনে। কেমন যেন লোকে সুযোগ পেয়ে অপমান করে যায়, যেটা ধরতে পারলেও সময় মত প্রতিবাদ করে উঠতে পারি না।
এই যেমন সেদিন হঠাৎ সাশা এসে আগবাড়িয়ে বলল, তুমি পারফিউম মাখো না?
আমি সহজ প্রশ্ন ভেবে সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলাম ― নাহ।
উত্তর শুনে সাশা গম্ভীর মুখে বলল, এবার থেকে মেখো।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, তা ও বললাম, কেন?
সাশা মুখ গম্ভীর রেখেই বলল, পারফিউম মেখো, তোমার গায়ে একটা গন্ধ আছে।
এটা অপমান কি না সেটা বুঝতে বুঝতেই বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেছে। তার মধ্যে সাশা আরও একটা বাক্য যোগ করে ফেলেছে ― সের্গেই বলে পাঠিয়েছে আমাকে, তোমার কাছে এলেই ওর নাকে গন্ধ লাগে। একটা ভাল দেখে পারফিউম কিনে নিও, সুন্দর গন্ধওয়ালা।
সাশা চলে গেল। আমি কোনও উত্তর দিতে পারি নি। পুরো ব্যাপারটার প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে হতে শুরু করল আমার ভেতরে। সেটা ক্রমশ বাড়তে শুরু করল, বাড়তে বাড়তে সেটা কোথায় গিয়ে থামবে তা আমি জানি না। আমার মাথার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, হয়ত চোখ দিয়ে জল পড়ছে, আমি জানি না পড়ছে কি না, আমি বুঝতে চেষ্টা করছি এটার নাম কি অপমান করা, নাকি এরকমই নিয়ম এই সমাজে।
মানুষ কি তার নিজের শরীরের দুর্গন্ধ বুঝতে পারে? কতদিন যাবদ এরকম দুর্গন্ধ আমার গায়ে? ইশ্, আমি জানতামই না! কী লজ্জার কথা। কিন্তু কেন এমন দুর্গন্ধ হল আমার শরীরে? আমি বুঝতে পারি না লজ্জা কেন পাচ্ছি, দুর্গন্ধের কারনে না অপমানিত হবার জন্য। আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি, আয়নায় সব ঝাপসা, তবু যতটা সম্ভব নিজের শরীর শুঁকে চলেছি গন্ধের উৎস খুঁজতে, খুঁজে পাচ্ছি না, কেন পাচ্ছি না? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? কাকে জিজ্ঞেস করব? কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? নীচে রিসেপশনে গিয়ে সুরঞ্জনাকে বলব কি, সুরঞ্জনা একটা সত্যি কথা বলবি, আমার গায়ে কি খুব দুর্গন্ধ? হ্যাঁ, লাঞ্চ ব্রেকে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু লাঞ্চ ব্রেকে তো ও রাশিয়ানদের বৌদের ইংরিজি পড়াতে চলে যাবে, তাহলে কাকে জিজ্ঞেস করব? তেমন বিশ্বস্ত কে আছে আমার, যে এই প্রশ্ন শুনে হাসাহাসি করবে না? যতক্ষণ না এই প্রশ্নের ঠিকমত উত্তর পাচ্ছি স্থির থাকতে পারছি না, আমার ভয়ানক লজ্জা করছে এই ভেবে যে, সবাই জানে আমার সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ, সবাই জানে, তারা এতদিন আমাকে কিছু বলে নি, উহ।
অডিট ফার্মের সেই ছেলেটা আমাদের ঘরে ঢুকেছে, আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, হয়ত কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, আমি পিছু হটতে থাকি, আমার পিঠ সত্যি সত্যিই দেয়ালে ঠেকে যায়, ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে, কী সব যেন চাইছে আমার কাছে, কিছু স্টেশনারি, কাগজ, রাইটিং প্যাড, ডটপেন, স্কেল, পেন্সিল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওগুলো নিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে একটা টেবিলের ওপর রেখে দিই সব, অন্তত একজন নাহয় না জানল আমার সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ। কাজে মন বসাতে পারছি না আমি। আচ্ছা ওরা যে আমাকে এই কথাটা বলল, মানে একজন বলে পাঠাল, অন্যজন এসে বলল, ওরা কি এরকম কথা অন্য কারোকে বলতে পারত, যদি অন্য কেউ, ধরা যাক বড়োসায়েব, কি মেজসায়েব বা বড়োসায়েবের বৌয়ের গায়ে যদি আমার মত দুর্গন্ধ থাকত? এমনি করে বলতে পারত? কীসব ভাবছি আমি, তাদের কী করে বলবে? তারা এমনিতেই দামি দামি সেন্ট মাখে, তাদের গায়ে গন্ধ থাকলেও দামি সাবান সেন্টের গন্ধে চাপা পড়ে যাবে, তাদের কেউ এসব বলবার সাহস পাবে না।
সের্গেই বলে পাঠিয়েছে সাশাকে দিয়ে! তার মানে আমাকে নিয়ে ওরা আলোচনা করে। কদিন আগে ব্রা-প্যান্টির সেট পাঠিয়েছিল এখনও পড়ে আছে আমার দেরাজে। আমায় নিয়ে রৌরকেল্লা যাবে বলেছিল, এখন গায়ের গন্ধ নিয়ে দুজনে আলোচনা করছে। কিন্তু এই যে গন্ধের ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, লজ্জায় অপমানে এমন অবস্থা হয়েছে আমার যে সত্যাসত্য যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠল, বস ডাকছে নাকি? এখন বসের ঘরে গেলে সের্গেইয়ের সঙ্গে দেখা হবেই, বসকে বলে দেব তখন যে সের্গেই আমার গায়ের গন্ধ নিয়ে সাশাকে এসব বলেছে? ফোনটা ধরলাম, বস নয়, বাইরের কল ―নিরঞ্জনদা। নিরঞ্জনদা আমার খবর নিল, কেমন আছি, কী করছি ইত্যাদি, আমি পুরোনো বাড়িতে ফিরে যাবার পর কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, ― আমি হুঁ হাঁ করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ কী যেন হয় আমার মধ্যে, ধাঁ করে বলে বসি, আচ্ছা নিরঞ্জনদা একটা প্রশ্ন করব আপনাকে, সত্যি করে উত্তর দেবেন তো? বলুন তো, আপনার কি মনে হয় আমি পাগল?
― না। একদম মনে হয় না। এসব কথা ভাবছ কেন? শক্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ, পাগল তুমি নও।
― আরেকটা প্রশ্ন করব?
― কী?
আমি আমতা আমতা করে বলি, আচ্ছা আপনি কি কখনও আমার… মানে বলতে চাইছি যে আমার গায়ে কি কোনও বাজে গন্ধ আছে? কখনও পেয়েছেন?
নিরঞ্জনদা একটু চুপ করে থেকে বলল, তা একটু আছে।
আমি বুঝে যাই, আমার গায়ে দুর্গন্ধ তা সবাই জানে। আর কী বলব এখন আমি? আমি চুপ হয়ে গেছি, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিরঞ্জনদা আমায় উপায় বাৎলে দেয়, তুমি ডিও ব্যবহার করতে পারো, আজকাল তো সবাই মাখে।
কেউ পারফিউম মাখতে বলছে তো কেউ ডিও। মানুষের জীবনে অল্প কিছু অহংকার থাকে তার একান্ত নিজস্ব, আমি বুঝতে পারি, আমার কিচ্ছু নেই। নাথিং।
(চলবে)