দুই কন্যা, সেজোপুত্র, আরবাব আকন্দবাবু ও আমি — মোট পাঁচজনে দাঁড়িয়ে রয়েছি মাদাম তুসোর মিউজিয়ামের গেটের সামনে, টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন তো বটেই তবে তার চেয়েও লম্বা চওড়া হচ্ছে টিকিটের দাম। তিনজন বাচ্চার টিকিটের মূল্য কম, আমরা অ্যাডাল্ট আমাদের দাম বেশি। বাচ্চাদের হাতে কোনও পয়সাকড়ি নেই, অবশ্য থাকলেও তারা বের করবে না, মরিয়মের কাছে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু শে খুবই বুদ্ধিমতী, গোবেচারার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এই মিউজিয়ামের নাম আমি সিনিয়র দাদাদের কাছে শুনেছি তো বটেই, বিভিন্ন মোমের মূর্তির সঙ্গে তাদের ফোটোও দেখেছি। ইদানীং ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিও নাকি এখানে স্থান পেয়েছে। সিনেমাহল টাইপের দেখতে বাড়িটা। আজ সকালে বৃষ্টি বাদলাও নেই, তবু আমার মনের মধ্যে আতঙ্কের মেঘ, এত খরচ করে মোমের পুতুল দেখে পয়সা নষ্ট করতে মন রাজি হচ্ছে না।
আকন্দবাবু পুরুষোচিত স্মার্টনেসে কাউন্টারের কাছ থেকে ঘুরে এলেন সুখবর নিয়ে। আমরা পাঁচজনে যদি নিজেদেরতে একটা গোটা ফ্যামিলি বলে দাবি করি, তাহলে টিকিটের দাম কম পড়বে। হাজবেন্ড, ওয়াইফ, তিনটে বাচ্চা। মোট দামের ফিফটি পারসেন্ট দেবেন উনি, ফিফটি পারসেন্ট আমি। তাই ই সই। তারপর চলল আমাদের মাদাম তুসো অভিযান। হিটলারের মোমের মূর্তি একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে রেখেছে, বাকিরা খোলা। আর রয়েছে হরর রুম, একটা ছোট্ট শো, দূর থেকে দেখাচ্ছে ঘচাৎ করে একজনের মুন্ডু কাটা পড়ল। বেশিক্ষণ লাগল না পুরোটা দেখতে। আহামরি কিছু নয় তবু লোকে টিকিট কেটে দেখছে, অথম ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে প্রবেশ মূল্য নেই, সেখানে অত লাইনও নেই।
বাইরে বেরোতেই অল্প কয়েক পা হাঁটলে মোড়ের মাথায় খাবারের দোকান। বাচ্চারা খেতে চাইছে। সবাই বিগবারগার খাবে। দেখে হামবুর্গারের মত লাগল। জিনিসটা বড়া খাসি দিয়ে বানানো। আমি হামবুর্গার চাচ্ছিলাম, ওরা বলল ওটা হ্যামবারগার অর্থাৎ হ্যাম দিয়ে বানানো, নিষিদ্ধ মাংস। হামবুর্গে ঐ রকম স্যান্ডুইচের উৎপত্তি বলেই ওগুলোকে হামবুর্গার বলে ব'লে জানতাম, কিন্তু ক্রমে সেটার পরিবর্তন হয়ে হামবুর্গের হাম হ্যাম হয়ে গিয়ে শুয়োরের মাংস বনে গেছে। নতুন জিনিস শিখলাম।
খাবারের দামের খুব অল্প অংশ আমাকে দিতে হয়েছিল। আর দিন তিনেক পরেই ইদ। সম্ভবত মঙ্গল বা বুধবার। সঠিক তারিখ আগে থেকে বলা যায় না।
ফিরবার পথে আকন্দবাবু বললেন পরদিন আমাকে লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাবেন। আমি বোকার মত বলে ফেলেছিলাম — অক্সফোর্ড?
উনি হাসি চেপে বললেন — না। এটা আলাদা ইউনিভার্সিটি। অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজের মত অত বিখ্যাত না।
আমার হুট করে মনে পড়ে গেল এদেশে আমার এক দাদা থাকে, কাজিন। ডাক্তার। লন্ডনে নয়, অন্য একটা শহরে। শহরটার নাম একটু খটমটে, দাদা যখন কোলকাতায় এসেছিল বিয়ে করতে, তখন নামটা বলেছিল। কয়লা টয়লার জন্য বিখ্যাত। আহা সেই যে বলে না, টু ক্যারি কোল টু ...
— নিউক্যাসল?
ফশ করে বলে ফেললেন আরবাব আকন্দ।
— হ্যাঁ, ওটাই হবে। কতদূর বলুন তো লন্ডন থেকে?
— দূরত্ব ভালোই আছে। যাবেন দাদার বাড়ি? চাচাতো ভাই?
— না। আমার ঠাকুমার মেজদার বড়োমেয়ে বাসন্তীপিসির বড়োছেলে সুমন্তদা। কিন্তু আমি তো ঠিকানা জানি না। কী আর করব অতদূরে গিয়ে! তারচেয়ে এখানেই ভাল। আমি ছাত্র মানুষ, রোজগার তো করি না।
— সেটা সত্য কথা।
বাড়ি ফিরে দেখলাম মনোয়ারা পা ছড়িয়ে বসে একটা গামলার মতো বাটিতে কিমার তরকারি দিয়ে ভাত মেখে আপন মনে খেয়ে চলেছেন। জহির নিজের মনে দুষ্টুমি করে যাচ্ছে।
তিন চারদিন হয়ে গেছে ছেলে বাড়ি ফেরে নি, তার খোঁজ খবর নেই। বাচ্চারা হুটোপুটি করতে লাগল।
মরিয়মকে বাজারে পাঠালেন টাকা দিয়ে, সঙ্গে আমিও চললাম।
একটা বিশেষ দোকান থেকে সে সাপ্তাহিক যতটা মাংসের কিমা দরকার কিনে আনবে। হালাল শপ।
এরকম দোকান আমি সোভিয়েত দেশে দেখি নি। হালাল শপে মরিয়ম কিমা কিনছে, আমি দেখছি দোকানের বাইরে ফুটপাথে বিকোচ্ছে বাহারি নেলপলিশ। একটা একপাউন্ড তিনটে দুপাউন্ড। কী অসম্ভব সব রং! সবুজ, নীল, কালো, তুঁতে!
তিনটে কিনে ফেললাম। আমার প্রথম শপিং লন্ডনে। কালো নেলপলিশ পরে সকলকে তাক লাগিয়ে দেব হস্টেলে ফিরে।
বাজার সেরে ফিরতে ফিরতে সন্ধে।
মনোয়ারা আমাকে ডেকে একটা নোটবুক খুলে একটা ফোন নম্বর দেখালেন, সেটি ডায়াল করবার সময় আমি যেন দেখি ঠিক নম্বর ডায়াল হচ্ছে কি না। করিডোরের মাঝখানে ফোন রাখা। নম্বর রিং হচ্ছে বুঝতে পারছি।
উনি আমার দিকে ফিরে বললেন মনিরুলের বন্ধুর মা কে ফোন করছেন।
—হ্যালো। ... মি মনোয়ারা... আমার ছেলে মাই সান মনিরুল .. আপনার বাড়ি গেছেনি?
ফোনের অন্যপ্রান্তে যিনি, তিনি বাঙালি নন, ইংরিজিভাষী। তিনি বাংলা না বুঝলেও বুঝেছেন যে মনিরুল বাড়ি ফেরেনি।
ছেলে চারদিন ধরে বেপাত্তা হলে আমরা তো পাগলের মতো হয়ে যেতাম। কী অপরিসীম ধৈর্য ও সহ্যশক্তি এই নারীর।
টেলিফোনে জানা গেল কেউ জানে না মনিরুল কোথায়।
মরিয়মকে বাংলা পড়াতে হবে, জোর করছেন মনোয়ারা। মরিয়ম পড়বে না। সে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। অন্য বইখাতা খুলে খুব পড়াশুনোর ভাল করছে। অঙ্কের খাতা লালে লাল। অন্যান্য বিষয়ের অবস্থাও সঙ্কটজনক। একটু জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল যে সে কয়েকটা বিষয়ে ফেল করেছে। তাও প্রোমোশন পায়।
ওরকমই ব্যবস্থা। কোনওক্রমে ওভাবেই স্কুল শেষ করে ফেলবে। কিন্তু পড়াতে চাইলে পড়বে না। মানতেই চায় না কারোকে। বাবাকে অবশ্য ভয় পায়। কিন্তু বাবা তো তখন হজ করতে গেছেন।
নজরুলের অবস্থাও একইরকম। মনোয়ারা কি এসব জানেন আদৌ? ছেলেমেয়েরা মাকে পাত্তাই দেয় না।
তবে কেন উনি মরিয়মকে বাংলা শেখাতে চাচ্ছেন? ক্লাসের পড়াটা আগে মোটামুটি করুক, তারপর তো বাংলা শিখবে।
অনেক বছর পরে এই প্রশ্নের উত্তর নিজেই পেয়ে গেছলাম। ঐ দেশে নিজের ভাষায় নিজের মনের কথা শোনানোর জন্য একজনও ছিল না মনোয়ারার। সারাটাদিন শুধু ঘরের কাজ। কয়েকবছর পরপর নতুন নতুন সন্তান। একটা মানুষ নেই ও বাড়িতে যে তাকে ইংরিজিটা অল্প অল্প শিখিয়ে দেয়। কী জীবন মাইরি!
কাল লন্ডন ইউনিভার্সিটি যাব। পরশু ইদ। এদেশে ইদে ছুটি নেই। তবে ওদের প্ল্যান শুনলাম। ওরা রিজেন্ট পার্ক যাবে। পাশেই একটা মস্ক আছে। মস্ক মানে মসজিদ। লন্ডনে এসে আমার নতুন নতুন শব্দ শেখা হচ্ছে।