হরবোলা”র যে সাংস্কৃতিক পরিমগুলে আমি বর্ধিত হচ্ছিলাম, তা লুপ্ত হয়ে গেল অকস্মাৎ। অর্থাভাবের কোনও প্রশ্নই ছিল না, উৎসাহেরও অভাব ছিল না, তবু এই সংস্থাটি বন্ধ হয়ে গেল কমলকুমার মজুমদার ও দিলীপকুমার গুপ্ত নামে দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষে। এরকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষরা বেশিদিন অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা চালাতে পারেন না, সহ্য করতে পারেন না বিরুদ্ধ মত বা সমালোচনা। যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান/লক্ষ লক্ষ তৃণ একত্রে মিশিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন।” আমাদের মতন তৃণদলের মাঝখানে কমলকুমার ও ডি কে ছিলেন দুই বনস্পতি, কিছুদিনের জন্য দু'জনের গাঢ় বন্ধুত্বও ছিল, কিন্তু নাটক পরিচালনার ব্যাপারে অতি সামান্য কারণে এঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। একটিও কটু বাক্য উচ্চারিত হয়নি, তবু এক সন্ধেবেলা দু'জনে দু'দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন। ওঁদের মধ্যে মিলন ঘটাবার অনেক চেষ্টা করেছি আমরা, পলাতক ও আত্মগোপনকারী কমলকুমারকে ধরে এনে ডি কে-র সামনে দাঁড় করিয়েছি, দু'জনেই দারুণ ভদ্রতার সঙ্গে সহাস্যে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু মাঝখানের ফাটল আর জোড়া লাগল না। “লক্ষ্মণের শক্তিশেল", “মুক্তধারা” নাটক বেশ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করার পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “লম্বকর্ণ পালা'-র রিহার্সাল দিতে দিতে মাঝপথে 'হরবোলা” ভেঙে গেল।
তারপর ডি কে-র সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমে গেলেও আমরা রয়ে গেলাম কমলকুমারের প্রায় প্রতিদিনের সঙ্গী, বা ছায়াসঙ্গী বা অনুচর বা চেলা। ......
কোনও রহস্যময় কারণে কমলদা সেসময় তাঁর বাসস্থানের কথা গোপন রাখতেন। রাত্তিরের দিকে শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ চলি বলেই লাফিয়ে উঠে পড়তেন একটা চলন্ত বাসে। পরে অবশ্য, ডি কে-র সঙ্গে বিবাদের সময় আমরা গোয়েন্দাগিরি করে তাঁর বাড়ি খুঁজে বার করেছিলাম। সেই সময় তিনি থাকতেন পাতিপুকুরে, নিজের স্ত্রীকে করে রেখেছিলেন অন্তরালবর্তিনী এবং তাঁকে সম্বোধন করতেন বড় বউ! কথাবার্তার মাঝখানে একসময় তিনি বলতেন, বড় বউ, এদের চা-টা দাও! তখন পর্দার আড়াল থেকে একটি ফর্সা হাত ওমলেট ও চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিত। আমাদের মতন ছোটদের কাছেও কমলদা তাঁর স্ত্রীকে কেন লুকিয়ে রাখতেন, তা কোনও দিনই জানতে পারিনি। বহুকাল পরে বউদি দয়াময়ী মজুমদারকে সামনাসামনি দেখি, তিনি অত্যন্ত রূপসী তো বটেই, বুদ্ধিমতী ও বিদূষী, শেষ জীবনে লিখতেও শুরু করেন।.....আমরা কমলদার পাতিপুকুরের বাড়ি আবিষ্কার করায় তিনি খুশি হননি, অচিরেই বাসস্থান বদল করে তিনি আবার অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। এরকমভাবে তিনি বহুবার বাড়ি বদল করেছেন, শুনেছি। সুতরাং, তাঁর সঙ্গে দেখা করার একমাত্র উপায় ছিল খালাসিটোলার পানশালায় হানা দেওয়া। এটা “হরবোলা” ভেঙে যাবার পরের কথা।
কমলকুমারের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হবার আগে যারা প্রথম প্রথম তাঁর বাক্যালাপ শুনবে, তাঁরা আঁতকে আঁতকে উঠবে। যেমন, কথায় কথায় তিনি উঁচু জাত, নিচু জাতের প্রসঙ্গ তোলেন, ছোটলোক-ভদ্রলোকের তফাত করেন, কোনও মুসলমানের মুখের ওপর বলেন ব্যাটা মোছলমান, দেশ স্বাধীন হবার বদলে ইংরেজ আমল ভালো ছিল, এখনও আবার ইংরেজদের ডেকে এনে এ দেশ শাসন করার কন্ট্রাক্ট দেওয়া উচিত, এরকম মতামত ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেন না। এ সবই যে এক ধরনের তির্যক রসিকতা, তা বুঝে উঠতে সময় লাগে। খালাসিটোলায় একাধিক মুচি, মেথরের সঙ্গে তাঁর গলাগলি, অনেক বিখ্যাত, উচ্চবংশীয়দের নাম শুনলেই তিনি নাক সিঁটকোন, হুমায়ুন কবীর, আতাউর রহমান কিংবা বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর দারুণ বন্ধুত্ব! তিনি রামকৃষ্ণ ভক্ত বলেই ব্রাহ্মদের বিরোধী, সে কারণেই রবীন্দ্রনাথকেও “বেহ্ম' বলে অবজ্ঞার ভাব দেখান, অথচ “মুক্তধারা” অভিনয়ের সময় তিনি স্থির করেছিলেন, একটি শব্দও বাদ বা বদল করা চলবে না! একাত্তর সালে বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হবার সময়ে তিনি গভীর বিস্ময়ে ভুরু তুলে বলেছিলেন, আ্যাঁ, মোছলমানরাও বাঙালি হতে চায়, বলে কী? তাঁর মতে, শুধু পশ্চিমবাংলার কায়স্থরাই বাঙালি, হিন্দু ব্রাহ্মণরাও বাঙালি হবার যোগ্য নয়! বলাই বাহুল্য, এর সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোলের কোনও সম্পর্ক নেই, এসব কথা সেভাবে গ্রহণ করাও উচিত নয়, এসব কমলকুমার মজুমদার নামে এক সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, অসাধারণ মানুষের চমকপ্রদ উক্তি! অন্য কারওর সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে না। সঙ্গী-সাথীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাভক্তি আদায়ের বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁর ছিল না, কেউ সেরকম ভাব দেখালেই তিনি হা হা করে হেসে উঠে একটা অতি আদি রসাত্মক রসিকতা করে বসতেন। বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ওই ধরনের উক্তি করা সত্বেও এ তথ্য এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওদিক থেকে আগত অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীকে তিনি সাদর আলিঙ্গন দিয়েছিলেন এবং অন্য অনেক সময় কথাপ্রসঙ্গে বারবার বলতেন, মুসলমানদের মতো আতিথেয়তা দিতে হিন্দুরা জানে না।
কমলকুমারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না, তিনি সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত, বহু বিষয়ে ছিল গভীর জ্ঞান, তাঁর মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় আকাশ-পাতাল তফাত বলতে গেলে। তাঁর কথ্যরীতি খুবই চটুল, তারই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে উঠত প্রজ্ঞা, ইংরিজি করে বলতে গেলে প্রফাউন্ড ও প্রফেনের এমন সংমিশ্রণ অতি দুর্লভ। মানুষটি সব সময় জীবনরসে ভরপুর, তাকে কখনও গম্ভীর কিংবা সত্যি সত্যি ক্রুদ্ধ হতে দেখিনি। তাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্য, তিনি কোথাও বসতে চাইতেন না, খালাসিটোলায় টেব্ল-বেঞ্চ থাকলেও কমলকুমার মদ্যপান করতেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া। তখনকার খালাসিটোলা ছিল কলকাতার সবচেয়ে শস্তা দিশি মদের পানশালা, টিনের ছাদ ঘেরা বিশাল জায়গা, বাইরে থেকে কিছু বোঝাই যেত না। পরবর্তীকালে কোনও কোনও সাহেব, যেমন বিখ্যাত কোনও ফরাসি শিল্প সমালোচক কিংবা ইংরেজ কবি কমলকুমারের সম্পর্কে জেনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁদের আসতে হত ওই খালাসিটোলাতেই, কমলকুমার গেলাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন তাঁদের সঙ্গে। এরা কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, একসঙ্গে এত মানুষকে এক জায়গায় শুধু মদ্যপান করতে তাঁরা আর কোথাও দেখেননি। .... এক নম্বরের বাংলা মদ অতি কড়া, যাকে বলে তরল-গরল, তা এক গেলাস ভর্তি করে, জল বা সোডা এক বিন্দু না মিশিয়ে, কমলকুমার আগে তাঁর হাতের একটি আংটি গেলাসে ছুঁইয়ে নিতেন, (সে আংটিতে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম লেখা!) তারপর ঢক ঢক করে এক চুমুকে শেষ করে ফেলতেন সবটা। আমাদের মধ্যে শক্তিই একমাত্র কমলদার এই দৃষ্টাস্তের অনুসরণ করত, আমি দু'-একবার চেষ্টা করেও পারিনি, আমায় সোডা মেশাতে হতই। এক গেলাস শেষ করার পর দ্বিতীয় গেলাস নেবার আগে কমলদা একটা কলে খুব ভালো করে মুখ কুলকুচো করতেন। তাঁর মতে, এতে নাকি দাঁত ঠিক থাকে। লিভারের কী হবে, তার চিস্তা নেই, দাঁতের জন্য চিন্তা!
খালাসিটোলা রাত ন'টায় বন্ধ হবার পর বাইরে বেরিয়ে সরষের তেলে ভাজা গরম গরম ওমলেট খাওয়া ও তার পরেও বহুক্ষণ ওয়েলিংটনের মোড়ে পুরনো বইয়ের দোকানগুলির
সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা। এক প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে, পৃথিবীর বহু বিষয়ে কথা বলতেন কমলদা, আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। সক্রেটিস যেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা চলতে চলতে তাঁর ভক্তদের জ্ঞানের কথা বলতেন, তাঁর অনুগামীদের বলা হত পেরিপাটেটিক ফিলোজফার, কমলকুমারও সেরকম, তিনিই আমাদের সক্রেটিস। তিনি দার্শনিক তো অবশ্যই।
কমলকুমার শারীরিকভাবেও বেশ শক্তিশালী পুরুষ। অত মদ্যপান করেও কখনও তাঁকে বেচাল হতে দেখিনি। তিনি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, অনিশ্চিত উপার্জন, তবু আমরা বয়েসে অনেক ছোট বলে মদের বোতল কেনার টাকা তিনিই জোর করে দেবেন। তিনি টাকা রাখতেন তাঁর হাতে ধরা বইয়ে, প্রতিদিনই কোনও না কোনও ফরাসি বই থাকত, সেই বইয়ের ভাঁজে। আড্ডার শেষে তিনি একাই ট্রামে চেপে চলে যেতেন তাঁর অজ্ঞাত. বাসস্থানে। পরের দিকে অবশ্য তা জানা হয়ে যায়। তখন ইন্দ্রনাথ মজুমদার, কমলদার আপত্তি সত্বেও, জোর করে ট্যাক্সিতে তাঁকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসত। কমলদা নিঃসস্তান, ইন্দ্রনাথ মজুমদার শেষের কয়েক বছর যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে কমলদার দেখাশুনো করেছে, তা অনেকের নিজের সন্তানও করে না।
কমলদার চরিত্রের আর একটি বৈপরীত্যের উদাহরণও দেওয়া দরকার। সিগনেট প্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হবার পর জীবিকার জন্য তিনি “তদন্ত' নামে একটি গোয়েন্দা-রহস্য পত্রিকা বার করেছিলেন, তাতে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের 'দারোগার দপ্তর'-এর মতন পুরনো লেখা পুনর্মুদ্রিত হত, অনেক লেখা কমলদা নিজে লিখতেন, আমরাও দু'-একটা লিখেছি কাঁচা হাতে। অতি দীনভাবে ছাপা, বাজে কাগজ, মলাটে রগরগে ছবি নেই, সেরকম রহস্য পত্রিকা চলবে কেন? পুরোটাই লোকসান, বন্ধ হয়ে গেল অচিরে। কয়েক বছর পর তিনি আর একটি পত্রিকার সম্পাদক হন, নাম “অঙ্ক ভাবনা”, এরকম পত্রিকা প্রকাশের কথা এ দেশে আগে কেউ চিন্তাই করেনি, এর বিষয় গাণিতিক দর্শন, অতি দুরূহ সব প্রবন্ধ। বহু লেখক অঙ্ক জিনিসটাকেই ভয় পায়, তার ওপর তার দর্শন! এ পত্রিকার পাঠক যেমন দুর্লভ, লেখক পাওয়াও তেমনই কঠিন। কয়েক সংখ্যা পরেই পত্রিকাটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল। “অঙ্ক ভাবনা”-র সমস্ত দায়দায়িত্ব বহন করেছিল ইন্দ্রনাথ মজুমদার। একই ব্যক্তি একবার অতি লঘু রহস্য পত্রিকার সম্পাদক হন, আবার অতি গুরুগম্ভীর দর্শন-পত্রিকার, এর উদাহরণ কমলকুমারই একমাত্র!
এক রবিবার সকালে কমলদা তাঁর প্রথম উপন্যাস উপহার দিলেন আমাদের। উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ছাপা হয়েছে একটি সাধারণ পত্রিকায়, আমি তার নামও জানতাম না, কমলদা পত্রিকাটি ছিড়ে, শুধু তাঁর উপন্যাসের অংশটুকু সেলাই করে দিয়েছিলেন, নাম “অন্তর্জলী যাত্রা”, প্রথম লাইনটি আজও মনে আছে, “আলো ক্রমে আসিতেছে, আকাশ মুক্তাফলের ন্যায় হিম নীলাভ।” সে উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা, জীবনের কিছু কিছু ঘটনার মতন সম্পূর্ণ নতুন ও চিরস্থায়ী। ততদিনে সাধু বাংলা বিসর্জন দিয়েছে সমস্ত লেখক, কমলকুমারের রচনা শুধু সাধু বাংলায় নয়, তার বাক্যগঠনও আমাদের অপরিচিত, কোথাও কোথাও তা কঠিন দেওয়ালের মতন যেন ' অগম্য, তবু সেই দেওয়ালের ওপাশে যেন রয়েছে কী রহস্য, তাই বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়, গোটা উপন্যাসটি অন্তত তিনবার পাঠের পর তার প্রকৃত মর্ম ও সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম হয়। হীরকউদ্ধারের জন্য যেমন অনেক মাটি খুঁড়তে হয়, সেই রকমই কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস পাঠের পরিশ্রম সার্থক।
তাঁর মুখের ভাষা হাটে-বাজারের, আর সাহিত্যের ভাষা এত জটিল কেন, এ প্রশ্ন অনেকবার করেছি। তিনি যা উত্তর দিয়েছেন, তা অভিনব ও চমকপ্রদ হতে পারে, ব্যাখ্যা নয়। তিনি বলতেন, সাহিত্য হচ্ছে বাগ্-দেবী সরস্বতীর সঙ্গে কথা বলা। আমরা যে ভাষায় মাছের বাজারে, মদের দোকানে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলি, সে ভাষায় শব্দের অধিষ্ঠাত্রীর সঙ্গে কথা বলা যায় না, সে জন্য নতুন ভাষা তৈরি করে নিতে হয়। এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছিল
একটি ছোট প্রকাশনী থেকে, কমলকুমার রসিকতা করে বলেছিলেন, এক বছরে আমার বইটা বিক্রি হয়েছে পনেরো কপি, আর সতেরো জন ফেরত দিয়ে গেছে! তবু, যতই ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচিত হোন না কেন, এই সময় থেকে তিনি একজন পুরোপুরি লেখক।
কমলকুমার কবিতা লেখেন না, আমরা কৃত্তিবাস পত্রিকায় তাঁর কোনও রচনা ছাপতে পারি না, কারণ তখনও কৃত্তিবাসকে বিশুদ্ধ কবিতা পত্রিকা হিসেবে রাখতেই বদ্ধপরিকর। সন্দীপনের মতন বন্ধুও কৃত্তিবাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তবু সে এ পত্রিকার লেখক নয়। হঠাৎ আমার মস্তকে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা এসে গেল। একই সঙ্গে দুটি আলাদা পত্রিকা বার করা হবে, পৃথক মলাট, কিন্তু দুটিরই নাম কৃত্তিবাস, একটি কবিতা, অন্যটি গল্পের। কয়েকজন বন্ধু এতে সমর্থন জানাল। আমার স্কুলের ও বাল্য-বন্ধুরা, যেমন আশুতোষ ঘোষ, উৎপল রায়চৌধুরী, ভাস্কর দত্ত প্রমুখ, এরা কেউ লেখে না কিন্তু গোড়ার দিকে কৃত্তিবাসকে অনেক সাহায্য করেছে, অন্যরা আস্তে আস্তে সরে গেলেও ভাস্কর রয়ে গেল আজীবন কবি-লেখকদের সঙ্গী। ভাস্করের গড়া হল একটা তহবিল, শুরু হল দুই কৃত্তিবাসের কাজ। গল্পসংখ্যার জন্য নির্বাচিত হল দুটি মাত্র গল্প, কমলকুমার মজুমদারের “ফৌজ-ই-বন্দুক' এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের “ক্রীতদাসক্রীতদাসী”, দুটিই অসাধারণ গল্প এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন স্বাদের। শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্বেচ্ছায় গল্প পত্রিকার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল, তার নাম মুদ্রিত হল সম্পাদক হিসেবে, কিন্তু সে এমনই অস্থির স্বভাবের যে সম্পাদকীয় পর্যস্ত লিখে উঠতে পারল না। সে সম্পাদকীয়ও লিখতে হল আমাকেই। সে সম্পাদকীয় থেকে কিছু কিছু বাক্য পরে অনেকে উদ্ধৃত করেছে দেখেছি। যথাসময়ে প্রকাশিত হল দুটি পত্রিকা, দুটির নাম কৃত্তিবাস, দু'রকম চেহারা, দুটিই পরিচ্ছন্নভাবে সুমুদ্রিত। পাঠক মহলে খুবই বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছিল। বাংলা ভাষাতে তো বটেই, আর কোনও ভাষাতেও এরকম অভিনব ব্যাপার ঘটেছে কি না জানি না।'
দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য কমলকুমার লিখে দিলেন “গোলাপ সুন্দরী" এ ছাড়া দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, মতি নন্দী প্রমুখ বন্ধুরা গল্প দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়, কিন্তু গল্প-কৃত্তিবাসের আর দ্বিতীয় সংখ্যা বেরোতে পারেনি। কিছুটা অর্থাভাবে, কিছুটা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে মতান্তরে ও কিছুটা আমার পারিবারিক দুর্যোগের কারণে এই উদ্যোগ আর নেওয়া যায়নি। কবিতার কৃত্তিবাসও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় বছরখানেকের জন্য। খুবই দুঃখের সঙ্গে কমলকুমারের “গোলাপ সুন্দরীর মতন অমর গল্পটি আমি “এক্ষণ” পত্রিকার জন্য তুলে দিয়েছিলাম নির্মাল্য আচার্যের হাতে।
অবশ্য কয়েক বছর পর, আগেকার নিয়ম ভেঙে, কবিতার কৃত্তিবাসেই প্রকাশিত হয়েছিল কমলকুমারের সম্পূর্ণ উপন্যাস, “সুহাসিনীর পমেটম"।
----------------- অর্ধেক জীবন / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় / পৃ ১৭২-১৭৯
(এখানে সরা বা পপাঁ নেই, শুধুই ককুম)