*ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া ঋণের বিচারবিভাগীয় তদন্তের আবেদন প্রধান বিচারপতির কাছে*
ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে তার অনিবার্য পরিণতি হয় ব্যাঙ্কের এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদের বৃদ্ধি। কিন্তু পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করলো না সেই ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারীদের অভিপ্রায়ই কি থাকে বকেয়া না চুকোনোর? অন্যভাবে বললে, ব্যাঙ্কের টাকা লুট করার লক্ষ্যেই কি তারা ঋণ নেয়? পশ্চিমবাংলার নাগরিক সমাজের এক সংস্থা ‘ব্যাঙ্ক বাঁচাও দেশ বাঁচাও মঞ্চ’র ধারণা কিন্তু সেরকমই। ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ এবং অপরিশোধিত থেকে যাওয়া ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখালো তাদের আসল লক্ষ্য জাতীয় অর্থভান্ডার লুট করা। এই উপলব্ধি থেকেই তাঁরা ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে লেখা ২৭ জুলাইয়ের চিঠিতে আবেদন জানিয়েছেন, অপরিশোধিত ঋণকে ক্রমবর্ধমান ধারায় যেভাবে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে তা জাতীয় অর্থভান্ডারের কর্পোরেট লুট এবং বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নেয়। মঞ্চের দুই আহ্বায়ক বিশ্বরঞ্জন রায় ও সৌম্য দত্তর স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়াটা ইচ্ছাকৃত কর্পোরেট অপরিশোধকারীদের জাতীয় অর্থভান্ডার লুটেরই সমতুল্য।” চিঠিতে তাঁরা জানিয়েছেন, গত তিন বছরে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে ৫,৮৬,৮৯১ কোটি টাকার অপরিশোধিত ঋণ, আর মুছে দেওয়া ঋণের পুনরুদ্ধার হয়েছে মাত্র ১,০৯,১৮৬ কোটি টাকা। মুছে দেওয়া ঋণের পুনরুদ্ধার কোন পথে হতে পারে? সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছিল, “এই মুছে দেওয়া ঋণ কখনই ঋণ গ্ৰহিতার পরিশোধের দায়বদ্ধতার মুকুবে পরিণতি লাভ করে না, কেননা, মুছে দেওয়া ঋণের গ্ৰহীতাদের পরিশোধের দায় অব্যাহত থাকে।” অর্থাৎ, খাতা থেকে ঋণ মুছে দেওয়া হলেও ঋণ গ্ৰহিতার পরিশোধের দায়ের বিলোপ ঘটে না, এবং অপরিশোধিত ঋণের পুনরুদ্ধারের উদ্যোগও নেওয়া হয়। কিন্তু ঐ উদ্যোগ কতটা ফলদায়ী হয়? চিঠিতে উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মুছে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৫,৮৬,৮৯১ কোটি টাকা হলেও উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১,০৯,১৮৬ কোটি টাকা, যা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে মুছে দেওয়া ঋণের মাত্র ১৮.৬০ শতাংশে। অর্থাৎ, ৮০ শতাংশেরও বেশি থেকে যাচ্ছে পুনরুদ্ধারের বাইরে।
তাঁদের চিঠিতে মঞ্চের প্রতিনিধিরা প্রধান বিচারপতিকে আর একটি বিষয় সম্পর্কেও অবহিত করেছেন। যারা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিল সেই অর্থে তারা কারখানা বা অন্যান্য সম্পদের নির্মাণ করেছিল, এবং তাদের কাছে কাঁচামাল ও নির্মিত সামগ্রীও মজুত থাকে। গৃহীত ঋণ অপরিশোধিত থাকায় সরকারের তৈরি আইন ও বিধি অনুসারে অন্য কর্পোরেট সংস্থা অপরিশোধকারী সংস্থার সম্পদ কিনে নিতে পারে, এবং সেটি পরিচালিত হয় জাতীয় কোম্পানি আইন অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল (এনসিএলএটি) এবং দেউলিয়া দশা ও সর্বস্বান্ত হওয়ার বিধি (আইবিসি) অনুসারে। যে কর্পোরেট সংস্থা ঋণ অপরিশোধকারী সংস্থার সম্পদ কিনে নেয়, সেটা তারা কেনে সম্পদের প্রকৃত মূল্যের অনেক কম দামে। মঞ্চের চিঠিতে জানানো হয়েছে, ব্যাঙ্কগুলো “প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ হেয়ারকাট নেয়”। এই ‘হেয়ারকাট’এর অর্থ সম্পদের মূল্য হ্রাস করা। অর্থাৎ, যে কর্পোরেট সংস্থা ঋণ অপরিশোধকারী সংস্থার সম্পদ কিনে নিল, ব্যাঙ্ক তার মূল্যকে হ্রাস করল ৬৫-৭০ শতাংশ, যে অর্থ সরকার পেতে পারত পেল তার অনেক কম। ফলে, “একমাত্র যা ক্ষতির মুখে পড়ল তা হল জাতীয় অর্থভান্ডার, কেননা, সরকারি অর্থ লুট করছে কর্পোরেট সংস্থাগুলো।” এইভাবে ঋণ অপরিশোধকারী কর্পোরেট সংস্থা, তার সম্পদ কিনে নেওয়া কর্পোরেট সংস্থা এবং এমনকি ব্যাঙ্ক কর্তাদের মধ্যেও একটা দুষ্টচক্র কাজ করে চলে।
‘ব্যাঙ্ক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও মঞ্চ’র আবেদনে প্রধান বিচারপতি কি আদৌ গুরুত্ব দেবেন? ব্যাঙ্ক ঋণের ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী কর্পোরেট সংস্থার ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়ার ফলে জাতীয় অর্থভান্ডারের ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কি শুরু হবে? এর উত্তর রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে, রিজার্ভ ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যকে বিশ্লেষণ করে জাতীয় অর্থভান্ডারের ক্ষতির পরিমাণের একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে দেওয়া রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৮’র মার্চে শেষ হওয়া অর্থবর্ষে অপরিশোধিত ঋণ বা অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ছিল ১০.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা, প্রদত্ত মোট ঋণের ১১.২ শতাংশ। আর ২০২৩’র মার্চে শেষ হওয়া অর্থবর্ষে সেই অনুৎপাদক সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৫.৭২ লক্ষ কোটিতে, যা প্রদত্ত মোট ঋণের ৩.৯ শতাংশ। এটা কি ঋণ পরিশোধের উন্নতিকে নির্দেশিত করছে? ঋণ আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে পরিশোধিত হওয়ায় অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ২০২৩’র মার্চে অনেক কম পরিমাণে দাঁড়িয়েছে? ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ২০১৮’র মার্চে মুছে দেওয়া কোনও ঋণ বাদ দিয়ে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ নির্ধারিত হয়নি, কিন্তু ২০২৩’র মার্চে মুছে দেওয়া ঋণ বাদ দিয়েই অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে ২০১৮’র মার্চের তুলনায় ২০২৩’র মার্চে অনুৎপাদক সম্পদ সাড়ে চার লক্ষ কোটিরও অধিক কম পরিলক্ষিত হওয়ার রহস্য। এই মুছে দেওয়া ঋণের কতটা পুনরুদ্ধার সম্ভব? আমরা ওপরে দেখেছি সেটা মুছে দেওয়া ঋণের এক পঞ্চমাংশেরও কম। ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া ঋণের সিংহভাগ এইভাবে হাওয়া হয়ে যায় যা সরকারি অর্থভান্ডারের কর্পোরেট লুট ছাড়া অন্য কিছু নয়। সরকার যতই দাবি করুক যে ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়ার পরও অপরিশোধকারী কর্পোরেট সংস্থার পরিশোধের দায় থেকে যায় এবং সেই অর্থ উদ্ধারও হয়, সেই দাবি এক অসার আপ্তবাক্য ছাড়া অন্য কিছু বলে পরিগণিত হয় না। বিবেক কল ‘ডেকান হেরাল্ড’ পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন যার শিরোনাম ‘আনাদায়ী ঋণকে প্রথমে মোছা হয়, তারপর তা মুকুব হয়ে যায়’। ঐ নিবন্ধের একটি প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করে আলোচ্য ভাষ্য শেষ করা হচ্ছে, “তত্ত্বগত দিক থেকে এটা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, মুছে দেওয়া ঋণের পুনরুদ্ধার সম্ভব, কিন্তু বাস্তব হল এই যে, ঋণের বড় অংশ যাকে প্রথমে মুছে দেওয়া হয় পরে সেটাকে মুকুব করাই হয়, কেননা, সেটার উদ্ধার আর সম্ভব হয় না…।”
(সংগৃহীত)