“...পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রতি একধরণের পাথুরে উদাসীনতা ছিল নেহরুর। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ উদ্বাস্তুদের যে নগণ্য সাহায্য করেছিল, তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে ডঃ (বিধানচন্দ্র) রায় নেহরুকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তার উত্তরে নেহরু যে চিঠি লেখেন তাতে উদ্বাস্তুদের প্রতি তার চরম অবজ্ঞাই প্রকাশ পায়। ১৯৪৯-এর শেষদিকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাড়িয়েছিল ১৬ লক্ষ। ডঃ রায় প্রায় ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে তাঁর মনে হয়েছিল পশ্চিম-পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরাই প্রকৃত উদ্বাস্তু। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তরা উদ্বান্তই নয়। ১৯৪৯-এর ১ ডিসেম্বর তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নেহরুকে একটি চিঠি লিখেছিলেন :
“...আপনার এই ধারণা হয়েছে যে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য আপনার সরকার আমাদের বিপুল আর্থিক অনুদান দিয়েছে। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার সরকারের কাছ থেকে ১৯৪৮-৪৯ এবং ১৯৫০-৫১ এই দুবছরে যে অনুদান আমরা পেয়েছি তা তিন কোটি টাকার কিছু বেশি। অবশিষ্ট পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছি ঋণ হিসেবে। আপনার কি মনে হচ্ছে না যে পশ্চিম-পাকিস্তানের উদ্ধান্তদের তুলনায় এই টাকাটা একেবারেই নগণ্য? আমি তুলনা করতে চাই না। তাতে তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে। আমি শুধু বলতে চাই যে দুবছরে ২৬ লক্ষ উদ্বাস্তুকে অনুদান হিশেবে যে টাকাটা দেওয়া হয়েছে তাতে প্রত্যেক উদ্বাস্তু পায় অকিঞ্চিৎকর বিশটি টাকা। এই টাকাটাকে কি আপনি বিশাল অনুদান বলবেন? উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দুরা সর্বস্বান্ত হয়ে ক্ষুধায় ও উপবাসে ক্লিষ্ট হয়ে এদেশে এসেছে জীবিকার আশায়। অনেক মাস কেটে যাওয়ার পরও পূর্ব-পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের কেন্দ্রীয় সরকার কোনাে স্বীকৃতি দেয়নি এবং তাদের কোনাে দায়দায়িত্ব স্বীকার করেনি। তাদের জনা রাজ্য সরকার সাধ্যমতাে সব করেছে। আর এই উদ্বাস্তুদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দুবছরে বিপুল অর্থ—মাথাপিছু বিশটি টাকা বরাদ্দ করেছে।..”
উত্তরে নেহেরু লিখেছেন,
“পূর্ব-পাকিস্তান থেকে যারা এসেছে, তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য কত খরচ হয়েছে, আমি জানি না। আপনি হয়তাে ঠিকই বলেছেন তাদের জন্য পশ্চিম-পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের চেয়ে অনেক কম ব্যয় করা হয়েছে। … আপনার ও আমাদের উভয়েরই নীতি হল এই যে এ ব্যাপারে এমন কোনাে নীতি গ্রহণ করা উচিত হবে না যাতে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সব হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। তাতে ভয়াবহ দুর্দশার সৃষ্টি হবে যার মােকাবিলা করা কোনাে সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবে না।…”
অর্থাৎ অদ্ভুতভাবে লাজলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে 'প্রধানমন্ত্রী' বললেন তিনি জানেন না উদ্বাস্তুদের পেছনে কত খরচ হয়েছে!!
১৯৫০-এর দাঙ্গায় একটি সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। কেন্দ্রীয় সরকারের কথায় চিড়ে ভিজবে না। উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু না করলেই নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বাসনমন্ত্রী মােহনলাল সকসেনা কলকাতায় বৈঠক ডাকলেন। এতে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, ওড়িশার প্রতিনিধি ও মেঘনাদ সাহার মতাে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ জানানাে হল।
বৈঠকে আলােচনার বিশেষ কিছু ছিল না। বৈঠকে আহত ব্যক্তিদের সকসেনা জানিয়ে দিলেন যে নবাগত উদ্বাস্তুদের কেন্দ্রীয় সরকার ত্রাণ দেবে, পুনর্বাসন নয়, কেননা পূর্ববঙ্গে দাঙ্গাহাঙ্গামা বন্ধ হলেই আবার উদ্বাস্তুরা স্বদেশে ফিরে যাবে। অতএব পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কোনাে যুক্তি নেই। স্পষ্টতই কেন্দ্রীয় সরকার পরিস্থিতির মােকাবিলা করতে চাইছিলেন না। সকসেনার কথা শুনে বােঝা গেল সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকতেই চাইছে।
ডঃ মেঘনাদ সাহা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে বললেন যে, সরকার ভুলে গেছে দেশবিভাগের আগে কংগ্রেস নেতারা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন সেই প্রতিশ্রুতি পালন না করলে বিশ্বাসভঙ্গ করা হবে। সকসেনা সব শুনলেন। কিন্তু তিনি তাে আলােচনা করে উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্তে পৌছতে কলকাতা আসেননি। তিনি এসেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ঘটা করে বৈঠক করে জানিয়ে দিতে। কেন্দ্রীয় সরকার একথা বুঝতে চায়নি যে সাম্প্রদায়িক ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগ মেনে নেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তান পুরােপুরি মুsলমানদের দেশ এবং মুsলমান দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহ্য করা হয় না। তাই পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে যেমন সংখ্যালঘুরা বিতাড়িত হয়েছে, তেমনি পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরাও দেশত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
নেহরুর বােঝা উচিত ছিল পাঞ্জাবে যেভাবে জনবিনিময় করে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাঞ্জাবে জনবিনিময় সম্ভব হল, ভারতের ঐশ্বর্য ঢেলে দিয়ে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হল। কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে জনবিনিময় সম্ভব নয়, পূর্ব-পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুরা আসলে উদ্বাস্তুই নয়। তারা ভয় পেয়ে চলে এসেছে। কিন্তু তারা এদেশে থাকবে না। দেশে ফিরে যাবে। কেন দেশে ফিরে যাবে? কারণ নেহরু তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই বিশ্বাসের পেছনে কোনাে যুক্তি ছিল না। এদিকে ১৯৫০-এ দুই বঙ্গে দাঙ্গার ফলে হিন্দুরা একতরফাভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছিল না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানরাও পূর্ববঙ্গে চলে যাচ্ছিল। বেসরকারিভাবে সম্পত্তি ও জনবিনিময়ের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এই ধরণের বেসরকারি জনবিনিময় ঘটলে নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন থাকবে না। অথচ কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য এই বেসরকারি জনবিনিময় চলতে দেওয়া যেতে পারে না। অতএব কাশ্মীরের মুসলমানদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য ভারতের সম্পদ বিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের কয়েক কোটি হিন্দুকে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে।
১৯৫০-এর ২৭ ফ্রেব্রুয়ারি সংসদে এ বিষয়ে উত্তপ্ত আলােচনা হয়েছিল। নেহেরু বললেন, জনবিনিময়ের প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শের পরিপন্থী। এই প্রস্তাবের সঙ্গে আরাে বড় আদর্শ জড়িয়ে আছে। এতে বিশ্বাসভঙ্গ করা হবে।
উত্তরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেছিলেন যে, পাঞ্জাবে জনবিনিময়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময় পণ্ডিত নেহরুর বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটা হিমঘরে রেখে দিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতেও বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটা সেভাবেই ঠাণ্ডা ঘরে তুলে রেখে অভিজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞের মতাে পরিস্থিতির মােকাবিলা করাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু নেহেরু ইতিপূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ডঃ মুখার্জির যুক্তিতে তিনি কান দিলেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুsলমানরা যাতে পূর্ববঙ্গে চলে না যায়, তার ব্যবস্থা করলেন। বিশ্বের দরবারে তার ভাবমূর্তি অটুট রইল। তিনি সাড়ম্বরে ঘােষণা করলেন, ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপদে আছে। কাশ্মীরের ভারতভুক্তি যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ১৯৫০-এ জনবিনিময়ের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যার সহজ সমাধানের পথ রােধ করে দাড়ালেন নেহরু। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের রক্ষা করলেন, কিন্তু পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের ঠেলে দিলেন এক শ্বাসরােধকারী অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।"
-প্রান্তিক মানব, প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী