সত্যবচন‘বই তো ছুতো, আমায় দেখুন’ পড়ে ভাল লাগল। বাংলা ভাষায় যে বিশ্বমানের সাহিত্য রচিত হয়েছিল, বিশেষ করে কবিতা ও ছোটগল্পে, শেষ চার দশকের বাংলা সাহিত্য তার ধারেকাছেও এল না। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের অবলুপ্তি, লেখকের অভাব, বাংলা মিডিয়ামের প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে নিত্যনতুন পাঠক তৈরি না হওয়া, ক্লাসিক ও পুরনো লেখার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া ইত্যাদির জন্য আমরা এখন বাংলা সাহিত্যের মর্গে দাঁড়িয়ে আছি, দহনের অপেক্ষায়। তার মধ্যে সমাজমাধ্যম ঢুকে পড়ায় সোনায় সোহাগা। লেখক বুঝে নিয়েছেন ধ্যানের থেকে ঢের বেশি জরুরি বিপণন। তাই এই অনন্ত ছোটাছুটি ও জনসংযোগ ছাড়া উপায় কী? পাঠককুল বিভ্রান্ত। এখনও বুদ্ধদেব নামক দু’জন লেখকের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা, টুনি মেম বইটি দেখে আগ্রহী বালিকার প্রতি অভিভাবকের বিরক্তি— সবই দেখছি। বাংলা সাহিত্যের হিরণ্ময় যুগ পেরিয়ে গেছে, প্রত্যাবর্তন বলে সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু হয় না, বুদ্ধদেব বসু লিখে গেছেন। লেখক ও পাঠক উভয়েই দিশাহারা।
সুরঞ্জন চৌধুরী, কলকাতা-৯৭
আত্মবিজ্ঞাপন
শিশির রায়ের প্রবন্ধটি পড়ে লেখকের পর্যবেক্ষণকে সাধুবাদ জানাই। বইমেলায় এই বইটি প্রকাশিত হতে চলেছে, অমুক দিন অমুক স্টলে লেখক উপস্থিত থাকবেন— ইত্যাদি খবর আমরা মেলা শুরুর প্রাক্-মুহূর্তে, বইমেলা চলাকালীন সমাজমাধ্যমের সূত্রে অহরহ পেয়েছি। কিছু লেখক আবার শুধু তাঁর বই নয়, তিনি কোন দলীয় সংবাদপত্র পড়েন পাশাপাশি রেখে বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি শুধু লেখক নন দলেরও অনুগত এক জন সৈনিক। দলের উচ্চপদে আসীন নেতা থেকে সাংসদের হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তার ছবি সমাজমাধ্যমে ফলাও করে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন ‘আমাকে দেখুন’। প্রবন্ধকার যথার্থই লিখেছেন, প্রকাশককে আর ক’জন চেনেন, লেখকই তো সব। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে নামী পত্রিকায় পর্যালোচনা বার হলে অনেক লেখক পত্রিকার প্রচ্ছদের ছবি তুলে পর্যালোচনার অংশটুকু আবার টাইপ করে সমাজমাধ্যমে পাঠকারণ্যে ভাসিয়ে দেন। প্রবন্ধকার সম্ভবত এই প্রচেষ্টাকেই ‘আত্মবিজ্ঞাপন-পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠা’ বলেছেন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পড়া অমল পালের ‘বাংলা ভাষা কি বিপন্ন’ প্রবন্ধ থেকে একটা উদাহরণ দিই। লেখক এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন— একটি সঙ্কলনে প্রকাশ করার জন্য এক বার বাংলার এক অধ্যাপকের কাছ থেকে একটি প্রবন্ধ নিয়েছিলাম। সেই লেখায় কয়েকটি ভুল বানানের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তিনি বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ না-করে বেশ হাসিমুখেই বলেছিলেন, ও তুমি ঠিক করে নিয়ো। আমি বানানের কথা অত ভাবি না। আমার কাছে কনটেন্ট-ই আসল। শোনার পর যে বিস্ময়ের ঘা লেগেছিল, এখনও সে ঘোর কাটেনি।
সাগরময় অধিকারী, ফুলিয়া, নদিয়া
অপারগতা
শিশির রায় তাঁর প্রবন্ধে নব্য লেখকদের একটি অংশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি এনেছেন, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া গেল না। সমাজমাধ্যমে তরুণ লেখকদের নিজস্ব বইপত্রের প্রচার কতটা আত্মপ্রচার, আর কতটা তাঁরা বাধ্য হন, এই পরিসর আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, নব্য লেখকদের বইয়ের প্রচারে এক শ্রেণির প্রকাশকের চূড়ান্ত অনীহা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এই প্রকাশকরা তুলনায় ‘পরিচিত’ লেখকদের যে ভাবে বিজ্ঞাপিত করেন, নবাগতদের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও জোটে না। কিছু ক্ষেত্রে এই লেখকরা গাঁটের কড়ি খরচ করে বই প্রকাশ করেন। সেই বই বিক্রির দায়ও প্রকাশক ঘুরপথে লেখকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। যেখানে প্রকাশক নিজেই নতুন বইয়ে বিনিয়োগ করেন, সে ক্ষেত্রেও তিনি নীরব! প্রচারের দায়িত্বটিও এ ক্ষেত্রে লেখককেই নিতে বলা হয়, দৈনিক অথবা সাহিত্যপত্রে বিজ্ঞাপনের ব্যয় বহন করতে তাঁরা রাজি হন না। এমতাবস্থায় সমাজমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মটি নব্য লেখকদের আশ্রয়স্থল। এটি ‘দৈন্য’-র চেয়েও অপারগতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, লেখক বইপ্রকাশ করেন বেশি পাঠকের কাছে নিজের লেখা পৌঁছে দিতে। সেই বইয়ের প্রচারকৌশল তিনি নিজে কেন ঠিক করতে পারেন না, তার স্পষ্ট ধারণা লেখাটিতে নেই। নিজের বই সংক্রান্ত ভাবনা নিজস্ব পাঠক, অনুগামীদের মধ্যে রাখতে চাওয়া বইবিমুখ এই সময়ের কার্যকর দিক। তাকে আত্মপ্রচারের গেরোয় ফেলার ভাবনা পুরাতন মূল্যবোধজাত। বদলের সময় এসেছে।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন, জঙ্গলে বসে কেউ কবিতাচর্চা করতে পারেন না, কবিকে পাঠকদের মধ্যে আসতেই হয়। ‘নির্জনতা’ কারও ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তাকে গৌরবান্বিত করতে গিয়ে অপর অংশকে ‘আত্মবিজ্ঞাপন-পরাকাষ্ঠা’ বলে পরিহাস করাও সমীচীন নয়।
মৃণাল শতপথী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
নেতিবাচক চিন্তা
‘বই তো ছুতো, আমাকে দেখুন’ প্রবন্ধ পড়ে অবাক হয়ে গেলাম। বাজার অর্থনীতির যুগে, যেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, সেখানে লেখকদের বিজ্ঞাপন দেওয়া নিয়ে এ রকম উদ্ভট নিন্দা কেন? কোনও লেখক যদি ভাবেন যে, লিখে সংসার চালাবেন, তা হলে বিজ্ঞাপন না দিলে বই বিক্রি হবে? আর বই বিক্রি না হলে জীবন চলবে? না জীবনানন্দ দাশের মতো সারা জীবন কষ্ট করে থাকতে হবে, যাতে মৃত্যুর পর হয়তো কেউ প্রশংসা করবে? এই মনোভাব এখনকার দিনে কারও থাকতে পারে? সমস্যা হল, নতুন কিছু দেখলেই একটা নেতিবাচক কথা ভাবা অনেকেরই মজ্জাগত। সারা পৃথিবীতে লেখকরা বিজ্ঞাপন দিয়ে বই বেচে ফ্ল্যাটের ইএমআই দিচ্ছেন, ছেলেকে ভাল স্কুলে পড়াচ্ছেন, সেটা সহ্য হচ্ছে না। পাঠককে বিনোদন দেওয়ার জন্য ভাল গল্প লিখতে হবে, আবার সমাজতান্ত্রিক আদর্শ পূরণ করার জন্য সেই বেচারা লেখককেই ছেঁড়া জামা পরে নন্দন চত্বরে বসে থাকতে হবে?
রুদ্রজিৎ পাল, কলকাতা-৩৯