চাকুরীতে ঢোকার বয়স মোটামুটিভাবে ২৫ ধরলে এবং অবসরের বয়স ৬০ (যদিও কলেজ শিক্ষকদের ৬৫ বছর) ধরলে চাকুরী করার সময়সীমাটা দাঁড়ায় ৩৫ বছর। কলেজ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ৪০ বছর। অর্থাৎ বাম আমলে যারা চাকুরী পেয়েছিল তাদের বেশীরভাগই এখনও চাকুরী করছে। বাম আমলে চাকুরী পেয়েছে, চাকুরী পাওয়ার পরে বাম সংগঠন করতো আবার রাজনৈতিক পালাবদলের পরে রং পাল্টে ডান সংগঠনে নাম লিখিয়েছেন এইরকম চাকুরীজীবির সংখ্যা খুব কম নয়। যদিও এখনও অব্দি রাজ্য সরকারী কর্মচারী সংগঠনের ক্ষেত্রে ডানপন্থীরা খুব একটা বাম সংগঠনের ক্ষতি করতে পারেনি। তবুও সংগঠন পরিবর্তন করা চাকুরীক্ষেত্রের ব্যাপার, তার সাথে মূল রাজনীতির যোগ থাকার কথা নয়। সুতরাং তাদের রাজ্য সরকারী কর্মচারী হিসেবেই দেখা উচিত, কে কোন সংগঠন করে তা দিয়ে নয়। আজকের চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি চলছে সরকার আর বিরোধীপক্ষের সেই বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় বাঙালীর স্মৃতি বড়ই দুর্বল।
তৃণমূল দলের সরকারে আসা মোটামুটিভাবে ১২ বছর হয়ে গেল। ১২ বছর আগে রাজ্যবাসী বিধানসভার ভোটে বাম সরকারকে গোহারা হারিয়েছিল। বর্তমানে অনেক কথাই শোনা যায়, সারদার টাকা, রোজ ভ্যালির টাকা সেই বিধানসভা নির্বাচনে ওড়ানো হয়েছিল। নইলে বামফ্রন্ট হারতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবুও বাঙালি কি মনে রেখেছে, সেই সময়ের বাম সরকারের ওপরে জনসাধারণের বিতৃষ্ণার কথা? বাম সরকারের ওপর তাদের বিরক্তির পরিমাণ? বাঙালীর স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল।
আজকের তৃণমূল সরকারের ওপরে রাজ্যের মানুষের যে পরিমাণ বিতৃষ্ণা, বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে চতুর্দিকে তারচেয়ে কি কোনো অংশে কম ছিল ১২ বছর আগের বিতৃষ্ণা, বিরক্তি? ১২ বছরে বাঙালী স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে বলেই বামপন্থী নেতাদের মুখ থেকে এখন বিভিন্ন রকমের বাণী নিঃসৃত হচ্ছে।
এমনিতেই মিডিয়া ট্রায়ালের মূল উপজীব্য হলো, রাম চুরি করেছে, শ্যাম চুরি করেছে। সুতরাং তাদের মুখে চুরির কথা মানায় না। সারাদিন, রাত্রি ধরে এইসব শুনে শুনে বাঙালীর কান বলে কোনো অঙ্গ আর আছে কিনা সন্দেহ। এতদিনে বোধহয় পচে নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ বলছে না, চুরি করে অন্যায় করেছি, দলের ছেলেদের চাকুরী দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছি। আসল জায়গায় সকলের ব্যথা, তাই নকল ধরে টানাটানি। ফলে সকলেরই বড় দুর্বল চিত্রনাট্য। ২০০৯ সালের ক্যাগ রিপোর্ট এতদিন পরে সরকার কেনো সামনে আনছে? তারমানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। আসলে এখন রাজনৈতিক নেতাদের কোনো নৈতিক ব্যাপার নেই, সবটাই রাজনৈতিক। রিপোর্ট যবেই প্রকাশিত হোক না কেনো, রিপোর্ট কিন্তু রিপোর্টই থাকে, সেটা অচল হয়ে যায় না। ২০০৯ সালের রিপোর্ট প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের কোনো অভিসন্ধি থাকলেও রিপোর্টকে কি অস্বীকার করা যায়? মাসতুতো ভাইয়ের কথাটাই প্রমাণিত হয় এক্ষেত্রে। তৃণমূলের নেতারা বলছেনও ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হবে। অবাক করা অবস্থান এবং কথাবার্তা। মানে তো একটাই দাঁড়ায়, তুমিও চুরি করেছ, আমিও চুরি করবো।
আসলে বেশীরভাগ রাজ্য সরকারী চাকুরী যে বিক্রি হয় অযোগ্য প্রার্থীদের কাছে সেটা রাজ্যবাসী জানে। শুধু আশায় থাকে আমার পোলাটারও যদি একই রাস্তায় কিছু হিল্লে হয়ে যায়, তাই চুপ করে থাকে। একা একজন রাজ্যবাসী এর চেয়ে বেশী আর কিইবা করতে পারে? ব্যবস্থাপনাকে তো পরিবর্তন করতে পারবে না একাকী, তাই নিজের সন্তানের ক্ষেত্রেও আশায় বুক বাঁধে, বিবেককে দমিয়ে রেখে। বিবেক না চাইলেও ব্যবস্থাপনার জন্য চাইতে বাধ্য হতে হয়। চোখের জল পড়ে তখনই যখন টাকা দিয়েও চাকুরী পাওয়া যায়না। গরীব লোকগুলোর ভিটে মাটি বিক্রি করা টাকাও যখন নেতারা মেরে দেয় তখনই রাজ্যবাসী চড়াও হয় নেতাদের ওপর, কারণ তখন তাদের আর কিছু করার থাকে না।
কথাতেই আছে, "চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড় ধরা"। ধরা আগেও পড়েছে নেতারা, এখনও পড়ছে। সংখ্যার তারতম্য হতে পারে, কিন্তু বিষয় একই। বাম জমানাই বাঙালী ভুলে গেছে, তাহলে কংগ্রেস জমানা কি করে মনে থাকবে তাদের? চিরকুটে, সিগারেটের প্যাকেটে, অনেকভাবেই চাকুরী হয়েছে এই বঙ্গদেশে। মালদা, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, চব্বিশ পরগনা বা যে কোনো জেলাতেই কান পাতলে শোনা যায় সেসব কীর্তিকাহিনী। আজকের যে মন্ত্রী বলছেন অমুকের চাকুরী চিরকুটে হয়েছিল বাম জমানায়, খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে সেই মন্ত্রীর চাকুরীটাও চিরকুটেই হয়েছিল। বর্তমানে চাকুরী চুরির দায়ে সপরিবারে হাজতবাস করা তৃণমূলের বিধায়কের যোগেশচন্দ্র ল কলেজের অধ্যক্ষ পদে চাকুরীটা বাম আমলেই। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যা আমরা মিডিয়ায় দেখছি তাতে তিনিও তো চিরকুটে চাকুরীটা পেয়েছিলেন বলেই প্রতিপন্ন হয়। তাই রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে ইচ্ছে করছে, "তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।" ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। সরকারী যেসব রিক্রুটমেন্ট কমিশনগুলো আছে, তাদের ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। সরকারের এত বেসরকারী নিয়োগ সংস্থার ওপর ভরসা কিসের? ব্যবস্থাপনা ঠিক করার কথা কেউ বলেনা। কারণ একটাই, তৃণমূল সরকার গিয়ে যারা আসবে তারা তৃণমূলের নাম করে একইরকম ব্যবস্থা চালিয়ে যাবে। প্রত্যেকেরই চেষ্টা নজরটা অন্যের দিকে ঘুরিয়ে দাও। মুল গলদটা রাজ্যবাসী যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই মঙ্গল। নচেৎ বাম, ডান, সবাই সমান। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
রোজকার মিডিয়া সার্কাসে রাজ্যবাসীর যেটা লাভ হচ্ছে, চলতি বাজারের অন্যান্য টিভি সিরিয়ালের চেয়ে অনেকবেশী উত্তেজক সিরিয়াল নিত্য দেখতে পাচ্ছে। এই ওয়েব সিরিজের কোনো শেষ নেই। নিত্য কোনো দলের মেজো, সেজো নেতারা বেফাঁস মন্তব্য করেই চলেছেন, দল যতই বারুন করুক না কেনো। এমনকি দল আমাকে কথা বলতে বারুণ করেছে বলে যেটুকু বলছেন সেটাও মারাত্মক। বিচারাধীন বিষয় বলে যেটুকু বলছেন সেটা আরও মারাত্মক। তাই নিয়ে মিডিয়ায় আবার আলোচনা, দলে আবার আলোচনা, আবার নির্দেশ, আবার মন্তব্য। সবটাই চক্রাকারে চলছে। আর সাধারণ জনগন চক্রব্যূহে পড়ে নাভিশ্বাস তুলছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।