ঘরের মানুষটির আগে আফ্রিকা নিয়ে একটু দোনামনা ছিল। আগের দুটো সফরে, যথাক্রমে দক্ষিন আফ্রিকা ও মরক্কো ঘুরে আসার পরে তার খুঁতখুতোনি কেটে তো গেছেই, আমার মত সেও পড়েছে এই মহাদেশের প্রেমে।তবে সাধু সাবধান। প্রথম যখন সাউথ আফ্রিকা গেলাম তখন ইন্টারনেটে খোঁজ করে অধিকাংশই নেগেটিভ কমেন্টস পাচ্ছিলাম স্থানীয় লোকজনদের ব্যাপারে। ভয়ঙ্কর ক্রাইম, সব সময়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, চাদ্দিকে চোর ডাকাত ছিনতাইকারী, সূর্য ডুবে গেলে বাইরে বের হওয়া নিজের ঝুঁকিতে, এই সমস্ত। গিয়ে ক্রমে দেখা গেল এইসব শুধুই প্রচার। কিন্তু এই প্রচারের চাপে পড়ে প্রথম কয়েকটা দিন বড্ড ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে অনেকটা সময় বৃথা হোটেলবন্দী হয়ে নিজেদেরই ক্ষতি হয়েছে।
মরক্কোর ব্যাপারে তাই অনেকটাই রিল্যাক্সড ছিলাম। তবে সেখানেও যাবার আগে অনেকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, ডেমোক্র্যাসী নেই, রাজার দেশ, তার ওপর মুসলমানদের দেশ, আরব কালচার, ওখানে আধুনিক মেয়েদের আদর সম্মান নেই, খুন টুনও করে দিতে পারে বেশি মডার্ন ভাবসাব দেখালে। আবার প্রমাণিত হয়েছিল এই সবই ফালতু অপপ্রচার ব্যতীত কিস্যু না।
তাছাড়া ছাত্রজীবনে বেশ কয়েকজন মরোক্কান তরুণ তরুণী আমার বন্ধু এবং সহপাঠী ছিল, কই তাদের হাবভাব চালচলনে তো কখনও পর্দানশীনতার ছাপ দেখিনি! নিন্দুকের দল বলল, সেসব আগে ছিল, এখন দুনিয়া বদলে গেছে, সর্বত্র মৌলবাদী এবং টেররিস্টরা ওৎ পেতে থাকে। মোটকথা মরক্কোর সফরে প্রকৃতির রূপ ও মানুষের ভালো ব্যবহার এই দুটোর মধ্যে কোনটাকে বেশি নম্বর দেব এখনও সে নিয়ে দ্বিধায় রয়েছি।
কাজেই রোডেশিয়া যাবার পরিকল্পনা করবার সময়ে লোকের মুখের ঝাল খাইনি।
মূল গন্তব্য ছিল ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত দেখা। ম্যাপে দেখলাম জান্বেজি নদীর এই প্রপাত দেখতে হলে হয় জাম্বিয়া যেতে হবে, নয় জিন্বাবুয়ে। একটা ছিল আগে উত্ত রোডেশিয়া, অন্যটা দক্ষিন।
আফ্রিকার ম্যাপে বেশ কিছু জায়গায় থাকে সরলরেখা।
আমার নিজের হিসেব বলে যে সরলরেখা লোভের প্রতীক, মিউচুয়াল ভাগ বাঁটোয়ারার চিহ্ন। দখলদারদের নিজস্ব বোঝাপড়ার লাইন। তুমি ওদিকটা নাও, আমি এদিকটা নিই। স্কেল দিয়ে দিয়ে স্ট্রেইট লাইন টেনে টেনে লুঠের জমিতে আধিপত্যস্থাপন।
আমার গ্রামসম্পর্কে এক দাদা থাকে প্যারিসে, সে দীর্ঘকাল আফ্রিকায় থেকেছে, পেশায় ব্যাংকার ছিল, কিন্তু এক সময়ে নিজেই ছেড়ে দেয় এই ব্যাংকিং এর জগৎ। তাকে ফোন করলাম — ভিক্টোরিয়া ফলস যাচ্ছি।
— দারুণ সুন্দর জায়গা। যাও ঘুরে এসো।
— আর কী কী দেখব বলে দাও। মোট এগারো দিন, তবে দৌড়োদৌড়ি করে ঘোরা আমাদের পোষায় না সে তো জানোই।
— চোবে ন্যাশানাল পার্কটা ঘুরে এসো। ওটা বটসওয়ানাতে।
— দাঁড়াও, টুকে নিই। আর কোথায় যাবো?
— কাজুঙ্গুলা যেও। দুনিয়ার ঐ একটি জায়গাই আছে যেখানে চারটি দেশ মিলেছে। আর তার কাছেই পাবে লায়নস জ।
— সিংহ দেখা যাবে ওখানে?
— সে তো এমনিতেই দেখা টেখা যায়। তবে লায়নস জ অন্য জিনিস। ওটা মিস কোরো না। চব্বিশ মিটার চওড়া যেখানে চোবে নদী।
— আমি ইন্টারনেটে দেখে নিচ্ছি।
কী কাণ্ড! ইন্টারনেটে লায়নস জ পাওয়া গেল না। ইতিহাসের এটাই মজা। সময়ই পুরোন হতে হতে ইতিহাস হয়ে যায়। তার কিছু কিছু অংশ স্কেল টেনে সরলরেখা টানার মতো ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলাও সম্ভব।
লায়নস জ টাইপ করলেই আসছে অশ্বডিম্বের মতো কেবল সিংহের ছবি। হায়রে ইন্টারনেট!