এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ১

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ অক্টোবর ২০২২ | ৭৩৭ বার পঠিত
  • নিজের অজান্তেই আধো-জাগা আধো-ঘুমের মধ্যে পায়ের কাছে রাখা পাতলা চাদরটি গায়ের উপর টেনে আপাদমস্তক ঢেকে নেয় বকুল। কিন্তু মায়ের অনর্গল 'এই বকুল কত বেলা হয়ে গেল, ওঠ এবার ----' ডাকাডাকিতে চোখ পিটপিট করে তাকায় বকুল চাদরটি একটু সরিয়ে মুখের উপর থেকে। শুনতে পায় টিপটিপ করে ঝরে পড়া জলের আওয়াজ। ঘাড় একটু ঘুরিয়ে মাথার দিকের খোলা জানালা দিয়ে দেখতে পায় গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়ার মতো বৃষ্টি হচ্ছে। একটা শীতল আর্দ্রতায় ভরা বাতাস খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। জানালার উপরের পাটাতনটি অবশ্য বাধা দিচ্ছে বৃষ্টির হালকা ছাটকে ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে। কালকে রাতে শুতে যাওয়ার আগেই দেখেছিল বকুল একটি বেমক্কা কালোমেঘ ছিল স্থির হয়ে চাঁদের পাশে, যেমন একটি ধুরন্ধর টিকটিকি থাকে দেয়ালের উপর ওঁৎ পেতে পোকা ধরার জন্য। কাল হয়তো গভীর রাতে সেরকমই কালো মেঘটি সুযোগ বুঝে খেয়ে নিয়েছে চাঁদকে। ইচ্ছা করছে না এখন বকুলের বিছানা থেকে উঠতে। ইচ্ছে করছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে চাদরের তলায়। উপুড় হয়ে শুয়ে দেখতে পায় বৃষ্টির ফোঁটা টুপটুপ করে পড়ছে উঠোনের আম গাছের পাতা থেকে। পাতাগুলো হয়ে গেছে সবুজ নবীন বৃষ্টির জলে ধুয়ে। দৃষ্টি আরও সামনের দিকে এগিয়ে দেখতে পায় বড় মাঠ আর মাঠের চারপাশ দিয়ে অজস্র গাছ। বকুল সমস্ত গাছকে চেনে না, কিন্তু খুব আপন মনে হয় গাছগুলোকে - সেই ছোটবেলা থেকেই। কত বয়স হলো গাছগুলোর, বকুলই তো দেখছে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। মনে হয়, অনেকটা উচ্চতা থেকে অভিভাবকের মতো বকুলের উপর নজর রাখছে।  বাবার কথা মনে পড়ে বকুলের, যখনই এসে দাঁড়িয়ে থাকে একা এই গাছগুলির নীচে। যদিও বাবাকে দেখেই নি কোনোদিন বকুল। বাবার সান্নিধ্যই পায়নি কোনোদিন। বাবার হাতের মধ্যে আঙুল গুঁজে হাঁটেই নি কোনোদিন। বাবাকে দেখেছে মায়ের ঘরে দেয়ালে টাঙানো একটি ফটোফ্রেমের মধ্যে। আর দেখেছে মায়ের কাছে রাখা সাদা-কালো ছবির অ্যালবামে। বাবা-মায়ের বিয়ের ছবির অ্যালবাম। কিন্তু এই গাছগুলোকে দেখলেই বকুলের একটা পিতৃসান্নিধ্যের অনুভূতি হয়। দেখেছে শুনেছে, ছেলেমেয়ে বিপথে গেলে বাবা বটগাছের মতো আড়াল করে যেমন সামলিয়ে নেন - সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন, এই গাছগুলোও হয়তো সেরকম ভাবে বকুলকে আগলে রাখে সবসময়।

    (দুই)

    এবার বকুল আগরতলাতে মায়ের কাছে এসেছে একাই। অভিরূপ ছুটি পায়নি। রয়ে গেছে কলকাতাতেই। বলেছে কয়েকদিন পরে আসবে, নতুন বছরের কোম্পানির দেওয়া টার্গেটগুলি সবাইকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিয়ে। ইয়ার এন্ডিং-এর ঝামেলা কাটাতে না কাটাতেই, ঘাড়ের উপর চেপে বসেছে নতুন বছরের পর্বতসমান কোম্পানির আশা, কোম্পানির বৃদ্ধির হার। অভিরূপের বাড়িও এই আগরতলাতেই। নুতন নগর, এয়ারপোর্টের কাছে। আগরতলাতে অভিরূপের মা-বাবা থাকেন। ওর বোন ঝিনুক, বকুলের কলেজ বান্ধবী, এখন মুম্বাইতে। বকুলের মা অবশ্য থাকেন নন্দন নগরে, আগরতলা শহরের থেকে একটু বাইরে, একটু খোলামেলা। এই এলাকাতে কংক্রিটের জঙ্গল এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। একান্ন বছর আগে মা যখন প্রথম আগরতলাতে আসেন, তখন বাবার চেনাজানা একজনের বাড়িতে উঠেছিলেন। অনেক পরে একটু একটু করে, যখন যেমন সম্ভব হয়েছে এই ছোট বাড়িটি তৈরী করেন।

    বকুল যখন উইমেন্স কলেজ আগরতলাতে পড়ত, তখন আলাপ হয় সহপাঠী ঝিনুকের সাথে। পরস্পরের বাড়ি আসা-যাওয়া লেগে থাকতো, কলেজ ছুটির পর। অভিরূপ তখন ত্রিপুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়ে। সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝেই হোস্টেল থেকে বাড়ি আসতো। এক শনিবার বকুল গিয়েছিল ঝিনুকের বাড়ি। আর অভিরূপও সেই সপ্তাহে শুক্রবারে বাড়ি আসে। আলাপ হয় দু'জনের। এরপর থেকে প্রায়ই শুক্রবারে চলে আসতো অভিরূপ হোস্টেল থেকে বাড়িতে। আর শনিবার ঝিনুক টেনে নিয়ে যেত বকুলকে ওদের বাড়িতে, কলেজ ছুটির পর। বকুলেরও পুরোদমে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতো। ততদিনে বকুলেরও ভালো লাগতে শুরু করেছে অভিরূপকে। অভিরূপ চাকরি নিয়ে চলে যায় কলকাতাতে। তার দুই বছরের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় বকুলের অভিরূপের সাথে। বকুলের বয়স তখন মাত্র তেইশ। এক বছরের মধ্যেই পেটে এসে যায় ছেলে অভিমন্যু। এখন সে বেঙ্গালুরুতে আছে, আই টি ইঞ্জিনিয়ার। অভিরূপের এটা তিন নম্বর কোম্পানি, তবে কলকাতার বাইরে কোনোদিন চাকরি নিয়ে যায়নি। এই কারণে বকুলের সুবিধা হয়েছে, মায়ের কাছে এসে থাকার মাঝে মাঝেই - যখনিই সুবিধা পেয়েছে। এখন অবশ্য ঝাড়া হাত-পা। ছেলে সাবলম্বী, এখন বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই হয়।

    কিছুদিন হলো মাকে নিয়ে একটু চিন্তিত বকুল। সেই কারণেই এবার আসা। গতবার যখন এসেছিল শীতের শেষ দিকে, দেখতে পেয়েছে মা একটু একা একা থাকতে পছন্দ করছেন। বকুল চিরকাল মাকে দেখে এসেছে একজন বেশ সাহসী মহিলা হিসেবে, বেশ কর্মঠ, প্রচন্ড প্রাণ-প্রাচুর্যতায় ভরা। কিন্তু আজকাল দেখতে পায় অন্যরকম। একটু জবু-থবু। দেখলে মনে হয় বাঁচার ইচ্ছেটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। যেন জীবনের সাথে সংগ্রাম করতে করতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছেন। বাড়িতে অবশ্য সবসময় দেখাশুনার, কাজ করার শান্তি-মাসি রয়েছে। কিন্তু মা আগে নিজের হাতেই সবকিছু করতেন। আগরতলা হাসপাতাল থেকে দশ বছর আগে অবসর নেওয়ার পরেও মা খুব একটিভ ছিলেন। পাড়ার থেকে কেউ অসুবিধায় পড়ে ডেকে নিয়ে গেলে, এক বছর আগেও দৌঁড়ে যেতেন নিজের চামড়ার ঢাউস ব্যাগটি নিয়ে যাতে থাকে স্টেথোস্কোপ সহ ডাক্তারির সব সরঞ্জাম। কিন্তু গতবার বকুল এসে দেখেছে সেই উদ্দীপনাটা আর নেই মায়ের। এটা বয়সের ভারে নয়। কারণ মা এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ, বকুলের চেয়ে বেশি কাজ করার ক্ষমতা রাখেন। বোধহয় মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন, যেন নিজের অস্তিত্ব নিয়েই একটা সংকটে পড়েছেন।  

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Supriya Debroy | ১৫ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৩৬512859
  • ধন্যবাদ। পরের পর্বর জন্য একটু অপেক্ষা করুন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন