আজকাল গ্রুপে অনেকে ইংরেজি বইয়ের রেকামেন্ডেশন দিচ্ছে দেখে এই বইটা সাজেস্ট করার ইচ্ছে হল। অসম্ভব জনপ্রিয় বই, অনেকেই পড়ে থাকতে পারেন। না'হলে পড়ে দেখতে পারেন। টাইমলাইনে বছরখানেক আগে লিখেছিলাম, সেটাই কপি পেস্ট করে দিলাম।
অ্যামাজন বেস্টসেলারের তালিকায় থাকা কোন বই হাতে পেলে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি। কয়েকবার রাম ঠকান ঠকেছি, মাঝখানে বই ছেড়ে দেওয়া আমার নীতিবিরুদ্ধ, ফলে বইটা শেষ করতে গিয়ে রীতিমত নাকানি চোবানি খেতে হয়েছে।
এই বইটা নিয়েও আমার দ্বিধা কম ছিল না। আমাজন বেস্ট সেলার লিস্টে এক নম্বরে বিরাজ করছে, কিন্তু তেমন কোনও আলোচনা নেই কেন? ভয়ে ভয়ে বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম। আমার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান খুবই সীমিত, লিটারারি স্টাইল নিয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে আমি ভ্যাবা গঙ্গারামের মতো বসে থাকি, কিছুই মাথায় ঢোকে না। সেই ভয়ও ছিল কম নয়!
পড়ার পর বলতে বাধ্য হচ্ছি যে বইটা না পড়লে সত্যিই মিস করতাম। গত দু' এক বছরের মধ্যে পড়া বইগুলোতে এই বইটা আমাকে যেভাবে মুগ্ধ করেছে, অন্য কোন বই করেছে বলে মনে হয় না। আশ্চর্যের কথা হল, অনেকের মতে এটা থ্রিলার। যদি সত্যিই এটা থ্রিলার হয় তাহলে বলতে হয়, এমন মায়া জড়ানো আর মনকাড়া থ্রিলার কস্মিনকালেও পড়িনি। আমি অবশ্য এটাকে থ্রিলার বলব না। মানুষের জীবনে প্রকৃতির কী মাহাত্ম্য, সেটাই এই কাহিনীর প্রধান আকর্ষণ।
যাকগে, হোয়্যার দ্যা ক্রড্যাডস সিংগ একটা মেয়ের জীবনের গল্প। গল্প শুরু হয়েছে ১৯৫০ এর দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শল্যান্ডে সমাজ বহির্ভূত একদল মানুষ বাস করত। এরকম একটা পরিবারের মেয়ে কিয়া। ভাগ্যের টানে একে একে প্রত্যেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে থাকে। জলাভূমির অবসাদগ্রস্ত বিষাদময় জীবন সহ্য না করতে পেরে কিয়ার মা চলে যান। ভাই বোনরা চলে যায়, মদ্যপ বাবাও ছেড়ে চলে যায়। মার্শল্যান্ডের বিস্তীর্ণ জলাভূমির একাকিত্বে থেকে যায় বছর দশেকের একটি মেয়ে। একা।
সরকারি লোকেরা একা মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করতে চেষ্টা করেছে, হয়ত ফস্টার হোমে পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু কিয়ার জীবন যে বাঁধা ধরা গতে চলবে না, সেটা হয়ত অনেক আগেই ঠিক হয়েছিল। কিছুতেই সে সামনে আসতে চায় না। মানুষজন দেখলেই সে লুকিয়ে পড়ে, কিন্তু প্রকৃতির মাঝে সে সাবলীল, সহজ। একা থাকার কৌশল প্রকৃতি তাকে শিখিয়ে দিচ্ছে, একই সঙ্গে গভীর হচ্ছে মার্শল্যান্ডের সঙ্গে কিয়ার সম্পর্ক। পোকামাকড়, পাখি পাখালি, বন ও বনজদের সঙ্গে নিয়ে সে বড় হতে থাকে। ডেলিয়া যেভাবে এই সম্পর্ক বুনে তুলেছেন, তার কোন তুলনা নেই। অপূর্ব লেখনীর মাধ্যমে টুকরো টুকরো করে এমন একটা জগৎ তুলে ধরেছেন, যার সঙ্গে একাত্ম হতে কোন অসুবিধে হয় না। এক একটা লাইন বারবার পড়েছি। ভাষার ব্যবহার এতটাই প্রাণবন্ত যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এই অবাস্তব সারভাইভালের গল্প কী আসলে লেখিকার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা?
এই ঘটনার প্রায় বারো চোদ্দ বছর পর সেই জলাভূমিতে একটা লাশ পাওয়া যায়। সন্দেহ যায় মার্শ গার্লের ওপর। এই কয়েক বছরে বাইরের জগতের কিছু মানুষের সঙ্গে কিয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, কিন্তু মোটের ওপর এই জংলী মেয়েকে নিয়ে সকলেই সন্দিহান। সমান্তরাল ভাবে কিয়ার বড় হওয়া আর হত্যা রহস্যের তদন্ত চলতে থাকে।
গত এক বছরে আমি তেরোটা দেশের পঞ্চাশ থেকে ষাটজন বন্ধুকে এই বইটা পড়ার পরামর্শ দিয়েছি বার বার। আমাজন বেস্টসেলার হলেও অনেকেই এই বইটা পড়েনি আগে। এর মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যেই বইটা পড়ে ফেলেছে এবং অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের পড়তে বলেছে।
ডেলিয়া ওয়েন্স সত্তর বছর বয়সে এসে প্রথম উপন্যাস লিখেছেন এবং পর পর ছক্কা মেরেছেন। তিরিশ চল্লিশ বছর আগে থেকে লিখলে কোথায় পৌঁছে যেতেন সেটা ভেবে আর লাভ নেই। বরং প্রার্থনা করি অন্তত পক্ষে আরো একটা বই যেন ডেলিয়া লেখেন। বইটা নিয়ে সিনেমাও হচ্ছে, প্রধান ভূমিকায় 'নরম্যাল পিপল' খ্যাত অভিনেত্রী ডেইজি এডগার জোন্স। সিনেমা হলে অনেকেই হয়তো দেখবেন কিন্তু বইটা পড়বেন কিনা বলতে পারছি না। বরং আগেভাগে পড়ে নিন। ঠকবেন না।
https://www.goodreads.com/book/show/36809135-where-the-crawdads-sing
এক সহকর্মীর কথায় বইটি পড়েছিলাম। ডেলিয়া ওয়েন্সের প্রথম উপন্যাস। উনি ওয়াইল্ডলাইফ সায়েন্টিস্ট- নন ফিকশন বই রয়েছে।
কাহিনীতে একটি হত্যা রয়েছে, তার তদন্ত, কোর্ট রুম সবই আছে- কিন্তু একে থ্রিলার বলতে দ্বিধা করব। যদিও থ্রিলারের মত পরিচয় উন্মোচন রয়েছে উপন্যাসের একদম শেষে- তবে একটি নয় দুটি উন্মোচন - কিয়ার খুব কাছের মানুষও যে পরিচয় জানতে পারে নি; আর নিবিষ্ট পাঠকের কাছে অন্তত একটি পরিচয় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত রয়ে গিয়েছিল শেষটুকু পড়া অবধি।
গল্পের টান একদম গোড়া থেকেই - ছোটো মেয়ের একলা বেঁচে থাকা -
উপন্যাসের নাম, গল্পের ভাষা মায়াময়- কোনো কোনো লাইন যত্ন করে রেখে দেওয়ার। কবিতা এই বই এর চরিত্রের মত।
একটা সময়ের পর ঘটনাবলী অনুমেয় মনে হচ্ছিল- আদালতের ঘটনাবলীও । দুটি সময়ের পাশাপাশি চলা ইদানিংকালে পড়া দুটি থ্রিলারকে মনে করাচ্ছিল- যেখানে অবশ্য বিভিন্ন সময়কাল দুর্দান্তভাবে ব্যবহার হয়েছিল- এই বইতে তা হয় নি। গারদে ছবি আঁকাও অন্য একটি থ্রিলারকে মনে করিয়েছে।
সমাপ্তিতে আবার ফিরে এসেছে সেই মায়া এবং জিতে গিয়েছে। বইএর তিন চতুর্থাংশ পার করে যে কবিতা ছিল, সেটি আবার মনে এসেছে-
'Sunsets are never simple.
.......Sunsets are in disguise,
Covering truths, covering lies.'
গোটা কাহিনী জুড়ে এই অনুরণন আসি আসি করেও আসে নি বা এলেও আগাগোড়া বজায় থাকে নি। এইটি পাঠকের খেদ। তবু মায়া রহিয়া গেল ...
আমারও তাই মত। এটা থ্রিলার তো নয়ই। কবিতা বলাই ঠিক।