তোলেদো। তাগুস নদীর কিনারায় অবস্থিত প্রাচীন পার্বত্য নগরী। শহর না বলে গ্রাম বলাই ঠিক। তবে একরত্তি একলা গ্রাম নয়, বেশ জমাটি 'ভিলেজ টাউন'। স্পেনের এই এক চিলতে জায়গায় কী জাদু কে জানে, হাজার বছর ধরে অনুপ্রবেশকারীরা তোলেদো দখল করবে বলে হাপিত্যেশ করে বসে থেকেছে। রোমান, মুর, ভিসিগথ-- নতুন প্রজন্মের সঙ্গে নতুন নতুন ইতিহাসের পাতা যোগ হয়েছে তোলেদোতে কিন্তু পুরোনো পাতাগুলো মুছে যায়নি কোনোদিনই, বরং সময়ের সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
সেই শহরে গিয়ে পৌঁছেছি সেইবার। রূপকথার রাজ্য, কিন্তু সে রাজ্য পাথর দিয়ে গড়া। লোরকার ভাষায় স্পেন হল জ্যান্ত ভূতের দেশ, বর্তমান এখানে গৌণ। ভুল বলেননি। এখানকার ভুগোল, ইতিহাস, শিল্প, কিংবদন্তি সবই অতীতের পরিচয় বহন করে, পাথরের গির্জা, প্লাজা, স্কোয়ারে ভূত ঘোরাঘুরি করে জ্যান্ত মানুষের পাশাপাশি, ম্যাকডিতে গিয়ে বার্গারও খায় সম্ভবত।
গুগল ম্যাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এরকম জায়গায় এসে গলির গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে না গেলে ঠিক জমে না। ইহুদি-মুর-ক্রিশ্চান সভ্যতার নিদর্শন, স্যুভেনিরের দোকান, ক্যাফে,রেস্তরাঁ,জামাকাপড়,গয়নার দোকান। অনেক জায়গায় ট্রেজার হান্টিং ম্যাপ আর যন্ত্রপাতিও পাওয়া যায়। কিং সলোমনের হারিয়ে যাওয়া সোনার টেবিল আর চাবি খুঁজতে এক সময় সারা দুনিয়া থেকে ইন্ডিয়ানা জোন্সের জ্ঞাতিগুষ্টি এসে হাজির হয়েছিল, তাদের অর্ধেককে ভূতে ঘাড় মটকেছে, বাকিরা হতাশ হয়ে বা ভয় পেয়ে পিটটান দিয়েছে। (মস্করা নয়, ভূতের কথা পুলিশও স্বীকার করে, 'আনসলভড মার্ডার' এর ফাইলে সে কথা লেখাও নাকি আছে!)
খোঁজ অবশ্য এখনও চলছে, তোলেদো গুপ্তধনের ডিপো কিনা! সলোমনের গুপ্তধন ছাড়াও একটা গুজব ছিল গির্জা তৈরী করার সময় কয়েকশ টন সোনা নাকি আর্চবিশপরা লুকিয়ে রেখেছে কোনো গুপ্তস্থানে।
সে সব আমার ভাগ্যে নেই। গুপ্তধন দূর, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এ ব্যালেন্স দেখলে হিক্কা উঠতে থাকে। বন্ধুবান্ধবরা ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি কিনে খুশ! মস্তিতে চাকরি করে করে টাকা জমাচ্ছে, আমি জমাচ্ছি স্মৃতি। নতুন জায়গায় এলে স্মৃতির খাতায় সূর্যাস্তগুলোও ঢুকে যায়। এক একটা সূর্যাস্ত এক একটা ইনভেস্টমেন্ট! সে নিয়ে গাফিলতি করি না।
সুতরাং সবচেয়ে জনপ্রিয় সানসেট পয়েন্টের খোঁজে হাঁটা শুরু হল, সাত কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পর পড়ল মিরাদোর দেল ভাইয়ে।
আকাশের গায়ে তখন ঘন কমলার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। দূরে তোলেদো শহরের ওল্ড টাউন সূর্যাস্তের অপেক্ষায় সাজতে শুরু করেছে এক একটা করে আলোর টিপ পরে। তাগুস নদী এখানে বাঁ দিকে বেঁকেছে। অনেক নীচে নদীর পাড় দিয়ে কয়েকজন জলের ধারে গিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার ধরে উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের কালস্থায়ী,আবহমান জীবনদৃশ্যের দিকে। সূর্যাস্ত হচ্ছে। আলোহিত আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে বাসায় ফিরে চলেছে পাখির দল। নদীর গর্ভে হয়ত মাছেরাও ঘুমোনোর তোড়জোড় শুরু করবে এইবার। দূরে তোলেদো শহর অনন্তকাল ধরে এই সায়াহ্নের সাক্ষী। আমার চোখের সামনে এই মুহূর্তে ইতিহাস, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক ফ্রেমে। নিজের অজান্তেই এই মুহূর্ত আমাদেরও ইতিহাসের পাতায় বন্দী করে রাখলো, চিরকালের জন্যে।
আরো কিছু মুহুর্ত ফ্রেমবন্দি করলাম, অভিজ্ঞতার ফিক্সড ডিপোজিটে ফেলে তালাবন্ধ করলাম। ম্যাচয়োর হলে এই মুহুর্তগুলো ভাঙিয়েই জীবন চলবে।
সেই মুহুর্তের একটা ছবি।
টাকা জমানোর থেকে স্মৃতি জমানোই ভালো। এটা আমিও বিশ্বাস করি। তোলেদো শহরটা নিয়ে আরেকটু লিখলে ভালো লাগতো।
অনেক ধন্যবাদ। এই বইটা পড়তে পারেন। সম্ভবত লং টার্ম ব্যাকপ্যাকিং নিয়ে লেখা প্রথম বই। তেরোটা দেশের বেশ কিছু শহরের অভিজ্ঞতা আছে। ইতিহাস, মিথ, স্থানীয় কবি, লেখক, শিল্পীদের নিয়ে গল্প, অনেক কিছু পাবেন। তোলেদোর কথাও বিস্তারিত লিখেছি।