
Goutam Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোনশুধু ভালবাসায় ভর করে হাঁটা যায় যোজনপথ
আমাদের সমস্ত শিল্পপ্রকাশই কোনও না কোনওভাবে প্রেম-ভালবাসার কাঙালপনা, আকুতি, চাওয়া পাওয়া, হারানো এই সমস্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ভালবাসা এই চতুর্বর্ণে বর্ণমালা শেষ হয়ে যায়। শুধু ভালবাসায় ভর করে হাঁটা যায় যোজনপথ। প্রতিটি নারী অথবা পুরুষ নিজের মতো করে এক চিরন্তন রাধিকা বা বনমালী। ভালবাসা ক্ষমাপ্রবণ করে তোলে, শান্ত করে অস্থিরতা। বেঁচে থাকা রমণীয় করে তোলে দু’দণ্ড। প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু, মা-বাবা, স্বামী স্ত্রী, ভাই-বোন বা নামহীন অজস্র সম্পর্কের সুতোয় টান পড়ে কতবার। অথচ ‘ভালবাসি’ কথাটি সে ভাবে বলে ওঠা হয় না অনেকেরই। ভালবাসার কথা সেভাবে বলে ওঠা হয় না। বলে ওঠা হয় না ভালবাসি, সত্যিই ভালবাসি, ভালবাসা দিতে পারি। আসলে “ডিজিটাল ড্রাগে” বন্দী গোটা পৃথিবী। সামাজিক মাধ্যম, মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে চলেছে বিশ্ব জুড়ে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে যে ভাবে যান্ত্রিক যোগাযোগ ও ভার্চুয়াল সম্পর্কের ব্যবহার বাড়ছে তাতে মানুষের আনন্দিত হওয়ার বিশেষ কোনও কারণ আছে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। আর তাই ভালোবাসাও ডিজিটাল হয়ে যায়। নেট প্রযুক্তির সবকিছুই খারাপ তা অবশ্যই নয়। সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে মানুষের জানার দুনিয়া অনেকটাই হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। মুঠোফোনের সাহায্যে জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে ফেলেছে আধুনিক মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন এটাই যে কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজস্ব ভার্চুয়াল জগতে ঠাঁই নিয়েছে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। যে কারণে বাড়ছে যান্ত্রিকতা। হারিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো।
ভার্চুয়াল জগত নয়, পরিবারে গড়ুক ভালোবাসার বন্ধন
“পৃথিবীটা নাকি, ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ ড্রয়িংরুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দি”। বাস্তব জীবনে মানুষ এখন নিঃসঙ্গ। সময়ের সঙ্গে আজ এই ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে কত নিস্পাপ মন। তারই ফলে এক প্রবল মানসিক ব্যাধি গড়ে উঠছে সমাজে। পরিবারের পর পরিবার এক নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সন্তানদের এই ডিজিটাল ড্রাগের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে। বই পড়ার অভ্যাস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, বিমানবন্দরে সর্বত্র নতুন প্রজন্ম ব্যস্ত মুঠোফোনে। হয় গান, নয় সিনেমা, নয় তো সামাজিক মাধ্যম। হারিয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের কারণে অতিমাত্রায় প্রভাব পড়ছে নাগরিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক জীবনেও। মানবিক সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এই যান্ত্রিক নেশার কারণে। এটাই সবচেয়ে দুঃখের। নিজেকে যন্ত্রের কাছে সঁপে দিয়ে আধুনিক প্রজন্মের একাংশ হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দারা। শিশুরাও কি আক্রান্ত নয়? দুধের শিশুও অন লাইন ক্লাশে আবদ্ধ। এত আতঙ্কের পরিবেশ ওরা কখনও দেখেনি। টিভিতে সর্বক্ষণ রোগ নিয়ে কথা, সম্পূর্ণ ঘরবন্দি হয়ে থাকার ফলে ওদের সমস্ত ভাল লাগার জায়গাগুলো দুরে সরে গিয়েছে। ঘরে আটকে থেকে শুধু পড়াশোনা করে ওরা ক্লান্ত। পড়াশোনার চাপ কমায় অনেকে প্রথম দিকে উৎসাহ বোধ করলেও ক্রমশ তা হতাশায় পর্যবসিত। তারপর করোনা মোকাবিলায় নানা রকমের বিধিনিষেধে একদমই অভ্যস্ত নয় ওরা। বাইরের ফাস্ট ফুড এই বয়সি ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষক। সে সবও বন্ধ ঘরবন্দি হয়ে। মনোবিদদের মতে, এর প্রভাব শিশুমনে হবে দীর্ঘস্থায়ী। এমনকি মানসিক বৈকল্যও আসতে পারে। অপরাধ প্রবণতাও বাড়তে পারে। এই সময় আরো বেশি বেশি করে সন্তানকে ভালোবেসে সময় ডেওয়া একান্তই প্রয়োজন।
মানসিক চাপ এবং একাকীত্ববোধ কমাতে হবে
মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ বা প্র্যাকটিক্যাল অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানসিক চাপও বাড়ছে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের। মৃত্যুভয়ে বয়স্কদের মানসিক সমস্যার সঙ্গে হার্টের সমস্যা, ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, হাঁপানি বাড়তে শুরু করেছে। একাকিত্ব কাটলেও মৃত্যুভয় মনে গেঁথে বসছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কাউন্সেলিং। টিভি দেখলেও কিন্তু সবসময় দেখা ঠিক না। টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখলেই ভালো থাকবে মন। বাচ্চাদের সঙ্গে ঘরে বসে লুডো, ক্যারাম খেললে পারিবারিক সম্পর্ক এই সময়কালে মজবুত হবে। গল্পের বই, ম্যাগাজিন পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। বাচ্চাদের ও বয়স্কদের পছন্দমতো বই জোগাড় করে দিলে সময় কাটবে ভালো। গান, কবিতার চর্চা করা যায় এই সময়ে মানসিক সঙ্কট কাটাতে। সবসময় করোনা সংক্রান্ত খবর দেখে বা পড়ে মানসিক উদ্বেগে থাকার প্রয়োজন নেই। তাতে অবসাদ আরও বাড়বে, কমবে না। ভবিষ্যৎ তো কারও জানা নেই। তবু হতাশ হলে চলবে না। আতঙ্ক কাটাতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই বেঁচে থাকব এবং ভালভাবেই বেঁচে থাকব। সুস্থ শরীর, সুস্থ মন ও পরিপূর্ণতা নিয়েই নতুন পৃথিবীতে থেকে যাব আগের মতোই। কিন্তু সেই অবস্থায় পৌঁছতে হলে আমাদের প্রত্যেককে সাবধান থাকতে হবে আগামী আরও কিছু দিন। না হলে এই মারণব্যধির আক্রমণে দূর্যোগ আরও বাড়বে।
উদ্বিগ্ন মনের যত্ন প্রয়োজন
সব উদ্বেগই মন্দ নয়, সব ভয় অকারণ নয় যে এখনই তাড়াতে হবে। আজ এত কোটি কোটি মানুষ যে ঘরবন্দির ডাকে সাড়া দিয়েছেন তার কারণই তো ভয়। রোগের উদ্বেগ কাজ করছে বলেই সরকারের অনুরোধে নাগরিক সাড়া দিয়েছে, না হলে এত লোককে দিনের পর দিন জোর করে ঘরে আটকে রাখা অসম্ভব হত। যে উদ্বেগের মূলে যথেষ্ট কারণ আছে, যা নিরাপদ থাকার উপায় সন্ধান করতে মানুষকে প্রণোদিত করে, তা ক্ষতিকর নয়। তবে যদি দেখা যায় রোগের ভয় বা অন্য কোনও কিছু নিয়ে উদ্বেগ এত তীব্র হয়ে উঠছে যে তা কোনও ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতাকে ব্যাহত করছে, অন্যদের সঙ্গে তার ব্যবহার বদলে যাচ্ছে, আদানপ্রদানে সংঘাত তৈরি করছে, তা হলে তা অশ্যই বিশেষজ্ঞদের নজরে আনতে হবে। রোগে আক্রান্ত হওয়ার চাইতেও দীর্ঘ লকডাউনের ফল কী হবে সেটা মানুষকে ভাবাচ্ছে বেশি। এটা অকারণ উদ্বেগ নয়, এবং মনের চিকিৎসা করা যে এর থেকে বাঁচার উপায়, এমনও নয়। সঙ্কটের কল্পনায় উদ্বেগ খারাপ নয়। পরীক্ষা নিয়ে ভয় থাকে বলেই ছাত্রেরা পড়াশোনা করে, রোজগারের অনিশ্চয়তার কথা ভেবেই সঞ্চয়, বা অধিক আয়ের চেষ্টা করে মানুষ। সমস্যা তখনই হয় যখন উদ্বেগ এত তীব্র হয় যে তা স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। প্রতিকূলতার সামনে সকলকেই দাঁড়াতে হয়। ফসল মার খেলে চাষি বিপদগ্রস্ত হন, কারখানা উঠে গেলে শ্রমিক বিপন্ন হন, প্রশ্ন কঠিন হলে ছাত্র বিপাকে পড়ে। কিন্তু যাদের উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণে থাকে না তারা বিশেষভাবে আক্রান্ত হন, ছিটকে যান।
চলুন মানবিক মুখগুলোকেই আপাতত ভালোবাসি
মানবসভ্যতার সাফল্যের দিকে বিশাল প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেওয়ার সময়ে একতার অনুভূতিটুকু প্রাপ্তি তো বটেই। প্রাপ্তির সেই ছবিতে কোথাও দেখা যাচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধা তাঁর সঞ্চিত যাবতীয় অর্থ তুলে দিচ্ছেন করোনা ত্রাণ তহবিলে। কোথাও আবার কলেজ পড়ুয়া কন্যাশ্রী প্রকল্পের জমিয়ে রাখা অর্থ নির্দ্বিধায় তুলে দিচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, কোথাও-বা কেউ কেউ জোট বেঁধে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন ওষুধ। যে পথকুকুরদের, পথের বিড়ালদের কেউ এতদিন পৃথিবীর বাসিন্দাই ভাবেনি, তাদেরও যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন অনেকে এমন ছবিও মোটেই বিরল নয়। অথচ এই আমরাই এতদিন বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে চারদিক চারপাশকে অগ্রাহ্য করে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছি। নিজেদের পরিসরের গণ্ডিও যে কখন ছোট হতে শুরু করেছিল তার হিসেবও কেউ রাখিনি। কিন্তু একটা বিপর্যয় নিমেষে সারা পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদেরও আমূল বদলে দিয়ে গিয়েছে। একদিন সামাজিক মাধ্যমে যাঁরা আবিষ্ট হয়ে থাকতেন আজ তাদের সিংহভাগই ভাবছে এই বিপর্যয়ের সময় সামান্য হলেও কিভাবে দুঃস্থ মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। যে তরুণ প্রজন্ম সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে কেরিয়ারমুখী হয়ে উঠেছিল, আজ তারাই দিনরাত রাতদিন ছুটে যাচ্ছে বিপন্ন মানুষের কাছে। এই মানবিক মুখগুলো যেন কখনও বদলে না যায়। এই মানবিক মুখগুলোই আসলে এ দেশের চিরন্তন ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গেরও এবং নিশ্চিতভাবে আমাদের এই উত্তরবঙ্গেরও।
জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 117.2.***.*** | ০২ জুন ২০২১ ০৯:৩৬494453বা! ভালো লিখেছ। যে কথাটি আমাকে বেশি ভাবায় তাহল - মানুষ যখন মানুষকে ছেড়ে ভার্চ্যুয়াল দ্বীপে বাস করে তখন সে নিজের তৈরি করে নেওয়া হয়েছে জগতের গোষ্ঠীপতি একদিকে, অন্যদিকে, কর্পোরেট পুঁজির দুনিয়ায় কেবল ভোক্তা।
এই লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ চলছে। অতিমারি একে অনেক সফল করেছে। এর মাঝে সাবভার্সনের ইঙ্গিত আছে "নো ভোট টু বিজেপি", " রেড ভলান্টিয়ারস" এবং স্থানিক স্তরে যে অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
এই প্রচেষ্টাগুলোকে জল-বাতাস-মমতা-সাহচর্য দিয়ে বড়ো করে তোলার দায় এবং দায়িত্ব আমাদের।
সে কাজটুকু আমরা করবো তো?
Goutam Chakraborty | ০২ জুন ২০২১ ১২:৩১494458বৃহত্তর স্বার্থে জনসমাজ অবশ্যই করবে।
dc | 122.164.***.*** | ০২ জুন ২০২১ ১২:৩৭494459একদম ঠিক কথা। বেশী বেশী করে ভালোবাসা উচিত। কিন্তু একজন আরেকজনকে ভালোবাসলেই যে অন্যজন রেসিপ্রোকেট করবে, সেটার দূর অস্ত। এই তো আমি পড়শীনি কে ভালোবাসতে চাই, কিন্তু সেকথা বললে অন্তত তিনজন লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে :-(
লকডাউনে বাচ্চারা মোবাইলে লুডু খেলতে খেলতে পড়ালেখা সব ভুলতে বসেছে!
কি ভয়ানক নিদানকাল!
সান্ত্বনা পাখিরা | 2409:4061:2c9e:976e:7b3e:1d77:19bd:***:*** | ০২ জুন ২০২১ ১৬:৪২494470বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক লেখা।সমাজের সচেতন স্তরে মননশীল মানুষগুলোর সমবেত অঃশ গ্রহণ একান্ত আবশ্যক।এনাদের দেখাদেখি আরও মানুুষ এগিিয়ে আসবে। আশা রাখি এই পরিিিস্থিতি একদিন শেষ হবে।
অর্পিতা ঘোষ | 122.177.***.*** | ০৪ জুন ২০২১ ২০:২৮494550যথার্থ লিখেছিস .....প্রযুক্তিতে মানুষ আসক্ত হলেও ভালোবাসা কিন্তু হারিয়ে যায়নি...... আজকের এই চরম সঙ্কটের সময় সহাবভুতি আর ভালোাসার বড় প্রয়োজন ....তোর লেখা অনুপ্রাণিত করবে আমাদেরকে ....
রীণাঘোষ | 2401:4900:3a0b:cc71:65a8:8884:6dba:***:*** | ০৪ জুন ২০২১ ২১:৩৭494553খুব ভালো লেখেছো সত্যি কেমন যেন হযে যাচ্ছে সমাজ ভালোবাসা খুবই দরকার তবে ডিজিটাল না থাকলে তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো? সব কিছুরই ভালো/মন্দ রযেছে