রাশিচক্রের চক্রব্যূহে: জ্যোতিষশাস্ত্র এবং ইন্টারনেট-যুগে জ্ঞানগম্যির রকমসকম : সুব্রত রায়
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭৬২ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭৪
একখানা সাত-বাসি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। রাজা যাবেন যুদ্ধে। রণসজ্জা প্রস্তুত। কিন্তু বাদ সেধেছেন রাজজ্যোতিষী। রণক্ষেত্রে রাজার সাক্ষাৎ মৃত্যুযোগ নাকি দেখতে পাচ্ছেন তিনি! রাজজ্যোতিষীর গণনাকে রাজা অব্যর্থ বলে ভাবেন। সব কাজেই নেন তাঁর পরামর্শ। এবারেও তাঁর সাবধানবাণী ফেলতে পারছেন না। এদিকে সেনাপতি রেগে কাঁই। সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, রণকৌশল – সব কিছুতেই প্রতিপক্ষের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে থেকেও এভাবে রণে ভঙ্গ দিতে তাঁর বেজায় আপত্তি। রাজজ্যোতিষীর ডাক পড়ল রাজসভায়। আবারও রাজার মৃত্যুযোগ ঘোষণা করে সর্বসমক্ষে তিনি সগর্বে জানান যে, তাঁর গণনা কখনও ভুল হয় না। “বটে!”, সেনাপতি শুধোন, “তা আপনার নিজের মৃত্যু বিষয়ে কোষ্ঠীতে কিছু লেখেনি?” রাজজ্যোতিষী ঝটপট উত্তর দেন, “লিখেছে বই-কি, সেনাপতি! গণনা করে দেখেছি যে, বাঁচব আরও বহু বছর। থুত্থুড়ে বুড়ো হয়েই মরব আমি।” সেনাপতি মৃদু হেসে বলেন, “না গো মাননীয় মহাশয়, আপনি আর এক মুহূর্তও বাঁচবেন না”, এবং কথাটা শেষ হওয়ার আগেই চকিতে কোমরে গোঁজা তরোয়ালটা খাপ থেকে বের করেই রাজজ্যোতিষীর কাঁধ লক্ষ্য করে চালিয়ে দেন নিখুঁত নিশানায়। ঘচাং করে ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা হয়ে যায়..
গল্পটা সেকেলে হলেও এর নৈতিক উপদেশটুকুর প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি, অন্তত সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষার খবর তেমনই ভাবাচ্ছে। গোড়াতেই সেগুলো একটু দেখে নিলে মন্দ হয় না। ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে জ্যোতিষ-বাণিজ্যের মোট বহরটা ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাপে এবং তা বার্ষিক প্রায় ৬ শতাংশ হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জন্মছক দেখে ভাগ্যগণনা ছাড়াও এই সওদার মধ্যে আছে নিউমেরোলজি, পামিস্ট্রি, ট্যারট কার্ড গণনা, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদির পরামর্শ-খরচ এবং মহার্ঘ গ্রহরত্নের বিক্রিবাটার হিসেব। জ্যোতিষশাস্ত্রের এই বিপুল বাজারে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছেন গড়ে লাখখানেক করে নতুন জ্যোতিষী [Allied Market Research 2023]। ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় বিশ্বখ্যাত পিউ ফোরাম জানিয়েছিল যে, মার্কিন মুলুকে প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ জ্যোতিষে ঘোর বিশ্বাসী [Gecewicz 2018]। ব্রিটেনে এই বিশ্বাস কিছুটা কম (১৯%) হলেও ইউরোপের অনেক দেশেই জ্যোতিষে আস্থাশীল মানুষের শতকরা হিসেব মার্কিনীদের মতোই, কোথাও কোথাও তার চেয়েও বেশি। যেমন, স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়ামে তা ৩০ শতাংশের ওপরে। ইউরোপের অনেক দেশেই প্রতি তিনজনের একজন মানুষ ভাগ্যে বিশ্বাস করেন [PEW Research Center 2018: 135]। ভারতের চিত্র অবশ্য আরও ভয়াবহ। ২০২১ সালের পিউ-সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, এদেশে ভাগ্যবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ এবং জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন শতকরা ৪৪ জন ভারতীয় [Sahgal et al 2021: 206]। আরও একটি পরিসংখ্যান তাৎপর্যপূর্ণ যে, কোভিড অতিমারির পর থেকে জ্যোতিষে বিশ্বাস ও জ্যোতিষ ব্যবসার পালে যেন একটা ধাক্কা লেগেছে, ধাক্কাটা এসেছে প্রধানত জ্যোতিষের অনলাইন বাজারের হাত ধরে। কাজেই, বিষয়টিকে নিয়ে একটু চর্চা করার দরকার আছে।
‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ (astrology) শব্দটার গায়ে বেশ-একটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের (astronomy) গন্ধ মাখানো আছে! অনেকেই দুটোকে এক বলে ভাবেন। এ হেন ভ্রান্তিকে গোড়াতেই শুধরে নেওয়া দরকার। তবে কেবল এটুকু হলেই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও যখন বিষয়টিকে চর্চার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন বিজ্ঞান না-হোক, যে কোনও প্রকারের জ্ঞানচর্চার দিক থেকেও এর আদৌ কোনও মূল্য আছে কিনা, খতিয়ে দেখা দরকার তা-ও। এরই সঙ্গে, ফলিত জ্যোতিষ আদৌ ফলে কিনা, তার উত্তরও আমাদের পেতে হবে।