শেষের দিব্যেন্দু পালিত : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | আলোচনা : বিবিধ | ১০ আগস্ট ২০১৯ | ১৩২৮ বার পঠিত
দিব্যেন্দু পালিত ভিন্ন ধারার এক ঔপন্যাসিক। বাজার চলতি ফর্মে তিনি কোনদিন হাঁটেন নি। নিভৃতে বসে শিল্পের দায়বদ্ধতা পালন করে গেছেন। ‘ঢেউ’ উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে আগস্ট, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে। এ উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম পুরস্কার পান ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে। জীবনের বহুকৌনিক বোধে তিনি উপনীত হন। মৃত্যুই যেন মানুষকে এক নতুন বোধের জগতে নিয়ে যায়। চেতনার গভীরে এক ঢেউ নিয়ে আসে, যা মানুষকে নতুন করে পথ চলতে শিক্ষা দেয়। এ উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে সপ্তম পরিচ্ছেদে। মিসেস চৌধুরীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত অপূর্ব ও মালবীর জীবনে এক নতুন চেতনা এসেছে। অপূর্ব চেয়েছিল নতুন করে উপন্যাস লিখবে। শিল্পীর জীবনও যেন এক উপন্যাস। সেই আত্মকেন্দ্রিকতাকেই সে ধরতে চেয়েছিল। লেখক অচেতনে সেই প্লটই যেন দিয়ে গেলেন। অপূর্ব ও মালবীর নতুন বিবাহ, মধ্যবিত্তের সংসার, সেখানে আশা- আকাঙ্ক্ষা আছে। মনোজ হঠাৎ নিয়ে আসে মৃত্যু সংবাদ। শেষ পরিচ্ছেদটি গড়ে উঠেছে মিসেস চৌধুরীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে সবার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। লেখক নিভৃতে থেকে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কয়েকটি মানুষের ( অপূর্ব, মালবী, মনোজ, বিমলকৃষ্ণ ) চেতনায় যে বিবিধ আলোড়ন তা দেখিয়েছেন। স্মৃতির সঙ্গে বাস্তবের কোন সম্পর্ক নেই। সেই বাস্তবকে সামনে রেখেই সবাই গেছে স্মৃতিচারণায়। জীবনের পথে চলতে গেলে সব সত্য প্রকাশ করা যায় না।
কবিতার শত্রু মিত্র ** : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : বই পছন্দসই | ২৬ জুন ২০২২ | ১৭৩৪ বার পঠিত
এ এক সাংস্কৃতিক বয়ান। সমাজ পরিবেশ পরিস্থিতি সহ গত শতকের সাতের দশকের উত্তাল আবহ, সময়ের জটিলতা, রাজনীতি ও ব্যক্তি মানুষের দ্বিরালাপ। কবিমনের অনুভূতিতে সব দেখা-বোঝা-জানা। আবেগ রোমান্টিসিজম বলতে বলতেই জীবনের ভিতরে, সময়ের ভিতরে উঁকি ঝুঁকি দেন। কেন এই আখ্যান লেখার প্রয়োজন হল এই কুজ্ঝটিকাপূর্ণ সময়ে? কবি তার দায়বদ্ধতা থেকে সরে এসেছেন। কেন কবিতা লিখি এই বয়ানে বিবিধ জবাবদিহি উঠে আসে। ভালোলাগা, আনন্দ দান, কাজ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কবিতাই তো দেশকে, মানুষকে পথ দেখাবে। কবির সেই সমাজচেতনা, দায়বদ্ধতা অস্তগামী হয়েছে। জীবনের বেলাভূমিতে কবিতা কোন পথে যাত্রা করবে? বিষাদময় সময়ে, সন্ত্রাসের পটভূমিকায়, রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে কবি ও কবিতা কতখানি গ্রহণযোগ্য তার হিসাব নিকেশের পক্ষ-বিপক্ষের আখ্যান ‘নতমুখ চরাচর’।
যে গল্প বিশ্ব জয় করে এলো : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : বই কথা কও | ২০ নভেম্বর ২০২২ | ১৭৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
গাঁওবুড়ো এক যাত্রাপথের গল্প। বলে যেতে পারে হাঁটার গল্প। হাঁটতে হাঁটতে সুখ অনুসন্ধানের গল্প। সুখ এখানে বিভ্রম। কিন্তু সন্ধানটা জরুরি। যে সন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সুখের স্বপ্ন দেখায়। মানুষ তো সুখের সন্ধানে বাঁচে। সমস্ত প্রাপ্তির মধ্যেও আরেকটু সুখ বা সমস্ত অপ্রাপ্তির মধ্যেও সামান্য সুখের সন্ধান করে। ‘গাঁওবুড়ো’ তেমনই এক গল্প যেখানে বিভ্রমকে সামনে রেখে বিভ্রমের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করে জনপদ জীবনের চরম অর্থনৈতিক অস্বচ্ছন্দতার নিত্য নৈমিত্তিক দিনলিপি। রাঙা পথের জীর্ণ চিত্রে জার্নির ক্লান্তিতে মেঠো সুরে ব্যক্তি ও সমষ্টির ব্যথিত কোলাহল সহ রূপহীন-রংহীন মানুষের সমস্ত না পাওয়া ও পথের দিকে চেয়ে থাকার উদাসীন সোপান। যে ভূগোলে কিছুই নেই, যেখানে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে মানুষ বাঁচে-স্বপ্ন দেখে, সেখানে কেউ কেউ অলীক জাল রচনা করে আরও দুই মুহূর্তের স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে যায়, ‘গাঁওবুড়ো’ সেই স্বপ্ন হাতছানির গল্প।
সর্বনামই যেখানে নাম হয়ে উঠতে পারে : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : মনে রবে | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫৮০ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
জীবনের অন্ধকারমালাই সুবিমলের পাঠক্রম। খুন, জখম, সন্ত্রাস, ধর্মীয় বিভেদ, বিস্ফোরণ, পুলিশি অত্যাচার অন্যদিকে যৌনতার নন্দনকানন। যৌন মিলনের যে পরম তৃপ্তি তা নারী-পুরুষ উভয়ই ভোগ করে কিন্তু পরক্ষণেই জাগে সামাজিক গ্লানি। এই দ্বন্দ্বই সুবিমলের টার্নিং পয়েন্ট। কেন জাগে পাপবোধ? কেন দঃশিত হয় নরনারীর সামাজিক বোধ, কেন স্বীকার করে না পরকীয়া? কেন মেনে নেয় না জীবনের স্বাভাবিক দাবিকে। এই যে সেক্স করা ও তাকে সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি না দেওয়া এই আলো অন্ধকার নিয়ে তিনি আখ্যানের ভেলা ভাসান। এমনকি তিনি মারাত্মক ভাবে চেতনার গান বাজান। তা বিপ্লব হোক বা মধ্যবিত্ত বিবেক হোক। চেতনা না থাকলে নতুন জোয়ার সম্ভব নয় তা কেবল আয়োজন সর্বস্ব। অথচ আজ আয়োজন সর্বস্ব পরিমণ্ডলের রমরমা। উৎসবের ফানুস উড়িয়ে চেতনাহীনতার মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির যে ডাক তা যে যথার্থই ভিত্তিহীন তা তিনি প্রয়োগ করে দেখান। সমাজের বিবিধ স্তরের বয়সের নারীর দৈহিক চাহিদাকে সামনে রেখে নারী মনস্তত্ত্বের নিপুণ বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হন। এত বড় সমাজ, এত বড় পরিমণ্ডল, এত শ্রেণি, বয়স বিভাজনে সকলেরই কম বেশি যৌনতা আছে। তার নানা রকমফের প্রক্রিয়া, চাহিদা, সম্পর্ক। বেশিরভাগই আড়ালে আবডালে। বিভাজনোত্তর সমাজে নারী পুরুষ পারিবারিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে আড়ালে মিলিত হয়েছে। কোথাও ক্লেদ নেই, গ্লানি নেই। আছে এক তৃপ্তির আনন্দ। তার বহুবিধ বয়ান নিয়ে এই আখ্যান। ভাষা আগ্রাসন থেকে জাতি খণ্ডীকরণ, বাঙালির হুজুকে প্রবণতা থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শূন্য অবয়ব কোন কিছুই নজর এড়িয়ে যায় না। জগাখিচুরি হিন্দি, ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির আদ্যশ্রাদ্ধ, পক্ষ-বিপক্ষে কোন্দল, সংস্কৃতির নষ্টচরিত্র, আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি মিলিয়ে দিনের আলোর পরিমণ্ডলের উপর সুবিমল বুলডোজার চালান নিজস্ব ভঙ্গিতে।
অসুখবেলার পাণ্ডুলিপি : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : বই পছন্দসই | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ৭৩০ বার পঠিত
কোভিড, বিধ্বংসী ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বইপাড়ার বিবরণ ‘মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ২০২০’ আখ্যানে এসেছিল। বাঙালি যত আধুনিক হল, যত অর্থবান হল, বিনোদনের নানা উপকরণ পেতেই বই ত্যাগ করল। মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিপ্রবণ মানুষ কেউ কেউ বইকে আঁকড়েই বাঁচতে চাইল, স্বপ্ন দেখল। বাড়ি গাড়ি ভোগবাদের আতিশয্য বিসর্জন দিয়ে কেউ বাইরে মত্ত হল। ভোগবাদে ভেসে যাওয়া, ক্ষমতার অন্দরমহলে থাকা মানুষ বইকে অবহেলা করতে শুরু করল। বিমলের প্রতি অখিলের মনোভাবের মধ্য দিয়ে লেখক কালের ধ্রুব সত্যের তরঙ্গমালা এঁকে চলেন।
গল্পসমগ্র’ (২০২২) প্রথম খণ্ড (উপল মুখোপাধ্যায়) : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : বই পছন্দসই | ২২ এপ্রিল ২০২৪ | ৯৪১ বার পঠিত
বিজ্ঞাপনের মোহিনী মায়া, সংবাদের আলো-আঁধারি ভাষা, কুঞ্ঝটিকা, বাজার ধরার কৌশল সমস্ত মিলিয়ে যে ফাঁদ তার প্রগাঢ় ভাষ্য উপল নির্মাণ করে নেন। সেই নির্মাণে গপ্প হিসেবে উপলকে অনেক সময়ই বাস্তবের আড়ালে চলে যেতে হয়। বাস্তবকে ধরে অপ্রচ্ছন্ন বাস্তবের প্রতিমূর্তি গড়ে তোলেন। সেই অপ্রচ্ছন্ন বাস্তবের ছায়ামূর্তির মধ্যেই বাস্তবের প্রতিমা লুকিয়ে আছে। সেখানে পাঠক বাস্তবকে আবিষ্কার করবেন বা প্রত্যাখ্যান করে অধিবাস্তবের স্বরকে দেখবেন সেটা পাঠকের প্রত্যাশার উপর ছেড়ে দেন। পাঠকের ভাষ্যে তা শিল্প হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সেসব নিয়ে উপলের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি শিল্প বা না-শিল্প বৃত্তের ভাবনায় পাঠককে যে মাতিয়ে রাখতে পারেছেন সেটাই তাঁর সার্থকতা। হ্যাঁ তিনি রীতিমতো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যান। গদ্যসেতু ধরে ভাবনার তরঙ্গ বিচ্ছুরণে পাঠকের মস্তিষ্কে একাধিক বিরোধাভাসের জাল বুনে দিতে চান। সেখান থেকে পাঠক বাস্তবের সত্যে ফিরুক বা বাস্তবকে অস্বীকার করে শিল্পের সত্য বুঝে নিক।
পচা চালকুমড়োর ছাঁচে গড়া সমাজকে ভেঙে ফেলার পদকীর্তন : পুরুষোত্তম সিংহ
বুলবুলভাজা | পড়াবই : মনে রবে | ১৯ আগস্ট ২০২৪ | ৫৩০ বার পঠিত
দেবজ্যোতি রায় গল্প, গপ্প, কাহিনি, ছোটোগল্প কিছুই লিখতে চাননি। তিনি একটি দর্শন রচনা করতে চেয়েছেন। তিনি একটা নিজস্ব গদ্যসরণিতে হেঁটে যেতে চেয়েছেন। যে পাঠক গদ্যসরণি, অস্তিত্বের আত্মখননে আসতে চান তাকে স্বাগত, যে চান না তাকে সদম্ভে নিকুচি করা। তিনি কোনো লক্ষে পৌঁছতে চাননি। অস্তিত্বের জায়মান অন্ধকারে যে বিদ্রোহ, আত্মগ্লানি, সংশয়, যৌন পিপাসা, বিভ্রান্ত প্রবণতা, সংস্থিতির অহমিকা, মরবিড, অ্যাবসার্ড তাই দেখাতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্ত মেকিবোধের সমূল উৎপাটন ঘটাতে চেয়েছেন। ফলে তাঁকে নেমে যেতে হয়েছে অন্ধকারের জগতে। সভ্যতার জাতীয় সড়ক দিয়ে না গিয়ে জাতীয় সড়কের আশেপাশে যে অলিগলি, যেখানে মানুষ আত্মত্রাণের জন্য নীরবে অবস্থান করে অথবা নিজের চাহিদা-পিপাসা মেটাতে গোপনে প্রবেশ করে সেই বন্ধ দুয়ারে প্রবেশকের তালাচাবির আবিষ্কারক তিনি।