মহাযুদ্ধের পটভূমি : অনিল ঘোষ
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : উৎসব | ০৯ নভেম্বর ২০২০ | ৩৮৫৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ১৩
চলার গতি বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে কোমরের দুলুনি। ওই দুলুনি জল বাঁচানোর জন্য। জল, খাবার জল। এই সোঁদরবনের গাঁ গেরামে বড়ো মহার্ঘ এই জল। কেউ একফোঁটা খরচ করে না অকারণে। করতে নেই। কেননা জল এখানে মাথা কুটলেও মিলবে না কোথাও। কেমন মজা বোঝো! মজাটি নিয়ে শরিফা আর ওর মিতেনি জীবন ঢালির বউ নেকি এক সময় খুব হাসাহাসি করত। জলের দেশের মেয়ে ওরা। জলের অভাব ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। মুখে বলেও, ধুস তাই আবার হয় নিকি! ভাত নি, কাপড় নি সে তো বুঝি, তা বলে পানি নি!
শরিফার স্বামী ময়জুদ্দি হেসে বলে, হয় হয়। এটাই তো মজা র্যা। সোঁদরবনে পানি আছে, তবে লোনা, খাবার পানি খুব কম।
হ্যাঁ, দেখেছে শরিফা, উলার চকে আট-আটটা টিউকল বসল। পানি উঠল বালি গোলা। খাওয়া দূরে থাক, মুখে দিলে ওয়াক থুঃ। পুকুরের পানি! সে তো তিন-চার মাস। খেলে পেটে ঘা হয়। বলে আর্সেনিক। তবে পানি কোথায়! হুই ডাঁসা নদী পার হও। ভবানীপুরে ডিপ টিউকল করেছে পঞ্চায়েত। সেখান থে পানি নে এসো। কিন্তু যাবে কীভাবে? বড়ো বাধা যে নদী। ছোটো-বড়ো নাও যা আছে, সব মাছ মারতে যায় বাদায়, চালানি যায় হাসনাবাদে। দু-একখানা নাও যা আছে, সেখানে ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। কলসি-বালতি পিছু এক টাকা, নগদা-নগদি। টাকা দাও আর পানি নাও। কার আছে পয়সা! উলার চকের মানুষের চাষবাসের উপর জীবন। ছ-মাস কাজ, বাকি সময় জোন খাটো, নাও চালাও নয়তো বিশপুরের হাটে মাল বও। না হলে উঞ্ছবৃত্তি করে চালাও। তাই পানি নিয়ে চলে টানাপোড়েন। কখনও মারপিট, মেয়ে হলে ইজ্জতের উপর হামলা। অনন্ত ঢালির বউ আয়না এক কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে শরীরের রং ঢং দেখিয়ে মাঝিদের বশ করে পানি আনত। কিন্তু রসিক মাঝি সেয়ানা খুব, সুযোগ বুঝে একদিন হামলে পড়ল ওর উপর। আর আয়নাও তেমনি৷ ইজ্জত বাঁচাতে দিল হালের বাড়ি কষিয়ে। এক ঘায়ে কাত রসিক। আয়না এখন জেলে। ওর রুগ্ন ছেলেটা মা মা বলে উলার চকের আকাশ বাতাস ভারী করে চলেছে।
তিরিশে সেপ্টেম্বর : অনিল ঘোষ
বুলবুলভাজা | ইস্পেশাল : নববর্ষ | ১৫ এপ্রিল ২০২১ | ২০৮০ বার পঠিত
সাম্য অনেক বিষয়ে গল্প লিখেছে, কিন্তু দাঙ্গা বা সম্প্রীতি নিয়ে একটিও নয়। নয় মানে লিখতে পারেনি। লিখবে কী, আজ পর্যন্ত দাঙ্গার সঙ্গে ওর প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি। খুব ছেলেবেলার একটা দৃশ্য ওর মনে আছে। ওরা যে শহরে থাকে, সেখানে হঠাৎ কী কারণে যেন গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। কী গণ্ডগোল, কোথায় হচ্ছে-- এসবের কিছুই জানা নেই সাম্যর। ও দেখল ওর বাবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছবি। বাবা অফিস কোয়ার্টারের সিঁড়ি বেয়ে একবার উঠছেন, আবার নেমে আসছেন উদ্বিগ্ন মুখে। একটা আতঙ্কের পরিবেশ যেন। ওই ছোটোবেলায় এসব বোঝার কথা নয় ওর। বোঝেওনি। বাবার ওই সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামার মধ্যে কেমন মজা পেয়ে গিয়েছিল। আজও যখন দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে, তখনই চোখে ভেসে ওঠে সেই সিঁড়ি ভাঙার দৃশ্যটা। এরপর দাঙ্গার সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে। সেই ৬ ডিসেম্বর সাম্য ছিল স্বরূপনগরে, থানার উদ্যোগে একটা যাত্রা উৎসবে। সন্ধের সময়ও জানে না কী ঘটনা ঘটে গেছে দূরে অযোধ্যা নগরীতে। থানার ও সি পরিচিত। তিনি যেন কেমন অস্থির ছিলেন। মুসলমান অধ্যুষিত স্বরূপনগরে সেদিন ব্রজেন দে-র বাঙালি পালা খুব জমেছিল। হিন্দু-মুসলিম শিল্পীরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভেরী বাজিয়েছিলেন রঙ্গমঞ্চে। মাঝরাতে সাম্যরা ফিরেছিল। রাস্তায় দেখেছিল যাত্রা ফেরত মানুষেরা ফিরে যাচ্ছে গল্প করতে করতে। তাদের মধ্যে হিন্দু ছিল, মুসলমানও ছিল। ইছামতী নদী পার হয়ে শহরে যখন প্রবেশ করল, তখনই আতঙ্কের সঙ্গে ওর পরিচয় ঘটল। মোড়ে মোড়ে পুলিশ। সাম্যদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসছেন, কী ব্যাপার ইত্যাদি। এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিল সাম্য। আতঙ্কের পরিবেশে মানুষের স্বাভাবিক আচরণের গল্প। এই স্বাভাবিকতা যেন দাঙ্গার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ।
তবু সেখানে দাঙ্গা ছিল না। চেষ্টা করেও লিখতে পারেনি সাম্য। এখন যেন সেই সুযোগ এসে গেল সাম্যর।