'Manufacturing Consent'
-উপরিউক্ত term টির প্রথম প্রবক্তা নোয়াম চমস্কি। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বই 'Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media' তে তিনি প্রথম এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক শব্দবন্ধটির উল্লেখ করেন। এর মানে কী? বা কেনই বা এটি প্রাসঙ্গিক আজকের রাজনৈতিক আবহে, সেটি সংক্ষেপে বর্ণনা করাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।
গত ৪ মে, ২০২৫, আনন্দবাজার পত্রিকাতে প্রথম পাতায়, একটি খবর প্রকাশিত হয়, খবরটির হেডলাইনটি ছিল এরকম,
'শিল্পে উৎসাহ ছাড় প্রত্যাহার করল রাজ্য'।
(খবরটির লিঙ্ক দ্রষ্টব্য, সেখানে আরেকটি লাইন যোগ করা আছে ''নেপথ্যে কোন কারণ?"। যদিও খবরের কাগজের হেডলাইনে এই অতিরিক্ত প্রশ্নটি নেই। বিশেষ প্রযুক্তিগত কারণে খবরের কাগজের ছবি এখানে দেওয়া গেলো না। নিজেরা দেখে নিতে পারেন। )
হেডলাইনটি পড়ে বা খবরটির প্রথম ৪০-৫০% পড়ে কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে না, সেই চিরাচরিত ব্যাপার যে এই রাজ্যে শিল্প নেই, হবেও না, শুধু লক্ষ্মীর ভান্ডার আর ভাতার রাজনীতি হবে?
মনে হচ্ছে না যে এই সরকার এতই বেশি শিল্পবিরোধী যে পুরনো যেসব শিল্পসহযোগী নীতিগুলি ছিল, সেইগুলোকেও এই সরকার বাতিল করে শুধু টাকার রাজনীতি করতে চায়?
বেশিরভাগ মানুষ খবরের কাগজের শুধু হেডলাইন পড়েন, পুরো খবর পড়ার ধৈর্য বা সময় কোনোটিই তাঁদের নেই। তাই, তাঁরা এরকম খবর পড়ে রাজ্যসরকারের প্রতি যে রাগে জ্বলে উঠবেন, এটিই স্বাভাবিক।
কিন্তু, আমি নিজে আরেকটু রিসার্চ করলাম, Lexology নামে একটি ওয়েবসাইটের সন্ধান পেলাম, যেখানে প্রধানত আইনসংক্রান্ত বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়। লিঙ্ক শেয়ার করা আছে নিচে।সেখানে, প্রথিতযশা আইনের ফার্ম Fox Mandal গত ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫, উপরিউক্ত বিষয় নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন লিখেছে। তাদের প্রতিবেদনে পুরনো নীতি বাতিলের সাথে আরও অতিরিক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা আছে, যেটার জন্য পুরো খবরটির তাৎপর্যই পালটে যায়।
প্রতিবেদনটির হেডলাইনঃ 'Bengal to Scrap Old Industrial Incentives, Eyes Modern Approach'
অর্থাৎ, বাংলা পুরনো শিল্প উৎসাহ ছাড় প্রত্যাহার করে শিল্পনীতির আধুনিকীকরণের দিকে এগোচ্ছে।
প্রতিবেদনের সেই অতিরিক্ত জায়গাটি তুলে দিলাম,
"The state government is reportedly adopting a modern approach to encourage the setting up of industrial units, in light of ongoing advancements in AI technology and the emergence of new industrial strategies. A committee headed by the Chief Secretary has been constituted to submit its recommendations within a month, based on which the new scheme will be designed."
অর্থাৎ, রাজ্য সরকার নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য আধুনিক পদ্ধতি বা নীতি আনতে চলেছে, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে। এর জন্য মুখ্যসচিবের তত্ত্বাবধানে একটি কমিটিও
গঠন করা হয়েছে, যারা এক মাসের মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা করবে, এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে নতুন শিল্পনীতি তৈরি হবে।
অর্থাৎ, নতুন শিল্পনীতি আনার জন্যই পুরনোটি বাতিল করা হয়েছে। মানে রাজ্য সরকার আরো বেশী শিল্পোদ্যগী হয়ে শিল্পনীতির আধুনিকীকরণ করতে চলেছে।
অথচ, আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে বেমালুম এই তথ্য চেপে গেছে, শুধু ভেতরে এক জায়গায় লিখেছে, "যদিও নবান্নের বক্তব্য, আরও উন্নত এবং সময়োপযোগী শিল্পনীতি সামনে আনবে রাজ্য। তাতে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের পথ আরও সুগম হবে।" যেন, এটাও একটি রাজনৈতিক বক্তব্য, যেটা অনেকে পড়বে না বা পড়লেও বিশ্বাস করবেনা, কারণ তাদের মনে হবে শুধু এটিই নবান্নের বক্তব্য, আর বাকিটা বিরোধীদের থেকে জানা গেছে।
এখানে আনন্দবাজার পত্রিকা যেটি করছে, সেটিকেই বলে consent manufacturing. মানে, কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেপে রেখে বাকি তথ্য এমনভাবে প্রকাশ করা, যাতে সম্পূর্ণ উল্টো একটি সিদ্ধান্তে পাঠক উপনীত হয়। যেমন, আমাদের আপাতভাবে মনে হচ্ছে, রাজ্য সরকার ভোটের আগে ভাতার রাজনীতি করার জন্যই শিল্পে উৎসাহ ছাড় প্রত্যাহার করেছে, নতুন শিল্প আনার জন্য তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, যেখানে বাস্তব ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো, রাজ্য সরকার আরো বেশী শিল্পোদ্যগী হয়ে শিল্পনীতির আধুনিকীকরণ করতে চলেছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাজারি সাংবাদিকতার কারণে প্রতি মুহূর্তে আমরা এইরকম consent manufacturing এর শিকার হচ্ছি এবং, আমাদের চিন্তাভাবনাকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক জনমত তৈরি করার জন্য। এক্ষেত্রে শুধু মুদ্রিত গণমাধ্যম নয়, সামাজিক এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের দ্বারাও আমরা প্রতিনিয়ত এই অবস্থার শিকার। তাই আমাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং কোনো খবর দেখে বা পড়ে বিতর্কিত মতামত তৈরি করার আগে সেই খবরটির যথার্থতা বা পরিপূর্ণতা বারবার যাচাই করে নিতে হবে বিভিন্ন আলাদা নিরপেক্ষ source থেকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।