এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোটো গল্প (পুরোনো লেখা)

    sangeeta das লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মে ২০২৫ | ১৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কাজুর আম্মু
    --------------
    সংগীতা
    --------------
    ঠা ঠা রোদে ইঁটের পাঁজার উপর বসেছিল বছর বারোর কাজু। বাস রাস্তাটা এখান থেকে দেখা যায়। আব্বু সাইকেল চালিয়ে ফিরলে ও এখান থেকেই দেখতে পাবে। দেখলেই পাঁই পাঁই ছুট লাগাবে ও। সাইকেলের সামনের রডে বসে বাড়ি। অবশ্য যদি আব্বু সাইকেল চালানোর ক্ষমতায় থাকে আজ। দিনটা আজ ভালো নয় কাজুর। খুব মার খেয়েছে নতুন আম্মুর কাছে। কপালের কাছে নরম হালকা বাদামি চুল ঘামে লেপটে আছে বটে কিন্তু তার তলায় একটা ছোট্ট সুপুরির মতো ফুলে আছে। দুটো থাইতেই লাল দাগ ফুলে উঠেছে, পেয়ারা গাছের ডালের বাড়ি যা শপাং শপাং চালিয়েছিল, বাব্বাঃ। মার খেলেই বুকের ভিতর ধড়ফড় করে কাজুর, মাঝে মাঝে এত জোরে, যে দৌড়ে পালাবার শক্তি থাকেনা। তখন পড়ে পড়ে মার খেতে হয়। অবশ্য, মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে নতুন আম্মু নিজেই অন্য কাজে চলে যায়। তখন খরখরে মেজেয় শুয়ে থাকে কাজু। শুয়ে শুয়ে কাঁদে, চোখ থেকে নাক বেয়ে ঠোঁটে এসে পড়ে নমক পানি, তারপর একসময়ে শুকিয়ে খরখরে হয়ে যায়। তখন নিজের আম্মুর আদর, আঁচল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দেওয়া, সন্ধেবেলার পেঁয়াজি ভাজা খাওয়া, স্নান করিয়ে দেওয়ার কথা বারবার মনে পড়তে থাকে কাজুর। ব্যথা লাগলে আগে আগে খুব কষ্ট হতো কাজুর। এখন আর হয় না। বরং কাঁদতে কাঁদতে নিজের আম্মুর কথা ভাবতে ভাবতে, ঘুমিয়ে পড়লে, খিদে-টিদে আর বোঝা যায় না, দিব্যি কেটে যায় দুপুরটা।

    দুপুরে মর্জিনা খালুর বাড়িতে যায় আম্মু। খালু পান - দোক্তা সেজে দেয়, পিঁড়িতে বসতে দেয় আম্মুকে, নতুন নথ নেড়ে নেড়ে খুব গল্প করে আম্মু। কাজু বেড়ার পিছন থেকে লুকিয়ে দেখেছে, তখন আম্মুকে দেখতে খুবসুরত লাগে। যেদিন আব্বু দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে আসে ভাতটা জুটে যায় কপালে। তারপরেই ছ'মাসের বোনটাকে ধরে বসে থাকতে হয় দাওয়ায়। আব্বু-নতুন আম্মু দরজা ভেজিয়ে ঘুমোতে চলে যায়। তখন কাজুর কাউকে ডাকা মানা। সারা দুপুর নাল-কাজল লেপটালেপটি নাক বোঁচা গুড়িয়াকে কোলে করে নিয়ে বসে থাকতে হয় কাজুকেই। বোন কাঁদলে, সন্ধ্যেবেলা কপালে মার জুটবে, আব্বু তখন আড্ডা দিতে যায় দোস্তের বাড়ি।

    অবশ্য মার জোটে নতুন আম্মুর কপালেও। খুব বেশী নেশা করলেই আব্বুর মাথার ঠিক থাকে না। তখন চুলের মুঠি ধরে থাপ্পড় মারে নতুন আম্মুকে।

    কাজুর নিজের আম্মু, জ্বর হয়ে হুট করে মরে যাওয়ার পরেই এই আম্মুকে নিয়ে এসেছিল আব্বু। তখন এত মারতো না নেশা করেও। কিন্তু ইদানিং আব্বুর মেজাজ খারাপ, নতুন আম্মুর সাথে বনি বনা হচ্ছে না। নতুন আম্মু নাকি 'ঢলানি মেয়েছেলে'। মর্জিনা খালুর বাড়িতে যায় খালেদ চাচার সাথে আশনাই করতে। শোনে কাজু, মানে বুঝতে পারে না। তবে, নতুন আম্মুকে মারলে ওর মজা লাগে ! ওকে তো কথায় কথায় জুতোপেটা, লাঠিপেটা করে, তখন কেমন লাগে ! আজকে তাই কাজু রাস্তায় এসে অপেক্ষা করছে। আব্বুকে এখনই বলবে, তারপর মজা দেখাবে আজ।

    হলোও তাই। সহিদুল মোল্লার আজ মেজাজ খারাপ ছিলো আগে থেকেই। নতুন কাজের বায়না পেয়ে মাল-মশলা কিনতে গেছিল নতুন-বাজারে। সেখানেই খালেদ এসেছিল। খুব চেঁচামেচি করে গেছে, হুমকি দিয়ে গেছে সহিদুলকে। বুকের ভিতরটা অপমানে, রাগে পোড়া কয়লার মতো ধিকিধিকি জ্বলছিল। তার উপর এই চাঁদিফাটা রোদ। কাজুর গায়ে মারের দাগগুলো আরো উসকে দিলো মনের আগুনটা। দাওয়ায় পা দিয়েই এক লাফে চুলের ঝুঁটিটা ধরলো নতুন বিবির। তার পর চড়, কিল, ঘুষি, লাথি - ভাগ্যিস বোনটা শোওয়ানো ছিলো ঘরে। বোনকে কোলে নিয়ে মার খাওয়া দেখতে লাগলো কাজু। মার-টার শেষ হলে, ঘর থেকে দুর হয়ে যেতে বলে, সহিদুল দরজায় একটা লাথি মেরে বেরিয়ে গেল যখন, কাজু তখনও দাঁড়িয়ে আছে। খুব আস্তে আস্তে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো নতুন আম্মু, তারপর আঁচল লোটাতে লোটাতেই ঘরে চলে গেল। আধঘন্টাটাক দাওয়ায় অপেক্ষা করে ঘরে উঁকি দিলো কাজু। খরখরে মেঝেতে শুয়ে আছে আম্মু। খুব কেঁদেছে। চোখের কাজল গালে নেমে এসেছে। মুখটা শুকনো, এদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে ইশারায় ডাকলো কাজুকে। প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল কাজু ! এই সময় সামনে গেলে তো আবার মার জুটবে কপালে। কিন্তু উপায় নেই, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কাজু। আম্মু উঠে বসেছে। গালে লেগে আছে পানির দাগ। কাজুকে অবাক করে দিয়ে ওর মাথায় হাত দিলো আম্মু, হাসলো। বললো - "খুব লেগেছে, নারে?" কেন কে জানে, চোখে পানি এলো কাজুর! গলাটা আটকে গেল কেমন। মাথা নেড়ে বললো - "না, এখন ব্যাথা হচ্ছে না"।

    আম্মুর শুকনো মুখে হাসি দেখলো এবার। বোনকে কোলে নিয়ে বললো - "পুঁইশাকের তরকারি আচে, চিংড়ি মাচ দিয়ে। ভাত দিই চল।"
    কোনমতে মাথা নাড়লো কাজু। দাওয়ায় বসে ছোট্ট থালায় ভাত খেতে বসলো যখন, আম্মু বসলো সামনে। হাঁড়িকুড়ি একটু নেড়েচেড়ে, বললো - "শুদ্দু মার খেয়ে মরিস আমার কাচে। আর খাবিনেকো। থাকপো না একেনে। চলে যাপো। বাপটারে দেকিস।"
    হাত থেকে ভাতের দলা পড়ে গেল কাজুর ! একটা অন্ধকার, খালি ঘর, বিছ্না চোখের সামনে ভেসে উঠলো যেন। আম্মু মারা যাবার পর, এরকমই অন্ধকার ঘরে, ঠান্ডা বিছানায় ভয় গিলে নিয়ে বসে থাকতো কাজু। ভাতে জল ঢেলে, দাওয়ায় এসে বসলো কাজু।
    বেশ রাত্তিরে, বেড়ার দরজা ঠেলে যখন সহিদুল ঢুকলো, তখনো ভূতের মতো বসে আছে কাজু। ঘরের কোথাও কোন আলো, আওয়াজ কিচ্ছু নেই। ছেলের পাশে এসে বসে পড়ে সহিদুল। হাত রাখে কাজুর পিঠে। নরম স্বরে বলে - "ব্যথা আছে ? বাপজান"
    আর তখনই চীল চীৎকার করে ওঠে কাজু। রিনরিনে গলায় বলে ওঠে, "কেন মারবা তুমি আমার আম্মুকে? কেন চলে যাবে আম্মু? আম্মু কোথ্থাও যাবে না! আমায় মারে তো কী? বেশ করেচে, মেরেচে! আমার আম্মু, আমাকে মেরেচে, বেশ করেচে।" হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে কাজু।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন