এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ডিলান-ঠাকুর

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৯২ বার পঠিত
  • অদ্ভুত অন্ধকারে বসে আছি। আমার পাশে ডিলান। আমরা দুজনেই গাঢ় অতল অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে নীরব হয়ে আছি অনেকক্ষণ! চির অস্থির কালপ্রবাহের ধারে স্ববিরোধী মানুষের উন্মুক্ত অঙ্গন! কোপাইয়ের ধার থেকে,কিংবা অন্ধকারের উৎস থেকে ঠিকরে পড়ছে কীর্তণ-শব্দ! আর্তি! আরাধনা! সঙ্গীত। হাজার বছর আগে এক নিগ্রো কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো কথা ছুঁড়ে দিয়েছিল। সঙ্গীত ভূমিষ্ঠ হয় সেইদিন! সেইদিনই সঙ্গীতের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা! নিরন্তর যাত্রা! ডিলান জানেন সঙ্গীতের সময় আত্মা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়!

    আজ রবি ঠাকুরকে খুব মনে পড়ছিল। এই ভয়ানক একাকীত্বে রবি ঠাকুরই জলসাঘরের ভৃত্য অনন্তর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন হাতে বাতি নিয়ে। বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মজিছে, গানটা গুনগুন করতে করতে হঠাৎ মনে এলো জীবনের বিগত বিহান আলেখ্য! ট্রেনটা আচমকা হুইসেল দিয়ে যতো এগিয়ে যাচ্ছিল ততো পিছিয়ে যাচ্ছিল প্লাটফর্ম, প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মা-বাবা, আমার গোটা ছেলেবেলা হাত নাড়তে নাড়তে অদৃশ্য হয়ে গেল একসময়। সেই প্রথম ঘর ছাড়া। ট্রেনের কামরায় একলা গুমরে থাকা মন, বাইরে তুমুল বৃষ্টি! তারপর উড়নচন্ডী কলেজজীবন। রাঁচির কুসুমবিহার গলি, ভয়ানক গ্রীষ্মে বরফকামী হৃদয়, জানলা দিয়ে ধূসর মুরগা মুরগীর পাহাড়। হঠাৎ কালবৈশাখীর মতো একটা গান ঝাপটা দিয়েছিল মুখে!!!!

    The times they are a changing...

    ঘরের পর্দা গুলো ওড়া বন্ধ করল। ফিঙে পাখিটা নিরুদ্দেশ হল। আমার ঘরে প্রথম আমি বারুদের গন্ধ পেলাম। আমার পাশবালিশ, বেসিন, অ্যাশট্রে, আয়না - সবাই বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল হঠাৎ! জ্যোতি ঠাকুরের পাহাড়টার মাথায় চেপে তখন রবিবাসরীয় যাপন। কফি মাগ আর কিছু ধাতব শব্দ!!

    The line it is drawn
    The curse it is cast
    The slow one now
    Will later be fast
    As the present now
    Will later be past
    The order is rapidly fadin'
    And the first one now
    Will later be last
    For the times they are a-changin'

    কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সব। এই প্রথম সুরকে ছাপিয়ে কথার নেশায় পড়লাম। তখন ডান হাতে রবীন্দ্রনাথ, যিনি পুড়তে পুড়তে আগুনকেই মহিমান্বিত করেছেন বারবার, আরেক হাতে ডিলান, যিনি মৃত্যুঘোর রণদীর্ণ সময়ে গিটার দিয়ে ভাঙছেন কনভেনশন। জ্যোতি ঠাকুরের পাহাড়ে অন্ধকার নেমে আসত। কফিও শেষ হয়ে যেত। অগত্যা ঘরের বিছানায় লেপ্টে থাকা! মধ্যরাতের মধুশালায় বিষ ঢেলে দিতাম গলায়। পাশে এসে বসতেন ডিলান। আজ যেমন বসে আছেন। প্রথম শোনালেন,

    How does it feel, how does it feel?
    To be without a home
    Like a complete unknown, like a rolling stone

    আহ ঈশ্বর! ডিলানকে কি সুন্দর দেখতে!! এলোমেলো চুল, নীল চোখের যুবক! প্রলয়ের পদাবলী শোনানো মানুষ গুলো এরকম ছটফটে হয়! ডিলান আমায় বৃক্ষ চিনিয়েছেন, সেই বৃক্ষের ইতিহাসের দিকে চোখ মেলতে শিখিয়েছেন। বৃক্ষ!

    কত উথালপাথাল ইতিহাস আমাদের আজ এই অন্ধকারে নিয়ে এসেছে ডিলান! অভিন্ন প্রলয় আমাদের কেশেবেশে মাতামাতি করছে দিনরাত! কত উন্মাদ কল্লোল পেরিয়ে তিরতিরে পাহাড়ি নদীর মতো বেজে উঠেছিল তোমার হারমোনিকা!! মানুষ তো বন্ধ দরজার সামনে প্রতীক্ষারত, দরজা খুললেই স্বর্গ।

    It's getting dark, too dark to see
    I feel I'm knockin' on heaven's door

    জনাকীর্ণ ম্যালের সামনে গিটার হাতে এক যুবক গাইছিল সাংঘাতিক একটা গান। দর্শকরা পাহাড়ি হাওয়ায় দুলছিল। আমার মনে আছে সব। আস্তাবলের ঘোড়াগুলো ঝিমোচ্ছিল। বাহ্যের পচা গন্ধ মিশছিল বাতাসে! ঝকঝকে পাবটায় টেবিলভরা বৈভব। টুংটাং গ্লাসে গ্লাস! হাসি, খেলা, বেলুনের মাঝখান দিয়ে স্থাণীয় বৃদ্ধা বোঁচকা পিঠে জল আনতে নেমে যাচ্ছিলেন অনেক নীচে। আমার সবটা স্পষ্ট মনে আছে। খয়েরি ছেঁড়া সোয়েটার পরে ভিখারী শিশু প্রত্যাখ্যাত হতে হতে বড় হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ! ডিলান, তুমিও ছিলে সেখানে। তুমি তো জানোই প্রশ্ন গুলো সহজ, আর উত্তর তো জানা... আমার কানে ভাসে ভয়ানক সন্দীপ্ত সেই গানখানা! যারা টুকরো টুকরো শব্দ গুলো মানুষের উল্লাসে হারিয়ে যাচ্ছিল সেদিন!

    how many times must a man look up
    Before he can see the sky?
    And how many ears must one man have
    Before he can hear people cry?
    how many deaths will it take 'til he knows
    That too many people have died?

    এই বিদ্যুৎ কোথায় কিনতে পাওয়া যায় ডিলান? এই ডিসকোর্স কোথায় শিখলে? শরীরে রক্ত লেগে আছে অসংখ্য হননের! অন্ধকার গিলতে গিলতে এখন আলোতে বদহজম হয় আমাদের! আশ্চর্য! তবুও শুভত্বর শেষ নেই! নেতি কখোনোই শেষ কথা হতে পারে না। ডিলান, আমাদের চরম অমানিশার মাঝেও জ্বলতে থাকা একমাত্র যে জ্যোতিষ্ক, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ! তিনি এসব কথা বলতেন। লিখতেনও এরকম। সমস্ত বেদনা আর যন্ত্রণাকে তিনি হৃদয়ের অর্জিত ধন বলতেন! আমরা এখন যেখানে বসে আছি সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ দূরেই তিনি থাকতেন। লিখতেন। কাল তোমায় ওঁর স্কুলটা দেখাব। তোমার ভালো লাগবে। ওই একটা মাটির ঘর আছে,সেখানে বসে লিখেছিলেন, "আরো বেদনা, আরো বেদনা, প্রভু দাও মোরে আরো চেতনা.."

    সব খোয়ানোকে যে সব পাওয়া বলে সে আস্ত ক্ষ্যাপা,তাইনা সাহেব??

    আমাদের কলকাতা শহরের কিছু জায়গায় দেখা যায় তোমার মতো কিছু টগবগে যুবক গীটার হাতে একমনে গান গাইছে। আমি তো দাঁড়িয়ে দেখি। তোমার কথাটা মনে পড়ে, সংগীতের সময় আত্মা দেহের বাইরে বেরিয়ে উড়ে বেড়ায়! সত্যিই তাই! লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরে ওরা। সিগন্যাল, ভিখারী, বেশ্যা, কর্পোরেটের ভিড় ঠেলে অবসন্ন বাড়ি ফেরে। গোটা পৃথিবী তাকিয়ে দেখে সংগীতকে। মুক্তিকামী আবেদন নিয়ে!

    Though I know that evening's empire has returned into sand
    Vanished from my hand
    Left me blindly here to stand, but still not sleeping
    My weariness amazes me, I'm branded on my feet
    I have no one to meet
    And the ancient empty street's too dead for dreaming

    চলো, একটু হাঁটি এবার। অন্ধকার বুক পেতে আছে। হাতটা ধরো শক্ত করে। আমি সহজেই হোঁচট খাই। চলো, তোমায় কীর্তণের আসরে নিয়ে যাই। তোমার ভালোলাগবে। তোমার তো দোতারা বাজানোর খুব শখ! একটু বাজিয়ে নিতেও পারবে। চলো!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাপাঙ্গুল | 150.242.***.*** | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:১৬541262
  • ডিলানের জন্মদিনে শিলং চলে যাবেন। ওখানে সবাই বড় করে উদযাপন করে। 
     
    আপনার ব্লগের একসেস আছে দেখছি। খেরোতে না লিখে হরিদাস পালে লিখলে ভাল হয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন