ভারতের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে আলোচনা করলেন শ্রদ্ধেয় প্রধানশিক্ষক আবদুল হালিম বিশ্বাস।এই কারণেই মাধ্যমিক স্তরের পর সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীরা পড়া ছেড়ে পেটের ধান্দায় বেরিয়ে পড়ে!
------------------------------------------------------------------
বিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষাবর্ষের তিনটি পরীক্ষার মার্কশিট তৈরির কাজ চলছে। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য অভিভাবকেরা আসছেন, কেহ ফর্ম নিচ্ছেন, কেহ জমা করছেন। শীতের মিষ্টি রোদে চেয়ার পেতে লনে বসে আছি। সাবির হোসেন (নাম পরিবর্তিত) ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।
সাবির দশম শ্রেণির ছাত্র। টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনলাইনে ফর্ম জমা করেছে। বিদ্যালয়ে বহু ছাত্র আছে যাঁদের অনেক বলেও একটু নড়ানো যায় না। এগোনো তো দূরের কথা। সাবির শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে প্রতিদিন উন্নতি করেছে। তিনটি পরীক্ষার ফলাফলেই তার প্রমাণ। পাতলা লিকলিকে শরীরের লাজুক চেহারা। বাড়িতে কিছু খাস না নাকি - বলে অনেক দিন ধমক দিয়েছি।
আজ সাবিরকে উস্কোখুস্কো, বিধ্বস্ত, গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম:
আমি- কেমন আছো সাবির, পড়াশোনা ঠিকঠাক হচ্ছে?
সাবির- (স্বভাবগতভাবেই মুখ নামিয়ে) হচ্ছে স্যার।
আমি- কোনো দরকার আছে, কিছু বলছো?
সাবির - মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কবে দিবেন স্যার?
আমি- পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে এসে নিয়ে যেও। সে তো দেরি আছে।
সাবির - পরীক্ষার এক দুদিন আগে এলে পাব?
আমি- সে পাবে। কিন্তু কেন? কোথাও যাবে?
সাবির হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো। সে কিছু লুকাচ্ছে। এক মুহুর্তে নীরব হয়ে গেল।
আমি- কি হয়েছে সাবির? আমাকে বলো।
সাবির - স্যার আমাকে বাহিরে কাজে যেতে হবে।
আমি- সামনে পরীক্ষা। এখন কোথায় কাজে যাবে। পড়া নষ্ট হয়ে যাবে।
সাবির - খুব অসুবিধা হচ্ছে স্যার। বড় ভাই আর সংসার চালাতে পারছে না।
আমি- চালাতে পারছে না কেন? তোমার আব্বা কি করেন?
সাবির - আব্বা স্যার অসুস্থ। কাজ করতে পারে না। বড় ভাই রাজমিস্ত্রি খাটে। ঘরে সাতটা মানুষ। জিনিসপত্রের আগুন দাম। আব্বার ওষুধ লাগে। একজনের ইনকামে চলছে না। অশান্তি হচ্ছে। মা বলছে, স্কুল নাই। এক মাস খেটে আয়।
আমি- এখন কাজে গেলে তোমার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে। ঠিক আছে আমি তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি। কথা বলে আসছি।
সাবির - না, স্যার আপনি যাবেন না। তখন আরো খারাপ হবে। স্কুল থাকলে কিছু বলতো না হয়তো। ঘরে বসে আছি বলে ভাইয়ের সঙ্গে অশান্তি করছে।
ব্যপারটা স্পষ্ট হলো। নিম্নবিত্ত ও ভূমিহীন সকল পরিবারে একই চিত্র। কেহই বসে খায়না, খেতে পায়না। টেস্ট পরীক্ষা থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত সকল ছাত্রছাত্রীকে ঘরে বসেই পড়তে হয়, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পরিবারে এই ধারণা নাই। তার উপর শাকসবজির অগ্নিমূল্য। পোশাক আশাক ওষুধপত্রের দাম দিনরাতে বাড়ছে। ভূমিহীন পরিবারগুলোর কিভাবে দিন গুজরান হয়, কেবল তারাই ভালো জানে। অষ্টম শ্রেণি থেকে অর্থাৎ কর্মক্ষম হতেই তাঁদের জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়। আমরা শিক্ষক শিক্ষিকারা ভদ্রস্থ ভাষায় "ড্রপ আউট" বলেই দায় সারি। প্রতি বছর দলে দলে বহু ছাত্র ক্ষুধা নামক এক অবুঝের তাড়নায় শিক্ষার আলোকবৃত্ত থেকে ছিটকে যায়। সম্ভাবনাময় কত জীবন, কত স্বপ্ন অকালে ঝরে পড়ে।
সাবিরকে বললাম, পরীক্ষার আর দেড়মাস মাত্র বাকি। কোনো উপায় যদি থাকে, ভেবে দেখো। সাবির ধীর পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। এত ধীরে তাকে কখনো যেতে দেখিনি।