এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্মৃতির ওপারে

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • একটা চায়ের দোকান, প্রবীনের ভিড়! শুধুমাত্র একটা গল্পই তো! তারই গলিখুজিতে হন্যে হয়ে হয়ে, শব্দ কল্প দ্রুম!! মহানন্দার তীরটা ঘোলাটে ঠেকছে। চা ফুটছে এবং তার একটা অলস ঘ্রাণ আছে। জগাদা এসে বসে প্রায়ই! এসে বসা, খানিক গুজবস্নানে ধরা শুচি হয় কিনা জানিনা, তবে এইসময় গাঁজা ধরায় জগাদা। তারপর ডার্ক কথাবার্তা বলে। ডিমেনশিয়া নিয়ে ভাবছি। এ ভাবনার কারণ নেই! শুধু জানলার চৌকো খোপ দিয়ে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে এসে পড়া রোদ আর রোদের ওপর একটা চেয়ার, চেয়ারের ছায়া, গোটা একটা মানুষ, বৃদ্ধ! স্মৃতিভ্রষ্ট। চোখে পড়লে ডিমেনশিয়া নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে। বৃদ্ধের নব্বই শতাংশ স্মৃতি বিলুপ্ত! বাকি দশের ওপর স্ক্রিবলিং করছে মহাকাল! অর্থাৎ, বিগত বিহানের কোনো মালঞ্চই আর নেই। আছে বলতে কুড়িয়ে পাওয়া এদিক সেদিক, ঘটনা-বিভ্রাট। বুড়োটা রোদের সাথে কথা বলে। স্ত্রী এসে গ্লাসে কী একটা দিয়ে যান। স্ত্রীকে চিনতে পারেন কিনা এ নিয়ে আমার কৌতুহল অসীম। জগাদাকে ঘটনাটা বলাতে, সেই একই ধাতের কোয়ারি, "কীরকম চেনার কথা বলছিস??" চেনা মানে, সাগরের অতলে ডুবে ফ্লোরা ফনার হিসেব নয়, ইনফ্যাক্ট, সঙ্গের লোকটা আমার কে হয়, সেটা মনে আছে ভদ্রলোকের?? এটাই বলতে চাইছি। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাহলে তাঁকে চিনিয়ে দেওয়ার বা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়?? কীরকম সেই চেষ্টা?? এসব নিয়ে ভাবার সময় আমার আছে। একটা মস্ত অ্যালবামের সামনে, কিংবা, মে বি আ ক্যানভাস, হতে পারে নীল নীল ঢেউয়ের সপাট স্রোত! মালাবদলের ছবি, বৃদ্ধের অন্ধকার চৈতন্যের সামনে মেলে ধরা বিয়েতে পাওয়া শাড়িটা! শশুরবাড়ির গয়না! মনে নেই কিসসু?? জানলা দিয়ে দুজনকে একসাথে যতটা দেখা যায়, ওটা তো ক্লোজআপে নয়! একটা ব্যবহারিক দুরত্ব, একটা প্রাগৈতিহাসিক বিস্মরণ! বৃদ্ধের মনে বেঁচে থাকা দশ শতাংশ জমিতে কোথাও কি ঘরণী নেই?? কোথায় কোথায় সেই মেরুপ্রান্ত? কিংবা অহেতুক ভাবছি আমি! দুজনই দুজনের আজন্ম চেনা, এ তো নতুন কথা নয়। বৃদ্ধ বিকেলের দিকটা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন কাক, কাঠবিড়ালি, মানুষ, জামা, গাছালির দিকে। অন্তর্লীন কুশল সংবাদ, যেন বলছেন, তোমাদের কেমন সব চেনা চেনা লাগছে! এই সব দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে আমি চলে যাই ডালটনগঞ্জের কুমান্ডি নামের গ্রামটায়। কেচকির দিকে যেতে কোয়েল নদী পড়ে। তার উত্তর পশ্চিমে এই টোলা। এতই সংক্ষিপ্ত যে মানচিত্রে তার ঠাঁই মেলেনি। পঁচিশ ঘর উপজাতিদের বসতি। তারই একঘরের কর্তা সিকন্দর সোরেন। বৃদ্ধ! ভার্যা আছেন৷ ছেলে পুলেরা চেন্নাইতে লেবারের কাজ করে! সিকন্দরেরও সেই একই অবস্থা! সব ভুলে গেছেন৷ সব?? সত্যিই সব? কোয়েল নদীকে ভুলে গেছেন? ভুলে গেছেন একেকটা সুর্যাস্ত। ভার্যা বললেন "এখন আর জঙ্গল কী দেখছ! সব কাটা হয়ে গেছে! " কারা কাটল?? কোন দস্যুরা?? পাহাড় কেটে মাইন বসেছে! শিল্প হবে। সিকন্দর সোরেন গাঁয়ের মাস্টারমশায় ছিলেন৷ সারাক্ষণ বাঁশের মাচার ওপর বসে বসে ঝিমোচ্ছেন! কুমান্ডি বদলে যাচ্ছে! নগরপতিদের চোখ পড়েছে। কত ছেলে পুলে কাজ পাবে! আর চেন্নাই যেতে হবে না। কিন্তু, সিকন্দর সোরেন! সেই ছেলেবেলা থেকে যিনি গাছ লাগিয়ে গেছেন, তাঁর আধবোজা চোখের সামনে দিয়ে অরণ্যের ধর্ষণ চলছে। কিসসু করার নেই! তিনি সব ভুলে গেছেন৷ শুধু আবছা আলোর মতো মনে আছে পৃথিবীটা আগে অন্যরকম ছিল! স্মরণ নয়! বরং চেতনা। বরং অনন্ত প্রবাহের কাছে মৌনস্বীকার! কুমান্ডি মানচিত্রে ঠাঁই পায়নি। এতকাল পরে সিকন্দরও আর বেঁচে নেই বোধহয়। জঙ্গল আরো পাতলা হয়ে এসেছে নির্ঘাত! সভ্যতা আর খুব বেশী গুরুতর থাকতে পারছেনা। আমার সামনের সেই বৃদ্ধ দুতলার বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে যখন রাস্তার ওপর দিয়ে চলা মিছিলটা দেখেন, স্পষ্ট দেখতে পাই যে মিছিলকে শবযাত্রা ভেবে তিনি কপালে হাত ঠেকাচ্ছেন। আর স্নায়ু বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ধাতুর মতো কিছু! বোবা চোখে তাকিয়ে দেখছেন ঘরে সাজানো প্রাইজ মেডেল! বৃদ্ধা স্ত্রী, স্লিভলেস ব্লাউজ, কুঞ্চিত ত্বক, বড় টিপ, আরবান ড্রয়িংরুম। আমি আমার বারান্দা থেকে যতটুকু দেখতে পাই ততটুকুই যেহেতু সবটা নয়, তাই এই সমীকরণকে নিয়ে খেলতে আমার ভালো লাগে। আমার বারবার মনে হয়, করুণা হয়! ভুলে যদি যেতেই হয় তাহলে একসাথে দুজনের ভুলে যাওয়াই ভালো! তুমি - আমি হারা শুন্য ড্রয়িংরুমে অলীক মুখোমুখি আমাদের! বোধ ক্ষয় হয়। শুধু সেই বিস্মরণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রবল গতিশীল পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকা, ফ্যাল ফ্যাল করে...এও ভালো। কুমান্ডির সেই শিক্ষকের সামনে রোজ যেমন শিল্পপতি দস্যুরা বলে যেত, আপনি কিছুই দেখেন নি মাস্টার মশায়..এই যে ধ্বংস, এই যে আগ্রাসন আর নৈরাজ্য, এর নেশা অন্যরকম মাস্টারমশায়! আপনার হিতবাদে আমরা পেচ্ছাপ করি!

    এইটুকুই! কুমান্ডি আর কোনোদিন হয়তো যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু রোজ এই ঢাকুরিয়ার বাড়ির বারান্দায় বসে সোজা তাকালেই দেখব একটা অন্যরকম বারান্দা। তাতে রোদ পড়েছে। ভাষা হারা, স্মৃতিহারা পলাশ গাছের মতো নীরব এক বৃদ্ধকে বারবার কোয়েল নদীর মতো ছুঁয়ে যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। আর দেখব নীচে, বহু নীচে, পাতালে, বহু মানুষের মিছিল সর্পিল শবযাত্রার মতো এগিয়ে যাচ্ছে সর্বশেষ দাহর দিকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন