সেদিন আর উনি বিকেলে হাঁটতে বেরোন নি, নিজের আরাম কেদারায় বসে ভাবছিলেন আজ হাঁটতে যাবেন কিনা! এখনও পৃথিবী তার অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠে নি, বেরোলেই আবার সংক্রমণের ভয়।
হঠাৎই কানে এলো ওনার , পাশের ঘরে নাতনি আর বউমার ক্রমশ উঁচু স্কেলে ওঠা তর্ক।
“সারাক্ষণ এভাবে ঘরে বসে থাকা যায় নাকি? একটু পার্কে গেলে কী হবে?”
“কী হবে তুমি বেশ জানো – ন্যাকা সেজো না। এত কিছুর পরেও, স্যোশাল ডিস্ট্যান্সিং তোমরা কেউ মেনটেন করো না।”
“ আমরা জীবনভোর কি ভার্চুয়ালি কথা বলবো নাকি? এখন তো আর লকডাউন নেই। তাহলে…”
“তোমাদের আক্কেল হলে , তারপর আবার বেরোবে।“
দরজাটা খুলে রাগ হয়ে তিয়াসা দুমদুম করে চলে গেলো বারান্দায় আর সশব্দে বারান্দার দরজাটা বন্ধ হলো।
তখন ওর খুব কষ্ট হলো ওই মেয়েটার জন্যে। আহা – এই পনেরোয় পড়লো। এই বয়েসে বন্ধুদের সঙ্গে হৈ চৈ করবেই…
কষ্ট হলেও ওঁর বিশেষ কিছু করার নেই। কারণ বউমা যেটা বলেছে, সেটা যুক্তিযুক্ত।
অবশেষে সাতপাঁচ ভেবে শেষে আস্তে আস্তে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে এলেন। দেখলেন তিয়াসা কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। মুখে একটা অস্থির ভাব।
তখন উনি পাশে এসে, খুব নীচু স্বরে জিগ্যেস করলেন “গান শিখবি?”
“গান?” অবাক হলো তিয়াসা । “কী গান?”
“ওই আর কী – আমি যেসব গান, মানে আমার…”
“শিখেছিলাম কয়েকটা। তবে আমার তেমন ভালো লাগছিলো না - বুঝতে পারি নি ।“
“আমি বুঝিয়ে দেবো।“ বললেন উনি। “দাঁড়া – আগে গীতবিতানটা নিয়ে আসি।“
গীতবিতান !!” বলে হাসলো তিয়াসা । “এখন সব নেটে পাওয়া যায়। এই নাও – এই সাইটে খুঁজে দেখো।“
খুঁজে পেলেন উনি। তারপর সেটাকে আস্তে আস্তে পড়তে লাগলেন।
“এই যে মুক্তির কথা বলেছেন – সেটা আমাদের অন্ধকার থেকে মুক্তি। মানে আমাদের মনের অন্ধকার… তাই এ মুক্তি আলোয় আলোয়। এই প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি নিশ্বাসে আসছে আমাদের মুক্তি।“
তিয়াসা ভুরু কুঁচকে শুনছে। সবটা ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু বলতে বলতে ওনার মুখে যে আলো ফুটে উঠছে সেটা টের পাচ্ছে। আর না বুঝেও কেমন যেন ভালো লাগছে তার।
পেছন থেকে সন্দীপনের গলা পাওয়া গেল। “দেহ মনের সুদূর পারে, হারিয়ে ফেলি আপনারে…”। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সে – গলা ছেড়ে গাইছে। তিয়াসার চোখ গোল গোল হয়ে গেল।
“বাবা – তুমি গান গাইতে নাকি?”
সন্দীপন হাসলো ।
“থামলি কেন – গা” বললেন উনি। সন্দীপন আবার গাইতে শুরু করলো। তিয়াসাও।
এসব গানের আওয়াজে ইন্দিরা বারান্দায় এসে পড়েছেন। তাকে দেখেই তিয়াসা বলল “মাম্মা – বাবা গান গাইছে – আর আমিও। এই গানটা জানো তুমি?”
“এটা সবার জানা। “
“তাহলে আমাদের সঙ্গে গাও। ১মিনিট – পিয়াকে ডেকে নিই স্কাইপে? ও তো বেঙ্গলি – ওরও ভালো লাগবে।“
স্কাইপ চালু হলো। সোনাঝরা বিকেলে প্রবাসী দুটি পরিবার, তারা একসাথে সেই গানটা গেয়ে উঠলো।
অভিশাপের যন্ত্রনা ও বেদনায় বিষণ্ণ পৃথিবীর ওপর ছেয়ে আছে কালশিটে রঙের আকাশ। কিন্তু তার একপ্রান্ত আলোকিত হয়ে উঠছে রক্তিম সূর্যাস্তে। সেই সোনালি আলোয় দেখা যাচ্ছে ওনার সাদা দাড়ি আর আলখাল্লা। উনি গাইছেন। আর প্রায়-অন্ধকার আকাশে মুঠো মুঠো মুক্তির আশা ছড়িয়ে পড়ছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।