এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সকাল রাত আর বিকেল দুপুর

    আফতাব হোসেন লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ জুলাই ২০২৪ | ২৩৬ বার পঠিত
  • (১)

    তখন সকাল,
    বাগদীপাড়া আর ধুনিয়াপাড়ার মাঝের যে মাঠটা সদ্য রক্তবন্ধ করে যৌবন হারিয়ে ধুঁকছে, তার ডানদিক বরাবর হেই মোটা পুরানো বটগাছটার নীচে লাশ হয়ে পড়ে থাকে লোকটা। নতুন আমদানি এ তল্লাটে। কুল, বংশ, মজহব সব অজানা। করুণা রুগী কেউ ফেলে গেছে ভেবে ধারেকাছে ঘেঁসেওনি কেউ অনেকদিন। জুম্মাবার রাস্তাদিয়ে যাবার সময় সেলিম চাচা লোকটার নেতিয়ে পড়া খতনার লিঙ্গ দেখে জাতভাই আদরে দু বাটি গোস দিয়ে এলেও মুখে দেয়নি কিছুই লোকটা। বাগদীপাড়ার ধলবউ এর আবার মায়া খুব, চিড়ে গুড়ের বাটি নিয়ে গিয়েছিল বিকেল করে। খায়নি। সারাদিন খালি বসে থেকে মাটি খুঁড়ে। খুঁড়েই যায়। মনে হয় জন্মান্তরের সম্পত্তি লুকানো যেন। পিচুটি বসা প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের ওপর হাত রেখে শীতের রাতে লোকটা বড্ড কাঁদে। গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে। দুঃখের কান্না নয় হয়ত, আক্রোশের কান্না। হাভাতের কান্না নয় হয়ত, লজ্জার কান্না। শেয়াল কুকুরগুলোও কান্নার আওয়াজে ভয় পেয়ে নিজেদের ছানা পোনাদের গুটিয়ে রাখে সারারাত। তারপর রোজ ভোর হয়। দলবেঁধে পায়খানায় যাওয়া লোকজন দেখতে পায় কান্নায় ক্লান্ত লোকটা নিজের গর্তেই মুখ ঢুকিয়ে গোঙাচ্ছে
    • ‘ ও আব্বা, চামড়া নাই গো, কুত্তাউ নাই ‘
    সূর্য তখন সদ্য উঠছে। এখনো সারা দিন বাকি।

    (২)

    তখন রাতের শুরু সবে,
    চারিদিকে একটা হৈ হৈ, কিছু ধুপধাপ শব্দ,
    • ‘সালো ভশ্রীবালে, হমে সব পতা হে,
    একটা শোরগোল খুব…
    • ‘ মাদারচোদ, লুটনে আয়ে হো সালো ..
    শোরগোল এর শব্দটা বাড়লো একটু, সাথে দর্শকের সংখ্যাটাও।
    • ‘ ভাগ যা আপনে দেশ মে, যো তুম লোগোনে বানায়া থা ‘

    লোকদুটোর রক্ত ঝরছিল সারা শরীর থেকে। বাঁশে জড়ানো কাঁটাতারের ভালোবাসার ছাপ শরীরময়। মেরুদণ্ডের থরে থরে সাজানো হাড়গুলো ভয়ের চোটে সোজা হয়ে বসা ভুলে গেছে হয়ত, কিংবা মারের চোটে সোজা হয়ে সাজানো নেই আর।
    চোখের ঠিকরে থাকা মনি গুলো, পেরেক গেঁথে যাওয়ায় পুরো বন্ধ। তাকানোর ইচ্ছে নেই হয়ত, কিংবা তাকাতে বড্ড লজ্জা ওদের আজ।
    হাত দুটো ভূমিকম্পের মত কাঁপতে কাঁপতে জোড় করে রাখা। একজন আর একজনকে আঁকড়ে থাকতে চায় হয়ত, কিংবা বাঁচিয়ে রাখার ভিক্ষে চাওয়ার আশায়।
    চোখের জল আদ্রিনালিন ঝড়ে শুকিয়ে যাবার আগেই একটা লোক দুম  করে পড়ে গেল। খেলনার ঝোলাটা তখনো কাঁধে। বন্ধ চোখগুলো একবার হঠাৎ করে খুলে গিয়ে খুলেই রইলো। অনেকক্ষন। হয়ত সারাজীবন…
     আর একজন তখন প্যান্ট জাপটে, ইজ্জত আঁকড়ে। চারটা জোয়ান হাত হ্যাঁচকা টানে জাঙ্গিয়া শুদ্দু ধরে টান মারা মাত্রই লোকটার মাথার পেছনে কাঁটা লাগানো লাঠিটা চুমু খেলো। কয়েকবার। ফলাফলা হয়ে যাওয়া চোখের আলোটা দপদপ করে জ্বলে নিভে যাবার আগেই লোকটার কানগুলো শুনলো, আবছা সুরে, অনেক দূর থেকে, অনেকগুলো আওয়াজ…
    • ‘ সালা মাদারচোদ, কাটোয়া সালে ‘…
    এখম মাঝরাত।

    (৩)

    অনেকদিন আগে …
    দুপুর সবে শুরু হল,
    পাঁচ বছরের সদ্য সুন্নত হওয়া কচি ছেলেটার সুন্নত জায়গাটা বার বার গামছায় ঘষা খেয়ে ব্যাথা পাবার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে ওর মায়ের কাছে খেল একবার জোর মার। তখন থেকেই কান্না শুরু ছেলেটার।মারের ব্যাথায় না কি মায়ের ওপর অভিমানে, কে জানে ? মাটির ঘরটার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে যখনই রিনরিন করে চুড়ির শব্দটা সামনে আসছিল, তখনই ছেলেটার কান্নাটা বাড়ছিল একটু করে। কতক্ষন এভাবে গেছে খেয়াল নেই। উঠোনে একটা ভারী গলার আওয়াজ পেতেই কান্নার বেগটা বাড়লো আরো। পুরুষ মানুষটার মায়া বেশি। ফেরি করে ফেরত আসা খেলনার ব্যাগটা কাঁধের থেকে নামিয়েই নিজের বিবির ওপর একচোট মিথ্যে রাগ দেখিয়েই মায়া মায়া গলায় পাঁচ বছরেরটাকে প্রশ্ন - ‘ ও লে বাবা লে, কি হয়েছে আমার বাবা সোনা ?’
    নরম ডাক শুনে একটু ফোঁপানি এলো হয়ত পুঁচকেটার। গামছাটা ভালো করে কোমরে পেঁচিয়ে আদুরে ফোঁপানি গলায় আবদার
    ‘ আব্বু, মোর চামড়া খান ফিরাই দে,আগের মত করে দে, গোটা।‘
    আব্বার মুখে হাসি। বলে ‘ বোকা, উটা তো উপরের লুকটা নিয়া নিয়েছে ‘।
    ছেলে তাও অবুঝ,ফোঁপানি জোরে আরো,
    ‘ না, মোর টা গোটা করে দে ‘..
    আব্বা ছেলেকে হুস করে কোলে তুলে নিয়েই মুখে হাত
    -‘ সসসস…. আম্মিকে বলবি না, হুই ধুনীয়া পাড়ার সামনের ছোট বট গাছটার নিচে পুঁতেছি চামড়া টা, কাউকে বলিস না, বড় হলে দরকারে নিয়ে নিস ‘

    ছেলের মুখে মিষ্টি হাসি। বাবার চোখে অনেক স্বপ্ন।
    তখন দুপুরের তেজ শেষ। বিকেলের মিষ্টি আলো বাপ ছেলের গাল ছুঁয়ে । যে আলোয় মনে হয় সামনের রাত স্বপ্নের হবে।
    তখন বিকেল সবে।

    (৪)

    সকাল দুপুর বিকেল আর রাত কে মেলানো যেত হয়ত। মিলে গেলে রূপকথা হত। রূপকথায় রাজা রানী থাকে। এখানে নেই। এখানে প্রজা সবাই। এখন সকাল দুপুর বিকেল আর রাত পরপর শুধু ভূগোল বই এ আসে, নয়ত রূপকথায়। বাস্তবে না। বাস্তবে কখনো কখনো রাত আসে আগে, স্নিগ্ধতার নয়, অভিশাপের স্বপ্নের, যে স্বপ্নে নিজভুমে পরদেশী হবার ত্রাস ঠোঁট কাঁপায়। আর তারপর আসে রাতের অভিশাপের বোঝা নিয়ে পাগলের গোঙানির সুরে সকাল। যে সকাল, স্মৃতি খুঁজে ফেরে দগদগে কাটা চামড়ার,সাথে গামছা ঘষার সুখ ব্যাথার। যে ব্যাথা আশায় থাকে আবার বিষুবরেখা বরাবর সকাল, দুপুর, বিকেল আর সুখ রাত এক লাইনে আসবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন