এবারের নির্বাচনে মোদী তথা বিজেপি যে ২৪০ পর্যন্ত পৌঁছতে পারলো, তার জন্য দায়ী কি কংগ্রেস নয়? ইন্ডিয়া জোটের মুম্বাইয়ে শেষ বৈঠকে তৃণমূল নেত্রী জোর দিয়েছিলেন অবিলম্বে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করতে। চেয়েছিলেন জোটের কনভেনর নিযুক্ত হোক। তিনি খার্গেজীর নামও উত্থাপন করেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে, তিনি একজন দলিত নেতা হবার কারণেই তাঁর নাম আমরা ভবিষ্যতে পিএম মুখ হিসেবেও সবাই বিবেচনা করতে পারি। এই প্রস্তাবটি পছন্দ না হবার কারণে গোটা বিষয়টিতেই জল ঢেলে দেওয়ার সাথে সপাটে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিযে তৃণমূল নেত্রীকে যথেষ্ট বিব্রত করা হোল। এই বিড়ম্বনা নেত্রী হজম করতে পারলেন না, ফলে তিনি আর কোন বিরোধী বৈঠকে আগ্রহী হলেন না। অবশ্য কংগ্রেসের তরফেও ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক আর একবারও ডাকা হোলনা সার্বিক রূপে আলোচনার জন্য।
কংগ্রেস ব্যস্ত হয় পড়লো রাহুলের ইস্ট ওয়েস্ট তথা মনিপুর থেকে মহারাষ্ট্র রাহুলের যাত্রা নিয়ে। সেই যাত্রা বাংলার কিয়দাংশ দিয়ে অতিক্রম কালে গুরুত্ব দেওয়া হোল অধীরকে এবং সেলিমকে, যাদের একমাত্র লক্ষ হচ্ছে মমতার বিরুদ্ধে মোদীর প্রতিটি অন্যায় পদক্ষেপকে সমর্থন করা ও মমতার তীব্র সমালোচনায় আকাশ বাতাস মুখরিত করে মোদীর হাতকে শক্ত করা। অধীর ও সেলিম তাদের মমতাকে উত্যক্ত করার লক্ষ্যে সফল হলে খুশি হবে এমনটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এটা যে মমতাকে প্রচণ্ড বিরূপ করবে সেটা কি রাহুল বুঝতে চাইলেন না, নাকি ইন্ডিয়া জোটে মমতার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করতেই চাইলেন? অধীর সেলিম তো চায়, বাংলায় মোদী মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজ্য শাসন করুক ও তৃণমূলকে ধ্বংস করুক। এখন প্রশ্ন, রাহুলও কি তেমনটাই চায়? চায়না, এমনটা কিন্তু পরিষ্কার নয়। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে অধীর ও সীতারামের লাগাতার কূমন্ত্রনা সহ নানাবিধ কারণে রাহুল মমতার প্রতি সবিশেষ প্রীত নয়।
জয়রাম রমেশ সহ কংগ্রেসের দ্বিতীয় সারির নেতারা সম্ভবত চান না যে ইন্ডিয়া জোট যথেষ্ট শক্তিশালী হোক। ওনারা মুখে খুব ভালো ভালো মন ভোলানো কথা বলে থাকেন সাধারণ মানুষকে এদের আসল উদ্দেশ্য আড়াল করতে। ওনারা হয়তোবা দ্বিদলীয় ব্যবস্থার সমর্থক অথবা আঞ্চলিক দল সমূহের উত্থান এদের পছন্দ নয় আদৌ। এর পেছনে কর্পোরেট শক্তির দুষ্প্রভাব না অন্য কোন খেলা আছে, বোঝা মুশকিল।
কংগ্রেস দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব তথা সোনিয়া, রাহুল ও প্রিয়াংকা কে কোনরকম দোষারোপ করা ঠিক নয়, কারণ কংগ্রেসে এখনও ইন্দিরা গান্ধী জমানার সাংগঠনিক ধাঁচের ব্যবস্থাই বহাল আছে, কিন্তু নেই ইন্দিরা গান্ধী সদৃশ দৃঢ় নেতৃত্ব। রাহুলের প্রভূত জ্ঞান ও গুণ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বাস্তব জ্ঞানের পরিপক্বতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রকৃত বন্ধু নিরূপণে তিনি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত। ফলে সবার কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নানাবিধ ভুল হচ্ছে। আর দলের দ্বিতীয় সারির নেতাদের অনেকেই দেশ ও দলের চেয়ে স্বীয় স্বার্থ রক্ষাতেই বেশি মনোযোগী। আহমেদ প্যাটেল গত হবার পরে সোনিয়া সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্য কাউকে পাননি। এটাও অন্যতম সমস্যা। একটি সৎ, নিঃস্বার্থ ও যোগ্যতা সম্পন্ন উপদেষ্টা মন্ডলী জরুরি সঠিক পরামর্শ দেবার জন্য, কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনজনকেই যৌথভাবে। তাহলেই ভুলের সম্ভাবনা কমে যাবে।
এবার জোট পরিচালনার ভুল, প্রসঙ্গে আসি। জোটকে সম্পূর্ন রূপে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কংগ্রেস কিছুতেই আর কোন জোট বৈঠক ডাকলো না। ভেবেছিল মিজোরাম ও চার রাজ্যের ভোটে ভাল ফল করে আসন সমঝোতা নিয়ে দর কষাকষির ক্ষেত্রে ভালো জায়গায় থাকতে পারবে। কিন্তু বিধি বাম, তাই ফল হলো বেশ খারাপ। এক তেলেঙ্গানা ছাড়া বাকি তিন রাজ্যেই ডুবলো। কিন্তু এর পরেও জোটের বৈঠক ডাকলো না খারাপ ফলের কারণে। তার পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তর প্রদেশে ও সংশ্লিষ্ট শরীক নেতৃত্বের সঙ্গে মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝারখন্ড ও অন্যত্র আসন সমঝোতা সারলো।
তিন রাজ্যের বিধানসভার ভোটে খারাপ ফল করায় একটা দিকে ভালো হোল যে, খানিকটা সহজভাবেই আসন সমঝোতা সম্পন্ন হোল। যদিও বাংলায় অধীর সেলিমের চক্রান্তে ও রাহুলের প্রশ্রয়ে জোটের মাধ্যমে আসন সমঝোতা হোল না। হলে বিজেপি বাংলায় একটি আসনও পেত কিনা সন্দেহ এবং জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়তো অন্য মাত্রায়। তবু একথা মানতেই হবে যে, কংগ্রেস ও বিজেপির মুখোমুখি লড়াইয়ের ফল আদৌ ভালো হয়নি। এমনকি কংগ্রেস শাসিত রাজ্য কর্নাটক, তেলেঙ্গানা ও হিমাচলের ফলও ভালো নয়। জোটের ফল ইউপিতে ও মহারাষ্ট্রে যথেষ্ট ভালো হবার কারণেই মোদী তথা বিজেপি ২৪০এ আটকে গেল। এই ফলাফল থেকে এটা পরিষ্কার যে, এবারের ভোটে দেশব্যাপী মোদীর বিরুদ্ধে ও জোটের পক্ষে মানুষের সমর্থন ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ও দূরদৃষ্টির অভাবে ইন্ডিয়া জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ও মোদী শাসনের অবসান ঘটলো না।
ভেবে দেখুন, মহারাষ্ট্রে ইন্ডিয়া জোট বৈঠকে যদি মমতার পরামর্শ মেনে খর্গে সাহেবকে জোটের কনভেনর বানানো হোত এবং জোটের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থিরকৃত অভিষেক সহ বিভিন্ন নাম সমূহ সমন্বিত আসন সমঝোতা কমিটির উদ্যোগে আলোচনা শুরু ও নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে সম্পন্ন করা যেত এবং অতঃপর দেশজুড়ে সর্বত্র জোট নেতৃবৃন্দ যৌথ সভা করতে পারতো, তাহলে গোটাদেশে যে হওয়া উঠতো তাতে খড়কুটোর মতো ভেসে যেত মোদী। কিন্তু যে মোদী এতদিন ধরে কর্পোরেট জগতের সেবা করেছেন, সেই কর্পোরেট কর্তারা কিভাবে এটাকে সফল হতে দেয়? ফলে খেলা শুরু হোল নেপথ্যে, আর জোট রইলো খাতা কলমে, নিয়ন্ত্রণ রইলো রাজনৈতিক ফড়েদের হাতে। ফলে কিছুটা কমজোরী হলেও স্বপদেই রইলেন মোদী। অতকিম?
এখনও পর্যন্ত কিন্তু কংগ্রেসের তরফে কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যে, একটা সুস্থ সবল ঐক্যবদ্ধ নিটোল জোট গড়ে ওঠে। যেখানে লিখিত পড়িত সমস্ত নির্দিষ্ট বিষয় থাকবে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকবে, নির্দিষ্ট ব্যবধানে জোটের সবাই বসে পর্যালোচনা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সব ভালো কি সবার স্বার্থের পরিপূরক হয়? মনে হয় না। ঘোলা জলে মাছ ধরাতেই অনেকের আনন্দ। কিন্তু চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয়না, আমরা জানি। আঞ্চলিক দল সমূহকে একাট্টা হতে না দিয়ে সময়ে সময়ে নানা দলকে নানা ভাবে ব্যবহার করে সাময়িক লাভ হলেও আখেরে লাভ হবেনা। অন্যদেরকে যারা বোকা ভাবে, তারা নিজেরা কি যথেষ্ট বুদ্ধিমান? এটা বুঝতে হবে, তৃণমূলকে প্রকৃত বন্ধু রূপে মন থেকে গ্রহণ করতে পারাই হোল জোট সাফল্যের অন্যতম শর্ত। মনে রাখা জরুরি, সবার শুভ বুদ্ধি জাগরুক না হলে ক্ষতি সবার, গোটা সমাজের ও দেশের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।