এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নির্জন পথের পথিক, তপনকর ভট্টাচার্য

    Debasis Sarkar লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ জুন ২০২৪ | ২৪৪ বার পঠিত
  • একলা পথের পথিক, তপনকর ভট্টাচার্য

    দেবাশিস সরকার  

    সম্প্রতি হাতে এলো তপনকর ভট্টাচার্যের লেখা ‘চিলেকোঠা’, ‘নাচ ও পিস্তল’ এবং ‘জন্মদিন’ শিরোনামাঙ্কিত তিনখানা গল্পগ্রন্থ এবং ঐতিহ্যবাহী ‘নান্দীমুখ’ পত্রিকার ‘তপনকর ভট্টাচার্য সংখ্যা’। গত চার চারটি দশক ধরে অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন নির্জন পথের দিশারী যে মানুষটি, তাঁকে নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ খুবই জরুরী ছিল। বস্তুত উল্লিখিত ক্রোড়পত্রটি তপন করের সাহিত্যকীর্তির ওপরে এক বহুকৌণিক বিচ্ছুরণ যা পড়া থাকলে আমার এ আলোচনা চর্বিতচর্বণ মনে হবে। তবে, এ তো হতেই পারে যে উক্ত ‘নান্দীমুখ’ পত্রিকাটি আমার উদ্দিষ্ট পাঠকদের অনেকেই পড়েন নি, সেক্ষেত্রে তাঁদের কাছে এই আলোচনাটি পাঠযোগ্য হলেও হতে পারে, সেই প্রত্যাশায় এই লেখা। তাছাড়া, হাইজেনবার্গের নীতি অনুযায়ী বস্তুর অবস্থানকে মাপতে গেলেই তার ভরবেগের একটা তারতম্য আসে। ফলে বস্তুর (বিষয়ভাবনার) ভরবেগ বিভিন্ন মাপকের কাছে বিভিন্ন রকম। হাইজেনবার্গের নীতিতে একে অবজারভার এফেক্ট বা নিরীক্ষক প্রভাব বলা হয়েছে। কোন পাঠক তো একসঙ্গে একটা লেখা পড়েন না। তাই নিরীক্ষক প্রভাব একেকজন পাঠকের কাছে একেক রকমের। সুতরাং মাভৈ! সে ভরসায় এ আলোচনা শুরু করা যাক!

    “ওই তো বড় খোকা আসছে। খাটাল বাপী পাড়া দখল করলে ছোটখোকার অ্যান্টি এখানে ঢুকে যাবে। তার ওপরে দল যদি মস্তান পোষার জন্য নোটিশ ধরায়, কাউন্সিলার থাকার দরকার কি? বাড়ি বেচে সবাই মিলে একসঙ্গে অন্য কোথাও থাকব। সবই তো শান্তির জন্য।
    আচ্ছা বউমা ছেলেটার সঙ্গে কি এত কথা তোমার? ওই তো বড় খোকা, ওকে টাকা দিস না। ওর খেল খতম। মাজার জোর নেই। গর্ত খুঁজছে। ভাগিয়ে দে। ওরা সব অকৃতজ্ঞ। উপকার করেছিলি মনে রাখেনি। তোর বন্ধুকে একটা ফোন কর। খোকা সাবধান, কে কোথায় দেখে ফেলবে। একশ দিচ্ছিস কেন ? দশ কুড়ি দিয়ে বিদেয় কর। ও কিছু করতে পারবে না। ওদিকে শাহাজাদা এদিকে রাম অবতার। পেছনে খাটাল বাপি। লাথি মার। দরজা বন্ধ করে দে। বউমা উঠে এস। বড় খোকা উঠে আয়। আবার তর্ক করছে। মেশিন দেখাচ্ছে। অ্যাই অ্যাই ছেলে, যা ভাগ। পালা বলছি, জানিস না, পুলিশ বড় খোকার বন্ধু। পুলিশ ডাকব কিন্তু।”
    ( ইঁদুর )

    আবার,
    “এই নীলু প্রধান বক্তা। সভাপতির বাড়িতে নতুন কুটুম আসবে। ঝামেলা এড়াতে সহ-সভাপতি সাতসকালেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সে কারণে নীলুকে অতিরিক্ত অনেক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আমার মনে হয় পাড়ার ক্লাব হিসেবে আমাদের একটা কর্তব্য আছে। এটা খুন বা আত্মহত্যা যাই হোক না কেন সেটা পুলিশ দেখবে। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের এই অঞ্চলে এমন কাজ যেন না হয়। আমাদের সেটুকু দেখলেই হবে।আর সুবোধ নামে একটা লোক বাইরে থেকে এসে এরকম অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে দিব্যি চালিয়ে গেল, আমরা জানতেও পারলাম না। এটা আমাদের গাফিলতি।
    নীলুর কথা শেষ হল। সবাই চুপচাপ। ক্লাবের সম্পাদক রাজা। প্রাক্তন শিক্ষিত বেকার। এখন প্রোমোটার। তিনটে বাড়ি শেষ করেছে। হাতে আরও দুটো। ”
    ( ভূতের গল্প )

    কাটা কাটা, ছোট ছোট সরল বাক্যে আমরা এই সময়ে এক নগর পরিক্রমায় বেরিয়েছি। খুব প্রয়োজন না হলে তপনকর বোধহয় যৌগিক বা জটিল বাক্য লেখেন না। তপনকরের ভাষা গঠনের পদ্ধতি এরকমই। খুব অল্প শব্দে তিনি চাক্ষুষ বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলেন।

    আসলে, সাহিত্য রচনার মসৃণ বীথির ধারে দণ্ডায়মান সুখপাঠ্য, গতানুগতিক বিষয় ও সেই অনুযায়ী চরিত্র ও ভাষ্য নির্মাণ বাতিল করে তপনকর এবড়ো খেবড়ো চড়াই রাস্তা ধরে হেঁটে গেছেন। এই পথের পথিক হবার পূর্বাহ্নেই তিনি জানতেন হাতে গোণা দু একজন নাছোড়বান্দা ছাড়া অনুসারী সহযাত্রী বিশেষ তেমন তিনি পাবেন না।

    তাঁর গল্পের চরিত্রগুলি উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, অতিদরিদ্র শ্রেণী থেকে। এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চরিত্রগুলির অন্তর্ললোকের উদ্ভাসন তপনকরের লেখালেখির বৈশিষ্ট্য। উদ্ধৃত অল্পাংশগুলিতে যা পরিস্ফুট, বয়ানের ভেতরে প্রবেশ করলেই লেখকের এই আপাতনির্বিকার নির্লিপ্ত ভাষাভঙ্গি একই সঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। রক্তাক্ত সংশ্লিষ্টতা নয়, ধ্রুপদী নির্লিপ্তিই তপনকর ভট্টাচার্যের লেখালেখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমাপিকা ক্রিয়াহীন ছোট ছোট বাক্যে আজকের খণ্ড সময়ের টুকরো টাকরা গুলি তপনকরের গল্পের মাল মশলা। তিনি প্রতিটি গল্পেই সমাজের অবক্ষয়, ব্যক্তির স্খলন, মানুষের দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার করার প্রবণতা আঁকেন এক অমোঘ নির্লিপ্তর সঙ্গে।

    তপনকর চারটি দশক ধরে লিখছেন। একটি লেখায় তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে তিন খানি উপন্যাস, অজস্র কবিতা লিখলেও গল্প লিখতেই তিনি বেশি পছন্দ করেন।

    পণ্যমোহে আক্রান্ত নাগরিক জীবনের বহুস্তরীয় জটিলতার ফাঁকফোকর গুলির প্রতি তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। সে হিসেবে তাঁকে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের যথার্থ উত্তরসূরী বলা যায়।

    নিজের লেখালেখি সম্পর্কে একটি নিবন্ধে তপনকর জানিয়েছেন, জীবন সম্পর্কে প্রশ্নমূলক সমাজ সচেতনতা তাঁর ছোটগল্প রচনার অন্যতম প্রেরণা। তাই তার প্রকাশভঙ্গি সরল হতে পারে না। আম পাঠকের দরবারে তাই তাঁর গল্প দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। আবার, অন্য কয়েকটি গল্পে দেখি –

    “ আমি কি করেছি? আমাকে তোমরা মারছো কেন?
    লক্ষ্য ছিল কপালের মাঝখানে। নিশানা ভুল হওয়ায় গুলি ছিটকে কানের চামড়া ছিঁড়ে দিল।
    একের বেশি দুই খরচের ইচ্ছে বা সময় কোনটাই হয়ত ছিল না। নীলোৎপল বেঁচে গেল।
    সবটুকু ভুল লক্ষ্যবস্তু এবং লক্ষ্যভেদে। ”
    ( আততায়ী )

    কিংবা

    “ অবশেষে সে প্রলয়কে ন্যাংটো হতে বাধ্য করল।
    ছুরির ডগায় মাখন। প্রলয়কে বলল, চেটে নাও।
    একটা শিশুও জানে এক্ষুনি ওর জিভ কেটে যাবে। রক্তারক্তি কান্ড বিল্বদলের রক্ত সহ্য হয় না। ”
    ( হননকথা )

    অথবা,

    “ নিলাদিত্য পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বের করে চেয়ারের পেছনে মজুমদারের হাত দুটো বাঁধে।
    এক ফালি কাপড় বেরোয় বাঁ পকেট থেকে। চোখ বাঁধে। চার ইঞ্চি খোলার শব্দে মজুমদার মরিয়া চেষ্টা করে – চার লাখ।
    একটুও লাগবেনা। নিলাদিত্য ছুরি ঠেকায়।
    পাঁচ লাখ, দশ লাখ, শালাকে সরিয়ে তোমাকে ফরটি পার্সেন্ট থলে থেকে আপেল বের করে চার ইঞ্চিতে কাটে। শসা, কলা, আঙ্গুর টুকরো টুকরো করে কাটে। চারটে ডিম ফাটিয়ে হলুদ কুসুম মাখায়। প্যাকেট ফুটো করে দুধ ঢালে, টেবিলে দুধ গড়ায়, দুধ লাল হয়, হলুদ কুসুমে লাল রং। আপেল কলা শসার টুকরো সব রক্তবর্ণ।
    বেসিনের কলে ছুরি ধুয়ে পকেটে ঢোকায়। মজুমদারের বিস্ফারিত মুখে ছোটবেলার হাসি।
    নিলাদিত্য দরজা খুলে শিস দিতে দিতে নামতে থাকে। পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ায়। রাস্তায় নেমে ডাকে – ট্যাক্সি।
    ( হন্যমান )

    ‘আততায়ী’ গল্পে নীলোৎপলকে খুন করতে এসেছে গালে লাল জড়ুলওয়ালা অজ্ঞাতনামা আততায়ী। ‘হননকথা’ গল্পে বিল্বদল খুন করতে এসেছে প্রলয়কে, আবার ‘হন্যমান’ গল্পে পেশাদার খুনি নিলাদিত্য খুন করতে এসেছে মজুমদারকে। তিনটি গল্পের বহিরঙ্গের সাদৃশ্য এটাই, তবে তিনটি গল্পেই হননকারী ও হন্যমানের যে ডিসকোর্স তা ফ্রয়েডিয় মনস্তত্ত্বের আলোকে বিচার্য। হত্যা করা অথবা নিহত হওয়াই কি মানুষের নিয়তি! বিশেষ করে ‘হননকথা’ গল্পটির পোস্টমডার্নিটি পাঠককে বিস্মিত করে।

    যৌনতার অতৃপ্তিই কি মানুষের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তোলে! নাকি এই সমাজের কালেক্টিভ অবক্ষয়ই মানুষের মধ্যে দ্বিচারিতা মিথ্যাচার করার প্রবণতাকে জাগিয়ে তোলে! গল্পগুলির আনুষঙ্গে খোদ তপনকর নিজেই এক জায়গায় বলেছেন, “খুন, খুনি, হত্যা, হত্যাকারী, সম্ভাব্য হত্যাকারী ও তার শিকারের মধ্যে সম্পর্ক আমার লেখার বিষয়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে লাগল।”

    তপনকর মনে করেন, “প্রথা বা ছক একটি খাঁচা, তার বাইরে শিল্পীকে বেরোতেই হবে। নতুন গতিপথের সন্ধান করা সাহিত্যের চিরকালীন চরিত্র।”

    অন্য একটি গল্পে দেখি,
    “ আমার বউ, বুঝলি, খুব খারাপ…
    একটু আগেই, কিরে চিনতে পারছিস না আমি মহাদেব… সেই যে
    কি হলো ভাই? গাড়ি আসবে তো?
    কথাগুলো একজনই বলছে। নাম মহাদেব। মোহনলাল রীতিমত লেজে গোবরে। চিনতে পারছে না – মহাদেব নামে সে যাকে চেনে – এ অবশ্যই সে নয়। ”
    ( মহাদেব )

    একটি গল্পের শুরু থেকেই পাঠক্রিয়ায় এরকম আগ্রহ তৈরি করা একজন শিল্পীর কাজ। ভূমিকাটুকুতে বোঝা যাচ্ছে দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দেখা হয়েছে যার ফলে একজন নিঃসংকোচে উচ্চারণ করছে তার স্ত্রী খুব খারাপ ! কিভাবে খারাপ, কতটা খারাপ এসব ঘিরে পাঠকের মধ্যে টান টান আগ্রহ তৈরি হয়। গল্প নির্মাণের এই কৌশলটিকে বলে, Attraction created by the upper surface of the text বা আখ্যানের ওপরতলার টান। আমি এটিকে বলি, ‘বয়ানের বৈঠকখানার আকর্ষণ’। কোন বাড়ির বৈঠকখানার মনোরম ছিমছাম পরিবেশটি দেখে খানিকক্ষণ বসার আগ্রহ হয় এমনকি তক্ষুনিই উঠে পড়তে ইচ্ছেও হতে পারে। সাহিত্যবস্তুর ক্ষেত্রেও তাই। মুখপাতেই এরকম টানটান আগ্রহ তৈরি করে ফেললে সাহিত্যবস্তুটিকে পাঠক আঁকড়ে ধরবে। সুচারুভাবে নির্মিত এই গল্পটি নিয়ে আরো অনেক কথা বলার লোভ হচ্ছে। কিন্তু পাছে ভাবী পাঠকের প্রতি অবিচার করে ফেলি, তাই আপাতত এটুকু বলা যাক, এই অসাধারণ মর্মস্পর্শী গল্পটি পাঠককে বেদনার্ত করবে। সিদ্ধি শুঁকলে নেশা হয় না, সিদ্ধি খেতে হয়। পাঠকরা গল্পটি পড়ে নিন।

    আবার, ধ্বসে পড়া মধ্যবিত্ত জীবন, মধ্যবিত্ত মানসের ছবি দেখি আর একটি চমৎকার ‘ডেডবডি’ গল্পে,
    “তিরিশ বছর আগে যেদিন বাচ্চু পিনুর কাছ থেকে এ গল্পটা শুনেছিল তার একটু আগেই বিটলের ডেডবডি নিয়ে একটা দল চলে গেছিল। সেদিন পিনুর চোখ থেকে জল গড়াতে দেখে বাচ্চু জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি ওকে চিনতে?’
    সে কথার উত্তর না দিয়ে পিনু বলেছিল, শ্মশানে যাওয়া উচিত ছিল। দূর সম্পর্কের দাদা, ওর পয়সায় অনেক চা বিস্কুট খেয়েছি।
    এক চুমুকে কাঁচের গ্লাসে চা শেষ করে আঙুল ঢুকিয়ে তলানিতে পড়ে থাকা চিনির সবটুকু তুলে এনে চোখ বন্ধ করে গোপাল চাটতে থাকে আর ভুটানকে বলে, ‘ যা যা বললাম, সব কিন্তু বাচ্চু আমাকে বলেছিল। জল মেশানো মনে হলে – সে ধর যদি তোর মনে হয়ও দোষের কিছু নেই। সেদিন সকালে বুঝলি, পিনুর ডেড বডি দেখে বাচ্চু কেঁদে কেটে একশা। আমাকে নিয়ে ওই সাত সকালেই বেসমনির ঠেকে। এর মধ্যে ব্লাডার থেকে চোলাইয়ের ফার্স্ট কাট পেটে ঢুকেছে, তো সেই গল্পে যদি একটু জল থাকে, দোষের কিছু নেই।’ ”
    ( ডেডবডি )

    তুলির নিপুণ আঁচড়ে ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত নাগরিক যাপনের স্থূলতা ও কুশ্রীতাগুলি।

    অন্য একটি গল্পে দেখি, “আমি টিভির ভিতরে ঢুকে পড়ি। মিছিলে পা মিলিয়ে আমিও এগিয়ে চলি। হঠাৎ একটানা গুলির শব্দ। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই, ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই আমার কপালে পুলিশের লাঠি, -- হাত ধরুন কমরেড – একটা বাড়ানো হাত, -- আমি আঁকড়ে ধরতেই দেখি ক্যাবলা স্মৃতি পাঠাগারের ক্যাবলাদার হাত আমাকে টেনে তুলছে। — দৌড় লাগা, আমার বাড়িতে চল, তোকে ফার্স্ট এইড দিতে হবে। ক্যাবলাদার ঘরে অনেক মানুষ। আমার বাবা-মা, কাকা, জ্যাঠা, ভাই, বোন। মা বলছে টিভি বন্ধ কর। ক্যাবলা ঘুমোবে। টিভির আলো বৃত্তাকারে ছোট হতে হতে একটা মাকড়সা হয়ে যেতেই আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম। মা, মাগো। আমি তক্তপোশে শুয়ে পড়ি। ”
    ( জন্মদিন )

    এবার, অন্য আরেকটি গল্পে (মকরধ্বজ) পড়ি, “ল্যাংড়ার হাতে একটা সবজি কাটার ছুরি। কথা পছন্দ না হলে গলা কেটে দেওয়াই তার কাজ। এই কাজের জন্য দীর্ঘদিন তাকে জল্লাদ বলা হতো। এখন সে সমাজসেবী একটু আগেই একজন ধর্ম আচরণ নিয়ে কথা বলার সময় কথা প্রসঙ্গে জল্লাদ শব্দটা উচ্চারণ করায় ল্যাংড়া তার গলা কেটে ফেলেছিল। ল্যাংড়ার অসহিষ্ণুতা আর সহ্য করতে না পারার অক্ষমতার জন্য সে খাতির পায়, তাকে ভয়ে এবং ঘৃণায় সকলেই মান্যিগন্যি করে। তার গলা কাটার পদ্ধতি এতটাই অভিনব, ধড় থেকে মাথা আলাদা হলেও মৃত্যু হয় না। শুধুমাত্র হাতে অথবা কাঁধে ইচ্ছেমতো মাথা বহন করতে হয়। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনেও অসুবিধা হয় না।
    কিন্তু গুলি পিস্তলের যুগে মাথা কাটার বিষয়টা নিয়ে আপত্তির কথা একজন বলছিল। কাটা মাথার ভার বহন করে বেঁচে থাকা কষ্টকর। বিকল্প ব্যবস্থা চালু হলে ল্যাংড়ার গুরুত্ব বাড়বে না কমবে ঠিক করতে না পেরে লোকটার গলা না কেটে দৌড়াদৌড়ি করছিল।……….
    মাথা উঁচু করে বাঁচার সক্ষেপ যদি না থাকে এটা একটা চমৎকার ব্যবস্থা। এর জন্য যা ক্ষতিপূরণ এবং ভাতা পাওয়া যাবে একজন মানুষ সচ্ছন্দে তার পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে পারবে। আর মাথা বহন করা সে তো অভ্যাস !”

    না! সাম্প্রতিক ভাতা বিতর্ক নিয়ে লেখকের এই বিদ্রুপ কিনা সে বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা বরং গল্পটির অন্য অংশে যাই — লেখা মানে তো শুধু ঘটিত বাস্তব বা ঘটমান বাস্তবের কথকতা নয়, আজকের গল্পে চাক্ষুষ বাস্তবতাকে উবিয়ে দিয়ে অসদ বাস্তবের একটা কাঁথা কম্বল গল্পের গায়ে চাপাতে হয়। নতুন শতকের লেখার আবেদন শুধু হৃদয়ের কাছে নয়, মগজের কাছেও!

    “গভীর রাতে মকরধ্বজ তার প্রিয় নদীর পাশে এসে দাঁড়াল। তার হাত বহন করছিল তারই মাথা। কেউ যা কখনো করেনি হাত থেকে মাথাটা ছুড়ে দিয়েছিল নদীর জলে। নদীতীরে মকরধ্বজের মৃত ধড় পড়েছিল।”

    হাংরি, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী, ছোটগল্প নতুন রীতি, লাতিন আমেরিকান জাদুবাস্তবতা প্রভৃতি নানা স্তর অতিক্রম করে বাংলা গল্প আজ যথেষ্ট পরিণত।

    তপনকর ভট্টাচার্য কোন ঘরানায় প্রভাবিত?

    লেখকের কপালে একটা ট্যাগ না এঁটে দিলে আমাদের শান্তি হয় না! ‘ছোটগল্প নতুনরীতি’ আন্দোলনকারীদের তত নয়, বরং তাঁদের অনুকারীদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল এক ধরনের আঙ্গিক সর্বস্বতা। এই অনুকারীদের মনে হয়েছিল, গল্পহীন গল্প লেখাই সারকথা।

    তাঁরা বুঝতে পারেন নি, আঙ্গিক যখন সমাজের নির্যাসকে ধরার প্রণালী হয়ে ওঠে না, তখন তার আধুনিকতার দাবি ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যায়!

    সামান্য পরবর্তী সময়ের ছোট গল্পের আন্দোলন সাহিত্যের সামাজিক দায় শুধু অস্বীকারই করে নি, সেই আন্দোলনের শরিক গল্পকাররা জানিয়েছিলেন বাস্তবতায় তাঁরা ক্লান্ত। সচেতনভাবে তাঁরা সচেষ্ট হয়েছিলেন গল্পকে যথাসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলতে। অন্তরাত্মার জটিল অনুভবকেই তাঁরা করে তুলতে চেয়েছিলেন গল্পের বিষয়, আদৌ যদি কোন বিষয় থেকেই থাকে! কিন্তু এই বাস্তববিমুখতা শেষ অব্দি পাঠকের চোখের মণি হয়ে দাঁড়ায় নি।

    তপনকরের গল্প ছোট্ট খাটো, বাগবিস্তারহীন। আমার মনে হয়, নিটোল গল্প বলাকে পাখির চোখ করাও যেমন ভালো নয়, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত বর্ণনা, লোকসংস্কৃতির বিবিধ প্রসঙ্গ, আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত, ইতিহাস, ভূগোল, মনোজগতে ডুবে যাওয়া একটা পর্যায়ের পর নিছক তথ্যের সমাবেশ মনে হতে থাকে যা গল্পটির ভাঁজে ভাঁজে পলি জমিয়ে নিম্নপ্রবাহের নদীর মতোই গল্পটিকে মন্থরা ও পৃথুলা করে।

    শিল্পের পর্যাপ্ত শর্ত পূরণ করার দায় হয়তো লেখকের নেই তবে একটি অন্যতম শর্ত হলো পাঠকের আগ্রহ টানটান রাখতে হয় শেষাবধি। চারটি দশক ধরে লেখালেখিতে তপনকর সে দক্ষতায় কুশলী তা বলার অপেক্ষা রাখে না! সঙ্গী বিশেষ কেউ নাইবা হলো!

    বব ডিলানের প্রফেটিক উক্তি ধার করে বলাই যায়, “You don't need a weatherman to know which way the wind blows.”

    ২১ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে বাংলা কথাসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য তেমনই কোন ড’য়ে বিসর্গ ওয়ালা পন্ডিতের দরকার নেই। তপনকর ভট্টাচার্যের মতন একজন লেখক আর দেবাশিস সরকারের মতন একজন সাধারণ আলোচক থাকলেই যথেষ্ট !

    ###############
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Naresh Jana | ১২ জুন ২০২৪ ০০:০২533043
  • দারুণ বলেছেন!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন