গর্বের মাস?- এই যে এই বিপুল পৃথিবী, নানা জায়গায় নানা মানুষ, নানা ধর্ম-সংস্কৃতি, নানা ধরনের মন মানসিকতা, সেই মিশ্রণে মিশে আছি আমি, আমরা; দিকে দিকে মানুষের দিগন্ত, জীবের চেতনার দিগন্ত নিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে, আলো-অন্ধকার-ছায়ার খেলা চলেছে নিরন্তর আমাদের চিত্তলোকে।
এখন পৃথিবীতে বড়ো সুখের সময় নয় সত্যি। জরতী পৃথিবীর অন্নপাত্র নিঃশেষপ্রায়, দিকে দিকে চিতার আগুনের হল্কা মুখে এসে লাগে, পোড়া মাংসের গন্ধে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, গরম বাতাসের দীর্ঘনিশ্বাসে চোখের জল ও শুষে নেয় উষর মাটি, তারি মধ্যে চিৎকৃত শিবারব আমাদের চিত্ত বৈকল্য ঘটায়, সত্য-সুন্দর-শিব, শান্ত-শুভ-অদ্বৈতের যে শ্বাশ্বত আদর্শ মানুষের তার বিপরীতে এমন শ্রীহীন কুৎসিত অশ্লীল স্ব-প্রদর্শনী ও তীব্র সম্ভোগপ্রবণতা, শ্মশানের মধ্যে একনাগাড়ে উচ্চনিনাদে নিজেকে বিজ্ঞাপিত/পণ্যায়িত করার ও অপরকে 'অপর' বানানোর আর দাবিয়ে রাখার এমন বিষম প্রবণতা চিরন্তন মানবপ্রকৃতির অন্তরাত্মাকে পর্যন্ত কলুষিত করে তোলে, ক্রমশ যেন মুক্তির দুয়ারগুলি বাইরে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মনে হয়।
তাই এবার, এইসব ব্যাক্তিগত ও বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়গুলির মুহূর্তে ফিরে তাকাই আপন অন্তরের পানে, প্রথম প্রথম আলো ঠেকে না অনভ্যস্ত চোখে-মন বিমর্ষ ও বিরূপ হয়ে ওঠে, আপন চিত্তদৈন্যের ধিক্কারে মন বিকল হয়ে আসে, সব আশাই যেন হারায় অতল আঁধারে।
কিন্তু জানি, আছে আনন্দনিকেতন, নিজের মধ্যেই আছে-কত দূরে জানিনা, কিন্তু তারি মলয় বাতাস কখনো গায়ে এসে লাগে বৃষ্টির পরের বসন্তবিকালের দখিনা বাতাসে, একলা রাতের গভীর ভেজায়, বুদ্ধপূর্ণিমার রাতের চাঁপা-গন্ধরাজ-রজনীগন্ধার সুবাসে। প্রকৃতি নিরুত্তাপ, নির্বিকার আমাদের এই একলা প্রাণের গোপন সব দুঃখ, মানবের নিরন্তর সংঘর্ষ আপন সত্তার সাথে-আদিমের সাথে অর্বাচীনের, বর্বরের সাথে সুন্দরের, সত্যের সাথে মোহের, জ্ঞানের সাথে মূঢ়তার, তথ্যনিষ্ঠার সাথে সংস্কারের, বিশ্বাসের সাথে সংশয়ের, গর্বের সাথে লজ্জার এই যে সব সতত ক্রিয়াশীল দ্বান্দ্বিক বিরোধ-সমন্বয়, আমাদের ক্রমেই মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে বা ভাঙছে- তার সাথে আপাত সম্পর্করহিত এই বিস্তৃত বহিঃপ্রকৃতি।
কিন্তু এ আপনার এবং আমাদের অজানিতে আমাদের অন্তঃপ্রকৃতিকে নিয়ত আলোড়িত ও প্রভাবিত করছে- আমাদের সৌন্দর্যপিপাসু মনে সৌন্দর্যবোধকে জাগিয়ে তুলছে জ্যোৎস্নাদীধিতি বিধৌত পূর্ণিমা বা জীবের প্রাণরক্ষার সংগ্রাম আর জীবনের অনিত্যতা সম্বন্ধে অহরহ সচেতন করে তুলছে এই বিশাল পার্থিব সংহারযজ্ঞ- যেখানে কেবলি বিভেদ জীবের সাথে জীবের মৌলিক প্রকৃতিতে, একের উপর অন্যের এই অধিকার স্থাপনের প্রয়াস প্রেম-প্রীতি বা হিংসার আশ্রয়ে, এসবকিছুই নিত্যই আমাদের অবচেতনে নব নব ভাব, ভাবনা, জিগীষার উন্মেষ ঘটাচ্ছে- তাই বাহ্যপ্রকৃতি ও মানবের অন্তঃপ্রকৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে সংশ্লিষ্ট।
এবার তাই ফিরে চাইছি মানবের হিংসা-রিরংসা-প্রণয়-ক্ষোভ দীর্ণ জগৎ থেকে আপন নিভৃত অন্তর্জগৎটির পানে, আর এই সসাগর জীবের, সৌন্দর্যের ও বিরাটের আকর এই বহু বৈচিত্র্যময় পৃথিবী, তারও সীমানার বাইরে যে মহাবিশ্ব তার নৈসর্গিক আলো-অন্ধকারের পানে, ইন্দ্রিয়াতীত সব অনুভব, প্রজ্ঞা এবং বোধির পানে।সেখানে হোক আমাদের সত্য আশ্রয়- যে বাহ্যিক বিরুদ্ধশক্তিগুলি ক্রমাগত খর্ব করছে মানবের মহতী শ্বাশ্বতী অধিকারগুলিকে, অবমাননা করছে মানবের পরমসত্তার, সেগুলির বিপ্রতীপে আমাদের অভিযান হোক কঠোর, বন্ধুর পথে, মলিনতা, অসত্য, ভীতি, বাইরের কলঙ্ক ও অন্তরের লজ্জা ত্যাগ করে আমাদের নিভৃত সাধনা হোক ক্রমশ সেই বিরাট মানুষটি হয়ে ওঠার যে আমাদের অন্তরে সুপ্ত এবং গুপ্ত, প্রবুদ্ধ এবং প্রকাশিত হবার ঐকান্তিক প্রতীক্ষায়। বাইরের ক্ষুদ্রতা যেন আমাদের অন্তরের ঐশ্বর্যগুলিকে ম্লান না করে, হাটের ধুলা মার্জনা করতে পারি যেন নির্জনে সুরধুনীর ধারায়, মলিন বসনখানি ত্যাগ করে প্রেমের বসনখানি যেন নিতে পারি নিজদেহে, আর সমবেতভাবে উপনীত হতে পারি সেই সত্যের পথে দেবযানে, ব্যাষ্টিসত্তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও যেন মিলতে পারি সমষ্টির মাঝারে, একাত্মভাবে প্রার্থনা করতে পারি-" অপাবৃণু"; হে বিরাট, হে উদার, উন্মোচিত কর হিরন্ময় আবরণ, সত্যের মুখটি, দুয়ারটি খুলে দাও, "তমসো মা জ্যোতির্গময়" অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও এবং আলোর জ্যোতিতে চোখ ধাঁধিয়ে ভুলিয়ে দিয়ো না, নিয়ে চলো আলো-অন্ধকার, শুভ-অশুভ, শুচি-অশুচি, অজ্ঞান-জ্ঞানের দ্বৈতের পরপারে অদ্বৈতে, তোমার প্রকাশ হোক আমাদের মাঝে ও আমরাও প্রকাশিত হই তোমার আলোকে, জগতের সবকিছুই আমাদের দৃষ্টিতে তোমার জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
এই গর্বের মাসের সূচনায়, বাইরের এই ক্লেদ, গ্লানি আর কদন্নের মুষ্টিভিক্ষার থালি ত্যাগ করে যেন উপভোগ করতে পারি ভূমাব্যাপিত তোমার এবং তার সাথে এক ও অভিন্ন একক আমার ও সম্মিলিত সকলের আনন্দকে, স্থিত হই স্ব-তে, আমাদের গর্ব হোক তোমারি গর্ব হে নাথ, হে জীবনস্বামী, এই গর্ব হউক আমাদের অন্তে-তোমারে চেয়েছি, চেয়েছি নিজেকে, বহন করেছি সুকঠিন দায়িত্বের ভার মনুষ্যত্বের, নিজেদের, আপন সত্যে, অনন্তের মাঝে, বাইরের জীর্ণতা, দীনতায় মানবনা অন্তরের নিত্য মানবের পরাজয় , মর্যাদার পরাভব। ক্ষুরধার শঙ্কিল পঙ্কিল বাট, কিন্তু পেরিয়ে যেন যাই হে প্রভু, পেরিয়ে যেন যাই এই নিজেরই ওপর, আমাদের ওপর, তোমার ওপর দৃঢ় বিশ্বাসে ভর করে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।