এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কুরআনের, আলাদীনের ও জৈনদের জিন - কি ভিন্ন?

    Argha Bagchi লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ মে ২০২৪ | ৪৯৮ বার পঠিত
  • জৈন ধর্ম এক প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম, সম্ভবত বৈদিক যুগেরও আগে তাদের উৎপত্তি। এমনটাই বলেছেন রাধাকৃষ্ণণ তাঁর গবেষণা গ্রন্থে। জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর, যাঁরা জিন নামেও পরিচিত। জিন থেকেই জৈন শব্দের জন্ম। যদিও ঐতিহাসিক গণনায় প্রথম বাইশ জন জিনের অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়।

    আমরা জৈন ধর্মের ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে হয়ত জানতে পারব ভারতের প্রাগৈতিহাসিক জীবনের প্রগতি সূত্র। একটা দৃষ্টান্ত দিই। দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের জন্ম হয়ত বস্ত্র বয়ন আবিষ্কার কালের সমসাময়িক ঘটনা। প্রাচীনপন্থী অহিংসবাদীরা বস্ত্র উদ্ভাবনকে আদর্শহীনতা বলে পরিহার করেছিলেন। ফলে বিপ্লব ও দুই সম্প্রদায়ের জন্ম। জৈনরা নির্গ্রন্থ নামেও প্রসিদ্ধ, কেননা গ্রন্থ তাদের পরবর্তী কালের আবিষ্কার। যদিও সুবৃহৎ জৈন সাহিত্য ভারতীয় ইতিহাসের মূল্যবান দলিল, যার যথাযথ বিশ্লেষণ ও গবেষণা এখনো সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

    তীর্থঙ্কররা যে তীর্থ করতেন তা তাঁদের নাম থেকেই সহজে বোঝা যায়। এ সেই সময়ের কথা যখন তীর্থ করতে গেলে পাসপোর্ট ভিসা পারমিশন কিছুরই দরকার হত না। ফলে তাঁদের পদব্রজে ভ্রমণ বর্তমান রাজনৈতিক সীমানা মেনে যে চলত না, সে কথা বলা বাহুল্য। সুতরাং স্থলপথে সংযুক্ত বিস্তারিত দেশেবিদেশে তাঁদের ছড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। তাঁরাই প্রথম শ্রমণ। দিকে দিকে জিন বাণী প্রসার সেভাবে হওয়া সম্ভব।

    জিন শব্দের অর্থ বিজেতা, 'যে জিনিয়া লয়'। আবার জিন অর্থে জ্ঞানও বোঝায়। জৈন ধর্ম প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও যুক্তির ধর্ম। এতে ঈশ্বরের কোন ধারণা নেই। সকল মানুষের মধ্যেই জিন হবার ক্ষমতা আছে। জ্ঞান অর্জন করে সেই স্তরে পৌঁছানো যায়। অন্তরের বা মনের ভিতরকার শত্রুদেরকে জয় করে জিন হওয়া যায়। জিন হলে সে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ সোপানে উত্তীর্ণ হয়, পার্থিব কোনকিছুই তার নাগালের বাইরে থাকে না। তাই জৈন ধর্মে জিনের স্থান সবার উপরে, যার পরিণতি মোক্ষ, বা মুক্তি।

    পুরাকালে কেবল যে ভারত ভূখণ্ড থেকেই তীর্থঙ্কররা বাইরে যেতেন তা নয়, বাইরের লোকও এখানে আসতেন। আরব ব্যবসায়ীরা ভারতের পথ পেরিয়ে সুদূর চিনেও যেতেন ব্যবসা করতে। অন্তত ইসলামের জন্মের আগেই এদেশের সাথে আরবের ব্যবহারিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। ফলে ভারতীয় জিনের ধারণা আরবে আর পারস্যেও যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল সে কথা না বললেও চলে। প্রাক-ইসলামিক আরবে জিন একটি পরিচিত ধারণা ছিল। হয়ত তারা তাদের মত করে জিন ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল। ফলে, জিনের দার্শনিক তত্ত্ব তারা না বুঝলেও জিনের চারিত্রিক গুণাবলী তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতই আকর্ষণীয় ছিল।

    এতটাই সে আকর্ষণ যে পরবর্তীতে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ সংকলনের কালেও একটি সম্পূর্ণ সুরাহ্ (৭২তম অধ্যায়, ২৮টি আয়াত) জিন বিষয়ে আলাদাভাবে রাখা হয়।

    এর প্রথম দুটি আয়াত শুরু হচ্ছে এভাবে -
    ১। বল: আমার প্রতি অহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরাতো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি –
    ২। যা সঠিক পথ নির্দেশ করে; ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের রবের সাথে কোন শরীক স্থির করবনা। [অনুবাদ: শেখ মুজিবর রহমান, সূত্র: quran.com]

    লক্ষণীয়, জিনদের একটি দল, যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে পরিচিত, তাদের উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে। পরবর্তী আয়াতগুলি থেকে জানা যাচ্ছে যে, তিনি (রব) উচ্চ মর্য্যাদার কেননা তিনি অকৃতদার ও নিঃসন্তান, অতএব ব্রহ্মচারী ও নিষ্কাম। সেই জিনের দল এও জানাচ্ছে যে কিছু লোক জিন-এর স্মরণ নিত, ফলে জিন-দের অহঙ্কার বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসত, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা সেই কাজ করতে গেলেই তাদের জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়। (৩ থেকে ৯)।

    এখানে ব্যক্ত সামাজিক চিত্রের দিকে যদি মনোযোগ দেওয়া যায়, তাহলে জিনপন্থীদের সাথে আল্লাহ্‌পন্থীদের তৎকালীন বিরোধের সন্ধান পাওয়া যায়। কেউ ব্রহ্মচারী ও অকৃতদার হলে যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হবে, এটা দিগম্বর জৈন সম্প্রদায়ের একটি মূল ধারণা। কেবল তাই নয়, জিন-সম্প্রদায়ের অন্ততঃ একটা দল যে উদারতার পরিচয় দেখিয়েছিল, সে কথাই এখানে লিপিবদ্ধ আছে। পরের আয়াতগুলিতে বলা হচ্ছে, সেই আত্মসমর্পণকারী জিনের দল বুঝতে পেরেছে তারা পালিয়ে বাঁচতে পারবে না, আল্লাহ্‌-র প্রতি বিশ্বাস রাখলেই তাদের কোন ক্ষতি বা জোর-জবরদস্তির আশঙ্কা থাকবে না। অবিশ্বাসীরা (সে জিন-পন্থী হোক বা না হোক) জাহান্নমের ইন্ধন। (১০-১৫)।

    এর পর ১৬ থেকে ২৪ আয়াতে বিশ্বাসীদের কি কি করা উচিত সেই বর্ণনা রয়েছে, যেমন উপাসনাস্থলে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কাউকে তার শরিক করা হবে না ইত্যাদি। ২৪ নম্বর আয়াতটি উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা হচ্ছে, "যখন তারা প্রতিশ্রুতি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা বুঝতে পারবে, কে সাহায্যকারীর দিক দিয়ে দুর্বল এবং কে সংখ্যায় স্বল্প।" তার মানে, এই আত্মসমর্পণকারী জিন-দের দলকে কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, লোকবল ও বাহুবলের নিরিখে। অতঃপর শেষ চারটি আয়াতে রসুল-এর অধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

    উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আরবে ইসলাম-প্রবর্তনকালীন সময়ে যথেষ্ট প্রভাবশালী জিনপন্থীরা ধীরে ধীরে সমাজের ওপর তাদের প্রভাব হারাচ্ছিল। অর্থাৎ, আরো পিছনে গেলে তাদের প্রাক্‌-ইসলামিক সামাজিক মান্যতা আমরা সহজেই ধারণা করে নিতে পারি।

    জিনদের এই জনপ্রিয়তা বা সামাজিক সচ্ছলতা ও গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণেই তাদের নিয়ে প্রবাদ ও রূপকথার জন্ম হওয়া সম্ভব ছিল, এবং তারই একটা রূপ আমরা খুঁজে পাই পারসিক ও আরবিক রূপকথা 'আলাদীন ও জাদু-চিরাগ' নামক অতি পরিচিত গল্পে। সেখানে জিন যেন কল্পতরু। সেই গল্পে ভাল জিন যেমন আছে, খারাপ জিনও আছে। এবং জিনেদের পরিচয় সেখানে ধোঁয়াশাময়। একটা সম্ভ্রমের দূরত্ব থেকে তাদের দেখা হয়েছে। তার মানে, এই গল্পের জন্মের পর লোকমুখে বিবর্তন হতে হতে যখন একটা স্থির রূপে পৌঁছেছে, ততদিনে আরবের জিনজাতি তৎকালীন আধুনিক সমাজে বিস্মৃত, কিন্তু সমাজের সার্বিক স্মৃতিতে তাদের ক্ষমতার কথা তখনও সুবিদিত, বরং অতিরঞ্জিত।

    জাদুর দেশ ভারত ও চীন থেকে সুদূর আরবে প্রাচীন জৈনদের ঐতিহাসিক বিস্তার ও প্রভাব আলাদাভাবে গবেষণার যোগ্য একটি বিষয় হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এই বিষয়ে আপনাদের মূল্যবান মন্তব্য জানতে পারলে সমৃদ্ধ হব।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :|: | 174.25.***.*** | ১৪ মে ২০২৪ ০০:৫৭531693
  • ইসলামের জ্বীন আর জৈনের জিন একই নাকি? জান্তুমনা।  
  • &/ | 151.14.***.*** | ১৪ মে ২০২৪ ০২:৫৮531699
  • 'নির্গ্রন্থ' শব্দের অর্থ জানতাম গ্রন্থিহীন। অর্থাৎ কিনা গ্রন্থি মানে গিঁট নেই। মানে বস্ত্র( যা গিঁট দিয়ে পরতে হয়) হীন।
  • &/ | 151.14.***.*** | ১৪ মে ২০২৪ ০৩:০২531700
  • ইসলামের জ্বিনজাতি তো অন্য জানতাম। তাঁরা নাকি কোহকাফ নগরীতে থাকেন। আল্লাহ তাঁদের বানিয়েছিলেন আগুন থেকে। আদমজাদ অর্থাৎ কিনা মানুষ বানিয়েছিলেন মাটি থেকে। কিন্তু জৈনধর্মের জিন তো অন্য। মহাবীর জিন যেমন।
  • :|: | 174.25.***.*** | ১৪ মে ২০২৪ ০৩:২৫531703
  • এই লেখাটি গুরুর ক্লাসিকে ঠাঁই পাবার যোগ্য। 
    "জৈনরা নির্গ্রন্থ নামেও প্রসিদ্ধ, কেননা গ্রন্থ তাদের পরবর্তী কালের আবিষ্কার।" :D
    এবং তাঁরা সুপন্থ নামেও পরিচিত কারণ পুঁথি তাদের পূর্ববর্তী কালের আবিষ্কার। 
    অবশ্যই তাঁরা মানে জিন এবং জ্বীনরা সকলেই গুরু ছিলেন তাই থেকেই তো এসেছে শিখদের গুরুগ্রন্থসাহিব।
    এইরকম আরও কতভাবে যে লেখাটির শিবরামীয় পরিবর্ধন করা যায়! 
  • Argha Bagchi | ১৪ মে ২০২৪ ০৮:১০531707
  • জৈন ধর্ম এক প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম, সম্ভবত বৈদিক যুগেরও আগে তাদের উৎপত্তি। এমনটাই বলেছেন রাধাকৃষ্ণণ তাঁর গবেষণা গ্রন্থে। জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর, যাঁরা জিন নামেও পরিচিত। জিন থেকেই জৈন শব্দের জন্ম। যদিও ঐতিহাসিক গণনায় প্রথম বাইশ জন জিনের অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়।

    আমরা জৈন ধর্মের ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে হয়ত জানতে পারব ভারতের প্রাগৈতিহাসিক জীবনের প্রগতি সূত্র। একটা দৃষ্টান্ত দিই। দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের জন্ম হয়ত বস্ত্র বয়ন আবিষ্কার কালের সমসাময়িক ঘটনা। প্রাচীনপন্থী অহিংসবাদীরা বস্ত্র উদ্ভাবনকে আদর্শহীনতা বলে পরিহার করেছিলেন। ফলে বিপ্লব ও দুই সম্প্রদায়ের জন্ম। জৈনরা নির্গ্রন্থ নামেও প্রসিদ্ধ, কেননা গ্রন্থ তাদের পরবর্তী কালের আবিষ্কার। যদিও সুবৃহৎ জৈন সাহিত্য ভারতীয় ইতিহাসের মূল্যবান দলিল, যার যথাযথ বিশ্লেষণ ও গবেষণা এখনো সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

    তীর্থঙ্কররা যে তীর্থ করতেন তা তাঁদের নাম থেকেই সহজে বোঝা যায়। এ সেই সময়ের কথা যখন তীর্থ করতে গেলে পাসপোর্ট ভিসা পারমিশন কিছুরই দরকার হত না। ফলে তাঁদের পদব্রজে ভ্রমণ বর্তমান রাজনৈতিক সীমানা মেনে যে চলত না, সে কথা বলা বাহুল্য। সুতরাং স্থলপথে সংযুক্ত বিস্তারিত দেশেবিদেশে তাঁদের ছড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। তাঁরাই প্রথম শ্রমণ। দিকে দিকে জিন বাণী প্রসার সেভাবে হওয়া সম্ভব।

    জিন শব্দের অর্থ বিজেতা, 'যে জিনিয়া লয়'। আবার জিন অর্থে জ্ঞানও বোঝায়। জৈন ধর্ম প্রত্যক্ষ প্রমাণ ও যুক্তির ধর্ম। এতে ঈশ্বরের কোন ধারণা নেই। সকল মানুষের মধ্যেই জিন হবার ক্ষমতা আছে। জ্ঞান অর্জন করে সেই স্তরে পৌঁছানো যায়। অন্তরের বা মনের ভিতরকার শত্রুদেরকে জয় করে জিন হওয়া যায়। জিন হলে সে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ সোপানে উত্তীর্ণ হয়, পার্থিব কোনকিছুই তার নাগালের বাইরে থাকে না। তাই জৈন ধর্মে জিনের স্থান সবার উপরে, যার পরিণতি মোক্ষ, বা মুক্তি।

    পুরাকালে কেবল যে ভারত ভূখণ্ড থেকেই তীর্থঙ্কররা বাইরে যেতেন তা নয়, বাইরের লোকও এখানে আসতেন। আরব ব্যবসায়ীরা ভারতের পথ পেরিয়ে সুদূর চিনেও যেতেন ব্যবসা করতে। অন্তত ইসলামের জন্মের আগেই এদেশের সাথে আরবের ব্যবহারিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। ফলে ভারতীয় জিনের ধারণা আরবে আর পারস্যেও যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল সে কথা না বললেও চলে। প্রাক-ইসলামিক আরবে জিন একটি পরিচিত ধারণা ছিল। হয়ত তারা তাদের মত করে জিন ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল। ফলে, জিনের দার্শনিক তত্ত্ব তারা না বুঝলেও জিনের চারিত্রিক গুণাবলী তাদের কাছে রূপকথার গল্পের মতই আকর্ষণীয় ছিল।

    এতটাই সে আকর্ষণ যে পরবর্তীতে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ সংকলনের কালেও একটি সম্পূর্ণ সুরাহ্ (৭২তম অধ্যায়, ২৮টি আয়াত) জিন বিষয়ে আলাদাভাবে রাখা হয়।

    এর প্রথম দুটি আয়াত শুরু হচ্ছে এভাবে -
    ১। বল: আমার প্রতি অহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরাতো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি –
    ২। যা সঠিক পথ নির্দেশ করে; ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনও আমাদের রবের সাথে কোন শরীক স্থির করবনা। [অনুবাদ: শেখ মুজিবর রহমান, সূত্র: quran.com]

    লক্ষণীয়, জিনদের একটি দল, যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বলে পরিচিত, তাদের উল্লেখ করে বলা হচ্ছে যে তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে। পরবর্তী আয়াতগুলি থেকে জানা যাচ্ছে যে, তিনি (রব) উচ্চ মর্য্যাদার কেননা তিনি অকৃতদার ও নিঃসন্তান, অতএব ব্রহ্মচারী ও নিষ্কাম। সেই জিনের দল এও জানাচ্ছে যে কিছু লোক জিন-এর স্মরণ নিত, ফলে জিন-দের অহঙ্কার বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শোনার জন্য বসত, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা সেই কাজ করতে গেলেই তাদের জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়। (৩ থেকে ৯)।

    এখানে ব্যক্ত সামাজিক চিত্রের দিকে যদি মনোযোগ দেওয়া যায়, তাহলে জিনপন্থীদের সাথে আল্লাহ্‌পন্থীদের তৎকালীন বিরোধের সন্ধান পাওয়া যায়। কেউ ব্রহ্মচারী ও অকৃতদার হলে যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হবে, এটা দিগম্বর জৈন সম্প্রদায়ের একটি মূল ধারণা। কেবল তাই নয়, জিন-সম্প্রদায়ের অন্ততঃ একটা দল যে উদারতার পরিচয় দেখিয়েছিল, সে কথাই এখানে লিপিবদ্ধ আছে। পরের আয়াতগুলিতে বলা হচ্ছে, সেই আত্মসমর্পণকারী জিনের দল বুঝতে পেরেছে তারা পালিয়ে বাঁচতে পারবে না, আল্লাহ্‌-র প্রতি বিশ্বাস রাখলেই তাদের কোন ক্ষতি বা জোর-জবরদস্তির আশঙ্কা থাকবে না। অবিশ্বাসীরা (সে জিন-পন্থী হোক বা না হোক) জাহান্নমের ইন্ধন। (১০-১৫)।

    এর পর ১৬ থেকে ২৪ আয়াতে বিশ্বাসীদের কি কি করা উচিত সেই বর্ণনা রয়েছে, যেমন উপাসনাস্থলে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কাউকে তার শরিক করা হবে না ইত্যাদি। ২৪ নম্বর আয়াতটি উল্লেখযোগ্য। এখানে বলা হচ্ছে, "যখন তারা প্রতিশ্রুতি প্রত্যক্ষ করবে তখন তারা বুঝতে পারবে, কে সাহায্যকারীর দিক দিয়ে দুর্বল এবং কে সংখ্যায় স্বল্প।" তার মানে, এই আত্মসমর্পণকারী জিন-দের দলকে কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, লোকবল ও বাহুবলের নিরিখে। অতঃপর শেষ চারটি আয়াতে রসুল-এর অধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

    উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, আরবে ইসলাম-প্রবর্তনকালীন সময়ে যথেষ্ট প্রভাবশালী জিনপন্থীরা ধীরে ধীরে সমাজের ওপর তাদের প্রভাব হারাচ্ছিল। অর্থাৎ, আরো পিছনে গেলে তাদের প্রাক্‌-ইসলামিক সামাজিক মান্যতা আমরা সহজেই ধারণা করে নিতে পারি।

    জিনদের এই জনপ্রিয়তা বা সামাজিক সচ্ছলতা ও গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণেই তাদের নিয়ে প্রবাদ ও রূপকথার জন্ম হওয়া সম্ভব ছিল, এবং তারই একটা রূপ আমরা খুঁজে পাই পারসিক ও আরবিক রূপকথা 'আলাদীন ও জাদু-চিরাগ' নামক অতি পরিচিত গল্পে। সেখানে জিন যেন কল্পতরু। সেই গল্পে ভাল জিন যেমন আছে, খারাপ জিনও আছে। এবং জিনেদের পরিচয় সেখানে ধোঁয়াশাময়। একটা সম্ভ্রমের দূরত্ব থেকে তাদের দেখা হয়েছে। তার মানে, এই গল্পের জন্মের পর লোকমুখে বিবর্তন হতে হতে যখন একটা স্থির রূপে পৌঁছেছে, ততদিনে আরবের জিনজাতি তৎকালীন আধুনিক সমাজে বিস্মৃত, কিন্তু সমাজের সার্বিক স্মৃতিতে তাদের ক্ষমতার কথা তখনও সুবিদিত, বরং অতিরঞ্জিত।

    জাদুর দেশ ভারত ও চীন থেকে সুদূর আরবে প্রাচীন জৈনদের ঐতিহাসিক বিস্তার ও প্রভাব আলাদাভাবে গবেষণার যোগ্য একটি বিষয় হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এই বিষয়ে আপনাদের মূল্যবান জানতে পারলে সমৃদ্ধ হব।
  • Argha Bagchi | ১৪ মে ২০২৪ ০৮:১৪531708
  • উপরের মন্তব্যে ভুল করে মূল লেখাটা চলে গেছে। কর্তৃপক্ষ দয়া করে ডিলিট করে দিলে সুবিধা হয়।
  • Argha Bagchi | ১৪ মে ২০২৪ ০৮:১৫531709
  • @ &/ আপনি ঠিক কথাটাই জানেন, নির্গ্রন্থ শব্দের অর্থ গ্রন্থিহীন। অনুরূপে গ্রন্থ শব্দের অর্থ গ্রন্থিযুক্ত। যা গাঁথা হয়েছে (যেমন মাল্য, পুস্তক ইত্যাদি)। এখানে আমি গ্রন্থ বলতে পুস্তক এবং নির্গ্রন্থ বলতে যাঁরা পুস্তকহীন তাঁদেরকে নির্দেশ করতে চেয়েছি। ঠিক যেমন বেদ অলিখিত ছিল বলে তার অপর নাম ছিল শ্রুতি। এবং লক্ষণীয়, আমি কোন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি করতে চাইনি, আমি নতুন সম্ভাবনার ধারণা (assumption) বিষয়ে স্রেফ উদাহরণ দিতে গিয়ে এভাবে বলেছি। সুতরাং দিগম্বর-বস্ত্র-নির্গ্রন্থ-কেতাব ইত্যাদি অংশ সেভাবেই বুঝতে হবে, facevalue তে নয়।

    দ্বিতীয়ত কোহকাফ নগরীর বাসিন্দা আগুন থেকে বানানো জ্বীনজাতি বিষয়ে আপনার জানাতেও কোন ফাঁক নেই।  কিন্তু ভেবে দেখুন, আগুন থেকে যাদের বানানো হয়েছে, তারা জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডকে ভয় পাবে কেন? এগুলো আসলে অপ্রিয় অপর গোষ্ঠীর জন্য রক্ষিত বিশেষণ। যেমন, আমার বিরোধী শিবিরের লোকজনকে আমি বলতে পারি, তারা জন্মেছে ঘোড়ার ডিম থেকে। তাতে দুই দলের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বটাই  প্রকট হয়, সত্য পরিবর্তিত হয় না।
  • dc | 2402:e280:2141:1e8:89ce:2eb9:de70:***:*** | ১৪ মে ২০২৪ ০৮:১৭531710
  • এই জিনরা যখন একসাথে পরিভ্রূমনে বেরোতেন তখন কি তাঁদের জিনস বলা হতো? 
  • Argha Bagchi | ১৪ মে ২০২৪ ০৯:০৭531712
  • @ :।: আপনার উৎসাহ দানের ভঙ্গী অসাধারণ। গ্রন্থ বিষয়ে বক্তব্য উপরের মন্তব্যে জানিয়েছি। সুপন্থ ও পুঁথি এক উৎস থেকে যে আসছে না, সেটা জেনেই আপনার অতিশয়োক্তি, যেমন জিন গুরু ও গ্রন্থসাহেবের গুরুচন্ডা৯। লিখে ফেলুন। লিংক দিন। পড়ে বিচার করা যাবে তা শিব্রামীয় না আদিত্যযোগীয়, কোনটা হল। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে না গেলে আর আড্ডা কিসের।
  • syandi | 45.25.***.*** | ১৮ মে ২০২৪ ২৩:৩৭531929
  • জিন (দৈত্য অর্থে), জিন (জৈন ধর্মের  সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থে), জীন (ঘোড়ায় চড়তে লাগে যেটা) বা জিন ( বংশগতির ধারক ও বাহক) সবই এক জিনিস। একাধিক জিন তা সে একই টাইপের হোক বা বিভিন্ন টাইপের হোক একসাথে থাকলেই তখন জিন্স ফ্যাব্রিক, সেটা ডিসি বলেই দিয়েছেন। 
  • &/ | 107.77.***.*** | ১৮ মে ২০২৪ ২৩:৫৫531931
  • জিন্সের প্যান্টশার্ট পরে ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ুন ।টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে জিন সেন্টারে গিয়ে আপনার জিন পরীক্ষা করান দেখে নিন আপনি কোহকাফের জিন নাকি আলাদ্বীনের প্রদীপের জিন নাকি জৈন জিন নাকি জিন্দার ভাই জিন । নাকি মোটে জিনই নন। কিন্তু তাহলে জিন পেলেন কোথায় পরীক্ষা করানোর জন্য ?  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন