এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পোষা ভূত ও ভয়াল তান্ত্রিকদের কথা - ৫

    Sudip Ghoshal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২২৪ বার পঠিত
  • | | | | | | |
    মন থেকে থেকে যদি বিচিত্র আওয়াজ শোনেন ফাঁকা বাড়িতে, তবে নিশ্চিত হন, সেটা ছুঁচোর কীর্তি বা বিড়ালের ডাক কি না। তাতে যদি সন্দেহ না-মেটে, তবে সাবধান। আর একটা ব্যাপারেও তিনি খেয়াল রাখতে বলেছেন, যদি হঠাৎ হঠাৎ বাড়ির ভিতরে শীত বোধ হয় গরমকালে, তা হলে সমস্যা রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, সামান্য ঠান্ডা অনুভব করা মানেই তেনারা এসে গিয়েছেন, তা একেবারেই ঠি নয়।হঠাৎ কোনও বিশেষ গন্ধ পাওয়া। গন্ধপিশাচ হতে পারে।  মতে, । বিশেষত, আপনার কোনও অনুপস্থিত প্রিয়জনের সুবাস যদি ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে ধাক্কা মারে, তা হলে সাবধান। গন্ধটা খুবই সন্দেহজনক বলে জানবেন। তান্ত্রিক  এবার বললেন একটি নতুন গল্প। এক নরখাদকের কাহিনী। সারা পৃথিবী জুড়েই নরখাদকদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের পাওয়া গেছে ফিজি, আমাজন অববাহিকা, আফ্রিকার কঙ্গোতে। এমন কি নিউজিল্যান্ডের মাওরি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিলেছে নরখাদকের সন্ধান। ইউরোপের হল্যান্ডেও সন্ধান পাওয়া গেছে।শোনা যায় উগান্ডার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক ইদি আমিনও নাকি নরখাদক ছিলেন।প্রত্যেকটি মানুষকে খাওয়ার পর সর্দার রাতু উদ্রে উদ্রে তার শিকারের স্মৃতিতে একটি করে পাথর সাজিয়ে রাখতো। তারপর খেয়ালখুশি মত গুনতে বসত, এ পর্যন্ত কটা মানুষ খেল সে। সে চাইত তার মৃত্যুর পর তাকে যেন এই পাথরগুলির পাশে কবর দেওয়া হয়। হয়েছিলও তাই। মৃত্যুর পর উদ্রে উদ্রেকে উত্তর ভিটিলেভুর এলাকার সেই পাথরের স্তূপের মধ্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।উদ্রে উদ্রের উদরে যাওয়া সমস্ত হতভাগ্যই ছিল, ফিজির আদিবাসী গোষ্ঠী সংঘর্ষে হেরে যাওয়া যুদ্ধবন্দী। এছাড়া, উদ্রে উদ্রের দলে থাকা রাকিরাকির অনান্য আদিবাসী সর্দাররা তাদের জীবিত বন্দী ও মৃত শত্রুর দেহ উদ্রে উদ্রের হাতে তুলে দিত। মৃতদেহগুলির সৎকারের জন্য নয়, স্রেফ খাওয়ার জন্য।লিথ সাহেবকে উদ্রে উদ্রের ছেলে রাভাতু বলেছিল,  তার বাবা মানুষের মাংস ছাড়া আর কিছু খেত না। এবং  তার নরখাদক বাবা হতভাগ্য মানুষদের পুরো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আগুনে ঝলসে খেত। একেবারে একটা দেহের সব মাংস খেতে না পারলে অর্ধভুক্ত দেহ্টি একটা বাক্সে তুলে রাখত। কিন্তু পরে পুরোটা খেয়ে নিত।সেই মৃত মানুুষের আত্মাগুলো এখন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারপর ঘুরতে ঘুরতে একদিন সেই নরখাদকের গলা টিপে ধরে এবং সেই আপনাদের হাতেই তার মৃত্যু হয় তাকে পাওয়া যায় ছিন্নভিন্ন একদম টুকরো-টুকরো অবস্থায় তার হাত-পা সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন আঙুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এমনই পরিণতি তার একদম সত্যি ঘটনা বাবুরা...পাহাড়ের উপরে বসে আমরা এই সব কথাগুলো শুনছিলাম তারপর সন্ধ্যে হয়ে গেলে আমরা ফিরে এলাম পিসেমশায় বন্ধুর বাড়িতে তারপর খাওয়া-দাওয়া করে ঠিক এগারোটার সময় শুয়ে পড়লাম বন্ধু আমাদের একটা আলাদা ঘর দিয়েছিল তিনজনকে পেশায় ছিলেন আমরা মেঝেতে বসে ছিলাম তারপর ঠিক বারোটার সময় আমরা দেখলাম আমাদের মশারির ভেতরে কত মশা। অনেক মশা জমা হয়েছে। পিসেমশায় বলছেন এত মশা কেনরে? তখন বললাম যে মশাগুলো মারা উচিত কমে যাবে।পিসেমশাই বললেন দাঁড়া তাড়াহুড়ো করিস না। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে তারপর দেখলাম তিনি সাধনায় বসলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মশা কমে গেল।পিসেমশাই কিন্তু সাধনা ভেঙে উঠলেন না তিনি মারণ, উচাটন  শুরু করলেন।এক ঘন্টার পরে পিছনের ঘর থেকে বন্ধু চিৎকার করে বললেন, কেন রে এত রক্ত কেন? ঘরের মধ্যে দেয়ালে ট উপর দিয়ে রক্ত নেমে আসছে নিচে।পিসেমশাই চুপ করে থাকলেন কোন উত্তর দিলেন না পরদিন সকালে উঠে আমাদের নিয়ে ব্যাগ নিয়ে একদম বাইরে বেরিয়ে এলেন তখন পিছনে বন্ধু বলছেন এই নে  জল খেয়ে যাবি । পিসেমশাই বন্ধুকে বললেন খুব সাবধান আবার যদি আমি পাঁচ মিনিট দাঁড়ায়, তোর কিন্তু জীবনের সংশয় হবে।তারপর পিসেমাশায়ের বন্ধুটি   আর কোন কথা বলল না।আমরা সকলে বাইরে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।রতন বললো,  বাবা রে, এমন জায়গায় ঢুকেছিলাম কি করে বেরিয়ে আসবো চিন্তা করছিলাম।পিসেমশায় বললেন ওকে আর কোন দিন ঘুরে এইসব লোকের ক্ষতি করতে হবে না। তার কারণ তিনদিনের মধ্যেই পঙ্গু হয়ে যাবে।আমরা ওদের গ্রামের একটা লোকের মুখে অনেকদিন পর শুনেছিলাম  লোকটি নাকি পঙ্গু হয়ে বসে আছে। পিসেমশায় বললেন, ইয়ার্কিকা কথা নেহি,সিরিয়াস ব্যাপার হ্যায় তন্ত্র জগতমে।তিনি বাংলা হিন্দী মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ী ভাষা তৈরি করেন আমাদের হাসাবার জন্য। রতন কাছেই ছিলো। পিসেমশাই বললেন, কি রতন কিছু বলবে? রতন বললো, আমি বোকা। অত কিছু বুঝি না। কিন্তু আপনার সঙ্গে থাকতে ভালো লাগে। কত কিছু শেখা যায়।পিসেমশায় বললেন, বিদুরের নাম শুনেছো?  আমি বললাম, হ্যাঁ উনি তো পন্ডিত ছিলেন। ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। 

    ১৩

    রতন বললো, বিদুর মহাভারত মহাকাব্যে ধৃতরাষ্ট্রের ভাই। আসলে তিনি ছিলেন দাসিপুত্র। পিসেমশাই বললেন, হ্যাঁ আরও অনেক ঘটনা আছে। তবে সে প্রসঙ্গে না গিয়ে তাঁর বাণীগুলো বলি। কিছু শিখতে পারবে। তিনি বলতেন, যার মধ্যে অনেক জ্ঞান আছে সে জ্ঞানী। আর জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বুদ্ধিমান। আর যারা তার সঠিক ব্যবহার করতে পারেন না তাঁরা বোকা। যে মানুষ সফল সে সমস্ত নেতিবাচক ভাবনা থেকে বহুদূরে থাকে। আর জীবনের প্রথম দিন থেকে বেড়ে ওঠাই তাঁদের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে তাঁরাই বুদ্ধিমান। কিন্তু বোকা মানুষ চিনতে গেলে তার কিছু লক্ষণ রয়েছে। যাঁদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো রয়েছে তাঁরাই বোকা। ধৃতরাষ্ট্রের সৎভাই বিদুর মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি বলে গেছেন বোকা মানুষের সাতটি লক্ষণ রয়েছে। এখন দেখা যাক সেগুলি কী কী১ যে ব্যক্তি সর্বদা অজান্তে আত্মঅহংকার নিয়ে বাস করেন এবং পরিশ্রম না করেই ধনী হতে চান। এ জাতীয় ব্যক্তিকে বোকা বলা হয়। যে ব্যক্তি তাঁর নিজের কাজ ছেড়ে অন্যের কর্তব্য পালন করেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। তাঁরা বোকা।  এ ছাড়া যারা সর্বদা ভুল কাজ করে চলেন তাঁদের বোকা বলা হয়।এমন ব্যক্তি যে নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দাবি করে এবং নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান লোকের সঙ্গে শত্রুতা করে। সেই ব্যক্তিকে বোকা বলে মনে করা হয়।যে ব্যক্তি তার শত্রুকে বন্ধু তৈরি করে এবং তার জন্য বন্ধুদেরও ত্যাগ করেন। যাঁরা ভুল সংস্থাকে অবলম্বন করেন তাঁদেরই বোকা বলা যায়।যে ব্যক্তি নিজেকে সবোর্চ্চ দেখানোর চেষ্টা করেন তাঁদের বোকা বলা হয়। যে ব্যক্তি ভুল করে অন্যকে দোষারোপ করে এবং সর্বদা তার ভুলগুলি আড়াল করার চেষ্টা করে এমন ব্যক্তিকে মূর্খ বলা হয়। যে ব্যাক্তি নিজের বাপকে অসম্মান করে এবং অজ্ঞ লোককে প্রাধান্য দেয় তাকে বোকা বলে। রতন বললো, পিসেমশাই তন্ত্র সম্পর্কে সমগ্র জ্ঞান আপনার আছে আমরা জানি। যদি এই সমুদ্রজলের একচামচ জলের ধারণা করতে পারি তো ভালো লাগবে। আর আমাদের প্রয়োজনেও লাগতে পারে। পিসেমশাই কম্ববলের  আসনে বসে আমাদের চারদিকে গঙ্গার জল ও মন্ত্র পড়ে গন্ডি কেটে নিয়ে বললেন, যেখানে সেখানে এইসব মন্ত্র পড়তে নেই। তাই স্থানশুদ্ধি করে নিলাম। তারপর তিনি শুরু করলেন তার কাহিনী। তন্ত্র- ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু গভীর তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্র হল এক বৃহৎ ও অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, তন্ত্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। শিব ও মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলিকেও তন্ত্র সাধনা নামে অভিহিত করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে তন্ত্র সাধনার বিকাশ লাভ করে। গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র ভারতের অতিপ্রাচীন এবং গুরু পরম্পরার একটি গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। এটি গুরু পরম্পরা বিদ্যা বলে প্রকৃত গুরুর খোঁজ করতে হয়। দীক্ষা ছাড়া এ শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে কেউ কাউকে কিছু ব্যক্ত ভারতের আদি ও অকৃত্রিম তন্ত্র সাধনার জায়গা হল নীলাচল পর্বত। যা 'কামাখ্যাধাম' নামে পরিচিত। তন্ত্র এমনই একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায়। নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়।তন্ত্র শব্দটির অর্থ ব্যাপক ।

    ১৪

    তান্ত্রিক পিসেমশাই বললেন,  সংক্ষেপে তন্ত্র হচ্ছে "সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম " । মহাদেব বা শিবের ডমরু থেকে তন্ত্রের উৎপত্তি । সতী বা দেবি দূর্গার দশ হাতে আছেন দশ মহাবিদ্যা । এই দশমহাবিদ্যার উপর ভিত্তি করেই অনেকটা তন্তশাস্ত্র গড়ে উঠেছে । তন্ত্রের বিষয়টা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । সাধারনভাবে, তন্ত্র অসীম জ্ঞানের আধার । সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনা রিসার্চ করলে দেখা যায়, যা অবিদ্যাকে গ্রাস করে তাই জ্ঞান । তন্ত্র জ্ঞানচক্ষু উম্মোচন করে ।সৃষ্টির কারন বুঝতে সাহায্য করে তন্ত্র । তন্ত্র সৃষ্টি , স্থিতি ও বিনাশের পরিচালনা শক্তি । ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিন শক্তির পরিচালনা নিয়ম ব্যাক্ত করে তন্ত্র ।তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত আছে মন্ত্র ,যন্ত্র । তন্ত্র সাধনায় সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে । আমি বললাম, একটু বিশদে বলুন। তিনি বললেন, হ্যাঁ তোমরা এখন সাবালক। সব বলা যাবে আশা করি। তন্ত্রমতে মদ, মোহ, মাৎসর্য এই নিয়ে সংসার। নারীর ভূমিকা তন্ত্র সাধনায় অপরিসীম।বায়ুরুপ লিঙ্গকে শূণ্যরুপ যোনীতে প্রবেশ করিয়ে কুম্ভক আসনে সাধনা করতে হয় সাধককে। খুব কঠিন সাধনা। চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী,  ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে 'চৈতন্যময়ী' বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল। কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে।রতন বললো, এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।

    ১৫

    পিসেমশায় বললেন, চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। 

    রতন বললো, আমার বাবা বলেন এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক।

    পিসেমশাই বলেন, ঠিক  পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ"।।এর তাৎপর্যঃ হলো "হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক"।

    ১৬

    আমি বললাম আপনি আজ মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলবেন বলেছেন।

    পিসেমশাই বললেন মাংসাধনা  হচ্ছে, "মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী"।মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। "গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়"।আমি বললাম, তাহলে এই সাধনায় মাছ, মাংস, নারী, মদ সবকিছুর প্রয়োজন আছে। পিসেমশায় বললেন, ধারণা আরও পরিষ্ককার করতে হবে। এই সাধনা এইরকম।"...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন"।মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা "বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন"। আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, "মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে"।যে 'সাধারণ' লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, "...সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন"। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় 'মৈথুন' কখনই 'কদর্য, কুৎসিত' বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, "...আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ 'র' এই বর্ণে আকারের সাহায্যে 'ম' এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে"।শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ - তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য, সেখানে 'তত্ত্বাদিন্যাসের' নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম 'ষড়ঙ্গসাধন' এবং শিবের ইচ্ছায় একে 'অতীব গোপন' মোহর দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া "কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে"। অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন অধরা হয়ে গেল এবং  তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত চক ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না। শুদ্রজন ও নারী এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান লাভ করত। সাধনযোগিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ  বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের  পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। এসবে মতান্তর থাকতে পারে। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্র, খর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা,  নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়।শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশু আচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু' প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম ।বিভিন্ন দেবতা এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ , কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ড এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট করেন। এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন। উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে। এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। গুরুকে সর্বশাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছেশিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।এক আধটা উদাহরণ দিই। '

    ১৭

    পিসেমশাই বললেন এসব কথা সব জায়গায় বলতে নেই। আমি বললাম, না বললে আমরা জানব কি করে। পিসেমশাই বললেন, এখন তো জানা সহজ। গুগুল এর দয়া ছাড়া আছে কত বই।পড়তে হবে। শুনতে হবে বেশি।পিসেমশাই বললেন,   কালীবীজ' মন্ত্র, 'বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বর্ণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এইভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' 'হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।তন্ত্রসাধনে 'গ্রহণ'-এও সিদ্ধিলাভ সম্ভব। হিন্দু শাস্ত্রে 'গ্রহণ' নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে। এবার জেনে নিন, কী কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে,চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি: চাইলে গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে শ্রীযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। যন্ত্রের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন। গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পঞ্চোপচারে শ্রীযন্ত্রের পুজো করুন। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন: 'ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ'। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।মামলায় জয় লাভ: সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। একই সঙ্গে পুজোর পর একটি তিনমুখী রুদ্রাক্ষও যন্ত্রের সামনে রাখতে হবে। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: 'ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা'।তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি: পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি হলুদ, বড়ো, দাগহীন পাতিলেবু নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে লেবুটিকে চার টুকরোয় কেটে ফেলুন। এবার সেই চারটি টুকরো চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসুন।ভূ-লোকে রিদ্ধি-সিদ্ধি লাভের জন্য একটি মহাকুঞ্জিকা রচনা করেন মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গুপ্তমন্ত্র। এই মন্ত্র পাঠ করলে মারণ, মোহন, বশীকরণ এবং উচ্চাটন ইত্যাদি উদ্দেশের সিদ্ধি হয়।এই মন্ত্রটি হল-- ওম এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্বালয় জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে জ্বল হং সং লং ক্ষং ফট্ স্বাহা।নমস্তে রুদ্ররুপিণ্যৈ নমস্তে মধুমর্দিনী। নমঃ কৈটভহারিণ্যৈ নমস্তে মহিষার্দিনী।। নমস্তে শুম্ভহন্ত্রয়ৈ চ নিশুম্ভাসুরঘাতিনী।। জাগতং হি মহাদেবী জপং সিদ্ধং কুরুষ্ব মে। এংকারী সৃষ্টিরুপায়ৈ, হ্রীংকারী প্রতিপালিকা।। ক্লীংকারী কামরুপিণ্যৈ বীজরুপে নমোস্তু তে। চামুণ্ডা চণ্ডঘাতী চ য়ৈকারী বরদায়িনী। ভিচ্চে চাভ্যদা নিত্যং নমস্তে মন্ত্ররুপিণি।। ধাং ধীং ধূং ধূর্জটেঃ পত্নী বাং বীং বুং বাগদীশ্বরী। ক্রাং ক্রীং ক্রুং কালিকা দেবী শাং শীং শুং মে শুভং কুরু।। হুং হুং হুংকাররুপিণ্যৈ জং জং জং জম্ভনাদিনী। ভ্রাং ভ্রীং ভ্রুং ভৈরবী ভদ্রে ভবান্যৈ তে নমো নমঃ।। অং কং চং টং তং পং য়ং শং বীং দুং এং বীং হং ক্ষং ধিজাগ্রং ধিজাগং ত্রোটয় ত্রোটয় দীপ্তং কুরু কুরু স্বাহা।। পাং পীং পূং পার্বতী পূর্ণা খাং খীং খূং খেচরি তথা।। সাং সীং সুং সপ্তশতী দেব্যা মন্ত্রসিদ্ধিং কুরুষ্ব মেব।। ইদং তু কুংজিকায় দেবী হীনাং সপ্তশতীং পেঠত্‍‌। ন তস্য জায়তে সিদ্ধিররণ্যে রোদং যথা।।দুর্গা-মন্ত্রে দূর হবে সব বিপত্তি। রতন বললো, কেউ যদি  দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়, তার থেকে মুক্তির মন্ত্র আছে ?বা পারিবারিক কলহ রাতের ঘুম কেড়েছে ?

    ১৮

    পিসেমশাই  বললেন, এসব আমার ইইন্টারনেটের দৌলতে জানা জ্ঞান।  তা হলে এই দুর্গা মন্ত্রীগুলি জপ করলে সমস্ত বিপত্তি দূর হবে।পরিবারে সুখের বাস হবে।দারিদ্রতা এবং দুঃখ ইত্যাদি দূর করতে, দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি। দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণি কা ত্বদন্যা সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্রচিত্তা।।আমি বললাম,  কলহ, অশান্তি দূর করে ভালোবাসা বৃদ্ধির জন্য  উপায় আছে?  তিনি বললেন আছে। ধাং ধীং ধূং ধূর্জটে পত্নী ।বাং বীং বূং বাগধীশ্বরী।।ক্রাং ক্রীং ক্রূং কালিকা দেবী। শাং শীং শূং মেং শুভং কুরু।।সুশীল এবং বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন স্ত্রীর প্রাপ্তির জন্য, ভার্য্যাং মনোরমাং দেহি। মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্।রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।তারিণি দুর্গসংসার-সাগরস্যাচলোদ্ভবে।রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।রতন বললো,  কোনও বিপত্তির হাত থেকে বাঁচতে?  তিনি বললেন, আছে সব আছে। তার মন্ত্র হলো, শূলেন পাহি নো দেবী পাহি খড়গেন চাম্বিকো। ঘণ্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিঃস্বনেন চ।।প্রসন্নতা প্রাপ্তির জন্য,প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবী।বিশ্ববার্তিহারিণি।ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।।মন্ত্র-গুণে সমস্যা সমাধান কে না জানে, জীবন ইক্যুয়ালটু রকমারি সমস্যা! তা বলে লাগাতার সমস্যায় ভুগতে কার ভালো লাগে! অনেকেই জানেন না, যেমন হরেক কিসিমের সমস্যা আছে তেমনি তার নানা সমাধানও রয়েছে। আর সে সবই হয় মন্ত্রগুণে। তবে মন্ত্রে বিশ্বাস রাখতে হবে। শান্ত মনে জপ করতে হবে। সঙ্গে ধূপ জ্বালাতে পারলে আরও ভালো। তবেই ফল মিলবে। এবং মন শুদ্ধ করতে প্রথমে আরাধ্য দেবতা, গণেশ, গুরুদেব বা মহাদেব-কে স্মরণ করতে হবে।এমনও হয়, দোষ না করেও আপনি দোষের ভাগীদার হয়ে যান। আর অকারণে লাঞ্ছিত হওয়ায় মন অস্থির হয়ে ওঠে। এই অসুবিধে দূর করতে জপ করুন 'ওঁ হ্রিং ঘৃণীঃ সূর্যায় আদিত্য শ্রী ওঁ হ্রিং জূং সঃ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'।কোনও গ্রহের প্রভাবে সব সময় ভয় বা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। এমন আশঙ্কাও হয় যে, ঘর থেকে বের হলেই ভয়ানক ক্ষতি হবে। তখন ঈশ্বরকে স্মরণ করে জপ করবেন 'ওঁ জূং সঃ পালয় পালয় সঃ জূং ওঁ ওঁ ওঁ'।কর্মক্ষেত্রে উন্নতি চাইলে জপ করুন, 'ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ,তত্সবিতুর বরেণ্যং,ভর্গো দেবস্য ধীমহি, ধিয়ো যোনঃ প্রচোদয়াত্‍ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'।কোনও অঘটনের সম্মুখীন হয়ে যদি মৃত্যুভয় মনে আসে প্রথমে বলুন, 'ওঁ হ্রিং জূং সঃ'। তারপর বলুন, ওঁ ত্রম্বকং যজামহে,সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্, উর্বারুকমিব বন্ধনান্, মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্'।।মন যখন প্রচণ্ড চঞ্চল হয়ে ওঠে. কিছুতেই বশে থাকে না, তখন শান্ত করতে এই মন্ত্র জপ করুন, 'ওঁ দ্বৌঃ শান্তিরন্তরিক্ষক্ষং শান্তি পৃথ্বী শান্তিরাপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তি, বনস্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বেদেবাঃ শান্তির্ব্রহ্ম শান্তিঃ, সর্ব শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি,ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি'।হতে হতে কোনও হওয়া কাজ মাঝপথে আটকে গেলে জপ করুন, 'দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম,রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি'।

    ১৯

    রতন বললো, এগুলো সব জানলেন কি করে?  আপনাকে প্রণাম।

    পিসেমশায় বললেন, এর জন্য বিভিন্ন বই পড়তে হয়। মোবাইলে টিকটক আর ভিগো না দেখে গুগুলে সার্চ করলে অনেক পন্ডিতের লেখা থেকে এইসব জানতে পারবে শিখতে পারবে বিশদে। আমি তো সামান্য কটা কথা বললাম।

    অঘোরীরা পূজা করে শিবের। এছাড়াও মৃত্যুর দেবী কালীসাধনাও করে থাকে এরা। বারানসীর অঘোরী মেরোনাথ এক সাক্ষাৎকারে ফটোগ্রাফার এবং লেখক ডাভোর রস্তুহারকে বলেন, “হিন্দুবাদে প্রত্যেকটি প্রভুর একটিমাত্র রুপ থাকে। বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করে। তাদের মতো করে নৈবেদ্য প্রদান করে। শিব আর মা কালী যখন ভক্তদের কাছ থেকে বলী আশা করে, তখন ভক্তরা কিন্তু তা মান্য করতে নিরুৎসাহিতা দেখিয়ে থাকে। আমরাই একমাত্র গোত্র, যারা মা কালী এবং শিবের আশামতো নৈবেদ্য প্রদান করে থাকি।” পিসেমশাই বললেন, আর এক ধরণের তান্ত্রিকের নাম আছে। শিবরাত্রি পশুপতিনাথের মন্দিরে পৌঁছে গেলেই সাক্ষাৎ হয়ে যাবে অঘোরী সাধুদের সঙ্গে। দুর্গম পাহাড় থেকে এরা একে একে বেরিয়ে আসেন শিব পুজোর জন্য। অঘোরী বলতে মূলত বীভত্‍স আচারে অভ্যস্ত শৈব সম্প্রদায়কে বোঝায় যাঁরা মহাকালের তপস্যায় গভীরভাবে বুঁদ হয়ে আছেন। অঘোরীদের সাধন পদ্ধতি যেমন ভয়ানক তেমনই এরা প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। এরা বৃষ্টি বা খরার আহ্বান করতে পারেন যখন ইচ্ছে। ইচ্ছে মতো বদলে দিতে পারেন ঋতুচক্রও। আজও মণিকর্ণিকার ঘাটে অঘোরীদের দর্শন পেতে পারেন আপনিও। যদিও প্রবল শীতের সময় ছাড়া বছরের বাকি সময় হিমালয়ের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন এরা। এদের উপাসনা পদ্ধতিও খুব অদ্ভুত। মল, মূত্র, পশুর মাংস, মানুষের মাংস, মদ সবই কাজে লাগে এই ধরনের তপস্যায়।এরা নোংরা, আবর্জনা থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে ইতস্তত করে না। অস্বাভাবিক খাওয়া দাওয়াই নয়, এরা মৃত দেহের সঙ্গে সাধনার জন্য যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। এরা মৃতদেহ থেকে একধরনের তেল বের করেন যা দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ। টানা ১২ বছর কঠোর সাধনার পর অঘোরী গুরুর আশীর্বাদে নিজের ধর্মীয় যাত্রা শুরু করেন অঘোরী সাধুরা। আর তখনই জন্ম হয় এক চরম সাধকের। যাঁদের বস্ত্র হয় মৃত ব্যক্তির জামা-কাপড়ের ছেঁড়া অংশ। শরীরে থাকে মৃত দেহের ছাই। এখানেই শেষ নয়, এমন সাধকদের সারা জীবন একজন গুরুর অধিনে থাকতে হয়। প্রত্যেক অঘোরী সাধু কে একজন গুরুর অধীনে থাকতে হয়। গুরু যা বলেন, সেইভাবে জীবনযাপন করতে হয়। সংগ্রহ করতে হয় মৃতদেহের খুলি, যা তাঁদের সাধনার প্রধান উপকরণ। এরা মন্ত্রোচারণ করতে শুরু করলে শরীরে একজন মানুষকে গায়েও করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

    আমি বললাম, পৃথবীর কতটুকু আমরা জানি। পিসেমশাই  বললেন, খুব সামন্য অংশ। 

    রতন বললো, সামান্যই ব বললেন,  শ্মশানে শবের উপর বসে  অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। মহাদেব  হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ দেবতা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমূহে তিনিই একক রূপে ঘোষিত। শিব সৃষ্টি-স্থিতি ধ্বংসরূপে তিন কারণের কারণ, পরমেশ্বর- এটা তার প্রণাম মন্ত্রেই বার বার উঠে এসেছে। তিনি জন্মরহিত, শাশ্বত, সর্বকারণের কারণ; তিনি স্ব-স্বরূপে বর্তমান, সমস্ত জ্যোতির জ্যোতি; তিনি তুরীয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন।শিব ও শঙ্কর এই দুটি সবচেয়ে বেশি করে হিন্দু সমাজে ঘোরাফেরা করে। বিশেষ করে যারা ধর্মীয় ভাবাবেগকে দর্শন করে ঈশ্বর কল্পনায় মূর্ত হন তাদের কাছে শিব ও শঙ্কর নাম দুটি নিয়ে প্রবল ধাঁধা রয়ে গিয়েছে। মা কালি,  মা তারা,  ভবতারিণী সব এক শক্তি বাবা। ভিন্ন নামে তারা পরিচিত। 

    ২০

    আমি বললাম তান্ত্রিক সাধকরা বেশিরভাগ মা কালির সাধনা করেন জানি।  পিসেমশাই বললেন , মা কালি ও শিব ও শঙ্কর নামে আদল বা ধারণা পাওয়া যায় তিনি হলেন শিব।এঁরা আলাদা কেউ নন। ঈশ্বরের থেকেই উৎপত্তি সব শক্তির। 
    ধ্বংসের প্রয়োজনে এবং অত্যাচার নিরসনে বাবা মহাদেব শক্তিরূপিণী মা কালির রূপ তৈরি করেন। আবার শক্তি বিলীন হন তাঁর মধ্যে। ।  শিবপুরাণ এবং অন্যটি হল শৈবাগম শাস্ত্র পড়লে এসব জানা যায়।  শিব নামটি-র সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিবলিঙ্গের কথা। অন্যদিকে শঙ্কর নামটি হল ভগবানরূপে কল্পিত শিব-এর মানবরূপী পরিচয়। সুক্ষ্মদেহ স
    ম্পন্ন এক সত্তা। তধ্যানরূপেণ পূজিতর্ধচন্দ্র, কন্ঠে সর্পাহার এবং জটায় গঙ্গাকে ধারণ করেছেন।
    শঙ্করেরর মূর্তিকল্পে যে যে বিষয়গুলির উপরে নজর দিতে হয় সেগুলি হল অর্ধচন্দ্র, যা মাথার জটার মধ্যে থাকে। এর অর্থ হল জ্ঞানের প্রতীক। হাতে থাকে ডমরু। এর অর্থ হল অদ্বৈত। গলায় থাকে সাপের কুন্ডল। এর মানে এটি হল কুলকুন্ডলিনীর প্রতীক। ত্রিশূল কখনও ত্রিগুণ, কখনও ত্রিকাল, কখনও বা সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের যে তিন তত্ত্ব আছে তাকে ব্যাখ্যা করে। গঙ্গা বিশুদ্ধতার প্রতীক। যা বিশুদ্ধ জ্ঞানকে সংযোগ করে। তৃতীয় নয়ন মানে হল ত্রিকাল দর্শন। 

    দুই পুরাণ গ্রন্থে এমন কাহিনিও রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে শিব ব্রক্ষ্মার মাধ্যমে সত্যযুগের সৃষ্টি করেছিলেন। এবং শঙ্কর-কে তিনি মানবরূপে  নিয়ে এসেছিলেন কলিযুগে যাতে তিনি সৃষ্টি-কে সংহার করতে পারেন। তাই শিব ও শঙ্কর এক হলেও দুজনের নামের পিছনে রয়েছে দুই বিশেষ কাহিনি। তাই বলা হয় শিব হল দৈব্যভাবের প্রতীক। আর শঙ্কর মানে আদি ও বিমূর্ত রূপকেই বোঝায়। কিছু কিছু সামাজিক নিয়ম থাকে যা একটা সময়ের পর অগ্রাহ্য করলে কোন অসুবিধা হয় না। স্পষ্ট বোঝা যায় যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে, সেগুলো না মানলে তেমন কোন সমস্যা নেই। নারীদের শ্মশানে যাওয়া নিষেধ সংক্রান্ত যে সব কারণ রয়েছে, সেগুলোও তাই বর্তমান শহুরে সমাজে চলে গেছে অগ্রাহ্যের খাতে।

    তবে, অনেক অঞ্চলে এখনও কঠোরভাবে মেনে চলা হয় নারীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ না দেওয়ার নেপথ্য কারণগুলো! যার শুরুটা হয়েছিল রক্ষণশীলতার হাত ধরে।

    বর্তমান সময়ে শবদেহ বহন করার জন্য গাড়ি পাওয়া গেলেও বছর কয়েক আগে পর্যন্ত শ্মশানবন্ধুরা দেহ নিয়ে যেতেন কাঁধে করে। পথ দিয়ে মিছিল করে তারা পৌঁছতেন শ্মশানে। এটাই ছিল শবদাহের প্রথম ধাপ। শেষ সময়ে পাওয়া পরিজনের শেষ সেবা। কিন্তু রক্ষণশীলতা নারীকে পথে বেরনোর অনুমতি দেয় না। দিলেও, মিছিলে হাঁটার প্রশ্নই নেই। সেই জন্যই মূলত নারীর শ্মশানে যাওয়া নিষেধ করা হয়।

    তবে, এই সামাজিক প্রসঙ্গ বাদ দিলেও দেখানো হয় আরও পাঁচটি যুক্তি। তার মধ্যে কোনটা অমোঘ, কোনটা আংশিক সত্যি, কয়েকটা আদ্যন্ত অর্থহীন। কী কী, এবার এগোনো যাক সেই দিকে।

    ঘর পরিষ্কার রাখা: এই কারণটা অনেকটাই যুক্তিযুক্ত। দেহ অন্ত্যেষ্টির জন্য শ্মশানের দিকে চলে গেলে ঘর পরিষ্কার করাটা একটা বেশ বড়সড় কাজ। কেন না, মৃতদেহ থেকে জীবাণু সংক্রমণের ভয় থাকে। তাই ঘর-দোর ভাল ভাবে ধুয়ে-মুছতে হয়। এখন, এই ঘর পরিষ্কার রাখা, বলাই বাহুল্য, বরাবরই থেকে গেছে নারীদের খাতে। সেই জন্যই তাঁরা শ্মশানে যান না। বাড়ি পরিষ্কার করে যতটা সম্ভব দূর করে দিতে চান শোকের আবহ। তাছাড়া, হিন্দু অন্ত্যেষ্টি প্রথা অনুসারে শ্মশানযাত্রীরা বাড়ি ফিরলে তাদের দিকে এগিয়ে দিতে হয় লোহা-আগুন-নিমপাতা। শ্মশানবন্ধুদের আপ্যায়ন করতে হয় মিষ্টি দিয়ে। সেই সব কাজের জন্যও বাড়িতে কারও একটা থাকা দরকার!

    শ্মশানের ভীতিকর পারিপার্শ্বিক: বলাই বাহুল্য, শ্মশানের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য আদপেই মধুর হয় না। বরং, তা রীতিমতো ভয়াবহ। একের পর এক দাহের অপেক্ষায় থাকা দেহ, মৃতের পরিজনের কান্না, শোকাতুর মুখ, ডোম আর শ্মশান-পুরোহিতের দেহ সৎকারের নির্লিপ্তি- চোখের সামনে দেখা খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে যার প্রিয়জন দেহত্যাগ করেছেন, তার পক্ষে তো বটেই! এই জায়গা থেকেই নিষেধ করা হয়ে নারীদের শ্মশানে যাওয়া! আসলে, সবাই ধরে নেন, নারীরা মাত্রেই কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী। শ্মশানের ভয়াবহতা দেখে যদি সংবেনশীল মনে আঘাত লাগে, যদি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন- এসব ভাবনা-চিন্তা থেকেই জারি হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া আরও একটা গুরুতর কারণ রয়েছে। যে সময় থেকে এই নিয়মের প্রচলন, তখন দাহ হত কাঠের চিতায়। অনেক সময়েই চিতায় দাহর সময় শব আগুনের উত্তাপে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কখনও বা উত্তাপে দেহ উঠে যায় কিছুটা। ঠিক যেন মনে হয়, শব চিতায় উঠে বসেছে। সেই সময় বাঁশের আঘাতে টুকরো করে দিতে হয় মৃতদেহ। এই দৃশ্য পুরুষদের পক্ষেও সহ্য করা কঠিন! নারীদের পক্ষে তো হবেই!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 2401:4900:6332:3154:c5b1:d574:1211:***:*** | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:০৬528337
  • হুম, এই গন্ধর ব্যপারটা সত্যিই খুব ভয়ের। আমি তো অনেক সময়েই আমার বৌএর গন্ধ পাই, শুধু বাড়ির ভেতরে নয়, কোথাও ঘুরতে গেছি, হঠাত চেনা গন্ধ পেলাম আর ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। বৌ যদিও জলজ্যান্ত বেঁচেই আছে, তবুও ঘাড় মটকাতে কতোক্ষন? 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন