এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্ব এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রভাব

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৭৩ বার পঠিত
  • বর্তমানকালে প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব জাতীয় বিভাজন বা নামকরণ হয়তো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে কিন্তু উদ্দেশ্য একই রয়ে গেছে এখনও। মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই কি এইরকম বিভাজন ছিল? উত্তর হলো, ছিল। রূপ অন্যরকম ছিল। সে তো হবেই, হওয়ারই কথা। মানুষ যত সভ্য হচ্ছে, ততই ক্রমশঃ যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে, ততই এই বিভাজনের রূপ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ যখন পৃথিবীতে প্রথম আসে তখন থেকেই সে গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে, সংঘবদ্ধ হয়েছে। কারণ প্রকৃতির বিনাশকারী রূপের কাছে তার অসহায়তা। সে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সেই বিনাশের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে। এরপরে গোষ্ঠীবদ্ধ থেকে নিজেদের এলাকা তৈরী করেছে, চাষবাস শুরু করেছে, বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়েছে। শুরু হয়েছে মানুষের সামাজিক জীবন। এলাকার দখলদারি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছে এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর সাথে। ধীরে ধীরে তৈরী হয়েছে শাসক শ্রেণী আর শোষিতের। শক্তের জয় আর নরমের পরাজয়ের ইতিহাস শুরু হয়েছে সেই আদিকাল থেকেই। গোষ্ঠীর মধ্যে যেমন সৃষ্টি হয়েছে মুরুব্বির, তেমনি এক গোষ্ঠী চেষ্টা করেছে অন্য গোষ্ঠীকে নিজের কব্জায় আনতে। ফলে সল্প বা বৃহৎ যে পরিসরেই হোক না কেনো, মানুষ চিরকালই অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে, অন্যকে নিজের বশীভূত করতে চেয়েছে সেই আদিকাল থেকেই। মুরুব্বীয়ানা মানুষের আদিকাল থেকেই সহজাত প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে একটি। সবসময়েই মানুষ চেষ্টা করেছে নিজের জন্য ভালোটা রেখে অন্যকে খারাপটা দেওয়ার। "নিজের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে", সেই আদিম প্রবৃত্তিরই অঙ্গ। একদিকে অন্যকে নিজের বশে রেখে তাকে বাধ্য করে খারাপটা চাপিয়ে দেওয়া আর অন্যদিকে নিজের জন্য সেরাটা রাখা, এই নিয়েই মনুষ্য সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। সুন্দর এই পৃথিবীতে সকলেরই সমান অধিকার, সকলেরই সমানভাবে এই পৃথিবীর রসাস্বাদন করার অধিকার রয়েছে, এই আপ্তবাক্য কোনোদিনই গুরুত্ব পায়নি। আদিকাল থেকেই রূপ বা প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে পাল্টে গেলেও মূল ভাবনা একই থেকে গিয়েছে।

    মানব সভ্যতা যত এগিয়েছে, মনুষ্য নামক প্রাণীর সংখ্যা পৃথিবীর বুকে যত বেড়েছে, মানুষ তত উদ্ধত হয়েছে। তার এই উদ্ধত মানসিকতায় নতুন নতুন পালক যোগ হয়েছে। এইভাবেই মানব সভ্যতায় গোষ্ঠী থেকে জমিদার, রাজা-মহারাজা-নবাবে উন্নীত হয়েছে মুরুব্বীয়ানার তালিকা। সৈন্য-সামন্ত বেড়েছে, তলোয়ার-বর্ষা উন্নীত হয়েছে বন্ধুক-কামানে, গুলতি উন্নীত হয়েছে গোলাবারুদে। চারিদিকে শুধু প্রভুদের ভীড় জমেছে, প্রভুত্বের গাথা চতুর্দিকে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাতেও মানুষের মন ভরেনি। মানুষের মনকে সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, "ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া"র উল্টো। এই পাত্রে যতই জল ঢালা হোক না কেনো কোনোদিনই ভরে না। এক ভদ্রলোক তার বড় মেয়েকে একটি চকলেট দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তার চকলেট পেয়ে কেমন লাগছে? বড় মেয়ে উত্তরে  বাবাকে অনেক আদর করলো, গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। সেই ভদ্রলোক তাকে নিজের পাশে বসতে বলে ছোট মেয়েকে ডাকলেন। ছোট মেয়ে এলে ভদ্রলোক তাকে দুটো চকলেট দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তার চকলেট পেয়ে কেমন লাগছে? ছোট মেয়েও উত্তরে বাবাকে অনেক অনেক আদর করলো, গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। এবার সেই ভদ্রলোক বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, মা, এবার তোর কেমন লাগছে? উত্তরে বড় মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোমার মত খারাপ, দুষ্টু, বাজে বাবা আর কেউ নেই। ভদ্রলোক কারণ জানতে চাইলে বড় মেয়ে বললো, তুমি কেনো বোনকে দুটো আর আমাকে একটা চকলেট দিলে? প্রশ্নটা এখানেই। মানুষ যে অতি অল্পতেই খুশি হতে পারে তার প্রমাণ, একটা চকলেটেই বড় মেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছে। কিন্তু মানুষের শুধু নিজের খুশি হলেই হয় না, অন্যকে অখুশি থাকতে হবে বা অন্ততঃ আমার চেয়ে কম খুশি থাকতে হবে এটাও মানুষের নিজের খুশি হওয়ার অন্যতম শর্ত। সেই কারণেই বোন দুটো চকলেট পেয়েছে এটা দেখার পরেই সেই বড় মেয়ে অখুশি হয়ে যায় যদিও সে তার আগে অব্দি চূড়ান্ত খুশি ছিল। এই মনস্তত্ত্বের ওপরেই মানুষের প্রভুত্ব এগিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

    বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের হাতের অস্ত্রশস্ত্রের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। মানুষের নিত্য ব্যবহার্য্য সামগ্রীর প্রভূত উন্নতি হয়েছে। মানুষের চিন্তাভাবনার উন্নতি হয়েছে অকল্পনীয় রকমের। গত শতাব্দীর শুরু থেকেই মানব সভ্যতা এক সংকটের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। ততদিনে রাজা মহারাজাদের যুদ্ধ থেকে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যুদ্ধের যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। উপনিবেশ নামের একটি শব্দ অভিধানে যুক্ত হয়েছে। ঔপনিবেশিকতার নামে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষমতাবান প্রভুদের ক্ষমতা প্রদর্শনের ফলস্বরূপ লাখো লাখো লোকের মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। দাসত্ব, ক্রীতদাস প্রভৃতি প্রথার নামবদল হয়ে পৃথিবীতে রাজত্ব চলছে। শোষক আর শোষিতের বিভাজন রেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে কালের নিয়মে। সমগ্র পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য কিছু শোষক হিংস্র হয়ে উঠেছে। তখনও কোনো পারিভাষিক শব্দের প্রচলন হয়নি কিন্তু শোষকরা নিজেদের আলাদা জাতের বলেই প্রতিপন্ন করেছে। শোষক বা শাসকের বিশ্ব আর শোষিতের বিশ্ব আলাদা বলেই চিহ্নিত হয়ে গেছে।

    এরপরে পৃথিবী ইতিহাসের প্রথম একটি রক্তক্ষয়ী দীর্ঘ যুদ্ধ দেখলো, যাকে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করি। কোটি কোটি লোক মারা গেলো সারা পৃথিবীতে, যত সংখ্যক লোক মারা গেলো তার দশগুণ লোক গৃহহীন হলো, দারিদ্রসীমার নীচে চলে গেলো। আরও অনেককিছু হলো যার হিসেব দিতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। যুদ্ধের শেষে পৃথিবী এক নতুন সমাজতান্ত্রিক দেশের উদ্ভবের সাক্ষী হলো। শোষক আর শোষিতের সমীকরণ পাল্টে গেলো। শোষকের বিশ্বে যারা শোষিত তারাই আবার সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় শাসকের আসনে। ফলে জটিলতা আরও বাড়ল। মুরুব্বীয়ানার নতুন পরিভাষা চালু হলো, প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্ব। শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত, যন্ত্রে উন্নত (অর্থাৎ প্রচুর কলকারখানা আর উৎপাদন আছে), অফুরন্ত বিলাস-ব্যাসনের পয়সা আছে, সাদা চামড়া গায়ে আছে, এমন দেশগুলোকে একত্রে প্রথম বিশ্বের দেশ বলে অভিহিত করা হলো। আবার প্রথম ক্ষেত্রের সব শর্তগুলোই পূর্ণ করছে কিন্তু সেখানে শোষিতরাই শাসকের আসনে, সুতরাং এদেরকে পাশে নিয়ে বসা প্রথম বিশ্বের লোকেদের কাছে অবশ্যই অসম্মানজনক। তাই এদেরকে আলাদা করে দেওয়া হলো, এদের বলা হলো দ্বিতীয় বিশ্বের লোক। পুরো সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াকেই দ্বিতীয় বিশ্ব বলে অভিহিত করা হলো। এরপরে পড়ে থাকলো শোষিতের দল। সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো, যেখানে উপনিবেশ চলছে বা চলেছিল, শিক্ষার মান কম, দারিদ্রতা বিরাজ করছে, যন্ত্রে উন্নত নয়, চামড়ার রং কালো বা বাদামী, সেই দেশগুলোকে অভিহিত করা হলো তৃতীয় বিশ্ব।

    শুধু মুনাফা আর বিলাস-ব্যাসন, এরমধ্যেই প্রথম বিশ্বের দেশগুলো চক্রাকারে ঘোরে। এই মুনাফার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হলো কলকারখানা আর তাদের উৎপাদন। আবার বিলাস-ব্যসনের সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হলো কলকারখানা আর তাদের উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বহু জিনিসের উৎপাদনের চেহারা পাল্টে গেছে। যেমন বিদ্যুৎ আগে কয়লা থেকে উৎপাদিত হলেও বর্তমানে অনেকটাই পরমাণু থেকে উৎপাদিত হয়। আর কলকারখানার কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রতিটি ধরনের কারখানাতেই বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থ থাকে, যেগুলোর প্রকৃতি এবং মানুষ তথা যে কোনো ধরনের প্রাণীর শরীরে গভীর প্রভাব আছে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে প্রাণী এবং উদ্ভিদের। কলকারখানা বেশী মানে বর্জ্য পদার্থও বেশী, কিন্তু সেইসব পদার্থ নিজের দেশে রাখলে নিজেরই ক্ষতি, কারণ কলকারখানাগুলো যেমন উন্নত হচ্ছে ক্রমশঃ, তেমনি তার বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকারক দিকটাও ক্রমশঃ বাড়ছে। এরপরে রয়েছে উন্নত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি আর কলকারখানা থেকে নিঃসৃত কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড-র মত ক্ষতিকারক গ্যাসসমুহ, পারবানবিক চুল্লির বর্জ্য পদার্থ। আমাদের উন্নত জীবনযাত্রায় কাঠের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এত জনসংখ্যার কারণে গাছ কাটার প্রয়োজন এতটাই যে অ্যামাজনের বিস্তীর্ণ জঙ্গলও সাফ হয়ে যাবে। অর্থাৎ যেসব দেশ বেশী উন্নত সেইসব দেশের জনগণের ক্ষতিটাও বেশী। অর্থাৎ প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনগণের ক্ষতি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনগণের চেয়ে অনেক বেশী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শ্রীলংকার জনগণের চেয়ে আমেরিকার জনগণের আয়ুষ্কাল কম হবে, রোগভোগের পরিমাণ বাড়বে, জটিল রোগভোগ হবে অনেক বেশী।

    তাহলে তো শোষক বা শাসকের ক্ষতি শোষিতের চেয়ে বেশী হয়ে যাচ্ছে। উপায় কি? উপায় হলো তৃতীয় বিশ্ব। আবার ১৯৭৪ সাল থেকে আর একটি পরিভাষা নিয়ে আসা হয়, "চতুর্থ বিশ্ব"। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বের যেমন রাষ্ট্রীয় চেহারা আছে, তাদের নিজস্ব সীমানা আছে, নিজস্ব সরকার আছে, চতুর্থ বিশ্বের তেমনি কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা বা সরকার নেই। চতুর্থ বিশ্ব বলতে সেই আদিবাসী জনগণের জাতিগুলোকে, সাংস্কৃতিক বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যাদের সাধারণ বাস্তবতায় কোনো রাষ্ট্র নেই। বরং তারা একটি দেশের ভিতরে বা বহুদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। উদাহরণস্বরূপ, রেড ইন্ডিয়ান বা আদিবাসী আমেরিকানরা উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বাস করে। এই রেড ইন্ডিয়ানদের এবং আরও নানারকম উপজাতি যারা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে তাদের বিশ্বকে চতুর্থ বিশ্ব নাম দেওয়া হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে এরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী অবহেলিত এবং প্রকৃতির খুব কাছাকাছি বিরাজ করে আজ অব্দি।

    আমাদের দেশে প্রতিটি শহরের শেষ প্রান্তে এক বা একাধিক ডাম্পিং গ্রাউন্ড দেখা যায়। শহরের যত জঞ্জাল সেইসব মাঠে জমা করা হয়। তেমনি প্রথম বিশ্ব এবং দ্বিতীয় বিশ্বের জঞ্জালের জন্য চিহ্নিত করা হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। সেইসব দেশের উপকূল এলাকায় অথবা মরুভূমি এলাকায় প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর জাহাজ এসে ফেলে দিয়ে যায় সুবিশাল জঞ্জালের স্তূপ। বিনিময়ে সেই দেশগুলোকে কিছু আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। সুতরাং জঞ্জালের ঝামেলা থেকে তাদের মুক্তি মেলে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদে খুব একটা হাত দেয় না। অন্য দেশের অরণ্য থেকে কাঠের ব্যবস্থা করে। নিজেদের দেশের মাটির নীচে তেল মজুদ থাকলেও অন্য দেশের তেল কেনে এরা। বর্তমান বিশ্বে কার্বন এমিশন যেহেতু একটা প্রধান সমস্যা তাই বেশ কিছু বছর ধরে এই দেশগুলো তাদের কলকারখানাগুলোকে অন্য দেশে সরিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেকটাই কমে যাচ্ছে ফলে উৎপাদিত বস্তু তাদের দেশে নিয়ে যেতে যে অতিরিক্ত খরচ লাগছে সেটা পুষিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের আর্থিক অবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও এই ব্যবস্থায় অরাজী হচ্ছে না। তাদের দেশে কর্মসংস্থান তৈরী হচ্ছে। কিন্তু নতুন করে সমস্যা তৈরী হচ্ছে জঞ্জাল আর দূষণের। এই সমস্যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর একান্তই নিজস্ব এবং সমাধান তাদের নিজেদেরকেই করতে হবে। অর্থাৎ সুচারুরূপে সমস্ত দায়ভার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাঁধে চাপিয়ে দিতে পেরেছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনও এই রাস্তায় হাঁটা শুরু করেনি সেইভাবে। মূল কারণ, সেই দেশগুলো ধনতান্ত্রিক দেশ নয়, সরকারী কাঠামোয় বাঁধা আছে তাদের দেশের কলকারখানাগুলো। অবশ্য সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ভেঙে পড়ার পরে আর দ্বিতীয় বিশ্বের সেইরকম আলোচনা করা হয় না। তারাও ধীরে ধীরে ধনতান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকেছে। খাতায় কলমে না হলেও বাস্তবে। সুতরাং তাদের দেশের কলকারখানাগুলোও সরছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়।
    আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রয়োজন কর্মসংস্থান। আর্থিক কারণেই চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান তৈরীর মত ক্ষমতা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেই। ফলে যখন অন্য দেশ থেকে কোনো শিল্পপতি আমাদের মত দেশকে তাদের বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে,  আমরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ি। আমাদের কর্মসংস্থান তৈরী হয়। সেইসব কারখানা বা কোম্পানীতে চাকুরী করে মোটা টাকা উপার্জন হয়, আমাদের আর্থিক অবস্থা উন্নত হয়, সমাজে মুরুব্বীয়ানা প্রতিষ্ঠিত হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দেশের বা দশের উন্নতির বিনিময়ে দশের ক্ষতিকে মেনে নিতে হচ্ছে। প্রভূত ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, জটিল রোগভোগ, স্বল্পায়ু থেকে শুরু করে প্রকৃতি ধ্বংস, বিষাক্ত গ্যাসসমূহ, বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থসমূহের বোঝা আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মদের ঘাড়ে চেপে বসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমশঃ উপনিবেশের পরিধি কমতে শুরু করেছিল এবং গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের পর থেকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে সংখ্যাটা। যদিও একেবারে শূন্য হয়ে যায়নি। ফলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর রণনীতি বা উপনিবেশ নীতির পরিবর্তন দরকার ছিল। কারণ তাদের একমাত্র নীতি হলো, পরিশ্রম অন্যের, ক্ষতি বা যা কিছু খারাপ সেসব অন্যের, ক্ষীর খাবো আমি। অত্যন্ত সুচারুরূপে তারা সব ক্ষতি বা খারাপগুলো তৃতীয় বিশ্বের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পেরেছে। আবার এইটুকু বললেও সম্পূর্ণ বলা হলো না। কলকারখানা হচ্ছে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়, কারখানার কাঁচামাল আমাদের দেশের (সমস্ত না হলেও বেশীরভাগ), কারখানার শ্রমিক থেকে বেশীরভাগ প্রশাসনিক লোক আমাদের দেশের, বর্জ্য পদার্থ আমাদের, কারখানা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক এবং ক্ষতিকারক গ্যাসসমূহও আমাদের। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোয় এরফলে কারখানার সংখ্যা কমছে এবং ক্ষতিকারক গ্যাসের পরিমাণ কমছে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় সেইগুলো বাড়ছে। প্রথম বিশ্বের মুরুব্বীরা চোখ রাঙিয়ে বলছে কার্বন এমিশন কমাও।

    আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের লোকেরা যাদের শিক্ষার হার ও মান প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে, আমাদের কাছে জীবনশৈলি পাল্টে যাওয়াটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রকৃতির কথা, সমাজের কথা বিচার বিবেচনার মধ্যে রাখি না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুনীল আকাশ, নির্মল বাতাস রেখে যাওয়া যে আমাদের কর্তব্য সে কথা আমাদের মাথায় থাকে না। প্রকৃতির সবুজ কোলে বসে সুনীল আকাশ দেখতে দেখতে প্রাণভরে নির্মল বাতাস বুকে সঞ্চিত রেখে পান্তাভাত খাওয়ার চেয়ে সাহারা মরুভূমিতে বসে মাংস সহযোগে বিরিয়ানি খাওয়া আমাদের কাছে বেশী লোভনীয়।

    যেভাবেই হোক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের মুরুব্বীদের চোখ রাঙানি থাকবেই তৃতীয় বিশ্বের ওপর, তারা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করবেই। ঔপনিবেশিকতার ধরণটাই শুধু পাল্টেছে, মূল গল্পটা এখনও একই আছে।  পৃথিবীতে এখনও অনেক দ্বীপ আছে যে দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের কিন্তু সেই দ্বীপপুঞ্জের একটি বা দুটি দ্বীপের মালিকানা প্রথম বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের। এর থেকে বেরিয়ে আসার আশু কোনো সম্ভাবনার আশা না করাই ভালো। আমেরিকার অর্থনীতি শ্রীলংকার মত হয়ে গেলো আর ভারতবর্ষের অর্থনীতি আমেরিকার মত হয়ে গেলে হয়তো সেই সম্ভাবনার দেখা মিলতে পারে। কিন্তু অর্থনীতি ছাড়াও রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, গোষ্ঠীতন্ত্রের (ন্যাটো, ওয়ারশ, জি-২০, কমনওয়েলথ প্রভৃতি) মত অনেক কিছু এর সাথে যুক্ত। ফলে আমাদের ভাগ্যে আগামীদিনে সবুজ প্রকৃতি বা সুনীল আকাশ বা নির্মল বাতাস লেখা নেই। আছে শুধুই বিস্তীর্ণ সাহারা মরুভূমি, এটা বলাই বাহুল্য। তাই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, অখিলবন্ধু ঘোষের গলায় এবং সুরে আমাদের সেই হাহাকারের কথাই প্রকাশিত হয় বারেবারে...
    তোমার ভুবনে ফুলের মেলা,
    আমি কাঁদি সাহারায়।
    ওগো কমলিকা বুঝিলেনা,
    আমি কত অসহায়।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন