গল্প নাম্বার :- ১৩
ট্রেনের অযাচিত প্রেম।
(সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জিত।)
গল্পকার :- শংকর হালদার শৈলবালা।
◆ রচনার শ্রেণী :- ভ্রমণ কাহিনী। ভালোবাসা এক বাস্তব ছোট গল্প।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
◆ মদন নামে একজন যুবক কাজের সন্ধানে দিল্লি যাওয়ার জন্য হাওড়া স্টেশন থেকে দিল্লি গামী সুপারফাস্ট ট্রেনের অপেক্ষাকৃত সংরক্ষিত অর্থাৎ ওয়েটিং রিজার্ভেশন লিস্ট টিকিট নিয়ে, এক সংরক্ষিত কামরায় উঠে পড়ে ।
◆ গাড়িতে ওঠার আগে একবার টিকিট পরীক্ষা করে দেখে নেয় কিন্তু সিট নাম্বার নিশ্চিত সংরক্ষিত হয়নি।
◆ মদন ভাবে মনে :- অগত্য মধুসূদন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিল্লিতে যেতে হবে।
◆ মদন এক বার ট্রেনের কামরার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেয় এবং ফাঁকা জায়গা দেখে বসার দুই আসনের মাঝে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
◆ আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পায়, একজন সুন্দরী যুবতী জানালার পাশের সিটে বসে আছে। তার ডান পাশে একজন বয়স্ক মহিলা কিন্তু দুই জন মহিলার মধ্যে এক জন বসার মতো জায়গা ফাঁকা রয়েছে। সাহস করে মদন বসার কথা বলতে পারছে না। কারণ এই ভাবে ট্রেনের কামরায় বা বাইরের জগতের সাথে চলাফেরা নেই। একবার ভাবে বসতে গিয়ে যদি অপমান করে কিছু বলে। সিট নম্বর থাকলে অবশ্যই জোর করা যায়।
◆ এক সময় হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন চলতে শুরু করে। ট্রেনের নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে শহর, গ্রাম ও বন-জঙ্গল পেরিয়ে দিল্লির দিকে।
◆ মদন কে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুন্দরী যুবতী বলে :- কোথায় যাবেন ?
◆ মদন বলে :- দিল্লি ।
◆ যুবতী হাসি দিয়ে বলে :- সে তো; অনেক দূরের পথ ! মনে হচ্ছে আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন। বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলে কিন্তু সিট পাওয়া যাবে না। তা সাধারণ কামরার টিকিট কেটে সংরক্ষিত কামরায় আসেনি তো?
◆ মদন বলে :- না; ওয়েটিং টিকিট কেটেছিলাম কিন্তু এখনো কনফার্ম হয়নি, হয়তো মাঝখানে কোথায় হয়ে যেতে পারে।
◆ যুবতী বলে :- তাহলে, ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসছেন না কেন?
◆ মদন বলে :- আমি ভেবেছি সিট কনফার্ম না হলে রিজার্ভেশন কামরায় বসা যাবে কিনা?
◆ যুবতী জোরে হাসি দিয়ে বলে :- আচ্ছা বুঝতে পারলাম; ট্রেন ভ্রমণের আপনার কোন অভিজ্ঞতা নেই, সেই জন্যই বোকার মত দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের পাশেই বসে পড়ুন, কতক্ষন আর দাঁড়িয়ে থাকবেন।
◆ বয়স্ক মহিলা যুবতীর দিকে চেপে বসে এবং অতিথি আপ্যায়ন করার জন্য এক পাশে জায়গা করে দেয়। মদন বয়স্ক মহিলার পাশে বসে পড়ে।
◆ কিছু সময় চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর যুবতী জালনার পাশে থেকে উঠে বয়স্ক মহিলাকে বলে :- ঠাকুমা, তোমার খুব গরম লাগছে না, জানলার ধারে গিয়ে বসো।
◆ যুবতী তার বসার আসন পরিবর্তন করে মদনের পাশে এসে বসে আর মদন বোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তার স্পর্শ বাঁচাতে থাকে।
◆ যুবতী বলে :- দিল্লিতে কোথায় যাবেন ?
◆ মদন বলে :- কাজের সন্ধানে চলেছি।
◆ যুবতী বলে :- জানা শোনা কেউ আছেন।
◆ মদন বলে :- এক বন্ধু রাজমিস্ত্রির কাজ করে, বলেছে দিল্লি স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে।
◆ যুবতী বলে :- বসার আসন নাম্বার যখন নির্দিষ্ট (কনফার্ম) হয়নি, তবে কি রাত জেগে থাকবেন ?
◆ মদন হালকা হাসি দিয়ে বলে :- অগত্য মধুসূদন; আপনার পায়ের তলায় বসার দুই আসনের মাঝে ফাঁকা জায়গায় দিব্যি এক রাত কাটিয়ে দেবো। বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্যে বলে :- এক রাত জেগে থাকলে, শত রাত জীবিত থাকা যায়।
◆ যুবতী মৃদু মৃদু হেসে বলে :- বাবু মশায়, মেয়েদের মন জয় করার জন্য কবির কল্পনায় আপনার মহিমা প্রকাশ করতে হবে না।
◆ মদন চুপচাপ হয়ে ভাবে মনে :- মনের অজান্তে হয়তো বেশি কিছু বলে ফেলেছি। দেখে মনে হচ্ছে আভিজাত্য সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে কিন্তু আলাপ ব্যবহার নমনীয়। এই সুন্দরী মহিলাকে আমার মনে ধরেছো কিন্তু ভালোবাসার কথা বলার সুযোগ এখনো আসেনি।
◆ কয়েক ঘণ্টা পরে যুবতী বলে :-আরো মশায়, কথাবার্তা বলছেন না, সময় কাটবে কেমন করে! আসুন একদান লুডু খেলার মধ্যে দিয়ে সময় কে পার করে দেয়।
যুবতী বসার আসনের নিচ থেকে ব্যাগ থেকে লুডু খেলার বোর্ড ও গুটি বের করে বলে :- মদন বাবু, উপরে শোয়ার আসনে চলে আসুন। বলে সিঁড়ি দিয়ে থর থর করে উপরে উঠে পড়ে।
◆ মদন ইতস্তবোধ করে ভাবে মনে :- যাবো কি! যাবো না?
◆ বয়স্ক ঠাকুমা দুষ্টু-মিষ্টি মুচকি হাসতে হাসতে মদনের ধাক্কা দিয়ে বলে :- আরো; আমার নাতনি ডাকছে শুনতে পাচ্ছো না! যাও উপরে গিয়ে লুডু খেলা করে, তাহলে মন ও শরীর ভালো থাকবে। সময় কেটে গিয়ে ক্লান্তি বোধ দূর হয়ে যাবে।
◆ মদন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে, অসাবধানতার কারণে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার মত হয়-আর সেই মুহূর্তে যুবতী হাত ধরে টেনে উপরে তুলে নিয়ে এসে বলে :- মনে হচ্ছে; ট্রেনে চড়ার অভ্যাস নেই, তারপর সুন্দরী মহিলার আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে --------------------।
◆ যুবতী লুডু খেলা করতে করতে বলে :- আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?
◆ মদন বলে :- একমাত্র ভালোবাসার মতো বউ বাদে, বিধবা মা, এক ভাই ও এক অবিবাহিত বোনকে নিয়ে সংসার।
◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- মদন বাবু, দারুণ বলেছেন। আমারও, আপনার মত কিন্তু একটু ব্যতিক্রম আছে। আপনাকে যত বোকা মনে করেছিলাম কিন্তু আপনি তো বোকা না। আবার রসে বসে কথা বলতে পারেন।
◆ মদন বলে :- ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
◆ মদনের গুটি কেটে দিয়ে যুবতী বলে :- নিজের গুটি গুলো ঠিকমত চালাতে পারছেন না, তাহলে সংসার করবেন কি করে?
◆ মদন বলে :- সংসারের খেলাটাও লুডু ও দাবা খেলার মতো কাটা-কাটি ও হার-জিত থাকবেই। আর সংসার চক্রের মাঝে মেয়েদের কাছে-ছেলেরা চিরকাল হেরে থাকে। পাড়ার বৌদিরা বলেন, লাঠির জোরে নাকি সংসার চলে।
◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- ঠিক বলেছেন, যেখানেই যাবে সেখানেই লাঠির জোর সব সময় দরকার হয়।
◆ মদন বলে :- সংসার চক্রে "বিশ্বাস" নামক ছোট একটি শব্দ কে মজ্জাগত করে রাখতে হয়। না হলে হনুমানের মত সোনার লঙ্কায় আগুন লেগে যায়।
◆ যুবতী হাসতে হাসতে বলে :- আরে মশাই; মনে হচ্ছে আপনি তো সংসারের খুঁটিনাটি সবই জানেন।
◆ মদন বলে :- অল্প বয়সের বাবা হারা হই আর কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করেছি। আবার সংসারে চরম দারিদ্রতার জ্বালা অনুভব বর্তমান সময়ে করে চলেছি।
অতল সমুদ্রের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিন্তু অজানা উদ্দেশ্যে অবিরাম ভাবে সাঁতার কেটে চলেছি।
কখনো আশার আলো দেখি আবার
কখনো চরম নিরাশায় ভুগতে থাকি।
সান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নাই পাশে,
১৬ বছরের বোনকে দিতে হবে বিয়ে।
জন্মভূমি ত্যাগ করে কাজের সন্ধানে
দেশের রাজধানী দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা।
মদন তার বিপক্ষে খেলোয়াড়ের একটি গুটি কেটে দিয়ে মুখে হালকা হাসি দিয়ে বলে :- আরো ম্যাডাম; গুটি বাঁচাতে পারলেন না।
◆ যুবতী বলে :- না; কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন বার বার বিরক্ত করছে।
◆ মদন বলে :- বলে ফেলুন, জানা থাকলে অবশ্যই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
◆ যুবতী বলে :- তা কোন মেয়ের চক্রে পড়েছেন। বলে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায়।
◆ মদন বলে :- লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু কিন্তু হয়নি। মেয়েদের চক্রে পড়া তো দূরের কথা, আমার জীবনের ২৮ বসন্ত পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন মহিলা ভালোবাসার ইঙ্গিত পর্যন্ত করেনি। আচ্ছা আমি দেখতে কি ভীষণ খারাপ?
◆ যুবতী চন্দনা তিন ঘর গুটি এগিয়ে দিয়ে ভাবে মনে :- মদনবাবু ভালবাসার ইঙ্গিত করছে কিন্তু কথাবার্তা বলতে বলতে আরো তথ্য জানতে হবে। দেখে তো মনে হচ্ছে সরল-সোজা মানুষ কিন্তু একদম বোকা নয়।
◆ মদনের ইঙ্গিতপূর্ণ কথার মানে নিজের মনে উপলব্ধি করতে পেরে আনন্দিত হয়ে চিৎকার করে চন্দনা বলে :- ছয় ছয় আরেক এবার কিন্তু পাঁচ হয়েছে। এবার কিন্তু মদন বাবুর দুইটি গুটি খাওয়া যাবে। বলে হাতে তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে।
◆ মদন লুডুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে :- খেলায় চোরাকারবারি হচ্ছে। বলে মাথা উঁচু করতেই, চন্দনার থুতনির সাথে মদনের মাথা ঠোকাঠুকি হয়।
◆ চন্দনা হাসতে হাসতে বলে :- আরে মশাই; এক ঠোকাঠুকি করলে কিন্তু যমরাজের মতো শিং গজাবে। বলে দুই হাত দিয়ে মদনের মাথা ধরে আরো তিনবার ঠোকাঠুকি করতে থাকে।
◆ মদন বলে :- আধুনিক যুগের বিংশ শতাব্দীর মহিলা হয়েও কিন্তু অন্ধ কুসংস্কার কে বিশ্বাস করেন ?
◆ চন্দনা বলে :- কুসংস্কার বড় কথা নয়, আসল কথা অন্তরঙ্গ মানুষের সাথে তিন বার ঠোকাঠুকি হয়ে থাকে। অন্য কেউ করলে কিন্তু সেটাকে আঘাত হিসাবে ধরে ঝগড়া অশান্তি বাদে।
◆ নতুন করে আবার খেলা করতে করতে মদন বলে :- আপনার মাথায় অনেক বুদ্ধি আছে। আপনি নিশ্চয় উচ্চশিক্ষিত ও আভিজাত্য সম্পন্ন মহিলা। সে যাই হোক কথায় কথায় আমার পরিচয় দিয়েছি কিন্তু আপনার পরিচয় নেওয়া হয়নি।
◆ চন্দনা লুডু খেলা বন্ধ করে লুডু বোড গুছিয়ে নেয়। মুখমন্ডলে সূর্যের আলোকে ঢেকে গিয়ে ঘন কালো মেঘে পরিণত হয়ে যায়। আর হালকা মেঘের গর্জনের সাথে ভারী বর্ষণ শুরু হয়।
◆ মদন অপরাধীর মত জড়োসড়ো হয়ে, আস্তে আস্তে বলে :- আমি; আপনার মনে নিশ্চয়ই দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, নিচের দিকে যাচ্ছি।
◆ চন্দনা এক হাত দিয়ে মদনের হাত চেপে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলে :- কপাল আমার মন্দ, দুঃখের কথা আর কি বলবো ?
◆ মদন বলে :- আমাকে যদি বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনার জীবনের দুঃখময় ঘটনা জানাতে পারেন।
◆ চন্দনা বলে :- বিয়ের ছয় মাসের পর এক পথ দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যায়। তাকে কে চিরদিনের মতো চিতার আগুনে পুড়ে ছাই করে, সুবাসিত চন্দনের সৌরভ হারিয়ে বিধবা হয়েছি।
◆ চন্দনার চোখের জল মুছে দিতে দিতে মদন বলে :- সত্যিই; অসময়ে বিধবা হয়ে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। বিধির বিধান মানুষের কি সাধ্য আছে?
◆ চা ওয়ালা বলে :- গরম চায়ে, গরম চায়ে।
◆ মদন বলে :- একটু চা পান করুন মনটা আবার আগের মত তরতাজা হয়ে যাবে। চা বিক্রেতা কে তিনটি চা দিতে বলে।
◆ দীর্ঘ সময় ধরে দু'জনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা চলাতে থাকে।
◆ মদনের প্রশ্নের উত্তরে একসময় চন্দনা বলে :- আরে মশাই; এখন নতুন করে কোন পুরুষের সাথে মন দেওয়া নেওয়া হয়নি কিন্তু হতে কতক্ষণ!
◆ মদন বলে :- দিল্লি আপনার বাবা কি করেন?
◆ চন্দনা বলে :- বাবা-মা সহ ঠাকুমা কে নিয়ে দিল্লি যাচ্ছি। দিল্লিতে বাবার বড় ব্যবসা ও নিজস্ব তিন তলা বিশিষ্ট বসবাসের বাড়ি রয়েছে।
◆ মদন বলে :- বাংলায় কোথায় বাড়ি?
◆ চন্দনা বলে :- পূর্বপুরুষের পৈত্রিক বাড়ি বাঁকুড়া জেলার রাধা কৃষ্ণ নগর গ্রামের দামোদর নদীর পাড়ে।
◆ মদন বলে :- গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে।
◆ চন্দনা বলে :- গ্রামের বাড়িতে বাবা মা বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমি ঠাকুমা, জ্যাঠা, জেঠিমা, কাকা, কাকিমা, দাদা, বৌদি ও দিদিদের সাথে ছোটবেলা থেকে গ্রামের পরিবেশের সাথে বড় হয়েছি।
◆ মদন বলে :- পড়াশোনা কোথায় করেছেন।
◆ চন্দনা বলে :- গ্রামের বাড়িতে বসবাস করে শহরে কলেজে পড়াশোনা করেছি কিন্তু মাঝে মধ্যে স্কুল ছুটির সময়ে দিল্লিতে বাবা-মা, ছোট ভাই-বোনের সাথে বসবাস করি।
◆ প্রকৃতির নিয়মে দিনের আলো বিদায় নিয়ে, ধীরে ধীরে সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা হয়ে যায়।
◆ চন্দনা; রাতের খাবারের জন্য তার বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করে তারপর মদন সহ সবাই একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
◆ খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর চন্দনা বলে :- মদন বাবু; আমাদের একজন ব্যক্তির আসার কথা ছিল কিন্তু কোনো কারণবশত আসতে পারেননি। আমাদের কারখানায় ম্যানেজারের পদে কাজ করার কথা হয়েছিল।
◆ চন্দনার ঠাকুমা বলেন :- দাদু ভাই; উপরের ডান দিকের সিটে গিয়ে শুয়ে পড়ো। একজন বাঙালি হয়ে আরেক জন বাঙালি কে কাঙ্গালের মতো করে রাখতে পারি না।
◆ চন্দনার দিকে তাকিয়ে মদন বলে :- আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে গেলাম, শুভ রাত্রি।
◆ হালকা মুচকি হাসি দিতে দিতে চন্দনা বলে :- আরে মশাই; সময় ও সুযোগ পেলে কিন্তু ঋণ শোধ করে দেবেন।
◆ মদন হালকা হাসি দিয়ে বলে :- 'ঈশ্বর; সেই সুযোগ কি আর আমাকে দেবে?
◆ মদনের কাছাকাছি হয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চন্দনা বলে :- আপনার সোজাসুজি বিপরীত দিকে থাকবো কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়াতে চাইলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
◆ মদন শুয়ে চন্দনার সাথে আজকের স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে কল্পনার জগতে ডুবে দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অন্যদিকে চন্দনা কামরার আলো-আঁধারিতে মদনের দিকে মুখ করে তাকিয়ে মদনের রূপ যৌবনের সৌন্দর্য কল্পনার মাধ্যমে উপভোগ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
◆ সকালে চন্দনা তার শোয়ার সিট থেকে হাত বাড়িয়ে মদনের হালকা চিমটি কেটে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় আর মদন তাড়াহুড়ো করে বিছানার উপর উঠে বসে।
◆ চন্দনা হাসতে হাসতে রহস্য করে বলে :- মাত্র দুই হাত লাফ দেওয়ার সাহস নেই কিন্তু সংসারের জলময় সমুদ্রে সাঁতার কাটবে কি করে ?
◆ চন্দনা ভাবে মনে :- রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে, মদন একবার ভালবাসার হাত বাড়ালেই কিন্তু দুটি হৃদয়ের মিলন ঘটে যেতো। ভালোবাসা নিবেদনের ক্ষেত্রে মদন বড়ই লাজুক মনে হচ্ছে। মুখখানা দেখে মনে হচ্ছে আমার কথায় কতই না লজ্জা পেয়েছে।
◆ মদন ঘুম ঘুম চোখে বলে :- কি হয়েছে?
◆ চন্দনা বলে :- অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে।
তা মদনবাবু, পড়াশোনা কতদূর করেছেন ?
◆ মদন বিরক্তি হয়ে মুখ কালো করে বলে :- এই সামান্য কথা জানার জন্য কি! আমার সুখের স্বপ্ন টাকে নষ্ট করে দিলেন।
◆ চন্দনা বলে :- আরে মশাই; নাটক না করে সোজাসুজি বলুন না।
◆ মদন চোখে হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে :- এপাস-ওপাস আর নিচের থেকে পাস আবার উপর থেকে পাস কিন্তু মাঝখানে ধপাস করে বিয়ে না করেই আবার বিএ পাস।
◆ চন্দনা বলে :- চলবে কিন্তু স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে বাস্তবে ফিরে আসুন। জানিনা কোন রাজকুমারীর গল্প শুনে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন।
◆ মদন মৃদু মৃদু মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বলে :- স্বপ্নের নারী হয়তো, সত্যিই; বাংলার কোন এক রাজার আদরের দুলালী রাজকুমারী হবে। তাকে স্পর্শ করার শক্তি হয়তো একমাত্র স্বপ্নের মাধ্যমেই সম্ভব।
◆ চন্দনা বলে :- আর কাব্য কথা বলে সময় নষ্ট না করে, কিন্তু দয়া করে হাত মুখ ধুয়ে নেবেন। চা পান করার জন্য বাবা-মা সহ সবাই কিন্তু আপনার অপেক্ষা করে বসে আছে।
◆ মদন লজ্জিত হয়ে বলে :- এখনো হয়নি, আমার জন্য অপেক্ষা ।
◆ চন্দনা অভিমানের সুরে বলে :- ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজকুমারী স্বপ্ন দেখলে তবে, হবে কি করে ?
◆ সারাদিন নানারকম অন্তরঙ্গতার কথাবার্তার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। উভয় উভয়ের আরো কাছে পাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্নের উত্তর চলতে থাকে।
◆ চন্দনা বলে :- মদন বাবু, এক ঘন্টা পরে দিল্লি পৌঁছে যাবে কিন্তু কিছু মনে না করলে, একটা কথা বলার ছিল।
◆ মদন মনের অজান্তেই বলে ফেলে :- বল কি বলতে চাও! তুমি কি আমার পর ?
◆ চন্দনা আনন্দে পুলকিত হয়ে বলে :- আমাদের সাথেই চলে, তোমার বিষয়ে বাবা-মা কে বলেছি।
◆ মদন ভাবে :- কি করব! কাজ তো আমার চাই কিন্তু আবার চন্দনা কে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে কি চন্দনার বাবা কোন কাজ দেবেন?
◆ বড়লোকের মেয়ে চন্দনার খামখেয়ালিপনার বশবর্তী হয়ে, আমাকে ব্যবহার করে নর্দমায় ফেলে দেবে না তো।
◆ চন্দনা বলে :- দিল্লি বোম্বে যেখানেই যাও না কেন! সব জায়গায় কাজ করতেই হবে। কাজের দক্ষতা অনুসারে টাকা নামক লক্ষ্মী তার ঘরে ঢুকে পড়ে। এলাকার মানুষের সাথে থাকা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়।
◆ মদন কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ হয়ে ভাবতে থাকে। চন্দনার সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে যা বুঝতে পারলাম। আভিজাত্য সম্পন্ন ব্যবসায়ীর এক মাত্র বিধবা কন্যা কিন্তু চন্দনার সাথে মিলেমিশে থাকতে আমি পারবে তো । আমাকে তো কর্মচারী হিসেবে থাকতে হবে কিন্তু চন্দনা তার ভালোবাসার মর্যাদা কখনো দেবে কি?
◆ হয়তো ট্রেনের সময় কাটানোর জন্য আমার সাথে আলাপ পরিচয় কিন্তু ভালোবাসা তো হতে পারে না। তবে কি আমাকে দয়া দেখাচ্ছে ?
◆ দুই জনের নীরবতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে এক সময় ট্রেন দিল্লি স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চন্দনা একবার মদনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ঘুরিয়ে মুখ কালো করে নামার জন্য তার ঠাকুমাকে তাড়াতাড়ি করতে বলে।
◆ মদন মনের সাথে লড়াই চালিয়ে ট্রেন থেকে নামার আগেই, মনে সাহস সঞ্চয় করে চন্দনার সামনে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে।
◆ চন্দনা অমাবস্যার অন্ধকারের মতো গম্ভীর মুখ করে বলে :- কিছু বলতে চান?
◆ মদন সকলের সামনে চন্দনার হাত ধরে বলে :- চলে তবে, আপন জনের সাথে থাকি। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে এগিয়ে যাবে কিন্তু চন্দনা! আমার এই হাত কখনো ছেড়ে দেবে না তো ?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
◆ রচনাকাল :- 25 জুলাই 2019 সালে। হাওড়া স্টেশন থেকে নিউ দিল্লি সুপারফাস্ট ট্রেনে যাওয়ার সময়ে রচিত।
◆ সংশোধনের তারিখ :- ১৩ আগস্ট ২০২৩ সালে। দত্তপুলিয়া বাড়ি থাকাকালীন, নদীয়া।
----------------------------------------------------------
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।