আপনাকে, খুব সম্ভবত, আমি চিনি না। আপনিও আমায় চেনেন না। এই মুহূর্তে আমরা সামনাসামনিও নেই। এমন অদ্ভুত অবস্থা মোটেই আলাপচারিতার উপযুক্ত না। তবু, আসুন—আলাপ করা যাক। অবস্থা বুঝে, চলুন আমরা আলাপের নিয়ম একটু বদলে নিই। আমি প্রশ্ন তুলবো—আপনি নিজের মনে তার উত্তর দেবেন। আপনার উত্তর আমি তারপর আন্দাজ করার চেষ্টা করবো। বেশ?
আচ্ছা, 'বিজ্ঞান' শব্দটা শুনলে কী মনে হয় আপনার ঝটিতি? চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো—কীসের ছবি ভেসে ওঠে? দুটো সম্ভাবনা আছে—হয় আপনি বড় কম্পিউটার, স্মার্টফোন, টিভি, গাড়ি, ফ্রিজ, প্লেন – এসব ভাবছেন, নইলে ভাবছেন স্পেসশিপ, টেলিস্কোপ, ল্যাবরেটরি, মাপজোকের যন্ত্র – এসবের কথা।
যদি আপনার চিন্তা প্রথমটার সঙ্গে বেশি মেলে, তবে বিজ্ঞান নয়—আসলে আপনি ভাবছেন প্রযুক্তির কথা। কেন ভাবছেন জানেন? জানেন কি, আমাদের দেশের বিজ্ঞাননীতি ঠিক কীভাবে ধীরে ধীরে প্রযুক্তিনীতি হয়ে উঠেছে? কেন প্রতি বছর লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার পাশ করে বেরোলেও, আদত উদ্ভাবনের কোঠায় আমাদের অবদান যৎসামান্য? কেন এমন হলো—জানেন? বলছি।
যদি দ্বিতীয় অপশনটা আপনার চিন্তার কাছাকাছি হয়, তবে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু ভাবুন—যে টেলিস্কোপ, ল্যাব, আবিষ্কার, ওষুধ, ভ্যাক্সিন-এর কথা আপনার মনে এসেছিল – ভারত সরকারের অনুদান, বিজ্ঞাননীতি বা নিদেন শিক্ষানীতি—কোনটা তার একটার জন্যেও দায়ী?
আরেকটা ব্যাপার ভাবুন—চতুর্দিকে শুনতে পান, অন্য কোন দেশে কত বিজ্ঞানী কতরকম পুরস্কার পান, আমরা তার কিছুই পাই না। অথচ খেলায় দেখুন, সিনেমায় দেখুন, কোটি টাকার মূর্তি, লক্ষ কোটি টাকার রাজনৈতিক ক্যাম্পেন, ক্রমবর্ধমান পুজোর প্যান্ডেল, আর কিছু না হলে সিয়াচেনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্রেই দেখুন – উন্নয়ন কি কালাশনিকভ হাতে দাঁড়িয়ে নেই?
বিজ্ঞানে কী হল তবে?
এই অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় আমরা কী করে পৌঁছলাম, আর কেনই বা এতদিনের এত চেষ্টাতেও বিজ্ঞান আমাদের দেশে শেকড় গজাতে না পেরে কিছু বিশেষ-সুবিধে-পাওয়া মানুষের ছাদের বনসাই হয়ে থেকে গেল—এ নিয়ে অনেকে নানা আলগা কথা এদিক-ওদিক বলেন ঠিকই, কিন্তু রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় এ বিষয়ে নিয়ম করে লিখে চলেছেন বহুদিন। সরকারি বিজ্ঞাননীতি থেকে শুরু করে আমাদের দেখনদারি পরিবেশ-নীতি—কী করে যে আমাদের কর্মফলের বেতাল হয়ে আমাদেরই ঘাড়ে চেপে বসবে—তা জলের মতো সহজ ভাষায় বছরের পর বছর লিখে বুঝিয়েছেন তিনি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
এই বইমেলায় বেরোচ্ছে সেই সব লেখার এক সংগ্রহ—'ভারতীয় বিজ্ঞান – নির্মাণ ও বিনির্মাণ'।
নাম শুনে ঘাবড়াবেন না। গোটা বইয়ে কঠিন কথা শুধু ওই নামেই। ক্লাসরুমে প্রশ্ন করতে শেখানো থেকে শুরু করে, ভারতীয় জ্ঞানধারা (ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম), বিজ্ঞানের রাস্তায় দেশভক্তি, বিজ্ঞানদিবস ও বিজ্ঞাননীতির আনাচকানাচের খবর—সবই এ বইয়ে সহজ করে লেখা।
তাছাড়া, যে সব বিষয় নিয়ে সাধারণ সাংবাদিকের পক্ষে কিছুতেই লেখা সম্ভব নয়, অথচ যা ছাড়া আলোচনাই শুরু হয় না—সেই গবেষণা-অনুদান বা রিসার্চ গ্রান্ট (তা সে নকুলদানা-মাপের অস্বাভাবিক কম পরিমাণই হোক বা পাওয়ার আগের কণ্টকাকীর্ণ পথ) আর গবেষণাগারের আদত অবস্থা—এ নিয়ে তাঁর লেখায় যে পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠেছে, তার থেকে ভালো ছবি এই মুহূর্তে এই মাপের কোনো বইয়ে নেই, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
যাঁরা গুরুর বইপ্রকাশের পদ্ধতিটা জানেন, অথবা যাঁরা জানেন না—গুরুর বই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। যাঁরা কোনো বই পছন্দ করেন, চান যে বইটি প্রকাশিত হোক—তাঁরা বইয়ের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অর্থভার গ্রহণ করেন। আমরা যাকে বলি 'দত্তক'। এই বইটি যদি কেউ দত্তক নিতে চান, আংশিক বা সম্পূর্ণ, জানাবেন guruchandali@gmail.com-এ ইমেল করে।