হিন্দু ধর্মের উৎসস্থল হিসেবে ভারতবর্ষকে জানে সবাই। সিন্ধু নদের তীরবর্তী এলাকায় যারা বাস করতো তাদেরকে হিন্দু বলে আখ্যায়িত করা হয় সেই প্রাচীনকাল থেকে। সেই হিন্দুদের আচরিত ধর্মকেই হিন্দু ধর্ম বলা হয়। আবার অন্যমতে হিন্দু ধর্ম বলে কোনো ধর্ম হয় না বা নেই, আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলে বলি সেটা আসলে সনাতন ধর্ম। কিন্তু হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্ম, যাই হোক না কেনো, তা যে পৃথিবীর আদিতম ধর্ম এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার ভারতীয় সভ্যতা যে পৃথিবীর আদিতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। ভারতীয় সভ্যতা যেমন শুধু সিন্ধু নদের পাড়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, বিশেষ করে দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা এবং পরবর্তীতে দ্রাবিড়ীয় ও আর্য অথবা মঙ্গোলীয় সভ্যতার মিশ্র সভ্যতা যে ভারতবর্ষের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ ইতিহাসেই পাওয়া যায়। আদিকালে ভারতবর্ষ সভ্যতার নিরিখে বা ধনসম্পদের নিরিখে যে পৃথিবীর একটি সেরা দেশ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেইজন্যেই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশীবার বৈদেশিক আক্রমণের লক্ষ্য হতে হয়েছে ভারতবর্ষকে, আবার সবচেয়ে বেশী সময় জুড়ে বৈদেশিক শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে থাকতে হয়েছে ভারতবাসীকে। তবে বৈদেশিক আক্রমণের সময়কাল খুব বেশী দিন আগের নয়, হাজার খানেক বছরের। তার আগের সময়ের গৌরব, গরিমা সবকিছুই কিন্তু চাপা দেওয়া হয়েছে বৈদেশিক আক্রমণকারীদের গরিমার কাছে। অদ্ভুতভাবে আমরা নিজেদের ইতিহাস রচনা না করে বৈদেশিক আক্রমণকারীদের ইতিহাস রচনা করে, গরিমা ব্যাখ্যা করে বড়ই আত্মশ্লাঘা লাভ করি। তবুও নিজেদের ইতিহাস চাপা স্তূপের থেকে মাঝেমাঝেই বেড়িয়ে পরে কিছু মানুষের সৌজন্যে। তখন সেই সুগন্ধে চারিদিক ম ম করে। ভারতীয় রাজাদের সময়ে হিন্দু ধর্মের যে বাড়বাড়ন্ত ছিল এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল তা মূলতঃ রাজাদের প্রত্যক্ষ মদতে। আসলে রাজধর্ম বলে একটা ধর্ম চিরকাল পৃথিবীতে শাসন করে এসেছে। মানুষের মধ্যে কর্তৃত্ব করা বা শাসন করা বা আধিপত্য বিস্তার করার সহজাত প্রবৃত্তি আদিমকাল থেকেই উপস্থিত। তাই যেমন বাইরের রাজারা এদেশে এসেছেন তেমনি এদেশের রাজারাও বাইরের রাজ্য আক্রমণ করেছেন, নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করেছেন। ভারতীয় রাজারা যে বহির্বিশ্বে তাদের রাজত্ব চালিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে তার প্রমাণ রয়েছে প্রচুর। আবার সেই রাজাদের সাথে সাথে সেই রাজধর্মও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজত্ব বিস্তারের পাশাপাশি বাণিজ্যের সাথে সাথেও রাজধর্ম ছড়িয়ে পড়ে অন্যদেশে। তখনকার ভারতবর্ষ যেহেতু ধনসম্পদে শ্রেষ্ঠ ছিল, সেইহেতু বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল বিপুল। বহির্বিশ্বের প্রচুর দেশের সাথে আমাদের দেশের মানুষেরা বাণিজ্য করতো। ফলে আমাদের দেশের সংস্কৃতি যেমন অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়েছে তেমনি সনাতন বা হিন্দু ধর্মও ছড়িয়ে পড়েছে সেইসব দেশে। মূল ভাবনা ছিল, রাজা যে ধর্মের প্রতিপালন করছেন, অর্থাৎ রাজধর্ম, সেই ধর্ম মেনে নিলে করসহ বিভিন্নভাবে সুবিধা পাওয়া যাবে। অথবা, মূলতঃ যে দেশ থেকে বাণিজ্য করে পেট ভরে বা জীবিকা নির্বাহ হয় সেই দেশের ধর্ম মেনে নিলে বাণিজ্যে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, মঙ্গোলিয়া, চীন, মালয় সহ অনেক দেশেই বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন সময়ে। আবার এইসব দেশগুলো থেকেও বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল আরও অনেক দেশে। বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমে একীকৃত থাকলেও পরবর্তীতে হীনযান এবং মহাযান, দুইটি গোষ্ঠীতে বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মহাযান সম্প্রদায়ের সাথে সনাতন ধর্মের অনেকাংশেই মিল ছিল এবং পরবর্তীতে তারা হিন্দু বা মুসলিম ধর্মের সাথে মিলে যায়। এর ফলেও বিভিন্ন দেশে হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মের লোকের আধিক্য দেখা যায়। এইভাবেই ভারতবর্ষ থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল হিন্দু ধর্ম এবং সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে ভিয়েতনামে। আবার ভারতবর্ষের সাথেও খেমার সাম্রাজ্যের সরাসরি বাণিজ্য হতো একটা বিশাল সময় জুড়ে। সুতরাং সরাসরিভাবে ভারতবর্ষের প্রভাবও পড়ে থাকতে পারে সেখানে। ভাবতেও আশ্চর্য্য লাগে চীন, জাপান বা কোরিয়ার পাশে এক টুকরো ফালি একটি দেশে হিন্দু ধর্ম প্রসারিত হয়েছিল প্রাচীনকালে এবং এখনও টিকে আছে। অবশ্য পাশের দেশ কম্বোডিয়াতেও এখনও হিন্দু ধর্ম টিকে আছে। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতির আমদানি ঘটেছিল খেমার রাজত্বের সময়। দুটো দেশই খেমার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যদিও সেই সাম্রাজ্যের বিস্তার আরও বিস্তৃত ছিল। কম্বোডিয়ায় যেমন "আঙ্করভাট মন্দির" উল্লেখযোগ্য নিদর্শন তেমনি ভিয়েতনামে "মাই সন" মন্দির উল্লেখযোগ্য। ভিয়েতনাম হল এমন একটি দেশ যার সাথে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বা ভারতীয় সংস্কৃতির নিবিড় সংযোগ আছে। ভিয়েতনামের চম্পা নামে এখনো একটি নগর আছে যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায়। বর্মন রাজবংশের রাজার অধীনে একসময় এই চম্পা নগর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলে যে হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সমৃদ্ধশালী হয়েছিল তার নাম চম্পা রাজ্য এবং রাজধানী হল চম্পা (Champa)। চম্পা সম্ভবত এই রাজ্যটির একটি অঙ্গদ্বীপ ছিল যা বায়ুপুরাণেও উল্লিখিত আছে। এই হিন্দু রাজ্যের অধিবাসীদের বালামন চাম বা বালামণ হিন্দু বা চাম হিন্দু বলা হত। রাজ্যটি ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলের কেন্দ্র থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল যার মধ্যে কোয়াং নাম (Quang Nam) কে চামদের পবিত্র ভুমি হিসেবে বিবেচনা করা হত। অন্যান্য ভাগগুলির মধ্যে ছিল উত্তরে অমরাবতী (Amaravati / Part of Quang Nam) আর দক্ষিণে পান্ডুরাঙা (Panduranga / Phan Rang), কৌথারা (Kauthara / Nha Trang), বিজয়া (Vijaya / Binh Dinh) ও ইন্দ্রপুরা (Indrapura)। চাম অধিবাসীগণ প্রাচীন ভারতের সাথে শক্তিশালী বানিজ্য সম্পর্ক তৈরী করেছিল এবং সেই কারণেই তারা হিন্দু ধর্ম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল যা তাদের ধর্মীয় অনুশীলন ও শিল্পকর্ম থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়। চামেরা বেশীরভাগ কৃষিজীবী, মাছ ধরা, মন্দির নির্মাণ ও ভাস্কর্য শিল্পে দক্ষ ছিল। তাদের কারিগরী দক্ষতার প্রমাণ এখনো ভিয়েতনাম (Vietnam) ও কাম্বোডিয়ার (Cambodia) প্রাচীন মন্দিরগুলিতে দেখা যায়। আবার কম্বুজা রাজ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর বসবাস ছিল এবং সেটাও হিন্দু রাজ্য ছিল। তৎকালীন কম্বুজা রাজ্যের বর্তমান অবস্থান হলো ভিয়েতনামের পার্শ্ববর্তী দেশ কাম্পুচিয়া বা কম্বোডিয়া রাষ্ট্র।
সেই যুগে চম্পা নগর ছিল বিশ্ব বানিজ্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং গুরুত্বপূর্ণ সমূদ্র বন্দরগুলির সাথে এর সংযোগ ছিল। চাম হিন্দুরা জাপান, তাইওয়ান, চীন, ভারত, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত বানিজ্য যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। বহু পুরোনো ভাঙা জাহাজের অংশবিশেষ ফিলিপিন্স ও চম্পার মধ্যে সমৃদ্ধ বানিজ্যের ইতিহাস প্রমান করে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে চামরা সা হুন (Sa Huynh) এর বংশধর ছিলেন। তারা মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভিয়েতনামের পূর্ব উপকূলে সমূদ্র পথে প্রায় 1000 খ্রীষ্টপূর্বে যাত্রা করে, মূলত চীন ও মালয়ের মধ্যে বানিজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে। চামেরা ভিয়েতনামে পৌছানোর সময় থেকে সেই দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলেই রয়ে গিয়েছিল এবং অবশেষে চাম কিংডম নামে তাদের রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, যা প্রায় ১৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিল (১৫০-১৪৫০ খ্রীঃ)।
লোকমতে চাম সাম্রাজ্যের স্থপতি ছিলেন কিউ লিয়েন (Kiu Lien) যিনি তার রাজধানী হু (Hue) এর নিকটে স্থাপনা করেছিলেন, যদিও এর প্রত্যক্ষ প্রমান নেই। ঐতিহাসিক ভাবে লিপিবদ্ধ প্রথম চাম রাজা ছিলেন শ্রী মারা (2nd CE) যিনি প্রথম চাইনিজদের থেকে চাম সাম্রাজ্যকে মুক্ত করেছিলেন। ২২০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে চীনে হান পতনের পর চম্পা রাজত্বের পরিধি বাড়তে থাকে, ২৪৮ খ্রীষ্টাব্দে চম্পা রাজার বিশাল নৌবাহিনীর কাছে চীন পরাজিত হয়। এলাকা দখলের লড়াই অবশ্য পরবর্তী ১০ বছর যাবৎ চলতে থাকে এবং শেষে চীনের আধিপত্য চিরতরে বিলীন হয়। চাম সাম্রাজ্যের সব থেকে প্রভাবশালী রাজা ছিলেন ভদ্র বর্মন এবং ঠিক এই সময়ে চাম সাম্রাজ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটে ও চামেরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে।
৬০০ খ্রীষ্টাব্দে মাই সন-এ (My Son জায়গা) ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে রাজা ভদ্র বর্মন সুন্দর ও আকর্ষণীয় মন্দির নির্মাণ করেন। চামেদের জাতীয় ধর্মীয় মনুমেন্ট হিসাবে ঘোষণা করা হয় এই মন্দির আর মূর্তিকে ভদ্রেশ্বরসভামিন নাম দেওয়া হয়। ভারতীয় রাজাদের মত চাম রাজারাও বর্মন উপাধি নিয়েছিলেন তাদের নামের শেষে। ভদ্রবর্মনের পুত্র গঙ্গারাজা তার শেষজীবনে রাজত্ব ত্যাগ করে ভারতে এসেছিলেন এবং এখানেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। গঙ্গা রাজার পর চাম কিংডম পান্ডুরাঙ্গা (Panduranga), ভ্রিগু (Vhrigu) এরকম ছোটো ছোটো ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। অষ্টম শতকের পরবর্তী সময় থেকে রাজধানী মাই সন এর জৌলুশ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। পান্ডুরাঙ্গা কিংডম ৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল। অনেক মন্দির তারা পুনরায় নির্মান করেছিলেন যেগুলো পরবর্তীতে জাভা অধিবাসীদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল। চীন এবং কাম্বুজার (Cambodia Khmer Hindu) বিরুদ্ধে তারা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ভ্রিগু রাজাদের (৮৬০-৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দ) দ্বারা চম্পা কিংডম পুনরায় শক্তিশালী হয়েছিল বিশেষত ভদ্রবর্মন-৩ এর শাসনকালে (৯০৫-৯১০ খ্রীষ্টাব্দ)। অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের ব্যাপারে, বিদেশী দূতদেরও আনাগোনা ছিল তাঁর রাজত্বকালে। ভদ্রবর্মন-৩ এর পুত্র ইন্দ্রবর্মন-৩ সেই সময়ের একজন বিখ্যাত স্কলার ছিলেন। তিনি সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন এবং বুদ্ধের দর্শন সম্পর্কেও অবহিত ছিলেন। কাম্বুজা শাসকের আক্রমনে তাঁর রাজধানীর চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তাঁর পুত্র পরমেশ্বর বর্মনের রাজত্বকালে আন্নামিস (Annamese, North Vietnam or Dai Viet) রাজারা চাম সম্রাজ্যে আক্রমন করেছিল এবং যুদ্ধে পরমেশ্বরের পরাজয় ও মৃত্যু হয়। আন্নামিসরা চম্পা কিংডমের একটা বড় অংশ ৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিল, পরবর্তীতে চাম নেতা বিজয় শ্রী হরিবর্মন-২ তাদেরকে পরাজিত করে চাম সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার করে। আবার আন্নামিসরা এই চম্পা সম্রাজ্য এয়োদশ শতাব্দীতে (1300 CE) পুনরায় দখল করে এবং ষোড়শ শতাব্দীতে (১৬০০ খ্রীঃ) মোঙ্গলদের কাছে পরাজিত হলে তা মোঙ্গলদের হাতে চলে যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে (১৭০০ খ্রীঃ) চম্পা ও দাই ভিয়েত একত্রিত হয় যদিও অলিখিত ভাবে চাম অঞ্চল আলাদা সত্তা নিয়ে থাকে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ভিয়েতনামে এখনো খুব কম সংখ্যক চাম অধিবাসী বাস করে। বেশীরভাগ চাম অধিবাসী সপ্তদশ শতাব্দীতে ভিয়েতনামীদের অত্যাচারে মালয়, পেনিনসুলা, জাভা, হাইনান, কাম্বোডিয়া ও সুমাত্রাতে পালিয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে চাম জনসংখ্যা ব্যপক হারে কমে যায় যখন ১৯৭৫ – ১৯৭৯ সালে খেমের রুজ (Communist Rule of Khmer Rouge Group, Pol Pot) কমিউনিস্টরা নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করে চামেদের। খেমের রুজ কমিউনিস্ট চেয়েছিল খেমের ছাড়া আর কোনো এথনিক মানুষ কাম্বোডিয়ায় থাকবে না। চামেরা যে হিন্দু মন্দির নির্মান করেছিল তা মূলত পাকা ইটের তৈরী এবং শিখর বিশিষ্ট। অন্যদিকে খেমের হিন্দুরা (কাম্বোডিয়া) যে হিন্দু মন্দির নির্মাণ করেছিল তা মূলত পাথরের। বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনো ভিয়েতনাম ও কাম্বোডিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে ষষ্ঠ শতকে নির্মিত মাই সন এর শিব মন্দির হল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সব থেকে পুরোনো মন্দির যা এখোনো পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মের ছোঁয়া স্পষ্টভাবে বিদ্যমান এই মন্দির চত্বরে।
ভিয়েতনামের এই প্রথম নিজস্ব মুদ্রা নির্মিত হয় দিন রাজবংশের (৯৬৮-৯৮১ সাল) শাসনকালে, ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। এর পূর্বে ভিয়েতনামে চিনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। আন্নাম অর্থাৎ বর্তমান ভিয়েতনাম ৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চিনের দক্ষিণ হান রাজবংশের আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভের পর ৯৪৪ থেকে ৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১২ জন বিবদমান শাসকদের দ্বারা শাসিত হত। দিন বো লিন (রাজত্বকাল ৯৬৮-৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এই অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে প্রথম সমগ্র বর্তমান ভিয়েতনামকে একটি সাম্রাজ্যের অধীনে আনতে সক্ষম হন। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন নাম দেন ‘দাই কো ভিয়েত’ (মহান ভিয়েত), এই নামই বর্তমান ভিয়েতনাম নামের উৎস। ৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে হত্যা করা হয়। স্বল্পস্থায়ী ‘দিন’ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দিন বো লিন ভিয়েতনামের ইতিহাসে দিন তিয়েন হোয়াং (প্রথম দিন সম্রাট) নামেও পরিচিত। ভিয়েতনামের প্রথম নিজস্ব মুদ্রা তিনিই নির্মাণ করান। ভিয়েতনামের এই প্রথম নিজস্ব মুদ্রা ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি। এই মুদ্রাগুলি ২৫ মিমি ব্যাসের, ২.২ গ্রাম ওজনের, গোলাকৃতি, কেন্দ্রস্থলে চতুষ্কোণ ছিদ্রবিশিষ্ট। মুদ্রাগুলির একপিঠে লেখা থাকত ‘থাই বিন হুং বাও’ (থাই বিন কালপর্ব, অর্থাৎ ৯৭০-৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মুদ্রা) ও অন্যপিঠে লেখা রাজবংশের নাম ‘দিন’। এই মুদ্রা খুব কম সংখ্যায় নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রথম স্বাধীন সত্ত্বার প্রতীক হিসাবে ভিয়েতনামের ঐতিহ্যে এই মুদ্রার একটি উল্লেখনীয় স্থান রয়েছে।
আজ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে দেশটির নাম বার বার সংবাদের শীর্ষকে দেখা যায়, সেই ভিয়েতনামের অধিবাসীদের দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মনির্ভরতা অর্জনের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাথে আজও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার হিন্দুধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতির ইতিহাস।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।