উফ্ যেন সাঁড়াশি ছাড়া গরম জলের পাত্র হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দিয়েছে কেউ! খোলা আকাশের নিচে, চামড়ায় ৪০ ডিগ্রির ছ্যাঁকা খেতে খেতে বিশ্বাস করুন ঠিক এই কথাটাই মনে হচ্ছিল সেদিন। ভরন্নি দুপুরবেলা। ছুটির দিন। বছর শেষের বিকিকিনির হাট বসেছে সর্বত্র। গড়িয়াহাট মার্কেটের পসরাগুলোতে একবার ঢুঁ মারার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। উঠল বাই তো দরগা যায়। বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম ছয় বছরের ননীর পুতুল আর ছত্রিশ বছরের চওড়া কাঁধকে। দিনভর ঘুরুঘুরু আর দেদার কেনাকাটার স্বপ্নে আমি তখন উড়ছি। ‘কাবাব মে হাড্ডির’ মতো জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সূয্যি ঠাকুর একচোট শাসিয়ে গেলন, ‘বেশী উড়োনা ডানা পুড়ে যাবে ! সত্যি টি.এস এলিয়ট কিছু ভুল বলেননি, “April is the cruellest month”.!
"একশো টাকায় একজোড়া। একশো টাকায় একজোড়া। আর মাত্র ক’দিন.. মাত্র ক’দিন ”— ক্রমাগত হাঁকছিল রাস্তার উপরে ঢেলে সাজানো এক দোকানদার। মায়ের হাত ধরে ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়লাম। দেখি রকমারি চপ্পলের মেলা। নিজের পায়েরটার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম দিব্যি তন্দরুস্ত আছে। অতএব শিকে ছিঁড়বে না। হঠাৎই কেমন যেন একটা বৈরাগ্য এলো আমার পাদুকালয়ের প্রতি ! পা বাড়ালাম রকমারি পোশাকের স্টল গুলোতে।
এ ছবি বছর বিশেক পুরনো। তখনো আমাজন, ফ্লিপকার্ট, মিশো আসেনি। বিগ বাজার, রিলায়েন্স, স্টাইল বাজার শহরতলিতে মাথা গলায়নি তখনো। দিওয়ালি ধামাকা, ক্রিস্টমাস স্পেশাল, স্বতন্ত্রতা দিবস কি উপহার ও বহুতদূর! নিউমার্কেট, হাতিবাগান, এসপ্ল্যানেড, চাঁদনী, বড়বাজার ছিল আমাদের মফস্বলীয় মধ্যবিত্তের গণ্ডির বাইরে। কব্জি ডুবিয়ে কেনাকাটার উপুরহস্ত ময়দান ছিল এক ও একমাত্র চৈত্র সেল।
শৈশবে দেখেছি চৈত্র মাস পরতেই পাড়ার কাকী-জেঠিদের মধ্যে রীতিমতো সাড়া পড়ে যেত। পুজোর আগুনছোঁয়া বাজারে যে শখ তাদের পূরণ হয়নি এবার তা ঝাঁপি থেকে মুখ বাড়াত। চলতো ভান্ডার ভাঙ্গা। পুজোর পর থেকে জমানো যৎসামান্য খুদঁকুঁড়োর সঙ্গে যদি কর্তার থেকেও কিছু ম্যানেজ করা যেত তাহলে তো ‘সোনে পে সুহাগা’। বিকেল বিকেল সখীদল জুটিয়ে সব হাজির হতো বছরশেষের স্টক ক্লিয়ারেন্সের বৃহত্তর মার্কেট চৈত্র সেলে।
শুধু শখ পুরন কেন ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ জনগোষ্ঠীর কাছে চৈত্র সেল কেনাকাটার এক স্বর্গোদ্যান যেন ! মেয়ের বিয়ের তত্ত্ব- তল্লাশের অগ্রিম আয়োজন কিংবা পুজোর সময় নিকট আত্মীয়দের জন্য বরাদ্দ পোশাক অথবা সম্বৎসরের জুতো থেকে ব্যাগ, ছাতা থেকে হাতা -- সস্তায় মাল কিনে বাড়ি ফেরার এমন হরির লুট সে যুগে আর একটাও ছিল বলে আমার জানা নেই। অবশ্য ভিড়ের বাজারে একেবারে অচল জিনিস কিনে কপাল চাপড়াতেও কিন্তু কম জনকে দেখিনি !!
এখন অপশন অনেক। মুঠোফোনের এক ক্লিকেই বিশ্বজোড়া বিপণন মারকেট হাতের মুঠোয়। পথে নামলেই শপিং জায়েন্টদের হাতছানি। ডিসকাউন্টের নামে সুচতুরভাবে সেখানে আপনাকে গছিয়ে দেওয়া হবে বড়সড়ো একটা প্যাকেজ। যতক্ষণে আপনি লাভ লোকসানের হিসেব করবেন ‘বাত তবতক হাত সে নিকাল গয়ি’।
শহরতলীর জল হাওয়ায় পুষ্ট। ছোট পুঁজির সমর্থক। ফেলে-ছড়িয়ে, মেখে-মাখিয়ে, দরদাম করে কেনাকাটায় আমাদের ট্রেডমার্ক। সেল বাজার উপলক্ষে স্বল্প ক্ষমতাধর ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যে আদান প্রদান হয়, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তার ঠিক কতটা গুরুত্ব পন্ডিতেরা সেসব ভাবুকগে ! আমি শুধু রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, মাঠে-ময়দানে কেনাকাটার মধ্যে দিয়ে বুড়ি ছুঁয়ে আসতে চাই নিজের ফেলে আসা তিনটে দশকের। সূয্যি মামার চোখ রাঙানিকে তাই থোড়াই কেয়ার !!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।