মধ্যবিত্ত কারা?
বিশেষ করে বাঙালি মধ্যবিত্ত। অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন তাতে নিম্ন মধ্যবিত্তর আয়ের সীমা ছ লাখ থেকে সতেরো লাখ বছরে। তাহলে অর্থমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী মধ্যবিত্তর আয় আরো বেশী। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত কি এতটাই রোজগেরে? ইতিহাস কি বলে?
১৮২৯ সালে বঙ্গদূত পত্রিকা প্রথম বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উল্লেখ করে। সেখানে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবের জন্য চারটি কারন বলা হয়েছিলো, প্রথমত জমির দাম বেড়েছে, দ্বিতীয়ত অবাধ বানিজ্য, তৃতীয়ত ইউরোপীয়দের এদেশে আসার ফলে বাঙালির ধন বৃদ্ধি হয়েছে। আর চার নম্বর কারনটা হলো মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতির বিস্তার।
বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর উদ্ভব রহস্য লুকিয়ে আছে উনিশ শতকের শিক্ষা বিস্তারে। মোটকথা শিক্ষা আস্তে আস্তে বাঙালিকে যেমন আত্মনির্ভরশীল করে তুললো তেমন ভাবেই অর্থনীতির দিক থেকে আলাদা শ্রেণীর তৈরিও করে ফেললো।
১৭৮৪ সালে উইলিয়াম জোনসের উদ্যোগে তৈরি হলো এশিয়াটিক সোসাইটি। লর্ড ওয়েলেসলির সহায়তায় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। লর্ড মেকলে ১৮৩৪ সালে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৭ সালে তৈরি হলো হিন্দু স্কুল। আবির্ভাব ঘটলো ইয়াং বেঙ্গল দলের। শিক্ষায় আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে থাকলো। এই সময়ে এলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। বেথুন সাহেব লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন ইন ক্যালকাটা এবং জুভেনাইল সোসাইটি এর মাধ্যমে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা শুরু করলেন।
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হওয়ার পিছনে সাহিত্যিকদের ভূমিকা খুব একটা কম ছিলো না। বরং বলা যায় অন্যতম প্রধান প্রভাব ছিলো সাহিত্যিকদেরই। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস বাঙালি মানসে সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করলো। তৎকালীন উচ্চশ্রেনীকে বারবার বিদ্ধ করতে লাগলেন তাঁর লেখা দিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে চলে এলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন গল্প,উপন্যাসে ফুটে ওঠে সময়। তাই তার উপন্যাসে খুব একটা মধ্যবিত্ত শ্রেনী বা নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কথা উঠে আসেনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত চেতনায় যাঁর লেখা সাংঘাতিক ভাবে নাড়া দিয়েছিলো তিনি হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
"শিক্ষিত সম্প্রদায়ের আর এক দুঃখের কারন দারিদ্র। ইহাদের বিলাসিতা ও অন্যান্য অভাব খুব বাড়িতেছে,কিন্তু বিলাস সামগ্রীর দুর্মূল্যতা ও ইহাদের দরিদ্রতার জন্য ইহাদের বিলাসপ্রিয়তা চরিতার্থ হইতেছে না। অপূর্ণ অভাবজনিত দুঃখ শিক্ষিত সম্প্রদায় পূর্ণমাত্রায় ভোগ করিতেছে।"
১৮৯০, তত্ত্ববোধিনীর জৈষ্ঠ্য সংখ্যাতে রবীন্দ্রনাথ লিখে ছিলেন।
ভবতোষ দত্ত লিখেছিলেন," ষাট বছর আগে আমরা মধ্যবিত্ত বলতে শুধু আয়ের দিকটা বুঝতাম না,আরো অনেক কিছু বুঝতাম। ভদ্রলোক মাত্রেই মধ্যবিত্ত ছিলেন না,কিন্তু তখনকার দিনে মধ্যবিত্তেরা সবাই ভদ্রলোক।।তারা প্রধানত ছিলেন চাকুরীজীবী -কাজ করতেন সরকারি আর মার্চেন্ট অফিসে,স্কুলে,কলেজে,সংবাদপত্রে,প্রকাশনা সংস্থায়,প্রশাসন,পুলিশ ইত্যাদির নিচের স্তরে। অবশ্য চাকরি পাওয়াটা সৌভাগ্যের কথা ছিলো। ১৯৩০ এর কাছাকাছি প্রথম শ্রেনীতে বি.এ অনার্স,আর এম এ পাশ করে তিন-চার বছর কোনো কাজ পান নি এমন নজির অনেক ছিলো সর্বস্তরে। মধ্যবিত্ত স্তরে সমস্যাটা বড় হয়ে দেখা দিত, কারন ভদ্রলোকেরা সব ধরনের কাজ নিতে চাইতেন না। যদিও কোনো কোনো কায়িক পরিশ্রমের মজুরী অফিসের কেরানির চেয়ে বেশী ছিলো।"
অনেকদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া কিম্বা অনেক দূরে বেড়াতে যাওয়া সেই সময় মধ্যবিত্তর সাধ্যে ছিলো না। শহরের মানুষজনেরা পুজোর সময় দেশে ফিরতেন। মধ্যবিত্তর জন্যই রেলে ইন্টার ক্লাস ছিলো। মনীষ ঘটকের কবিতা আছে এটা নিয়ে।
"সব সময় রেলের ইন্টার ক্লাস মধ্যবিত্ত। যাত্রীদলের সামাজিক আর আর্থিক অবস্থার দিক থেকে তো বটেই, অন্যান্য দিক থেকেও। ওর আসন অতিমাত্রায় নরম গদি মোড়া নয়,আবার কাষ্ঠাসনও নয়। ওর গদি এত চওড়া নয় যে বাড়ির আরামে ঘুমোতে পারি। এত সরুও নয় যে গাড়ির ঝাঁকুনিতে স্থানচ্যুত হই। "--লিখেছিলেন নব্যেন্দু বসু। ঢাকা মেল,চাঁটগা মেল,দার্জিলিং মেলে কলকাতার চাকুরিজীবী, উকিল সবাই পুজোর সময় বাড়ি যেতেন। কলকাতা থেকে ঢাকা ইন্টার ক্লাসের ভাড়া ছিলো সাড়ে এগারো টাকা।
ভবতোষ দত্ত অসাধারণ কিছু সমাজের চিত্রটা কি ছিলো তুলে ধরেছেন। তিনি লিখছেন..." যাঁর চাকরি ছিল তাঁরও ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোত না। একজন দেড়শো টাকা মাইনের বেসরকারি কলেজের অধ্যাপকের বাড়ি ভাড়া দিতে হত ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা। তখন হাজার হাজার ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হয় নি। কম ভাড়ার বাড়ি বলতে বোঝাত একটা বড় বাড়ির অংশ। আসবাবপত্র যথাসম্ভব কম। কয়েকটা তক্তপোশই প্রধান সম্বল।একটি সারাদিনের গৃহভৃত্য এবং একটি বাসন মাজা ঝি থাকত। দু-তিনটি ছেলেমেয়ের স্কুলে পড়াবার খরচ ছিলো, কিন্তু স্কুলের আভিজাত্য নিয়ে ভাবনা ছিলো না। প্রতি ছাত্রের জন্য মাসে তিন-চার টাকা মাইনে দিলেই হত। খাবার খরচ খুব কম ছিলো। মাসে দশ,পনেরো টাকায় একজনের খাওয়া হয়ে যেত। একটা ধূতির দাম ছিল এক টাকা -পাঁচসিকে,শাড়ির দাম আড়াই টাকা-তিন টাকা। ধূতির সঙ্গে পাঁচসিকে দামের টুইলের শার্ট অনেকে পরতেন। চাঁদনিতে গেলে দাম আরো সস্তা হত।
লোক লৌকিকতার বোঝা চাপত প্রায় নিয়মিত।বিয়েতে হয়ত একখানা বই-শরৎচন্দ্রের সিল্ক প্যাডে বাঁধাই একটাকা দামের পরিনীতা প্রত্যেক বধূই কয়েকখানা করে পেতেন।"
এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত। বাঙালি মধ্যবিত্ত। টিকা, টিপ্পনী, টিটকিরি, টনসিল, টেনশান, টেনিসান, কাব্য-টাব্য, তেঁতুলের টক, টিয়া পাখি, এসবে যতটা ভরসা রাখে, টাকায় ততটা রাখে না। আবার যদি বলি টাকাতেও রাখে, তবে ব্যবসায় রাখে না। ব্যবসা এখানে অন্যরকম, চাঁদা-টাদা তোলা, সিন্ডিকেট-টিন্ডিকেট, নেতা-টেতা গিরি।
তবুও বাঙালি মধ্যবিত্ত ইতিহাসে থেকে যাওয়া উপন্যাস । যার প্রতিটা অধ্যায় মিশে আছে আবেগ-টাবেগ দিয়ে।
তথ্য - সুভাষ সাহা, ডঃতাপস অধিকারীর কিছু লেখা এবং অন্যান্য।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।