শিকাগো ধর্মমহাসভার কথা এলেই আমরা ভাবি ঐ তো 'Sisters and brothers of America', আর নাকি বিরাট হাততালি কিন্তু এর বাইরেও যে কিছু আছে তা এত তলিয়ে দেখি না।
১৯ শে সেপ্টেম্বর ধর্মমহাসভার নবম দিনে স্বামী বিবেকানন্দ একটি লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন, বিষয়-হিন্দু ধর্ম।
ধর্ম বললেই আমরা বুঝি তা যেন শুধুমাত্র সংসারত্যাগীদের জন্য বিশেষ করে যারা ঈশ্বর সাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন তা তিনি আশ্রমেই থাকুন বা হিমালয়ের গিরিগুহায়, আর তা না হলে ধর্ম একেবারেই বৃদ্ধ বয়সের ব্যপার। কিন্তু ধর্মও যে একটা বিজ্ঞান, যা আমাদের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটায় (Science of human possibilities), তা আমরা সচরাচর ভেবে দেখি না। জীবনের কিছু বুনিয়াদী প্রশ্নের উত্তর আমরা এর থেকেই পেতে পারি। কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণেই দেখা যায় ধর্ম আজ যেন বেশি করে মানুষ ঠকানোর বিষয় হয়ে উঠেছে । সেইরকমই, আমায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করে হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক কে, একেবারেই ছেলেমানুষি হয়ে যাবে, কার নাম বলব, রাম, শ্যাম না অন্য কেউ। আচ্ছা, স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মমহাসভায় হিন্দু ধর্ম বিষয়ে ঠিক কি কি বলেছেন?
হিন্দু ধর্মে সর্বোৎকৃষ্ট বেদান্ত জ্ঞান থেকে মূর্তি পূজা ও আনুষঙ্গিক পৌরাণিক গল্প এমনকি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতবাদ সবকিছুই আছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এইসব আপাতবিরোধী ভাব কী করে একত্রিত হল। হিন্দুরা বলে, তারা বেদ থেকে তাদের ধর্ম লাভ করেছে। ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চারটি টি বেদ-এর মাধ্যমে সংহত করেছেন তাই তাকে বেদব্যাস বলে। তাই বেদ কোনো বই নয়, বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে যে আধ্যাত্বিক সত্য আবিষ্কার করেছেন তারই ভান্ডার। তাই আবিষ্কার হওয়ার আগেও যেমন এই সমস্ত সত্য ছিল মানুষ যদি কোনদিন সব ভুলেও যায় তাও এই সত্য থাকবে, শুধু তখন তা হবে মানুষের অজানামাত্র। তাহলে এই সকল সত্য অনন্তকালের জন্য, কিন্তু এখন প্রশ্ন হতে পারে এই সকল আধ্যাত্বিক সত্য ভবিষ্যতে সবসময় থাকলেও এর নিশ্চয়ই সৃষ্টি হয়েছিল কোন একসময়ে। কিন্তু বেদ বলে-এই সব সত্য অনাদি। কোন কিছুর সৃষ্টি থাকলে তার ধ্বংস হবেই। যেমন ধরা যাক, শক্তি, তা সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, একমাত্র রূপান্তর সম্ভব ঠিক সেইরকম, এই সকল আধ্যাত্বিক সত্য অতীতেও ছিল ও ভবিষ্যতেও থাকবে।
এবার, কি এই আধ্যাত্মিক সত্য, যা নিয়ে এত কথা। চোখ বুজে আমি যদি নিজের চিন্তা করি, 'আমি', 'আমি', 'আমি' তাহলে আমি কি দেখি? আমি এই দেহ, এই বোধ হয়। কিন্তু বেদ বলে আমি এই দেহ নই, দেহ মধ্যস্থ সেই সত্তা যার সৃষ্টি নেই, তা অনাদি ও অনন্ত।
আবার দেখা যায়, কেউ জন্ম থেকেই সুখ ভোগ করছে শরীর সুস্থ, মন উৎসাহ পূর্ণ, কিছুরই অভাব নেই কিন্তু কেউ জন্ম থেকেই দুঃখ ভোগ করছে হাত নেই পা নেই, হয়তো বা জড়বুদ্ধি সম্পন্ন অতি কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। তা কেন হবে? যদি ভগবান বলে কেউ কোথাও থেকেও থাকেন তাহলে তিনি এমন একপেশে হবেন কেন ? যদি এ কথা ভাবি, এ জন্মে যে সুখ ভোগ করেছে পরজন্মে সে দুঃখ ভোগ করবে এবং এজন্মে যে দুঃখ ভোগ করেছে পরজন্মে সে সুখ ভোগ করবে তাহলেও সমস্যার সেরকম কিছু সমাধান হয় না, সর্বশক্তিমানের নিষ্ঠুর আদেশ মেনে নেওয়া হয়। তাহলে এ সব, অবৈজ্ঞানিক, নিশ্চয়ই সুখ ও দুঃখ ভোগ করার পেছনে কোন কারণ আছে।
পূর্বজন্মের কর্মসমূহই সে কারণ। তাহলে পূর্বজন্মের কথা আমার মনে নেই কেন? স্বামী বিবেকানন্দ খুব সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন, আমি এখন ইংরেজিতে কথা বলছি, ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয় কিন্তু আমি আমার মাতৃভাষা যদি স্মরণ করি তা এখনই মনে প্রবল বেগে উঠে আসবে। ঠিক সেই রকমই চেষ্টা করলে পূর্বজন্মের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে।
এবার প্রশ্ন হতে পারে, এই শুদ্ধ মুক্ত পবিত্র আত্মা কেন জড়ের মধ্যে আবদ্ধ হল? হিন্দুরা বলে, তা তো আমরা জানি না।
"জানি না, কেমন করিয়া পূর্ণ আত্মা নিজেকে অপূর্ণ এবং জড়ের সহিত যুক্ত ও জড়ের নিয়মাধীন বলিয়া মনে করেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ব্যাপারটি তো অনুভূত সত্য। প্রত্যেকেই তো নিজেকে দেহ বলিয়া মনে করে।"
আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে, এর থেকে কি বেরোনোর উপায় নেই, আমি কি সবসময় জড়ে আবদ্ধ থাকবো?
বৈদিক ঋষি বিশ্বসমক্ষে ঘোষণা করেছেন-
"......শোনো বিশ্বজন
শোন অমৃতের পুত্র যত দেবগন
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ম্ময়, তারে জেনে তার পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি।"
অর্থাৎ, অন্তরের সেই জ্যোতির্ম্ময় সত্তাকে জানলেই মৃত্যুকে এড়ানো যাবে।
এই কথা শুনিয়েই, সমস্ত খ্রিষ্টান শ্রোতাদের সামনে স্বামীজি ঘোষণা করলেন তোমরা পাপী নও, অমৃতের পুত্র, মানুষকে পাপী বলাই পাপ, মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা। তোমরা জড় নও, দেহ নও, জড় তোমাদের দাস, তোমরা জড়ের দাস নও।
কোন মতবাদ বা বদ্ধমূল ধারণায় বিশ্বাস করাই হিন্দু ধর্ম নয়, অপরোক্ষানুভূতিই তার মূল মন্ত্র, আদর্শস্বরূপ হয়ে যাওয়াই ধর্ম। মানুষ পূর্ণ হলে, আদর্শ স্বরূপ হলে কি হয়? তিনি অনন্ত আনন্দময় জীবনের অধিকারী হন। প্রকৃত আনন্দের উৎস তিনি লাভ করেন, জীবন পরমানন্দময় হয়ে ওঠে। ভারতের সকল সম্প্রদায়ের এই সাধারণ ধর্ম।
একত্বের আবিষ্কার ছাড়া বিজ্ঞানে আর কিছুই নেই। স্বামীজি বলেছেন কেমিস্ট্রিতে যদি এমন একটি পদার্থ আবিষ্কার হয় যা থেকে সমস্ত পদার্থ তৈরি করা যাবে তাহলে কেমিস্ট্রি তার চরম উন্নতি লাভ করবে, ঠিক একইভাবে ফিজিক্সে যদি এমন শক্তি আবিষ্কার করা যায়, যা থেকে সমস্ত শক্তির রূপান্তর হয়েছে তাহলে ফিজিক্সও তার চরম উন্নতি লাভ করবে (যেটা আজকের The theory of Everything)। ঠিক তেমনি ধর্ম-বিজ্ঞানও সেইদিন পূর্ণতা লাভ করেছে যেদিন সে সর্বজীবের একত্ব আবিষ্কার করেছে। অর্থাৎ আমারা সবাই এক। Vedanta teaches the doctrine of Universal Oneness. 'বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির ব্যবস্থা, হিন্দুগণ এই রহস্য ধরিতে পারিয়াছেন।'
এখন যদি দর্শনের উচুঁ শিখর থেকে নেমে এসে সাধারণ মানুষের ধর্ম সমন্ধে ভেবে দেখি। তাহলে একটা বিষয় উঠে আসবে, হিন্দুরা মূর্তি ব্যবহার করে কেন ? কারণ কোন বিষয় চিন্তার সময় আমাদের মনে যেমন বিষয় অনুযায়ী রূপ ফুটে ওঠে। সেই রকম জড় মূর্তি দেখলে মনের মধ্যে ভাব ফুটে ওঠে। সংক্ষেপে, মূর্তি মন স্থির করতে সহায়তা করে কিন্তু হিন্দুরা জানে প্রতিমা ঈশ্বর নয়। অনেক মূর্তিপূজক আছেন যাদের মতো নীতিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম কখনো কোথাও দেখা যায় না। তখন মনে প্রশ্ন আসে, পাপ হতে কি পবিত্রতা জন্ম নিতে পারে ? হিন্দুর দৃষ্টিতে মানুষ অসত্য থেকে সত্যের দিকে যায় না, বরং সত্য থেকে সত্যের দিকে যায়, নিম্নতর সত্য থেকে উচ্চতর সত্যে । মন্দির, প্রতিমা বা ধর্মশাস্ত্র - সবই মানুষের ধর্ম জীবনের প্রাথমিক অবলম্বন ও সহায়ক মাত্র, তাকে আরও এগিয়ে যেতে হয়। হিন্দু ধর্মে মূর্তি পূজা একান্ত পালনীয় বিষয় নয় কিন্তু কেউ যদি মূর্তি পূজার মাধ্যমে অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটায়, তখন তাকে তো পাপ বলা যায় না। তাই ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা বললে তা আসলে অপরিণত মনের উচ্চ আধ্যাত্বিক ভাব গ্রহণের চেষ্টা মাত্র বোঝায়।
"অতএব হিন্দুর পক্ষে সমগ্র ধর্মজগৎ নানারুচিবিশিষ্ট নর-নারীর নানা অবস্থা ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে সেই এক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। প্রত্যেক ধর্মই জড় ভাবাপন্ন মানুষের চৈতন্য স্বরূপ- দেবত্ব বিকশিত করে, এবং সেই এক চৈতন্য স্বরূপ ঈশ্বরই সকল ধর্মের প্রেরণাদাতা। তবে এত পরস্পরবিরোধী ভাব কেন? হিন্দু বলেন- আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষের উপযোগী হইবার জন্যই এক সত্যই এরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ ভাব গ্রহণ করে।"
"ইহাই হিন্দুদের ধর্ম বিষয়ক ধারণাগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ।"
স্বামীজি এও বলেছেন, হিন্দুরা হয়তো তাদের সব চিন্তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারেনি, কিন্তু কোন দিন সার্বজনীন ধর্ম বলে যদি কিছু হয় যা সমস্ত বৈষম্য ভুলে সবাইকে আপন করতে পারবে, তা হল এই চিন্তারাশি।
স্বামীজির কথায় মানুষের সেবা ও ভগবানের পুজোয়, পৌরুষ ও বিশ্বাসে, সদাচার ও আধ্যাত্মিকতায় কোন পার্থক্য নেই।
সবই তো ভালো কথা, তাহলে, এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আমার ভরসা দিন দিন কমছে কেন? কারণ, আমি তো ধর্মের দর্শনের দিকটা একেবারেই জানি না, শুধু কিছু যুক্তিহীন, মানুষ ঠকানোর হাবিজাবি কথা শুনি, যাতে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে হয়, কোন প্রশ্ন করা যায় না। তাই ধর্মকে যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস বলে মনে হয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।