এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • দুর্গোৎসব 

    Saswati Basu লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ১৪ অক্টোবর ২০২১ | ১৬২৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। আজ দুর্গাসপ্তমী। কলকাতার থেকে দূরে মফঃস্বল শহরের ছোট্ট এই গ্রামের সম্পন্ন পরিবার চৌধুরীদের সব চেয়ে বড় উৎসব এই দুর্গাপূজো। তাই পূজোর এ ক’দিন প্রবল উৎসব আনন্দের আয়োজন সে বাড়িতে। শরতের সকালে হাওয়ায় শীতের সামান্য ঠাণ্ডা আমেজ। থেকে থেকেই ঢাকের আওয়াজ আসছে দূর থেকে। ঢাকিরা বেরিয়েছে তাদের দুর্গাপুজার পার্বণী আদায়ে। এ গ্রামের এটাই রেওয়াজ। দশমীর দিনেও বেরোবে আবার তারা।

    অমিতবরন বা পুজু তখন ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে পাঞ্জাবি পরছে। হালকা দুধে আলতা মেশানো রঙের পাঞ্জাবি – মায়ের পছন্দের রং। কেন যেন সপ্তমীর এই সকালে পাঞ্জাবির রঙটা তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আকাশে আজ মেঘ রৌদ্রের লুকোচুরি। সকালে সোনার বরণ রোদ ছিল। এখন আবার সূর্যদেব লুকিয়েছেন মেঘের আড়ালে। মনটা চাঙ্গা করতে সে উজ্জল রঙের পাঞ্জাবি খোঁজ করতে থাকে জানলার পাশে রাখা আলমারিতে।

    পাঞ্জাবি পরে সে বাইরের এসে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির হাতা ধীরে ধীরে সযত্নে ভাঁজ করে গোটাতে থাকে। তিন ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে উঠোন। চোখ যায় রান্না ঘরের বাইরে মাটির দাওয়াতে বেতের বোনা আসন পেতে সব সকালের জলখাবার খেতে বসেছে। কারো পাতে খই মুড়কি নাড়ু মোয়া, কারো কানা উঁচু কাসার থালায় গরম ধোঁয়া ওঠা লাল চালের ফ্যানাভাত আর ঘি। পাশে কমলা রঙের কুমড়ো সেদ্ধ। ঘরের মধ্যেও পাত পড়েছে। কিন্তু পূজোর এই কটা দিনে এ বাড়িতে প্রায় ৪০/৫০ জনের পাত পড়ে। তাই বাইরেও সবাই বসে গেছে। সবাই এসেছে পূজো বাড়িতে। পিসিরা কাকারা তাঁদের ছেলেমেয়ে সহ এসেছে। এমনকি পিসিমা কাকিমাদের শ্বশুর বাড়ির ছেলেমেয়েরাও রয়েছে তাঁদের মা বাবাদের সঙ্গে। পুজুরা এসেছে জ্যাঠামশায়ের কাছে নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে। প্রতিবারই আসে কয়েক দিনের জন্য।

    নজরে পড়ে ছোট্ট পাঁচ বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে। পুজু যেখানে দাঁড়িয়ে তার দু ধাপ সিঁড়ির নিচের কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে জলখাবারের দিকে। চোখে খিদে। ময়লা জামা আর ততধিক ময়লা একটা খাটো সালোয়ার পরা। নাকে সিকনি। ময়লা লালচে জট পাকানো উসকোখুসকো চুলে দুটি বিনুনি করা। এই শরতের সকাল, এই ঢাকের আওয়াজ, এই উৎসবের দিন, সকালের এই গরম ভা্‌ত ঘি এর সুগন্ধভরা স্বচ্ছল খুশির পরিবেশে সে যেন এক মূর্তিমতি ছন্দপতন।

    রান্নাঘরের উল্টোদিকে বড় ঘরের বারান্দায় মলিন বেশে বৃদ্ধ রজব কাকা বসে আছে জ্যাঠামশাই এর সঙ্গে। কি সব লেখা পড়া হচ্ছে। তার মানে রজব কাকা হয় নতুন ধার নিচ্ছে নয়তো পুরনো ধারের কিস্তি শোধ করতে এসেছে। পুজু চেনে রজব কাকাকে, জ্যাঠামশায়ের জমিতে কাজ করে ।জ্যাঠামশাই এর এই মহাজনী ব্যাবসা আছে। পুজু জানে।

    - এই মেয়েটা কী নাম রে তোর ?

    পাঞ্জাবির একটা আস্তিন ঠিক করে পুজু অন্যটায় মন দেয়। মেয়েটা জ্বলজ্বলে চোখে তাকায় পুজুর দিকে। হাত দিয়ে দেখায় রজব কাকার দিকে।

    - ও রজব কাকার সঙ্গে আসা হয়েছে?
    - হ্যাঁ ।
    - কী নাম?

    অস্ফুট স্বর শোনা যায় উত্তরে।

    ঢাকের আওয়াজ ওঠে বাড়ির বাইরে পূজো মণ্ডপ থেকে। পুজু সেদিকে পা বাড়িয়েছে ততক্ষনে।

    - পুজু মণ্ডপেই থাকিস। প্রণাম করবি । প্রতিমা খাটে ওঠানোর সময়ে তুইও ধরবি কিন্তু। এটা আমার ইচ্ছে এবার। সকালে উঠেই চান করে রেডি হয়ে নিবি।

    মায়ের গলায় আদেশের সুর ছিল, ছিল কিছুটা উৎকণ্ঠাও ।

    - হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। ভেবো না তুমি বলেছিল পুজু।

    পুজু জানে মা ওর এবছরের হায়ার সেকেন্ডারি এক্সামের জন্য এসব বলছিল।পুজু জানে পড়াশুনোয় ও ফ্যামিলির যাকে বলে একেবারে ব্ল্যাক শিপ। তাই মায়ের এতো ভয়। যেন এগুলো করলেই ওর সাকসেস একেবারে অবধারিত।পুজুর কিচ্ছু বলার নেই। মার বিশ্বাসে আঘাত করবে না সে। বিশেষ করে এ বছর।

    মাকে আজ হতাৎ খুব ভোরে দেখেছে পুজু। পূজোর জন্য সকালেই মা চান করেছে আজ। পাটভাঙা নতুন লাল পেড়ে শাড়ি পরে পূজোর কাজ করার জন্য মণ্ডপে যাবার আগে পুজুকে ডেকেছিল। পুজু তখন ঘুমুচ্ছিল। মার চুলে তখনো দু এক ফোঁটা জল। কপালে লাল টিপ। মায়ের ঠাণ্ডা হাতটা পুজুর গায়ে। মায়ের গায়ে সেই চির পরিচিত মা মা গন্ধ। পুজু ইচ্ছে করেই আবার চোখ বুজিয়ে রেখেছিল যাতে মা আরেকটু সময় ধরে পুজুর কাছে থাকে। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? পুজুর কী ভাগ্যি তার মা আছে।

    পূজামণ্ডপের সামনের বিরাট চারকোণা উঠোনে দাঁড়িয়ে পাট দিয়ে দড়ি পাকাচ্ছিল সবাই। সে তো দড়ি নয়, প্রায় কাছির মত মোটা এ দড়ি; যা দিয়ে অনায়াসে বাঁধা যায় বড় বড় নৌকো বা ইচ্ছে করলে ছোট খাটো মোটর লঞ্চও নোঙ্গর করা যায়। এরকম মোটা মোটা দড়ি লাগবে প্রায় ডজন খানেকের বেশী। চাঁদোয়া বা সামিয়ানা টানাতে লাগবে। সেই বিশাল চারকোণা সাদা সামিয়ানা এইমাত্র শঙ্কর কাকুর বাড়ি থেকে আনা হয়েছে। চারজন সবচেয়ে শক্ত চেহারার ছেলে কাঁধে করে এনেছে। এটা গুটিয়ে রাখা থাকে সারা বছর কাকুর বাড়িতে। পূজোতে বের করা হয়।

    - পুজু হাত লাগাবি নাকি? মনা জিজ্ঞাসা করে।

    - হাঁ আছি।

    দড়ি পাকানো হয়ে গেছে। এইবার সবাই হাত লাগিয়ে গুটনো সামিয়ানা খুলে ফেলে । বিশাল সাদা সামিয়ানার চারধারে পেতলের বড় বড় আংটা লাগানো। মোট ১৬ টা আংটা। ওই আংটার ভেতরে দড়ি পরিয়ে উঠোনের চারধারে লাগানো খুঁটির দিকে সে দড়ি হৈ হৈ করে পুজুরা টেনে নিয়ে গিয়ে তার মাথায় লাগানো হুকের সঙ্গে টান করে লাগিয়ে দিল।

    - মাঝখানটা তবু ঝুলে আছে যে। একজন চেঁচায়।

    সুতরাং সেখানে আরও একটা খুঁটি দিয়ে উঁচু করা হোল। চাঁদোয়া এখন টান টান হয়ে আকাশ ঢেকে ঝুলে আছে । সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হাততালি। পুজু পাঞ্জাবির গায়ে লেগে যাওয়া ধুলো ঝাড়ে।

    চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে পুজুর তাকাল ওপরের দিকে। সাদা ধারগুলো লাল শালুর কাপড়ে মোড়া। ধবধবে সাদা চাঁদোয়ার মাঝখানে টকটকে লাল শালুর আলপনা।সূর্যের আলো পড়ে খুশিতে যেন হাসছে।

    আওয়াজ উঠলো ‘দুর্গা মাঈ কী - জয়’। ঢাক বেজে উঠলো তুমুল কান ফাটানো শব্দে। একটু পরেই প্রতিমা খাটে তোলা হবে। মণ্ডপের বারান্দা পেরিয়ে আরও উঁচুতে মূল মণ্ডপ। সেখানে একচালার বিশাল প্রতিমা দাঁড় করানো রয়েছে। সেই প্রতিমাকে ধরাধরি করে একপাশে সরানো হবে।তারপর একটি কাঠের চৌকির উপর প্রতিমা রাখা হবে বা প্রতিমার অধিষ্ঠান হবে। তার জন্য তোড়জোড় চলছে। এটা রীতিমত গুরুত্বপূর্ণ এক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পুজোর আগের পর্বের। লোকের বিশ্বাস এই খাটে ওঠানোর ব্যাপারে হাত দিলে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। ফলত সবাই হাত লাগাতে যায়। হাত সরাসরি না দিতে পারলেও যারা ধরেছে তাঁদের ছুঁয়ে থাকলেও হয়। আবার তাঁদেরও ছুঁয়ে থাকে আরও দূরের লোকজন। হুড়োহুড়ি পড়ে যায় একেবারে। ছোঁয়াছুঁয়িতে ভিড় থাকে জমাট বেঁধে।

    মণ্ডপের বারান্দা ভর্তি হতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। মণ্ডপের ভেতর দিকে প্রতিমা ঘিরে প্রচুর লোক। সময় লাগবে অনেক এই পর্বের শেষ হতে। পুজু ঘড়ির দিকে তাকায়।

    - আমায় ডিম ভাজা কিনে দাও না? শুনে পুজু চমকে তাকায়।

    ওমা! কখন সেই রজব কাকার সঙ্গে আসা বাচ্চা মেয়েটা এসে তার ময়লা হাত দিয়ে পুজুর পাঞ্জাবির কোণা মোচড়াচ্ছে আর ওর দিকে মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে। হাত ভর্তি ভীষণ নোংরা কালি পুজু লক্ষ করল। নাকের সিকনি এখন শুকনো দাগ হয়ে তার হাতের পিঠে।

    পুজু তাড়াতাড়ি ওর পাঞ্জাবীর কোণা ছাড়িয়ে নেয়।

    - যা! দিয়েছে নোংরা করে। সদ্য গোঁফের রেখা কামানো জিমে যাওয়া সুদর্শন পুজুর মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ওঠে। লালচে হলুদ রঙের খাদির শৌখিন জামায় ততক্ষনে কালচে দাগ।

    - ও ফেলি। রজব কাকার নাতনী। ওর মা নেই। কেউ দেখেও না । ওইরকম ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। পাশ দিয়ে কানাই যেতে যেতে বলে।

    - কী ব্যাপার? কী বলছিস?

    আবারো জামায় টান পড়তে বিরক্ত পুজু বলে ওঠে।

    - দেও না ডিম ভাজা কিনে। সে বলে ওঠে।

    ফেলির চোখের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠতে গিয়েও চুপ করে যায় সে। মেয়েটার খিদে পেয়েছে।

    - কোথায় ডিম ভাজা?

    - ওই যে দুকান। মেয়েটা পুকুর পাড়ে সার দিয়ে বসা দোকানের দিকে নির্দেশ করে।

    - কিন্ত দোকান তো খোলে নি এখনো।

    - খুলেছে তো। ওই যে ।

    হ্যাঁ পুজুর নজরে পড়ে । প্রতিবারের মতই সাধু কাকার ডিম ভাজার দোকান খোলা।

    - চল। বলে সেদিকে এগোয় পুজু ফেলির সাথে দূরত্ব রেখে।

    আশেপাশে সব বালখিল্যরা ঘুরঘুর ঘুরঘুর করছে ডিম ভাজার গন্ধে। কয়েকজনের হাতে অমলেট এসে গেছে কলাপাতায়। বাকীরা অধীর অপেক্ষায়। কয়েকজনের হাতে রঙিন পটকা বাজি । মানে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় আমলকী সাইজের গোল বারুদ ভর্তি বল একটা সরু শক্ত লাঠির মাথায় আটকানো। ওই কাঠিটা কোন শক্ত সিমেন্টের বা কাঠের ওপর জোরে মারলে বিকট আওয়াজ করে বারুদ ভর্তি বলটা ফেটে যায়। ধোঁয়া ওঠে। ছেলেমেয়ে গুলো নিজেরাও বিকট চেঁচিয়ে আনন্দে লাফাতে থাকে। ফেলি এই কীর্তি দেখছে খুব মন দিয়ে । মুহূর্ত পরেই সে বলে ওঠে ।

    - ওটা কিনব। ওই যে বাজি পটকা।

    কী ফ্যাসাদেই যে পুজু পড়েছে ফেলিকে নিয়ে । কিছু বলতেও পারছে না আবার। কোথায় যে বাধছে তাও বুঝতেও পারছে না।

    - এই যে পুজু দেখছি। কবে আইলে? বাবা মা এইছে? সাধুকাকা ফ্রাইপ্যানে একটা ব্রাশ দিয়ে এই এত্তটুকুন একটু তেল সারা প্যানে ঘসতে ঘসতে বলে।

    - না সাধুকাকা। আসতে পারে নি এবার। তুমি এই বাচ্চাটার জন্য একটা বানাও দেখি । আমি ওর পটকা বাজি নিয়ে আসি।

    - অ ফেলি নাকি? ফেলির জন্যি? ঠিকাছে বানাই । তুমি তাইলে ইবার একাই আইছো ? সেয়ানা হইছো। জব্বর খুশির কতা। সাধুকাকা ডিম গুলতে গুলতে বলে।

    পুজু এগোয় সামনে কাজলের দোকানের দিকে। মাটির ওপরে পলিথিন পেতে তার ওপর মোটা শতরঞ্চি পেতে কাজল পটকা বিক্রি করছে। ওখানে যেতে না যেতেই ফেলি হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

    - লাল গুলান নেবো। লাল গুলান নেবো। বলে নিজেই উবু হয়ে বসে লাল পটকা বাছতে থাকে।

    - কবে এলে পুজু?

    পেছন ফেরে পুজু। বীরেনদা।

    - কাল দুপুরে।

    - একাই ? কাকু কাকিমা আসেন নি?

    - না। বাবা অফিসের কাজে বম্বের খাণ্ডালায়। তাই মাও আসতে পারলেন না।

    - সত্যি সম্বচ্ছরের দিন, তাও কাকু আটকে গেলেন অফিসের কাজে? খুব খারাপ । তা তোমার খবর কী ? পার্ট মুখস্ত হোল? আজ সন্ধ্যায় রিহার্সাল। মনে আছে তো? দ্বিজেনদা কিন্তু কান মুলে দেবে পার্ট মুখস্ত না বলতে পারলে।বুঝলে? আচ্ছা দেখা হবে সন্ধ্যায়। বলে লাল পাতলা ঠোঁট ছড়িয়ে হাসতে হাসতে রোগা ফর্সা মধ্য তিরিশের বীরেনদা যেতে যেতে বলে।

    হ্যাঁ সংলাপ মনে আছে পুজুর। পোষ্টে সে তার সব সংলাপ পেয়ে গেছে কলকাতায় বসে দু মাস আগেই।

    ‘বৃথা ভয়ে ভীতা তুমি মাতা,
    তুমি রাজ নন্দিনী অজেয়া সমরে, প্রজা রক্ষক,
    তবু সদা এতো বিচলিত পুত্র ব্রভ্রূ তরে?

    ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটক হবে। কার লেখা কে জানে। সে ব্রভ্রূবাহন । চিত্রাঙ্গদার পুত্র। এই বীরেনদা সাজবে চিত্রাঙ্গদা। দেখতে মেয়েদের মত সুন্দর। ফাটাফাটি অ্যাকটিং তার।গত বছর দেখেছে। বনবাস নাটকে সীতার ভুমিকায়। পুজুর চোখেও জল এসে গেছিলো।

    দুহাতে যত গুলো পারে বাজি নিয়ে উঠে পড়েছে ফেলি।

    দাম মিটিয়ে পুজু ফেরে। দূর থেকে ওদের ফিরতে দেখেই সাধুকাকা ততক্ষনে ওদের জন্য অমলেট ভাজার জোগাড় শুরু করেছে। ছোট্ট একটা টিনের গ্লাসে ডিম ভেঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে একটা চামচ দিয়ে গুলছে। ঝিরঝেরে করে কাটা লাল পেঁয়াজ, সামান্য লঙ্কা কুচি আর নুন দিয়ে উনুনে রাখা তেল মাখানো গরম ফ্রাইপ্যানে ঢেলে দেয়। যেন বিস্ফোরণ ঘটে। অমলেটের সুগন্ধে আশেপাশের হাওয়া ভরে ওঠে। খাবে নাকি একটা, ভাবে পুজু । খিদেটা তো বেশ চাগিয়ে উঠেছে এতক্ষণে।সকাল বেলাতেও লাল চালের ফ্যানাভাত উইথ গাওয়া ঘি মিস করেছে এই ঠাকুর খাটে ওঠা ব্যাপারটার ফ্যাঁকড়ায়। না থাক, একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুজু। এবছরটা খুব খাটুনি যাচ্ছে, অনেক কিছুই ছাড়তে হয়েছে। না হয় আরও একটু কষ্টই করল সে। আর তো বেশী দেরি নেই মনে হয়। প্রতিমা এখনই খাটে উঠবে। তারপরে খেয়ে নেবে সে।

    গরম অমলেট ততক্ষনে ফেলির হাতে। কলাপাতায়। মুহূর্তে মুখেও চলে গেছে অনেকটা। মেয়েটার খিদে পেয়েছিল খুব। পটকা বাজি পুজুর হাতে। থিয়েটার ঘরের স্টেজের সামনের সিমেন্টের উঁচু ভিতের দেওয়ালে ততক্ষনে দুমদাম দুমদাম আওয়াজে পটকা ফাটছে। সব বালখিল্যরা মহানন্দে মহা উল্লাসে পটকা ফাটিয়ে যাচ্ছে। ফেলি বাকি অমলেট মুখে চালান করে তড়িৎগতিতে বাজি নিয়ে ভিরে যায় সেখানে।

    পুজু এগোয় তাড়াতাড়ি পূজোমণ্ডপের দর দালানের দিকে।মণ্ডপের দাওয়া ভিড়ে ভিড়াক্কার। পিসি কাকিমারা সব চলে এসেছেন স্নান করে নতুন শাড়ি আর গয়নায় সেজে। তরুণী দিদিরাও আছে সে দলে । সেখানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। লম্বা পুজু উঁকি দিয়ে দেখে ভেতরে। দাদারা সব হাতকাটা নতুন গেঞ্জি আর ধুতি পরে বাইসেপস দেখিয়ে ভেতরে প্রতিমার কাঠামোতে মোটা মোটা দড়ি আটকাতে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু তার মধ্যেই তাঁদের ট্যারা চোখের লুকনো দৃষ্টি দিদিদের দিকে ঘুরে যেতে ভুলছে না ।

    - দুর্গা মাঈ কী ......

    - জয়। প্রচণ্ড গগন ভেদি ধ্বনিতে চারদিক যেন ফেটে পড়লো।সঙ্গে ঢাকের প্রবল সঙ্গত।

    ইস! খুব দেরি হয়ে গেছে । এখন কী করে ভেতরে ঢুকবে সে? সামনে শুধু অগনিত মাথা।আসে পাশে চারদিকে। পুজু এবার রীতিমত শঙ্কিত।

    - পুজু এগিয়ে যা। এগিয়ে যা। এখনো সময় আছে।

    কে যেন বলে উঠলো পুজুকে।

    ওহ! তাহলে এখনো সময় আছে? দেরি হয় নি ।

    ছিলা-ছেঁড়া তিরের মত পুজু সামনের দিকে প্রাণপণ শক্তিতে এগোতে গিয়ে আটকে যায় । জামায় টান পড়ে জোরে। জড়িয়ে যায় কেউ পায়ের দিকে।

    - আমায় কোলে কর। আমায়...... আমি ঠাকুর দেখব ।

    - ফেলি। পুজু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।।

    নিচে পায়ের দিকে এক জোড়া উত্থিত কচি হাত। টলটলে করুণ আকুতি ভরা চোখ।শেষ জয়ধ্বনি তখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত চারদিকে প্লাবিত করে উঠে পড়েছে। মুছে যাচ্ছে ধীরে ক্ষণপূর্বের কঠিন বালুকাবেলার অস্তিত্ব। প্রতিমার সজ্জিত চালচিত্র সামনে পেছনে পাশে টাল খেতে খেতে ধীরে ধীরে মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যেন সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসছে। প্রতিমা খাটে উঠে যাচ্ছেন।

    এদিকে পুজুর বুকের কাছে পাঞ্জাবির অবস্থা করুণ থেকে করুণতর।

    প্রবাসী ২০২১ এ প্রকাশিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Parijat | 1.129.***.*** | ১৪ অক্টোবর ২০২১ ০৩:৫১735036
  • ভীষণ  ভালো লাগল শাশ্বতী দি। 
  • Saswati Basu | ১৪ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৩০735041
  • শুভেচ্ছা নিও 
  • Sanjucta | 2402:a040:23e:3f72:cd8b:a70d:6211:***:*** | ১৯ অক্টোবর ২০২১ ১৪:১৫735049
  • খুব সুন্দর  লিখেছো দিদি ...
  • Saswati Basu | ২৭ অক্টোবর ২০২১ ০৩:১২735067
  • শুভেচ্ছা রইলো 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন