এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  আলোচনা   বই

  • সেলিনা হোসেন আর যাপিত জীবন 

    Tanima Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ০৪ জুলাই ২০২১ | ১৮০০ বার পঠিত
  • ১৯৪৭ এ বাংলাদেশের রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করছেন সেলিনা হোসেন। আর সাতচল্লিশের দেশভাগের দাঙ্গায় ভারতের বহরমপুরের বোটানির শিক্ষক আর শখের আয়ুর্বেদ নিয়ে চর্চাকারী সোহরাব আলি তার পরিবার নিয়ে পার হয়ে আসছেন মহানন্দা, সেখানে থেকে গরুরগাড়িতে আমানুরা।তারপর ট্রেনে ফুলবেড়িয়া, সেখান থেকে রিক্সায় এক অজানা শহরে এক অজানা কারুর গাছপালাঘেরা আধা নোনাধরা বাড়িতে। এইটুকু সফরে সময় লেগেছে তাঁদের পাঁচদিন। তাঁরা মানে সোহরাব আলি, তাঁর স্ত্রী আফসানা খাতুন আর তাঁদের তিন ছেলে মারুফ, জাফর আর দীপু।। সাথে তেমন কিছু নেই, সামান্য কাপড়চোপড় আর সামান্য কিছু বই রবীন্দ্রনাথের আর আয়ুর্বেদ বিষয়ক।। 


    এটুকু সম্ভব হয়েছে সোহরাব আলির বন্ধু দীপেনের সহায়তায়। কাঁটাতারের এপারে এই অচেনা  দেশ তাঁদের পক্ষে নিরাপদ।  এখানে কেউ তাঁদের রামদাঁ নিয়ে, ছুরি নিয়ে তেড়ে আসবে না, তাঁদের ধর্ম ইসলাম সেই অজুহাতে। 


    তবু কেন কান্না পায় তাদের ছেড়ে আসা নিজস্ব ভিটেটুকুনের জন্য। মনে হয় এদেশ তাদের নয়, এদেশে তাঁরা মুহাজির, তারা রিফিউজি।। 


    তবুও এমনই এক শিকড় উপড়ানো সর্বহারা ব্যথার রাতে, অচেনা মালতীর হাতের রান্না গলা দিয়ে নামে যেন অমৃত,কপালে লেপ্টে থাকা সিঁদুরের ফোঁটা যেন একখন্ড মেঘ।। অথচ পালায়নি ঠিকই কিন্তু মালতী আর হরেন এখন তার নিজেরই দেশ বাংলাদেশের মাটিতে  হিন্দু হবার অপরাধে বিপন্ন, শরণার্থী।। 


    দেশ তবে কি?  একখন্ড মাটি, নাকি একমুঠো ধর্ম, যা মানুষের ভিতরে সৃষ্টি করে অন্য মানুষ, বিশ্বাসের ভিতর গজিয়ে তোলে হিংসার কালো  ছত্রাক। সে ছত্রাক কি একটি গোষ্ঠীর আত্মরক্ষার ওষুধ নাকি আত্মহননের অসুখ ।। 


    সেলিনা হোসেন যিনি জন্ম নিচ্ছেন ১৯৪৭ এ, তিনি এসব কথা লিখছেন ২৯ শে অক্টোবর ১৯৭৭ থেকে ৩০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ অব্দি। আবার মনে হলো যেন ঠিকমতো লেখা হল না, ঠিকমতো ব্যথাগুলি,সুখগুলি,বোধগুলি,


    দুর্বোধ গুলি,প্রেম গুলি,হিংসাগুলি, ত্যাগগুলি, স্বার্থপরতাগুলি ফুটে উঠলো না ঠিক বুননে। তাই মুছলেন, আবারও লিখলেন ১৯৮৭ সালে। তারপর ২০১২ সালে ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্ণ হবার প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হল, এই উপন্যাসটির অনুপুঙ্খ বিবরণ আরও একটু বিস্তৃত পরিসর দাবি করে। তাই জুড়লেন আরও একশ পাতারও বেশি।। 


    এই যে নির্মাণ এবং নির্মাণ ঘিরে বিনির্মাণ, এই যে একটা উপন্যাসের আখ্যান তাড়িয়ে নিয়ে ফেরে লেখিকার সত্ত্বা, যে  সত্ত্বা জন্মদানের পরেও আরও তালিম দেয় পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠবার জন্য।। 


    এই বিনির্মাণ কোনো না কোনো জায়গায় যেন সোহরাব আলিরই যাপিত জীবন।। 


    কাঁটাতারের এপারে এসে যার পরিচয় বদলে যায়, যাপন বদলে যায় শিক্ষক থেকে চিকিৎসক এ, কিন্তু অর্ন্তভুক্ত আদর্শ বদলায় না। সে আদর্শ মানুষকে মানুষ দেখে, তার জাত ধর্ম দেখে না।। তার মুখের ভাষা কাঁটাতারের এপারে ওপারে একই স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ পাহারা দিতে দিতে মানুষজনের সাথে আবেগের দেওয়া নেওয়া করে। সে পাহারাদারির নেশা তার ছেলেদের চোখে লাগে,  যে চোখ কাঁটাতারের অনেক উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখে, মন্দির মসজিদ এর দরদালান পেরিয়ে মানুষের ক্ষুধা দেখে, রোগের ব্যথা দেখে, প্রেমের আশ্রয় দেখে, অন্যায়ের দাসত্বের মুক্তি দেখে  ।। 


    যে মানুষ স্বপ্ন না দেখে ঘুমাতে পারে না  তার শিকড় আবারও অন্যমাটিতে খানিক ঝামরে থাকার পরে কান্ডের কোটরে পত্রমুকুলের ঘুম ভাঙ্গায়। পুষ্পের কন্ঠে মধু জমা করে, শাখায় পাখপাখালিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে বাসা বাঁধার জন্য।। 


    কিন্তু কেমন সেই বাসা? বাসার মানে কি সবার জন্য এক?  কেউ নিজে একা বেঁচে সুখ পায়, কেউ সবাইকে নিয়ে না বাঁচলে তৃপ্ত হয় না।। 


    এই সবাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য সোহরাব আলির গাছগাছালির ঔষধ, গাছগাছালির পথ্য, আয়ুর্বেদ এর হাসপাতাল তৈরি করে নিত্য মরা অভাগাদের প্রাণের শেকড়টুকুনকে সেবা দিয়ে, স্নেহ দিয়ে  মাটিতে পুঁতে রাখা।। 


    দেশ তবে কি?  মাটি, নাকি মানুষ, নাকি ধর্ম, নাকি ভাষা নাকি সবকিছু মিলিয়ে এক অপূর্ব যৌগ।। 


    যে ধর্মভেদ নিয়ে দেশভাগ,  মারুফ আর মণিকার ভালবাসার  ছাড়াছাড়ি সেই  ধর্মই কি সুমনার  স্বামীকে অত্যাচারী না হয়ে  ভালবাসার রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারে ?  কই পারে না তো। তাই তো ধর্মের তলোয়ার কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে যায়  দীপকদের গোটা পরিবার। তার বোন চিত্রা  ছেঁড়া রক্তজবার মতো ধর্ষিতা হয়ে মরে পড়ে থাকে জবাগাছের নীচে। 


    সেই বীভৎস দৃশ্য কেন  জাফরের অন্তরাত্মার দরজা জানালা ধরে ভূমিকম্পের মতো নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কারণ সে ধ্বংস এক হেরে যাওয়া।। সে হেরে যাওয়া মানবতার হেরে যাওয়া। সে হেরে যাওয়া ভালবাসার টুঁটি টিপে হিংসার উল্লাস।  যে ছেলে প্রেমিকার ডাকনামে কখনো চকখড়ি, কখনো কৃষ্ণচূড়া, কখনো রোদের বিকেল, কখনো মধুমাস, কখনো শীতের বেলা সে ছেলে কেমন করে ডাকনামে হয়ে ওঠে চোখের জল, কি করে হয়ে ওঠে হৃদয়ের বারুদ।  তবুও সে তার বুকভরা স্বপ্ন।। 


    যে স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না, কিন্তু অনেক স্বপ্নের ফুলকি তৈরি করে দিতে পারে। । 


    ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে দাবি জানিয়ে আসেন শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির অধিবেশনে, সে দাবির আগুন ধিকিধিকি জ্বলে ওঠে ছাত্রসমাজের  ভিতরে ভিতরে।  


    যে দেশের নদীর নাম কীর্তনখোলা, ইছামতী,  সে দেশেরই নদীর নাম আগুনমুখা, মাথাভাঙ্গা। ভাষা কি ডাকনামে ডাকে নদীকেও, যখন যেমন মনের ভাব, যখন যেমন মনের রাগ?  


    দেশ তবে কি?  সে কি মারুফের পূর্ব প্রেমের ব্যথা কাটিয়ে  আবার স্বামীঅত্যাচারিতা সুমনার সাথে ঘর বসানো আর সন্তানের জন্ম দেবার গল্পের মাটি?  নাকি সোহরাব আলির দারিদ্র্যে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া অভাগাদের বাঁচিয়ে রাখার মন্ত্রে গড়ে তোলা হাসপাতাল?  নাকি আফসানা খাতুনের তিল তিল করে আবার ফুটিয়ে তোলা কাঁথার ফোঁড়ের মতো, স্নেহের সন্তানগুলির নিজ নিজ ব্যাক্তিত্বে বেড়ে উঠে কোলছাড়া হয়ে যাবার গল্পের ফুলকাটা রেকাব?  নাকি দীপুর বাবার সাথে মায়ের সাথে বাগানের গাছ চিনতে চিনতে, স্বাদু খাবার আর খেলনার বায়না করতে করতে  হঠাৎ গোঁফ গজিয়ে  বড় হয়ে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পা মেলানোর  হাঁসুলি বাঁক, নাকি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সওয়াল জবাবের দৃঢ়  পেশকশ।। 


    নাকি জাফরের মতো একটা ছেলের মজবুত  প্রতিবাদী শক্ত চোয়াল। নাকি অনেক ইকবাল, প্রশান্ত, আঞ্জুম, যাদের আলাদা আলাদা নাম, আলাদা আলাদা দেহ কিন্তু আদর্শ এক, স্বপ্ন এক সেই সব নানা ডাকনামে অমর হয়ে থাকা।। 


     সেই স্বপ্নের নাম বাংলা হরফ, বাংলা অক্ষর, বাংলায় উচ্চারণ, যাতে সাংস্কৃতিক দাসত্বের বেড়ি নেই, অন্য হরফের কামড় নেই, সেই বেড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদিন হঠাৎ মধুমাস থেকে চোখের জল হয়ে যাওয়া।। 


     তারপর একটা আস্ত বুলেট খেকো কৃষ্ণচূড়া গাছ হয়ে সোহরাব আলির বাগানে, মুহাজির মাটিতে শিকড় চারিরে কান্ড হাঁকিয়ে ফুলে ফুলে ফুটন্ত হয়ে তীব্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকা।।  তাতে বিকেলের রোদ লাগে, শীতের সকাল আসে, আর আর বাংলা অক্ষরে অক্ষরে আগুন খেকো প্রেম  নির্মাণ বিনির্মাণ করে  যান সেলিনা হোসেন।। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন